কাহিনি–সংক্ষেপ
ড্যানিয়েল ডিফোর (১৬৬০–১৭৩১) কিশোর ক্লাসিক রবিনসন ক্রুসো। উপন্যাসের নায়ক ক্রুসো জনমানবহীন একটি দ্বীপে আশ্রয় নিয়ে জীবন রক্ষা করে। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। একরাশ গাছপালা ও পশুপাখী। কোনো সঙ্গী সাথী নেই। শুধু পোল নামের একটি কাকাতুয়া ঘোরে ফেরে আর ডাকে—রবিন ক্রুসো, রবিন ক্রুসো, তুমি কোথায়, কোথায়…
এই বিজন দ্বীপে মানুষটি আঠাশ বছর একাকী কাটায়। শেষের ক’বছর সভ্য জগতের বাইরের বাসিন্দা ফ্রাইডেকে সঙ্গী হিসেবে পায়। নরখাদক বর্বরদের হাত থেকে সে তাকে রক্ষা করে। আশ্চর্য আর লোমহর্ষক সেই কাহিনী। আরও আশ্চর্য ঘটনা পরম্পরায় তাঁরা দ্বীপ থেকে সভ্য জগতে ফিরে আসে। তারপর নতুন আরেক যাত্রা। অরণ্য। হাজার হাজার নেকড়ের ভয়ার্ত ডাক। তাদের থেকে আত্মরক্ষার বিস্ময়কর বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে উপন্যাসটিতে।
আর সেই দ্বীপ? সেখানে গড়ে ওঠে নতুন জনপদ। প্রতিষ্ঠিত হয় রবিনশন ক্রুসোর পূর্ণ কর্তৃত্ব।
তাত্ত্বিক পটভূমি
আধুনিকতা একটি বিশেষ চিন্তা কাঠামো। এই চিন্তা কাঠামো বুঝতে হলে ইউরোপে ১৭ ও ১৮ শতকে প্রায় দুশো বছর ধরে চলা নতুন চিন্তার উত্থানকে বুঝতে হবে। এই চিন্তার উত্থানটাই আধুনিকতা। আধুনিকতা কখনও কখনও বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন শহুরেপনা বা শহরের তরিকায় অভ্যস্ত হওয়া। কিন্তু এগুলো আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। শুধু এটুকুই আধুনিকতা নয়।
মূলত বুর্জোয়া ভাবাদর্শই আধুনিকতা। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ধারণা গড়ে ওঠে। শিল্প বিপ্লব যে নতুন পৃথিবী, নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্ম দেয় তার সাংস্কৃতিক আবহ-ই আধুনিকতা।
শিল্প বিপ্লবের পুর্বে রাজা বাদশা ও চার্চের মাধ্যমে ইউরোপ শাসিত হতো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অভিঘাতে মানুষ রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচার, শোষণ ও চার্চের নিপীড়ন সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে। স্বাধীনতা, মুক্তি, প্রগতি, সহনশীলতা, সংবিধান, সরকারের পৃথকীকরণ ইত্যাদি ধারণা বিকশিত হতে শুরু করে। এর ফলে যুক্তি, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ইত্যাদির ব্যাপক চর্চা শুরু হয়।
উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ কৃষিক্ষেত্রে কায়িক শ্রমের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব হ্রাস পায়। ফলে দলে দলে লোকজন নগরমুখী হয়। তাই ঐতিহ্যগতভাবে আধুনিকতা নগরাশ্রয়ী এবং রাজা-বাদশা ও চার্চের সমালোচনার পাত্র।
রাজ্য আর রাষ্ট্র এক নয়। রাষ্ট্রে জনগণ পরস্পরের সঙ্গে চুক্তির অধীনে বসবাস করে। যার নাম সংবিধান। তাই রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে। কিন্তু রাজ্যে প্রজারা রাজার ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন। তাই পারস্পরিক চুক্তির অধীনে থাকা অবান্তর। খুব সম্ভবত ম্যাকিয়াভেলির প্রিন্স প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে মানুষজন রাষ্ট্র নাম ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিল না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদ ও রাজ্যের পরিবর্তে রাষ্ট্রের উত্থান প্রায় সমসাময়িক।
এনলাইটেনমেন্ট যেমন আধুনিকতার মনোজগৎ তৈরি করে ঠিক তেমনি পুঁজিবাদ তার সঙ্গে আধুনিকতাকে নিয়ে আসে। আর এই আধুনিকতার একটি প্রপঞ্চ সেকুলারিজম। এনলাইটেনমেন্টের মুখ্য দিক জীবনকে যুক্তির মাপে দেখা। এর আগে জীবনের সবকিছু ( যেমন আবেগ-অনুভূতি, আধ্যাত্মিকতা ) ঈশ্বর বিশ্বাস দিয়ে বিচার করা হতো।
জগতের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া এই দর্শনের খামতি ধরা পড়ে যুক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মানুষজনের চোখে। ১৮ শতাব্দীতে এই সমালোচনা শুরু হয় ম্যাক্স ওয়েবারের হাতে। তিনি এনলাইটেনমেন্ট কে দেখেছিলেন ‘আয়রন কেইস অফ ফিউচার’ হিসেবে। এরপর ফ্রাঙ্কফুর্টস্কুলের হার্ক হাইমার ও অ্যাডর্নো লিখলেন ‘ডায়ালেক্ট অব এনলাইটেনমেন্ট’। তারা দেখান, এনলাইটেনমেন্ট কিভাবে প্রকৃতির ওপর মানুষের এবং মানুষের উপর মানুষের আধিপত্য সৃষ্টি করে। মোদ্দাকথা, যে এনলাইটেনমেন্ট আধুনিকতার মনোজগৎ তৈরি করে তার ভিত্তি ভূমি কেঁপে উঠে। বিশেষত নৈতিক দিক থেকে।
আজকের দিনে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদী ধারায় সাজানো। অথচ, পুঁজিবাদকে সন্দেহ আর অবিশ্বাস করা হয় সবচেয়ে বেশি। মনে করা হয়, আমাদের সকল দুর্দশার মূলে ক্যাপিটালিজম। কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। ক্যাপিটালিজম কাল পর্বেই পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূর হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কথিত আছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৫ সনের মধ্যে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি দারিদ্র্য দূর হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য দূর হয়েছে ১৯৮৯ সনের চীনের অর্থনৈতিক সংস্কারের পর থেকে।
পুঁজিবাদের এত দুর্নাম কুড়ানোর কিছু ঐতিহাসিক কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ, মনে করা হয় পুঁজিবাদ/ব্যবসা আর আধ্যাত্মিক জীবন একসঙ্গে যায় না। এর সমর্থনে বাইবেলে কাহিনি বর্ণিত আছে। আছে চিত্রকর্ম ‘জেসাস এন্ড দ্য মানি ল্যান্ডার’। এই ফ্রেস্কোতে বর্ণিত আছে, যিশু একজন ব্যবসায়ীকে পেটাচ্ছেন। কারণ, সে সুদের বিনিময় অর্থ ধার দিত। আছে উপন্যাস ‘হার্ড টাইমস’। এখানে ডেভিড কপারফিল্ড দেখান, পুঁজিবাদ একটি শয়তানি ব্যবস্থা। যেখানে অসংখ্য মানুষের নির্মম দারিদ্র্যের বিনিময় অল্প কিছু মানুষ ধনীহয়। জন রাসকিন ‘আন্টু দা লাস্ট’ গ্রন্থে দেখান কিভাবে পুঁজিবাদ মানুষকে প্রতারিত করে, পরিশেষে ধ্বংস করে। এমন সব চাহিদা তৈরি করে যারআদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি সেই পুরোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন : টাকার উপার্জন নৈতিক হলেই হবে না, খরচও করতে হবেনৈতিকভাবে।
আধুনিকতা যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ ছাড়া সবকিছু বাতিল করে দেয়। তাই মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, অভ্যাস, আধ্যাত্মিকতা, মানবিক সম্পর্ক, মিথ ইত্যাদি আধুনিকতার দৃষ্টিতে অপাংক্তেয়। মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের পরিবর্তে জাতি পরিচয়, আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে দেশ প্রেম তার অভিষ্ট।প্রকৃত প্রস্তাবে আধুনিকতা এমন একটি সমন্বিত প্রকল্প, যুক্তিও বলা চলে, যেখানে ব্যক্তি ও বিজ্ঞান পরস্পরের হাত ধরে প্রগতির পথে চলে।
আধুনিকতাপূর্ব কালে মানুষ ছিল সমাজের অধীন; সামাজিক মানুষ। আধুনিকতা তাকে মুক্ত করে ব্যক্তি মানুষে পরিণত করার প্রয়াস পায়।যেখানে সে অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে উপস্থিত হয়। নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে প্রয়াসী হয়। তাই বলা চলে, আধুনিকতাপূর্ব কালে ব্যক্তি ( ইন্ডিভিজুয়াল) ছিল কিন্তু তার স্বাধীনতার স্বীকৃতি ছিল না অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ছিল না।
তখন রাজ্যের সঙ্গে কমিউনিটির সম্পর্ক ছিল। যেমন: গ্রামের সকলে মিলে একত্রে রাজাকে কৃষি কর দিত। আলাদা ব্যক্তি কর ছিল না। তখন পুত্র অপরাধ করলে পরিবারের কর্তা হিসেবে বাবাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হত। গ্রামের ছেলে হিসেবে গ্রামবাসীর মাথা লজ্জায় হেট হয়ে যেত।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কারণে এই সামাজের অধীন মানুষকে লোভী ও স্বার্থপর হিসেবে তৈরি করা কঠিন। কিন্তু লোভ আর আত্মস্বার্থ পরায়ণ মানুষ ব্যতীত পুঁজিবাদ অসম্ভব। তাই সে আধুনিকতার বর্মে সমস্ত নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে ‘ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা’ ধারণা তৈরিতে সচেষ্ট হয়। এখানে পুত্রের অপরাধে পিতা কিংবা গ্রামবাসী দায়ী নয়।
এই ব্যক্তিকে রাজ্যের সঙ্গে তার পুরনো সম্পর্কের কাঠামোয় ধারণ করা কঠিন। প্রয়োজন নতুন চুক্তির। এই চুক্তি হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় সংবিধানতার দলিল। রাজ্যের সঙ্গে রাষ্ট্রের অনেক মিল থাকতে পারে কিন্তু মুখ্য অমিল হচ্ছে ব্যক্তি কিংবা ইন্ডিভিজুয়ালের থাকা কিংবা না-থাকা।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যতিরেকে পুঁজিবাদ, আধুনিকতা, রাষ্ট্র ইত্যাদির অস্তিত্ব অসম্ভব।
রাজনৈতিক প্রকল্প
উপন্যাসটির কাহিনি সংক্ষেপের সঙ্গে আধুনিকতার তাত্ত্বিক পটভূমি মিলিয়ে নিলে সাধারণ দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে এখানে কিভাবে আধুনিকতার রাজনৈতিক প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে। স্মর্তব্য যে, উপন্যাসটি ১৭১৯ সনে প্রকাশিত। তাই উপর্যুক্ত সময়ের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসে বর্ণিত আধুনিকতাকে বিবেচনা করতে হবে।
মানুষ একটি সামাজিক সত্তা। বিস্তর মানুষের সঙ্গে সে বিনিময় সম্পর্কে সম্পর্কিত না থাকতে পারলে তার অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব। সমাজতান্ত্রিক ধারার অর্থনীতিবিদগণ বলেন—উৎপাদন সবসময় সামাজিক। তাই ভোগ ও বিনিময় সামাজিক হলে মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে একটি নির্দিষ্টসীমা রেখায় রাখা সম্ভব।
অপরদিকে, পুঁজিবাদে ভোগ ব্যক্তিগত। ব্যক্তি এখানে ভোগ ও বিনিময়ের কর্তা। ব্যক্তির ভোগাকাঙ্ক্ষা সীমাহীন। তাই তাকে সমাজ থেকে আলাদা না করলে পুঁজিবাদ, যা আধুনিকতার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, দাঁড়াতে পারে না। তাই মর্ডানিজমের দেখানোর প্রয়োজন হয়েছিল এমন এক সত্তার যে নিজেকে কোনরূপ সামাজিক বিনিময়ের মধ্যে না রেখেও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। এভাবেই জন্ম নিয়েছে রবিনসনক্রুসো। যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিবাদের বর্ম পড়ে ঘুরে বেড়ায়। তৈরি করে তার ব্যক্তিতন্ত্রের নিজস্ব দ্বীপ।