মেঘদল ও কোক স্টুডিও’র বনবিবি

Share this:

কোক স্টুডিও দ্বিতীয় সিজনের দ্বিতীয় গানের শিরোনাম ‘বনবিবি’। গানের শুরুতেই ইউটিউবের পর্দায় ভেসে ওঠে গানটি সম্পর্কে সূচনা বক্তব্য : ‘সুলতানের রং-তুলি অথবা খনার বুলি আজও আমাদের ডেকে নিয়ে যায় পাহাড়, সমুদ্রঘেরা প্রকৃতিতে পরম ভালোবাসায়। এই ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের এই গান’। সূচনা বক্তব্যেই প্রথম প্রশ্ন যেটি মাথায় আসে, তা হচ্ছে- সুলতানের রং-তুলি বা খনার বুলিতে আমরা যে প্রকৃতিকে পাই, সেখানে আসলে পাহাড় ও সমুদ্র কতখানি আছে? সুলতানের ছবি বললেই সবার আগে কোন বিষয়টি মাথায় আসে? বিশালাকায় পেশিওয়ালা মানুষ। গ্রামবাংলার মানুষ, ফসলের মাঠে, কিংবা বাড়ির আঙিনায় কর্মরত মানুষ। কিষান-কিষানি। সুলতানের ছবিতে পাহাড়, সমুদ্রের প্রকৃতি দেখেছি কি কখনও কিংবা খনার বচনে পড়েছি বা শুনেছি? গানটিতে ব্যবহৃত খনার বচনেও পাহাড় ও সমুদ্রের প্রকৃতি কোথায়? বিভিন্ন ঋতুতে গ্রামবাংলার প্রকৃতি আর তাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ মানুষের জীবন-জীবিকাই কি প্রধান বিষয় নয়? অথচ, কোক স্টুডিও গানের সূচনা বক্তব্যে সেই ’গ্রামবাংলার’ বা গ্রামীণ জীবনের কোনো উল্লেখ নেই। সাধারণভাবে কোনো একটি শিল্পে, সাহিত্যে বা গানে তথা এর সূচনা বক্তব্যে ’কী নেই’- তা নিয়ে আপত্তি তোলা যায় না, বরং ’কী আছে’ আলোচনাটি সেদিকেই নিবদ্ধ রাখাই শ্রেয়, কিন্তু এখানে বাংলার প্রকৃতি বলতে ’গ্রাম-বাংলা’ বা ’গ্রামীণ জীবন’ বাদ দিয়ে কেবল ’পাহাড়-সমুদ্র’-কে নিয়ে আসার বিষয়টি আলাদাভাবে উল্লেখ করছি, কেননা এর মধ্য দিয়ে কোক স্টুডিও’র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য তথা তার টার্গেট অডিয়েন্স সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া সম্ভব। এই টার্গেট অডিয়েন্স হচ্ছে, শহুরে উচ্চ-মধ্যবিত্ত তথা উচ্চবিত্ত- যাদের কাছে বাংলার প্রকৃতি বলতে ঐ পাহাড় বা সমুদ্রই, যেখানে তারা ছুটি-ছাটায় বেড়াতে যেতে পারে, প্রকৃতিকে ’উপভোগ’ করে! কিংবা বড়োজোর শহুরে ’ইন্টালেকচুয়াল’ মধ্যবিত্ত শ্রেণি- যারা বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, লোকশিল্প এসবেরও স্বাদ নিতে আগ্রহী! বলাই বাহুল্য, এই স্বাদ গ্রহণ তারা করে নিজেদের রুচিমাফিক, সে অনুযায়ী তারা ’ব্লেন্ড’ করতে বা মিশাল দিতে পছন্দ করে। কোক স্টুডিও’র যাবতীয় পরিবেশনার মাঝেই এই ’ব্লেন্ডিং’ ব্যাপারটা মুখ্য, মিউজিকের ক্ষেত্রে যেই ট্রেন্ডকে আমরা বলছি ফিউশন। কোক স্টুডিও এই ব্লেন্ডিং কেবল পাশ্চাত্য ও দেশীয় মিউজিকের মাঝেই করে না, কেবল নানান গানের ব্লেন্ডিং-ই করে না, মানুষের চাহিদা-রুচি এসবেরও ব্লেন্ডিং তারা করে। আর সে কারণেই সুলতান ও খনার বচনে তারা সাগর-পাহাড়ের প্রকৃতি দেখতে পায়! এ কারণেই, গানটির শিরোনাম ’বনবিবি’ হলেও পুরো গানটির কোনো জায়গাতে, এমনকি সেই সূচনা বক্তব্যেও ’সুন্দরবন’ বা বন-জঙ্গলের কোনো রকম উল্লেখ নেই, নেই বনবিবির মিথের সাথে কোনো সম্পর্ক (ইউটিউবের ডেসক্রিপশন বক্সে অবশ্য সুন্দরবনের উল্লেখ বাদ দিয়ে বনবিবি মিথ সম্পর্কে দুই লাইনে কিছুটা বলা হয়েছে)! তো, গানটিতে আমরা কোন বনবিবিকে দেখতে পাই? সেদিকে যাওয়ার আগে আমাদের এই লৌকিক দেবী এবং তাকে নিয়ে প্রচলিত মিথ সম্পর্কে একটু জেনে আসি।

বনবিবি কে?

বনবিবি হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত সুন্দরবন অঞ্চলে মৎস্যজীবী, মধু-সংগ্রহকারী ও কাঠুরিয়া জনগোষ্ঠীর দ্বারা পূজিত এক লৌকিক দেবী। সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী- সুন্দরবনকে কেন্দ্র করেই যাদের জীবন ও জীবিকা চলে, তারা বাঘ, ডাকাত, সাপ, কুমিরসহ সমস্ত বিপদ-আপদ, এমনকি বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও রক্ষা পেতে এই বনদেবীকে ডেকে থাকে, বনদেবীর পূজা করে থাকে। এই বনবিবি কি হিন্দুধর্মের কোনো দেবী? কোনো হিন্দুশাস্ত্র, কোনো ধর্মীয় পুরাণে এই দেবীর উল্লেখ নেই, সুন্দরবন অঞ্চল বাদে অন্য কোনো অঞ্চলেও এই দেবীর পূজা হয় না। তারও চেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, সুন্দরবন অঞ্চলের হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই বিপদে-আপদে এই বনবিবিকে ডেকে থাকে, বনবিবির পূজাতেও অংশ নেয়। এই পূজার জন্য কোনো পুরোহিতের দরকার হয় না, কোনো বিশেষ মন্ত্রও উচ্চারিত হয় না। পূজার সময়ে বনবিবিকে নিয়ে লোকজ লোককাহিনি সংবলিত পুঁথি পাঠ করা হয়। হিন্দুরা কেউ নিজেদের মতো নিজস্ব মন্ত্র পড়তেও পারে, যেমন মুসলিমরা নিজেদের মতো করে দোয়া-দরুদ, নামাজের সুরা এসবও পাঠ করতে পারে, এর পরে বনবিবির কাছ থেকে বন-জঙ্গলের বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা কামনা করে।

বনবিবির মিথ

বনবিবিকে কেন্দ্র করে সুন্দরবন অঞ্চলে অনেকগুলো মিথ প্রচলিত রয়েছে। ’বনবিবির কেরামতি’ ও ’বনবিবির জহুরানামা’ নামে দুটো লোকসাহিত্য প্রচলিত আছে। মঙ্গলকাব্যের ধাঁচে লেখা ’বনবিবির জহুরানামা’য় আল্লাহ্-রসুল, মক্কা, পির-পিরানি প্রভৃতি প্রসঙ্গও যুক্ত হয়েছে। বনবিবির লোককাহিনি বা মিথ অনুযায়ী বনবিবির বাবা ইব্রাহীম (বা বেরাহিম) আরব থেকে আগত এক সুফি। তার দুই স্ত্রী গুলালবিবি ও ফুলবিবি (স্ত্রীদের নাম স্থানীয় বা বাংলা নাম হলেও মিথ অনুযায়ী তারাও মদিনা থেকে আগত)। গুলালবিবি যখন সন্তানসম্ভবা তখন ফুলবিবির চক্রান্তে ইব্রাহীম গুলালবিবিকে সুন্দরবনের গহীন বনে রেখে আসেন। সেখানে গুলালবিবির দুই সন্তান জন্ম নেয়, বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী। বনবিবি জন্মের পর থেকেই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হন, সুন্দরবনের পশুপাখিসহ সকলের সাথে তার সখ্য হয়, বা সকলেই তার আনুগত্য স্বীকার করে। এর পরে সুন্দরবনের রাজা বা দানবরাজা বা ডাকাতরাজা দক্ষিণরায়ের সাথে যুদ্ধ হলে তাকে বনবিবি ও তার ভাই শাহ জঙ্গলী মিলে পরাজিত করেন। এই দক্ষিণরায় কোথাও ডাকাত রাজা, আবার কোথাও একজন বহুরূপী, যে বাঘের বেশ ধর সুন্দরবনে বিচরণ করে। এসব লোককাহিনিতে আরেকটি কাহিনিও ঘুরেফিরে আসে। দুখে নামে এক দরিদ্র মেষপালক বালক তার বিধবা মায়ের সাথে বাস করত। দারিদ্রের কারণে সে মৌলীদের (মধু-সংগ্রহকারী) সাথে সুন্দরবনের গভীরে ফুটফরমাশ খাটতে যেত। সেই গ্রামে ধনাই ও মনাই নামের দুই মৌলী ভাই বাস করত। একবার ধনাই সাত নৌকায় করে ঘন জঙ্গলে মধু সংগ্রহে যেতে চাইলে তার ভাই রাজি না হলে, তখন সে দুখেকে সাথে নিয়ে রওনা দেয়। দুখে যখন তার মা-র কাছে বিদায় নিতে যায়, মা তাকে বলে- যেকোনো বিপদে যেন বনবিবিকে স্মরণ করে। এর পরে, গহীন জঙ্গলে যখন ধনাই-দুখে পৌঁছে, তখন ডাকাতরাজ দক্ষিণরায়কে কোনো রকম উপঢৌকন না দিয়েই তার সীমানায় প্রবেশ করায় দক্ষিণরায়ের তোপের মুখে পড়ে। দক্ষিণরায় স্বপ্নে হাজির হয়ে ধনাইকে জানায়, সে কোনো মধু তো সংগ্রহ করতে পারবেই না, উল্টো তার নৌকা ডুবিয়ে দিবে। একটাই উপায়, দক্ষিণরায়ের উদ্দেশ্যে নরবলি দিতে হবে, তাহলেই সে প্রচুর মধু নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে। তখন ধনাই লোভে পড়ে ও প্রাণের ভয়ে দুখেকে বলি দিতে রাজি হয়। এর পরে দুখেকে সেই জঙ্গলে রেখে প্রচুর মধু নিয়ে ফিরে আসে। একাকী দুখের সামনে যখন দক্ষিণরায় বাঘের বেশে হাজির হয়, তখন দুখে বনবিবিকে ডাকে। বনবিবি চলে আসেন। বনবিবি সব দেখে রেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলে দক্ষিণরায় পালিয়ে গাজি পিরের আস্তানায় আশ্রয় নেয়। বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী সেখানে হাজির হলে গাজি পির বনবিবিকে বুঝিয়ে তার রাগ থেকে নিবৃত্ত করেন ও বনবিবি দক্ষিণরায়ের প্রাণভিক্ষা করেন। দুখেকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিলে, দুখের মাধ্যমেই এই কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে এবং দুখে বনবিবির পূজাকে সেই অঞ্চলে জনপ্রিয় করে তোলে। এই মিথগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এখানকার চরিত্রগুলো হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মেরই। ’বনবিবি জহুরানামা’র লোককাব্যগুলোর রচয়িতার মাঝে মুসলিম কবিও রয়েছে। বনবিবির বাবা-মা আরব থেকে আগত, বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গলী মুসলিম। বনবিবি কি হিন্দু নাকি মুসলিম? হিন্দুদের পূজিতা মূর্তিতে তার গায়ের রং হলুদ, মুকুট, কণ্ঠহার ও বনফুলের মালা পরিহিতা এবং লাঠি অথবা ত্রিশূলধারিণী। অন্য দিকে, মুসলমান সমাজে বনবিবিকে মা যেমন বলা হয়, তেমনি দেবীর বদলে পিরানি (পিরের স্ত্রী বা নারী পির) হিসেবেও বনবিবি পরিচিত। তাদের তৈরি মূর্তিগুলিতে বনবিবি টিকলির সঙ্গে টুপি পরিধান করেন, চুল বিনুনি করা, ঘাগরা-পাজামা বা শাড়ি এবং জুতা পরিহিতা। (সূত্র : বাংলা উইকিপিডিয়া)।

ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলের অবস্থিত দয়াপুর বনবিবি মন্দির। বনবিবির পাশে দাড়িওয়ালা, পাগড়ি-পাঞ্জাবি-পাজামা পরিহিত মুসলিম পুরুষ মূর্তিটি বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গলী। (ছবি ক্রেডিট : বাংলা উইকিপিডিয়া)

কোক স্টুডিও’র বনবিবি

কোক স্টুডিও গানটির নাম ’বনবিবি’ হলেও পুরো গানে বনবিবির উল্লেখ মাত্র একটি ছত্রে, মাত্র একবারই। গানের একদম প্রথম লাইনেই জহুরা বাউল গান (পরে শিবু কুমার শীলও একই লাইন দিয়ে তার অংশের গান শুরু করেন)- ’বনবিবির পায়েরে- ফোটে বুনো রোদের ফুল’, ইংরেজি সাবটাইটেলে ভেসে ওঠে- “At Bonobibi’s feet, bloom flowers of feral sunlight”। এর পরে যেহেতু বনবিবি বা সুন্দরবন বা বন-জঙ্গলের কোনো উল্লেখ নেই (গহীন জঙ্গলে তালে তালে ময়ূর নাচে- এমন একটি লাইন আছে অবশ্য, বাংলাদেশের জঙ্গলে কি এখন ময়ূর আছে নাকি?), ফলে এই একটি মাত্র বাক্যের মধ্য দিয়ে আমরা যে বনবিবিকে পাই, তিনি কোন বনবিবি? তিনি কি মিথিকাল বনবিবি, যিনি সুন্দরবনের অধিবাসীদের বাঘ ও অন্য সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন? নাকি, বনবিবি সুন্দরবন রক্ষাকারী কোনো দেবীমাতা? (যেভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন নাটিকা, গানে বনবিবিকে দেখেছি)! এই গানে ’বনবিবি’র উল্লেখ সেই এক ছত্রে থাকলেও, গানের ইউটিউব ভিডিওতে আমরা সবুজ মণিযুক্ত চোখের অধিকারী এক নৃত্যরতা আকর্ষণীয়া-মোহময়ী নারীকে ’বনবিবি’র রূপে দেখি। সে নারীর চেহারা, শারীরিক গঠন (ফিগার), বেশভূষা, কিংবা তার নৃত্যের কলা- কোনোকিছুর মাঝেই সেই গ্রামীণ বা গ্রাম্য- কোনো ব্যাপার নেই। এই পারফর্মেন্সের জন্য নেওয়া হয়েছে মডেল শিরীন আক্তার শীলাকে, যিনি ফেস অব বাংলাদেশ নামের বিউটি কনটেস্ট প্রতিযোগিতার ২০১৯-এর চ্যাম্পিয়ন এবং মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ প্রতিযোগিতারও একজন প্রতিযোগী! সুলতানের রং-তুলিতে যে ’গ্রাম্য’ নারী দেখি, খনার বচন যে গ্রামীণ জীবনকে তুলে ধরে- এমনকি শিবু কুমার শীলের অংশে যে তামাটে কিষানির কথা বলা হয়, সব ছাপিয় ‘বনবিবি’ চরিত্রে মোহনীয় পারফর্মেন্স করে শহুরে আকর্ষণীয়া এক নারী! ফলে, সুন্দরবনের জনগোষ্ঠীর কাছে রক্ষাকর্তী দেবীমাতা থেকে কোক স্টুডিও’র ’বনবিবি’ হয়ে ওঠেন শহুরে মিডলক্লাস-আপার ক্লাস অডিয়েন্সের আরাধ্য, কামনীয় এক নারী। কোক স্টুডিও’র এই ’বনবিবি’ তাদের টার্গেট অডিয়েন্সের জন্য রোমান্টিসাইজড তথা ফ্যান্টাসাইজড এক ’দেবী’, যার পায়ে বুনো রোদের ফুল ফোটে!

কোক স্টুডিও’র বনবিবি, পারফর্ম করেছেন মডেল শিরিন আক্তার শীলা। ফটো ক্রেডিট : শিহাব মোহাম্মাদ।

’বনবিবি’ গানের ব্যবচ্ছেদ

বনবিবিকে উপস্থাপনের সমস্যাটিকে উপেক্ষাও যদি করি, গানটি শুনতে কেমন লাগল? গানটিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে জহুরা বাউলের গলায় উচ্চসুরে ’বনবিবি’র পায়েরে, ফুটে বুনো রোদের ফুল’ লাইনটির পরেই শুরু হয় খনার বচন। জহুরা বাউল, সূচনা শেলি, নাবিয়া মিতুল, ফারজানা ইভা, ডলি মণ্ডল ও প্রিয়া বিশ্বাস কোরাস করে ছন্দে ছন্দে খনার চারটি বচন দুবার করে গায়। দ্বিতীয় ভাগে- ব্যান্ড মেঘদলের শিবু কুমার শীলের গাওয়া অংশ। আর তৃতীয় ভাগে- জহুরা বাউলদের কোরাসে গাওয়া গীত। এসবের মাঝে ইনস্ট্রুমেন্টাল মিউজিক আছে, কুলায় চাল/ধান ঝাড়ার শব্দ আর উড়ুন-গাইনের শব্দ আছে। সবমিলে গানটি ৭ মিনিট ২০ সেকেন্ডের। একটা গানের জন্যে যথেষ্ট সময়, কিন্তু কোক স্টুডিও’র এমন জোড়াতালির গান- যেখানে খনার বচন, গীত ও ব্যান্ডের পরিবেশনাকে ’ব্লেন্ডিং’ করা হয়েছে, তার জন্য বেশ কম। প্রথম ও তৃতীয় ভাগে জহুরা বাউল ও অন্যদের কোরাসে গাওয়া খনার বচন আর গীত অংশটুকু এত কম হয়ে গিয়েছে যে, ঠিকভাবে মন ভরে না, আরও বেশি শুনতে মন চায়, ফলে যখনই সেই খনার বচন বা গীত থেকে সুইচ করে শিবু কুমার শীল গাওয়া শুরু করেছে, এক রকম বিরক্তিই যেন তৈরি হয়! এর বড়ো কারণ হচ্ছে- গানের কথায় ও সুরে, এবং গায়কিতে কোরাস অংশ আর শিবু কুমার শীলের অংশের মাঝে এমনই বিস্তর ফারাক যে, এক পার্ট থেকে অন্য পার্টে জাম্প এমনই এবরাপ্ট ও বেখাপ্পা লাগে এবং মনে হয় সম্পূর্ণ আলাদা দুটো গানকে জোর করেই যেন জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে, পরিবেশনাটি মোটের ওপরে জোড়াতালির জোড়াই হয়েছে, একটি পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ গান হয়ে উঠতে পারেনি। যদিও আগাগোড়া সম্পূর্ণ পরিবেশনাটির কম্পোজিশন এককভাবে মেঘদলেরই করা!

কোক স্টুডিও’র গান

কোক স্টুডিও’র গানগুলো শুনতে গেলে প্রধানত তিনটি বড়ো সমস্যায় পড়তে হয় :

এক) পুরাতন বিখ্যাত বা পরিচিত গান নতুনভাবে রিমিক্স, রিমেক করা হয় যখন, চেতনে-অবচেতনে অরিজিনাল গানের সাথে এক রকমের তুলনার জায়গা চলে আসে। এমনকি কোনো শিল্পীর গাওয়া পূর্বতন গান কোক স্টুডিওতে যখন নতুন করে গাওয়া হয়, তখনও হয়তো তুলনায় আগের ভার্সনটির চাইতে পানসে লাগতে পারে। অর্ণবের গাওয়া গানের ক্ষেত্রেই এমন অভিযোগ করেছে অর্ণবের অনেক ভক্ত। অনেক সময়ই এই রিমেক-এর ক্ষেত্রে অরিজিনাল গানের যন্ত্র অনুষঙ্গ, গায়কিই শুধু পাল্টে ফেলা হয় না, গানের কথাও কর্তন করা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে ভাবও পাল্টে ফেলা হয়! অনিমেষ রায়ের নাসেক নাসেক অরিজিনাল গান থেকে অনেকগুলো লাইন কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো শিল্পী বা গ্রুপের বিশেষত্বও অনেক সময়ে হারিয়ে ফেলা হয়। জালালি সেটের র‌্যাপ গানের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, গানের মাঝে থাকা স্ল্যাং বা গালাগালি। কিন্তু কোক স্টুডিওতে তাদেরকে গালাগালি সেন্সর করতে হয়েছে, এভাবে মিডলক্লাস ’রুচিশীল’ শ্রোতার উপযোগী হয়ে উঠতে গিয়ে তাদেরকে ’ভদ্র’, ’ভব্য’ ও ’সুশীল’ বনে যেতে হয়েছে।

দুই) একাধিক গানের জোড়া দিয়ে যে পরিবেশনাটি তৈরি করে, সেখানে অধিকাংশ সময়েই ভিন্ন ভিন্ন অংশ কথায় ও ভাবে, সুরে, গানের ধরনে (জনরায়), গায়কিতে এতই আলাদা যে, পরিবেশনাটি হয়ে যায় স্রেফ একাধিক গানের কর্তিত অংশের মাঝে জোড়াতালির জোড়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আলাদাভাবে একটি বা একাধিক তথা সবগুলো অংশই ভালো লাগতেই পারে, কিন্তু তার পরেও সবমিলে একটা পরিপূর্ণ গান হিসেবে পরিবেশনাটি দাঁড়াতে পারে না। প্রথম সিজনের প্রথম পরিবেশনা ’নাসেক নাসেক’-এ অনিমেষ রায় আর পান্থ কানাইয়ের দুটো অংশই আমার ভালো লেগেছিল, কিন্তু শুনে মনে হয়েছিল- দুটো আলাদা গানের অংশ বিশেষ শুনলাম, যার কোনোটিই পুরো শুনতে দেওয়া হলো না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক অংশের তুলনায় আরেক অংশ একটু ভালো লাগলে, যখন ভালো লাগা অংশটি হুট করে বন্ধ করে অন্য অংশে চলে যায়, সেই অংশটি এক রকম বিরক্তি তৈরি করে। হয়তো বা, সেই অংশটিই সম্পূর্ণ আলাদা গান হিসেবে শুনলে এমন বিরক্তি তৈরি নাও হত, বা ভালোও লাগতে পারত। ফলে, এরকম জোড়াতালির মাধ্যমে সেই অংশের গানের প্রতিও এক রকম অবিচার করা হয়!

তিন)  প্রায় ক্ষেত্রেই একাধিক গানের জোড়াতালিতে প্রতিটি অংশের রানটাইম অনেক কমে যায়। তার মধ্যে কখনও কখনও দেখা যায় কোনো একটি অংশের রানটাইম তুলনামূলক বেশ কম। এর মাধ্যমে কেবল সেই অংশের শিল্পীর প্রতিই অবিচার করা হয় না, শ্রোতার প্রতিও এক রকম অবিচার করা হয়। মুশকিল হচ্ছে, কোক স্টুডিও যে টার্গেট অডিয়েন্সের জন্য এই গানগুলো তৈরি করে, তাদের মূলেই রয়েছে আজকের এই অস্থির জেনারেশন। আজকের এই অস্থির জেনারেশন অভ্যস্ত- রিমোর্ট কন্ট্রোলে অসংখ্য টিভি চ্যানেলে ঘুরাফিরা করায়, একের পর এক এফএম রেডিও চ্যানেলে ঘুরে ঘুরে এক গানের একটু অংশ, সেখান থেকে আরেক গান, তার পরে কিছুক্ষণ রেডিও জকির অদ্ভুত উচ্চারণে বাংলিশ কথাবার্তা, একটুখানি বিজ্ঞাপন, এভাবে গান শোনায় অভ্যস্ত। শুরু হয়েছে ৩-৪ মিনিটে দুই-তিন লাইন করে ৮-১০ টি গানের ম্যাশ-আপ, সেসব ম্যাশ-আপ করে কত ইউটিউবার ভাইরাল হয়ে গেল! ফলে কোক স্টুডিও যখন এক-দেড় মিনিট করে একেকটা গানের জোড়া লাগিয়ে একটা পরিবেশনা বানিয়ে ফেলে, সেখানে পুরো গান শুনতে না পেরে যন্ত্রণা বোধ করা শ্রোতাদের জন্যে তাদের এতটুকু চিন্তা না করলেও চলে! তো, শ্রোতাদের জন্যে চিন্তা না-ই হতে পারে, কিন্তু কখনও কখনও শিল্পীর প্রতি অসম্ভব কম রানটাইম দিয়ে এক রকম অপমানিত যে করা হয়, তা মানতে পারা বেশ কঠিনই। অবশ্য, এই কাজটি কেবলমাত্র কোক স্টুডিও বাংলা-ই করে না, অন্যান্য কোক স্টুডিও করে থাকে। কোক স্টুডিও পাকিস্তান যখন আবিদা পারভিন, রাহাত ফতেহ আলী খান বা সানাম মারভি, প্রমুখদের নিয়ে দুজন শিল্পীর পরিবেশনা বানায়, সেখানে ঠিকই রানটাইম বাড়িয়ে নয়-দশ-এগারো মিনিট করতে পারে, ফরিদ আহমেদ ও আবু মোহাম্মাদের পরিবেশনার রানটাইম এমনকি ১৬ মিনিটও করতে পারে, কিন্তু তাদের সর্বশেষ সিজন ১৪-এর গানগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে অধিকাংশ পরিবেশনারই রানটাইম ৪ থেকে ৫ মিনিট। অন্যতম হিট গান ’কানা ইয়ারি’র রানটাইম মাত্র ৪ মিনিট, গানটি গেয়েছে আবার তিনজনে মিলে। যে আব্দুল ওয়াহাব বাগতির গলায় গানটা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগল, তাকেই দিয়েছে সবচেয়ে কম রানটাইম, শুরুর ২০ সেকেন্ডে একটা মাত্র লাইন গাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, আর শেষ দিকে ৩০-৪০ সেকেন্ডে আরও কয়েকটা লাইন।

কোক স্টুডিও বাংলার দ্বিতীয় সিজনের দুটি গানই অবশ্য নতুন গান বা মৌলিক গান- অর্থাৎ প্রথম সমস্যা থেকে মুক্ত। প্রথম গান ’মুড়ির টিন’-এ তিন আঞ্চলিক ভাষায় তিনজন শিল্পী তিনটি অংশ গাইলেও, গানের কথায়, ভাবে ও সুরে এবং বিষয়বস্তুতে একটি পরিপূর্ণ গান হয়ে উঠতে পেরেছে। ফলে, ২য় ও ৩য় সমস্যা থেকেও এটি (এখন পর্যন্ত কোক স্টুডিও বাংলার এই একটি গানই) মুক্ত থাকতে পেরেছে। কিন্তু তাদের দ্বিতীয় গান ’বনবিবি’ মেঘদলের কম্পোজিশনে তৈরি হলেও বস্তুত জোড়াতালির গানই থেকে গিয়েছে। এবং খুবই দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, জহুরা বাউল, সূচনা শেলি, নাবিয়া মিতুলসহ কোরাসে যারা গেয়েছেন, তারা খনার বচন ও গীত- দুটো অংশ গাইলেও রানটাইম পেয়েছেন খুবই কম!

গ্রামবাংলার প্রকৃতি

সূচনা বক্তব্যে পাহাড় ও সমুদ্রের প্রকৃতির কথা বলা হলেও সুলতানের রং-তুলি ও খনার বচনে আসলে গ্রামবাংলা, গ্রামীণ জনপদের জীবন-জীবিকা, ঋতুবৈচিত্র্য এসবই পাওয়ার কথা। তিনভাগে বিভক্ত এই পরিবেশনাটিতে সেই গ্রামবাংলার প্রকৃতিকে কতখানি পাওয়া গেল? চারটি খনার বচনে স্বভাবতই গ্রামবাংলা আসবে, এসেছেও। চারটি বচনই অবশ্য বৃষ্টিকেন্দ্রিক, কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবনে বৃষ্টির ভূমিকা বিশাল, বৃষ্টির সাথে ধানের সরাসরি সম্পর্ক। বচন চারটি বিভিন্ন ঋতুতে/মাসে বৃষ্টির ঘটনা বা সম্ভাবনার কথা জানান দেয়। গীত অংশেও গ্রাম বাংলাকে পাওয়া যায়, সুবোধ সাঁওতাল গ্রামের পাশে সুবাসের জমি ফলায়, মাঝি ঘাটে নোঙর ফেলে, সুলতানের দূর গাঁ থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসে, নববধূর পা মটরশাক পেঁচিয়ে ধরে, আজগর নামের একজন তার শক্ত বাহুতে ধানের আঁটি নিয়ে হাঁটে, জমিলা ঢেঁকিতে গানের তালে তালে পা মারে। দারুণভাবেই গ্রামীণ জীবনকে পাওয়া যায়। কিন্তু শিবু কুমার শীলের গাওয়া ব্যান্ড অংশটুকুতে গ্রামবাংলা অনুপস্থিত, সেখানে পাওয়া যায় শহুরে কোনো কবির কবিত্ব, কিংবা ’ইন্টেলেকচুয়ালিটি’! তার ভাষা, ভাব- কোনোকিছুই পুরো গানের মূল থিম বা গানের বাদবাকি অংশের সাথে একদমই খাপ খায় না। কেবল, এক জায়গায় কিষানির তামাটে শরীর পোড়ে, ঘামে ভেজা মুখ- এর উল্লেখ আছে, এর বাইরে সবটাই কিছু রোমান্টিসিজম আর ফ্যান্টাসিজমে ভরপুর কাব্যময়তা! একদম স্বতন্ত্র গান হিসেবে যদি মেঘদল এটি গাইত এবং সেখানে যদি গ্রামবাংলার প্রাণ-প্রকৃতির ঘোষণা না থাকত, সেটি হয়তো ভালোই লাগত, কিন্তু এই পরিবেশনাটির মাঝে এই অংশটুকু একেবারেই বিশ্রী রকম বেখাপ্পা ও বেঢপই লেগেছে।

তো, ব্যান্ডের অংশটিতে গ্রামবাংলার সাথে সম্পর্কহীন শহুরে ’ইন্টেলেকচুয়াল’ এর গ্রাম নিয়ে ফ্যান্টাসি কীভাবে ঝরে পড়েছে? শিবু কুমার শীল শুরু করেছেন এভাবে- ’বনবিবির পায়েরে- ফোটে বুনো রোদের ফুল/ তামাটে শরীর পোড়ে, কিষানির ঘামে ভেজা মুখ’! এই যে জঙ্গলকে দেবীর পায়ে ফোটা ফুলে আর গ্রামকে কিষানির তামাটে শরীর আর ঘামে মুখে দেখা- এটাই হচ্ছে দূর থেকে বন-জঙ্গল আর গ্রামকে দেখার ফ্যান্টাসি, সুনির্দিষ্টভাবে বললে, একজন পুরুষ কবির ফ্যান্টাসি। তামাটে শরীর তো দেখার কথা বেশি একজন কিষানের, কেননা খালি গায়ে সে জমিতে কামলা খাটে, চাষ করে, ফসল ফলায়- রোদে তার-ই শরীর পোড়ার কথা। অথচ, আমাদের শহুরে পুরুষ কবি কল্পনায় গ্রামকে দেখেন কিষানির তামাটে শরীরে, যেভাবে বনবিবির পায়ে বুনো রোদের ফুল ফুটতে দেখেন! এর পরের লাইনেই গ্রামীণ বৃষ্টির বিবরণ, সেই বৃষ্টি কবির কল্পনায় লাল মেঘ থেকে ঝরে পড়ে ’আদিবাসী কোনো গ্রামে’। এই যে, ’কোনো’ এক ’গ্রাম’- এর মাঝেই আছে, দূর থেকে দেখার বিষয়টি, ঠিক যেন এটি কোনো অভিজ্ঞতা নয়, বরং কল্পনা। আর ’আদিবাসী’ গ্রামের উল্লেখও ’বাঙালি’র আদিবাসীদের নিয়ে এক রকম ফ্যান্টাসির মতো করেই এসেছে। কবি কল্পনায় বৃষ্টি যেমন ঝরে লালমেঘ থেকে, তেমনি তা হয়ে ওঠে কান্না। সেই কান্না কার? ’তোমার’ ও ’আমার’ কান্না- এখানে ’আমার’ বলতে বোঝা যাচ্ছে কবির কান্না, কিন্তু এখানে ’তোমার’ বলতে কার কান্না? গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর? নাকি, সেই রোদে পোড়া কিষানির? দুই কান্না আবার এক হয়ে ঝিরিপথ বয়ে নেমেও যায়! শহুরে কবি শহর আর গ্রামের মেলবন্ধন দেখছেন, দারুণ রোমান্টিক এক ব্যাপার। গানে দুটো দাঁতভাঙা কাব্যিক লাইনও আছে, ’পোকামাকড়ের কুহক বাজে সবুজ অন্ধকারে, …’’ ’তোমার নিহত সুরের কসম গর্জে তীর ধনুকে, …’’! আধুনিক কাব্যময়তার জন্যে বাহবা জানাই, তবে খনার বচনের সবচেয়ে বড়ো দিক হচ্ছে এর সহজবোধ্যতা তথা সিমপ্লিসিটি, তার পাশে এই লাইনগুলো বেশ বেমানানই লেগেছে।  আর, পরিবেশনার মূল দুটো পাঞ্চলাইন হচ্ছে, ’ও – ও – ও পাখি, ঠোঁটে তুলে নাও খড়কুটো গান/ ও – ও – ও রাখাল, মিথ্যে বাঘের গল্প শোনাও আবার’! শেষ হয়, ’ও – ও – ও রাখাল, পৃথিবীর শেষ গানটা শোনাও’! এগুলোতেও আধুনিক কাব্যভাব ভালোভাবেই এসেছে, কিন্তু স্বতন্ত্র গান হিসেবেই হয়তো শুনতে বেশি ভালো লাগত।

মেঘদলের গান

গানটি ইউটিউবে রিলিজ হওয়ার আগে মেঘদল তাদের ফেসবুক পেজ থেকে প্রচার করে, ’বনবিবি’ শিরোনামে প্রাণ-প্রকৃতিকে বিষয়বস্তু করে আজ রাত ১ টায় আসছে মেঘদল তাদের নতুন গান নিয়ে। কোক স্টুডিও বাংলার সিজন ২ এর দ্বিতীয় গান হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে এই গান। মেঘদলের চেনা সুর ও কথার বাইরে গিয়ে মেঘদল এবার নিজেদের সাজিয়েছে একটু অন্য আয়োজনে…’। কোক স্টুডিও বাংলার চ্যানেল থেকে আপলোড করা ইউটিউব ভিডিও’র ডেসক্রিপশনেও উল্লেখ করা আছে ’মিউজিক কম্পোজড অ্যান্ড প্রোডিউসড বাই মেঘদল’। ঠিক জানি না, গানটি বানানোর সময়ে মেঘদল কোক স্টুডিও থেকে কোনো রকম ফরমাশ বা নির্দেশনা-উপদেশ পেয়েছিল কিনা, বা তারা নিজেরাই বানিয়ে কোক স্টুডিওতে এটা দিয়েছে কিনা। যাই হোক, মোটের ওপরে গানটি পুরোমাত্রায় (বরং অনেক বেশি করেই) কোক স্টুডিও ফর্মুলা মেনে হয়েছে। মেঘদলের ফেসবুক পেইজের পোস্ট আর কোক স্টুডিও বাংলার ইউটিউব চ্যানেলের ডেস্ক্রিপশন বক্সের দাবি মোতাবেক গানটি যদি সম্পূর্ণভাবেই মেঘদলের হয়, অর্থাৎ গানটি কম্পোজ ও প্রোডিউস করার কাজটি একক ও স্বাধীনভাবে (কোকের কোনো নজরদারি বা চাহিদাপত্র বাদেই) গানটি বানিয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হবে যে, কোক স্টুডিও’র মতো মেঘদলও আসলে সেই একটা সুনির্দিষ্ট টার্গেট অডিয়েন্সকে লক্ষ করেই গানটি বানিয়েছে। আর, জহুরা বাউল, সূচনা  শেলি, নাবিয়া মিতুলসহ কোরাসে গীত যারা গেয়েছেন, তারা কি মেঘদলের সদস্য? সদস্য যদি না হয়ে থাকেন, তা হলে তাদেরকে দিয়ে গান গাওয়ানোর কাজটি করেছে কে? কোক স্টুডিও, নাকি মেঘদল? মেঘদল গানটিকে ’তাদের নিজেদের গান হিসেবে উপস্থাপন করল কেবল, এমনকি কোক স্টুডিও’র নামও নিল, কিন্তু মেঘদলের বাইরের শিল্পীদের কারোর নামই নিল না! পুরো গানটিকে মেঘদলের হিসেবে উপস্থাপন করায় বস্তুত জহুরা বাউল, সূচনা মিতুল, নাবিয়া মিতুলসহ অনেকেই নাই হয়ে গেলেন! তাদেরকে অগ্রাহ্য করা, উহ্য করা বেশ সহজই!

 

 

সূত্র :

১। বনবিবি, কোক স্টুডিও বাংলা : www.youtube.com/watch?v=LQ3677p5NWg

২। বনবিবি বিষয়ক বাংলাপিডিয়া লিংক : bn.wikipedia.org/wiki/বনবিবি

৩। বনবিবির পাঁচালী অবলম্বনে সানাই : www.youtube.com/watch?v=BuZ_zXg1Sc8

৪। সুন্দরবনের বনবিবি পূজা : www.youtube.com/watch?v=3iympIGCdRI

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!