মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গণতন্ত্রের সংগ্রাম

Share this:

কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় ক্ষমতাসীন সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর থেকে কার্যত সারাদেশে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আর এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় এ মুহূর্তে নীতি-নির্ধারকরা দেখাতে পারছে না। সরকার বিভিন্ন ‘প্রণোদনা’ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। আসলে সেগুলো কতটুকু ‘প্রণোদনা’ তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। কার্যত এগুলো ঋণ প্যাকেজ। যা মানুষকে আরও ঋণগ্রস্ত করে তুলবে। সবখানেই বিরাজ করছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। আছে হতাশা, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকার তীব্র সংগ্রাম। এর বিপরীতে, জনগণের ক্ষমতায়নের সংগ্রামই পারে মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে।

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি কর্মহীনদের মানবিক সহায়তা দিতে ৬৪ জেলায় চার দফায় ৬৫ হাজার ৯০০ টন চাল এবং ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং শিশুখাদ্যের জন্য তিন কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। তবে এ অর্থ কিভাবে কোন খাতে খরচ হচ্ছে, তার কোনো সরকারি ঘোষণা নেই। নেই কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা। যার ফলে জনগণই জানতে পারছে না, তাদের অর্থ কোন খাতে, কিভাবে খরচ হচ্ছে! অন্যদিকে, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরের চালও হতদরিদ্রদের দেওয়া কথা। এ চাল আদৌ হতদরিদ্রদের দেওয়া হচ্ছে কিনা, অথবা ‘হতদরিদ্র’ বলতে কাদেরকে বোঝানো হয়েছে- এ নিয়ে আছে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত। এসব প্রক্রিয়ায় নেই স্বচ্ছতা। অঘোষিত লকডাউনের কারণে গ্রামের বাড়িতে আছি। এখানেও দেখছি, যাদের কোনো অভাব নেই, যাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বিভিন্নভাবে উপার্জনক্ষম, তাদেরকে এই চাল দেওয়া হচ্ছে। তারা আবার বেশি দামে প্রকৃত হতদরিদ্রদের মাঝে এ চাল বিক্রি করছে। এটাই ব্যবস্থাপনা! আবার সরকারি দলের চ্যালা-চামুন্ডাদের হুঙ্কারে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই।

যদিও প্রধানমন্ত্রী নানানসময়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন- যারা এই সময়ে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে দুর্নীতি করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এটা শুধু এখনকার বিষয় নয়। হঠাৎ করে কি কেউ ‘দুর্নীতি’ করছে? না, যারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তারা আগে থেকেই এ ধরনের কাজে যুক্ত ছিল। কেননা, তারাই এই প্রণোদনার অর্থ বণ্টনের দায়িত্ব পায়, ত্রাণের দায়িত্ব পায়। যার অসংখ্য অনিয়মের খবর সরকার বাহাদুরের কাছে রয়েছে। যেখানে পুরো রাষ্ট্রের চিত্র এই সেখানে এসব ছোট-ছোট ঘটনাকে কোনো ঘটনাই মনে হয় না।

মার্চ মাসের ২৬ তারিখ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অনেকগুলো জেলা শহরে চাল চুরি, মানবিক সহায়তা বিতরণের সময় অমানবিক আচরণ এবং চট্টগ্রাম, যশোর, বগুড়া, নোয়াখালী, ঝালকাঠি, খাগড়াছড়ি, গাইবান্ধা, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইলে অভিযুক্ত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের খবরও বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে।

চরম অমানবিক দৃশ্যও দেখতে হয়েছে। যা ভাবতে গেলেও চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চেতনার জগত অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে চেয়ারম্যান নুরুল আবছার ২৭ জনকে ত্রাণ দেওয়ার ছবি তুলে আবার ত্রাণ কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। ত্রাণ নেওয়ার সময় ছবি তুলতে আপত্তি জানানোর কারণে ত্রাণগ্রহীতাকে চড়-থাপ্পড়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এমন কোনো অমানবিক ঘটনা নেই যা ঘটেনি।

নাটোরের সিংড়ায় ত্রাণের ১৩ বস্তা চাল চুরি; কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ত্রাণের তালিকা তৈরিতে টাকা নেওয়া, যশোরের গুদামে অভিযান চালিয়ে সরকারি ৮০ বস্তা চাল জব্দ; বগুড়ায় ১০ টাকা কেজি দরের চাল নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনিয়মের অভিযোগ, ঝালকাঠির বাসন্ডা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামানের বাসা থেকে মজুদ করা ত্রাণের আড়াই টন চাল জব্দ করাও হয়। এইসব খাদ্যসামগ্রী চুরি করা লোকদের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে প্রায় সকলেই কোনো না কোনোভাবে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের সদস্য। এ থেকে পরিষ্কার হওয়া যায় যে, এই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার কোনোভাবেই জনগণের সরকার হতে পারে না।

খাবার না পেয়ে, অনাহারে থেকে দিন আনে দিন খাওয়া মানুষদের আত্মহত্যার চিত্র নতুন নয়। কিন্তু, এ চিত্র আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। অভাবের কারণে অন্তত ১০-১২ জন আত্মহত্যা করেছেন। গত ২৪ এপ্রিল অভাব ও দেনার কারণে যশোরের কেশবপুরে একই দড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে এক দম্পতি আত্মহত্যা করেছেন। আমাদের অজানা আরও কত মানুষ আত্মহত্যা করেছেন বা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এ সবই ঘটেছে সরকারের লোকজনের অস্বচ্ছতার কারণে। লাখ লাখ শ্রমিক-কৃষকরা এখন অভুক্ত রয়েছেন। বেতনহীন রয়েছে নিম্নমধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশ। যাদের কোনো হিসেব সরকারের কাছে নেই। কারণ এ সরকার জনবান্ধব সরকার নয়।

জীবনের ভয় নিয়ে হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন। মহামারি মোকাবেলায় কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই সরকারি ছুটি দিয়ে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা এবং রাজধানী থেকে শ্রমিকদের গ্রামে যেতে বাধ্য করা, আবার কারখানা মালিকরা তাদের ইচ্ছেমতো গণপরিবহণ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার শ্রমিককে পায়ে হেঁটে ঢাকায় আসতে যেভাবে বাধ্য করল- মহামারির সময়েও মালিকদের সামনে এমন অসহায়ত্বই সরকারের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে। একই ঘটনা জমায়েতে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে ঘটেছে। যেখানে পুরো বিশ্বের ধর্মীয় উপাসনালয়ে জনসমাবেশ বাতিল করা হয়েছে, সেখানে অঘোষিত লকডাউন থাকলেও বিভিন্ন মসজিদে জমায়েতে এখনো নামাজ হতে দেখা যায়। সারাদেশে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য সরকার এ দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

কোনো সেক্টরই সরকারি অব্যবস্থাপনা থেকে মুক্তি পায়নি। এই ভয়ংকর মহামারিতেও সারাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে প্রায় দুই লাখের মতো চা বাগানে কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা সরকারপ ঘোষিত সাধারণ ছুটি পাননি। ৮ এপ্রিল ২০২০ কমলগঞ্জের রহিমপুরে চা শ্রমিকের ১৩ বছরের শিশু করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যায়। ঝুঁকিপূর্ণ, আতঙ্কিত ও নিপীড়িত চা শ্রমিকরা এই অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার জন্য মালিকপক্ষকে দায়ী করেছেন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মতো চা বাগানের শ্রমিকদেরও কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, অথচ পাওনা মজুরি দেওয়া হচ্ছে না।

এই মহামারির সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, খুন, শিশু নির্যাতনও থেমে নেই। বিভিন্ন পত্রিকার তথ্যমতে, ১ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অন্তত ৪৪ জন। এর বাইরের পরিসংখ্যানটা যে আরও দীর্ঘ, তা বলাই বাহুল্য। এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫০ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণের ফলে আত্মহত্যা করেছেন অন্তত দুইজন এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন দুইজন। স্বামীর যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্তত ১২ জন। আমরা সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি, ইউপি সদস্য ধর্ষণ করেছে এক দিনমজুরের মেয়েকে। ত্রাণ নিতে গিয়ে ১০ বছরের ওই শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। অন্যদিকে, ৩০ মার্চ জামালপুরে পুলিশ পরিচয়ে করোনা ভাইরাসের রোগী তল্লাশির কথা বলে বলে এক শিশুকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। এমন গণবিরোধী ব্যবস্থাপনার পরও যখন করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের দাবি করা হয়, তখন তা নির্মম হাস্যকরই মনে হতে পারে!

এর বিপরীতে আমরা দেখছি, জামালপুরে অভুক্ত মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় ত্রাণের ট্রাক লুট করেছে। চট্টগ্রামে একটা খাবারের গাড়ি অনাহারি মানুষ লুট করেছে। এসব চিত্র সামনে আরও বাড়তে পারে। পিঠ দেয়ালে ঠেকলে মানুষ বাঁচার জন্য যে কোনো কিছুই করবে, এসব চিত্র সে বার্তাই শোনাচ্ছে। উল্লেখ্য, পুলিশের পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে- এখন দেশে চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। আর এ জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতেও হবে। কিন্তু এ ভাইরাস আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে অর্থনীতি- দেশের প্রতিটা খাত কতোটা ভঙ্গুর, অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আর এর মূলে রয়েছে গণতন্ত্রের অভাব। সরকার উন্নয়নের গণতন্ত্রের নামে যত বুলিই আওড়াক না কেন, এটা চূড়ান্ত বিচারে ফাঁপা। বরং সেটাকেই আমরা উন্নয়ন বলবো, যেখানে জনগণের উন্নয়ন হয়, জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন হয়- অবকাঠামো নির্মাণকে উন্নয়ন বলা যায় না। আর প্রকৃত উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন জনগণের গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব হবে। মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে আমাদের জনগণের ক্ষমতায়নের বিষয়টিও ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। তবেই আমরা প্রকৃত অর্থে করোনাভাইরাসকে পরাজিত করতে সক্ষম হবো।

 

Laboni Mondol is an organizer of Revolutionary Workers Movement.

More Posts From this Author:

Share this:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!