অনুবাদকের ভূমিকা: মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল লিখিত ‘পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস এবং তার সাথে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান যুগের সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের যোগাযোগ’ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। পরবর্তীকালে এটি চিন্তার জগতে ‘পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস’নামক একটি আকরগ্রন্থে রূপ লাভ করে। গ্রন্থটির মুখ্য নামের সাথে তার গৌণ নামের সংযোগ এই গ্রন্থে পাঠকের বিশেষ মনোযোগের দাবিদার। জ্ঞানকান্ডের একটি বিশেষ শাখা কিংবা মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাপদ্ধতি হিসেবে দর্শনের দাবি হলো, সে চিন্তা করে পুরো জগতব্যাপী। সংকীর্ণ আঞ্চলিকতা কিংবা খন্ডিত চিন্তায় তার বিশেষ আগ্রহ নাই। কিন্তু তাই বলে যে চিন্তক বা ভাবুকদেরকে তাদের স্বকীয় পরিপ্রেক্ষিত স্পর্শ করে যায় না, তেমনটা নয়। অন্তত বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করছেন, দর্শনচিন্তার ক্ষেত্রে দার্শনিক যে স্থানে বসবাস করেন তার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোচনা বেশ গুরুত্ববহ। এগুলো ছাড়া কোনো বিশেষ চিন্তাকাঠামোকে পুরোপুরি বোঝা ও তার বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। উক্ত গ্রন্থটিতে তিনি প্রাচীনকাল থেকে তার সমসায়মিক সকল চিন্তাগোষ্ঠীর ধ্যান-ধারণার আলোচনা প্রসঙ্গে সে সময়ে বিরাজমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলাপ তুলতে ভোলেন নি। একই ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হয়েছে গ্রন্থটির দ্বিতীয় পুস্তকের দশম অধ্যায়ে আলোচিত ‘মোহাম্মদীয় সংস্কৃতি ও দর্শনচিন্তা’ প্রবন্ধে। পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর প্রদীপ রায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দর্শন বিভাগের পাঠ্যক্রমের চাহিদা অনুযায়ী এই বৃহৎ কলেবরের গ্রন্থটির কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ অনুবাদ করেছিলেন। অনুবাদকর্মটি তিনটি খন্ডে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা থেকে। সেখানে বাদ পড়ে গিয়েছিল এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি। এখানে রাসেল তার স্বভাবসুলভ দার্শনিক নির্লিপ্ততায় আলোচনা ও মূল্যায়ন করেছেন মুসলমানদের জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগকালীন কয়েকজন পুরোধা ব্যক্তিত্বের চিন্তাচর্চাকে। মধ্যযুগে মুসলমানদের প্রায় হাজার বছর বয়েসী সভ্যতার অবদানকে তিনি স্মরণ করেছেন দ্বিধাহীনভাবে। এই দিক থেকে তিনি পাশ্চাত্যের পূর্বনির্মিত প্রাচ্যের ধারণাকে আমলে না নিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া মতামত ব্যক্ত করেছেন। মুসলমান সাম্রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মুসলমানদের স্বকীয় দর্শনচিন্তার ইতিহাসকে। বিংশ শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হিসেবে ‘পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস’ গ্রন্থের এই বিশেষ অধ্যায়টি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার বাইরেও নিজগুণেই আলোচিত হতে পারে।
অনুবাদক: জাকির হোসেন
প্রাচ্য সাম্রাজ্য, আফ্রিকা এবং স্পেন দখল উত্তরের বর্বরদের দ্বারা পশ্চিম সাম্রাজ্যসমূহ দখলের তুলনায় দুটি দিক দিয়ে আলাদা। প্রথমত, পাশ্চাত্যের তুলনায় প্রাচ্য সাম্রাজ্য প্রায় এক হাজার বছর বেশি (১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত) টিকেছিল। দ্বিতীয়ত, প্রাচ্যে মূল আক্রমণ সংঘটিত হয়েছিল মোহাম্মদীয়দের দ্বারা, যারা সাম্রাজ্য দখলের পর খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ না করে বরং তাদের নিজেদেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা গড়ে তুলেছিল।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদের মক্কা থেকে মদীনায় ‘হিজরত‘ এর ঘটনা থেকে মোহাম্মদীয়দের সাল গণনা শুরু হয়। এর দশ বছর পর মোহাম্মদ মারা যান। তার মৃত্যুর অব্যবহিত পর থেকেই আরবদের সাম্রাজ্য দখল অভিযান শুরু হয় এবং তারা অসাধারণ দ্রুততার সাথে প্রসারিত হতে থাকে। পূর্বদিকে সিরিয়া আক্রমণ হয় ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে এবং পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তা সম্পূর্ণরুপে দখল হয়ে যায়। ভারত আক্রমণ হয় ৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে। কন্সটান্টিনোপল আক্রমণ হয় ৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দে (এবং পরবর্তীকালে আবার ৭১৬-১৭ খ্রিষ্টাব্দে)। মোহাম্মদীয়দের পশ্চিমাভিমুখী অগ্রগমণ মোটেই আকস্মিক কোন ব্যাপার ছিল না। মিসর বিজয় হয়েছিলো ৬৪২ সালে। কার্থেজ বিজয় ৬৯৭ খ্রিষ্টাব্দের আগে হয় নি। উত্তর-পশ্চিম দিকের এক ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া পুরো স্পেন বিজয় হয় ৭১১-১২ খ্রিষ্টাব্দে। সিসিলি এবং দক্ষিণ ইতালি ব্যতিরেকে পশ্চিমাভিমুখী অগ্রগমণ থেমে যায় ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে টুওর্সের যুদ্ধে মোহাম্মদীয়দের পরাজয়ের মাধ্যমে। ঠিক সেই বছরেই নবীর মৃত্যুর একশ বছর পূর্ণ হয়। যদিও অটোমান তুর্কিরা শেষপর্যন্ত কন্সটান্টিনোপল দখল করতে সক্ষম হয়, তবে তা আমাদের আলোচ্য সময়কালের পরের ঘটনা।
বিভিন্ন পরিস্থিতি মুসলিম সাম্রাজ্যের এই বিস্তৃতিকে সহজতর করেছিল। পারস্য এবং পূর্ব সাম্রাজ্য তাদের দীর্ঘকালব্যাপী চলমান যুদ্ধসমূহের দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল। সিরিয়ায় নেস্টোরিয়ানরা[1] ক্যাথলিকদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছিল। পক্ষান্তরে, মোহাম্মদীয়রা সকল শাখার খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়কে রাজস্বের বিনিময়ে নিরাপত্তা প্রদান করেছিল। একইভাবে মিসরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মনোফিসাইটরা[2] আক্রমণকারীদের স্বাগত জানিয়েছিল। আফ্রিকায় আরবরা এমন সকল বর্বরদের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছিল যাদেরকে রোমানরা কখনোই পুরোপুরি শাসনের অধীনে নিতে পারে নি। আরব এবং বর্বররা একযোগে স্পেন আক্রমণ করে যেখানে তারা ভিজিগথদের[3] দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ইহুদীদের সাহায্য পায়।
নবীর ধর্ম ত্রিত্ববাদ এবং অবতারবাদ দিয়ে কন্টকিত কোনো আচারনিষ্ঠ ধর্মতত্ত্ব নয় বরং তা একটি সাধারণ একেশ্বরবাদী ধর্ম। নবী নিজেকে কখনো ঐশ্বরিক বলে দাবি করেন নি এবং তার অনুসারীরাও তার পক্ষ হতে তেমন কোনো দাবি উত্থাপন করে নি। তিনি খোদিত চিত্রের বিষয়ে পূর্ববর্তী ইহুদী নিষেধাজ্ঞা পুনরায় চালু করেছিলেন এবং মদের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন। একজন বিশ্বাসীর কর্তব্য হলো ধর্মের জন্য পৃথিবীর যতোটুকু সম্ভব দখল করা। শর্ত ছিল ইহুদী, খ্রিষ্টান এবং জরথ্রুষ্টদের উপর জুলুম করা চলবে না যাদেরকে কোরআন ‘গ্রন্থসমূহের অনুসারী‘ সাব্যস্ত করেছে এবং যারা সেই ধর্মগ্রন্থসমূহের শিক্ষাগুলোকে লালন করে।
আরবের বেশীরভাগ অংশ ছিল মরুভূমি। ধীরে ধীরে তা এর জনগোষ্ঠীর জন্য অপর্যাপ্ত হয়ে উঠছিল। আরবদের প্রথম আক্রমণগুলো ছিল স্রেফ লুঠতরাজের উদ্দেশ্যে করা। পরবর্তী সময়ে তারা শত্রুদের দূর্বলতা বুঝতে পেরে দখলদারিত্বকে স্থায়ী রূপ দেয়। মাত্র দুই দশকের মতো সময়ের ব্যবধানে আরবরা যারা মরুভূমির এক প্রান্তে হাজারো প্রতিকূলতার সাথে ধুঁকে ধুঁকে অস্তিত্বের লড়াই করে যেতে অভ্যস্ত ছিল, তারা হঠাৎ নিজেদেরকে পৃথিবীর সচ্ছলতম ভূখন্ডের মালিকরুপে আবিষ্কার করল। এর ফল হিসেবে তারা সবরকম বিলাসিতা উপভোগ এবং এক প্রাচীন সভ্যতার সকল সুফল ভোগ করতে পারত। উত্তরের বর্বরদের তুলনায় তারা এইরকম হঠাৎ রূপান্তরের প্রলোভন থেকে নিজেদেরকে যথাযথভাবে দূরে রাখতে পেরেছিল। তীব্র কোন প্রতিরোধ ছাড়াই সাম্রাজ্য দখল করতে পারার ফলে তারা সেখানে তেমন কোনো ধংসযজ্ঞ চালায় নি বরং স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে অপরিবর্তিত রেখেছিল। পারস্য এবং বাইজান্টাইন উভয় সাম্রাজ্যের বেসামরিক প্রশাসন পূর্বে থেকেই দারুণ সংগঠিত ছিল। আরব মরুচারীরা প্রথমদিকে সেখানকার প্রশাসনিক জটিলতাগুলোকে বুঝে উঠতে পারে নি। তারা একরকম বাধ্য হয়েই কর্মরত আমলাদের সেবা গ্রহণ করে। উক্ত ব্যক্তিরা বেশিরভাগ সময় জুড়েই তাদের নতুন মালিকদের সেবা করতে কুণ্ঠিত হয় নি। প্রকৃতপক্ষে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রাজস্ব কমানোয় তাদের কাজ আরো সহজ হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর সংখ্যক প্রজা রাজস্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
খলিফার অধীনে আরব সাম্রাজ্য ছিল চরমতর রাজতান্ত্রিক। খলিফা ছিলেন নবীর পরস্পরা যিনি উত্তরাধিকারসূত্রে তার পবিত্রতা বহন করতেন। প্রথমদিকে খিলাফত নামেমাত্র মনোনীত ছিল যা শীঘ্রই বংশানুক্রমিক হয়ে যায়। প্রথম রাজবংশ হিসেবে উমাইয়া খিলাফত (যা ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল) এমন সকল ব্যক্তিরা মিলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যাদের গ্রহণযোগ্যতা মোহাম্মদের নিকট ছিল নির্জলা রাজনৈতিক। এই বিষয়ে বিশ্বাসীদের মধ্যবর্তী সবচেয়ে উগ্রবাদীরা সবসময় বিরোধীতার ভূমিকা পালন করেছিল।
আরবরা যদিও একটি নতুন ধর্মের নামে পৃথিবীর এক বিশাল অংশ দখল করেছিল, তারা নিজেরা জাতি হিসেবে খুব বেশি ধার্মিক ছিল না। তাদের আক্রমণের উদ্দেশ্য ধর্মের চেয়ে বেশি ছিল বরং সম্পদ লুঠতরাজ। তাদের ধর্মান্ধ না হওয়ার একমাত্র সুবিধা হয়েছিল এই যে, মুষ্টিমেয় যোদ্ধা তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই উন্নততর সভ্যতা এবং আনকোরা ধর্মানুসারী বিশাল সংখ্যক জনসমষ্টিকে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল।
অপরদিকে, পারসিকরা বহুকাল থেকেই ছিল গভীরভাবে ধার্মিক এবং মরমীবাদী। ধর্মান্তরকরণের পরবর্তীকালে তারা নবী এবং তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর ইসলাম থেকে এমন কিছু নির্মাণ করল যা ছিল তুলনামূলক বেশি আকর্ষণীয়, বেশি ধর্মীয় এবং অধিকতর দার্শনিক রসে জারিত। মোহাম্মদের জামাতা আলীর মৃত্যুকাল থেকে (৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে) মোহাম্মদীয়রা সুন্নী ও শিয়া এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম দলটি বৃহত্তর। দ্বিতীয় দলটি আলীকে অনুসরণ করত এবং উমাইয়াদেরকে দেখত দখলদার হিসেবে। পারসিকরা সবসময় শিয়া দলভুক্ত ছিল। পারসিক প্রভাবের ফলেই শেষ পর্যন্ত আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের পরাস্ত করে; যা পারস্য স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করেছিল। এই পরিবর্তন চিহ্নিত হয়েছিল আরব সাম্রাজ্যের রাজধানী দামেস্ক থেকে বাগদাদে স্থানান্তরের ঘটনার মধ্য দিয়ে।
আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের তুলনায় রাজনৈতিকভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তারা যদিও পুরো সাম্রাজ্য দখল করতে পারে নি। উমাইয়া রাজবংশের একজন সদস্য গণহত্যা থেকে পালিয়ে স্পেনে আশ্রয় নেন এবং সেখানে বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃত হন। এই সময় থেকেই স্পেন বাকি মোহাম্মদীয় জগৎ থেকে পৃথকভাবে স্বাধীন থাকে।
প্রথমদিকের আব্বাসীয়দের সময়ে খিলাফত সর্বাধিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। এদের মধ্যে হারুন-অর-রশীদ (মৃত্যু ৮০৯ খ্রিষ্টাব্দ) এবং সম্রাজ্ঞী ইরিন সকলের কাছে কিংবদন্তী ‘আরব্য রজনী’র মাধ্যমে সুপরিচিত। খলিফা হারুন-অর-রশীদের রাজদরবার ছিল কাব্য, শিক্ষণ এবং বিলাসিতার এক অত্যুজ্জ্বল কেন্দ্র। তার রাজস্ব ছিল প্রচুর। তার সাম্রাজ্য জিব্রাল্টার প্রণালী থেকে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার ইচ্ছাই ছিল চূড়ান্ত। তার অভ্যাস ছিল আমলাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকা, যারা খলিফার মস্তক হেলনে দরবারী কর্মকান্ড সম্পাদন করতেন। এই সমৃদ্ধি যদিও স্বল্পায়ু হয়েছিল। তার উত্তরসূরী সৈন্যদলকে সিংহভাগ অবাধ্য তুর্কিদের দিয়ে গঠন করে এমন প্রমাদ ঘটিয়েছিলেন যে, তারা খলিফাকে অপদার্থ ব্যক্তিতে পরিণত করে তাকে ধোঁকা দেয়। খলিফার প্রতি অতিষ্ট হয়ে গেলে তারা তাকে হত্যা করে। এমনতর অবস্থাতেও খিলাফত প্রলম্বিত হয়। মঙ্গলরা সর্বশেষ আব্বাসীয় খলিফাকে হত্যা করে ১২৫৬ সালে। একই সাথে গণহত্যা চালানো হয় আট লক্ষ বাগদাদবাসীদের।
আরবদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রোমান এবং অন্যান্য আরো কিছু সাম্রাজ্যের মত একই ধরণের ত্রুটি লক্ষ করা যায়। চরমতর রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সচরাচর বহুগামীতার মাধ্যমে গঠিত হয়ে থাকে বলে তা রাজবংশের অন্তর্বর্তী গৃহযুদ্ধের দিকে গড়ায়। যখন কোনো শাসক মারা যান, তার অন্তর্ধানের পরে সংঘটিত গুহযুদ্ধ শেষ হয় শাসকের কোনো এক পুত্রের বিজয়ী হওয়া এবং তার বাদবাকী ভাইদের নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্যে দিয়ে। সফল যুদ্ধগুলোর ফলাফল হিসেবে প্রচুর সংখ্যক মানুষ দাসে পরিণত হত। তাদের মধ্যে থেকে মাঝে মাঝে বিপদজনক দাস বিদ্রোহ সংঘটিত হত।
খিলাফত পূর্ব এবং পশ্চিমের কেন্দ্রস্থল অধিকার করার ফলে বাণিজ্যের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। “প্রচুর সম্পদ অধিকার করার ফলে শুধু চীনের রেশম এবং উত্তর ইউরোপের পশমের মত ব্যয়হুল দ্রব্য-সামগ্রীর চাহিদাই তৈরি হয় নি বরং বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা হয়েছিল বিশেষ কিছু পরিস্থিতির মাধ্যমে। যেমন: মুসলিম সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি, বিশ্বজনীন ভাষা হিসেবে আরবির প্রসার এবং মুসলিম নৈতিক ব্যবস্থায় বণিকদের সুউচ্চ মর্যাদা প্রদান। বলা হয়ে থাকে যে, মোহাম্মদ নিজে একজন বণিক ছিলেন এবং মক্কায় হজ পালনকালীন সময়েও বাণিজ্যের প্রশংসা করেছেন।”[4]
সামরিক সংযোগের মতো এই বাণিজ্যগুলোও গুরুত্বপূর্ণ পথসমূহের উপর নির্ভরশীল ছিল। সেগুলো আরবরা পেয়েছিল পারস্য এবং রোমানদের থেকে। উত্তরের বিজেতাদের মতো সেগুলোকে তারা ভগ্নদশায় পতিত হতে দেয় নি। মুসলিম সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে স্পেন, পারস্য, উত্তর আফ্রিকা এবং মিসরে ক্রমাগতভাবে ভেঙ্গে গিয়ে সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।
আরব অর্থনীতির সবচেয়ে সেরা বৈশিষ্ঠ্য হলো কৃষি। বিশেষভাবে বললে, তাদের দক্ষ সেচব্যবস্থা যা তারা দুর্লভ জনপ্রাপ্তির জায়গায় বসবাস করে শিখেছিল। আজকের সময়ে স্পেনের কৃষি আরব সেচব্যবস্থার সুফল ভোগ করছে।
সিরিয়া থেকে শুরু করে মুসলিম জগতের বিশেষ বৈশিষ্ঠ্যসূচক সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তসীমায়, পারস্য এবং স্পেনে। সিরিয়া বিজয়ের সময় সিরিয়াবাসীরা ছিল এরিষ্টটলের গুণমুগ্ধ। যেখানে নেস্টোরিয়ানরা ক্যাথলিকদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া দার্শনিক প্লেটোকে পছন্দ করত। আরবরা সর্বপ্রথম গ্রিক দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে সিরিয়াবাসীদের মাধ্যমে। তারা এভাবে শুরু থেকেই এরিষ্টটলকে প্লেটোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করত। তাদের এরিষ্টটল যদিও নব্য-প্লেটোবাদী পোশাক পরিধান করেছিল। কিন্দি (মৃত্যু অনুমানিক ৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) প্রথম ব্যক্তি হিসেবে আরবি ভাষায় দর্শন রচনা করেছিলেন। তিনিই একমাত্র খ্যাতিমান দার্শনিক যিনি নিজে ছিলেন আরব। কিন্দি প্লটিনাসের ‘ইনিয়াডস্’ এর কিছু অংশ অনুবাদ করে ‘এরিষ্টটলের ধর্মতত্ত্ব’ শিরোনামে প্রকাশ করেন। এটি এরিষ্টটল সম্পর্কে আরব্য ধারণার মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে; যা কাটিয়ে উঠতে আরব্য দর্শনের কয়েক শতক লেগে যায়।
এদিকে পারস্যে মুসলিমরা ভারতের সংস্পর্শে আসে। অষ্টম শতাব্দিকালে তারা সংস্কৃত লেখাগুলোর মাধ্যমে জ্যোর্তিবিদ্যা সম্পর্কে প্রথম জ্ঞান অর্জন করে। ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি যিনি সংস্কৃত থেকে গণিত এবং জ্যোর্তিবিদ্যা বিষয়ক বইসমূহের অনুবাদক, তিনি একটি বই প্রকাশ করেন যা দ্বাদশ শতাব্দীতে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে ‘অ্যালগোরিদমি ডি ন্যুমেরো ইন্ডোরাম’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এই বই থেকেই পশ্চিমারা প্রথম যাকে আমরা বলি ‘আরবি’ সংখ্যা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে; যা আসলে ‘ভারতীয়’ হিসেবে আখ্যায়িত হওয়া উচিত ছিল।
পারস্য সভ্যতা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গলদের আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শিল্পগত উভয় দিক দিয়ে ছিল প্রশংসনীয়। সেখান থেকে তারা আর কখনোই পুষিয়ে উঠতে পারে নি। একমাত্র ওমর খৈয়াম সম্পর্কেই আমি জানি যিনি কবি এবং গণিতবিদ উভয়ই ছিলেন; তিনি ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দে দিনপঞ্জীর সংস্কার সাধন করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু কিংবদন্তীসম খ্যাতি পাওয়া ‘পর্বতের বুড়ো’ ছিল গুপ্তঘাতকদের একটি সংঘের প্রতিষ্ঠাতা। পারসিকরা ছিলো মহান কবি। ‘শাহনামা’র কবি ফেরদৌসিকে (মৃত্যু আনুমানিক ৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) তার পাঠকেরা হোমারের সমতুল্য মনে করত। তারা মরমীবাদী হিসেবেও পরিচিত ছিল যা অন্যান্য মোহাম্মদীয়দের ব্যাপারে বলা হয় না। সূফি গোষ্ঠী প্রচলিত ধর্মীয় অনুশাসনের মরমীবাদী এবং রূপকাশ্রয়ী ব্যাখ্যা দেয় যা কমবেশি নব্য-প্লেটোবাদী। তারা এখনও বিদ্যমান আছে।
মুসলিম জগতে সর্বপ্রথম গ্রিক প্রভাব এসেছিল যাদের মাধ্যমে সেই নেস্টোরিয়ানরা কোনো দিক দিয়েই পূর্ণাঙ্গ গ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর ছিল না। এডেশায় তাদের একটি বিদ্যালয় ছিলো যা ৪৮১ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জেনো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষিত ব্যক্তিরা পরবর্তীকালে পারস্যে অভিবাসিত হয় এবং সেখানে তাদের কাজ চালিয়ে যায়। তবে তা পারস্য প্রভাব এড়িয়ে নয়।
নেস্টোরিয়ানরা শুধুমাত্র যুক্তিবিদ্যার জন্য এরিষ্টটলকে মূল্য দিত। আরব দার্শনিকেরা তার যুক্তিবিদ্যাকেই প্রথমদিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিল। পরবর্তী সময়ে যদিও তারা ‘মেটাফিজিক্স’ এবং ‘ডি অ্যানিমা’ অধ্যয়ন করেছিল। আরব দার্শনিকরা সাধারণত ছিল সর্ববিদ্যাবিশারদ। তারা আলকেমি, জ্যোর্তিবিদ্যা, জ্যোতিঃশাস্ত্র এবং প্রাণীবিদ্যার ব্যাপারে ততোটুকুই আগ্রহী ছিল যতোটুকু ছিল, যাকে আমাদের দর্শন বলা উচিত, তার ব্যপারে। তাদেরকে গোঁড়া এবং ধর্মান্ধ জনসাধারণ সন্দেহের চোখে দেখত। তুলনামূলক মুক্তচিন্তক রাজপুত্রদের অধীনে থেকে তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত।
দুইজন মোহাম্মদীয় দার্শনিক বিশেষ মনোযোগ দাবি করেন। তাদের একজন পারস্য এবং অপরজন স্পেনের অধিবাসী। প্রথমজন মোহাম্মদীদের মধ্যে বেশি বিখ্যাত এবং দ্বিতীয়জন বিখ্যাত খ্রিষ্টানদের মধ্যে। আভিচেন্না (ইবনে সিনা) (৯৮০-১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) তার জীবন অতিবাহিত করেছেন এমন সব স্থানে, মানুষ যে সকল স্থানকে শুধু কাব্যেই অস্তিত্বশীল বলে মনে করত। তিনি জন্মেছিলেন বোখারা প্রদেশে। চব্বিশ বছর বয়সে তিনি যান খিভায় – “নির্জন খিভা ফুরিয়ে যায়”। তারপর খোরাসানে – “নির্জন সেই খোরাসমানি তীর“। কিছুকাল তিনি ইস্পাহানে চিকিৎসাশাস্ত্র এবং দর্শনের শিক্ষা দেন। তারপর তিনি তেহরানে স্থায়ী হন। তিনি দর্শনের চেয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের জন্য বেশি বিখ্যাত ছিলেন যদিও সেখানে গ্যালেনের সাথে তেমন নতুন কিছু যুক্ত করেন নি। দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত তিনি ইউরোপে চিকিৎসাশাস্ত্রের একজন পথপ্রদর্শক হিসিবে গণ্য হয়েছিলেন। চরিত্রের দিক দিয়ে তিনি সাধু-সন্ত গোছের কেউ ছিলেন না। তার মদ ও নারীর প্রতি ঝোঁক ছিল। ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের নিকট সন্দেহভাজন হলেও চিকিৎসাশাস্ত্রে দক্ষতার সুবাদে তিনি বেশ কয়েকজন রাজপুত্রের সুহৃদ হয়েছিলেন। কখনো তিনি তুর্কী সৈনিকদের শত্রুতার বশবর্তী হয়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছেন, কখনো আত্মগোপনে থেকেছেন, কখনো বা বন্দী হয়েছেন। তিনি একটি বিশ্বকোষের রচয়িতা যা ধর্মতাত্ত্বিকদের শত্রুতার কারণে প্রাচ্যের নিকট অজানা হলেও ল্যাটিন অনুবাদের মাধ্যমে পাশ্চাত্যে প্রভাব বিস্তার করেছে। তার মনোবিদ্যায় অভিজ্ঞাতাবাদী প্রবণতা আছে।
আভিচেন্নার দর্শন ছিল তার মুসলিম পূর্বসূরীদের চেয়ে এরিষ্টটলের কাছাকাছি এবং তুলনামূলকভাবে কম নব্য-প্লেটোবাদী। পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টান স্কলাস্টিকদের মতো সার্বিকত্ব বিষয়ক সমস্যাগুলো তাকে ঘিরে ধরে। প্লেটো বলেন, সার্বিক ধারণাসমূহ বস্তুসমূহের তুলনায় পূর্ববর্তী। এরিষ্টটলের দুই রকমের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। একটি হলো তিনি যখন চিন্তা করতেন এবং অপরটি যখন তিনি প্লেটোর বিরোধীতা করতেন। তার দৃষ্টিভঙ্গীর এই দ্বৈততা তাকে ভাষ্যকারদের নিকট আদর্শ বস্তুতে পরিণত করেছিল। আভিচেন্না একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন যা পরবর্তীকালে আভেররস এবং অ্যালবার্টাস ম্যাগনাস পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। তত্ত্বটি হলো “চিন্তা আকারের মধ্যে সার্বিকত্ব প্রদান করে”। এ থেকে মনে হতে পারে যে তিনি চিন্তার বাইরে সার্বিকত্বের ধারণায় বিশ্বাস করতেন না। এটা অসঙ্গতভাবে একটা সাদামাটা মতামত বা পর্যবেক্ষণ হতে পারত। ‘জাতি’র মতো সার্বিক ধারণাগুলো, তার মতে, বস্তুর ‘পূর্বে’ ছিল ঈশ্বরের উপলব্ধিতে। উদাহরণস্বরূপ: ঈশ্বর বিড়াল সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন। এর জন্য তাঁর ‘বিড়ালত্ব’ সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। এইদিক থেকে ধারণাটি বিশেষ কোনো বিড়ালের পূর্ব থেকেই অস্তিত্বশীল।
জাতির ধারণা প্রাকৃতিক বস্তুসমূহের ‘মধ্যে’ অবস্থান করে। উদাহরণস্বরূপ: যখন বিড়াল সৃষ্টি করা হলো, তখন প্রত্যেক বিড়ালের মধ্যে ‘বিড়ালত্ব’ ছিল।
প্রাকৃতিক বস্তুসমূহকে ‘অতিক্রম করে’ জাতি বা সার্বিকত্বের ধারণা আমাদের চিন্তার মধ্যে থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: যখন অনেকগুলো বিড়ালকে দেখি, তখন তাদের মধ্যেকার মিলগুলো প্রত্যক্ষ করে আমরা সার্বিকভাবে ‘বিড়ালত্বের’ ধারনায় পৌঁছাই। এই মতামত স্পষ্টভাবেই বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়াস চালায়।
আভেররস (ইবনে রুশদ) (১১২৬-১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ) বাস করতেন আভিচেন্নার তুলনায় মুসলিম সাম্রাজ্যের অপর প্রান্তে। তিনি কর্ডোভায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তার পিতা এবং পিতামহ ছিলেন কাজী।[5] তিনি নিজেও কাজী ছিলেন। প্রথমে তারা ছিলেন সেভিলে, পরবর্তীকালে কর্ডোভায়। প্রথমদিকে তিনি ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্রে এবং পরবর্তীতে চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত এবং দর্শনশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। এরিষ্টটলের কর্মসমূহ বিশ্লেষণে সক্ষম এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে তাকে ‘খলিফা’ আবু ইয়াকুব ইউসুফের নিকটে পাঠান হয় (যদিও তিনি গ্রিক জানতেন না বলে ধারণা করা হয়)। এই শাসক তাকে আনুকূল্য দিলেন। ১১৮৪ সালে তিনি তাকে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ দেন। দুর্ভাগ্যবশত দুই বছর পরে রোগী মারা যায়।
এগারো বছর যাবৎ তার পুত্র আল-মনসুর পিতার পৃষ্ঠপোষকতার ধারাবাহিকতা চালিয়ে যান। পরে উগ্রপন্থীদের দার্শনিকের প্রতি বিরোধীতায় বিপদাশঙ্কা থেকে তিনি আভেররসকে তার পদবঞ্চিত করে প্রথমে কর্ডোভার কাছাকাছি ছোট একটি স্থানে এবং পরবর্তীতে মরক্কে নির্বাসিত করেন। তাকে সত্য বিশ্বাস বর্জন করে সেকেলে দর্শন চর্চার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। আল-মনসুর এই প্রেক্ষিতে ফরমান জারি করেন যে, যারা মনে করে সত্যকে দূর্বল যুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে, সৃষ্টিকর্তা তাদের জন্য দোযখের আগুন নির্ধারিত করে রেখেছেন। সেসময় যুক্তিবিদ্যা এবং অধিবিদ্যা বিষয়ক সকল বই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
এর অল্পকাল পরে খ্রিষ্টান বিজেতাদের হাতে স্পেনের মূরদের সাম্রাজ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। আভেররসের সাথে সাথে স্পেনে মুসলিম দর্শনের ইতি ঘটে। তীব্র গোঁড়ামির চর্চা বাকি মুসলিম জগতে মুক্তচিন্তার ইতি ঘটায়।
ইউবারওয়েগ আগ্রহের সাথে আভেররসের প্রতি আনা প্রথাবিরোধীতার অভিযোগ খন্ডনের দায়িত্ব নেন। অনেকেই বলতে পারেন যে তা মুসলিমদের সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়। তিনি যুক্তি দেখান: মরমীবাদীদের মতে, কোরআনের প্রত্যেক বাক্য ব্যাখ্যার জন্য সাত থেকে সত্তরটি অথবা সাতশতটি অর্থের স্তর রয়েছে। কোরআনের আক্ষরিক অর্থ শুধুমাত্র গন্ডমূর্খদের জন্য। একজন দার্শনিকের শিক্ষা কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। কোরআনের সাতশত ধরণের ব্যাখ্যার কোনো একটির সাথে দার্শনিক যা বলতে চান তার মিল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মোহাম্মদীয় জগতে গন্ডমূর্খেরা এমন সকল ধরনের শিক্ষার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছিল যা পবিত্র গ্রন্থের জ্ঞানসীমার বাইরে যায়। প্রকৃতঅর্থে, তেমন কোনো প্রথাবিরোধীতা প্রকাশ না পেলেও তা বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হত। সাধারণ মানুষ কোরআনের বাক্যগুলোকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলেও বিজ্ঞদের তা করা উচিত হবে না – মরমীবাদীদের এই দৃষ্টিভঙ্গীর দৃশ্যত বৃহত্তর জনসাধারণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
আভেররস এরিষ্টটলের সৃষ্টিকর্মের আরবী ব্যাখ্যার উন্নতির প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন যা ততোদিনে অসঙ্গতভাবে নব্য-প্লেটোবাদী ভাবধারার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। আভিচেন্নার চেয়ে আভেররস এরিষ্টটলকে এমন পর্যায়ের সমীহ প্রদর্শন করেছিলেন যা সাধারণত একজন ধর্মপ্রচারককে প্রদান করা হয়। তিনি মনে করতেন যে প্রত্যাদেশ ছাড়াও বুদ্ধি স্বাধীনভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম। টমাস একুইনাসও একই মত পোষণ করতেন। অমরত্বের বিষয়ে তিনি এরিস্টটলের কাছাকাছি মত প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, আত্মা অমর নয়, তবে বুদ্ধি (নাওস) অমর। যদিও এই মত ব্যক্তিগত অমরত্বের স্বীকৃতি দেয় না। কারণ হিসেবে বলা যায় বুদ্ধিবৃত্তি বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে আলাদাভাবে ব্যক্ত হলেও আদতে তা একই। এই মত স্বাভাবিকভাবেই খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছিলো।
আভেররস পরবর্তী আরো বহু মোহাম্মদীয় দার্শনিকদের মতোই বিশ্বাসী কিন্তু কট্টর গোঁড়াপন্থী ছিলেন না। পুরোদস্তুর গোঁড়াপন্থী ধর্মতাত্ত্বিকদের একটি দল ছিল যারা সকল প্রকার দর্শনসূহকে ধর্মবিশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে তার বিরোধীতা করেছিল। তাদের একজন ছিলেন আল গাজেল। তিনি ‘দার্শনিকদের অসঙ্গতি’ নামক একটি গ্রন্থে মত প্রকাশ করেন যে, যখন সকল গুরুত্বপূর্ণ সত্য বচনসমূহ কোরআনেই বিদ্যমান, তখন কোরআনের বাইরে কোনো চিন্তাচর্চার প্রয়োজন নেই। আভেররস সেই গ্রন্থের প্রত্যুত্তরে ‘অসঙ্গতির অসঙ্গতি’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল গাজেল যেসব যেসব ধর্মীয় মতবাদকে তুলে ধরেন সেগুলো হলো: নির্দিষ্ট একটি সময়ে শূন্য থেকে জগতের সৃষ্টি, ঐশ্বরিক গুণসমূহের বাস্তবতা এবং দৈহিক পুনরুত্থান।
আভেররস ধর্মকে রূপকাশ্রয়ে দার্শনিক সত্য বহনকারী হিসেবে দেখেছিলেন। এটি সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাপারে বিশেষভাবে প্রযোজ্য যা তিনি তার দার্শনিক প্রজ্ঞায় অনেকটা এরিষ্টটলীয় ঢঙে ব্যাখ্যা করেছেন। আভেররস মোহাম্মদীয় দর্শনের চেয়ে খ্রিষ্টীয় দর্শন ঘরানায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তিনি যথাক্রমে প্রথমটির ক্ষেত্রে ছিলেন উপসংহার এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ছিলেন ভূমিকা। ত্রয়োদশ শতকের প্রথমদিকে মাইকেল স্কট তার সৃষ্টিকর্ম ল্যাটিনে অনুবাদ করেন। দ্বাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তার সৃষ্টিকর্মগুলো রচিত হয়েছিল, এই হিসেবে তা বিস্ময়কর। ইউরোপে তার প্রভাব ছিল অসাধারণ। শুধু স্কলাস্টিক দার্শনিকদের মধ্যেই নয়, অপেশাদার মুক্তচিন্তকদের একটি বিশাল অংশ অমরত্বকে অস্বীকার করত এবং তাদেরকে আভেররসের অনুসারী বলে অভিহিত করা হত। পেশাদার দার্শনিকদের মধ্যে তার সর্বপ্রথম গুণগ্রাহী ছিল ফরাসীরা এবং সেইসাথে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়।
মৌলিক চিন্তার দিক দিয়ে আরব্য দর্শন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আভিচেন্না এবং আভেররসদের মতো ব্যক্তিরা ছিলেন মূলত ভাষ্যকার। সাধারণভাবে বললে, যুক্তিবিদ্যা এবং অধিবিদ্যার অধিক বিজ্ঞানমনষ্ক দার্শনিকেরা এসেছেন এরিষ্টটল ও নব্য-প্লেটোবাদীদের ধারাবাহিকতায়, গ্যালন থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে, গ্রিক এবং ভারতীয় উৎস থেকে গণিত এবং জ্যোর্তিবিদ্যায়। মরমীবাদীদের ধর্মীয় দর্শন মূলত প্রাচীন পারসিক বিশ্বাসসমূহের সংমিশ্রণ। আরবি ভাষার লেখকেরা গণিত এবং রসায়নে কিছুটা মৌলিকত্ব দেখিয়েছেন। পরবর্তী ক্ষেত্রটি ছিল আলকেমির গবেষণার আনুষঙ্গিক ফল। মোহাম্মদীয় সভ্যতা এর চরম সমৃদ্ধির দিনে শিল্পকলা এবং বিভিন্ন প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে প্রশংসনীয় ছিল। কিন্তু তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর প্রতি স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রে সামর্থ্যরে প্রমাণ রাখতে পারে নি। এর গুরুত্ব হলো প্রেরক হিসেবে, যা কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। প্রাচীন এবং আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার মাঝে অন্ধকার যুগ এসেছিল। উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির অভাবের সময়ে মোহাম্মদীয়রা এবং বাইজান্টাইনরা সভ্যতার কলকব্জাগুলো সংরক্ষণ করেছিল: শিক্ষা, গ্রন্থ এবং প্রাজ্ঞ অবসর। এই দুই দলই পশ্চিমকে বর্বরতা কাটিয়ে ওঠার কালে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মোহাম্মদীয়রা সাহায্য করেছিল বিশেষত ত্রয়োদশ শতকে, বাইজান্টাইনরা মূলত পঞ্চদশ শতকে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অনুপ্রাণিতরা প্রেরকদের চেয়ে উন্নততর চিন্তার উৎপাদন ঘটিয়েছিল। একটি ক্ষেত্রে স্কলাস্টিসিজম এবং অপর ক্ষেত্রে রেনেসাঁর কথা বলা যায় (যদিও এর পেছনে আলাদা কিছু কারণ বিদ্যমান)।
ইহুদীরা প্রোভেন্সে স্পেনের মূর এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে একটি কার্যকরী যোগসূত্র স্থাপন করেছিল। স্পেন খ্রিষ্টানদের পুর্নদখলে আসার সময়েও সেখানে অনেক ইহুদী থেকে গিয়েছিল। তারা যেহেতু আরবি ভাষা জানত এবং বাধ্য হয়ে খ্রিষ্টানদের ভাষা শিখেছিল। সুতরাং তারা অনুবাদ করতে সক্ষম ছিল। পরিব্যাপ্তির অপর একটি সম্ভবনা দেখা গেল এরিষ্টটল পন্থীদের ওপর মোহাম্মদীয়দের নিপীড়নের সময়ে যখন মূর দার্শনিকরা বিশেষত প্রোভেন্সে ইহুদীদের সাথে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। স্পেনের ইহুদীরা একজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক উপহার দিয়েছিল। তার নাম ছিল মাইমোনিডেস। তিনি ১১৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কর্ডোভায় জন্মগ্রহন করেন। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি কায়রো গমন করেন। তিনি আরবি ভাষায় লিখলেও তাৎক্ষনিকভাবে তা হিব্রুতে অনুবাদ করতেন। তার মৃত্যুর কয়েক দশক পরে সম্ভবত সম্রাট ফ্রেডরিক দ্বিতীয়ের অনুরোধে তার কর্মগুলো ল্যাটিনে অনুবাদ করা হয়। যে সকল দার্শনিকরা তাদের ধর্মবিশ্বাস বিসর্জন দিয়েছেন তাদেরকে লক্ষ্য করে তিনি লিখেন ‘বিপথগামীদের জন্য পথনির্দেশ’ নামক একটি গ্রন্থ। এর উদ্দেশ্য ছিলো ইহুদী ধর্মতত্ত্বের সাথে এরিষ্টটলের সামঞ্জস্য বিধান করা। এরিষ্টটল ছিলেন পার্থিব জগতের অধিপতি, স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তি। কিন্তু ঈশ্বরের জ্ঞানের মধ্যে দর্শন এবং প্রত্যাদেশ উভয়ই বিরাজমান। সত্যের সাধনা করা একটি ধর্মীয় দায়িত্ব। জ্যোতিষশাস্ত্র একটি নিষিদ্ধ বিষয়। ধর্মগ্রন্থকে (পেন্টাটিউচ) সবসময় আক্ষরিক অর্থে নেওয়া যাবে না। যখন এর আক্ষরিক অর্থের সাথে যুক্তিকে সাংঘর্ষিক বলে মনে হবে তখন আমাদের অবশ্যই এর একটি রূপকাশ্রয়ী ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে। এরিষ্টটলের বিরোধীতা করে তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বর শুধু আকারই নয়, তিনি শূন্য থেকে বস্তুকেও তৈরী করেছেন। তিনি টাইমিয়াসের একটি সারসংক্ষেপ প্রদান করেন (তিনি তা আরবী ভাষায় জানতেন) এবং এরিষ্টটলের সৃষ্টিকর্মের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তা উপস্থাপিত করেন। ঈশ্বরের সত্তা হলো অজ্ঞেয় এবং সবরকমের চুলচেরা বিশ্লেষণের উর্দ্ধে অবস্থান করে। ইহুদীরা তাকে প্রথাবিরোধী বিবেচনা করে খ্রিষ্টান যাজকীয় কর্তৃপক্ষকে তার বিরুদ্ধে উসকিয়ে দেয়। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি স্পিনোজাকে প্রভাবিত করেছিলেন। কিন্তু, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
[1] সিরিয়া এবং এশিয়া মাইনরে উদ্ভূত একটি বিশেষ শাখার খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়: অনুবাদক
[2] নেস্টোরিয়ান মতাদর্শের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া অপর একটি শাখার খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়: অনুবাদক
[3] নর্মাদি উপজাতির পশ্চিমা শাখা: অনুবাদক
[4] Cambridge Medieval History, IV, 284
[5] শরীয়া আদালতের বিচারক: অনুবাদক
Zakir Hossain is a Writer, Translator, and currently pursuing a M.A. degree in Philosophy from Rajshahi University.