মার্কসবাদ বিকাশের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অবচেতন বিষয়টিকে শ্রেণী সংগ্রামের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে বিচার বিশ্লেষণ হতে থাকে। পরবর্তীতে উত্তর-মার্কসবাদী চিন্তকদের মাধ্যমে রাজনৈতিক জ্ঞানভাষ্যে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিসর তৈরি করে। অবচেতনের জিজেকিয়ান বিশ্লেষণমূলক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে এ প্রবন্ধে রাজনৈতিক অবচেতন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাই এটি ধ্রুপদী মার্কসবাদের মধ্যে যে অবচেতনের ধারণা রয়েছে তা থেকে স্বতন্ত্র। রাজনৈতিক অবচেতন বলতে কোন ধরনের ভ্রান্ত সচেতনতাকে বুঝায় না। ভ্রান্ত সচেতনতা বলতে বুঝায় জনগণ কোন একটি ব্যাপারে সচেতন না থাকলেও তার গুপ্ত ভাবাদর্শের ফলে এটি কাজ করে। ভ্রান্ত সচেতনতা হচ্ছে কোন ব্যাপারে ব্যক্তি বা জনসাধারণের অস্বীকৃতি। অন্যদিকে রাজনৈতিক অবচেতন হচ্ছে একধরনের স্বীকৃতি। যে স্বীকৃতি ভ্রান্ত বা প্রতীকী প্রক্রিয়ায় কাজ করে। রাজনৈতিক অবচেতনের মধ্যে জনসাধারণ কোনকিছুর ব্যাপারে ভ্রান্ত বা প্রতীকী স্বীকৃতি প্রদান করে বলেই এটি কাজ করে। এটি ভ্রান্ত সচেতনতার মতো বিভ্রম নয় বরং এটি সামাজিক বাস্তবতার অংশ। রাজনৈতিক অবচেতন বাসনা ও ফ্যান্টাসি দ্বারা নির্ধারিত। যে বাসনা সার্বভৌম কতৃপক্ষকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং ফ্যান্টাসি অনবরত এই বাসনার কাঠামোকে সক্রিয় রাখে। অবচেতনের যে প্রতীকী শৃঙ্খলা রয়েছে তার মাধ্যমে আধুনিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতীকী স্বীকৃতিসমূহ গণতান্ত্রিক বাস্তবতাকে নির্মাণ করেছে।
রাজনৈতিক অবচেতন
রাজনৈতিক অবচেতন ধারণাটিকে ফ্রেডরিক জেমসন তাত্ত্বিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তার মতে রাজনৈতিক অবচেতন বলতে বুঝায় ‘সমস্ত জ্ঞানভাষ্যকে সম্প্রদায়ের গন্তব্যর প্রতীকী ভাবনা হিসেবে পাঠ করা।’১ জেমসন সামাজিকভাবে সমষ্টিগত সচেতনতা অবচেতনে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি পর্যায়ের কথা বলেছেন। এ তিনটি পর্যায়ে রাজনৈতিক অবচেতন কাজ করে। প্রথম পর্যায় হচ্ছে প্রতীকী ক্রিয়া। জেমসনের মতে সামাজিকভাবে প্রতীকী ক্রিয়া ‘সাংস্কৃতিক শিল্পকর্মের মুখোশ উন্মোচন করে।’২ ভাষা, শিল্প, সাহিত্য সহ সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদান রাজনৈতিক অবচেতনের প্রতীকী স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করে।
দ্বিতীয়ত পর্যায়ে রয়েছে ভাবাদর্শিক প্রক্রিয়া। ভাবাদর্শিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আলথুসারের ইন্টারপেলেশন তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ কেননা এটি নির্দিষ্ট ভ্রান্ত স্বীকৃতির মাধ্যমে ঘটিত হয়। লাকাঁর প্রতীকী শৃঙ্খলা ও বাস্তবের ধারণার উপর ভিত্তি করে আলথুসার তার ইন্টারপেলেশন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন।৩ এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বৃহত্তর এবং ক্ষুদ্রতম অপরের চেতনা ও সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে ধারণ ও চর্চা করে। এই ধারণ ও চর্চা কোন ভ্রান্ত সচেতনা নয় বরং কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং ভাবাদর্শিক আবদ্ধতার ভ্রান্ত স্বীকৃতি। ভ্রান্ত স্বীকৃতি বা প্রতীকীকরণকে প্রতিহিত করার কোন ধরনের ইতিবাচক উপাদান নেই। আলথুসারের মতো জিজেক এবং জেমসন অভিন্নভাবে ভাবাদর্শকে মূল্যায়ন করেন। যেখানে ‘সবকিছু স্বচ্ছ হলে কোনো ধরনের ভাবাদর্শ সম্ভব নয় এবং কোনো আধিপত্যও তৈরি হবেনা’৪, এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে জেমসন স্পষ্টত ভিন্নমত পোষণ করেন। ভাবাদর্শিক ধারণাসমূহকে ছদ্ম আবরণক ধারণ করার অতীব প্রয়োজন নেই। কেননা ভাবাদর্শ স্পষ্টভাবে সামাজিক বাস্তবতার অংশ হিসেবে কাজ করে। ভাবাদর্শ হচ্ছে বাস্তবতাকে সম্পর্কে ধারণ ও চর্চা করার পদ্ধতি।
রাজনৈতিক অবচেতনের ক্ষেত্রে তৃতীয় পর্যায় হচ্ছে শ্রেণী জ্ঞানভাষ্য। শ্রেণী জ্ঞানভাষ্যের মধ্যে যে ঐতিহাসিক স্তরের কথা বলা হয়, (সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ ইত্যাদি) এটি একধরনের ‘যান্ত্রিক ধারণা।’৫ শ্রেণী জ্ঞানভাষ্য সামাজিক বিকাশকে শুধুমাত্র শ্রেণী দ্বন্দ্বের মধ্যে সংকুচিত করে রাখে। একইসাথে এটি সামাজিক সংস্কার ও প্রগতিশীলতা ব্যাপারে ফ্যান্টাসি তৈরি করে। শ্রেণী জ্ঞানভাষ্য সম্পর্কিত এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য জেমসন ইতিহাসবাদকে দায়ী করেন। কেননা ইতিহাসবাদের রৈখিক উন্নয়নের ধারণাই শ্রেণী জ্ঞানভাষ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। যদিও জেমসন মনে করে ইতিহাসবাদ উপস্থিতি সবসময়ই রয়েছে, তবে তিনি ইতিহাসের একক অখ্যানকেন্দ্রিক বিশ্লেষণ বিরোধী। তিনি ইতিহাস পাঠের ‘রূপকধর্মী’ ব্যাখ্যার উপর গুরুত্বারোপ করেন, কেননা এই ধরনের পাঠই হচ্ছে একমাত্র বিশ্লেষণমূলক। অন্যদিকে ইতিহাসের রাজনৈতিক পাঠ হচ্ছে ‘ইতিহাসের সামষ্টি অর্থ’ সাপেক্ষ এবং মনোবিশ্লেষণমূলক পাঠ হচ্ছে ‘ব্যক্তি সাপেক্ষ।’৬ জেমসন এজন্য ইতিহাসের রূপধর্মী পাঠকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। ইতিহাস কখনো সম্পূর্ণ ও সঙ্গতিপূর্ণভাবে ধারণ করা যায়না, এজন্য ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রে রূপধর্মী বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করতে হয়। ইতিহাস সম্পর্কে উপযুক্ত বোঝাপড়া ব্যতীত শ্রেণী জ্ঞানভাষ্যের কার্যকরী জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। ধ্রুপদী মার্কসবাদ যে ইতিহাসবাদ রয়েছে এটি সবসময় শ্রেণী সংগ্রামকে ইতিহাসের মধ্যে সংযুক্ত করে। শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কিত নির্ধারণবাদী অবস্থান সমাজ জীবন সম্পর্কে একটি সুনিশ্চিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। যদিও সমাজ জীবন তার বৈচিত্র ঘটনার কারণেই অনিশ্চিত। শুধুমাত্র সামাজিক জীবনে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিশ্চয়তায় পৌঁছানো সম্ভব। এই মধ্যস্ততা শুধুমাত্র প্রতীকী ক্রিয়া নয় বরং একইসাথে বাস্তবিক।
জেমসনের মতে এই তিনটি পর্যায়ের সমন্বয়ে রাজনৈতিক অবচেতন কাজ করে। জেমসনের অবচেতনের ধারণা ভাষাতাত্ত্বিক বা মনস্তাত্ত্বিক অবচেতন নয় বরং পাঠ্যজ্ঞান বিশ্লেষণ ভিত্তিক রাজনৈতিক অবচেতন। জেমসনের পাঠ্যজ্ঞান বিশ্লেষণের চূড়ান্ত বিচারে সবকিছুই হচ্ছে রাজনৈতিক। তার দৃষ্টিতে সাহিত্য বা সামাজিক অখ্যান বিশ্লেষণের উপজাত (byproduct) হচ্ছে রাজনীতি। আর এখানেই জেমসনের সাথে আলথুসার ও জিজেকের ফারাকের জায়গা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জেমসনের অবচেতনের ধারণা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যার ফলে রাজনৈতিক কার্যাবলীর জন্য মনস্তাত্ত্বিক প্রেষণাকে স্বতন্ত্রভাবে উন্মোচন ও দায়িত্বশীল করে তুলা সক্ষম হয়না। তাই রাজনৈতিক অবেচতনের ক্ষেত্রে লাকাঁ বা জিজেকের অবচেতনের ধারণা এক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী। জিজেকের অবচেতনের ধারণা রাজনৈতিক পরিসরে ফ্রেমিং করে বলা যায় রাজনৈতিক অবচেতন হচ্ছে একধরনের প্রতীকী স্বীকৃতি যা রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নির্মাণ করে। জিজেক জেমসনের মতো রাজনৈতিক অবচেতন সম্পর্কিত কোন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা না করলেও তার ভাবাদর্শ সম্পর্কিত ধারণার ভিত্তি হচ্ছে রাজনৈতিক এবং মনোবিশ্লেষণমূলক তৎপরতা।
রাজনৈতিক অবচেতন বলতে রাজনৈতিক অজ্ঞতা নয়
রাজনৈতিক অবচেতন বলতে কোন ধরনের রাজনৈতিক অজ্ঞতাকে বুঝায় না। যদিও এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ধ্রুপদী মার্কসবাদের মধ্যে লক্ষ্যণীয়। এছাড়াও ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের প্রথম প্রজন্মের ক্রিটিকাল থিওরির মধ্যেও এ ধরনের পর্যালোচনার উপস্থিত রয়েছে। তাদের চিন্তায় ভাবাদর্শ ও ধারণার সামাজিক কার্যাবলী ছদ্ম আবরণের মধ্য দিয়ে কাজ করে। তাই তাদের ভাবাদর্শিক বিশ্লেষণের লক্ষ্য হচ্ছে ছদ্ম আবরণকে উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়েই শুদ্ধ ও সত্যিকারের মুক্তির পথ খুজে পাওয়া। কিন্তু অবচেতনের মধ্যে এমন কোন গুপ্ত ক্ষমতা নেই যাকে উন্মুক্ত করলেই মানবমুক্তি সম্ভব হয়ে পড়বে। ধ্রুপদী মার্কসবাদে রাজনৈতিক অবচেতন বলতে রাজনীতিতে কী ঘটছে সে ব্যাপারে অজ্ঞতাকে বুঝানো হতো। যেমনটি কার্ল মার্কস বলেছেন ‘তারা এ সম্পর্কে জানেনা, কিন্তু তারা এটি পালন করে থাকে।’৭ অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর ভ্রান্ত সচেতনতা তাদের সত্যিকারের সচেতনাকে অবদমন করে রাখে। তবে মার্কসের এ ভ্রান্ত সচেতনতা বা অজ্ঞতা অবচেতন নয়। অবচেতন ভাষার মতো কাঠামোবদ্ধ। জিজেকের মতে অবচেতনের নিজস্ব ‘ব্যাকরণ’ ও ‘যুক্তি’ রয়েছে। এটি তার নিজস্ব ভাষায় ‘কথা’ বলতে ও ‘চিন্তা’ করতে সক্ষম।৮রাজনৈতিক অবচেতনের জ্ঞান অপরের সাথে সম্পৃক্ত থেকেই আসে, যাদের বলা হয় বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর অপর। মানুষের সবধরনের কাজই সামাজিক সমষ্টির সাথে সম্পৃক্ত বলে মানবীয় কর্মকান্ডে অবচেতন বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
ধ্রুপদী মার্কসবাদের ধারণা অনুযায়ী বুজোর্য়া সচেতনতা দ্বারা সর্বহারাদের বিপ্লব অবদমিত হচ্ছে। এখানে সর্বহারাদের রাজনৈতিক অবচেতন বলতে বাস্তব সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতাকে বুঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ অবচেতন হচ্ছে ব্যক্তির এমন এক কার্যাবলী যার জন্য ব্যক্তি নিজে দায়মুক্ত, যেহেতু ব্যক্তি সে সম্পর্কে অজ্ঞাত। কিন্তু উত্তর-মার্কসবাদী রাজনৈতিক দর্শন অনুযায়ী রাজনৈতিক অবচেতনে এই ধরনের দায়মুক্ত প্রক্রিয়ায় কাজ করেনা বরং ব্যক্তির ফ্যান্টাসি, বাসনা ও ভাবাদর্শিক স্বীকৃতির মাধ্যমে অবচেতন কাজ করে। রাজনৈতিক অবচেতনের জন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বয়ং দায়বদ্ধ। রাজনৈতিক অবচেতনের মধ্যে জ্ঞাত হওয়ার পরেও ব্যক্তি তার কাজসমূহ করে থাকে। এর কারণ হচ্ছে ব্যক্তির কার্যাবলী সবসময়ই ভাবাদর্শিকভাবে সম্পাদিত হয়ে থাকে। ভাবাদর্শ একইসাথে সচেতন এবং অবচেতনের বিষয়।
আমাদের দেশের রাষ্ট্রিয় কাঠামোর মধ্যে বিদ্যমান অবদমন সম্পর্ক জানার পরেও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এতে অংশগ্রহণের বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা সমাপ্তি করে বিশাল অংশের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য থাকে এতে অংশগ্রহণ করা। শ্রেণীর প্রশ্নে এরা যে শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে অংশগ্রহণ করে তা নয় বরং নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত এর অন্তর্ভুক্ত। এটি হচ্ছে অস্তিত্বের প্রশ্নে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে বিদ্যমান কাঠামোকে স্বীকৃতি প্রদান করা। তাই অবদমিত রাষ্ট্রিয় কাঠামোকে বিদ্যমান রেখে রাজনৈতিক চর্চাকে সর্বাত্মকবাদের দিকে নিয়ে যাওয়ার পিছনে জনগণের অজ্ঞতা বা কোনধরনের রহস্যময় ক্ষমতা দায়ী নয়। অবদমন সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েও এতে সবাই অংশগ্রহণ করতে চায়। বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও চলমান আমলতান্ত্রিকতা স্বয়ং গণতন্ত্রের জন্য অচলাবস্থা। আমলাতান্ত্রিকতার লক্ষ্য সমস্যা সমাধান করা নয় বরং এর লক্ষ্য হচ্ছে স্বয়ং সমস্যাসমূহকে পুনরুৎপাদনের ন্যায্যতা হিসেবে ব্যবহার করা। আমলতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই নব্বই দশক পরবর্তী সামরিক প্রশাসন-উত্তর রাজনীতিতে সবার্ত্মকবাদী প্রেষণার পুনরাবৃত্তি সম্ভব হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাসের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণভাবে জড়িত। তবে জনগণ এই রাষ্ট্রিয় কাঠামোর দ্বারা অবদমিত হলেও তারা এই অবদমনের ব্যাপারে জ্ঞাত। একধরনের ভ্রান্ত স্বীকৃতির ফলেই এই অবদমনের কাঠামো এখনো বিদ্যমান।
ফ্যান্টাসি ও বাসনা
অবচেতনের প্রেষণা হিসেবে ফ্যান্টাসি ও বাসনা এই দুইটি ক্যাটাগরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক অবচেতনের ভিত্তি হচ্ছে ফ্যান্টাসি এবং বাসনা। অবচেতনের জ্ঞান আমাদের কাজ এবং অনুভূতিকে বিভিন্নভাবে নির্ধারণ করে। এ বিষয়টিকেই লাকাঁ ফ্যান্টাসি হিসেবে চিহ্নিত করেন। বাস্তবতাকে আমরা যেভাবে আমাদের অভিজ্ঞতাদের মধ্যে দিয়ে পাই তা ফ্যান্টাসির মাধ্যমে কাঠামোবদ্ধ হয়। লাকানিয়ান সাবজেক্ট অনুযায়ী তাই সত্যের কাল্পনিক কাঠামো রয়েছে। বাস্তবতাকে সমর্থনের জন্যই ‘ফ্যান্টাসির’ নির্মাণ।৯
জিজেকের মতে ফ্যান্টাসি আমাদেরকে কিভাবে বাসনা তৈরি করতে তা শিক্ষা দেয়।১০ সব মানুষের মধ্যেই বিভিন্নভাবে সন্তুষ্ট থাকার বাসনা রয়েছে। লাকাঁনিয়ান ভাষায় বাসনা হচ্ছে তাই যা ব্যক্তি লাভ করতে পারেনা, যা সব সময় অবদমিত করে রাখা হয়। বাসনার মাধ্যমে একটি বাসনা মেটানোর পর নতুন একটি বাসনা তৈরি করে। বাসনার এই নতুন চাহিদাই জিজেকিয়ান ভাষায় উদ্বৃত্ত উপভোগ (surplus enjoyment)। এই উদ্বৃত্ত উপভোগের মধ্যকার সংকট হচ্ছে এটি ব্যক্তির অর্জিত বাসনা সীমাবদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করে। যার ফলে ব্যক্তির মনোজগতে নতুন নতুন বাসনা তৈরি হয়। চূড়ান্ত বিচারে বাসনা হচ্ছে কোন বিষয় সম্পর্কে বাসনা নয় বরং স্বয়ং বাসনা সম্পর্কে বাসনা করা। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির মধ্যে বাসনা রয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে জীবিত। তাই সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে ব্যক্তির বাসনাকে ত্যাগ করা। বাসনার ফলে ব্যক্তি অনবরত নিজের মধ্যে অসম্পূর্ণতা বা অভাববোধকে ধারণ করে। মানুষের বাসনা জীবিত থাকে ফ্যান্টাসির মাধ্যমে। ফ্যান্টাসি আমাদের বাসনাকে বাঁচিয়ে রাখে, অপূর্ণ রাখে ও বাসনাকে বাসনা হিসাবে অক্ষত রাখে। ফ্যান্টাসি আমাদেরকে উদ্বেগ থেকে মুক্ত রাখার জন্য কাজ করে। একইসাথে ফ্যান্টাসি আমাদের সুখী থাকার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ বাতলে দেয়। এর মাধ্যমে ফ্যান্টাসি আমাদের মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি করে যে আমরা সত্যিকারের জীবনকে উপভোগ করছি কিনা।
ফ্যান্টাসির জটিলতা হচ্ছে এটি ‘অপরের বাসনা’ নিয়ে হাজির হয়।১১ যে ফ্যান্টাসিকে ঘিরে বাসনা আবর্তিত হয় সেই বাসনা শুধু ব্যক্তির নিজস্ব বাসনা (small other) নয় বরং বৃহত্তর অপরেরও (big other) বাসনা। বাসনার মূল জিজ্ঞাসা হচ্ছে, ‘ব্যক্তির নিকট থেকে অপর কি চায়?’‘১২ আমাদের সবার বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি বাসনা রয়েছে। আমরা বিভিন্ন জিনিসের প্রতি বাসনে করলেও আমরা এটি জানতে চাইনা যে আমরা কেনো বাসনা তৈরি হয়। এই বাসনা বৃহত্তর অপর ও অবচেতন কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। ব্যক্তির বাসনা একই সাথে অপরের ইচ্ছা ও বাসনা সাথে সংযুক্ত। যেমন একটি শিশুর পছন্দের খাবারের বাসনা তার পিতামাতার সন্তুষ্টির উপর নির্ভরশীল। নাগরিক কার্যাবলীর বাসনা তার সার্বভৌম কতৃপক্ষের বাসনার সাথে সংযুক্ত। নাগরিক দায়িত্ব তার নিজস্ব সক্রিয়তার অন্তর্ভুক্ত নয় বরং সে ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তার যন্ত্র মাত্র।’১৩ যার ফলে নাগরিক তার কার্যাবলীর মাধ্যমে বুর্জোয়া রাজনৈতিক অর্থনীতির শৃঙ্খলাকেই পুনরুৎপাদন করে। তবে সার্বভৌম কতৃপক্ষের ও অন্যান্য বৃহত্তর অপরের কাজ ব্যক্তির উপভোগের সীমানাকে সীমাবদ্ধ করা নয় বরং ব্যক্তির জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করা। কেননা এর মাধ্যমে বৃহত্তর অপর সবসময় উদ্ধৃত উপভোগকে বর্ধিত করে ও ফ্যান্টাসিকে সক্রিয় রাখে। ফ্যান্টাসি সামষ্টিক অবচেতনের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তার উপশম হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তিসত্তার উপর সামাজিক বাস্তবতার যে অবদমিত বলপ্রয়োগ রয়েছে ফ্যান্টাসির মাধ্যমে এটি স্থিতাবস্থা লাভ করে। অর্থাৎ ফ্যান্টাসি ব্যক্তির সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিচয় নির্মাণে কাজ করে। ফ্যান্টাসি সবসময় বাস্তবতার অসঙ্গতিকে পূর্ণ করে তুলে। আমাদের বাস্তবতার যে অভিজ্ঞতা রয়েছে এটি সবসময় ফ্যান্টাসি অবচেতন প্রয়োগ দ্বারা প্রভাবিত।
গণতন্ত্রের অবচেতন ভিত্তি
রাজনৈতিক চিন্তায় জিজেকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে আধুনিক গণতন্ত্রের যে অবচেতন ভিত্তি রয়েছে তাকে পদ্ধতিগতভাবে বিশ্লেষণ। গণতান্ত্রিক অবচেতন কোন ধরনের অস্বীকৃত, অজানা বা অচেতন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ নয় বরং এটি স্বীকৃতির অংশ। যেহেতু অবচেতন মুখোশের আড়ালে থাকা অচেনা কোন শৃঙ্খলা নয় তাই গণতন্ত্র তার অবচেতনের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী। লাকাঁ এবং জিজেকিয়ান সাবজেক্ট অনুযায়ী এই স্বীকৃতি কল্পনা,(imaginary) প্রতীকী শৃঙ্খলার (symbolic order) এবং বাস্তবের (real) সাথে সংযুক্ত। কল্পনা ও প্রতীকী শৃঙ্খলার মাধ্যমেই আমাদের বাস্তবতা নির্মিত হয়। (লাকাঁনিয়ান সাবজেক্ট অনুযায়ী বাস্তব ও বাস্তবতা ভিন্ন) অন্যান্য সব বাস্তবতার মতো গণতান্ত্রিক বাস্তবতাও কল্পনা ও প্রতীকী শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে এ সম্পর্কিত কল্পিত ধারণাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে প্রতিষ্ঠিত করার কল্পিত ধারণা থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে নির্মাণ করা হয়েছে। কল্পিত সম্পর্কের মধ্যে ক্ষুদ্র অপরের উপস্থিত রয়েছে। এর মধ্য দিয়েই ক্ষুদ্র অপর কাজ করে। ক্ষুদ্র অপর তার নিজস্ব বাসনা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। অর্থাৎ ক্ষুদ্র অপর হচ্ছে কল্পিত প্রক্রিয়ার নিজস্ব প্রতিফলন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অন্যতম উপাদান হিসেবে সার্বভৌমের ধারণা ও চর্চা হয় প্রতীকী স্বীকৃতির মাধ্যমে। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় প্রতীকী স্বীকৃতির মাধ্যমে সার্বভৌমত্বের ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে জনগণই হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এই লক্ষ্য অর্জনের প্রধান বাধা হল গণতন্ত্র নিজেই, যা জনগণের উপর ক্ষমতা চর্চা করে এবং জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা নিজস্ব স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা হিসাবে দেখে। কাজেই জনগণের নামে যে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই ক্ষমতার উপর জনগণের অধিকার গণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের ফলে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে।
লাকাঁনিয়ান মনোবিশ্লেষণে প্রতীকী শৃঙ্খলা হচ্ছে একধরনের ভ্রান্ত স্বীকৃতি। গণতন্ত্রের বিকাশের মূহুর্ত থেকে এটি একটি সাম্যবাদী (egalitarian) স্পৃহার কথা বলে আসছে। (যেমনঃ আইনের শাসন, সমান অধিকার, ন্যায্যতা ইত্যাদি) ফরাসি বিপ্লব এবং আমেরিকান বিপ্লবে সাম্য ও মুক্তির ধারণা প্রতীকী প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করেছে। ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী ফরাসি জাতীয়তাবাদ ইউরোপের জন্য মানবিক সাম্যের প্রতীকে পরিনত হয়। এমনকি ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালীন সময় সাম্যবাদী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতীকী স্বীকৃতি হিসেবে উভয় দেশে যথাক্রমে আম্বেদকর ও যোগেণ মন্ডলের মতো নিম্নবর্গের (দলিত) নেতাকে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম প্রধান ও আইন মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে প্রতীকী শৃঙ্খলার মধ্যে অংশগ্রহণের ফলেই গণতন্ত্র তার নিজস্ব ধারণাকে নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। প্রতীকী শৃঙ্খলার ফলের রাজনৈতিক বাস্তবতা সত্তাগতভাবে হয়ে ওঠে। প্রতীকী শৃঙ্খলার মধ্যে অংশগ্রহণ ব্যতীত গণতন্ত্র সামাজিকভাবে তার কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম নয়। সাম্যবাদী গণতন্ত্র নিজেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখা ভ্রান্ত স্বীকৃতি। ভ্রান্ত স্বীকৃতি সত্যিকারের বা বাস্তবিক গণতন্ত্রকে আড়াল করে রাখেনা বরং এটি বাস্তবতাকে নির্মাণ করে। ভ্রান্ত বা প্রতীকী শৃঙ্খলার ভূমিকার ফলে আইনের শাসন, সার্বজনীন শিক্ষা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো অনেকদূর পর্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই প্রতীকী শৃঙ্খলা হচ্ছে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও বাসনার সাথে বোঝাপড়া।
ঔপনিবেশিক কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গণতান্ত্রয়ণের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতীকীকরণই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যার ধারাবাহিকতা এখনো আমাদের দেশে বিদ্যমান। আমাদের দেশের প্রতীকী গণতন্ত্র যে বাস্তবের (real) জন্ম দিয়েছে তা হচ্ছে অনেকগুলো অচলাবস্থা। যে অচলাবস্থা সত্যিকারের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে স্বাধীন ঘোষণাপত্রে যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে এগুলোও প্রতীকী শৃঙ্খলা হিসেবে উপস্থাপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা গণতন্ত্রের ভাষাকেই প্রতীকী হিসেবে গ্রহণ করেছি। গণতন্ত্রের ভাষা থেকে আমরা যে বাস্তবে পৌঁছেছি সেটি স্বয়ং গণতন্ত্র বিরোধী। উন্নত দেশগুলোতে সাম্যবাদের স্পৃহার ভ্রান্ত স্বীকৃতির মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে স্বয়ং গণতন্ত্রের ভাষাই একটি ভ্রান্ত স্বীকৃতি। এর কারণ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত সেই প্রতীকগুলোর মৌলিক কোন রূপান্তর ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আর এটিই হচ্ছে আমাদের বাস্তবের রাজনীতির প্রধান অচলাবস্থা। তাই মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকারগুলো এখনো গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শের মুক্তির প্রতীকী সম্পর্ক হিসেবে কাজ করছে।
মাস্টার সিগনিফায়ার
মাস্টার সিগনিফায়ার কিভাবে রাজনৈতিক অচলাবস্থাসমূহকে সংকুচিতভাবে উপস্থাপন করে তার একটি উদাহরণ হচ্ছে ‘ডোন্ট লোক আপ’ চলচ্চিত্র। সংসদীয় গণতন্ত্র, আমলতান্ত্রিক জটিলতা বা পুঁজিবাদী কতৃত্ববাদের কাঠামোগত সমস্যার চেয়ে জনসাধারণ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও কর্পোরেট নেতাদের অজ্ঞতাকেই পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রধান লক্ষণ হিসেবে এতে উপস্থাপন করা হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী চরিত্রে অভিনীত এই চলচ্চিত্রে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও এবং জেনিফার লরেন্স একটি ধূমকেতু (জলবায়ু পরিবর্তনের রূপক হিসেবে) আবিষ্কার করেন যা ছয় মাসের মধ্যে পৃথিবীতে আঘাত হানবে। এজন্য তারা মানুষকে সতর্ক করার চেষ্টা করেন। তারা হোয়াইট হাউসে যান, মিডিয়ার কাছে যান। গ্রহ-হত্যাকারী ধূমকেতু পৃথিবীর কাছাকাছি আসার পরেও জনসাধারণ তাদের বার্তাটি শুনতে আগ্রহী নয়। ডিক্যাপ্রিও এবং লরেন্স বর্তমান প্রজন্মকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেই বের হয়ে উপরের দিকে তাকানোর জন্য অনুরোধ করতে থাকেন, যেনো তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হয়। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট জনসাধারণকে উপরে তাকাতে নিষেধ করেন। এই চলচ্চিত্রে দুটি প্রধান দিক রয়েছে। প্রথমত, জনসাধারণ প্রযুক্তি ও যোগাযোগ মাধ্যমে মগ্ন থাকার ফলে নিজেদের সত্যিকারের সমস্যা সম্পর্কে অসচেতন। দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে সত্যত্তোর (post-truth) রাজনীতি, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে এর অগ্রদূত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যার প্রধান কাজ হচ্ছে সম্ভাব্য সত্য ঘটনাকে গোপন রাখার জন্য জনসাধারণের নিকট মিথ্যা প্রচার করা। তবে এ চলচ্চিত্রে রাষ্ট্রপতি সত্যকে গোপন রাখার জন্য নিজেই নিজের সাথে প্রতিনিয়ত মিথ্যা বলে থাকেন। যেমনটি ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রতিনিয়ত নিজের সাথে মিথ্যা বলেছেন।
জিজেকিয়ান বিশ্লেষণ অনুযায়ী টিকটিক বা অন্যান্য ভার্চুয়াল যোগাযোগ মাধ্যমে মগ্ন থাকার অর্থ এই নয় এগুলোকে মানুষকে বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ করে তুলে যা এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন বাস্তবতার অংশে রূপান্তরিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বাস্তবতা বিরোধী নয় বরং এগুলো বাস্তবতাকে প্রভাবিত করে নতুন নতুন বাস্তবতা নির্মান করছে। এটি প্রাত্যহিক জীবন যাপনের অভিজ্ঞতার অংশে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় সহ স্থানীয় ও পুঁজিবাদী বৈশ্বিক কাঠামোর অন্যান্য সমস্যা এখন আর কোন গুপ্ত বা রহস্যময় কোন সমস্যা নয়। অজ্ঞতার সমস্যা কে এই চলচ্চিত্র যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা একটি ভ্রান্ত সমস্যা। এইধরনের উপস্থাপন জনসাধারণের মধ্যে অজ্ঞতাজনিত অপরাধবোধ সঞ্চার করে। জনসাধারণ তাদের সমস্যা সম্পর্কে অজ্ঞ, এটি কোন সত্যিকারের সমস্যা নয়। সত্যিকারের সমস্যা হচ্ছে সমস্যাকে জানার পরেও উপর্যুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম না হওয়া। যথাযথ পদক্ষেপের জন্য অচলাবস্থাসমূহকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যখন অচলবাস্থাসমূহ উপস্থাপন করা তখনই একটি মাস্টার সিগনিফায়ার উপস্থিত হয়। লাকাঁ-জিজেকিয়ান মনোবিশ্লেষণের মাস্টার সিগনিফায়ার হচ্ছে রাজনৈতিক জ্ঞানভাষ্য বিশ্লেষণে তাৎপর্যপূর্ণ ধরন। মাস্টার সিগনিফায়ার অবচেতন প্রক্রিয়ার ভ্রান্ত স্বীকৃতি। জিজেকের মতে মাস্টার সিগনিফায়ার স্বয়ং ফাঁপা।১৪ মাস্টার সিগনিফায়ার অনেক সময় অন্যান্য সামাজিক ইস্যুকে অবদমন করে রাখে। যেমন সাম্প্রতিক বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্যর ইস্যুতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত মাস্টার সিগনিফায়ার হিসেবে হাজির হয়েছে। তবে এর নিজস্ব কর্তাসত্তা রয়েছে। মাস্টার সিগনিফায়ার এমন এক সিগনিফায়ার যা অন্যান্য জ্ঞানভাষ্যের অর্থ নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধ করে একইসাথে সমাজ কাঠামো কেমন হওয়া উচিত তার ‘ভাবাদর্শগত ধারণা’ নির্মাণ করে। মাস্টার সিগনিফায়ার হচ্ছে সার্বিকের একক বা সর্বাত্মক উপস্থাপন। সর্বাত্মক উপস্থাপন হিসেবে এটি নিজেকে সার্বজনীন হিসেবে দাবী করে। তাই যখনই পুঁজিবাদের সংকট, পরিবেশ বিপর্যয় বা নারীর অধিকারের ইত্যাদি বিভিন্ন সংকটের কথা বলা হয় তখনই একটি মাস্টার সিগনিফায়ারকে উপস্থাপন করা হয়। উন্নত বিশ্বের জন্য এ মাস্টার সিগনিফায়ার হচ্ছে গণতন্ত্র। জিজেকের মতে “গণতন্ত্র পশ্চিমা সভ্যতার মৌলিক মূল্যবোধ হিসাবে কাজ করে যেখানে অন্যান্য অর্থনৈতিক, নারীবাদী, সংখ্যালঘুদের সমস্ত সংগ্রাম ইত্যাদি মৌলিক গণতান্ত্রিক সমতাবাদী নীতির সম্প্রসারিত প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।”১৫ যদিও গণতন্ত্রকে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের এখনো সুযোগ রয়েছে। তবে তার পূর্বে গণতন্ত্রের অচলাবস্থাকে স্বীকৃতি প্রদান করবে হবে। উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রের মতো আমাদের দেশের জন্য মাস্টার সিগনিফায়ার হচ্ছে ভ্রান্ত অর্থনৈতিক প্রগতি। চীন বা অন্যান্য ‘প্রাচ্যতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের’ মতো কতৃত্ববাদী পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক পরিসরের জন্য মাস্টার সিগনিফায়ার। অর্থনৈতিক প্রগতি এ অঞ্চলে মূলত কতৃত্ববাদী ক্ষমতার ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণ করে।
মাস্টার সিগনিফায়ারের তৎপরতা হচ্ছে ভাবাদর্শিক। ভাবাদর্শের লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক সমস্যাসমূহ সমাধানকল্পে একক মৌলিক কারণ চিহ্নিত করে, এর প্রভাব ব্যাখ্যা করে সমাধানের প্রস্তাব দেওয়া। জার্মান জাতিয়তাবাদী ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে ইহুদি বিরোধীতা একইভাবে মাস্টার সিগনিফায়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়, যারা মাধ্যমে জার্মানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার সমাধান সম্ভবপর হবে বলে উপস্থান করা হয়। একইভাবে ফিলিস্তিন ইসরায়েল দ্বন্দ্ব সমাধানের ক্ষেত্রে জেরুজালেম সবসময় ‘মাস্টার সিগনিফায়ার’ হিসেবে আবির্ভূত হয়, যাকে ছাড়া আরব ইসরায়েল ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এই ধরনের ‘মাস্টার সিগনিফায়ারকে’ প্রশ্নবিদ্ধ করা মানে কথিত ন্যায্যতা ও মুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, কেননা এগুলো সব এর মধ্যেই অন্তর্নিহিত হিসেবে স্বীকৃত। মাস্টার সিগনিফায়ারের এই সবার্ত্মকবাদী প্রবণতার মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক প্রচেষ্টাগুলি ব্যর্থ হয় কারণ সামাজিক স্তরে বৈচিত্রভাবে এমন অনেক মানসিক উদ্বেগ এবং আবেগ বিদ্যমান যা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা যায় না। এজন্য প্রত্যেক মাস্টার সিগনিফায়ার নির্মাণের সাথে যাপিত জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। রাজনৈতিক অবচেতন সামাজিক পরিসরে সবসময়ই মাস্টার সিগনিফায়ারকে ধারণ করে। তাই মুক্তি বলতে মাস্টার সিগনিফায়ার থেকে মুক্তি নয় বরং বিকল্প সিগনিফায়ারের পরিবর্তন।
পরিশেষ
রাজনৈতিক অবচেতনের যেসব জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাস্টার সিগনিফায়ার। অবচেতন সামষ্টিকভাবে মাস্টার সিগনিফায়ারকে উৎপাদন করে। মাস্টার সিগনিফায়ার সবসময়ই সত্যিকারের অচলাবস্থাসমূহকে সংকুচিত করে রাখে। তাই অচলাবস্থাসমূহের ব্যাপারে সতর্কমূলক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক পরিসরে বিদ্যমান কাঠামোকে সংস্করণ ও অস্বীকৃতির প্রয়োজন। বিদ্যমান কাঠামোকে নিজস্ব অবস্থান থেকে অস্বীকৃতি প্রদান করে এর থেকে মুক্তি অন্যতম পন্থা। এটি হচ্ছে সামাজিক কাঠামোর প্রতি একধরনের চ্যালেঞ্জ যা অস্বীকৃতির মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে ঐক্য ও সম্ভাবনা গড়ে তুলতে সক্ষম। যে বিবর্তনমূলক স্বীকৃতির মাধ্যমে রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকে কাঠামোগত অস্বীকৃতির মাধ্যমে বিদ্যমান কাঠামোর আমূল ও স্থায়ী পরিবর্তন সম্ভব। এই অস্বীকৃতি একইসাথে নতুন, মৌলিক ও সাম্যবাদী কাঠামোর স্বীকৃতি।
তথ্যসূত্রঃ
১) Fredric Jameson, The Political Unconscious: Narrative as a socially symbolic act , Routledge classics, London and New York, 2002, p.65
২) Ibid, p.5
৩) Ibid, p.19-20
৪) Ibid, p.46
৫) Ibid, p.75
৬) Ibid, p.16
৭) Slavoj Zizek, The Sublime Object Of Ideology, Verso, New York & London, 2008, p.24
৮) Slavoj Žižek, How to Read Lacan, W.W. Norton & Company, New York & London, 2007,p.3
৯) Slavoj Zizek, The Sublime Object Of Ideology, Ibid, p.45
১০) Slavoj Žižek, How to Read Lacan, Ibid, p.47
১১) Slavoj Zizek, The Sublime Object Of Ideology, Ibid, p.132
১২) Slavoj Žižek, How to Read Lacan, Ibid, p.49
১৩) Ibid, p.105
১৪) Slavoj Zizek, The Sublime Object Of Ideology, Ibid, p.172-73
১৫) Ibid, p.xxvii