মৃত্যুদণ্ড ও অপরাধ যেন এক যুগলবন্দি। মৃত্যুদণ্ডপন্থী সমাজে জীবনের প্রতি দরদ, শ্রদ্ধা, মর্যাদা কম থাকে। ঠিক একই কারণে সেখানে জীবনবিরোধী অপরাধও ঘটে বেশি বেশি।
এরকম জনপদে অপরাধ মোকাবেলায় ‘সমাজ’ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এতে ‘সমাজ’-এর অপরাধবিরোধী সক্রিয়তা কমতে কমতে শূন্যে নেমে আসে।
মৃত্যুদণ্ড অপরাধের আসল সামাজিক কারণগুলোও আড়াল করে। এতেও অপরাধ বাড়তে থাকে।
–আলতাফ পারভেজ
বাংলাদেশে যেন ধর্ষণের মহামারী সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ধর্ষণ কোন অভিনব অপরাধ না বাংলাদেশে, কিন্তু এই মুহুর্তে বেশ কয়েকটি আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটার প্রেক্ষিতে দেশজুড়ে ধর্ষণ বিরোধী রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতা জোরদার হয়েছে। নিরঙ্কুশ ও একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতাতন্ত্রের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আশ্রয় প্রশ্রয় ও দায়মুক্তির সংস্কৃতির মধ্যেই যে ধর্ষণের মতো লৈঙ্গিক সহিংসতার শর্ত বিরাজ করে, সেই ব্যাপারটিও দিনকে দিন স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষত বিগত কয়েকদিনের আলোচিত প্রায় সমস্ত ধর্ষণের ঘটনায় সরকারি দল আওয়ামীলীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার খবর প্রকাশ পাওয়ার পর, যে ধরনের জবাবদিহিহীন ও স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা এই মুহুর্তে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে ; সেই ক্ষমতার আশ্রয়-প্রশ্রয় ও প্রয়োজনেই যে একের পর ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, অতি চাটুকারের পক্ষেও সেই সত্য এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলন থেকে ধর্ষকের শাস্তির বিষয়টি আলোচনায় আসছে। গত লেখায় (শুদ্ধস্বর,২০২০) আক্ষেপ করে বলেছিলাম, ইতিহাসে সম্ভবত এমন সময় কখনো কখনো আসে যখন এমনকি প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বয়ানও স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকে পুষ্ট করে। সার্বিকভাবে সহিংসতাকে আরো উস্কে দেয়। যখনই ধর্ষণের সংস্কৃতি ও ধর্ষক তৈরির কারখানা একচেটিয়া ক্ষমতাতন্ত্রের দিকে সমস্ত রাগ-ক্ষোভ-প্রতিরোধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে, তখনই অত্যন্ত সুকৌশলে ধর্ষণের ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’, ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’, ‘মৃত্যুদণ্ড’, ‘ক্রসফায়ার’, ‘প্রকাশ্যে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা’, ‘প্রকাশ্যে ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন’ এর মতো ভয়াবহ সব দাবি উঠে আসছে কিংবা বলা যায় এমন ক্ষতিকর ও ক্ষমতাতন্ত্রের জন্য পোয়াবারো দাবি পদ্ধতিগতভাবে সমাজে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ সংশোধনের অধ্যাদেশে সই করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ফলে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কেন হওয়া উচিত না ; এই মুহুর্তের জন্য এই আপাত অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কোন বিকল্প আমাদের সামনে নাই। কারণ একবার কোন দাবির সামাজিক সম্মতি তৈরি হয়ে গেলে, সেখান থেকে সমাজকে ফিরিয়ে আনা খুব সহজ কাজ নয়। দীর্ঘ একযুগ নিরঙ্কুশ এক সর্বাত্মক ক্ষমতার হিংস্র থাবায় এমনিতেই বাংলাদেশের সমাজ নানাবিধ মরবিডি ও গণবিকারে জর্জরিত। ইতিহাসের এমন এক সন্ধিক্ষণে মৃত্যুদণ্ডের মতো ক্ষতিকর দাবির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান পরিস্কার না করলে এবং দ্যর্থহীনভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধীতা না করলে, ইতিহাস হয়তো আমাদের ক্ষমা করবে না।
ধর্ষণের শাস্তি হিশেবে মৃত্যুদণ্ডের দাবি অনেকগুলো কারণেই ভয়াবহ। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, অন্যান্য পক্ষের কথা বাদ দিলেও, সমাজের সবচাইতে অগ্রসর বলে দাবিদার এবং ‘বিপ্লব’ এর মাধ্যমে সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সংকল্পবদ্ধ বামদলগুলোরও যেন মৃত্যুদণ্ডের বাইরে ধর্ষণের আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বলার মতো কিছু নেই! মৃত্যুদণ্ডই যেন সমাধান! বামজোটের সমন্বয়ক ও বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা বজলুর রশিদ ফিরোজ তো এমনকি প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেও মত দিয়েছেন। জনগণ নাকি মৃত্যুদণ্ড ‘চায়’। উনি নিজেই স্বীকার করেছেন, বিদ্যমান আইনে অপরাধীদের সাজা হচ্ছে না, ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। তাহলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রণয়নের মাধ্যমে এমন কোন মিরাকল প্রতিষ্ঠিত হবে যার মাধ্যমে ধর্ষণ ঠেকানো সম্ভব হবে? আসলে বামজোটের সমন্বয়কের সাথে আইনমন্ত্রীর কিংবা সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের কোন পার্থক্য নেই। প্রত্যেকেই জনগণের দোহাই দিয়ে মূলত রাষ্ট্রকেই আরো নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন করে তুলছেন। (প্রথম আলো ২০২০)
যে সব কারণে ধর্ষণের শাস্তি হিশেবে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ডের বিরোধীতা করা উচিত :
*ধর্ষণের শাস্তি হিশেবে মৃত্যুদণ্ড লৈঙ্গিক সহিংসতাকে আরো নজিরবিহীন স্তরে নিয়ে যাবে। প্রথমত মনে রাখা দরকার, সমাজে সহিংসতার শর্ত জিইয়ে রেখে, কেবলমাত্র কঠোর থেকে কঠোরতর আইন করলেই সহিংসতা সমাজ থেকে নির্মূল করা যায় না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে সহিংসতা আরো বৃদ্ধি পায়। মনে রাখতে হবে শাস্তি বা দণ্ড অপরাধ দূর করার অনেকগুলো ‘উপায়’ এর একটিমাত্র উপায়, একমাত্র উপায় নয়। যে ধরনের আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় ‘অপরাধ’ সংঘটনের এর শর্ত শুকিয়ে যেতে যেতে সমাজের অগ্রগতি এই পর্যন্ত সাধিত হয় যে, অপরাধ হয়ে ওঠে ব্যক্তির একান্ত মামলা ; সেই সমাজে শাস্তির কোন অর্থ থাকতে পারে। কিন্তু যে সমাজে খোদ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ‘অপরাধ’ উৎপাদন করে, সে সমাজে শাস্তি বা দণ্ড অর্থহীনতায় পর্যবসিত হয়।
যে রাজনৈতিক ক্ষমতা ‘দেলোয়ার’ তৈরির কারখানা, তার লাগাম টেনে না ধরে কেবলমাত্র দেলোয়ারকে শাস্তি দিয়ে অপরাধের সুরাহা করা যায় না। পাঠক খেয়াল করবেন, বেগমগঞ্জের আলোচিত ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটানোর অনেক আগেই, দেলোয়ার অস্ত্রসহ ধরা পড়েছিল জনতার হাতে, তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছিল, তার নামে খুনের অভিযোগ ছিল কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। এসমস্ত অপরাধ বরং দেলোয়ারকে ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন করেছে, রাতের ভোটকেন্দ্র দখলের উপলক্ষ্য হয়েছে (প্রথম আলো ২০২০)। দেলোয়ারকে দানবে পরিণত করেছে রাজনৈতিক ক্ষমতা। সারাদেশে এমন শত সহস্র ‘দেলোয়ার’ তৈরি হয়ে আছে। যে ক্ষমতাতন্ত্র ‘দেলোয়ার’ তৈরি করে, তার শেকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে কঠোর থেকে কঠোরতর আইন প্রণয়ন করে কেবল লৈঙ্গিক সহিংসতাই নয়, কোন সহিংসতাই রোধ করা সম্ভব হবে না।
*আইন ভালো বা কঠোর হলেই অপরাধ ঘটবে না কিংবা সমস্ত আর্থ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংকট ‘ভালো’ হয়ে যাবে এই ধারণাও অত্যন্ত বিপজ্জনক ধারণা। কারণ কোন রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামো যদি একপদকেন্দ্রিক হয় (যেমন বাংলাদেশ), সেই রাষ্ট্রে জবাবদিহির কোন ব্যবস্থা থাকে না। সেই চূড়ান্ত পদে যে-ই বসুন, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী-সামরিক শাসক বা যে নামেই বসুন, তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে রাষ্ট্র কিভাবে চলবে বা না-চলবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান সংবিধান, মানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনি দলিল সেই একচেটিয়া ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে ১৯৭২ সাল থেকে। এই জবাবদিহিহীন একপদকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামো অক্ষত রেখে ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে কোনো দাবি আদায় করলেও তা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা যায় না। তাই যেকোন আন্দোলনের অভিমুখ সেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকাঠামোকে ব্যাপক মাত্রায় গণতান্ত্রিক করার দিকে না হলে, আন্দোলনের সাফল্য ধরে রাখা মুশকিল।
কোন রাষ্ট্রে জনগণকে সমস্ত ক্ষমতার মালিক ও নিয়ন্ত্রক হতে হলে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক আইন, অর্থনৈতিক আইন, রাজনৈতিক আইন—এগুলোকে নাগরিকের অধিকার সুরক্ষার উপযোগী হতে হয়, রাষ্ট্র বা সরকারের স্বেচ্ছাচারের উপযোগী হলে হয় না। আর এ জন্যই, রাষ্ট্র পরিচালনার আইন অর্থাৎ প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আইন, যেগুলো রাষ্ট্র ও সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতা চর্চার উপযোগী করে সংবিধানে বানিয়ে রাখা হয়েছে, সেগুলোর সংস্কার করে নাগরিকের নিরঙ্কুশ অধিকার ভোগের অনুকূলে আনতে হবে। তা না হলে যতো কঠোর আইন বানানো হবে নাগরিকের ভোগান্তি আরো বাড়বে।
*বাংলাদেশে যে পরিমাণ ধর্ষণ সংঘটিত হয়, পরিসংখ্যানগত দিক থেকে তার অতি সামান্য অংশই নথিবদ্ধ হয়, বেশিরভাগই স্থানীয় সামাজিক-পারিবারিক চাপে ধামাচাপা কিংবা দফারফার মাধ্যমে ‘সুরাহা’ করার চেষ্টা করা হয়। খুবই নগণ্য সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা মামলা পর্যন্ত গড়ায়। বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতা, আইনের ফাঁকফোকর, পুলিশ-আইন-আদালতের ওপর ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব সব মিলিয়ে আরো নগণ্য সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনার বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অন্যান্য পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রেখে, কেবলমাত্র ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করলে, ধর্ষণের ঘটনা নথিবদ্ধ হওয়া নজিরবিহীনভাবে কমে আসবে। কারণ ধর্ষণ সাধারণত ঘটায় স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি, কিংবা আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কেউ। আর ধর্ষণের ঘটনা নথিবদ্ধ হওয়া কমতে থাকা মানে ধর্ষক উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা এবং ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা।
শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলে, ধর্ষণের শিকার নারী একদিকে যেমন মামলা না করার জন্য সামাজিক চাপে পড়বেন ; অন্যদিকে ধর্ষণ প্রমাণিত হলে নিজের আত্মীয় কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলতে হতে পারে, এই মানসিক চাপে ধর্ষণের শিকার নারী নিজেই নিজেকে অভিযোগ দায়ের করা থেকে দমিয়ে রাখবেন। এছাড়াও, মৃত্যুদণ্ডের বিধান ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ এর ধারণাকে এক প্রকার মুছেই ফেলবে বলতে গেলে।
*মৃত্যুদণ্ডের বিধান ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর খুন হওয়ার ঝুঁকি নজিরবিহীনভাবে বাড়িয়ে তুলবে। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনার কোন তৃতীয় পক্ষীয় সাক্ষী বা প্রত্যক্ষদর্শী থাকে না। আক্রান্ত নারী/শিশুই একমাত্র আলামত/সাক্ষী/প্রমাণ। সুতরাং, ধর্ষক আলামত মুছে ফেলতে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে খুন করে ফেলতে পারে, এমনকি খুন করার পর লাশও গুম করে ফেলতে পারে। অর্থাৎ ধর্ষণের শর্ত জিইয়ে রেখে, মৃত্যুদণ্ডের বিধান ধর্ষণের পাশাপাশি খুনের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলবে।
*ধর্ষণের শাস্তি হিশেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধানের বিরোধীতা সবচেয়ে বেশি নারীদেরই করা উচিত। কারণ এটা নারীর জন্য অমর্যাদাকর। কোন নারী খুনের শিকার হলে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী খুনীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, আবার ধর্ষণের শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড করার মাধ্যমে মূলত স্বীকার করে নেয়া হয় যে, কোন নারীকে ধর্ষণ করা খুন করার চেয়েও বড় কিংবা সমান অপরাধ। এটা একদিকে যেমন নারীর যোনীকেন্দ্রিক ‘সতীত্ব’, ‘ইজ্জত’ এর ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে, অন্যদিকে সমাজে খুনকে ‘স্বাভাবিক’, ‘প্রত্যাশিত’ অপরাধে পরিণত করে। ধর্ষণকে করে তোলে ‘বিশেষ’ অপরাধ, যে অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ অপরাধ (খুন) এর চেয়েও বেশি বা সমান। ধর্ষণে নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন, ‘ইজ্জত’ বা ‘সম্ভ্রমহারা’ হন না, সুতরাং ধর্ষণকে ‘বিশেষ’ অপরাধ হিশেবে বিবেচনা করে বিশেষ শাস্তির বিধান সমাজকে আরো গভীরভাবে পুরুষতান্ত্রিকই করবে। নারীকে পুরুষের অধস্তনই রাখবে। ২০১৮ সালে প্রদত্ত ভারতের নারীবাদী সংগঠকদের একটি যৌথ বিবৃতি প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উদ্ধৃত করছি:
“The logic of awarding death penalty to rapists is based on the belief that rape is a fate worse than death. Patriarchal notions of ‘honour’ lead us to believe that rape is the worst thing that can happen to a woman. There is a need to strongly challenge this stereotype of the ‘destroyed’ woman who loses her honour and who has no place in society after she’s been sexually assaulted. We believe that rape is a tool of patriarchy, an act of violence, and has nothing to do with morality, character or behaviour.”
এছাড়াও, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী: ধর্ষণের পর হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং কেবলমাত্র ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন রাখা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে কেবলমাত্র ধর্ষণের সাথে ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যাকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা ভাবা হয়েছে। ধর্ষণ করলে যা শাস্তি(যাবজ্জীবন) হবে, ধর্ষণের পর হত্যা করলে শাস্তি(মৃত্যুদণ্ড) তার চেয়ে বেশি হবে যেন ধর্ষণের পর হত্যা করার প্রবণতা নিরুৎসাহিত হয়। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলে সেই পার্থক্যটি আর থাকবে না, ফলে ধর্ষণ এবং ধর্ষণসহ হত্যার শাস্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। নারীর জীবন অধিক ঝুঁকিতে পড়বে।
*তবে একদিকে ধর্ষণকে ‘মহিমান্বিত’ করা, অন্যদিকে খুনকে নিত্যনৈমিত্তিক অপরাধে পরিণত করার সামাজিক মনস্তত্ত্ব নির্মাণে এই দেশের অগ্রগণ্য লেখক সাহিত্যিকরাই ভূমিকা রেখেছেন। তাদের অনেকের কাছেই ধর্ষণ খুনের চেয়েও মর্মান্তিক। কারণ ধর্ষণে নারী ‘কলঙ্কিত’ হয়। তাদের চিন্তায় এই ‘কলঙ্কের’ দাগ এতটাই গাঢ় যে তাঁরা মনে করেন এর চেয়ে হত্যা কম মর্মান্তিক। আদতে হত্যা যেকোন অর্থেই ধর্ষণের চেয়ে মর্মান্তিক। কারণ হত্যা মানে একজন মানুষের জীবনাবসান, আর উপযুক্ত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শুশ্রূষা পেলে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ধর্ষণের ট্রমা থেকে নিস্তার লাভ করতে পারেন।
ধর্ষণ সম্পর্কে সমাজে যদি সচেতনতা থাকে, সমাজ,পরিবার যদি ধর্ষণ থেকে প্রাপ্ত শারীরিক ও মানসিক আঘাত সারিয়ে তুলতে আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে দাঁড়ায় ; তাকে যদি এটা বোঝাতে সক্ষম হয় যে এতে তার দোষ বা কলঙ্ক বা সম্ভ্রম হারানোর কিছু নেই তাহলে সেই নারী সমাজ এবং জীবনে পূর্ণ উদ্যম নিয়ে ফিরে আসতে পারেন। অর্থাৎ দরকার ধর্ষণ বিষয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন। আমরা নিশ্চই ভুলে যাইনি, এক ভয়াবহ বিরূপ সামাজিক পরিস্থিতিতেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার নারীরা সমাজের রক্ষণশীলতাকে মোকাবেলা করেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।
দণ্ড হিশেবে ফাঁসির আরেকটা সংকট হলো হয় ফাঁসি না হয় খালাস। মানে ফাঁসি না হলে সাধারণত অন্য কোন শাস্তি হবে না; খালাস। ধর্ষণের মামলায় ফাঁসির সংকট হলো আক্ষরিক অর্থেই প্রচুর মামলা উচ্চ আদালতে গিয়ে খারিজ হয়ে যাবে। কারণ ফাঁসির রায় কার্যকর করা খুব সহজ কথা নয়।
এক্ষেত্রে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য : “বিচারের বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে শাস্তি যত কঠোর হয়, আসামি তত বেশি নির্দোষ প্রমাণিত হয়। বর্তমানে যাবজ্জীবনের পরিবর্তে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান করলে ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ১ শতাংশের নিচে নেমে আসবে। বিচারে কোনো আসামি দোষী প্রমাণিত হলে এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় হলে এর বিরুদ্ধে আপিল যাবে হাইকোর্ট বিভাগে। হাইকোর্ট বিভাগ মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখলে আপিল যাবে আপিল বিভাগে। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ফলে বিচার শেষ হতে কমপক্ষে ১২ বছর লাগবে। ফলে শাস্তির দৃষ্টান্তমূল্য ভীষণভাবে হ্রাস পাবে।” (প্রথম আলো ২০২০)
*আদালত-পুলিশ-উকিলসহ গোটা বিচারিক প্রক্রিয়াই যদি একচেটিয়া ক্ষমতার প্রভাবাধীন হয়, সেক্ষেত্রে আইনের সিলেক্টিভ এবং রাজনৈতিক প্রয়োগ বন্ধের ব্যবস্থা না করে অপরাধের সাজা বৃদ্ধি যে কাউকে বিপদে ফেলবে। দণ্ড হিশেবে ফাঁসি সমাজে অন্তত দুটো নেতিবাচক পরিবর্তন তথা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। প্রথমত, খুনের মতো সর্বোচ্চ সহিংসতাকে স্বাভাবিকীকরণ করার মাধ্যমে সার্বিকভাবে খুনের শর্ত আরো পোক্ত হবে, অপরাধী যদি ক্ষমতা বলয়ের লোক হয়, সেক্ষেত্রে মামলা না হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ; মামলা হলেও প্রভাব খাটিয়ে উচ্চ আদালত থেকে দায় খারিজ করা সম্ভব।
সাথে আছে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা মঞ্জুরের প্রবল সম্ভাবনা। গত একুযুগে ক্ষমতাসীন দলের লোক বিবেচনায় কতজন ফাঁসির আসামীর দণ্ড মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি তা ইন্টারনেটে সার্চ করলেই পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় সংকটটি আরো ভয়াবহ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে ‘ধর্ষণ মামলা’ হয়ে উঠবে মোক্ষম হাতিয়ার। কোন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে যদি ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করা হয় হয়রানির উদ্দেশ্যে, নিষ্পত্তি হোক বা না হোক সদা সর্বদা মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাবনা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপের ফাঁদে ফেলতে পারে। সমাজে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ সম্পর্কে সন্দেহ, অবিশ্বাসও তৈরি হবে। এতে প্রকৃত ভিক্টিম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
জেল-জরিমানা, মৃত্যুদণ্ড, ক্রসফায়ার, বিভিন্ন মেয়াদের সাজা অপরাধ কমায় না। অপরাধ কমায় আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আমূল পরিবর্তন। শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্য হতে হবে অপরাধ দূর করা, প্রতিশোধ গ্রহণ করা কিংবা অপরাধের মাত্রা বাড়ানো না। যে দণ্ড অপরাধ কমায় না, বরং বাড়ায়; সেই দণ্ড অর্থহীন এবং ক্ষতিকর। অপরাধী যদি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পায়, খোদ ক্ষমতাতন্ত্র যদি অপরাধ ও অপরাধী উৎপাদন অব্যাহত রাখে, তাহলে কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি সমাজকে আরো সহিংস করে তুলবে। কঠোর শাস্তি কিংবা সর্বোচ্চ শাস্তি কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অনেকক্ষেত্রেই ন্যায়বিচারের অন্তরায়। নিষ্ঠুর কিংবা কঠোর শাস্তি নয়, দরকার শাস্তির নিশ্চয়তা। তার আগে দরকার অপরাধ ও সহিংসতার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অকার্যকর, নির্বিষ করে ফেলা। আমরা যেন ভুলে না যাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই খুনের শাস্তি হিশেবে ‘মৃত্যুদণ্ড’ বিধান আছে, কিন্তু এটা খুনের পরিমাণ কমাতে পারেনি। বরং দিনকে দিন বেড়েই চলছে
সমাজ-রাষ্ট্রে যদি অপরাধ ব্যাপকভাবে নিরুৎসাহিত হয়, কেবলমাত্র তখনই ‘অপরাধ’ হয়ে ওঠে ব্যক্তির স্বভাবজাত সমস্যা, ফলে সেইক্ষেত্রে শাস্তির মাধ্যমে অপরাধীকে শুধরানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। আমাদের এমন সমাজ-সম্পর্ক ভাবতে পারতে হবে, যেখানে অপরাধী ও আক্রান্ত ব্যক্তি উভয়কেই সমাজে ধারণ করা সম্ভব। এই ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘restorative justice system’ ; যার মূল লক্ষ্যই থাকে আক্রান্ত ব্যক্তি যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, অপরাধীর উপর সেই উপযুক্ত ও পরিমিত ক্ষতিপূরণ/শাস্তি ধার্য করে আক্রান্ত ব্যক্তির ট্রমা লাঘব করা। পরিশেষে সমাজগর্ভে বিকশিত দুই পক্ষকেই পুনরায় সামাজিকভাবে আত্মীকরণ করা। এই ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়ার লক্ষ্য থাকে একই অপরাধ পুনরায় সংঘটিত না হতে পারা, অপরাধীর অর্থপূর্ণ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সত্যিকার অর্থেই ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত হওয়া।
এটা তখনই সম্ভব যখন বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি পুনঃপুন অপরাধের সংঘটনের প্রভাবক হয় না।
কিন্তু উপনিবেশের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সকল রাষ্ট্রেই ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিশোধপরায়ন এবং অপরাধ-অনুকূল। এহেন জাস্টিস সিস্টেমে অপরাধ সংঘটনের পর গোটা বিচারিক প্রক্রিয়ায় ন্যারেটিভের ওপর ভিক্টিমের হিস্যা প্রতিষ্ঠিত হয় না, রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভই প্রাধান্য পায় ; বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারলেও একেকটা অপরাধকে কেন্দ্র করে( দণ্ড, বয়ান সবকিছু মিলিয়ে) রাষ্ট্র আরো প্রবল আরো অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ইতিহাসে কখনো কখনো এমন সময় আসে মনে হয়। যখন কালেক্টিভ হিস্টেরিয়াই রুলে পরিণত হয়! একদিকে খুন-ধর্ষণ-ক্রসফায়ারসহ যাবতীয় নিপীড়ন ভায়োলেন্সের ব্যাপকভাবে স্বাভাবিকীকরণ ঘটে ; অন্যদিকে একেকটা ঘটনা সেনসেশন তৈরি করার পর, তার প্রেক্ষিতে সমাজে যে প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে, যে ধরনের আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে, প্রতিবাদের যে বয়ান দানা বাঁধে ; এমনকি ‘সমাধান’ এর নামে তা সমাজকে আরো সহিংস, আরো দণ্ডবাদী করে তোলে! এ যেন এক ভয়ংকর চোরাবালি ; যেখানে নূন্যতম নড়াচড়া করার অর্থ হচ্ছে আরো গভীরভাবে তলিয়ে যেতে থাকা। বাংলাদেশ তেমনই এক ট্রমার টানেলে ঢুকে পড়েছে বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের মানুষ বর্তমানে সরকার-রাষ্ট্র-রাজনৈতিক ক্ষমতা নামক মহামারীতে আক্রান্ত। এখানকার মানুষের জান-মাল-মর্যাদাসহ সার্বিক অস্তিত্বই আজ ভয়াবহভাবে লুণ্ঠিত। এই দানবীয়, মহা-রাক্ষস ক্ষমতার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সমস্ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-আন্দোলনে এমন ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করতে হবে যা কোনভাবেই আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত ও পরিকল্পিত দাবিদাওয়াকে, আন্দোলনের পরিস্থিতিকে ক্ষমতার অনুকূল না করে।
ছবি কৃতজ্ঞতা
প্রচ্ছদ: মোরশেদ মিশু
ছবি ১: অজ্ঞাত
ছবি ২: নেত্র নিউজ
ছবি ৩: আবদুল্লাহ কাফি
তথ্যসূত্র:
*শুদ্ধস্বর ২০২০, “ধর্ষণ: সহিংসতা,বয়ান, পুনরুৎপাদন”, সারোয়ার তুষার, অক্টোবর ৯
*প্রথম আলো ২০২০, “সাজা মৃত্যুদণ্ড হলে ধর্ষণ কমবে?”, অক্টোবর ১১
**প্রথম আলো ২০২০, “অস্ত্রসহ ধরা, গণপিটুনি, তবু ছাড়া পান দেলোয়ার”, অক্টোবর ১২
*প্রথম আলো ২০২০, “৭টি ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছেই, এখন হবে ৮টি”, ড. শাহদীন মালিক, ১৩ অক্টোবর
*নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
bdlaws.minlaw.gov.bd/act-835.html
Sarwar Tusher is an author and activist; interested in studying the state, power, authority, sovereignty, violence, and social relations.