১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প যাত্রা শুরু করে। যে কোনও দেশে কারখানা গড়ে তুলতে গেলে ওই দেশের প্রচলিত শ্রম আইন, শিল্প আইন, পরিবেশ আইন ও অবকাঠামো, গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে; কিন্তু বাংলাদেশের পোশাকশিল্প প্রথম থেকেই এসব আইনকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে, বরং এটি এখন আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। ফলে এ শিল্পের যাত্রা থেকেই শ্রমিক বিদ্রোহ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বিশ্বব্যাপী চলছে করোনা ভাইরাস জনিত মহামারি- বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ২০২০ সালের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। সরকারের গাফিলতিতে তা এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে।
মহামারি মোকাবেলায় যখন সাধারণ ছুটি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার, তখন গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে চলেছে টালবাহানা। বৈঠকের পর বৈঠক করেও তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিল না। হাজারটা অজুহাত সামনে এসে দাঁড়ায়। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন মহলের চাপে গার্মেন্টস শিল্প বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে সরকার ও মালিকপক্ষ বাধ্য হয়।
৬ এপ্রিল সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, মালিকদের মূল আগ্রহ ছিল সরকারের কাছ থেকে আর্থিক অনুদান বা প্রণোদনা আদায় করার দিকে। যেহেতু সরকার তখনও কোনো ‘প্রণোদনা’ ঘোষণা করেনি, সেহেতু তারা গার্মেন্টস শিল্প খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। শ্রম প্রতিমন্ত্রী জানান, মিল কারখানা কেন বন্ধ করতে হবে! এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের বাইরে কোনো সিন্ধান্ত নেওয়া যাবে না। এর আগে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক ক্রয়াদেশ হারানোর কথা উল্লেখ করে বলেন, শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকদের সক্ষমতা বিবেচনা করতে হবে। কারখানা বন্ধ করার সক্ষমতা অনেকেরই নেই।
এ থেকে স্পষ্টই অনুধাবন করা যায়, এ সমাজ-রাষ্ট্র-সরকার শ্রমিকদের ‘মানুষ’ হিসেবে মূল্যায়ন করে না। শ্রমিকরা মালিকদের প্রয়োজনে শুধু শ্রম দিয়ে যাবে। তাদের নিজস্ব কোনো ভাষা নেই, অভিমত নেই, বেঁচে থাকার অধিকার নেই। সারা দেশ যখন ‘সাধারণ ছুটি’তে যাচ্ছে তখন শ্রমিকদের জীবন নিয়ে এভাবেই খেলছিল সরকার ও মালিকশ্রেণী। বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে চলছিল হাজারও টালবাহানা।
২৩ মার্চ বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক ভিডিও বার্তায় এক নাটকীয় বক্তব্যে বলেন, ‘এ অবস্থায় ধৈর্য হারালে হবে না। ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সবাই তার ভাষণের জন্য অপেক্ষা করি। আতঙ্কিত হওয়ার জায়গা নেই। শ্রমিকদের যখন বেতনের সময় আসবে তখন তারা বেতন পাবেন। কেউ ভয় পাবেন না। ভরসা রাখুন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় আমাদের আশ্বস্ত করেছে, তারা আমাদের পাশে আছে। অন্তত প্রধানমন্ত্রীর ওপর এটুকু ভরসা রাখুন, শুধু গার্মেন্টসে ৪১ লাখ শ্রমিকের দিকে নয়, উনি সব শ্রমিকের দিকে লক্ষ্য রাখছেন। যতদিন উনি পাশে আছেন, আমরা কেউ পানিতে পড়ব না। বিদেশি ব্র্যান্ডদেরকে আবেদন জানাই, তারা যেন তৈরি হয়ে যাওয়া মালগুলো ডেলিভারি নেয়। তা’ না হলে আগামী ৬ মাসে বহু বড়, মাঝারি ও ছোট কারখানা বসে যাবে।’ সংবাদকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনাদের তাৎক্ষণিক একটি হেডলাইন, স্ক্রল এ মুহূর্তে পোশাক শিল্পের জীবন বদলে দিতে পারে। যদি কোনও ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, না শ্রমিক-ভাই বোনরা উপকৃত হবে, না সরকার উপকৃত হবে। বেতনের সময় শ্রমিক তার বেতন পাবে। এটি মনে রেখে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান।’
শুরু থেকেই এ ধরনের নাটকীয়তা চলছিল। ২৪ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা ‘সাধারণ ছুটির’ প্রজ্ঞাপনে বলা হয় প্রয়োজনে রফতানিমুখী শিল্প কারখানা চালু রাখা যাবে। ওই দিনই গাজীপুরে ঝর্ণা নিটওয়্যার লিমিটেডের ছাঁটাইকৃত শ্রমিকেরা অবস্থান নেয় মালিকের বাসার সামনে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চলছে অবরোধ-অবস্থান।
২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন দিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। গার্মেন্টস শিল্প বন্ধের ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়নি। সরকারের ঘোষিত প্যাকেজের প্রতিক্রিয়ায় রুবানা হক জানান, বিজিএমইএর কারখানা বন্ধ বা খোলা রাখার এখতিয়ার নেই। এটি সরকারের সিদ্ধান্ত, এ অবস্থায় কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
গণপরিবহনসহ সবকিছু বন্ধ করে কিছু গার্মেন্টস খোলা রেখে, বাকি গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা করা হয় ৫ এপ্রিল পর্যন্ত। ৪ এপ্রিল আবার শ্রমিকদের ঢাকা আসতে বাধ্য করে সরকার ও মালিকপক্ষ। পিংপং বলের মতো শ্রমিকদের একবার পায়ে হাঁটিয়ে ঢাকা নিচ্ছে, আবার তাদেরকে পায়ে হাঁটিয়ে বাড়িতে পাঠাচ্ছে। শ্রমিকরা নিরুপায় হয়ে এভাবেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। একদিকে বাড়িওয়ালাদের চাপ, অপরদিকে ক্ষুধার জ্বালা।
এদিকে, শ্রমিক ছাঁটাই চলছে দেদারসে। বেতন না দিয়ে মাসের পর মাস তাদের সাথে এক ধরনের তামাশা চলছে। ৫ এপ্রিল ভালুকায় একটি গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদ ও বেতনের দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। তখন মালিক পক্ষের হামলায় ট্রাকের চাপায় দুই শ্রমিক নিহত হন। এই মৃত্যুর দায় নিশ্চিতভাবেই সরকার ও মালিকশ্রেণীকে নিতে হবে। সরকার নির্ধারিত সময় এবং একাধিকবার তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইর প্রতিশ্রুতির পরও মার্চ মাসের বেতন হয়নি সব পোশাক শ্রমিকের।
বিজিএমইএর মতে, বর্তমানে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ২২৭৪টি কারখানায় মোট ২৪ লাখ ৭২ হাজার ৪১৭ জন শ্রমিক কাজ করছেন। ২৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সময় পর্যন্ত সময়ে ২২০০ কারখানার ২৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪১৭ জন শ্রমিক মার্চ মাসের বেতন পেয়েছেন। অর্থাৎ এখনও করোনাভাইরাসের দুর্যোগের দিনেও ৭৪টি কারখানার ৩৭ হাজার শ্রমিকের বেতন হয়নি। সারা মাস কাজের পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন বেতনের দাবিতে আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা।
এই যে এত ‘প্রণোদনা’, তাতে শ্রমিকের কি যায় আসে! শ্রমিক এখনও অভুক্ত! অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। বাড়ির পাশেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের ভয়াবহ অবস্থা চোখে পড়ছে। এক শ্রমিক টেনশনে স্ট্রোক করে বেশ কয়েকদিন মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসার অভাবে তিনি এখন ঢাকার খুপড়ি ঘরে কাঁতরাচ্ছেন। বাড়িতেও ফিরতে পারছেন না। তার চার সন্তান কোনও রকমে পানি পান করেই দিন কাটাচ্ছেন। প্রতিমাসে বাবা-মাকে কিছু টাকা দিতেন, তাও দিতে পারছেন না। সেইসঙ্গে দোকানের বাকি, ঘর ভাড়া- একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন। ত্রাণের আশায় বিভিন্ন জনের কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন; কিন্তু দলীয়করণের ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় ‘শ্রমিকশ্রেণীর’ কোনও মূল্যায়ন নেই।
শ্রমিক নেতা ও বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের আহ্বায়ক বিপ্লব ভট্টাচার্য বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর গার্মেন্টস শিল্পের মিলিয়ন ডলার আয়কারী শ্রমিকের জীবনের মূল্য মালিক, বিজিএমইএ, বিকিএমইএ, সরকারের কাছে কোনদিনই ছিল না। করোনা পরিস্থিতিতে তা আরো স্পষ্ট হলো। হাজার হাজার শ্রমিককে নিয়ে তামাশা করা হচ্ছে। বিজিএমইএ’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী শতকরা ৪ ভাগ শ্রমিক বেতন ভাতা পায়নি। বিকেএমইএ’র শ্রমিক সংখ্যা হিসেব করলে তা লাখের কোঠায় পৌছাবে। তারপর মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়েছে লে-অফ। শতকরা ৯০ ভাগ গার্মেন্টস এই অন্যায় সুবিধা নিচ্ছে। সরকারও নিরব। এই দুর্যোগের পরিস্থিতিতে অর্ধেক বেতন দেয়া সত্যিই অমানবিক। পুরো দেশ লকডাউন ঘোষণা করলেও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করে কারখানা বন্ধ রাখার কঠোর নির্দেশনা দিচ্ছেনা সরকার। তাই, মুনাফালোভী মালিকদের খামখেয়ালি ইচ্ছার অধীন রয়েছে শ্রমিক ভাই-বোনদের জীবন।’
গত ২৬ এপ্রিল স্টাইল ক্যাপ নামে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে ভোগড়া এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এর মধ্যেই রফতানিমুখী কারখানাগুলো খুলে দেওয়ার নির্দেশনা এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রফতানিমুখী কারখানাগুলো ধীরে ধীরে খুলে দেওয়ার কথা জানান। কারখানা খোলার খবর শুনে, মালিকপক্ষের মেসেজ পেয়ে আবারও কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন শ্রমিকরা। অথচ ৫ মে পর্যন্ত গণপরিবহণ বন্ধ। পায়ে হেঁটে বা বেশি ভাড়ায় রিকশা ও ভ্যানে করে আসছেন তারা। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক জানান, মোট ৮৫৬টি কারখানা খোলার অনুমতির ব্যাপারে তাদের চাপ দেওয়া হয়েছে।
শ্রমিকরা আবারও অনিশ্চয়তার মধ্যে- বেতন পাওয়ার আশায়, চাকরি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে কর্মস্থলে ফিরছেন। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার হুঁশিয়ার করে বলছে- ঘরে থাকার কথা, সামনে আরও ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের কথা; সেখানে শ্রমিকদের নিয়ে চলছে এক অমানবিক খেলা।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদী জানান, ২৬ এপ্রিল থেকে শুধু ঢাকা শহরের ভেতরে ৮টি স্থানের কারখানাগুলো চালু হয়। এছাড়া ২৮ তারিখ থেকে খোলা হবে আশুলিয়া থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত সব কারখানা। নারায়ণগঞ্জ, কাঁচপুর, রূপগঞ্জ এলাকার কারখানা চালু হবে ৩০ তারিখ থেকে। ২, ৩, ৪ মে টঙ্গী থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত কারখানা চালু হবে।
এদিকে, ২৬ এপ্রিল থেকে খুলেছে চট্টগ্রামের কেইপিজেড। ২৫ হাজার শ্রমিক পড়েছে অনিশ্চয়তায়। শ্রমিকরা বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দুজন মানুষের মধ্যে তিন ফুট দূরত্বে অবস্থান নেওয়ার দরকার হলেও কেইপিজেডের শ্রমিকরা গাদাগাদি করে অবস্থান করেন। তাদের শারীরিক দূরত্ব নিয়ে সচেতন থাকা সম্ভব নয়। কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেইপিজেড খুলব। প্রতিটি ফটকে থার্মাল স্ক্যানার মেশিন বসানো হবে’। এজিএম সাহেবের কথায় মনে হচ্ছে থার্মাল স্ক্যানার দিয়েই যেন করোনাভাইরাস মোকাবেলা সম্ভব!
কার্যত এগুলো সবই ফাঁকা বুলি। বাস্তবতা হলো- শ্রমিকদের জেনেশুনে মৃত্যুকূপে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা হচ্ছে সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে। সরকার শ্রমিকদের বাঁচাতে চাইলে, শ্রমিকদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার নিয়ে ন্যূনতম ভাবলে এভাবে প্রাণঘাতি সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো না। সরকার চাইলে শ্রমিকদের ঘরে রাখতে পারত, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে পারত। সরকারের শ্রমিক-কৃষক বিরোধী অবস্থানের কারণেই শ্রমিক-কৃষকদের এভাবে ধকে ধুকে ভুগতে হচ্ছে। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও এমনটা ভাবা যায় না! এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে জনগণের ক্ষমতায়ন দরকার। জনগণের গণতন্ত্রই পারে শ্রমিক-কৃষককে ‘মানুষের’ মর্যাদা দিতে।
Laboni Mondol is an organizer of Revolutionary Workers Movement.