মাইয়ারা বরং অনেকটা বিনিময়যোগ্য সম্পদের মতোই গণ্য হইত। কুন্তীরেও তার বাপে ছোটবেলা দোস্তর বাড়িতে দান কইরা দেয়। কোনো কারণ ছাড়াই। আবার অবলীলায় শত্রুপক্ষেও মাইয়া দিয়া দিবার ঘটনা আছে। দুর্যোধনের মাইয়া লক্ষ্মণার বিবাহ হয় কৃষ্ণের পোলা শাম্বর লগে। কুরুযুদ্ধে সে শ্বশুরের বিপক্ষেই যুদ্ধ করে; আবার ভীমের হাতে মরা জরাসন্ধের মাইয়া করেণুমতি আছিল নকুলের বৌ…
মাইয়ার লাইগা বাপের কিংবা পরিবারের কিছু করার উদাহরণ মহাভারতে মাত্র দুইটা। এর মাঝে একটা দ্রৌপদীর বাপ দ্রুপদের। দৃশ্যত মাইয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়া ঝাড়ে বংশে উজাড় হয় দ্রুপদ…
কিন্তু কুরুযুদ্ধে দ্রুপদের এই অংশগ্রহণ কতটা তার মাইয়ার লাইগা আর কতটা কুরুরাজ্য-সমর্থিত দ্রোণাচার্যের কব্জা থাইকা তার হারানো অর্ধরাজ্য উদ্ধার করার লাইগা; সেইটা বোঝা মুশকিল…
কারণ দ্রৌপদীরে পাঁচ ভাইয়ে ভাগ কইরা নেওয়া কিংবা তার কোনো অপমান যন্ত্রণায়ই দ্রুপদরে আগাইয়া আসতে দেখা যায় নাই কোনোদিন…
আস্তা মহাভারতে; এবং জানামতে আস্তা ভারতীয় পুরাণে; যে কোনো অবস্থায় মাইয়ার পক্ষে খাড়াইতে দেখা যায় মাত্র একটা বাপরে; তিনি শুক্রাচার্য নামে পরিচিতি ঋষি উশনা…
মাইয়া দেবযানীর আব্দারে তিনি রাজি হইয়া যান শত্রুপক্ষের পুরোহিত বৃহস্পতির পোলা কচরে তার শল্যাবিদ্যা আর এন্টিসেপটিকের ফর্মুলা শিখাইতে। শুক্রাচার্যের এই ফর্মুলাগুলা আছিল মৃতসঞ্জিবনী নামে পরিচিত। শুক্র আছিলেন এক ছোট এক দ্বীপরাজ্যের রাজা বৃষপর্বার পুরোহিত। সেইখানেই তিনি চালাইতেন নিজের যুদ্ধ আর চিকিৎসাবিদ্যার ইস্কুল…
তির-বর্শা-কুড়ালে যুদ্ধের সেইকালে বেশিরভাগ সৈনিকই যুদ্ধের মাঠে লগে লগে মরত না। বরং যুদ্ধে আহত হইয়া ক্ষত বিষায়া মরত গিয়া পরে। শুক্রাচার্য এই ইনফেকশন ঠেকাইবার সূত্র জানতেন। একই লগে শইলে গাঁথা তির-বর্শার ফলা তিনি অপারেশন কইরা বাইর কইরা সৈনিকগো সুস্থ কইরা তুলতে পারতেন। ফলে তিনি যেই পক্ষে থাকতেন সেই পক্ষের যুদ্ধে ফাইনালি মানুষ মরত খুবই কম। পুরাণের ভাষায় তাগো আবার জীবনদান কইরা দিতেন ভার্গব ঋষি শুক্রাচার্য…
অন্যদিকে তার প্রতিপক্ষ; দেবতাগো শল্যবিদ্যা কিংবা এই এন্টিসেপটিকের ফর্মুলা জানা না থাকায় যুদ্ধে আহত বেশিরভাগ সৈনিকই আর টিকত না পরে…
বৃহস্পতি তার পোলা কচরে পাঠান শুক্রের কাছ থিকা এই ফর্মুলা শিখা আসতে। কচ আইসা পটায়া ফালায় শুক্রের মাইয়া দেবযানীরে। আর মাইয়ার আব্দারে শুক্র রাজি হইয়া যান শত্রুপক্ষের প্রতিনিধি কচরে তার গোপন ফর্মুলা শিখাইতে…
রাজা বৃষপর্বা; এমনকি তার শিষ্যরা পর্যন্ত আপত্তি করে; কিন্তু পাত্তা দেন না শুক্র। তার একটাই কথা- মাইয়ারে আমি কথা দিছি; সুতরাং কচরে মৃতসঞ্জিবনী বিদ্যা শিখাইতেই হবে…
শুক্রের কালে কোনো দিক দিয়াই তারে চ্যালেঞ্জ করার কেউ আছিল বইলা মনে হয় না। মাইয়ার এক গোস্বা নিবারণ করতে গিয়া যে রাজ্যে তিনি থাকতেন সেই রাজ্যের রাজকইন্যারে পর্যন্ত নিজের মাইয়ার দাসী বানায়া ফেলার ক্ষমতা আছিল তার…
শুধু মাইয়ায় পাত্র পছন্দ করছে বইলা সমস্ত শাস্ত্রের বিধান অমান্য কইরা তিনি দেবযানীর বিয়া দেন। এই বিষয়ে টু শব্দ করার সাহস করে না কোনো শাস্ত্রকার…
দেবগুরু বৃহস্পতির বৌরে তার ছাত্র সোম ভাগায়া আইনা আশ্রয় নেয় শুক্রাচার্যের কাছে। সোমরে ধরা-মারার লাইগা রীতিমতো যুদ্ধের আয়োজন কইরা বসে দেবতাকূল। কিন্তু সে শুক্রের আশ্রয়ে আছে শোনার পর হাত-পা গুটায়া ফেলে দেবতাকূল; বৌ ফিরত পাইবার লাইগা কান্নাকাটি ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না বৃহস্পতির…
রাজা বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর সমবয়েসি এবং বান্ধবী। একদিন কোনো এক কথা কাটাকাটিতে শর্মিষ্ঠা টিটকারি মাইরা দেবযানীরে কয়- খাটাখাটনি যা করার তা তো করে আমার বাপ। তোর বাপ তো আমার বাপের ঘাড়ে বইসা খায়…
শুক্রের অপমানে দেবযানী কাইন্দা বাপেরে জিগায়- আমি কি তবে এক পরখাউকির মাইয়া? যদি সেইটা হয় তবে অন্য কোথাও চলো যেইখানে তুমি খাটনি দিয়া খাওয়াবা আমারে…
মাইয়ার হাত ধইরা শুক্র গিয়া হাজির হন বৃষপর্বার কাছে- গ্রাম উঠায়া নিতাছি আমি; উস্টা মারি তোমার ভাতে। আমি গেলাম…
এইখানে বইলা যাওয়া ভালো যে আদিতে গ্রাম বলতে স্থির কোনো স্থান বুঝাইত না। বরং একজন ব্রাহ্মণের পরিবার-পরিজন গরুবাছুর দাসদাসী চ্যালা-শিষ্য মিলা যে লটবহর; সেইটারে বলত গ্রাম…
গ্রাম আছিল ভ্রাম্যমাণ। গ্রামপ্রধান ব্রাহ্মণ সেইটারে সুবিধামতো এক জায়গা থাইকা তুইলা অন্য জায়গায় নিয়া বসাইতেন। অথবা বলা যাইতে পারে নিজের গ্রাম নিয়া ঘুইরা বেড়াইতেন বাবনেরা। সম্ভবত এই কারণেই এখন পর্যন্ত যেমন গ্রামের কোনো পরিস্কার সংজ্ঞা নাই তেমনি সীমানা কিংবা বৈশিষ্ট্যের কোনো সাধারণ মানদণ্ডও নাই…
যাউকগা; পোলাপাইনের কাইজায় তার উপর রাগ না করতে বৃষপর্বা কাকুতি মিনতি করেন শুক্রর কাছে। শুক্র কন- আমার মাইয়ারে যদি তুমি খুশি করতে পারো; তবেই তোমার রাজ্যে গ্রাম বহাল রাখব আমি…
রাজা বৃষপর্বা দেবযানীরে জিগান- কী করলে খুশি হইবা তুমি? দেবযানী কয়- আপনের মাইয়া শর্মিষ্ঠারে আমার দাসী বানায়া দিলে আমি খুশি হব…
বিনা তর্কে রাজা তার নিজের মাইয়ারে পুরোহিতের মাইয়ার দাসী বানায়া দেন। মাইয়া খুশি তো শুক্রও খুশি; গ্রামও নড়ান না; টোলও চালাইতে থাকেন…
এই দিকে দেবযানী পইড়া গেছিল বৃহস্পতির পুত কচের প্রেমে। কিন্তু শুক্রর কাছে বিদ্যাশিক্ষা শেষ হইবার পর কচ দেয় ভাগল। ফলে রীতিমতো পুরুষ-পাগলি হইয়া উঠে ছ্যাকা খাওয়া দেবযানী…
এর মাঝে একদিন শিকারের কালে রাজা যতাতিরে দেখে দেবযানী। যযাতি তখন খুবই প্রতাপী রাজা; বিবরণমতে সুপুরুষও বটে। সোজা গিয়া দেবযানী তারে কয়- আমারে বিবাহ করো…
দেবযানীর পরিচয় শুইনা শইলের লোম খাড়ায় যযাতির। পয়লা কথা ক্ষত্রিয় হইয়া ব্রাহ্মণ কইন্যা বিবাহ নিষিদ্ধ; বিধানমতে ক্ষত্রিয়গো কাছে বাবন কইন্যা মায়ের সমান। এই রকম কিছু ঘটাইলে সিংহাসন টইলা উঠব তার…
আবার অন্যদিকে শুক্রের মাইয়ারে ক্ষ্যাপাইলে কপালে কী গর্দিশ নাজেল হয় কে জানে। তাই পিছলা বুদ্ধি করে যযাতি। সে দেবযানীরে কয়- এই বিষয়ে আমি শুক্রাচার্যরেই সালিশ মানলাম। তিনি যা কন তাই হবে…
শুইনা শুক্র কন- আমার মাইয়ায় তোমারে পছন্দ করেছ। এইখানে আবার কথা কীসের? তুমি তারে বিবাহ করো। যযাতি মিনমিনায়- আচার্য; ধর্মের বিধান যে বাধা দেয়। শুক্র ধামকি লাগান- ধর্মের বিধান কি আমার থাইকা বড়ো?
যযাতি দেবযানীরে বিবাহ করায় বিধানমতে দেবযানীর দাসী শর্মিষ্ঠার লগেও যৌনতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় তার। কিন্তু শুক্র শাসায়া দেন যযাতিরে- ওর দিকে নজর দিবা না কলাম…
এই দিকে জনসংখ্যা আকালের যুগে প্রতিটা নারীর প্রতিটা ঋতুস্রাবরে গণ্য করা হইত একেকটা জন্মের সম্ভাবনা হিসাবে। ঋতুমতি কোনো নারী কোনো পুরুষের কাছে আইসা সন্তানের বীজ চাইলে যদি পুরুষ সেইটা ফিরায়া দিত তবে বলা হইত মরার পরে নির্ঘাত নরকে হইব তার গতি…
ফলে শর্মিষ্ঠা ঋতুবতী হইলে বিধানমতে এর প্রতিকার চায় যযাতির কাছে। আর যযাতিও দেবযানীরে লুকায়া পুরুসহ দুইটা পোলা জন্মায় শর্মিষ্ঠার গর্ভে…
এই সংবাদ শুইনা শুক্র যযাতির উপর ক্ষেপলেও পরে তিনিই শর্মিষ্ঠারে দাসত্ব থাইকা মুক্তি দিয়া যযাতিরে বলেন তারেও রানির মর্যাদা দিতে…
শর্মিষ্ঠার গর্ভে দুই পোলা আর দেবযানীর গর্ভে দুই; মোট চাইর পোলার বাপ আছিলেন যযাতি। অসুখের কালে বড়ো তিন পোলা ঠিকমতো বাপের যত্ন না করায় ক্ষেইপা শর্মিষ্ঠা গর্ভজাত ছোটপোলা পুরুরেই সিংহাসন দিয়া যান যযাতি। এই পুরুরই বংশধর ভীষ্মের বাপ রাজা শান্তনু…
শুধু মহাভারত না; আস্তা ভারতীয় পুরাণের অন্য কোথাও মাইয়ার আব্দার মিটাইবার লাইগা বাপের পুরা ধর্ম এবং রাজশাসনের বিরুদ্ধে খাড়াইবার এমন দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ আমি পাই নাই…
মাইয়ারা বরং অনেকটা বিনিময়যোগ্য সম্পদের মতোই গণ্য হইত। কুন্তীরেও তার বাপে ছোটবেলা দোস্তর বাড়িতে দান কইরা দেয়। কোনো কারণ ছাড়াই। আবার অবলীলায় শত্রুপক্ষেও মাইয়া দিয়া দিবার ঘটনা আছে। দুর্যোধনের মাইয়া লক্ষ্মণার বিবাহ হয় কৃষ্ণের পোলা শাম্বর লগে। কুরুযুদ্ধে সে শ্বশুরের বিপক্ষেই যুদ্ধ করে; আবার ভীমের হাতে মরা জরাসন্ধের মাইয়া করেণুমতি আছিল নকুলের বৌ…
কোনো এক অদ্ভুত কারণে স্বামীপক্ষের লগে পিতৃপক্ষের বিরোধে কোনো কথা কইতে দেখা যায় না মহাভারতীয় নারীদের। আস্তা ভারতীয় পুরাণে সম্ভবত শুধু শিবের বৌ সতী স্বামীরে শ্বশুরবাড়ি নিমন্ত্রণ খাইতে না ডাকায় বাপের লগে কাইজা করছিল…
মহাভারতে মা-পুতের সম্পর্কের কড়া উদাহরণ আছে দুইটা। এর একটা কুন্তীর পরিবার; আরেকটা সত্যবতী-দ্বৈপায়নের সমীকরণ…
কুন্তীরে আগাগোড়াই তার পোলাগো কেয়ার করতে দেখি। বুড়া বয়স পর্যন্ত কুন্তী তাগোরে আগলাইয়া রাখে। যুদ্ধের আগে যখন কুন্তীর পোলাগো নাতি নাতনি পর্যন্ত হইয়া গেছে তখনো তারে দেখি পোলাগো জীবন বাচাইতে কর্ণের কাছে গিয়া মিনতি করতে…
কিন্তু কোনো এক কারণে পোলারা রাজা হইবার পর কুন্তী তাগো লগে থাকে না। সে থাকে হস্তিনাপুর তার শ্বশুর বাড়িতে। এমনকি শেষ বয়সে পোলাগো থুইয়া সে ধৃতরাষ্ট্র আর বিদুরের লগেই বানপ্রস্থে গিয়া মরে…
কুন্তীর আরেকটা বিষয় বেশ বিস্ময়কর। তার পোলাগো শত্রুতা ধৃতরাষ্ট্রপক্ষের লগে থাকলেও সে আগাগোড়াই বসবাস করে ভাসুর ধৃতরাষ্ট্রের হস্তিনাপুর রাজবাড়িতে। এইখানে বইসাই সে পোলাগো পক্ষে কাজ করে। এইটা নিয়া কুন্তীর নিজের যেমন কোনো মানসিক বিকার দেখা যায় না; তেমনি তারে কেউ কোনো খোঁটা দিতেও দেখা যায় না…
এই রকম একটা পরিস্থিতি রামায়ণেও আছে। বিভীষণ রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কিন্তু তার বৌ সরমা আগাগোড়াই স্বাধীন-সাবলীল মানুষ হিসাবে থাকে ভাসুর রাবণের বাড়িতে…
বর্তমান নৈতিকতায় শত্রুতা আর না-শত্রুতার এই সমীকরণগুলা মিলানো কঠিন। হইলে হইতে পারে নারীরে কেউ গণায় ধরত না দেইখা কুন্তী কিংবা সরমার শত্রুপক্ষে থাকারে পাত্তা দেয় নাই কেউ। আবার এমনো হইতে পারে যে শ্বশুর বাড়িতে থাকা বিবাহিত নারীর স্বাভাবিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত আছিল যার লাইগা এই বিষয়ে প্রশ্ন উঠায় নাই কেউ। আবার হইলে হইতে পারে সেইসব সমাজে শত্রুতার নৈতিকতাগুলা এমন আছিল যে স্বামী বা পোলার লগে শত্রুতা থাকলেও মা কিংবা বৌরে শত্রু ভাবত না কেউ; যদিও এইটা প্রকাশ্যই আছিল যে কুন্তী ধৃতরাষ্ট্ররে ক্ষমতাচ্যুত করতে কাজ করতেছে আর সরমা সক্রিয়ভাবেই যুক্ত আছে রাবণরে টাইনা নামানোয়…
তবে স্বামীরে কাবু করার লাইগা বৌ ধর্ষণের ঘটনা নারায়ণী উপাখ্যানগুলাতে পাওয়া যায়। কাহিনীমতে স্বয়ং নারায়ণ জলন্ধর নামের এক অসুররে কাবু করতে তার বৌ বিন্দারে ধর্ষণ করেন…
একইভাবে স্বামীরে কাবু করতে বৌরে আক্রমণের একটা ঘটনা আছে রামায়ণে। রাবণরে উদভ্রান্ত কইরা তুলতে হনুমান রাবণের বৌ মন্দোদরীরে প্রকাশ্যে লাঞ্ছনা করে; কোনো কোনো কাহিনীমতে মন্দোদরীরে ধর্ষণ করে হনুমান…
মহাভারতে মাতৃত্ব-পিতৃত্ব কিংবা মা বাপের লাইগা সন্তানের আবেগ কিংবা পোলাপানের লাইগা মা-বাপের আবেগের বিষয়গুলা খুব কমই উপস্থিত। দুর্যোধনের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষপাত বাপ হিসাবে খুবই পরিষ্কার কিন্তু আবেগটা সেইখানে নাই; স্নেহ আছে; প্রশ্রয় আছে; সমর্থন আছে…
মহাভারতের কাহিনীমতে গান্ধারী একশো পুতের জননী। কিন্তু আজব বিষয় হইল গান্ধারী চরিত্রটার ভিতর বিন্দুমাত্র মাতৃত্বের আবেগ নাই। এইটা হইতে পারে ধৃতরাষ্ট্রের একশো পোলার একটাও তার গর্ভজাত না বইলা। আবার কুরুযুদ্ধের শেষে লাশ দেখতে গিয়া গান্ধারী খালি কয়েকটা নাম নিয়া কিছু আনুষ্ঠানিক বিলাপ করেন; কেউ কেউ কন গান্ধারীর মূলত দুযোর্ধন-দুঃশাসনসহ মাত্র পাঁচ ছয়টা গর্ভজাত পোলা আছিল…
গান্ধারী কিন্তু তার কথিত পোলাগো লাইগা যতটা আবেগ দেখান তার চাইতে বেশি আবেগ দেখান কর্ণের লাশ দেইখা। কর্ণের বিচ্ছিন্ন পচাগলা মাথাটা তিনি তুইলা আইনা দেহের পাশে রাখেন। কিন্তু এর বিন্দুমাত্রও আবেগও তিনি নিজের কথিত পুত্রগো লাইগা দেখান না…
কর্ণের লাইগা কুন্তীর আবেগটা গর্ভধারিণীরই আবেগ। কর্ণের লাইগাই কুন্তী শেষ পর্যন্ত রাজবাড়ি ছাইড়া বনে গিয়া মরে। কর্ণের শেষকৃত্যের লাইগা সে টেকা চাইছিল; কিন্তু পাণ্ডবগো অর্থমন্ত্রী ভীম সেইটা দিতে রাজি হয় নাই; এইটাই কুন্তীর রাজবাড়ি ছাইড়া দিবার সিদ্ধান্তের কারণ…
সম্পর্কের আবেগের দিক দিয়া কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন অনন্য। মা কিংবা সন্তানদের গর্ভধারণীগণ কিংবা পোলাগো লাইগা তার দায় মিটানো আগাগোড়াই মানাবিক আবেগে ভরপুর…
মহাভারতে সবচে ব্যক্তিত্ববান আর অভিজাত সর্ম্পকটা সত্যবতী আর তার পুত্র দ্বৈপায়নের। কথাবার্তা খুব কম। রাজবাড়িতে মায়ের বিবাহ হইলেও কোনোদিন রাজভোগ খাইতে আসে না পুত। কিন্তু যখনই মায়ের দরকার তখনই গিয়া আগলাইয়া খাড়ায়…
এবং শেষ বয়সে রাজবাড়ির গ্যাঞ্জাম থাইকা সত্যবতীরে নিজের কাছে নিয়া যান দ্বৈপায়ন। তার দুই সন্তানের দুই গর্ভধারিণী অম্বিকা-অম্বালিকারেও শেষকালে নিজের কাছে নিয়া যান দ্বৈপায়ন; মাঝে মাঝে মনে হয় অম্বিকা-অম্বালিকার জীবনে একমাত্র সম্মানপ্রাপ্তি এই ঘটনাটাই…
পুতের লাইগা দ্বৈপায়নের আবেগের সর্বোচ্চ দেখা যায় যখন শুকদেব নিজের নামে টোল খোলার লাইগা পিতার আশ্রম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। বর্ণনামতে দ্বৈপায়ন জঙ্গলের গাছে গাছে ধইরা বুক ভাসায়া কান্দেন- পুত যাইও না…
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তার মহাভারতের ছয় প্রবীণ পুস্তকে এই ঘটনাটার বড়ো অদ্ভুত একট উপসংহার টানছেন। তিনি কন- বৃদ্ধ পিতার কান্দনের মূল্য বোঝেন নাই বইলাই শেষ পর্যন্ত শুকদেব শুধুই এক চতুর্বেদী ঋষি। আর পুতের বিদায়ে বুক ভাসায়া কানতে পারছিলেন বইলাই দ্বৈপায়ন হইলেন গিয়া মহাকবি…
দ্বৈপায়ন আগাগোড়াই আছিলেন তার পোলাগো পিছে। ঘুইরা ফিরাই দেখা যায় তিনি আইসা উপস্থিত তার লোভী আর আন্ধাপোলা ধৃতরাষ্ট্রর কাছে। আবার রাজনৈতিক গ্যাঞ্জামে রাজ্যহারা মৃত মাইজম পোলার ঘরের নাতিগো বনবাসকালে তিনিই আছিলেন প্রধান আশ্রয়; শিষ্যের বাড়িতে তাগোরে লুকায়া রাখার ব্যবস্থা করা থাইকা দ্রৌপদীর লগে পাঁচ ভাইর বিবাহ সিস্টেম করা সবখানেই দ্বৈপায়ন…
বিদুররে তিনি বরাবরই পুত্র বইলা সম্বোধন করতেন। শেষকালে যুধিষ্ঠিররেও দ্বৈপায়ন মনে করায়া দেন- তুমি কিন্তু বিদুরেরই অংশ…
শ্বশুর হিসাবে পুত্রবধু কুন্তীর বেলাতেও দ্বৈপায়নরে দেখি দায়িত্বশীল। কুরুযুদ্ধ শেষের যজ্ঞে ব্রাহ্মণ হিসাবে তিনি যে টেকাপয়সা পান; সবগুলাই তিনি কুন্তীরে দিয়া দেন। কোনো এক কারণে হয়তো তিনি বুঝতে পারছিলেন যে সম্রাট যুধিষ্ঠিরের কোষাগারে হাত পাততে কুন্তীর ব্যক্তিত্বে লাগবে…
দ্বৈপায়নের এই অনুমান সঠিকই হইছিল শেষ পর্যন্ত। পাণ্ডবেরা রাজকোষ থাইকা কুরুপাণ্ডব অনেকেরই শেষকৃত্য করে। কুন্তী কর্ণের শেষকৃত্য করার প্রসঙ্গ তুললে অর্থমন্ত্রী ভীম কর্ণের লাইগা টেকা দিতে অস্বীকার করে। আর এই একটা ঘটনাতেই রাজমাতা কুন্তী পোলাগো রাজবাড়ি ছাইড়া বনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়া বসে…
মা-পুতের সম্পর্কের অন্য কিছু উদাহরণ হিড়িম্বা-ঘটোৎকচের উপকাহিনীগুলাতে পাওয়া যায়; বাকি কাহিনীগুলায় মায়েরা কেমন যেন অনুল্লেখে হারায়া যায় ঘটনার ভিড়ে…
মাতৃভক্তির বিষয়টা ঘটোৎকচের ভিতর খুবই পরিস্কার। পাণ্ডবগো রাজসূয় যজ্ঞে হিড়িম্বার অপমানে ঘটোৎকচ যেমন হামলায়া পড়ে তেমনি বনবাসকালে সৎমা দ্রৌপদীরে পর্যন্ত কান্ধে কইরা পাহাড় পার কইরা দেয় ঘটা…
মা-পুতের আরেকটা ঘটনা হইল ঘটোৎকচ-অহিলাবতীর পোলা ঋষি খাটোশ্যাম বর্বরীকের। মা অহিলাবতী পুতেরে বলছিল সর্বদা দুর্বলের পক্ষে থাকতে; সেই কথা মাইনা বর্বরীক ঋতিমতো ঋষি হারুকি সহায় নামে বিখ্যাত হইয়া উঠছিল…
কাহিনীগুলা পইড়া মনে হয় আর্য ঘরানার পরিবারগুলার চাইতে সম্ভবত অনার্য পরিবারগুলায় মায়ের অবস্থান কিছুটা মর্যাদাময় আছিল পোলাগো কাছে। কুন্তী সারা জীবন পোলাদের পাইলা পুইষা বড়ো করলেও শেষকালে পোলাগো পরিষ্কার অবহেলার শিকার হয় সে…
অম্বিকা-অম্বালিকা মহাভারতের বড়োই নীরব নারী। তাগো গর্ভের সন্তানেরা রাজা-বাদশা কিন্তু তাগো কোনো কথা নাই। একেবারে নীরব। একেবারে নগণ্য মানুষ তারা। এইটার কোনো মানে বুইঝা উঠতে পারি নাই আমি…
মহাভারতে দ্রৌপদী হইল এক স্রোতে ভাসা মানুষ। নিজে কোনো ঘটনারই জন্ম দেয় না; মোড়ও বদলায় না কোনো ঘটনার। কর্ণরে বিবাহ করতে রাজি না; এই কথাটা বলা ছাড়া আস্তা মহাভারতের কোনো ঘটনা সংগঠনেই দ্রৌপদীর প্রায় কোনো অবদান নাই; সবখানে সে থাকলেও; সবখানেই সে স্রোতে ভাইসা যাওয়া নারী…
গর্ভজাত ছয় মাইয়া আর পাঁচ পোলার লগেও দ্রৌপদী-জীবনের কোনো বিবরণ মহাভারতে প্রায় নাই…
কুরুযুদ্ধে পাঁচ পাণ্ডবই পোলাপান হারায়। এর মাঝে ঘটোৎকচ মরায় জেঠা যুধিষ্ঠিররে কিছুটা আবেগি হইতে দেখা যায়; কিন্তু ভীমের তেমন কোনো নড়ন চড়ন নাই। অভিমন্যু মরায় অর্জুন কিছু ঝিমায়; কিন্তু তাও খুবই সামান্য মনে হয়। অন্য পোলাগো মরণে অর্জুনের কোনো বিকার পাওয়া যায় না মহাভারতে…
আরো অনেকেরই পোলাপাইন মরে কুরুযুদ্ধে; কিন্তু খুব একটা আবেগ দেখা যায় না কোথাও…
পাণ্ডবগো পোলাপানের হিসাব নিয়া বহুত গড়বড় আছে মহাভারতের কাহিনীগুলায়…
দ্রৌপদীর ঘরে পাঁচ পাণ্ডবের আছিল পাঁচ পোলা; বয়সের দিক দিয়া পয়লা যুধিষ্ঠিরের পুত প্রতিবিন্ধ্য; তারপর ভীমের পুত সুতসোম; তারপর নকুলের পুত শতানীক; তারপর সহদেবের পুত শ্রুতসেন এবং সর্বশেষ অর্জুনের পুত শ্রুতকর্মা…
এই পাঁচ পোলাই কুরুযুদ্ধ করে আর যুদ্ধের শেষ দিকে অশ্বত্থামার তলোয়ারে ঘুমের মইদ্যে মারা যায়; এগো মরণে বুক চাপড়ায়া কান্দে দ্রৌপদী; এই কাহিনী মোটামুটি মহাভারতের মূল কাহিনীর অংশ; সকলেই জানে…
কিন্তু দ্রৌপদী একই লগে আছিল অন্তত পাঁচটা মাইয়ার মা। কারো কারো হিসাবে অর্জুনের ঔরসে তার যমজ মাইয়া জন্মায়; সেই হিসাবে ছয় মেয়ের মা সে; মহাভারতের কাহিনীগুলায় এই মাইয়ারা প্রায় অনুপস্থিত…
দ্রৌপদীর প্রথম সন্তান যুধিষ্ঠিরের ঔরসে জন্মানো মাইয়া সুতনু। সুতনুর বিবাহ হয় কৃষ্ণ-সত্যভামার পোলা ভানুর লগে…
ভীমের ঔরসে দ্রৌপদীর মাইয়া সংযুক্তা। অর্জুনের ঔরসে দ্রৌপদীর মাইয়ার নাম প্রগতি; কেউ কেউ বলেন প্রগতির আছিল প্রজ্ঞা নামে আরেকটা জমজ বইন…
নকুলের ঔরসে দ্রৌপদীর মাইয়া প্রিনতা; সহদেবের ঔরসে সুমিত্রা…
সুতনু ছাড়া দ্রৌপদীর বাকি মাইয়াদের অন্য কোনো তথ্যের অস্তিত্ব প্রায় নাই…
দক্ষিণ ভারতীয় কাহিনীমতে দ্রৌপদী-সুভদ্রা-উলূপী-চিত্রাঙ্গদা বাদেও আরো তিনটা বৌ আছিল অর্জুনের। মানে মোট সাতটা বিবাহ করছিল অর্জুন…
সুভদ্রার ঘরে অর্জুনের পোলা অভিমন্যুর কথা সকলেই জানে। সুভদ্রার একটা মাইয়াও আছিল ভার্গবী নামে; যার বিবাহ হয় ভীমের পোলা ঘটোৎকচের লগে…
পাণ্ডবগো বৌদের মাঝে ভীমের বৌ হিড়িম্বা আর অর্জুনের দুই বৌ উলূপী-চিত্রাঙ্গদা থাকত তাগো নিজ নিজ বাপের বাড়ি…
পাণ্ডবগো অন্য বৌদের ঘরেও পোলাপান জন্মাইছিল। যুধিষ্ঠির-দেবীকার পোলা আছিল যৌধেয়। যৌধেয় কুরুযুদ্ধে অংশ নিবার কোনো নিশ্চিত বিবরণ নাই। তবে কুরুযুদ্ধে তার নানা গোবাসন মইরা গেলে নানার সিংহাসনে সে শিবির রাজা হয়…
ভীম-বলন্ধরার পোলা সর্বগ। হিড়িম্বা আর দ্রৌপদী গর্ভজাত ভীমের দুই পোলা কুরুযুদ্ধে মারা গেলেও সর্বগ কুরুযুদ্ধে যোগ দেয় নাই এইটা নিশ্চিত। তার জীবনী সম্পর্কেও আর কোনো তথ্য নাই…
নকুল-করেণুমতীর পোলা নিরমিত্র আর সহদেব-বিজয়ার পোলা সুহোত্রর নাম পাওয়া যায়…
কুরুযুদ্ধে সুহোত্র কর্ণের হাতে মারা যায়; নিরমিত্রের কুরুযুদ্ধে যোগ দেয়া কিংবা অন্য কোনো সংবাদ বিশেষ নাই…
অন্যদিকে পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানে যাবার আগে অভিমন্যুর পোলা পরীক্ষিৎরে যখন রাজা বানায়া দিয়া যায় তখন তাগো অন্য বৌদের ঘরে জন্মানো পাণ্ডব পোলাপানের সেই রাজ্যে কোনো হিস্যা আছিল কি না তার বিবরণ মহাভারতে নাই…
ভীম-হিড়িম্বার পুত ঘটোৎকচের দুই বৌ; নাগকইন্যা অহিলাবতী আর অর্জুন-সুভদ্রার মাইয়া ভার্গবী। অহিলাগর্ভজাত ঘটোৎকচের দুই পোলা অঞ্জনপর্বা আর বর্বরীকের বেশ বিস্তারিতই পাওয়া যায়; কোনো কোনো কাহিনীমতে তার তৃতীয় পুতের নাম আছিল মেঘবর্ণ…
ভার্গবীর কোনো সন্তানের সন্ধান পাই নাই আমি…
কিছু আখ্যানমতে যুদ্ধজয়ের আশায় কুরুযুদ্ধ শুরুর আগে ঘটোৎকচের ছোটপোলা বর্বরীকরে বলি দেয় কৃষ্ণ; আর কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ কইরা মরে অর্জুন-উলূপীর পোলা ইরাবান; যে কিনা দক্ষিণ ভারতে ইরাবত নামে পরিচিত। অন্য আখ্যানগুলায় দেখা যায় ইরাবান কুরুযুদ্ধ করে না বরং বর্বরীকের স্থলে সেই বলি হইতেছে কৃষ্ণের হাতে…
তবে ঘটনা হইল বর্বরীক আর ইরাবানের পূজা এখনো প্রচলিত আছে; মন্দিরও আছে। বর্বরীক পূজিত ঋষি ও বীর হিসাবে; ইরাবান পূজিত বীর ও দেবতা হিসাবে…
অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার পোলা বভ্রুবাহন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ কইরা মরছে এবং যুদ্ধে আসে নাই; দুইজাতের কাহিনীই আছে…
দ্রৌপদী আর সুভদ্রা গর্ভজাত পাণ্ডব পোলপান ছাড়া অন্যরা পরবর্তী জীবনে পাণ্ডবগো পরিচয় দিছে কি না তারও খুব একটা বিবরণ পাওয়া যায় না…
পালক বাপের আদেশে ঋষি দুর্বাসার সেবা করতে গিয়া গর্ভবতী হয় কিশোরী কুন্তী; জন্ম হয় কর্ণের…
কর্ণ তার জন্মঘটনা জানত। কিন্তু নিজেরে সে বরাবরই পরিচয় করাইত সূতবংশজাত পালক মাতা-পিতা রাধা-অধিরথের সন্তান হিসাবে। কুন্তীই তারে তেলাইছে ফিরা আসতে কিন্তু কোনোদিনও সে ছাড়তে চায় নাই তার সূত পরিচয়…
কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের জন্মটা হইছে পরাশর দ্বারা সত্যবতী ধর্ষিতা হইবার ফলে। ধর্ষণ শেষে কিশোরী সত্যবতীর হাতে কিছু বখশিশ রাইখা গেছিলেন পরাশর। আর পোলা জন্মের পর তার পড়াশোনার ভার নিছিলেন তিনি…
বাপের টোলে পড়লেও দ্বৈপায়ন পিতার বংশপরিচয় ব্যবহার করেন নাই কোনোদিন। বরং দ্বীপবাসী মায়ের পরিচয়ে দ্বৈপায়ন নামেই নিজেরে পরিচয় করাইছেন গায়ের রংয়ের কারণে কৃষ্ণ নামের এই ঋষি…
[এই উপকরণগুলা প্রচলিত মহাভারতীয় আখ্যান-উপাখ্যান নির্ভর একটা সংকলন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রসঙ্গিক অন্য আখ্যানও উইঠা আসছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণও পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন কাহিনীতে]
Mahbub Leelen is a poet, storyteller, and playwright. His book about Mahabharat “Avajoner Mahabharat” is very important work. He lives in the USA as an exiled.