আশির দশকের শেষদিকে পুরোনো সংবাদপত্র নাড়াচাড়া করছিলেন প্যাট্রিক মোদিয়ানো, হঠাৎ চোখে পড়ে যায় একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত সেই নোটিশে বলছে – ডোরা ব্রুডার নামের এক কিশোরীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বয়স ১৫ বছর, উচ্চতা ১.৫৫ মিটার, ডোরার পরনে ছিল ছাইরঙা জ্যাকেট, মেরুন রঙের সোয়েটার, নীল স্কার্ট আর বাদামী জুতো। কেউ সন্ধান পেলে ওর্নানো সড়কের ৪১ নম্বর বাড়িতে মসিওঁ এবং মাদাম ব্রুডারের সাথে দয়া করে যোগাযোগ করবেন।
১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাস। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান অধিকৃত প্যারিস। শহরের ৫০ লক্ষ মানুষের মাঝে কে এই ডোরা ব্রুডার? কি তার বৈশিষ্ট্য, কি এমন গুরুত্ব? কেন প্যারিসের আনাচে কানাচে এই অজানা কিশোরীর ছায়ার পেছনে ঘুরে ঘুরে জীবনের পরবর্তী দশ বছর খরচ করেছিলেন প্যাট্রিক মোদিয়ানো?
২০১৪ সালে যেদিন নোবেল প্রাইজ জিতলেন, বাইরের দুনিয়ার ৯৯% শতাংশ পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা ছিলেন তিনি। পরদিন পেপারের হেডলাইন অনুযায়ী – “প্যাট্রিক হু?” স্বীকারে লজ্জা নেই যে আমিও কখনো শুনিনি তার নাম। প্রায়শই একদম অপরিচিত লেখককে পুরস্কৃত করে আমাদের (বিশেষ করে ইংরেজীভাষী পাঠকদের) তাক লাগিয়ে দেন, আরেকটু শিক্ষিত করে তোলেন নোবেল কমিটি। মোদিয়ানোর তিন বছর আগে যেমন পেয়েছিলেন সুইডিশ কবি ট্রান্সট্রোমার বা তারও তিন বছর আগে মোদিয়ানোরই স্বদেশী ল্য ক্লেজিও। এদের কারোরই নাম আগে শুনিনি। সেদিনই লন্ডন লাইব্রেরির অনলাইন ক্যাটালগ ঘেঁটে বের করি যে বাসার কাছের এক ব্র্যাঞ্চে সত্তরের দশকে প্রকাশিত তাঁর একটি উপন্যাসের কপি আছে। গল্পটির নাম ছিল ভিলা ত্রিস্ত (বিষণ্ণ ভিলা) – মোদিয়ানোর অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সের রচনা, ফ্রান্সের দক্ষিণে স্বর্গসম আনেসি হ্রদের পারে একটি ত্রিভুজ প্রেমের ততোধিক বিষণ্ণ গল্প। গেল জুন মাসে স্বচক্ষে আনেসি হ্রদ আর তার পাশের ছোট্ট শহর দেখে আসার পেছনে এই বই পড়ার স্মৃতি ছিল অন্যতম অনুপ্রেরণা।
তবে ক্রমে বুঝতে পারলাম যে এই বইটি মোদিয়ানোর সাহিত্যে একটি ব্যতিক্রম, ওঁর লেখার মূল যে বিষয়বস্তু, প্রধান যে অবসেশন, সেটা থেকে বেশ তফাতেই বলতে গেলে ভিলা ত্রিস্ত। কি সেই অবসেশন, যা মোদিয়ানোকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে, জন্ম দিয়েছে একের পর এক উপন্যাসের?
উত্তরটি সহজ এবং একই সাথে কঠিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসী অধিকৃত ফ্রান্সে ইহুদিদের নির্মম পরিণতি, সেই হত্যাযজ্ঞে নাৎসীদের তাবেদার ফরাসী ভিশি (Vichy) সরকারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, শুধু তাই নয়, ফ্রান্সের সাধারণ জনগণের মাঝে চরম ইহুদি বিদ্বেষ এবং স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়ের নিশ্চিহ্নকরণে তাদের অগ্রণী ভূমিকা, এবং ইতিহাসের এই অসহনীয় রকমের লজ্জাজনক অধ্যায় সম্পর্কে আধুনিক ফ্রান্সের সম্পূর্ণ স্মৃতিবিলুপ্তি (amnesia) – এসবই মোদিয়ানোর সাহিত্যের চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। বলা যেতে পারে যে ডোরা ব্রুডারের গল্পে তিনি তাঁর অবসেশনের সবচেয়ে সফল এবং মর্মভেদী রূপদান করতে সক্ষম হয়েছেন।
গল্পটি এমন ঢঙে বয়ান করেছেন যে সহসা বোঝা যায় না, এটা কি ফিকশন না নন-ফিকশন। আমিও প্রথম বিশ-ত্রিশ পাতা পড়ে ধরতে পারিনি, পরে গুগলের মাধ্যমে বুঝতে পারলাম যে না, ঘটনাটি আসলেই ঘটেছিল, বাস্তব চরিত্রকে নিয়েই লিখেছেন মোদিয়ানো, কিন্তু একদম নিজের মতো করে – “ইমাজিনেটিভ নন-ফিকশন” হয়তো এই ধরণের ঘরানার সবচেয়ে যুৎসই বিবরণ।
ডোরা ব্রুডার বিশেষ তেমন কেউ ছিল না। প্যারিসের দরিদ্র শ্রমজীবী জনতার ভীড়ে বেনামী আরেকজন। সরকারী দলিল দস্তাবেজে তার হদিশ মেলা ভার, খণ্ডিত জীবনের বিশেষ মুহূর্তগুলো ফাইলপত্রে রেকর্ড হবার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। কিন্তু তবুও হঠাৎ পাওয়া হারানো বিজ্ঞপ্তিটি হাতে নিয়ে মোদিয়ানো বেরিয়ে পড়েছিলেন। ঝানু ডিটেক্টিভের মতোই খুঁজে বেরিয়েছেন ডোরাকে, এক বা দুই বছর নয় বরং এক দশক ধরে। চষে ফেলেছিলেন সমগ্র প্যারিস, অর্ধ শতাব্দী আগে আউশউইৎসের গ্যাস চেম্বারে মরে যাওয়া এই অতি সাধারণ মেয়েটির সন্ধান করতে গিয়ে। হয়তো কেউই নয় ডোরা ব্রুডার, কিন্তু তার মৃত্যুর সর্বজনীনতায়, তার জীবনের অনন্যতায় ডোরা একটি প্রতীক হয়ে ওঠে। মোদিয়ানো তাকে ব্যবহার করেন মিডিয়াম হিসেবে, ইতিহাসের বোবা তালা ধীরে ধীরে মোচড় দিয়ে খুলে ফেলেন, হাতে ধরা ডোরা নামের এই চাবির সাহায্যে, অন্ধকার ইতিহাস কিছুটা আলোকিত হয়ে ওঠে, মৃদু কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করে আমাদের সাথে।
যদিও সহজে ধরা দিতে চায় না ডোরা, প্রতিটি তথ্যের জন্যে, প্রতিটি ঠিকানা বা তারিখ বা নাম পেতে ঘাম ঝরাতে হয়, জুতার তলি খসাতে হয়, একের পর এক দশাসই সরকারি দফতরে ধর্ণা দিতে হয়, ব্যুরোক্রেসির লাল-ফিতায় বাঁধা গোলকধাঁধায় ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে হয়, তবুও যদি বা মিলে যায় এক টুকরো এভিডেন্স, কালের অতল থেকে উঠে আসা খড়কুটো…
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ফ্রান্সে অনেক ইহুদি চলে এসেছিল উদ্বাস্তু হিসেবে, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে। হাবসবুর্গ এবং অটোমান, এই দুই প্রতাপশালী সাম্রাজ্যের হঠাৎ পতনের ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই জীবনরক্ষার প্রয়োজনে নিরাপদ আশ্রয় জরুরী হয়ে পড়ে অনেক ইহুদিদের। ডোরার বাবা এসেছিলেন ভিয়েনা থেকে, ডোরার মায়ের জন্ম বুদাপেস্টে। আর লেখক? লেখকের নিজের বাবাও যে উদ্বাস্তু, ইতালীয়-গ্রীক বংশোদ্ভূত ইহুদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টিনেজার আলবার্ট মোদিয়ানো, নাৎসিদের ফাঁদ এড়িয়ে জীবন বাঁচানোর প্রবল সংগ্রামে লিপ্ত, কখনো সে কালোবাজারী, কখনো বা সাক্ষাৎ ডাকাত। মোদিয়ানোর সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে এই অনিশ্চয়তার ছায়া লক্ষ্য করি, কতবার মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়েছে ওর বাবা, কতবার মরে যেতে পারতো নাৎসিদের গুলিতে। প্যাট্রিকের তো এই পৃথিবীতে আসারই কথা ছিল না। গোটা জীবনটাই যেন পাশার দান, স্রেফ ভাগ্যের ফেরে ইহজগতে ওর অস্তিত্ব – লেখকের এই প্রচ্ছন্ন বোধ তার গদ্যের পরতে পরতে।
অদক্ষ ফ্যাক্টরি শ্রমিক ছিল ডোরার বাবা আর্নেস্ট, মা সেসিল ঘরের কাজ করতো। ডোরার জন্মের আগে থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত কোন স্থায়ী নিবাস ছিল না পরিবারের, প্যারিসের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় বিভিন্ন সস্তা হোটেল, হোস্টেল, রুমিং হাউসই ছিল ওদের ঠিকানা। কাকতালীয়ভাবে ডোরার প্যারিসের সাথে মোদিয়ানোর প্যারিস মিলে যায় অনেকটাই, বিশ কি ত্রিশ বছরের তফাতে একই পাড়ায় ওদের চলাফেরা ছিল, একই পথ-ঘাট ওদের পরিচিত। নগর প্যারিস এই গল্পের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, জ্বলজ্যান্ত এক স্বতন্ত্র চরিত্র। যেই মমতায় যেই ভালোবাসায় রাস্তাগুলোর নাম একের পর এক আউড়ে যান মোদিয়ানো – রু ফার্দিনান্দ ফ্লোকোঁ, রু এর্মেল, রু শাম্পিওনে, রু দ্য ক্লিনিয়াংকোর্ট – বুঝতে কষ্ট হয় না যে গর্হিত এই শহর তার প্রাণের শহরও বটে.. রু সাঁ-লুক, রু কাভে, রু দ্য পোয়াসোনিয়ে, ইম্পাস দ’ওরান…
তবে মানচিত্রে ডোরা-অনুসন্ধানের প্রধান দুটি মেরু। উত্তরে ওর্নানো বুলভার্দ, যেখানে ডোরার পরিবার বসবাস করতো, আর দক্ষিণে রু দ্য পিকপাস – প্রচন্ড স্বাধীনচেতা, প্রায় বেয়ারা বেড়ে ওঠা ডোরা-কে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে পিকপাসের এক কনভেন্ট স্কুলে ওকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ওর বাপ্-মা।
ইংরেজিতে প্যালিম্পসেস্ট বলে একটি শব্দ আছে, অর্থাৎ একটি পাণ্ডুলিপি যেখানে একবার নয়, অনেকবার লেখা হয়েছে, পুরনো লেখার উপরে নতুন লেখা সংযোজন হয়েছে, সেটাকেও ছাপিয়ে দিয়ে এসেছে আরো নতুন লেখা। ডোরা ব্রুডারের গল্পে প্যারিস যেন এক প্যালিম্পসেস্ট, যেখানে ১৯৪১-৪২ এর শহরের উপরে সুপারইম্পোজ হয়েছে লেখকের যৌবনের শহর পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের প্যারিস, তার উপর পুনরায় বসেছে প্রৌঢ় লেখক-ডিটেকটিভ মোদিয়ানোর আধুনিক রাজধানী।
একটিই শহর, আবার আলাদা অনেকগুলো শহর… বহু আগে ছাই হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে ভুলতে পারেন না মোদিয়ানো, তার চলার পথের অদৃশ্য সঙ্গী, অথচ চিরদিনের জন্যে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে এক মায়া, এক কুহেলিকা। অনুপস্থিতির বেদনায় নীল লেখকের কাছে পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ততম মেট্রোপলিস হয়ে ওঠে এক ভূতের শহর…
“The city was deserted, as if to mark Dora’s absence. Ever since, the Paris wherein I have tried to retrace her steps has remained as silent and deserted as it was on that day. I walk through empty streets. For me, they are always empty, even at dusk, during the rush hour, when the crowds are hurrying towards the mouths of the métro. I think of her in spite of myself, sensing an echo of her presence in this neighborhood or that. The other evening, it was near the Gare du Nord…”
ডোরার অভাব, ডোরাদের অভাব তাকে তাড়িত করে প্রতি মুহূর্তে। বইয়ের মাঝপথে এসে সেই সময়ের আরো কিছু চরিত্রদের উপস্থাপন করেন লেখক, ওঁরই স্বধর্মী স্বগোত্রীয় হারিয়ে যাওয়া কয়েকজন বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করেন মোদিয়ানো। তারা ছিলেন লেখক অথবা শিল্পী, কবি বা নাট্যকার বা অভিনেতা। এমনকি জার্মান জাতির সবাইও যে একমনা ছিল না, সকলেই যে হিটলারের শিষ্য হয়ে যায়নি, সেটাও মনে করিয়ে দেন তিনি। আমরা পরিচিত হই দুই তরুণ লেখকের সাথে – ফ্রেডো লাম্পে আর ফেলিক্স হার্টলাউব – দুজনই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পরাজিত বার্লিনে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছিলেন রেড আর্মির রুশ সৈন্যদের হাতে। আরো আছে নিহতের তালিকায়… কবি রজার গিলবার্ট-লেকোন্ত, আলবার্ট শাকি (ছদ্মনাম ছিল জেবু), কবি রবার্ট দেনো। একজনও বাঁচেনি, এদের কেউ মরেছে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে কবিতা,শিল্প আর সাহিত্যের, আমাদের মত উত্তর প্রজন্মের। একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অভাব যেমন আমরা অনুভব করি এত বছর পরেও, মোদিয়ানো নিকটাত্মীয়তার সম্পর্ক অনুভব করেন ওদের প্রত্যেকের সাথে। যখন অসহায় আক্ষেপের সুরে বলেন “So many friends whom I never knew disappeared in 1945, the year I was born.”, তার শোক আমাদেরও সংক্রমণ করে।
হয়তো কনভেন্টে থেকে গেলেই ভালো করতো ডোরা, নাৎসিরা কখনো সেই অভ্যন্তরে হানা দেয়নি। মাথা নীচু করে চুপচাপ সিস্টারদের গুরুশাসন মেনে নিলে হয়তো প্রাণেও বেঁচে যেতে পারতো। কিন্তু ওই যে ডোরার ঘাড় একটু ত্যাড়া ছিল বরাবরই। প্রথমবার পালিয়ে যায় একচল্লিশের শেষের দিকে, তখনই পেপারে নোটিশটি ছাপা হয়, যদিও এপ্রিল পর্যন্ত ওকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই চার মাস সময়কাল ডোরার জীবনীতে সাদা কাগজই রয়ে গেছে, প্রবল শীতের ঘন কুয়াশায় মোড়া, আজ অব্দি রহস্যময়। অবশেষে বসন্তের শুরুতে বাড়ি ফিরে আসে মায়ের কাছে, কিন্তু ফিরে এসেও থিতু হতে পারে না, তদ্দিনে ওর বাপকে চালান করে দেয়া হয়েছে প্যারিসের অদূরে কুখ্যাত ড্র্যান্সি ক্যাম্পে। আবারো পালিয়ে যায়, এবং আবারো ধরা পরে। এইবার আর রক্ষে নেই, সোজা তুরেল ক্যাম্প হয়ে ড্র্যান্সি-তে। বাপ্-বেটির বেদনাবিধুর পুনর্মিলনী, অবশেষে বেয়াল্লিশের সেপ্টেম্বর মাসে মালবাহী ট্রেন মারফত পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে অন্তিম যাত্রা।
ড্র্যান্সি বা তুরেল – এই নামগুলো ফরাসী জাতির কপালে কালিমার মত। আউশউইৎসের নরকের লাকড়ি হবার আগে এই ক্যাম্পগুলোই ছিল স্বদেশের মাটিতে ৭০,০০০ ইহুদীর শেষ ঠিকানা। তবুও কোথায় যেন মেলাতে পারেন না মোদিয়ানো। ১৯৪৪-এর জুন মাসে নরম্যান্ডি ল্যান্ডিং এর মাধ্যমে ফ্রান্সের মুক্তি নিশ্চিত করে মার্কিন পদাতিক বাহিনী, সে বছরের অগাস্টে জেনারেল দ্য গলের পদার্পণের মাধ্যমে অবরুদ্ধ প্যারিসে বেজে উঠে মুক্তির ঘন্টা। কিন্তু যেমনটা বলেছি, ফরাসিদের মাঝে মুক্তিযোদ্ধা যেমন ছিল, নাৎসিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন দেয়া রাজাকারের সংখ্যাও নেহায়েত কম ছিল না। এমনকি হতে পারে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠও ছিল ওরা।
কিন্তু বিজয়ের রূপকথা নির্মান করতে গেলে তো এইসব লজ্জাজনক অধ্যায় চেপে যেতে হয়। ইহুদিদের নির্মূল করার ঘৃণ্য কাজে ফরাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে ধামা-চাপা দিতে হয়। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে অর্থনৈতিক বুমে ফুলে ফেঁপে ওঠা সংশয়হীন আত্মবিশ্বাসী ফ্রান্স, উল্টো তখন ভিয়েতনাম আর আলজেরিয়ার উপনিবেশ ধরে রাখার সহিংস প্রচেষ্টায় শশব্যস্ত। ফরাসী সমাজ-সংস্কৃতির প্রতীক তখন একদিকে দ্যলোন আর বার্দোর মতো সিনেতারকা, আরেক দিকে কাম্যু-সার্ত্রের মতো ইন্টেলেকচুয়াল। পুরোনো লজ্জার কথা, পড়শীর লাশের কথা কেউ আর বলে না।
সত্তরের দশকে এসে এই ইচ্ছাকৃত স্মৃতিবিভ্রাটের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করলেন কেউ কেউ। যুদ্ধ শেষ হবার ত্রিশ বছর পরে ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় অত্যন্ত বিতর্কিত একটি চলচ্চিত্র – লাকোম্ব, লুসিয়েন। সাধারণ এক ফরাসী রাজাকারের ক্যারিয়ার অকপটে বিবৃত করেন নির্মাতা লুই মল – ফরাসী জাতির আত্মতুষ্টির আয়নায় ফাটল ধরার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল এই চলচ্চিত্র। এবং অবাক হবার কিছু নেই যে ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লিখতে গিয়ে মল-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন জনৈক তরুণ লেখক, তার নাম প্যাট্রিক মোদিয়ানো।
ডোরা ব্রুডার যেই পাড়ায় বড়ো হয়েছিল, ক্লিনিয়াংকোর্টের সেই পুরোনো দালানকোঠাগুলো আজ আর নেই। সেসব ভেঙেচুড়ে নতুন রাজপথ বসানো হয়েছে, নতুন ঘরবাড়ি তৈরী করা হয়েছে, যেন স্বপ্রণোদিত হয়েই সেই ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে আধুনিক প্যারিসের নগরপালেরা। নতুন এই দালানগুলো সম্পর্কে মোদিয়ানোর তিক্ত পর্যবেক্ষণ – The façades are rectangular, the windows square, the cement the colour of amnesia. দেশবাসীর প্রতি তার এই তিরস্কার তীর্যক, তবুও জোরালো।
একজন শক্তিমান লেখক যে তার সমাজে, তার সংস্কৃতিতে, তার পারিপার্শ্বে সত্যিকারের প্রভাব রাখতে পারেন, মৃদুভাষী মোদিয়ানো তারই প্রমাণ দিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন আজ অবধি। হয়তো ফ্রান্সের মতো দেশে সেই প্রচেষ্টা আজো ফলবতী হতে পারে। ডোরার গল্প তো শেষ, বাকি থাকে গল্পের পরের গল্প। লেখকের নোবেল জয়ের আট মাস পরে, তার অজ্ঞাত নায়িকা মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবার ৭১ বছর পরে, ২০১৫ সালের ঝকঝকে এক গ্রীষ্মের দিনে মোদিয়ানোর উপস্থিতিতে প্যারিসের মেয়র অ্যান হিডাল্গো উদ্বোধন করেন ডোরা ব্রুডার সরণী। মহাকালের বিস্মৃতির বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ, হোক না সাময়িক, তবুও তো এক ধরণের বিজয়।