Leesa Gazi, Issue 10

তারাবাত্তি জ্বলে

Share this:

তারাবাত্তি গানটা বেশ ক’বছর আগে লেখা। সৈয়দ হকের ‘পরাণের গহীন ভিতর’কাব্যগ্রন্থ নিয়ে একটা কাজ করবার ইচ্ছা ছিলো এক বন্ধুরসাথে। সেসময় কবিতাগুলির প্রতি উত্তর হিসাবে কয়েকটা গান লিখি। তারাবাত্তি তখনই লেখা। তারপর আর কাজটা হয়ে ওঠে নাই। গানের কথাগুলি গান হয়ে উঠবার অপেক্ষায় ছিলো।

এর কয়েক বছর পর মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের নিয়ে নাটকের একটা কাজ আমাদের আর্টস কোম্পানি কমলা কালেক্টিভ থেকে সম্পন্ন করতে আমরা বাংলাদেশে ছুটি। সেই যাত্রাই আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে রূপ নেয়। ইতিমধ্যে আমার চেনা তিনজন বীরাঙ্গনা আপা মারা যান। একে একে বীরাঙ্গনাদের অন্তর্ধান দেখে মনে হলো, ওঁদের চলে যাওয়ার অর্থ ওঁদের গল্পগুলি হারিয়ে যাওয়া। সেই হাহাকারবোধ থেকেই ‘রাইজিং সাইলেন্স’ছবি নির্মাণ করার কথা ভাবি। ছবিটা এখন মুক্তির প্রতীক্ষায় আছে, প্রযোজনা করেছে কমলা কালেক্টিভ (Komola Collective), ওপেনভাইযার (Openvizor) ও মেকিং হারস্টোরি (Making Herstory)।

‘রাইজিং সাইলেন্স’নারীর সাথে নারীর সম্পর্কের পরিভ্রমণ – যাঁরা যুদ্ধ সয়েছেন, যুদ্ধের হিংস্রতা আর পরবর্তীতে দৈনন্দিন বিদ্বেষ সয়েও আগামী দিন গড়তে ক্ষত মুছেছেন শর্তহীন ভালোবাসায়।

ছবিটা করতে গিয়ে শুটিং-এর প্রথম ধাপে আমরা টানা ৩৭ দিন কাজ করেছি, এবং পরবর্তি ধাপে কাজ করেছি ১০ দিন। ২০১৫ সালে নভেম্বরের এক শীতের সকালে আমরা বেরিয়ে পরি। ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁ, সেখান থেকে সোহাগপুর তারপর সিরাজগঞ্জ। সিরাজগঞ্জ থেকে খাগড়াছড়ি তারপর আবার ঢাকায় ফিরে বাকি শুটিং সারা হয়। পরবর্তি ধাপে আমাদের কাজ হয় কোলকাতায়। শুটিং-এর সময়টায় আমরা প্রতিজন বীরাঙ্গনা আপার সাথে ৩-৪ দিন করে থেকেছি। কাছে থেকে তাঁদের জীবন দেখার, জানার সুযোগ হয় সেকারণেই। সেই যাত্রা আমাকে বদলে দিয়েছে আমূল। কতশত কথা, কত গান, কত ছবি, কত বেদনার আখ্যান, বুকচেরা কান্না, কত বিপর্যয় আর ভালোবাসার গল্প একাকার হয়ে গেছে দিনরাত্রির পরিক্রমায় —‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয় কেবল তোমার কাছে যাওয়া…’ওঁদের গভীরে আমি নিরন্তর তারাবাতি জ্বলতে দেখেছি। সেই ওম হৃদয়ে এসে বেজেছে। আশ্চর্য হয়ে দেখেছি কিভাবে এতোটা বছর ধরে ওঁরা নিজেদের ক্ষত’র দেখভাল নিজেরাই করেছেন, পরম সহিষ্ণুতায় সারিয়ে তোলার স্পর্ধা দেখিয়েছেন, প্রকৃতি আর গানের ছায়ায় বেদনা জুড়িয়েছেন, নির্ভার হয়েছেন, ভস্বস্তূপের মধ্যেও শিখা নিবতে দেন নাই। নতুন জোরে বেঁচেছেন, বাঁচিয়েছেন। এই বেঁচে উঠবার এবং স্বপ্ন জিইয়ে রাখবার সংগ্রামে গানকে ওঁদের অবিচ্ছিন্ন সাথী হিসাবে দেখেছি।

তারাবাত্তি গান অনেকদিন আগে লেখা হলেও ওঁদের হৃৎস্পন্দনের সাথে তাল মেলায়, অনায়াসে। গানটা ওঁদের কথা উচ্চারণ করে। একদিন সাহস সঞ্চয় করে অতুলন সঙ্গীতশিল্পী, গান রচয়িতা আর আমি যার সবসময়ের মুগ্ধ শ্রোতা সেই মৌসুমী ভৌমিকের কাছে গানের কথাগুলি পাঠাই। মৌসুমী’দির সাথে আগেই পরিচয় ছিল। জিজ্ঞেস করায় বললেন যে তিনি নিজের লেখা ছাড়া গান করেন না বললেই চলে, তবু পাঠাতে বললেন। পাখির সাহস নিয়ে দুরুদুরু বুকে পাঠালাম।

সেই গান তাঁর সুরে এবং কণ্ঠে আমার প্রথম শোনা হল শরতের এক ভেজা সকালে, লন্ডনের এক ক্যাফেতে বসে। ফোনে রেকর্ড করে নিয়ে এসেছিলেন মৌসুমী’দি। ক্যাফের ভিতরে লোকজনের আলাপচারিতা এড়িয়ে নিরিবিলিতে শুনবো বলে আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। খুব কম মানুষ ছিল, একটাও গাড়ি নাই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে তারাবাত্তি ধ্বক করে জ্বলে উঠলো মৌসুমী’দির কণ্ঠে। সেই আর্তি, সেই অপরাজেয় দ্যুতির সমস্তটা নিয়ে। আমি ভীষণভাবে ঋণী মৌসুমী’দির কাছে। তাঁর সঙ্গীতায়োজন এবং গায়কীতে এই গানে যেমন প্রগাঢ় মায়া তেমনি দৃঢ়তা —বীরাঙ্গনা আপাদের সমরূপতা।

তারাবাত্তি

তারাবাত্তি জ্বলে রে তারাবাত্তি জ্বলে

মানুষ নামের কলে রে তারাবাত্তি জ্বলে

তারাবাত্তি ঢলে রে তারাবাত্তি ঢলে

মন যমুনা তলে রে তারাবাত্তি ঢলে

তারাবাত্তি জ্বলে, হাউই উইড়া চলে

মানুষ নামের কলে রে তারাবাত্তি জ্বলে

উথাল পাথাল নীলা রে পুঞ্জ পুঞ্জ সুখ

অতল ঢেউয়ের খেলা রে, বানে ভাসে বুক

সাতমহলা বাড়ি তার কুঞ্জে গুঞ্জে পাখি

জিগান মালিক নাই রে হুদাই হাঁকাহাঁকি

আট বেহারা পাল্কি রে হুহুম স্বরে ডাকি

তারাবাত্তি ঘরে রে জিগান মালিক নাকি!

তারাবাত্তি জ্বলে, হাউই উইড়া চলে

মানুষ নামের কলে রে তারাবাত্তি জ্বলে

তারাবাত্তি ঢলে রে তারাবাত্তি ঢলে

মন যমুনা তলে রে তারাবাত্তি ঢলে

তারাবাত্তি জ্বলে রে তারাবাত্তি জ্বলে।।

পরিচালনা: লীসা গাজী

প্রযোজনা: কমলা কালেক্টিভ, ওপেনভাইযার, মেকিং হারস্টোরি ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি: শাহাদাত হোসেন শব্দ গ্রাহক: আলি আহসান সম্পাদক: টাইমেন ভেল্ডহাউযেন এডিটরিয়াল কনসালটেণ্ট: দীনা হোসেন সঙ্গীত পরিচালক: সোহিনী আলম এবং অলিভার উইক্স রিসার্চ এ্যাডভাইযার: হাসান আরিফ স্থির চিত্র: শিহাব খান

 

Leesa Gazi is a  Bangladeshi-born British writer, playwright, theatre director and actress based in London.

More Posts From this Author:

Share this:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!