রমানাথ
এক
দিল্লিতে রাস্তার ধারে নাপিতগুলো সার ধরে বসে থাকত। লোকে খুব একটা ভিড় জমাত না। দিল্লির লোক চুলকাটা বা শেভ করা খুব পছন্দ করে না। নইলে ওদের ওরকম একা ফাঁকা বসতে হয়? প্রতিদিন সকালবেলায় চিন্ময়, রমানাথকে ১টা পয়সা দিতেন। সেই একপয়সা নিয়ে রমানাথ প্রথম প্রথম ভেবে পেত না কী করবে। চকলেট খেতে হলে দেড় মাইল হেঁটে একটা দোকানে যেতে হয়। সেখানে পাঁচটা চকলেট খাবার পর বাড়ি ফেরার পথে পেট সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যায়। মা কিন্তু তাই বলে রমানাথকে তখুনি খেতে দেন না। দিল্লিতে তাদের কাছের মানুষ বলতে নাপিতগুলো। দিল্লি আসবার ক’দিন পরে কে হুয়া নেহি হুয়া ধরনের বাংলায় কথা বলায় দুটো নাপিতের সঙ্গে তার জমাট খাতির হয়। এর প্রথম ফলাফল, নেড়ে মাথায় বাড়ি ফেরা। উৎসাহের বশে সুরেশ নাপিতকে বলে, ‘হামি তুমার চুলকে ঠিক করনা চাহ্তা।’ এ কথা বলে সে রমানাথের চুলের উপরে ছুরিকাঁচি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার চুলকাটা সমাপ্ত হলে আয়নায় রমানাথ দেখে নিজের কিম্ভূত চেহারা। চিনতেই পারে না নিজেকে। কান্নার প্রান্তে পৌঁছায় সে। কী করবে সে এখন? প্রমোদ নাপিত এগিয়ে আসে, ‘খোকা, তুমহারা চুল চাঁছ দু?’ বলে, রমানাথের সম্মতির একটুও অপেক্ষা না করে, পানি দিয়ে তার চুল নরম করে মাথায় কাঁচি চালিয়ে দেয়। চুল ছোট ছোট করে ছাঁটার পরে চাঁছা শুরু করলে রমানাথ সর্বনাশ বুঝতে পারে। কোনোমতে প্রমোদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে।
বেলা হয়েছে, মা পাকশালে। রমানাথ চুপিচুপি আয়নায় নিজের মাথা দেখে। চুল ছোট ছোট করে ছাঁটার ফলে তার মাথার উঁচু নিচু ক্ষেত্রগুলো এখন প্রভুত্ব করছে। মনে হচ্ছে চুল ছেঁটে এবড়োখেবড়ো করা হয়েছে তার মাথা। ডান কানের উপরে খানিকটা বেলমাথা দেখা দিয়েছে; একটা সরু লাল রেখা তার মাঝে বিন্দু বিন্দু ফুটে উঠেছে। রক্তের রেখা, রমানাথ স্থিত তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখে, কানের কিনারা ঘেঁষে রক্তের ক্ষীণ স্রোত নেমে আসছে। কান্নার নোনতা স্বাদ জিভে পায় সে। ডেটলের শিশিটা নামায়, খুঁজে পায় না তুলা, কোথাও না। বিজন জিজ্ঞেস করে, ‘কী খুঁজছিস, দাদা?’ সে জবাব দেয় না। হাত দিয়ে ডেটল লাগাতে লাগাতে শিশি র প্রায় সব ডেটল শেষ করে ফেলে। ঢেলেও ফেলে। ডেটলের শিশি শেষ করে ফেলায় রমানাথ ভয় পেয়ে যায়, চিন্ময় প্রতিদিন শেভ করে ডেটল খোঁজেন। নিশ্চয়ই কাল সকালে এ খবর জানলে তার পিঠের চামড়া ঠিক থাকবে না। আয়নায় চুলের চাঁছা অংশ বড় হতে থাকে, মনে হয় অর্ধেক মাথা চাঁছা, অর্ধেক নয়। সুতরাং দ্রুত সে অঙ্ক বইয়ের ফাঁক থেকে এক পয়সা নিয়ে চলে যায় নাপিতের কাছে। সুরেশ ও প্রমোদের কাছে যায় না। ওরা দু’জন খুব ডাকে, সে কানেও নেয় না। আজকে ওরা দু’জন রমানাথের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। এক বৃদ্ধ নাপিতের কাছে যায়, তার মুখ ভর্তি ছোট ছোট দাড়িমোচ, চুলদাড়িতে একটু খয়েরি আভা, নাপিতটা কথা বলে না মোটেই। নিঃশব্দে সে রমানাথের মাথা কামায়, তার চুল ভেজানো, মাথায় ঘাড়ে কানে হাত রাখা, ক্ষুর চালানো, সবই অনবদ্য। তার ক্ষুরের স্পর্শে যখন সরে যায় চুল, মনে হয় জায়গাটিতে বরফ বুলিয়ে দিল কেউ। চুল কামানো শেষে রমানাথের মনে হয় তার মাথা ভীষণ ফাঁকা ঝরঝরে হালকা হয়ে গেছে, অ্যাদ্দিন কেউ যেন অনুক্ষণ তার মাথায় চাপিয়ে রেখেছিল একটা বোঝা। এখন আর বোঝা নেই, হালকা সে, বৃদ্ধের হাতে একপয়সা গুঁজে দিয়ে বাড়ি ফেরে। বিজন তাকে দেখেই চেঁচিয়ে ছড়া কাটে, ‘নেড়ে মাথা টাকটুক, বর্ষাকালে হাগার সুখ।’
বৃদ্ধ নাপিতটিকে খুব ভাল লাগে রমানাথের। দিনে সে জেগে থাকে যতক্ষণ, মনে মনে কথা বলে নাপিতটার সঙ্গে। মনে মনে তার বাড়ির খবর নেয়। কল্পনা করে, যমুনার ধারে ছোট্ট একটা কুটিরে থাকে নাপিতটা। একটাই ঘর, বউ ও গোটা কয়েক ছেলেমেয়ে। নাপিতের বোধহয় একটা গাধাও আছে। ভোরবেলা উঠে সে গাধাটাকে ছেড়ে দেয়, সারাদিন সেটা চরে বেড়ায়। সন্ধ্যায় নাপিত বাড়ি ফেরার পরে গাধাটা বাড়ি ফেরে। বৃদ্ধ এমনিতে তো কথা বলে না, তখন নিশ্চয় গাধাটার সঙ্গে কথা বলে। গাধাটার লম্বা লম্বা কান, ঘোড়ার মতো চেহারা, সবই মনে মনে দেখতে পায় সে।
ছোটবেলায় রমানাথ গাধার দুধ খেয়েছিল কিছুদিন, তার মা এজন্যে রমানাথকে আদর করে ‘গাধামণি’ বলে কখনোসখনো ডাকেন। দুপুরে খাওয়ার পরে সময় পেলে মা রমানাথকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে গাধার গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতেন বারবার। গাধাকে নিজে সে কখনো দেখেছে মনে করতে পারে না, কিন্তু মায়ের বলা গল্পে গল্পে গাধাটা প্রায় জীবন্ত ঘুরত তার সামনে। মা তার কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গল্প বুনতেন, ‘তুই যখন হলি, প্রথম ছেলে, তোর বাবা ভেবেই পান না কী করবেন আর কী করবেন না। শেষে কে যেন বুদ্ধি দিল গাধার দুধ ছোট বাচ্চার জন্য খুব উপকারী। তোর বাবা খোঁজ শুরু করলেন গাধা কোথায় পাওয়া যায়। শেষে মিলল, দিল্লিতে পাওয়া যায় গাধা। কোথায় রাজশাহী আর কোথায় দিল্লি। তোর বাবা নিজেই দিল্লি চললেন, এই তো সেদিনের কথা, নয়শ টাকা খরচ করে গাধা আনলেন, সঙ্গে বাচ্চাও। মাইনে করা লোক রাখলেন। গাধার দুধ কি তাই প্রথমে তুই খেতে চাস! বুকের দুধ খেয়ে অভ্যাস। গাধাটার চেহারা ছিল চমৎকার। চকচক করত গা, প্রথম প্রথম অনেক লোক দেখতে আসত, মজার সব প্রশ্ন করত, অনেকে খুব তারিফ করত, কেউ কেউ বা একটু দূরে গিয়ে নিন্দায় ফেটে পড়ত। তোর বাবা তখন সারাদিন বাড়িতেই থাকেন। হয় তোর কাছে, নয়তো গাধার কাছে। মাস কয়েক ভালই গেল। তোর বাবার সংসারে মন দেখে তোর জ্যাঠারা খুব খুশি। ভালোই চলছিল। একদিন ভোরে গাধার বাচ্চাটাকে পাওয়া গেল না। চারদিকে খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। চাকরবাকরেরা খোঁজাখুঁজিতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে তিনদিন বাজার করার অভাবে মাছ ছাড়াই ভাত খেতে হলো আমাদের। গাধার বাচ্চার খোঁজে রাজশাহী শহরের চারদিকে ৫/১০ মাইল পর্যন্ত লোক পাঠানো হলো। হা হতিশ্যি। পাওয়া গেল না। তোর বাবা আশা ছাড়েন না। তোর জ্যাঠা জানিয়ে দিলেন গাধার বাচ্চার খোঁজে তিনি আর লোক পাঠাতে দেবেন না, এতে এস্টেটের কাজে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। সেই হলো কাল। তিনি নিজেই বেরুলেন বাচ্চাটার সন্ধানে। তিনমাস কোনো খবর নেই তাঁর। চিঠিও দেন না। আমি খোঁজ নেব, নিজের লোক তো কেউ নেই সেখানে। তোর জ্যাঠারা দায়সারা গোছের খোঁজ করে। বাড়ি ফিরলেন তিনি সন্ন্যাসীর বেশে। শুরুতে মাঝে মাঝে ছ’মাস ন’মাস পর পর বাড়ি ফিরতেন, থাকতেন ১৫ দিন থেকে একমাস। তারপর চলে যেতেন। চিঠি দিতেন না কোনোদিন। থাকার সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধুই তোকে দেখতেন।’
মা’র কাছে গাধার গল্প শুনে গাধার সুন্দর ছবি বানিয়েছিল সে মনে মনে। রমানাথ প্রথম গাধা দেখে দিল্লি এসে। খুব ভাল লাগে তার,রাজশাহী শুধু ঘোড়ার গাড়িতে ভর্তি, গাধা নেই একটাও। একদিন সাহস করে গম্ভীর বৃদ্ধ নাপিতকে প্রশ্ন করে, ‘তোমারা কি দু’একঠো গাধা হ্যায়?’ বৃদ্ধ নাপিত মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় তার গাধা নেই। এই খবরে সে হতাশ হয়ে পড়ে। নাপিত জানায় সে রমানাথের দাড়ি মোচ কামাতে চায়। তার দাড়িমোচ গজায়নি। নাপিত বলে তাদের ছেলেদের এই বয়স থেকেই কামিয়ে দাড়িমোচ গজিয়ে যায়। বৃদ্ধ নাপিত মনোরমভাবে রমানাথের দাড়ি ও মোচ গজাবার জায়গাগুলোয় ক্ষুর চালায়। এমনকি সাবানের ফেনা করে গালে তাও লাগায়। একজন বয়স্ক মানুষকে যেভাবে সম্মান দেখিয়ে সে শেভ করে দেয়, সেভাবেই সে রমানাথের খেউরি সারে। আয়নায় নিজের মুখটা ঝলসে ঝিলিক দিতে দেখে সে, শুধু একটা ছোট্ট ব্রণ কেটে গিয়ে স্থির হয়ে আছে, গালে একফোঁটা রক্ত। নিজেকে বয়স্ক ও ভারি মানুষ বলে মনে হয় তার।
দুই
চিন্ময় দিল্লিতে চিত্রকর হিসাবে যে সম্মান প্রত্যাশা করেছিলেন, তা না পাওয়ায় বম্বে চললেন।
চিন্ময়ের ইচ্ছা বম্বে গিয়ে একটা সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। সিনেমার উপরে তখন যেসব বই পাওয়া যেত তার সবই তিনি কিনে ফেলেন। পড়েও ফেলেন। বম্বে পৌঁছে তিনি তিন কামরার একটা বাড়ি গুছিয়ে নিয়ে সিনেমার লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন। সারাদিনরাত শুধুই সিনেমা নিয়ে ভাবেন। ঘুমন্ত অবস্থায়ও তিনি সিনেমা নিয়ে ভাবতেন। একদিন ঘুমের মধ্যে চিৎকার করেন, ‘কাট কাট কাট! রহিম, তোমার মুখটা তো ক্যামেরায় আসছে না। মুভ দ্য ক্যামেরা! রাইট, নো নো এক্সট্রিম লেফট!’ প্রায় প্রতিরাতেই তার এরকম কাণ্ডকারখানা চলে।
চিন্ময় (৩২) সুযোগ পেলেই সিনেমার শুটিং দেখতেন। সে আমলে বিখ্যাত পরিচালক ছিলেন ঘেসোরাম আগরওয়াল। তিনি তাঁর পৈতৃক খৈল-ভুসির ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তিন বছর পূর্বে সিনেমায় এসেছিলেন। তার বিশাল শরীর, মুখ গোলগাল, নাক চ্যাপ্টা, মাথায় টাক, হাঁটতে থাকার সময় তার ভুঁড়িটা এগিয়ে যেত প্রথমে, ও নিতম্বদেশ শেষে। তার বিরাট গোল গোল চোখ, গরুর চোখের মতো, তাতে সবসময় নীল রঙের গগল্জ্ ফিট করে রাখেন। সেদিন একটা বাগানে শুটিং চলছিল, বাগানের ফুলগাছগুলোকে সতেজ করবার জন্য তার আগের তিনদিন ধরে বাগানে অনবরত ঝারি দিয়ে জলসেচ করা হয়েছিল। ফুলগাছগুলো তরতাজা হয়েছিল এবং কিছু কিছু গাছ এত পানি পাওয়ায় অভ্যস্ত না থাকায় ঝিমাচ্ছিল। নায়ক ও নায়িকা এই বাগানের মধ্যে দিয়ে প্রেম করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছেন, তারা মুখ নাড়াচ্ছেন, কথা বলছেন না। পরে সংলাপ ডাব করা হবে। পোর্টেবল ক্যামেরা নিয়ে ক্যামেরাম্যান তাদের অনুসরণ করছে। দু’পাশে সবুজ হলুদ লাল পাতাবাহার গাছ, তার মধ্য দিয়ে পথ, নায়ক নায়িকা চলেছেন। ক্যামেরার সঙ্গে সঙ্গে পরিচালক। পরিচালক ঘেসোরাম একটা চাকাওয়ালা চেয়ারে বসে, একটা আর্দালি পিছন থেকে চেয়ার ঠেলছে। প্রতিমুহূর্তে ঘেসোরাম হিন্দিতে অতিদ্রুত নানারকম নির্দেশ দিচ্ছেন, তাঁর কথার তালে তালে ক্যামেরা মুভ করছে। ঘটনাটা ঘটে যায় মুহূর্তে। নায়ক পিছলে পড়ে যান কাদায়। বেকায়দা মতো। চিন্ময় প্রথমে ভাবেন এটাও অভিনয়ের অংশ। কিন্তু ঘেষোরামের নির্দেশে গোটা ইউনিট নিশ্চল হয়ে গেলে, বুঝতে পারেন তা নয়। নায়িকা কিন্তু নায়ককে উদ্ধার করবার কোনোই চেষ্টা করেন না। তিনি দ্রুত হেঁটে চলে আসেন। চিন্ময় খুব কাছ থেকে দেখেন তাকে, খিলখিল হাসছেন, রুমাল দিয়ে হাসি চাপবার চেষ্টা করছেন ব্যর্থ, প্রায় পানি এসে গেছে তার চোখে।
চিন্ময় নায়িকার হাসি দেখেন স্তব্ধ দাঁড়িয়ে। তার হাসি থামলে দুই চোখের কোনায় ফোটা অশ্রু দেখা দেয়। ভোরে পাতার অগ্রে জমা শিশিরের দানার মতো। নায়িকা কাঁপছেন। চিন্ময় স্তব্ধ। বাগানটি খুব সুন্দর ছিল। আগে চিন্ময় এসব শুটিং না দেখে বাগান দেখতেন তীক্ষè চোখ মেলে, জেনে নিতেন অজানা ফুলগাছের নাম। সূর্যের তীব্র আলোয় এ সবই এখন ধূসর তার কাছে। চিন্ময় সম্মোহিত বাড়ি ফেরেন, হাস্যস্ফূরিত আন্দোলিত দেহভঙ্গিমা পথে বিছিয়ে বিছিয়ে।
রমানাথ খুব ভয়ে ভয়ে প্রতিদিন চিন্ময়ের আঁকবার ঘরে খাবার দিয়ে আসত। তিনি আঁকবার ঘর থেকে সাতদিন বেরুলেনই না। রমানাথ দেখত প্রতিদিন তিনি একই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে, চতুর্থ দিনে সে লক্ষ করে, চিন্ময় একটা মেয়ের মুখ আঁকছেন। একদিন ছবিটা ঝাপসা লাগত, পরদিন উজ্জ্বল হয়ে উঠত। সপ্তম দিন দুপুরে রমানাথ খাবার দিয়ে দ্রুত ফিরে আসছিল। চিন্ময় ওকে ডাকেন, ‘দ্যাখ তো, তোর কি মনে হচ্ছে মেয়েটা খিলখিল হাসছে?’ সে ভয়ে ভয়ে জবাব দেয়, ‘আমার তো মনে হচ্ছে মেয়েটা কাঁদছে ভীষণ।’ তিনি মুহূর্তে ক্ষেপে যান, ‘দূর ছাই, যা ভাগ, তুই মডার্ন পেইন্টিং একেবারেই বুঝিস না।’
চিন্ময় পরদিন সকালবেলায় ফ্যান ঝোলাবার আংটায় দড়ির ফাঁস গলায় বসিয়ে ঝুলছিলেন। রমানাথ নাস্তা দিতে গিয়ে আঁতকে ওঠে, তার কথা আটকে যায়, চার ঘণ্টা কোনো কথা না বলতে পেরে চোখে জল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বাড়ির মধ্যে সে। চার ঘণ্টা পরে আবার চিন্ময়ের ঘরে সে যায়। চিন্ময় ঘরে নেই। ফাঁকা চৈত্রবাতাসের হাহাকার চারিদিকে, জানালাগুলো খোলা, এলোমেলো সবকিছু। ইজেলে চিন্ময়ের শেষ পেইন্টিং তখনও আছে, তীব্র আলোয় আবছা সূর্যমুখী ফুলেরা হেলে ঢুলে পড়ছে সুইসাইডে, কেন্দ্রে ডিপ বেগুনি কুৎসিত মুখ, চুলে দীর্ঘ ঢাকা, ভয়ঙ্কর কাঁদছে।
চিন্ময় একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল,
কাকিমা,
যাবার সময় তোমাদের জন্য কিছু রেখে যেতে পারলাম না। চা বাগানে বাবার শেয়ার আহামরি কিছু ছিল না। শেষটুকু গত মাসে বিক্রি করেছি। কিছুদিন আগে হঠাৎ এক মেয়েকে আমার ভালো লাগল, তার চিহ্ন আমার শেষ পেইন্টিঙে আছে। ওটা রমানাথকে দিলাম।
ছোটবেলায় একটা বিড়াল মেরে ফেলেছিলাম। বিড়ালটা এখনো রাতে আমাকে দুঃস্বপ্ন দেখায়। সাধুময় খাঁ বম্বের ফিল্মে ভাড়া দেবার জন্য বিড়াল ও অন্যান্য প্রাণী পোষে। শ্রাদ্ধের দিনে তিন ডজন বিড়ালকে পেটপুরে খাইও। সাধুময়ের বাড়ি এ পাড়াতেই, রমানাথ চেনে।
দেশে ফেরার খরচ আমার অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করলে পাবে।
চিন্ময়
চিন্ময়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য শ্রাদ্ধের আয়োজন করা হয়। সাধুময়কে খবর দিয়েছে রমানাথ। সন্ধ্যার সময় পুরো তিন ডজন বিড়াল নিয়ে সে পৌঁছে যায়। সাধুময়ের মোচ পাকানো, চোখ দুটো ঢুলুঢুলু, গাল বসা, মুখমণ্ডল নানারকম দাগে ভরা। বিড়ালগুলোর স্বাস্থ্য খুব চমৎকার। নাদুসনুদুস, দেখবার মতো। বাড়ির সামনে ঘাসের উপরে তারা বসে। মুখোমুখি দু’সারিতে ১৮ জন ১৮ জন করে। চিন্ময় ভালবাসতেন যেসব খাবার, লুচি, ক্ষীর, টক, রমানাথের মা সেসবই সুন্দর করে রেঁধেছিলেন। থালা সাজিয়ে রমানাথ ও বিজন খাবার এগিয়ে দেওয়া শুরু করে। বিড়ালগুলো শেষ থালাটি আসার আগে পর্যন্ত খাবার স্পর্শ করে না। ওদের মধ্যে ডজনখানেক বিড়ালছানা ছিল, একটার রঙ দুধে হলদে, সেটি অসচেতনভাবে ক্ষীর চাটা শুরু করে; ওর মা বোধহয় সামনের লাইনে ছিল, দুধে আলতায় তার গায়ের রঙ, দৌড়ে এসে ছানাকে সামনের ডান পা তুলে গালে এক চাটি মারে; লেজ ঘুরিয়ে সপাং করে চাবুকের মতো ছানার গায়ে দেয় মেরে। সাধুময় লাঠি হাতে এগিয়ে আসায় বচসা থামে। থালা সাজিয়ে দেবার পরে সাধুময় থালাগুলোর সামনে অতিদ্রুত একটা ভ্রমণ সারে। এবং ম্যাজিকের মতো বড় বড় লুচিগুলো গুঁড়ো হয়ে পড়ে থাকে থালায় থালায়। সাধুময় তার পকেট থেকে একটা বাঁশি বের করে। মুখে বাঁশি নিয়ে বাজানো শুরু করে। রমানাথের কাছে সুরটা খুব করুণ মনে হয়। সাধুময় সাপ খেলাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে বাঁশি বাজিয়ে যায়। বিড়ালগুলো সপ সপ করে খাচ্ছে। বাঁশির তালে তালে মনে হয় বিড়ালগুলো খেজুর পাতার মতো কেঁপে ভাসছে। ৬টা বিড়াল ছিল কালো কুচকুচে, অন্যদেরকে ম্লান করে দিয়ে তাদের চোখ জ্বলছিল অন্ধকারে। খাওয়া শেষে বাঁশিও থামে। গ্লাস থেকে প্রত্যেকের থালে থালে জল ঢেলে দিয়ে আসে সাধুময় নিমেষে, এটাও ম্যাজিকের মতো। জল পান করে থালাগুলো ঝকঝকে করে তোলে বিড়ালেরা। প্রত্যেকের থালায় একটি করে নতুন আধুলি রাখা হয়। সাধুময় প্রত্যেক থালার সামনে দিয়ে হাত বুলিয়ে গেলে আধুলিগুলো উধাও। রমানাথ বিভ্রান্ত হয়, আধুলি বোধ হয় দেয়া হয় নাই মনে করে কৌটা থেকে আধুলি আবার আনে। বিড়ালগুলো দু’পা বিছিয়ে লেঠা পেড়ে বসে। খাওয়া শেষে সাধুময় উঠবার ইঙ্গিত দিলে তারা চারপায়ে ভর দিয়ে গা ঝাড়ে। সাধুময় রমানাথকে বলে হিন্দিতে, ‘আমরা যাই, আধুলি তো আগেই দিয়েছ।’
সাধুময় রওনা হয়, পকেট থেকে একটা মোটা চুরুট বের করে আগুন ধরায়, তার ধোঁয়া উড়ছিল, অর্ধেক চাঁদের ধূসর আলোর মাঝ দিয়ে তার পিছুপিছু তিন ডজন বিড়াল মন্থর এগোয়। তাদের চলবার ভঙ্গি একান্ত নিশ্চিন্ত। রমানাথ ও বিজন এই ভোজন শেষে অপস্রিয়মান বিড়ালবাহিনীর যাত্রা দেখে।
দূরে কোথাও গান বাজছে। সামনের রাস্তা দিয়ে লোকজন চলাচল করছে। কিন্তু বাড়িটা নিষ্পত্র বেলগাছের মতো চুপ ঠাণ্ডা স্তব্ধ। চিন্ময়ের ঘরের জানালাগুলো খোলা, ক্ষীণ বাতাস ও মৃত আলোর ঘরের ভিতর যাওয়া আসা। রমানাথ ঘরের মধ্যে ঘোরে। দেয়ালে দেয়ালে হিজিবিজি দাগ দেখে। হঠাৎ দেয়াল জুড়ে চিন্ময়ের শেষ ছবির সূর্যমুখী ফুলেদের হারাকিরি শুরু হয়ে যায়, ডিপ বেগুনি রক্তে ঝলকে ঝলকে ফুটে ওঠে সেই দীর্ঘ চুলে ঢাকা মেয়ের মুখ, কাঁদছে, নতুন আলোর ঢেউয়ে সেই কান্না মুছে যায়।
তিন
শেয়ালদা স্টেশন। রমানাথদের কলকাতায় কয়েকজন দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজন ছিল। তাদের কারো ঠিকানাই জানা ছিল না তাদের। রমানাথের মা স্থির করলেন স্টেশনে অপেক্ষা করলে একদিন না একদিন তারা পরিচিত কাউকে পেয়ে যাবেন। স্টেশন এমন একটা প্লেস যেখানে সবাইকেই আসতে হয় বাইরে যেতে হলেই। নিশ্চয়ই তাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজনদের যেতে হবে এ পথ দিয়েই, তাদের একবার দেখা পেলেই হলো, ওরা নিশ্চয়ই একেবারে ফেলে যাবে না।
শেয়ালদা স্টেশনে বহু প্ল্যাটফর্ম। প্রায় সব প্ল্যাটফর্মেই লোক গিজগিজ। রাজশাহীগামী ট্রেন যে প্ল্যাটফর্মে বেশি সময় থামে সেখানে ওরা ডেরা বাঁধলেন। রমানাথের মা জগন্ময়ী তাঁর শাড়ি দিয়ে ৭ ফুট বাই ৭ ফুট একটা থামসংলগ্ন জায়গা ঘিরে ফেললেন। জগন্ময়ী সবসময় ঘেরার মধ্যেই থাকেন গোকুলকে সঙ্গে রেখে। শুরুতে রমানাথ ও বিজন ঘেরার মধ্যেই থাকত। রমানাথ জল আনতে সওদা আনতে যেত বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে বিজনও যেত। ক’দিনের মধ্যেই অবস্থা বদলে গেল, রমানাথ ও বিজন জগন্ময়ীর নির্দেশ অমান্য করে প্রায় সবসময় প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়াত। প্ল্যাটফর্ম পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীতে ভরপুর, কেউ আসছে খুলনা থেকে কেউ বরিশাল, যশোর বা কুষ্টিয়া থেকে। আশ্রয়ের সন্ধানে।
রমানাথ এদের ঘুরে ফিরে দেখে। বিজনের ভাব হয় বাদামওয়ালাদের সঙ্গে, তার সারাক্ষণ বাদাম খেতে ইচ্ছা করত, ওদের সঙ্গে ভাব করে পটিয়ে সে বাদাম খেত। ৯ দিন চলবার পর দুপুরে খাবার সময় বিজন (৯) ঘোষণা করল, ‘আমি বাদামওয়ালা হব। মা আমাকে ৫ টাকা দাও। চিন্ময়দার টাকায় নিশ্চয় আমারও ভাগ আছে। আমায় টাকা দাও আমি বাদামওয়ালা হব।’ বিজন কঠিন জেদ ধরে। জগন্ময়ী কিছুই ভেবে পান না, ছেলের নীচ আচরণে যার পর নাই ক্রোধ জমে ওঠে ভিতরে, খড়ম খুলে পেটান বিজনকে, রমানাথকে হুকুম করেন, ‘ধরে রাখ ওকে।’ প্ল্যাটফর্মবাসীরা এটা তামাশা হিসেবে দেখে, ও টিপ্পনি কাটে। জগন্ময়ী ক্রোধে প্রায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেন, ইচ্ছা করে গায়ে কেরেসিন ঢেলে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে দেবেন। সে আগুনে তিনি পুড়বেন, এই প্ল্যাটফর্ম পুড়বে, পৃথিবীও। কিন্তু ওসব না করে রমানাথ ও গোকুলকে তিনি বেধড়ক পেটান, রান্না করা খাবার রেললাইনের উপর ছিটিয়ে দেন, এবং রাতে চুলা জ্বালেন না।
পরদিন সকালে রমানাথের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। জগন্ময়ী দিশাহারা। বিজন সেই মার খাওয়ার পর যে কোথায় গেছে। রাতেও ফেরে নাই, সকাল হলো, তাও ফিরবার নাম নেই। কাকে এখন তিনি খুঁজতে পাঠান! বিজন নিজেই ফেরে, প্ল্যাটফর্মে এক উদার হোমিওপ্যাথকে খুঁজে বের করে, উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাদার চিকিৎসায়। সন্ধ্যানাগাদ রমানাথের জ্বর ক্রমাগত বেড়ে চলে। কোনো ওষুধে তাৎক্ষণিক ফল হয় না। অনবরত জল ঢালা হয় মাথায়। রমানাথের কপালের দু’ধার টগবগ ফুটছিল, মাথায় উঠছিল বুদ্বুদ, তীব্র নীল আলোয় ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল মগজের কোষগুলো। এর মধ্যে রমানাথ চলতে শুরু করে, ঘোরানো প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে। তার পা ঘুরছিল রাজপ্রাসাদের সংক্ষিপ্ত বাক্সের মধ্যের জ্যামিতিক ছোট ছোট সিঁড়ি ভেঙে ঊর্ধ্বে ঊর্ধ্বে আরো ঊর্ধ্বে। বেগুনি, লাল, গোলাপি আলোর ঝর্না কখনও কখনও তীব্র হলুদ হয়ে বিঁধছিল চোখে। যেন নিকটবর্তী সূর্যের আলো। হঠাৎ তীব্র অসহ্য কালোয় সিঁড়ি দুর্গম অরণ্যের বিশাল বৃক্ষের ন্যায় নিশ্চল হয়। সিঁড়ি যেন ডাল, কামড়ে কামড়ে উঠতে থাকে রমানাথ। ঊষার মতো আলোর ঘূর্ণি এগিয়ে আসে। দুপুর ঝলমল করে ওঠে, বাজে কাড়ানাকাড়া, বেগুনি আলোর ফোকাসে রমানাথ দেখে, চিন্ময় আঁকছেন, জগন্ময়ী জীবন্ত ছবির ভিতর থেকে মিটিমিটি হাসছেন।
‘ছাড় বাবা ছাড়। গলা ছাড় বাবা।’ রমানাথের চোখ গোল গোল বড় হয়ে বীভৎস তাকিয়ে জগন্ময়ীর দিকে, দু’হাতে তার জমেছে ক্রোধান্ধ শক্তি, টিপে ধরেছে জগন্ময়ীর গলা। জগন্ময়ী ডাকবার শক্তিও পান না!
চার
দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজন কাউকে শেয়ালদায় না পেয়ে রমানাথরা ফিরে আসে রাজশাহী শহরে। আশ্রয় দিতে পারেন এমন কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন না শহরে। রমানাথদের পিতৃপুরুষদের ভিটামাটি বেদখল হয়ে গেছে। জগন্ময়ী তাঁর এক বান্ধবীর কাছে আশ্রয় নিলেন। তার স্বামী ছোট চাকুরি করেন। বাড়িটা পুরনো জমিদারের, এখন জীর্ণদশা। ভাগ ভাগ করে এখন ওরা ভাড়া দিয়েছেন। তারই দুটি ঘরে ওঁরা থাকেন। কয়েকদিন পর জগন্ময়ী, স্থানীয় গার্লস স্কুলে প্রাইমারি সেকশনে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর মধ্যে পাশের ঘরের একটি পরিবার দেশত্যাগ করলে জগন্ময়ী ঘরটি নিজের নামে ভাড়া নেন।
রমানাথ ক্লাস এইটে, বিজন ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়। গোকুল বাড়িতে মায়ের কাছে অ আ ক খ শেখে। জগন্ময়ীর কঠিন শাসনে তারা অধ্যয়ন করে। রমানাথ পড়াশোনায় উৎসাহী, বিজনের উৎসাহ ব্যবসার দিকে।
রমানাথ ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে মিনিট পনেরো থেকে, লাইব্রেরিতে যেত। লাইব্রেরিতে বসে পড়তে ভালো লাগত তার। মাঝেমাঝে সন্ধ্যা হয়ে যেত ফিরতে ফিরতে। মায়ের বকুনি শুনতে হতো। একদিন ফিরতে ফিরতে গাঢ় অন্ধকার হয়ে যায়। রমানাথ ভাবনায় মগ্ন ছিল। কোন পথে হাঁটছে, কোন দিকে চলেছে, খেয়াল সেদিকে রাখেনি। মানুষ সমান লোহার দরজায় বাধা পেয়ে দেখে, একটা বিশাল দালানের সদর দরজার সামনে সে দাঁড়িয়ে। কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়ে ভিতরে। সবকিছুই চিরচেনা মনে হয়। আস্তাবলের দিকে এগিয়ে যায়। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, দাঁতের সঙ্গে আউড় জাতীয় দ্রব্যের সংঘর্ষে কুচমুচ ধ্বনি রমানাথের কানে ঢোকে। তার মনে হয়, আলো থাকলেই গাধা ও তার বাচ্চাটিকে দেখা যাবে। ধ্বনির উৎসে গিয়ে প্রাণীটির মাথায় হাত রেখে বিশ্বাসই হতে চায় না, একজোড়া শিং। বাইরে ফিরে আসে,অন্ধকার উন্মুক্ত আবহাওয়ায় আরো জাঁকালো হয়ে চোখকে অন্ধ করতে চায়। চোখদুটো সার্চলাইটের মতো হলে চমৎকার হতো ভেবে সিংহদরজার দিকে এগিয়ে যায়। তখনই চোখে পড়ে সন্ন্যাসীকে। অন্ধকারকে তুড়ি মেরে তার চোখদুটো জ্বলছে। কালো বিড়ালের চোখের মতো। রমানাথের ভয় হয়। এবং ভয়ে ভয়েই তাকে প্রশ্ন করে, ‘গাধার কি শিং হয়?’ অন্ধকার চিরে উল্কার মতো পাল্টা প্রশ্ন আসে, ‘হোয়াট! হোয়াট!’
রমানাথ অনেক দৌড়ে, পিছনে কেউ অনুসরণ করছে কিনা এই সন্দেহে মাঝেমাঝে চুপ করে কান পেতে বসে থেকে আবারও দৌড় শুরু করে। বাড়ি পৌঁছায় যখন, তখন গভীর রাত।
জগন্ময়ীর কানের দুটো দুল হারিয়ে যায়। ঘর তছনছ খুঁজে কোনো ফল হয় না। রাতে ঘরে চোর ঢুকেছিল এমন কোনো চিহ্নও দেখা যায় না। জগন্ময়ীর অনুগত রাখালবাবু আসেন। হাত চালাতে জানেন। তিনি বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়েন। মাটিতে হাত ঘষেন। তারপর হঠাৎ উঠানের উপর দিয়ে তার দেহটিকে তার হাত ইঞ্জিনের মতো টেনে নিয়ে ভীষণ বেগে ধাবমান হয়। হাতটি মাটি ছেঁচড়ে চলেছে, দেহ তাকে অনুসরণ করছে মুমূর্ষুর মতো। হাত উঠানের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলে, কখনোই শূন্যে ভেসে ওঠে না। নাকের পোঁটা, মুরগির গু, মাছের কাঁটা, তরকারির খোসা, কাদার উপর দিয়ে হাতটি অবলীলায় ছুটে চলে। রাখালবাবুর চোখেমুখে আচ্ছন্নতা, অতিপ্রাকৃত কোনো সত্তা তাঁর উপরে সওয়ার হয়েছেন। রাখালবাবুর হাতটি তাঁর নিজের পাঁঠার সামনে গিয়ে হঠাৎ স্থির হয়। পাঁঠাটি ব্যা ব্যা করে অসহায় চিৎকার করে ওঠে। আচ্ছন্নতা কাটবার পর রাখালবাবু উঠে দাঁড়ান। তার হাতের এখানে ওখানে কেটে গেছে। দুল দুটোর খোঁজ মেলে না।
বিজন (১১) জগন্ময়ীর শাসনকে তুচ্ছ করে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেয়। শুরু করে পান বিড়ি সিগ্রেট বিক্রি করা। কী চমৎকার কাজটা। প্রতিদিন কত চমৎকার সব লোকের সঙ্গে কথা বলা যায়। লোকগুলো বোকা বোকা, বুঝতেই পারে না বিজন কেমন এক পাই দু’ পাই তাদের কাছ থেকে লাভ করছে। এক পাই দুই পাই তিন পাই পাঁচ পাই দশ পাই পঁচিশ পাই করে লাভ হতে হতে একদিন তার অনেক বড় ব্যবসা হবে। বিজন হিসাব কষে। স্কুলে গেলে এই একটা লাভ, হিসাব কষাটা শেখা যায়।
‘বাবু, তোমার কাছে ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভোলে না মোরে’ চিঠি লিখবার প্যাড হবে?’ মণিকা রায় এক বিকেলে বিজনের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। আছে শুনতেই, মণিকা তিনখানা প্যাড কিনে ফেলে বিজনের কাছ থেকে। বিজনের কাছ থেকে এর আগে কেউ একসঙ্গে এতগুলো প্যাড কেনেনি। বিজন তার কাছ থেকে দু’পয়সা দাম কম নেয়। মণিকা দাঁড়িয়ে থাকে আরো একটুক্ষণ, ভিড় কমলে বিজনকে বলে, ‘খোঁজ রাখো কিছু? তোমার দাদার চোখ যে ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে, ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা দেখতে পায় না, বই পড়ে হুমড়ি দিয়ে, খোঁজ রাখো?’ মণিকা কথাটুকু বলে, জবাব না শুনেই চলে যায়।
বিজন একদিন সকালে উঠে প্রতিদিনের মতো দোকানে না গিয়ে রমানাথের পড়বার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে বলে, ‘চল দাদা, এক জায়গায় যাই।’ রমানাথ বইয়ের দিকে মাথা আরো নামিয়ে জবাব দেয়, ‘যা, আমার এখন পড়াশোনা আছে।’ বিজন রমানাথের পাঠ বিরতির অপেক্ষা করে। রমানাথ কিছুক্ষণ পরে ছোটভায়ের সঙ্গে অনিচ্ছুক বেরিয়ে পড়ে। তার এখন কত পড়া, সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা!
বিজন রমানাথকে নিয়ে এ গলি সে গলি ঘুরে চোখের ডাক্তারের বাড়িতে পৌঁছায়। রমানাথের পকেটে অর্থ ছিল না। সে ভীষণ লজ্জিত, প্রায় শিশু ছোটভায়ের অর্থে তাকে আজ চোখ দেখাতে হবে। আগে জানলে মা কি অর্থ দিতেন না? ফিরে গেলে বিজনটা হয়তো তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেবে চিরদিনের জন্য। কম্পাউন্ডার তার দুই চোখে ওষুধ দেন। চোখ দুটো মৃদু মৃদু ফুলে ওঠে। অসহায় বসে থাকা ছাড়া তার করার কিছু নেই। বিজন মাঝে মাঝে খোঁজ নিচ্ছে, ‘দাদা, কেমন লাগছে রে?’ ডাক্তার টর্চলাইট দিয়ে খুব উৎপাত করে দেখলেন চোখ। তার যন্ত্রণা বোধ হচ্ছিল। তিনি রমানাথের চোখে সাঁড়াশি বসিয়ে দিলেন। সাঁড়াশির দু’বাহু চেপে বসল কানের পাশে। নাকের উপরে কাচ বসাবার তাক। ডাক্তার দুটো কাচ বসিয়ে দিলেন দুই তাকে। হঠাৎ চোখের সামনে থেকে ঝাপসা পর্দাটা সরে গিয়ে পৃথিবীটা অসম্ভব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। স্পষ্ট রেখা, ছায়া মূর্ত হলো। পৃথিবীটায় আলোর মাত্রাটা হঠাৎ করে কয়েকগুণ তীব্র বোধ করায় রমানাথ দু’তিনবার চোখ পিটপিট তাকিয়ে পর্দা বন্ধ করে দেয়। ডাক্তার বলেন, ‘খোকা, পড়ো দেখি।’ রমানাথ চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখে, দেয়ালে অক্ষরের প্লেট টাঙানো। পড়তে পড়তে শেষের লাইনটায় পৌঁছে ঠেকে যায়। আবছা, পড়া যায় না। ডাক্তারের কণ্ঠ গম্ভীর, ‘তোমার বাবা আসেননি, ডাকো তাকে, এরকম ক্যালাস লোককে পেটানো উচিত।’ রমানাথের প্রথমে মনে হয় শেষের লাইনটা পড়তে না পারার জন্য ডাক্তার বকছেন। তাই সে আর্দ্র কণ্ঠে জানায়, ‘আপনার কাচ দিয়ে পড়তে পারছি, এমনিতে আমি সামনের বেঞ্চে বসেও ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা পড়তে পারি না।’ ডাক্তার বলেন, ‘না না, তোমাকে নয়, তোমার বাবাকে বকছি, যাও বাইরের আলোয় কেমন লাগে দেখে এসো।’ রমানাথ সাঁড়াশি ও কাচে চোখ ঢেকে বাইরে যায়। চারদিক বক্র মনে হয়, একটু বৃত্তচাপের মতো। বাইরে লনের ঘাসগুলো প্রতিটি সূক্ষ্ম পাতা নিয়ে ফুটে ওঠে। চারিদিককে অনুপুঙ্খ অনুভব করে রমানাথ। পৃথিবী উদ্ভাসিত হয় বর্ণালি সূক্ষ্ম রেখায়।
রমানাথ চশমা চোখে বাড়িতে ঢোকার সময় প্রফেসর কটমটে চোখে তাকে দেখেন। বিরাট জমিদার বাড়িটির একটি খুপরিতে তিনি একা থাকেন। তিনি একজন প্রফেসর এ কথাটি সব্বাই জানত, কিন্তু কোথায় পড়ান তা কেউ জানত না। প্রতিবেশী এক মহিলাকে তিনি মাসিক দু’আনা বেতন দিতেন, একটা মাত্র কাজের জন্য, লোক এলে জানিয়ে দেবে ‘প্রফেসর ঘরে নেই’। প্রফেসরের খোঁজে কালেভদ্রে দু’একজন আসত। তিনি ঘরের মধ্যে একটা ভাণ্ডে পেচ্ছাপ করতেন, পায়খানা সারতেন সবার অজান্তে, তাকে কেউ কখনো স্নান করতে দেখেনি। দুর্গন্ধে তার ঘরের কাছে যাওয়া ছিল অসম্ভব। তার ঘরের ছাদ থেকে একটা দড়ির ফাঁস ঝোলানো ছিল। তার বিশ্বাস সুইসাইড ঐশী প্রেরণার মতো আকস্মিক আসে, প্রণোদনার সঠিক মুহূর্তটি যাতে ব্যর্থ না হয় সে জন্য ফাঁস ঝুলিয়ে রাখা। ফাঁসের দিকে তাকিয়ে মাঝেমাঝে মিটিমিটি হেসে ঘোষণা করতেন, ‘মরণকে পায় না ভয় এ রতন, তুই ঝুলে থাক, হে আমার মরণ।’
চশমা চোখে ফেরার পথে রমানাথের মনে হয়, চারদিকের মানুষ তাকে ভিন্ন চোখে টিটকারি মিশিয়ে দেখছে। প্রফেসরের দৃষ্টিতে সে অসহায় বোধ করে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে জমিদার বাড়িটির একাংশের মালিকের সঙ্গে ধাক্কা খায়। মালিক স্বয়ং বলে ওঠেন, ‘সরি সরি, তা ভায়া চশমা নিয়েছ, বেশ বেশ, অধ্যয়ন অতি উত্তম কাজ, চালিয়ে যাও।’ তারপর তার চোখ উল্টিয়ে পুরনো দিনে তাদের বড়লোকি সম্বন্ধে গপ্পো বলে একটু অন্য কথায় চলে যান, ‘রমানাথ দেখ তো ভাইটি, তোমার কাছে একটা টাকা হয় কিনা। নৃপেন বিকেলে ওর বকেয়াটা দিতে চেয়েছে। না না ভায়া, ঠিক পেয়ে যাবে। একটুও ভেবো না।’ ভদ্রলোক খুব খরচ করতেন। মাস শেষে বাড়িভাড়া পাবার পর তার ভীষণ ফূর্তি শুরু হতো তিন চার দিনের জন্য। সকালে নাস্তা করতেন পাউরুটি ডিম দিয়ে টোস্ট করে, পিরিচে বাটার জেলি রেখে। দুপুরে গোমাংস। সন্ধ্যাবেলা দু’চারজন ইয়ার বন্ধুকে ডেকে কোনো রাখঢাক না রেখে মদ্যপান করতেন।
চশমা লাগিয়ে রমানাথ পড়তে বসেছে। জগন্ময়ী গোকুলকে নিয়ে স্কুল গেছেন। বিজন দোকানে। ঘরে সে একা। ডাকপিয়ন এসে একটা চিঠি দিয়ে যায়। প্রাপকের নামটি দেখে রমানাথ ভড়কে যায়। বাজে
হস্তাক্ষরে তার নামটি স্পষ্ট করে লেখা। তার হার্টবিট বেড়ে যায়। খুব সাবধানে খুলে ফেলে খাম। ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভোলে না মোরে’ শিরোনাম মুদ্রিত প্যাডের পাতায় লেখা চিঠিটি পড়তে পড়তে সে আনন্দিত ও উত্তেজিত বোধ করে। রমানাথের দেহ ও মনের অজস্র প্রশংসায় ‘প্রাণনাথ’ সম্ভাষণে ৩৭টি বানান ভুলের সাহায্যে ৫ পৃষ্ঠায় রচিত চিঠিটি। স্বাক্ষরের স্থানে গ.জ. অক্ষর দুটি লেখা। প্রেরকের ঠিকানাও নেই। রমানাথ রহস্য ও থ্রিল বোধ করে। সন্দেহাতীতভাবে চিঠিটি কোনো মেয়ের রচিত। তার কিছু রোমান্টিক নভেল পাঠের অভিজ্ঞতা থাকায়, সে বুঝতে পারে এটি লভ লেটার। সে অনেক ভাবে, পড়াশোনায় মন বসে না। এবং এর পর থেকে রমানাথ প্রতিদিন একটি করে চিঠি পেতে থাকে। দেখতে দেখতে ২৭টি চিঠিতে মোট বানান ভুলের সংখ্যা ৪১৪টিতে গিয়ে পৌঁছায়।
রমানাথ ঘরে একা। একটি মেয়ে আসে, তার সামনে দাঁড়ায়, তার ইচ্ছা হয় ঘর ছেড়ে পালাবে। মেয়েটি প্রশ্ন করে, ‘আমাকে চেনেন না?একই বাড়িতে থাকি অ্যাদ্দিন, আমি আপনাকে ঠিকই চিনি।’ সে তাকাতে পারে না মেয়েটির দিকে, কথা না বলে বসেই থাকে চুপ করে। মেয়েটি রমানাথের দিকে একটা খাতা বাড়িয়ে দেয়। খাতা খুলে রমানাথ হাতের লেখা দেখে বিমূঢ় বোধ করে। পাতা উল্টে যায়। কবিতা, ১টির পর ১টি কবিতা। রমানাথ খাতাটি ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ‘দেখুন, সামনে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা, আমাকে ডিসটার্ব করবেন না আর।’
মেয়েটির নাম মণিকা রায়।
একরাতে, রমানাথ পড়ছিল হারিকেনের আলোয়, জানালায় টোকা দেয় কে যেন। জানালা খুলে দেখে, প্রফেসর দাঁড়িয়ে। মাথা চুলকাচ্ছেন, ‘বুঝলেন, এ বাড়িতে সব্বাই মূর্খ। আপনি চশমা নিয়েছেন, আমি খুব আশান্বিত বোধ কচ্ছি। যাক, এই গৃহে আমার পরেও জ্ঞানের শিখা জ্বালিয়ে রাখবার মতো কাউকে পাওয়া গেল। এই চিঠিটা একটু দেখুন তো।’ বলে একটা চিঠি বাড়িয়ে দেন রমানাথের দিকে।
মহাত্মন,
আপনার গ্রামোফোন কোম্পানি হইতে প্রকাশিত ‘কিছুই তো হল না’ গানটির রেকর্ড আমি সকল সময় শ্রবণ করিয়া থাকি। ইহাতে একটি বড় অসুবিধা দেখা যাইতেছে যে, পিন বারবার উঠাইয়া শুরুতে সেট করিতে হয়। এই অসুবিধা নিরসনার্থে আমার একটি প্রস্তাব আপনারা বিবেচনা করিয়া দেখিতে পারেন। তাহা হইল ‘কিছুই তো হল না’ গানটির একটি লংপ্লে আপনারা প্রকাশিত করুন যাহাতে উপরোক্ত গানটি ১০০ বার প্রিন্ট করা থাকিবে। ইহার ফলে বাংলার গ্রামোফোন মালিকরা যাহার পর নাই উপকৃত হইবেন। আমার বিশ্বাস বাংলার গ্রামোফোন মালিকরা দিনে অন্তত ১০০ বার উপরোক্ত গানটি শুনিয়া থাকেন, আমার নিজের অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ করিয়া এই রেজাল্ট দিলাম। যদি আপনারা চাহেন এই মহা উদ্যোগে সাফল্য আনিবার জন্য আমি আপনাদের এক হাজার টাকা দিয়া এই উদ্যোগের সহিত নিজ নামকে অমর করিয়া লইব।
রমানাথ চিঠিটি পড়ে প্রফেসরকে উৎসাহ দিয়ে বলে, ‘তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিন, স্যর।’ প্রফেসর জবাবে বলেন, ‘সত্যিকার বিদ্বান লোকেরাই বিদ্বান লোকের কদর বোঝে।’
মণিকা রায় (১৭) গলায় দড়ি দিল। দড়ি ঠিক নয়, পরনের শাড়ি সিলিং থেকে ঝুলিয়ে ঝুলে পড়েছিল। অব্যর্থ উদ্যোগ তার, প্রায় নিঃশব্দ মৃত্যু হয়েছিল, ভোর হবার আগে কেউ জানতই না মণিকা রায় আর নেই। পরনে সায়া ও ব্লাউজ, বুক নি®প্রাণ নেতিয়ে, মুখে ষাট বছরের বৃদ্ধার জরা কয়েক ঘণ্টাতেই মূর্ত হয়ে উঠেছে।
মণিকা রায়ের বালিশের নীচে একটা চিঠি পাওয়া যায়,
রমানাথ
প্রাণনাথ
এ জন্মে তোমার সঙ্গে মিলন হলো না।
পরজন্মে যেন হয়।
তোমারই
মণিকা রায়
মণিকা রায়ের সুইসাইডের খবরে প্রফেসর (৩৪) আত্মহননের অনুপ্রেরণা বোধ করেন। তার টেবিলের উপরে একটা চেয়ার বসান। টেবিল বেয়ে চেয়ারে উঠে গলার কাছে ফাঁসটা টেনে আনেন। তার মনে হয় ডেথ সেন্টেন্স্ পেয়েছেন, পিছনে দাঁড়িয়ে জল্লাদ। অসহায়ভাবে গলায় ফাঁসটা ঢুকিয়ে চেয়ার থেকে লাফ দেন, দড়ি ছিঁড়ে মেঝেয় ছিটকে পড়েন, গলার ফাঁসটা তবু এঁটেই থাকে! তার গলায় একটা চিঠি ঝুলছিল। চিঠিটি নিম্নরূপ,
মণিকা
প্রফেসরের ছদ্মবেশে এই গৃহে এতকাল তোমার পুষ্পসম রূপসুধা পানের নিমিত্তেই বাস করিয়া আসিয়াছি। আজি হইতে এই গৃহ মরুভূমি হইল। তুমি চলিয়া গেলে, কাহার জন্য থাকিব এই ধরাধামে? মূঢ় রমানাথের সহিত নহে, পরজন্মে তোমার সহিত আমার মিলন ঘটিবে। জগৎ জানিয়া লউক।
ইতি
হরিচরণ মুখোপাধ্যায়
পাঁচ
রমানাথ (১৮) একটা সাদা থান কাপড় ও পাঁচটি টাকা সম্বল করে বেরিয়ে পড়ে। নাপিতের কাছে গিয়ে মাথার চুল কামিয়ে নেয়। শহর ছেড়ে পদ্মার বাঁধের উপরে উঠে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। সকালের রোদ। দূরে দূরে অল্প কিছু মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাঁধ থেকে খাড়া পাড় বেয়ে নেমে বালিতে পা দেয়। সকালের রোদে ঈষদুষ্ণ বালি। দূরে নদীর ওপারে ধু ধু বালি ও আকাশ মিলিত হয়েছে। সেখানে নিষ্পত্র প্রাণহীন শূন্যতা। নিষ্পলক তাকিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। গ্রীষ্মের নদী অনেক দূরে, একটা নির্জন জায়গা খোঁজে, পোশাক বদলাবার জন্য। দূরে নদীর ধারে দু’একজন মানুষ। পিছনে বাঁধের দিকে তাকিয়ে দেখে, কেউ দাঁড়িয়ে নেই। প্যান্টটা খুলে ফেলে ছুঁড়ে দেয় চরের মাঝে জমে থাকা জলে। থান কাপড়টা নিম্নাঙ্গে জড়িয়ে নেয়। জামাটা খুলে গুটি পাকিয়ে বগলে নিয়ে, থান কাপড়ের অবশিষ্টাংশ দিয়ে বুক ঢেকে, নদীর ধারে বেঁধে রাখা একটা ডিঙ্গি নৌকা লক্ষ্য করে হাঁটা শুরু করে। পৌঁছে দেখে, কোনো মানুষ নেই। পদ্মার জলে পা ডুবিয়ে অপেক্ষায় কাটে তার দীর্ঘ সময়, গুটি পাকানো জামাটি যাতে মাঝ পদ্মায় যায় এমন আকাক্সক্ষা করে বারবার হাতটা বোঁ বোঁ করে ঘুরিয়ে চলে। ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে ছুড়ে দেয় জলে, তারপর চোখ খুলে, একমুহূর্ত ভেবে, চশমাটিও। জল ছেড়ে চরে উঠে আসে। রোদ প্রখরতর হয়েছে। রমানাথ নৌকায় উঠে পাটাতনে জড়সড় শুয়ে পড়ে। থানকাপড়ে সর্বাঙ্গ ঢেকে।
ঘুম ভাঙলে দেখে, আকাশে পূর্ণচাঁদ। নদীতে তার প্রতিবিম্ব। মাঝ পদ্মায় নৌকাটি ভারসাম্য রাখতে পারছে না। যদিও নদীতে কেউ নেই। জল প্রায় নিস্পন্দ। বাতাস আছে। দেহের ভিতরটায় শিরশির অনুভূতি জাগানোর মতো। নৌকাটি পাক দিয়ে ঘুরে যায়। রমানাথ আবারও নৌকার এক কোণে গিয়ে শুয়ে পড়ে। এবারে ঘুম আসে না। তার হঠাৎ মনে হয় নৌকার অন্য দিকটিতে একটা গাধা শুয়ে আছে। এ জন্য নৌকায় ভারসাম্য থাকছে না, এবং পাক খাচ্ছে। ভোর হলে উঠে দেখবে, এই ইচ্ছায় রমানাথ আবারও ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রশ্নোত্তর
শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?
ইচক দুয়েন্দে: লেখার জন্য লেখা। শেখার জন্য লেখা। এই ভাবে গল্প লেখা আরম্ভ করি।
লেখা শেখার পরে কেবল ভাল, উপযুক্ত, প্রয়োজনীয় বিষয় পেলে তবেই লিখেছি।
শেষোক্ত দাবি সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে।
যখনই নূতন কিছু লিখি তখনই নূতন করে লেখা শিখতে হয়। অর্থাৎ আমার শেখা চলছেই।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?
ইচক দুয়েন্দে: গল্প লেখা মস্তিষ্কের এক জটিল প্রক্রিয়া। মস্তিষ্ক জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, কল্পনা, পর্যবেক্ষণ, দৃষ্টিভঙ্গি, বক্তব্য মিশিয়ে গল্প বলে, তৈরি করে।
মস্তিষ্ক গল্পের নাম নিয়ে ভাবে। বিশেষ করে ভাবে গল্পের শুরু ও শেষ।
আমার ক্ষেত্রে গল্প তৈরি হয় মনের অবচেতন স্তরে। সচেতন স্তর যা লেখে মাত্র।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।
ইচক দুয়েন্দে: আমাদের বেড়ে ওঠা বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের জোয়ারের কালে। কথাসাহিত্যিকরা তখন ব্যাপক রাজনীতি সচেতন ছিলেন। আমিও। কিন্তু আমরা জানতাম কথাসাহিত্য আমাদের রাজনৈতিক দর্শন প্রচারের হাতিয়ার নয়। গল্পে কথাসাহিত্যিক নন তাঁর চরিত্ররা, তাঁর সময় কথা বলে।
শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
ইচক দুয়েন্দে: হ্যারিয়েট বিচার স্টো রচিত ‘আংকল টমস কেবিন’ আমাকে কাঁদিয়েছে। আলোড়িত করেছে। তবে সেটি উপন্যাস।
শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
ইচক দুয়েন্দে: যে গল্প বলতে চাই, যে রূপ যে দৃষ্টিভঙ্গি গল্পে প্রকাশ করতে চাই তা গল্পের রূপ/অবয়ব/ফর্ম নির্মাণ করে। আলাদা করে ফর্ম নির্মাণ করতে যাই না।
ইচক দুয়েন্দে: বিষয়বস্তু।
শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনেরভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
ইচক দুয়েন্দে: লেখার প্রধানতম বিষয় কালে কালে পৃথিবীতে বিদ্যমান অন্যায্যতা।
লেখকরা তাঁদের দৃষ্টিতে যা-কিছু অন্যায্য বোধ করেন তার বিরুদ্ধে কলম ধরেন।
তাঁদের ন্যায্য-অন্যায্য বা ন্যায়-অন্যায় বোধে ব্যত্যয় সৃষ্টি করে থাকে তাঁদের কালের দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁদের শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ।
পৃথিবী চূড়ান্ত ন্যায্য হয়ে পড়লে কথাসাহিত্যিকদের সনাতন ধরনে কিছু লেখা বা বলার থাকবে না।
শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন।
ইচক দুয়েন্দে: আমি আমার পুরনো লেখাগুলি সম্পাদনা করছি। নূতন কিছু লিখছি না।
More Posts From this Author:
- None Found