বেশিরভাগ কাহিনীমতে ভীষ্মের মা গঙ্গাও আছিলেন একজন অপ্সরা। কোনো একটা কারণে বাচ্চা টিকাইতে পারত না রাজা শান্তনু। ফলে এক বাচ্চার চুক্তি কইরা গঙ্গারে পরপর আটটা বাচ্চা জন্মাইতে হয়। পয়লা সাতটাই মরে শান্তনুর হাতে; পরে ক্ষেইপা শান্তনুরে আর আট নম্বর পোলা দেবব্রত বা ভীষ্মরে ছুইতেও দেয় না গঙ্গা। নিজেই নিয়া গিয়া বড়ো কইরা বাপের কাছে পাঠায়…
মহাভারতের দীর্ঘজীবী চিরকুমার দেবব্রত ভীষ্ম নিজের পরিবারে তিন প্রজন্মের লাইগা ঘটকালি করছেন মোট পাঁচখান। বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া পাঁচটা বিয়াই একটা থাইকা আরেকটা সম্পূর্ণ আলাদা…
তার পয়লা ঘটকালি বাপের বিয়ার। বাপ শান্তনুর বিবাহের প্রস্তাব নিয়া তিনি গিয়া হাজির হন সত্যবতীর বাপের বাড়ি…
আবিয়াইত্যা সত্যবতীর একটা বারো বছরের পোলা থাকায় বিয়ার বাজারে তার অবস্থা আছিল খুবই খারাপ। তারে বিয়া করলে তার পোলারেও খাওয়াইতে হইবে চিন্তায় জোয়ান-তাগড়া কোনো বেটায় বিবাহের প্রস্তাব দিত না তারে। যে দুই একটা প্রস্তাব আসত সেইগুলা হয় বুড়াধুড়া না হয় এমন হাভাইত্যা যে কইন্যাপণ দিবারও ক্ষমতা নাই; ফলে প্রস্তাব ফিরায়ইয়া দিতো সত্যবতীর বাপ…
কইন্যাপণ জিনিসটা শুনতে পাত্রীপক্ষের নেওয়া যৌতুকের মতো মনে হইলেও জিনিটা ভিন্ন। মূলত মাইয়ারে লালন-পালন করতে বাপের যে খর্চা হইছে সেইটার প্রতীকী মূল্য কইন্যাপণ। কেউ কইন্যাপণ দিয়া মাইয়া নিয়া গেলে তার উপর বাপের আর কোনো অধিকার বর্তায় না। সে হইয়া পড়ে পাত্রপক্ষের মানুষ। পাত্রপক্ষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে সেই মাইয়ারে নিয়া। অনেকটা মাইয়ারে বেইচা দিবার মতো…
তবে সাময়িক বিবাহে ছোট অংকের কইন্যাপণজাতীয় মূল্য পরিশোধের একটা প্রচলন আছিল। সেইটা কইন্যার বাপ-ভাই-পরিবার পাইত না; সেইটা নিত পাত্রী নিজে…
এইটা অনেকটা ভাড়াটিয়ার বৌর ভাড়ামূল্যের মতো; চুক্তির মেয়াদ শেষ হইবার পর পাত্রী আবার স্বাধীন হইত। তবে চুক্তিকালীন সময়েও পাত্রীরে শাসন-টাসন কিংবা অন্য কোথাও বরাদ্দ দিবার অধিকার থাকত না স্বামীর। এইটা মূলত আছিল সন্তান জন্মদানের চুক্তি; সাধারণ বিবাহের মতো ঘর-সংসার করার চুক্তি না…
মারাত্মকভাবে জনসংখ্যার সংকটে আছিল মহাভারত সমাজের মানুষেরা; বিশেষত আর্য ঘরানার পরিবারগুলা। গেরস্থালির লাইগা বিশেষত বেটা মানুষ লাগত প্রচুর কিন্তু শিশু মৃত্যু আর রোগ বালাইয়ে মানুষের মরার হারও আছিল অতি উচ্চ। ফলে প্রতিটা পুরুষের অন্তত একটা পোলা জন্মদান প্রায় বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি যেকোনোভাবে মানবজন্ম; বিশেষত পুরুষজন্মরে স্বাগত জানানোর সংস্কৃতি গইড়া উঠছিল সেইসব সমাজে। একইভাবে পুত্র জন্মাইতে না পারা নারীরেও দেখা হইত অভিশাপের চোখে…
পুত্র জন্ম না দিয়া মইরা গেলে স্বর্গে যাওয়া অসম্ভব; এইটা মোটামুটি ধর্ম বিশ্বাসের মতোই আছিল সেইসব সমাজে…
কিন্তু হেডম ছাড়া বিয়াশাদি করাও কঠিন। মাত্র অল্প কিছু বেটায়ই পারত মাইয়া পটায়া-ভাগায়া-উঠায়া কিংবা স্বয়ংবরায় গিয়া বিবাহ করতে। সাধারণ মানুষের মূল বিবাহপন্থাটা আছিল কইন্যাপণ দিয়া বৌ আনা…
আবার কইন্যাপণ দিবার সামর্থ্যটাও আছিল না বহুতের; বিশেষ কইরা তরুণ মুনি-ঋষিগো। একদিকে চালচুলা পয়সাপাতি নাই; অন্যদিকে পোলা জন্মাইতে না পারলে স্বর্গের রাস্তা যেমন বন্ধ তেমনি পুত্রহীন ঋষির পক্ষে বাজারে প্রতিপত্তি জমানোও কঠিন…
ফলে গরিব আর তরুণ ঋষিরা পুত্র জন্মানোর লাইগা বাইছা নিত কম খর্চার সাময়িক বিবাহের পথ। এই সিস্টেমে বাচ্চা জন্মায়া দিবার লাইগা রীতিমতো মাইয়াগো একটা সম্প্রদায় গইড়া উঠছিল। এদের বলা হইত অপ্সরা…
অপ্সরাগো লগে চুক্তিতে পাত্র-পাত্রীর পরিবারের উপস্থিতি কিংবা অংশগ্রহণের প্রমাণ নাই। পাত্র নিজেই দরদাম কইরা নিতো পাত্রীর লগে…
চুক্তির মেয়াদ নির্ভর করত একেকটা জন্মদানের হিসাবে। মানে তুমি আমারে একটা পোলা জন্মায়া দিবা; এর বিনিময়ে আমি তোমারে দুইটা বা দশটা গরু দিব; লগে দিব এইটা আর সেইটা…
চুক্তির শর্ত শেষ হইবার পর একই অপ্সরা দিয়া আরেক বাচ্চা পয়দা করতে হইলে চুক্তি নবায়ন লাগত। আর চুক্তি নবায়ন না হইলে অপ্সরা আবার অন্য কারো কাছে যাইত ভাড়া খাটতে…
এই সিস্টেমেই অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে পোলা শুকদেবের জন্ম দেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন…
তবে মুনিঋষি ছাড়া গেরস্থগোও মাঝে মাঝে অপ্সরার গর্ভে বাচ্চা জন্মাইতে দেখা যায়। তেমনই একটা উদাহরণ হইল ভীষ্মের জন্মঘটনা…
বেশিরভাগ কাহিনীমতে ভীষ্মের মা গঙ্গাও আছিলেন একজন অপ্সরা। কোনো একটা কারণে বাচ্চা টিকাইতে পারত না রাজা শান্তনু। ফলে এক বাচ্চার চুক্তি কইরা গঙ্গারে পরপর আটটা বাচ্চা জন্মাইতে হয়। পয়লা সাতটাই মরে শান্তনুর হাতে; পরে ক্ষেইপা শান্তনুরে আর আট নম্বর পোলা দেবব্রত বা ভীষ্মরে ছুইতেও দেয় না গঙ্গা। নিজেই নিয়া গিয়া বড়ো কইরা বাপের কাছে পাঠায়…
অন্য কাহিনীমতে শান্তনুর লগে গঙ্গার আনুষ্ঠানিক বিবাহ হয়। পয়লা সাত পোলা মরে। অষ্টম পোলা জন্মের পর সে শান্তনুরে তালাক দিয়া পোলা নিয়া বাপের বাড়ি চইলা যায়। পরে পোলায় বড়ো হইয়া বাপের কাছে আসে…
উপাখ্যানগুলার বিবরণমতে এইটাই মহাভারতে একমাত্র তালাকের ঘটনা; যেইখানে স্ত্রী স্বামীরে তালাক দিছে বা ত্যাগ কইরা গেছে। মহাভারতের কাহিনীগুলাতে অন্য কোনো তালাকের ঘটনা আমার স্মৃতিতে নাই…
অবশ্য রামায়ণে স্বামীরা স্ত্রীরে তালাক দিবার অন্তত তিনটা ঘটনা আছে। আবার তালাক দেওয়া বৌ নিয়া ঘর করারও উদাহরণ আছে…
রামায়ণে কেকয়রাজ অশ্বপতি তার পোলা মাইয়া যুধাজিৎ আর কৈকেয়ীরে রাইখা দিয়া বৌ তালাক দেন। এর পরে কৈকেয়ীর মায়ের আর পোলামাইয়ার লগে দেখা করারও কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না…
অশ্বপতির মাইয়া কৈকেয়ীরে রাজা দশরথ পুত্রসমেত ত্যাগ করেন প্রকাশ্যে। কিন্তু এর পরে দশরথ যান মইরা; কৈকেয়ীর পুত ভরত হয় রাজা ফলে কৈকেয়ীরে আর অযোধ্যা ত্যাগ করতে দেখা যায় না; বরং দশরথের বিধবার মর্যাদা নিয়াই কৈকেয়ী অযোধ্যায় থাকে। যদিও দশরথ তার তালাক প্রত্যাহার করেন নাই…
রাম পয়লা লঙ্কায় সীতারে তালাকের ঘোষণা দেয় কিন্তু হনুমান আর বিভীষণ সীতারে আবার রামের কাছে গছায়া দেয়। আর রামও হাসতে হাসতে বৌ নিয়া বাড়ি আইসা ঘরসংসার করে। কিন্তু পরে তারে দ্বিতীয়বার তালাক দিবার পর আর ঘরে তোলে না…
মহাভারতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন স্বামী-স্ত্রীর অনেক উদাহরণ থাকলেও শান্তনু-গঙ্গা ছাড়া তালাক হওয়া বা সম্পর্ক ছিন্ন স্বামী-স্ত্রীর অন্য কোনো উদাহরণ নাই…
দ্রৌপদী ছাড়া পঞ্চপাণ্ডবের সবারই সংসার করার লাইগা অন্তত একটা কইরা বাড়তি বউ আছিল। এই বৌরা তাগো লগেই ইন্দ্রপ্রস্থ বা হস্তিনাপুর থাকত। কিন্তু এর বাইরে সংসার না করা বৌ অর্জুনের আছিল দুইটা; ভীমের একটা…
ভীমের সংসার বিচ্ছিন্ন বৌ হিড়িম্বা কিংবা অর্জুনের সংসার বিচ্ছিন্ন দুই বৌ উলূপী আর চিত্রাঙ্গদা থাকত তাগো বাপের বাড়ি। কিন্তু বৈবাহিক বা পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন হয় নাই তাগো। রাজসূয় যজ্ঞের সময় পাণ্ডবগো নয় বৌরেই বিশেষ রাজকীয় আসনে আইসা বসতে দেখা যায়। এর মাঝে বংশের পয়লা বউ হিসাবে ভীমের সংসার বিচ্ছিন্ন বৌ হিড়িম্বারে কুন্তী নিয়া বসায় সকলের মধ্যিখানে…
কারো কারো যুক্তিতে পাণ্ডব পরিবারে পয়লা বিবাহ আছিল যুধিষ্ঠির-দেবীকার। যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের যুবরাজ থাকতেই নাকি এই বিবাহ হয়। কিন্তু পরিবারের বড়ো বৌ হিসাবে হিড়িম্বারে কুন্তী নিজে আইনা নয়জন বৌর মাঝখানে বসানোর ঘটনায় মনে হয় পাণ্ডব পরিবারে দেবীকার বড়ো বৌ হইবার দাবিটা ঠিক না। হিড়িম্বাই পাণ্ডব পরিবারে পয়লা বৌ। হিসাবে বরং কয় ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা হইবার পরেই বরং স্বয়ংবরায় গিয়া দেবীকারে বিবাহ করে অলরেডি বিয়াইত্তা যুধিষ্ঠির…
সেই কালে বিবাহ যে প্রকারেই হউক না ক্যান; নারীরা স্বামীর সম্পত্তি বইলাই গণ্য হইত; যেই কারণে যুধিষ্ঠির সম্পত্তি বিবেচনায় দ্রৌপদীরেও ধইরা বসে জুয়ার দানে; যেইটা নিয়া কোনো প্রশ্নও উঠায় না দ্রৌপদীর বাপ-ভাই…
একই কারণে কুরুযুদ্ধের আগে কর্ণরে পটাইতে গিয়া কৃষ্ণ বলছিল পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিলে সেও দ্রৌপদীর ভাগ পাবে। মানে দ্রৌপদীর স্বামীপক্ষ হিসাবে এগারো সন্তানের মায়েরেও কৃষ্ণ আরেক বেটার বিছানায় বরাদ্দ দিবার অধিকার রাখত…
বাপের বিবাহের লাইগা ভীষ্মের পয়লা ঘটকালিতে দেখা যায় সকল শর্ত চাপাইতেছে পাত্রীপক্ষ আর জি হ ঠিক ঠিক কইয়া পাত্রপক্ষ সব মাইনা নিতাছে বিনাতর্কে। সত্যবতীর মাইমল বাপ বুইঝা ফালাইছিল রাজা শান্তনু তার মাইয়ার প্যাঁকে পইড়া গেছেন আর শান্তনুপুত বাপেরে কথা দিয়া আসছে যেমনে হউক এই মাইয়ার লগে বিবাহ ঠিক কইরা দিব তার…
স্বয়ং রাজায় পাঠাইছে বিবাহ প্রস্তাব তাই সত্যবতীর বাপ কইন্যপণ নিয়া বেশি কথা না বইলা চাপাইতে থাকে ভবিষ্যতের শর্ত; তার মাইয়ার গর্ভের পোলাপানরে রাজা বানইতে হবে। ভীষ্ম কয়- ঠিকাছে আমি রাজা হমু না। তোমার নাতিরাই হবে। মাইমল কয়- তুমি ঠিকাছে কইলে হবে না। কয়দিন পর তুমি বিবাহ করবা; তখন তোমার পোলাপান করব গ্যাঞ্জাম। ভীষ্ম কয়- ঠিকাছে তাইলে আমি আর বিয়াই করব না। এইবার রাজি হও…
এইটা পরিস্কার যে এইখানে খেলার বলটা পাত্রীপক্ষের নাগালে আছিল দেইখা মাইমলে খেলাইছে দারুণ। তবে বিবাহ নিয়া দরদামের ঘটনা আস্তা মহাভারতে কিন্তু এইটাই একমাত্র। আর কোনো ক্ষেত্রেই বিবাহের আগে শর্তমর্ত নিয়া কোনো কথাবার্তা পাওয়া যায় না কোথাও…
রামায়ণে শর্তের ঘটনা আছে একটা। কেকয়রাজ অশ্বপতি মাইয়া বিয়া দিবার আগে দশরথরে শর্ত দিছিলেন তার মাইয়ার গর্ভজাত পোলা সিরিয়ালে যত নম্বরেই থাকুক না ক্যান; তারেই বানাইতে হবে অযোধ্যার পরবর্তী রাজা। এই শর্তের কারণেই দশরথের বড়োপোলা রামের সিংহাসন দাবি থাকে না অযোধ্যায়; বৈধ দাবিদার হয় ভরত…
ভীষ্ম দ্বিতীয় ঘটকালিটা করেন তার ছোট ভাই সত্যবতীপুত্র বিচিত্রবীর্যের লাইগা। এইখানে কোনো কথাবার্তা নাই। সরাসরি কাশীরাজের বাড়িতে গিয়া তার তিন মাইয়ারে উঠায়া আইনা কন- আমার ছোট ভাইরে তুমগো বিয়া করা লাগব…
মাইয়া ধইরা আইনা বিয়া করার আরো ঘটনা আছে মহাভারতে। এর মাঝে আলোচিত অন্যটা হইল রুক্ষ্মিণীরে উঠায়া কৃষ্ণের বিবাহ; যদিও কেউ কেউ রুক্ষ্মিণীরে কৃষ্ণের প্রেমিকা বানায়া মাইয়া ছিনতাইর দায় থাইকা কৃষ্ণরে সাফাই দিতে চান…
বিচিত্রবীর্যের বিবাহ আয়োজনের ঘটনায় একটা ভিন্ন রীতির উপস্থিতি পাওয়া যায় মহাভারত সমাজে। সেইটা হইল বিবাহে পাত্রীর আপত্তি করার অধিকার…
ভীষ্ম উঠায়া আনেন কাশীরাজের তিন মাইয়া। এর মাঝে বড়ো কইন্যা অম্বা বিচিত্রবীর্যরে বিবাহ করতে অস্বীকার যায়। তারে জোর কইরা ধইরা আনলেও; বিচিত্রবীর্যরে বিবাহ করতে কেউ তার উপরে জোর খাটায় না; তারে ছাইড়া দেওয়া হয়…
আবার পাত্রের পক্ষে বিবাহে অস্বীকৃতি জানানোর ঘটনাও অম্বার কাহিনীতেই পাওয়া যায়। ভীষ্ম ছাইড়া দিবার পর অম্বা ফিরা যায় তার প্রেমিক শাল্বর কাছে। কিন্তু ভীষ্ম তারে ছুঁইছে এই দোহাই দিয়া বিবাহে আপত্তি জানায় শাল্ব। এই আপত্তির লাইগা শাল্বর উপর অম্বারে জোরাজুরি করতে দেখা যায় না। তবে অম্বা বিয়ার লাইগা জোরাজুরি করে ভীষ্মরে…
শাল্বার কাছ থিকা ফিরা আইসা অম্বা ভীষ্মরেই প্রস্তাব দেয় তারে বিবাহ করতে। ভীষ্ম বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে না; বরং নিজের কুমারব্রতের কথা জানায়া বিবাহে অপারগতা প্রকাশ করে। এইখানে বিয়াতে রাজি করানোর লাইগা জোরাজুরির ঘটনাও ঘটে। অম্বা ভীষ্মরে খালি চাপাচাপিই করে না; বিবাহে রাজি করাইতে এক পর্যায়ে সে লোকলস্কর নিয়া ভীষ্মের লগে রীতিমতো লাঠালাঠি করে। শেষে ভীষ্মের লগে কুলায়া উঠতে না পাইরা আত্মহত্যা করে সে…
বিবাহের লাইগা ভীষ্মরে অম্বার জোরাজুরিটা প্রচলিত রীতির চাইতে জেদ বা ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টাই বেশি মনে হয়। রীতি অনুযায়ী অম্বা চাপাচাপি করলে শাল্বরে করার কথা। কিন্তু সে সেইটা না কইরা করে ভীষ্মরে। হয়ত তারে উঠায়া আইনা জীবন ছানামাখা কইরা দিবার কারণ অম্বার সকল রাগ গিয়া পড়ে ভীষ্মের উপর। ভীষ্মের উপর অম্বার সেই রাগের ঘটনা নিয়া পরে বহুত কাহিনীও তৈরি হইছে মহাভারতে…
রামায়ণে এর উল্টা একটা ঘটনা আছে। সেইখানে পুরুষ নারীরে চাপাচাপি করে বিবাহের লাইগা। সীতারে উঠায়া আনার পর দেখা যায় রাবণ তারে চাপাচাপি করতে আছে বিবাহের লাইগা…
কাশীরাজের অন্য দুই মাইয়া অম্বিকা আর অম্বালিকার বিবাহে কোনো আপত্তি না থাকায় বিচিত্রবীর্যের লগে তাগো বিবাহ হয়; এই দুই বইন ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুর মা…
এর দুই প্রজন্ম পরে বিবাহে কইন্যার আপত্তির আরেকটা উদাহরণ পাওয়া যায় দ্রৌপদীর স্বয়ংবরায়। সেই স্বয়ংবরায় বহু জাতের বহু কিছিমের প্রার্থী থাকলেও কর্ণরে বিবাহ করতে অনিচ্ছার কথা দ্রৌপদী প্রকাশ্যে ঘোষণা করে। ফলে প্রতিযোগিতা থাইকা কর্ণ বাদ যায়। এইটা নিয়া তখন কাউরে কোনো হাউকাউ করতে দেখা যায় না। মনে হয় কোনো এক উপায়ে কইন্যার এই অধিকারটা স্বীকৃতি আছিল তখন…
চিরকুমার ভীষ্ম তৃতীয় প্রজন্মে ঘটকালি করেন তিনখান। একখান বড়ো ভাতিজা ধৃতরাষ্ট্রের লাইগা; একখান ছোট ভাতিজা পাণ্ডুর লাইগা। আরেকখান বিদুরের লাইগা; ভীষ্ম অবশ্য বিদুররে ভাতিজা গণ্য না কইরা গণ্য করতেন বিচিত্রবীর্যের দাসীপুত্র হিসাবে…
ভাতিজা ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহের লাইগা ভীষ্ম গান্ধারীর বাপ সুবলের কাছে দৃশ্যত বেশ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়া যান। কিন্তু লগে নিয়া যান সেনাবাহিনী…
বিয়ার প্রস্তাব দিতে সেনাবাহিনী নিয়া যাওয়া বেশ বিকট। ভীষ্ম জানতেন তার আন্ধা ভাতিজার লাইগা সুবলে মাইয়া দিতে রাজি হইব না। তাই মূলত ধামকি দিয়াই সুবলরে বিয়াতে রাজি করান ভীষ্ম। কোনো কোনো কাহিনীমতে সুবলরে বাইন্ধা থুইয়া মাইয়ার বিবাহে রাজি করান ভীষ্ম…
শান্তনু পরিবারে ভীষ্মের তিন প্রজন্মের ঘটকালির ঐতিহ্য ভাইঙা ফালায় পাণ্ডু। নিজে নিজে স্বয়ংবরায় গিয়া নিয়া আসে কুন্তীরে। ভীষ্ম ক্ষ্যাপেন। পরে যখন দেখা যায় কুন্তীর ঘরে বাচ্চাকাচ্চা হয় না; তখন তিনি আবার পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহের ঘটকালির দায়িত্ব নিজে নিয়া নেন। আইনা হাজির করেন মাদ্রীরে…
মাদ্রীরে কিন্তু ভীষ্ম পয়সা দিয়া কিনা আনেন তার ভাই শল্যর কাছ থিকা। কারণ কইন্যাপণ নিয়াও পাণ্ডুর ঘরে মাইয়া দিতে রাজি হয় নাই কেউ…
কুন্তীর বিবাহপূর্ব সন্তান কর্ণের কথা মোটামুটি সকলেই জানত। পাণ্ডুর ঘরে কুন্তীর বাচ্চা না হওয়ার মূল কারণ যে পাণ্ডুর আটকুরামি সেইটা বুঝত সকলেই। ফলে নিশ্চিত আটকুরার ঘরে মাইয়া বিবাহ দিতে রাজি হয় নাই কেউ। বরং বহুত টেকা পয়সা নিয়া বইনরে বেইচা দেয় মদ্ররাজ শল্য…
শল্যের নীতি-নৈতিকতার মান আছিল নিচা। খালি টেকার লাইগা আটকুরার কাছে বইন বেইচা দেওয়ার ঘটনাই না; বরং কুরুযুদ্ধে সে আসছিল পাণ্ডবদলে যোগ দিয়া ভাইগ্নাগো পক্ষে যুদ্ধ করতে। আইসা দেখে এগো পয়সা পাতি নাই; উল্টা দিকে দুর্যোধন দেখাইছে বেশি পয়সার লোভ; ব্যাস সে চইলা গেছে ভাইগ্নাগো শত্রুশিবির কুরুপক্ষে…
গড় হিসাবেই মনে হয় মদ্র লোকজনরে কিছুটা খাইস্টা কিসিমের ভাবত অন্যরা। যেই কারণে কুরুযুদ্ধের শেষ দিকে আস্তা জাতবংশ তুইলা শল্যরে ধুমায়া গাইলাইতে দেখা যায় কর্ণের…
তবে পয়সা দিয়া কিনা আনলেও মাদ্রী কিন্তু দাসী আছিল না। পাণ্ডুরাজার স্বাধীন বৌই আছিল সে…
অন্য কোনো বিবাহের ক্ষেত্রে জাতপাত মানার ঘটনা না থাকলেও বিদুরের বিবাহে দেখা যায় ভীষ্ম জাতপাত গুনতেছেন…
বিদুরের মা আছিলেন পাণ্ডুর দাসী। এই কারণে বিদুর দাসীপুত্র হিসাবেই গণ্য। বিদুর কুরুরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হইলেও বিবাহের সময় ভীষ্ম তার লাইগা পাত্রী ঠিক করেন রাজা দেবকের শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভজাত মাইয়া…
এই ঘটনা মহাভারতে কোন স্তরের সংযোজন ঠিক নিশ্চিত না। কারণ ভীম-অর্জুন দুইজনেই সরাসরি রাক্ষস নামে পরিচিত স্থানীয় শূদ্রেতর শ্রেণিতে বিবাহ করে। সত্যবতীও একজন শূদ্রাণি; সেইগুলাতে সমস্যা দেখা যায় না। কিন্তু বিদুরের লাইগা ক্যান বাইছা বাইছা শূদ্রকইন্যা আনা হইল বুঝি নাই…
মহাভারতে জাতপাতের বিষয়টা এক্কেবারে গুজামিল কইরা ঢোকানো। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ভীষ্মের মুখ দিয়া শ্রেণি বিভাজনের যেই সূত্রগুলা বাইর করা হইছে; সেই সূত্র অনুযায়ী ভীষ্মর নিজের ক্ষত্রিয়ত্ব বাতিল হইয়া হইবার কথা উগ্র নামে একটা নিচু জাতের মানুষ। কৃষ্ণের ক্ষত্রিয় না হইয়া হইবার কথা সূত; মানে যেই সূত জাতীয় পরিচয়ের লাইগা কর্ণরে অপমানিত হইতে হইছে বারবার…
ভীষ্মের বিবরণমতে বাপ ক্ষত্রিয় আর মা ব্রাহ্মণ হইলে পুত হয় সূত। কৃষ্ণের পূর্বপুরুষ যদুর বাপ যযাতি ক্ষত্রিয় আর মা দেবযানী ব্রাহ্মণ; সেই হিসাবে যদুর বংশধর কৃষ্ণ সূতজাতীয় মানুষ…
আবার যযাতির ছোটপোলা পুরু হইল শান্তনু বংশের পূর্বপুরুষ। পুরুর বাপ ক্ষত্রিয় আর মা শর্মিষ্ঠা শূদ্রেতর রাক্ষসবংশজাত নারী। সেই হিসাবে শান্তনুপুত্র ভীষ্মের বয়ানমতে যযাতি-শর্মিষ্ঠার বংশধর হইবার কারণে তার নিজেরই জাত নাইমা যায় নিচে…
দাসীপুত্র হইবার কারণে মহাভারতে দুইটা মানুষরে বেশ লঘুতুচ্ছ হইতে দেখা যায়। এর একজন বিদুর আর আরেকজন ধৃতরাষ্ট্রের পুত যুযুৎসু…
কর্মের দিক দিয়া বিদুর কুরুরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী; ক্ষত্রিয় পদ। আবার বিদ্যায় বিদুর ঋষিতুল্য; ব্রাহ্মণ মর্যাদা পাইবার দাবিদার। বাপের দিক দিয়া মহাঋষি দ্বৈপায়নপুত্র; কিন্তু কী কারণে যেন তার শূদ্র পরিচয়টা কোনোদিনও মোছে নাই…
ধৃতরাষ্ট্রের দাসীগর্ভজাত পুত্র যুযুৎসু। যোগ্যতার দিক দিয়া মহারথ মর্যাদার যোদ্ধা। কিন্তু খালি মায়ের দিক দিয়া শূদ্রাণীপুত্র হইবার কারণে এই ক্ষত্রিয় যোদ্ধারে গণ্য করা হইত শূদ্র হিসাবে। এই জ্বালায় সে কুরুযুদ্ধকালে আইসা যোগ দেয় পাণ্ডবপক্ষে। শেষককালে শিশু পরীক্ষিৎরে অভিষিক্ত কইরা পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানে যাবার পর বহু বছর পাণ্ডব রাজ্যের তত্ত্বাবধায়কও আছিল এই যুযুৎসু। কিন্তু তার শূদ্র পরিচয় খণ্ডায় নাই…
কিন্তু খালি দাসীপুত্র হিসাবে কাউরে ছোটজাত হিসাবে গণ্য করা হইলে ভীষ্মগো পূর্বপুরুষ পুরুরও ছোটজাত গণ্য হইবার কথা। পুরুর মা শর্মিষ্ঠা খালি রাক্ষসবংশজাতই না; বরং আছিল রাজা যযাতির বৌ দেবযানীর দাসী। সেই হিসাবে ভীষ্মসহ পুরা কুরু-পাণ্ডবই দাসীগর্ভজাজতের বংশধর…
শুকদেব-ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ড-বিদুর চাইরজনেই কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের ঔরসজাত সন্তান। আজব বিষয় হইল একই দ্বৈপায়নের পোলাগো মাঝে শুকদেব ব্রাহ্মণ; ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু ক্ষত্রিয় আর বিদুর শূদ্র…
অনেকে বলেন সেইকালে কর্মের উপর ভিত্তি কইরা শ্রেণি নির্ধারণ হইত। সেইটা দ্বৈপায়নের ক্ষেত্রে হইছে; শূদ্রাণীর সন্তান কর্মগুণে ব্রাহ্মণ। শুকদেব চতুর্বেদী ঋষি; ব্রাহ্মণ ঠিকাছে। কর্ণরে পয়লা শূদ্র বলা হইলেও যখন দুর্যোধন তারে অঙ্গরাজ্যের রাজা ঘোষণা করে; তার পর থাইকা তারে ক্ষত্রিয় গণ্য করা হয়; ঠিকাছে। কিন্তু এই কর্মগুণে শ্রেণি নির্ধারণের বিষয়টা কোনো এক কারণে বিদুর বা যুযুৎসুর বেলায় প্রযোজ্য হয় নাই…
[এই উপকরণগুলা প্রচলিত মহাভারতীয় আখ্যান-উপাখ্যান নির্ভর একটা সংকলন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রসঙ্গিক অন্য আখ্যানও উইঠা আসছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণও পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন কাহিনীতে]