মহাভারতের ঘরসংসার ১: বিয়াশাদি

Share this:

মহাভারতে অন্তত একটা পরকীয়া কাহিনী আছে। আবার বিবাহিত বৌ ভাইগা গিয়া অন্যের লগে সংসার কইরা বাচ্চাকাচ্চা জন্মদিবার পরে ফিরা আইসা সংসার করার ঘটনাও এইটা…

 

 

মহাভারত মূলত একখান গেরস্থালি উপখ্যানের সমাহার। জমিজমা নিয়া মারামারি কামড়াকামাড়ির লগে লগে এই পুস্তকটা বিয়াশাদি-জন্মদান কিংবা পোলাপানের লগে সম্পর্কের বিবরণেও রীতিমতো বিচিত্র-ব্যাপক…

কৃষ্ণ উপাখ্যানের কারণে এক বেটার একাধিক বৌ থাকার কথা সকলেই জানে; দ্রৌপদীর কারণে জানে এক নারীর বহুপতির কথা। কুন্তীর কারণে একাধিক পুরুষ দিয়া নারীর গর্ভসঞ্চার কিংবা দ্বৈপায়নের কারণে ভাইয়ের বৌরে গর্ভবতী করার কথাও সকলের জানা…

অন্যদিকে কর্ণ কিংবা দ্বৈপায়নের জন্মঘটনার কারণে যে কোনো তরুণীরে চাইপা ধইরা গর্ভবতী করায় বামুনগো অধিকারের স্বীকৃত প্রচলনগুলা মহাভারতের প্রাথমিক পাঠ্য উপাদান। তাই এইসব বিষয়ে কথা না বাড়াই…

দ্রৌপদী আর উত্তরার বিবাহ দুইটা রীতির দিক থাইকা মহাভারতের অন্যসব বিবাহ থাইকা ভিন্ন। প্রথমতো; এই দুইটা বিবাহই ঘটছে কইন্যার বাড়িতে। মহাভারতের বাকিসব বিবাহ ঘটছে হয় বরের বাড়ি না হয় কোনো নিরপেক্ষ স্থানে…

সময়কালের হিসাবে উপমহাদেশে কইন্যার বাড়িতে বিবাহের আয়োজন তুলনামূলক নতুন সংযোজন। পুরানা সিস্টেমে বিয়া হইত বরের বাড়ি। রামায়ণে রাম-সীতার বিবাহও ঘটে কইন্যার বাড়িতে; আরো কিছু উপাদানের লগে রামায়ণরে মহাভারতের পরের ঘটনা হিসাবে যারা দেখাইতে চান তারা এই কইন্যা-বাড়ির বিবাহের কথাটাও খাড়া করেন যুক্তি হিসাবে…

কুন্তীরও স্বয়ংবরা হইছে বাপের বাড়ি কিন্তু পাণ্ডু তারে বিবাহ করছে নিজের বাড়ি আইনা। স্বয়ংবরায় দ্রৌপদীরে জিতার কালে নিজের বাড়ি নামে অন্তত একখান কুড়েঘর আছিল অর্জুনের; রাজকইন্যা দ্রৌপদী বিয়ার আগে-পরে সেইখানেই থাকে। কিন্তু তার বিবাহটা সেইখানে না হইয়া হইছে বাপের বাড়ি…

উত্তরার বিবাহের সময় পাণ্ডবরা বৈতল হইলেও বিবাহের পাত্র অভিমন্যুর কিন্তু থান আছিল; মামার বাড়িই আছিল তার বাড়িঘর; কিন্তু বিয়াটা সেইখানে হয় নাই; হইছে পাত্রীর বাপের বাড়ি…

দ্রৌপদী-উত্তরার বিবাহগুলা আরেকটা কারণে অন্যগুলা থাইকা আলাদা; সেইটা হইল পাত্রীপক্ষ কইন্যাদান করার পর কার লগে কইন্যার বিবাহ হবে সেইটা ঠিক করে পাত্রের পরিবার…

দ্রুপদ অর্জুনের হাতে মাইয়া দিবার পর দ্রৌপদীর বিবাহ করতে হবে পাঁচ জনরে; এই সিদ্ধান্ত করে কুন্তী আর যুধিষ্ঠির। এইটা নিয়া পরে দ্রৌপদীর বাপ-ভাই বহুত মুলামুলি করলেও সিদ্ধান্ত কিন্তু বদলায় না…

অন্যদিকে মৎস্যরাজা বিরাট কইন্যাদান করে অর্জুনরে; আর অর্জুন ঠিক করে উত্তরারে বিবাহ করব তার পোলায়…

এই ঘটনায় মনে হয় বাপের পাত্রীরে পুতের বিবাহ করতে কোথাও কোনো সামাজিক খচখচানির অস্তিত্ব আছিল না তখন…

মহাভারতে ভীম-হিড়িম্বার বিবাহটা প্রেমের…

অর্জুন-সুভদ্রার বিবাহ ভাগল দিয়া। এইটা কাজিন বিবাহ। সুভদ্রা অর্জুনের মামাতো বইন। সহদেবের বৌ দ্যুতিমৎ বা বিজয়া আছিল তার মামাতো বইন; মদ্ররাজ শল্যর মাইয়া। কৃষ্ণের এক বৌ মিত্রবিন্দও আছিল তার ফুপুতো বইন…

মহাভারতে চাচাতো ভাই-বইনের ভিতর বিবাহেরও একটা উদাহরণ আছে। সেইটা হইল ভীমের পোলা ঘটোৎকচের লগে অর্জুন-সুভদ্রার মাইয়া ভার্গবীর বিবাহ…

মহাভারতে কুমারীমাতার বিবাহের দুইখান বিখ্যাত উদাহরণ সত্যবতী আর কুন্তী। এর ভিতর সত্যবতীর কুমারীকালের সন্তানের ঘটনা আছিল প্রকাশ্য; অন্যদিকে কুন্তীর কুমারীকালের সন্তানের কথা সম্পূর্ণ চাইপা যাওয়ার চেষ্টা হইছে আগাগোড়া…

 

 

মহাভারতে বিধবা বিবাহের ঘটনা আছে একখান; উলূপী। অর্জুনরে বিবাহের আগে উলূপীর আরেকটা বিবাহ হয়; কিন্তু স্বামী মইরা যায়…

স্বামী থাকা অবস্থায় নারীরে বিবাহ করতে চাওয়ারও উদাহরণ আছে মহাভারতে…

ধৃতরাষ্ট্রের মাইয়া দুঃশলার স্বামী জয়দ্রথ একবার দ্রৌপদীর তুইলা নেওয়ার চেষ্টা চালায়। দ্রৌপদীর স্বামীরা জ্যান্ত জাইনাও সে কয় বিবাহ কইরা রানির মর্যাদা দিব তারে…

এতে মনে হয় বিবাহের পাত্রী হইবার যোগ্যতার ক্ষেত্রে নারীর বিবাহিত-অবিবাহিত- কুমারী কিংবা বিধবা কোনো বিষয় আছিল না ওই সমাজে…

বিবাহ কিংবা যৌনতার লাইগা পটানোর উদাহরণ মহাভারতে আছে প্রচুর। চিত্রাঙ্গদা অর্জুনরে পটায়। পরে আরেক অপ্সরা অর্জুনরে পটানোর চেষ্টা করে; অর্জুন রাজি হয় না। তবে পটানো চেষ্টার কারণে ক্ষ্যাপার কোনো ঘটনা মহাভারতে নাই; রামায়ণে আছে। রামায়ণে রাবণের বইন সুপর্ণখা লক্ষ্মণরে পটাইতে চায়। এর লাইগা লক্ষ্মণ রীতিমতো তারে শাস্তি দেয়; তার নাক-কান কাইটা ফালায়…

মহাভারতে বেশ কয়েকটা স্বয়ংবরার উদাহরণ আছে। সেইগুলাতে পাত্রীরা পাত্র পছন্দ করত হয় তার শান শওকতের বিবরণ শুইনা; না হয় পাত্র নির্বাচনের লাইগা থাকত বিভিন্ন রকমের যুদ্ধকৌশল কিংবা লড়াই কিংবা খেলার প্রতিযোগিতা। যে জিতত সেই পাইত মালা। আবার স্বয়ংবরা থাইকা প্রতিযোগিতার আগেই কোনো প্রার্থীরে অযোগ্য ঘোষণা করার ঘটনা আমরা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরায় পাই…

কিন্তু মহাভারতে একটা স্বয়ংবরা কিঞ্চিত ভিন্ন রকমের। সেইটা হইল নাগ বংশজাত কইন্যা অহিলাবতীর স্বয়ংবরা। এই স্বয়ংবরাটায় প্রতিযোগিতা আছিল বুদ্ধি পরীক্ষার। পাত্রী অহিলাবতী নিজেই পাত্রগো কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে আর সেইসব কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিয়া তারে জিতা নেয় ভীম-হিড়িম্বার পোলা ঘটোৎকচ…

সাধারণ বিবরণে ঘটোৎকচরে নির্বোধ একটা গতরসর্বস্ব রাক্ষস হিসাবে বর্ণনা দিলেও এই ঘটনা থাইকা তার বুদ্ধিরও কিছু ঝিলিক পাওয়া যায়। আর তার চাইতেও বড়ো কথা হইল শান্তনুর আস্ত বংশধারায় একজন মাত্র মানুষ পরবর্তীতে ঋষি হয়; সেইটা হইল ঘটোৎকচ-অহিলাবতীর পোলা বর্বরীক। তার মানে হিড়িম্বার এই গোষ্ঠীরে লঘুতুচ্ছ করলেও এই বংশে যে জ্ঞান-বিদ্যা চর্চার অভ্যাস আছিল তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়…

ঘটোৎকচের পোলা অঞ্জনপর্বা বেশ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা হিসাবেই কুরুযুদ্ধে অংশ নেয়। ঘটোৎকচের বাহিনীটাই আছিল কুরুযুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের প্রথম বাহিনী। আবার বাপ কাকারা সৎমায়েরে নিয়া বনবাসে গেলে সেইখানে গিয়া তাগো মালপত্র টানার কামও করতে দেখি ঘটোৎকচেরে। এমনকি সৎমা দ্রৌপদীর কান্ধে কইরা পাহাড়ে পর্যন্ত বইয়া নিয়া যায় সে…

উল্টা দিকে রাজসূয় যজ্ঞে দ্রৌপদী হিড়িম্বারে অপমান করলে একেবারে রাক্ষসের মতো হুংকার ছাইড়া সামনে খাড়ায় ঘটোৎকচ…

হিড়িম্বার মতো পরিবারগুলাতে সম্ভবত পারিবারিক বন্ধনের কাঠামো কিঞ্চিত ভিন্ন রকমের আছিল; বাপ মায়ের প্রতি পোলাপাইনের নির্ধারিত কিছু দায়িত্ব আছিল। যেইটা দ্রৌপদীর পোলাগোরে কিছুই করতে দেখা যায় না…

মহাভারতে অন্তত একটা পরকীয়া কাহিনী আছে। আবার বিবাহিত বৌ ভাইগা গিয়া অন্যের লগে সংসার কইরা বাচ্চাকাচ্চা জন্মদিবার পরে ফিরা আইসা সংসার করার ঘটনাও এইটা…

দেবগুরু ঋষি বৃহস্পতির বৌ তারা তার ছাত্র সোমের লগে ভাইগা যায়। এইটা নিয়া দেবতাপক্ষ আর বৃহস্পতি বহুত চোটপাট এমনি লাঠিসোঁটাও আয়োজন করেন। কিন্তু সোমরে প্রশ্রয় দিয়া বসেন অসুরগুরু শুক্রাচার্য। ফলে দেবতারা আর তারে নাড়াইতে সাহস করে না। সোমের লগে সংসার করতে থাকে তারা। তাগো একটা পোলাও হয়…

এই দিকে বৌ ফিরত পাইবার লাইগা বৃহস্পতি শুরু করেন কাকুতি মিনতি। পরে শুক্র সোমরে বলেন তারারে তার স্বামীর কাছে ফিরত দিয়া আসতে। সোম তার পুতেরে রাইখা তারারে তার আগের স্বামী বৃহস্পতির কাছে ফিরায়া দেয়…

এইখানে তারার মতামতের বিষয়ে কিছু জানা যায় না। তারা নিজেই পলাইছিল সোমরে পটায়া। পরবর্তীতে তারারে বৃহস্পতির লগেই সংসার করতে দেখা যায়। বড়োই মায়া দিয়া মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই তারার মনের কথাগুলা আঁকছেন তার বীরাঙ্গানা কাব্যে…

খুব সম্ভবত কচ তারারই গর্ভজাত সন্তান; যারে কৌশলে শুক্রের গোপন বিদ্যা শিখার লাইগা পাঠান বৃহস্পতি। রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ কাহিনী কাব্যের কারণে বড়োই আবেগের সহিত এই কচ বিখ্যাত বাঙালির মনে…

পৌরাণিক ঋষিগো ভিতর কচই সম্ভবত প্রথম এবং একমাত্র তাত্ত্বিক গুরু বা প্রফেসর। অন্যসব গুরুরা বিদ্যা শিখাইতেন এবং নিজেও প্রয়োগ করতেন। কিন্তু কচ কোনোদিন নিজের বিদ্যা নিজে প্রয়োগ করত না; খালি ছাত্রগো পড়াইত। যেইটারে রবীন্দ্রনাথ দেবযানীর মুখ দিয়া অভিশাপ আকারে ‘শিখাইবে, করিতে পারিবে না প্রয়োগ’ বইলা কচের ভাণ্ডারে জমা করেন বাঙালির আবেগ…

অন্য দিকে দেবগুরু বৃহস্পতিরই আরেকটা পরকীয়া কিংবা ধর্ষণের ঘটনায় জন্ম নেওয়া শিশুর বিষয়ে মা বা বাপ দুই জনরেই দায়িত্ব অস্বীকার করতে দেখা যায়…

একবার দেবগুরু বৃহস্পতি তার বড় ভাই উতথ্যের বৌ মমতারে ধর্ষণ করেন; অথবা মমতার লগে পরকীয়া যৌনতা করেন। সেই ঘটনায় জন্মায় শিশু ভরদ্বাজ…

নিজের স্বামীর পোলা না দেইখা ভরদ্বাজরে মমতা পাঠায়া দেন বৃহস্পতির কাছে। কিন্তু বৃহস্পতি ভরদ্বাজের দায়িত্ব নেন না; ফলে ভরদ্বাজরে পালা খাইতে হয় গ্রামবাসীর কাছে…

বৃহস্পতির এই মমতা-ধর্ষণ কিংবা মমতা-যৌনতার লগেই সম্পর্কিত আছে নারীগো স্বামীর অধীন করার আরেকটা সমীকরণ…

মমতার লগে যখন বৃহস্পতি যৌনতা করতেছিলেন; তখন তা দেইখা ফালায় মমতার কিশোরপুত্র দীর্ঘতমা। সে আইসা কাকুরে শুরু করে কিল লাথি মারা। এতে ক্ষেইপা গিয়া বৃহস্পতি দীর্ঘতমার দুই চোখ অন্ধ কইরা দেন…

পরে আন্ধা হিসাবেই বড়ো হয় দীর্ঘতমা। ঋষি হিসাবেও বেশ নামডাক হয় তার; সে বিবাহ করে প্রদ্বেষা নামে এক নারীরে। কিন্তু নিজে চোখে দেখত না বইলা যৌনতার ক্ষেত্রে কোনো চক্ষুলজ্জা আছিল না দীর্ঘতমার। যখন তখন যেইখানে সেইখানে সে বৌরে চাইপা ধইরা শুরু করত কাপড় টানাটানি…

প্রদ্বেষা এইটাতে আপত্তি জানায়। বিষয়টা সহ্যের সীমা পার হইয়া গেলে এক পর্যায়ে প্রদ্বেষা লোকজন দিয়া পিটায়া গাঙে ভাসায়া দেয় দীর্ঘতমারে…

গাঙে ফালাইলেও মরে না দীর্ঘতমা। বাইচা উইঠা আরো ঋষিগিরি করে আর ধর্মীয় মোড়কে বিধান দেয়; বিবাহিত নারীরে যে কোনো অবস্থাতেই থাকতে হবে স্বামীর ইচ্ছার অধীন। মানে স্বামী যা চায় তা যে কোনো অবস্থাতেই সে করতে বাধ্য…

নারীগো স্বামীমুখী করার পয়লা বিধানিক উদ্যোগটা অবশ্য আসে আরেকটু আগে ঋষি শ্বেতকেতুর হাতে। সেইটা আছিল বিবাহিত নারীর বহুগামিতা নিয়ন্ত্রণের বিধান…

উপনিষদের প্রথম দিককার প্রচারক শ্বেতকেতু ঋষি উদ্দালকের ক্ষেত্রজ পুত্র। মানে উদ্দালকের বৌর গর্ভে অন্য কোনো পুরুষের ঔরসে জন্মানো পোলা। শ্বেতকেতুর তরুণ বয়সে তার এবং উদ্দালকের সামনে এক ব্রাহ্মণ আইসা শ্বেতকেতুর মায়েরে যৌনতার লাইগা নিয়া যায়। এতে বিস্মিত শ্বেতকেতু উদ্দালকরে জিগায়- এইটা কী হইল বাজান?

উদ্দালক কন- এইটা বিধানের মইধ্যেই পড়ে। কোনো ব্রাহ্মণ কিংবা অতিথি যৌনতার লাইগা ঘরের বৌরে চাইলে তা পাওয়ার অধিকার তিনি রাখেন…

এইটা শ্বেতকেতু মানতে পারে না। পরে বড়ো হইয়া সে বিবাহিত নারী স্বামী ছাড়া আর কারো লগে যৌনতা করতে পারব না বইলা বিধান প্রচার করে। যদিও তা কার্যকর হয় আরো বহু বহু পরে…

তবে অন্তত কুন্তী আর দ্রৌপদী পর্যন্ত এক নারীর চাইর পুরুষ পর্যন্ত যৌনতা গ্রহণযোগ্য আছিল। চাইরের অধিক পুরুষের লগে কোনো নারী যৌনতা করলে তারে বলা হইত বেশ্যা। এই সূত্র ধইরাই কুরুসভায় দ্রৌপদীরে বেশ্যা কইয়া ডাকে কর্ণ…

অন্যদিকে বিবিধ যুক্তিমতে নকুল-সহদেব কুন্তীর গর্ভজাত পোলা হইবার সম্ভাবনাই বেশি। তাগো লাইগা কুন্তীর অনুভূতি; মাদ্রীর লগে তাগো বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক; বড়ো তিন ভাইর লগে সম্পর্কের গভীরতা; শল্যর লগে তাগো স্বাভাবিক মামা-ভাগিনা সম্পর্ক না থাকা; সব কিছুতেই ওই জমজরে কুন্তীর পোলা হিসাবেই ভাবতে প্ররোচনা দেয়…

অনেকের মতে কুন্তী এই দুই জমজরে মাদ্রীর পোলা কইয়া পরিচয় করাইছে শুধু নিজে বেশ্যা খেতাব এড়াইতে। কারণ কর্ণ থাইকা নকুল-সহদেব পর্যন্ত জন্ম দিতে তারে নিতে হইছে পাঁচ পুরুষের ঔরস। এর লগে আছে তার স্বামী পাণ্ডুর বিছানা; সব মিলা জানামতে অন্তত ছয় পুরুষের যৌনসঙ্গী হইছে কুন্তী…

ফলে প্রথম আর শেষ গর্ভ অস্বীকার কইরা স্বামীসহ স্বীকৃত চাইর পুরুষের যৌনসঙ্গই প্রতিষ্ঠা করতে হইছে কুন্তীরে; যাতে কেউ তারে বেশ্যা না কইতে পারে…

তবে পরপুরুষের দিকে নজর দিবার কারণে বৌ হত্যা এমনকি মাতৃহত্যার ঘটনাও আছে মহাভারতে; তাও ঋষি পরিবারে…

ঋষি জমদগ্নির বৌ রেণুকার নজর পড়ছিল চিত্ররথ নামে এক রাজার উপর। রেণুকার গর্ভের পাঁচ পোলা তখন বড়ো। এর মাঝে সবার ছোট হইল পরশুরাম…

পরপুরুষের উপর বৌর নজর পড়ছে দেইখা জমদগ্নি বৌর মৃত্যুদণ্ড দেন; আর তা কার্যকর করতে বলেন নিজের পোলাদের। বড়ো চাইর পোলা সেইটাতে অস্বীকৃতি জানাইলেও বাপের আদেশে কুড়াল দিয়া মায়ের মাথা কাইটা ফালায় পরশুরাম…

তবে জমদগ্নি-পরশুরামের বংশে আরো আগের প্রজন্মে পরপুরুষে বৌ ছোয়ার বিষয়ে খুঁতখুঁতানি থাকলেও অত উগ্রতা দেখা যায় নাই…

জমদগ্নির বাপ ঋচিক। ঋচিক ভৃগু মুনীর দ্বিতীয় পোলা। ভৃগুর অন্য দুই পোলার মাঝে বড়োজন চ্যাবন মুনি আর ছোটপোলা শুক্রাচার্য। তিন পোলারই মা আলাদা আলাদা…

বিবাহের আগে চ্যাবনের মা পুলমার প্রেম আছিল গরিব এক সাধারণ তরুণের লগে। এর মাঝে পুলমারে দেইখা পছন্দ হওয়ায় ভৃগুমুনি গিয়া তার বাপের কাছে দিয়া বসেন বিবাহ প্রস্তাব। লগে লগে ভালো মূল্যের কইন্যাপণ…

ভালো কইন্যাপণ পাইয়া ভৃগুর কাছে মাইয়া দিয়া দেয় পুলমার বাপ। পরে এই ঘটনা জাইনা পুলমার প্রেমিক আইসা তারে স্বামীর বাড়ি থাইকা উঠায়া নিয়া গিয়া সংসার শুরু করে। আরো পরে চ্যাবন বড়ো হইয়া মায়ের প্রেমিকরে খুন কইরা মায়েরে ফিরায়া নিয়া আসে বাপের ঘরে। কিন্তু ভৃগু তারে আবার সংসারে নিতে রাজি হন না। পরে বহুত কান্নাকাটি আর সালিশের পরে ভৃগু আবার পুলমারে সংসারে গ্রহণ করেন…

পৌরাণিক কাহিনীমতে স্বামীর ঘরে ফিরার লাইগা পুলমা এমন কান্দনটা কানছিল যে সেই চোখের পানির স্রোতে বধূসরা নামে আস্ত একখান নদীই তৈরি হইয়া যায়…

কারো কারো যুক্তিতে আফগানিস্তানের বলখ নিবাসী চ্যাবন মুনীই হইলেন রামায়ণের আদি ভার্সন পুলস্ত্যবধ কাব্যের রচয়িতা বা আদি বাল্মিকী বা রামায়ণের আদি কবি। আর পুলস্তবধ্য কাব্যের মূল ঘটনাটা তার নিজের মায়ের অপহরণ ও উদ্ধার ঘটনারই কাব্যিক উপস্থাপন…

পরকীয়ার অবশ্য একটা বেশ সহিংস ঘটনা চলতি রামায়ণে আছে। ঋষি গৌতমের বৌ অহল্যা তার ছাত্র ইন্দ্রের লগে যৌনতায় ধরা পইড়া যায় স্বামীর হাতে। গৌতম ইন্দ্ররে ধইরা দুইটা বিচি গাইলা দেন। আর বৌরে শুকায়া মরার লাইগা বাইন্ধা রাখেন পাথুরে পাহাড়ে। পরে অবশ্য রাম অহল্যারে মুক্ত করে আর বিশ্বামিত্রের শালিসে গৌতম আবার অহল্যারে সংসারে ফিরায়া নেন…

স্বামীর একাধিক বিবাহে বৌর মাত্র একটা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় মহাভারতে। সেইটা সুভদ্রারে বিয়া করার পর অর্জুনের উপর দ্রৌপদীর ক্ষেইপা উঠা। দ্রৌপদী নিজের পাঁচ স্বামী থুইয়া অর্জুনের আরেক বৌ মানতে পারে না…

অন্যদিকে একাধিক বিবাহ করা স্বামীরে নিজের বশে রাখা না রাখা নিয়া টেনশনের ঘটনাও মাত্র একটা মহাভারতে। কৃষ্ণের বৌ সত্যভামা একবার দ্রৌপদীরে জিগায়- স্বামীরে কেমনে বশে রাখা যায়…

আস্ত মহাভারতে স্বামী ধইরা রাখা বিষয়ে আর কোনো টেনশনের ঘটনা নাই; স্বামীর অন্য বিবাহে গোস্বা করারও ঘটনা নাই…

 

 

[এই উপকরণগুলা প্রচলিত মহাভারতীয় আখ্যান-উপাখ্যান নির্ভর একটা সংকলন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রসঙ্গিক অন্য আখ্যানও উইঠা আসছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণও পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন কাহিনীতে]

 

 

 Mahbub Leelen is a poet, storyteller, and playwright. His book about Mahabharat “Avajoner Mahabharat” is very important work. He lives in the USA as an exiled.

 

 

More Posts From this Author:

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!