মায়ানমারের ‘ডিফেকশন সিন্ড্রোম’ কৌতুহলোদ্দীপক 

Share this:

গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আদালতে মায়ানমার সেনাবাহিনীর দুইজন কর্মকর্তা জবানবন্দী দেন। জবানবন্দিতে তাঁরা স্বীকার করেন যে রোহিঙ্গা নির্যাতনকালে তাদের ওপর ভয়াবহ রকমের নৃশংসতা সংগঠনের নির্দেশ ছিল। তারা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও গৃহে আটকা জীবন্ত মানুষসহ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। মানবাধিকার লংঘন করেছে। যতদুর জানা গেছে জবানবন্দি দেয়নি কিন্তু দিতে প্রস্তুত এই রকম স্বপক্ষত্যাগী সৈনিকের সংখ্যা ছয় বা ততোধিক। মতান্তরে নয় জন। এই মাসেরই পাঁচ তারিখে ১২ জন সেনা সেনাবিরোধী আন্দোলনে জনতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে স্বপক্ষ ত্যাগ করে। এই তথ্য এশিয়া প্যাসিফিক জার্ণালের। 

৬ মার্চের প্রথম আলোয় খবর হয়েছে যে নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে ৩০ জন পুলিশ ভারতে পালিয়ে এসেছে। মায়ানমার তাদের ফেরত চেয়ে ভারত সরকারকে চাপ দিচ্ছে। ভারত ফেরত দেবে কি না প্রশ্ন সেটি নয়। স্বপক্ষত্যাগী পুলিশদের ভাষ্য এই যে পুলিশের বেশির ভাগ সদস্যই সেনা-নির্দেশ পালনে অস্বস্তি বোধ করছে। অসম্মত হবার হিম্মত বা বুকের পাটা থাকা সম্ভব নয়। ফলে নিতান্ত নিরুপায় হয়েই তারা গুলি ছুঁড়ছে। হতাহতের ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা চালানোর অনীহাই নাকি প্রকাশ পাচ্ছে বেশির ভাগ পুলিশ সদস্যদের মাঝে। বিষয়টিই আবার আন্দোলনকারীদের মনোবলও চাঙ্গা করে চলছে।  

আলোচনায় সুবিধা পেতে অন্য আরেকটি খবর আগেভাগেই জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে মার্চের মাঝামাঝি নাগাদ মায়ানমারের আন্দোলনে চীনের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার সমমানের। শোনা যাচ্ছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হুমকির মুখে। চীন মূলত মায়ানমারকে তার দক্ষিণ ও দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল ট্রানজিট ঘাঁটি বানাতে চেয়েছিল। এই অর্থনীতিকে আরও সুনিশ্চিত করতে গিয়ে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন তৈরি করা দরকার ছিল। মূলত সে জন্যই ২০১৭ সালে এক বিশাল বিস্তৃত রাখাইন এলাকায় চারশরও বেশি গ্রামের পর গ্রা্ম আগুনে জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। এগারো লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রিত হতে হয়। অং সান সু কি নিজেই সেই প্রক্রিয়ায় জড়িত। পেছনে ছিল উগ্র বামার জাতীয়তাবাদী ভাবনা। 

মায়ানমারে উগ্র বামার জাতীয়তাবাদী ভাবনা নির্মাণ মূলত সেনাবাহিনীই কাজ। ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীর মধ্যে কয়েকশত বিবাদমান সশস্ত্র দলকে সক্রিয় রাখার পেছনেও সামরিক বাহিনীর হাত থাকে বলে ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন। তাতে করে সাধারণ নাগরিকদের এই বিশ্বাস ও বোধ বিলানো যায় যে সেনাবাহিনীর অতিক্ষমতায়ন জারি না রাখলে দেশটি খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়বে। মায়ানমারের জনগণকে এভাবেই ভাবতে শেখানো হয়েছিল—‘সেনাবাহিনীকে প্রভূত ক্ষমতা না দিলে এইসব সশস্ত্র জঞ্জাল কে ঠেকাবে? এই উগ্র জাতীয়তাবাদী বোধের কারণেই মায়ানমারের আপামর জনতা রোহিঙ্গা নিধনের ভয়াবহতার মাঝেও সামান্যতম মানবিক হয়ে ওঠতে শেখেনি। 

ছয়টি দশক জুড়ে সামরিক বাহিনী উগ্র বামার জাতীয়তাবাদী আদর্শের আফিমে বুঁদ করে রেখেছিল মায়ানমারবাসীদের। সেই আফিমের ঘোর কাটতে শুরু করেছে। সেনা ও পুলিশের হিংস্রতা ও মনোবলে ভাঙ্গন, এবং জনতার উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রশ্ন করতে শুরু করার অধ্যায়টি নিঃসন্দেহে ইতিহাসের একটি কৌতুহলোদ্দীপক মোড় হয়ে থাকবে। রালফ ডাহরেন্ডর্ফ দেখিয়েছিলেন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব্ব একচ্ছত্র হয়ে গেলে নিজেই নিজেকে বিনাশ শুরু করে। মার্ক্সীয় ‘পুঁজিবাদ নিজের ভেতরেই নিজের কবর খুঁড়ে ফেলার শর্ত তৈরি করে’ ধারণাটিকেই ডাহরেন্ডর্ফ ভিন্নতর প্রেক্ষাপটে ভিন্নতর আলোকে বলেছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের চরিত্র একই রকম। অনেকটা ল্যাটিন আমেরিকার র‍্যাট স্নেইকের মত। এই সাপটি নিজেরই লেজ খাওয়া দিয়ে শুরু করে নিজেকেই খাওয়া শুরু করে। মায়ানমারে সেই লক্ষণ মাত্র ফুটে উঠতে শুরু করেছে।          

    

আনোয়ার আরাকানি দুই দশকেরও আগে কানাডায় স্থায়ী হয়েছেন। তিনি একজন রোহিঙ্গা। বর্তমানে কানাডায় রোহিঙ্গা সমাজের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও মানবাধিকার আন্দোলনের প্রতিনিধি। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে কানাডার কনফ্লিক্ট অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইন্সটিটিউট সেনাঅভ্যুত্থানের ভবিতব্য বিষয়ে একটি আলোচনার আয়োজন করে। সেই আলোচনায় আরাকানি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তাঁর ভাষ্য ছিল আমাদের নাগরিক গণতন্ত্রের সুসভ্য সংজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গির মানদণ্ডগুলো মায়ানমারের আন্দোলন আলোচনার বেলায় খাটবে না। সেনাবাহিনীর বেলায় তো একেবারেই না। বাষট্টি বছর যে সেনাবাহিনী ক্ষমতায়, তারা নির্দ্বিধায় জনগণকে খুন করতে পারে বলেই এতটা দীর্ঘসময় ক্ষমতার ভরকেন্দ্র আঁকড়ে থাকতে পারছে। মানুষ মারা এবং পাখি মারার মধ্যে পার্থক্য করতে পারবার মত মানস-গড়নও এই সেনাবাহিনীটির নেই। তাদের গড়েই তোলা হয়েছে সেভাবে। এবারও তাই তারা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই যে কোন আন্দোলন সংগ্রাম নিষ্ঠুরভাবে দমিয়ে ফেলবে। চাই কি শয়ে শয়ে জনতা মরলেও মরবে, মারতে হয় মারবে।  

একই ইন্সটিটিউট ফেব্রুয়ারির শেষদিকেও আরেকটি সংলাপের আয়োজন করে। লন্ডনভিত্তিক রোহিঙ্গা মানবাধিকার আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তুন খিনও মতামত জানিয়েছিলেন যে মায়ানমারের মিলিটারি একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমন একটি দূর্ভেদ্য অবস্থান তৈরি করেছে যাতে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কাছ হতে মানবিকতা আশা করা নিতান্তই বোকামি হবে। তবে, দুর্ভেদ্য দেওয়ালেও ফাটল ধরতে পারে। রোমান, হান, মিশরিয়, পারসিক সাম্রাজ্য ইত্যাদি ধ্বংস হয়েছে। 

মায়ানমার আধুনিক রাষ্ট্রের ছকে পড়ে। তাহলে সাম্রাজ্যের কথা কেন? 

সাম্রাজ্যের কথা এ জন্য যে রাইজ অ্যান্ড ফল অব এম্পায়ার্সএর একটি গড়ন মায়ানমারের বেলায় কার্যকর রয়েছে যা আমরা সমাজবিজ্ঞানীরা এতদিন খুব একটা আমলে নিই নি। সাম্রাজ্যবিস্তারের  কাজটি করে চলছিল চীন, মায়ানমার নয়। মায়ানমার ক্রীড়নক। সোজা কথায় মায়ানমার চীনের দাবার ঘুটি। চীনের সাম্রাজ্য বিস্তারের ফর্মটি আধুনিক। কিন্তু সাম্রাজ্যধর্মী চরিত্রটি ধ্রুপদী ও পুরনোই বলা চলে। সাম্রাজ্যে জনগণ গৌণ। তাঁরা সাবজেক্ট বা প্রজা। সিটিজেনস বা নাগরিক নন। গ্রিক নগর রাষ্ট্র আদি গণতান্ত্রিক বলেই আধিবাসীরা ছিল নাগরিক। রোমান, হান, পারসিক, মোগল সব সাম্রাজ্যেই জনগণ প্রজা। প্রজার হাতে পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকে না। 

সাম্রাজ্য একটি মধ্যযূগীয় ধারণা হলেও অ্যাকাডেমিয়ায় এটিকে এখনও একটি সিস্টেম জ্ঞান করা হয় সেটি আমাদের জানা। এই সিস্টেমের মুলে থাকে পাঁচটি প্রপঞ্চ। প্রথম্‌ নেটওয়ার্ক। দ্বিতীয়ত, অর্থ ও অর্থকরী অর্থনীতি। তৃতীয়ত, শক্তিমত্তা বা মাইট, সংক্ষেপে পেশিশক্তি। চতুর্থত, নিয়ন্ত্রণক্ষমতা বা পাওয়ার অব কন্ট্রোল। পঞ্চমত, একটি ভাবাদর্শ বা আইডিওলজি। 

উপরের পাঁচটির সুসমন্বয় দিয়েই সাম্রাজ্য টিকে থাকে। একটিতে টান পড়লে বা ভাঙ্গন শুরু হলে অন্যগুলোতেও টান পড়ে। কান টানলে মাথা আসার মত। একটি উদাহরণ, ভারতে ব্রিটিশ শাসন মোগল সাম্রাজ্যে প্রথম ফাটল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ব্যবসার অনুমতিটি না দিলে মোগল সাম্রাজ্য হয়ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্তই টিকে থাকত। ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে ইওরোপিয় রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্পর্শে না এলে মোগল সামন্তরাজগণ (রাজা, জায়গিরদার, সুবাদার ইত্যাদি) স্থানে স্থানে বিদ্রোহ, ভাঙ্গন, স্বাধীনতা ঘোষণার ইন্ধন পেতেন না। আরও পরে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবোধ ও আধুনিক স্বদেশচিন্তাও অতোটা সাত-তাড়াতাড়ি তৈরি হওয়ার বা পরিণতি পাবার ঘটনা ঘটত না। 

প্রসংগক্রমে সাম্রাজ্যের উত্থান এবং টিকে থাকার পঞ্চম শর্ত বা ভাবাদর্শ সম্পর্কেঅর্থাৎ সব শেষ শর্তটি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা দিয়ে রাখা প্রয়োজন। ইওরোপিয় হিস্টরিওগ্রাফিতে উল্লেখিত ম্যাস কনভার্শন ধারণা দিয়ে আইডিওলজিকে ভালভাবে বুঝা যায়। যেমন সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সেটি টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণকে একটি ভাবনার জালে আটকে ফেলা প্রয়োজন হয়। যেমন, ধর্মান্তরণ। ভারতিয় উপমাহাদেশে ব্রিটিশদেরও সর্বাত্মক ও ব্যাপক ধর্মান্তরণ প্রকল্প ছিল। কিন্তু, তার আগের সুলতানি ও মোগল শাসনামলে ইসলাম ধর্মে ব্যাপক ধর্মান্তরণের কারণে ব্রিটিশের চেষ্টা হালে পানি পায়নি। তা ছাড়া ইসলামের ধর্মব্যবস্থাটিই ধর্মান্তরণবিরোধী।         

আধুনিক রাষ্ট্রব্যাবস্থায় ধর্মান্তরিতকরণ প্রায় অসম্ভব। তবে ধর্মের আফিম গিলিয়ে ধর্মাশ্রয়ীদের আরও ধর্মাচ্ছন্ন, আরও অনেক  বুঁদ রাখা যায়। মায়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং বামার জাতীয়তাবাদীরা গত এক দশকে এই কাজে অত্যন্ত সফল। ছয় হাজারেরও বেশি বিলাসবহুল ও নান্দনিক সৌন্দর্যের ধর্মশালা ও মঠ-মন্দির প্রতিষ্ঠা করে কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের বাগে নিয়ে আসা গেছে। ভিক্ষুদের উগ্র রোহিঙ্গাবিরোধী এবং মুসলিমবিরোধী করে তোলার প্রকল্পটিও সফল। উগ্র বামার জাতীয়তাবাদ তো আছেই। ফলাফল, সামরিক বাহিনীর রাস্তা পরিষ্কার। ২০০৭-২০০৮ সালে গেরুয়া আন্দোলনে বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলন সম্পুর্ণ বিনষ্ট করা তো সম্ভব হয়েছেই, উল্টো তাদেরকে সেনাশাসনের সহযোগীতে পরিণত করা সম্ভব হয়েছিল। ভাবাদর্শ নির্মাণে আরেকটি কাজ করা যায়। ধর্মের প্রতিবর্তী বা ধর্মের বিকল্প কোন আদর্শের আফিম গেলানো যায়। কোনো রাজনৈতিক আদর্শকে একসময় অনেকের কাছে ধর্মের মতই পালনীয় করে তোলা যায়। সমাজতন্ত্র নাম দিয়ে মায়ানমারে চীনের রাজনৈতিক যে ভাবাদর্শটিকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় যুক্ত করে দেওয়া গিয়েছিল, সেটি আসলে যে কতটা সমাজতন্ত্র, কতটা অর্থনৈতিক আগ্রাসনের কলকব্জা, সেইসব প্রশ্ন এখন উঠছে।     

আসা যাক সাম্রাজ্যের নেটওয়ার্ক, অর্থনীতি, শক্তিপ্রয়োগনীতি বা পেশিশক্তি, এবং নিয়ন্ত্রণক্ষমতা প্রসঙ্গে। ধ্রুপদী সাম্রাজ্যগুলোর সবগুলোই টিকে ছিল এই চারটির ভিত্তিতে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশয়েটিভ (বিআরআই) নেটওয়ার্ক-এর প্রাণ। গভীর সমুদ্রবন্দর, বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা (স্পেশ্যাল ইকোনোমিক জোন-এসইজে), রাখাইন পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন, তেল-গ্যাস পরিবহন সংযোগ স্থাপন, রোহিঙ্গা উচ্ছেদ এবং আরাকান আর্মিকে অস্ত্রশস্ত্র যোগান দেওয়াচীনের ইত্যাদি কর্মযজ্ঞে অন্য চারটি শর্ত যথা অর্থনীতি, শক্তিপ্রয়োগনীতি, এবং নিয়ন্ত্রণক্ষমতার উপস্থিতি স্পষ্ট। চীনের সাম্রাজ্যবিস্তারকামী-অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মায়ানমার সেনাবাহিনীর বাণিজ্য-বেসাতি। এই অদ্ভূত অর্থনীতিকে মিলিটারি-কমার্সিয়াল কমপ্লেক্স প্রপঞ্চ দ্বারা ভাল বুঝা যায়। 

মায়ানমারে সামরিক বাহিনীই অর্থনীতির নিয়ন্তা। মিলিটারি-কমার্সিয়াল কমপ্লেক্স এতটাই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে  দেশরক্ষার ধ্রুপদী দায়িত্ব বাদ দিয়ে সেনাবাহিনী বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কলকারখানা এবং বহুজাতিক লগ্নির সুবিধাভোগী অসংখ্য কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনার শীর্ষ দায়িত্ব কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। আমোস পার্লমুটারের বিখ্যাত তত্ত্ব তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকারী সামরিক বাহিনী প্রিটোরিয়ান স্যোলজারপ্রিটোরিয়ান গার্ডরা প্রাচীন রোমের রাজড়াদের সুরক্ষকের দায়িত্ব পালন করার নামে খবরদারিতে নেমে মুল ক্ষমতাই কব্জা করে  নিত। তাঁর এই তত্ত্বের ছক ভেঙ্গে নতুন উদ্ভাবনী প্রকরণে চলে গেছে মায়ানমারের রাজনৈতিক সেনাবাহিনী। পার্লমুটার মিলিটারি-কমার্সিয়াল কমপ্লেক্স ভাবনায় আনতে পারেননি। অথচ মায়ানমারে সেটি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।       

মায়ানমার আধুনিক রাষ্ট্র। সুতরাং, জনগণ নাগরিক। আবার মায়ানমারের চরিত্রটি দাঁড়িয়ে গেছে চীনের কৌশলগত সাম্রাজ্যের অধীন বশংবদ করদ রাজ্যের মত। সামরিক শাসকদের চরিত্রের সঙ্গে মোগল সাম্রাজ্যের নবাবদের চরিত্রের অনেকটাই মিল। এই কারণে মায়ানমারের জনগণ আধা-নাগরিক, আধাআধি প্রজা। তাই দেশটিতে জনগণ এক ধরনের গৌণ রাষ্ট্র-উপাদান। জনগণ গৌণ মানেই জনরাজনীতি গৌণ। 

সামরিক বাহিনীর আধিপত্য বজায় রাখতে জনগণের রাজনীতিসম্পৃক্ততা বা রাজনীতি-ভাবনাকে শত উপায়ে গৌণ করে রাখতেই হয়। অর্থাৎ রাজনীতি তখন টিকে থাকে শুধুমাত্র ক্ষমতার ভরকেন্দ্রেই। সম্রাট, রাজা, মহারাজা, বা হালের মহারাজা সামরিক শাসকরাই যখন ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের রাজনীতিতে একক শক্তি হয়ে ওঠেন, তখন জনরাজনীতি থাকে না। রাজনীতির নামে যা থাকে সেটি উপরমহলের কূটনীতি মাত্র। সেনাকূটনীতির জন্য গুটিকয় শীর্ষ সেনাশাসকের প্রশিক্ষিত হওয়াই যথেষ্ঠ। সুবিশাল সেনাবাহিনী সে ক্ষেত্রে অন্ধকারেই থাকে। ফলে যখনই তারা আন্দোলন দমনের জন্য স্বজাতি-সদস্যদের  নির্বিচার হত্যার নির্দেশ পায়, তাদের মানসপটে ভেসে ওঠে স্বদেশের মানুষের মুখ। পরিবার-বন্ধু-স্বজনদের মুখ। ট্রিগারের আঙ্গুল সরে সরে আসে। 

 

মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স-এ অস্ত্রশস্ত্র বা যুদ্ধসরঞ্জাম-নির্মাণকারী শিল্পায়ন-এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর অবিচ্ছেদ্য-অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই ব্যবস্থার সুবিধাভোগী হয় সকল সেনাসদস্যই। কোনো দেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ সামরিক খাতে বরাদ্দ হলে জনগণের স্বাস্থ্য-শিক্ষা-চিকিৎসা ও জীবনমানের বরাদ্দ কমে যায়। ফলে জনগণ-এর মাঝে সেনাবাহিনী বিদ্বেষ তৈরি হয়। কিন্তু, সেনাদের সকলেই সুবধাভোগী থাকায় ব্যারাকের সংহতি দৃঢ় হয়। কিন্তু মিলিটারি-কমার্সিয়াল কমপ্লেক্সএর বেলায় বিষয়টি উলটো। ব্যবসার আকাশ্চুম্বি লাভ গিয়ে জড়ো হয় উপরতলার সেনা অফিসারদের গোলায়। নীচের দিকের সেনাসদস্যরা ভাগ না মেলায় নিজেদের বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার মনে করে। ফলে তাদের মনে না-পাওয়ার ক্ষোভ জমা হয়। 

থিওডর ম্যাক্লছলিনসহ বিভিন্ন সামরিক বাহিনী গবেষকদের  ইন-গ্রুপ ও আউট-গ্রুপ ধারণার মাধ্যমে বিষয়টি পরিস্কার বুঝা যায়। সুবিধাপ্রাপ্ত (ইন-গ্রুপ) ও বঞ্চিত (আউট গ্রুপ) এই দুই ভাগ পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানে ১৯৬০-৬৫ সালে, জর্ডানে ১৯৬০ সালে, সিরিয়ায় ১৯৬০ এবং ১৯৭০ সালে, বাংলাদেশে ১৯৭২-১৯৭৪ সালে এবং ইরানে ১৯৭৮ সালে, ইরাকে ১৯৯৫ সাল হতে ২০০০ সালের মধ্যে সেনাবাহিনীতে ব্যাপক ইন-গ্রুপ আউট-গ্রুপ বিভাজন দেখা যায়। এ সমস্ত ক্ষেত্রে গণআন্দোলন ও জনআন্দোলনে আউট-গ্রুপ সাধারণ জনতার পক্ষ নেয়। তারা জনগণের প্রতি তাক করা ট্রিগার হতে আঙ্গুল সরিয়ে নেয়। সময়ে সময়ে জনগণের সঙ্গে যোগও দেয়। মায়ানমারেও গণআন্দোলনে আউট-গ্রুপ এর উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান নামে একটি ধারণার সঙ্গে আমাদের পরিচয় রয়েছে। এখনই না হলেও এক সময় মায়ানমারে সিপাহী-জনতার সংহতি তৈরি  হওয়াও হয়ত খুব অসম্ভব নয়। এ বছর মায়ানমারের গণ-আন্দোলনকালে কয়েকজন সেনা ও পুলিশ সদস্যদের স্বপক্ষত্যাগ সে রকম ইংগিতই দেয়। অর্থনৈতিক স্বার্থকে আরও ক্ষতির মুখে পড়তে না দিতে চাওয়া চীন ও শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের শক্তিপ্রয়োগ নীতির প্রতি সমর্থন দানও বন্ধ করে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে মায়ানমারে জনতার মনোবল আরও বাড়বে, এবং আন্দোলন আরও বেশি গতি পাবে। 

মায়ানমারের এবারের গণআন্দোলন জনগণ ও গণতন্ত্রের পথে ইতিবাচক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। মায়ানমারের ডিফেকশন সিন্ড্রোম কৌতুহলোদ্দীপক ফলাফলও বয়ে আনতে পারে।

 

ছবি সূত্র: ইন্টারনেট

 

Helal Mohiuddin is a Professor in Political Science and Sociology at the North South University, Bangladesh. He authored five books—The Rohingya Crisis: Analyses, Responses and Peacebuilding Avenues (co-authored, Lexington Books, 2020), Livelihood and Survival Strategies (Focus Books, 2008), Occupational Health Hazards of Bangladesh Garment Workers (Co-authored, CASS, 2007), নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক সমাজততত্ত্ব (সেণ্টার ফর অ্যাপ্লায়েড সোস্যাল স্টাডিজ, ২০০৭) and Total Sanitation: A Community Stake (Coauthored, NGO Forum, 2006).

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!