মুক্তির গদ্য, গদ্যের মুক্তি
মারিও ভারগাস য়োসা’র নোবেল বক্তৃতার নাম ছিল ‘লেখালেখি ও সাহিত্যপাঠের পক্ষে কয়েকটি কথা’; আজ আমাদের এই গদ্যটির শুরুতেই আমরা য়োসা’র সেই অসামান্য বক্তৃতাটির শুরুর দিকের কয়েকটি কথা (এডিথ গ্রসম্যানের ইংরেজি অনুবাদ থেকে) পড়ে নেব :
বলিভিয়া’র শহর কোচাবাম্বায় দে লা স্যাল একাডেমি’র ব্রাদার জাস্তিনিয়ানো’র শ্রেণিকক্ষে, মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই আমি পড়তে শিখেছিলাম। এই ব্যাপারটিই আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান। এভাবে পাঠের জগতে একে একে সত্তর বছরের বেশি সময় কাটিয়ে দেবার পর আমার এখনও মনে পড়ে বইয়ে লেখা শব্দগুলিকে ছবিতে রূপান্তরের সেই অদ্ভুত জাদুবিদ্যা নিজের জীবনটিকে ঠিক কতোটা পূর্ণ করে তুলেছিল, কাল ও স্থানের দেওয়ালগুলি ভেঙে গিয়েছিল ধীরে ধীরে, পথ দেখিয়ে দিয়েছিল ক্যাপ্টেন নিমো’র সঙ্গে সমুদ্রের অতল জলরাশির বিশ হাজার লিগ তলে অভিযাত্রায় চলে যেতে, আরামিস, অ্যাথোস, পার্থোসের লড়াই দ্য’আরতাঁনা’র সঙ্গে, রিশেলিও’র গূঢ় অভিপ্রায়ের দিনগুলিতে রাণি’র সহায়তা, প্যারিসের ভূগর্ভস্থ নর্দমায় নেমে গিয়ে জ্যঁ ভালজাঁয় রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া, তারপর ম্যারিউসের অচেতন শরীরটাকে পিঠে করে বয়ে নিয়ে যেতাম বহুদূর।
বইপড়া ব্যাপারটি এমন- এই পড়া স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দেয়, বাস্তব হয়ে যায় স্বপ্ন; পাঠের জাদুস্পর্শে একদিন যে এক ছোট্ট বালক ছিল, তার সামনে জীবন ও স্বপ্নের ঘোর দিয়ে তৈরি সাহিত্যের বিপুলা পৃথিবী তার দরোজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। মায়ের মুখ থেকে একদিন এই কথাটি শুনতে পেলাম- আমি প্রথম যা লিখতে শুরু করেছিলাম তা ছিল আমার পঠিত গল্পগুলির এক সম্প্রসারণ, কারণ গল্পগুলি যে জায়গাটিতে গিয়ে পৌঁছাত, শেষ হত, সেই শেষটা আমাকে বিষণ্ণ করে ফেলত, আমি তাই গল্পের সমাপ্তিটিকে নিজের মত করে বদলে নিতাম। সম্ভবত ব্যাপারটি ঠিক মত বুঝতে না পেরেই আমি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছি, আর এখনও বয়সের ভারে ভারাক্তান্ত হয়েও যে-গল্পগুলি আমার ছোটবেলার বিষণ্ণতা ও আনন্দের উৎস ছিল তাদেরকেই নিজের মত করে লিখে গেছি।
আজ যদি আমার মা এখানে থাকতেন, আমাদো নেরভো আর নেরুদা’র কবিতা যখন পড়তেন, আমার মায়ের চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ত; আমার পিতামহ- পেদ্র, যার নাকটি ছিল বিশাল, সঙ্গে একটি দীপ্তি বিচ্ছুরিত করা টেকো মাথা- আমার লেখাকে তিনি উদযাপন করতেন; আর একজনের কথা বিশেষভাবে বলব, তিনি আমার লুসো কাকা। এই লুসো কাকাই আমাকে শরীর ও আত্মা নিয়ে লেখায় ডুবে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটিকে আরও বেশি করে উসকে দিতেন যদিও সেই সময়ে লেখালেখি করা নিজেকে উজাড় করার নামান্তর ছিল, সেটা জেনেও। জীবনভর আমি আমার পাশে এরকম মানুষকেই পেয়েছি, যারা এভাবেই আমাকে ভালবেসেছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন, আর যখনই আমি নানামাত্রিক সংশয়ে ভুগেছি তখনই তাদের বিশ্বাসে আর ভরসায় আমি আস্থা রাখতে পেরেছি।’
পাঠক, আপনি কি কোনও সংযোগ অনুভব করতে পারছেন এই মহৎ লাতিন লেখকের সঙ্গে? উত্তর হ্যাঁ ধরে নিয়ে চলুন, দ্বিতীয় পর্বে যাই!
২
‘জীবন গিয়েছে চলে…’, মৃত্যুই অমোঘ নিয়তি তবে! ‘কুড়ি কুড়ি বছরের পার…’, তবে কি আমাদের ভেতর অন্তর্গত মৃত্যু-স্পর্শ-কাতরতা বাজছে শঙ্খের মত?
জানি না। এত জিজ্ঞাসা আমাদের- এই জীবনের কাছে! সে তবু নিশ্চুপ। বোবা। এই যে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে… এই যে শমশেরনগর স্টেশনে এসে থেমেছে কুশিয়ারা এক্সপ্রেস ট্রেন আর এই যে শনিবার শেষরাতে, দিনরাত্রির সঙ্গমে জেগে থাকছে প্যারিস, এই যে আমাদের মনে পড়েছে খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধগুলোর কথা… যেন হাত বাড়ালেই ধরে ফেলা যাবে এমন নিঃস্পৃহ ভঙ্গি ডানায় এনে জানালার পাশেই বসে পড়েছে নগরের ক্লান্ত চিল। আমি কী করি এখন? মাঝে মাঝে তাদের পালক খসে পড়ে, দু-একটা। দূরে বহুদূরে খালি গলায় কেউ গাইতে থাকে–অমল ধবল পালে… কুশিয়ারা এক্সপ্রেস কি ভানুগাছ ছেড়ে শ্রীমঙ্গলের পথ ধরেছে? কে দেবে এই তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর? উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমি মেঘ দেখতে দেখতে স্টেশন থেকে স্টেশন (পড়ুন ‘ইস্টিশন’) পার হয়ে চলেছি- পল এলুয়ার, লুই আঁরাগ, ভলতেয়ার…যেন মেঘ নয়, একটি মাত্র কবিতার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন, ছিলাম অনন্তকাল, কিংবা মাত্র দু’টি লাইন। মাত্র দু’টি!
As silent as a mirror is believed
Realities plunge in silence by…
কুশিয়ারা এক্সপ্রেস শ্রীমঙ্গলে পৌঁছে গেছে? বৃষ্টিতে পড়ছে শমশেরনগরে? জেগে থাকছে বুলেভার ম্যাক্সিম গোর্কি…কী মানে দাঁড়াচ্ছে তাহলে এই জীবনের? সাইলেন্ট। মিরর। রিয়েলিটি। সাইলেন্স… সাইলেন্স…
কোনও কোনও রাত হয় প্রত্যাখ্যানের। সেসব রাতে বুকের ভেতর থেকে সাইলেন্স সাইলেন্স বলে চিৎকার করে ওঠেন কবি হার্ট ক্রেন–
Then, drop by caustic drop, a perfect cry…
আরও একজন- মাহমুদ দারবিশ! তার লেখার সঙ্গে থাকতে থাকতে কেটে গেল কত কত দিন। অনবরত কথোপকথন আমাদের। হ্যাঁ, এই মুহূর্তে তার দু’টি বই কাছে আছে-‘In the presence of absence’ এবং ‘Journal of an ordinary grif’; নিজের সঙ্গে সংলাপ, শব্দে-কথায়-নৈঃশব্দ্যে। হ্যাঁ, এ ছাড়া আমাদের আর কোথায় বেঁচে থাকা! ইমাজিনেশন। ম্যাজিক মাউন্টেন। শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা। পথে পথে ছড়িয়ে পড়া তাজা স্ট্রবেরির ঘ্রাণ। জিপসি মেলকিয়াদেস। মার্কেসের উপন্যাসের সেই অদ্ভুত লোকটা। আমরা পারি। সৃষ্টিতে। মাধবী ও ওয়ালপেপারের যেখানে সংলাপ। ‘বিজনের রক্তমাংস’। ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’। ‘অন্ধপৃথিবীর জানালাগুলি’। এইসব পাঠকৃতি, আমাদের মুখে মুখে। অসীম রায়ের ডায়েরি। দেবেশ রায়ের গল্প। ইলিয়াসের পা। রবীন্দ্রনাথ । বুদ্ধদেব বসু। ‘সাতটি তারা তিমির’। এই সমস্ত কিছু নিয়েই তো। সুন্দরে। পুনর্পাঠে। আমরা থাকি। আগুনপাখি। হিটলারের মাথায় নাৎসী হেলমেট।
জয় গোস্বামীর ‘রানাঘাট লোকাল’ ধারাবাহিক লেখার একটি পর্বের নাম ছিল ‘নৈঃশব্দ্যের সংলাপ’। মনে হলো, আসল কথাটি তো এই। মহাদেশের কথাকাররা শব্দে কথায় সংলাপে নীরবতাই তো ভাঙতে চাইছেন। গভীর এক নৈঃশব্দ্য চেতনার ভেতর দিয়েই তো আমাদের মর্ম ব্যথায় তাদের ভাবনাগুলোকে পৌঁছে দিতে চাইছেন।
‘কেন পড়েন?’-এই প্রশ্নে কোনও অদলবদল ঘটে কি, মনে-মননে-বোধে? অন্তর্গত রক্তে খেলা করে কিছু? কেন পাঠক বার বার বইয়ের কাছে ফিরে যায়? তার কোন অসুখের উপশম হয় বই পড়ে? বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য? সাহিত্য কি তাঁর স্মৃতির ভার বহন করে চলে? আজ যদি সাহিত্য বলে আর কিছুই না থাকে তখন কি মানুষ স্মৃতিহীন হয়ে পড়বে!?
সাহিত্যকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে কোনও একটি বইকে লেখকরা ‘স্মৃতি’ হিসেবে বর্ণনা করেন; এই স্মৃতি, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়; সাহিত্যের একটি সুতো বুনে চলে আত্মস্মৃতির জামা। তাহলে এই প্রশ্নটিও চলে আসে- সাহিত্যে মানুষ কি তাঁর ‘আত্ম’কেই খুঁজে? নিজেকেই পড়ে? পড়তে পড়তে নিজেকে ভেঙে আবার গড়েও নেয়? যে-মানুষ দিনে দিনে নিঃসঙ্গ থেকে আরও গভীরতর নিঃসঙ্গতায় ডুবে যাচ্ছে, চরম একাকীত্বে জীবন ভরে যাচ্ছে তাঁর, সাহিত্য কি তাঁর কাছে নির্জনতার কোনও চিকিৎসা পদ্ধতি? কিংবা যখন পেরুর নোবেলজয়ী লেখক মারিও বার্গাস ইয়োসা ‘আপনি কেন লিখেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে ‘প্যারিস রিভিউ’-কে বলেন- I write because I’m unhappy. I write because it’s a way of fighting unhappiness, তখন কি কোনও বেদনাবোধে আক্রান্ত হই আমরা? আত্মপ্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকবার কথা ভাবি?
‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ কিংবা ‘শতবছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসটির নাম শুনলেই মনে হয় -এই ‘নিঃসঙ্গতা’ শব্দটির মধ্যেই পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যেন দাঁড়িয়ে আছি; আর, এই একটি শব্দই যেন সম্পর্ক তৈরি করে দেয় মার্কেজের সঙ্গে আমাদের অর্থাৎ লেখকের সঙ্গে পাঠকের; তৈরি হয় নতুন নতুন পাঠকৃতি। সাহিত্য এমনই, সে ‘ইভান ইলিচের মৃত্যু’ই হোক কিংবা মেটামরফসিসের ‘গ্রেগর সামসা’ হোক, নতুন পাঠকৃতির জন্ম হবেই, নিরন্তর পঠনপাঠনের ভেতর দিয়ে; লেখকে-পাঠকে সম্পর্কের সূত্রও তৈরি হবে।
বোর্হেসের সেই গল্পটিও আমাদের জীবনে অমোঘ হয়ে ওঠে, ব্যাবিলনিয়ার বন্দি সম্রাটকে কোনও এক আরব্য সম্রাট এক অন্তহীন গোলকধাঁধায় মুক্ত করে দেন- দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমির মাঝখানে, যার কোনও দিকচিহ্ন নেই; উত্তর-দক্ষিণ ধারণারও বাইরে। চিরন্তন এক গোলকধাঁধায় পাঠকরা চিরদিনের জন্য পতিত হতে হয়। যে-গোলকধাঁধা সাম্রাজ্যের স্থপতিগণ তৈরি করেছিলেন যেখানে আরব্য সম্রাট পথ হারিয়েছিলেন, মরুভূমির গোলকধাঁধার কাছে মানুষের তৈরি গোলকধাঁধা কিছুই নয়।
লেখকরা নতুন অনুভূতি-অনুভব ও বাস্তবতার আবিষ্কারক, এই যেমন ‘চাঁদের অমাবশ্যা’। ‘লালসালু’ কিংবা ‘একটি তুলসি গাছের কাহিনি’র বাস্তবতাকে অতিক্রম করে পাঠক যখন আরও দূরগামী হতে চায়, লেখকের আরও বিশিষ্ট রচনা পড়তে আগ্রহী হয় আর নিজের অজান্তেই একদিন ‘চাঁদের অমাবস্যা’র পাঠে ঢুকে পড়ে তখন সে একই সঙ্গে যেন জটিল মনস্তাত্ত্বিক ঘোরলাগা জগতেও ঢুকে পড়ে। চরিত্রের টানাপড়েন কিংবা আন্তরজাগতিক জটিলতার ঘোরে পাঠকও যেন এক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে যান। পাঠকমাত্রই জানেন- কীভাবে একটি হত্যাকাণ্ডের অনুষঙ্গে লেখক বলে ফেলেন জীবনের পক্ষে অমোঘ কিছু কথা। উপন্যাসটি ওয়ালীউল্লাহ্ লেখেন ফ্রান্সের আল্পস পর্বত অঞ্চলের পাইন আর দেবদারু গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজ নামক এক ক্ষুদ্র গ্রামে বসে। আর পাঠক, বাংলাদেশের পটভূমিতে লেখা উপন্যাসটি পড়ছে হয়ত ইংল্যান্ডের কোনও গ্রামে চেরি, নাশপাতি, গোলাপ আর আঙুরলতার ছায়ায় বসে, তাঁর পাঠ-অভিজ্ঞতায় ঢুকে পড়ছে যথার্থ এক উপলব্ধি- ‘সত্যই সত্যকে আকর্ষণ করে’। সাহিত্যে দেশকালের সীমানা এভাবে ভেঙে পড়ে। তখন সাহিত্য এক মিথ, এক আশ্রয়, অন্তর্জগতের সঙ্গীত। আমরা হয়ত একজন মানুষকে দেখছি- যে পড়ছে। পাঠক। কিন্তু সে মানুষ তো গড়ে ওঠা, অর্থাৎ নির্মিত। তাঁর ভেতরে বহু মানুষের বাস। বহুল স্বরের এক দেবতা সে। সেই দেবতায় আমাদের শ্রদ্ধা।
অথবা সেই পাঠকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক কীরূপ হয়, যে-পাঠকের ভিতরে লেখক হওয়ার একটি বীজ লুকিয়ে থাকে!
লেখালেখিও শিল্পকর্ম, এক শিল্পমাধ্যম, যা মানুষকে অর্থাৎ তাঁর পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে। পাঠক তাঁর নিজের ভিতরে সেই শিল্পকর্মের রস টেনে নেয় মহাবৃক্ষের মত, তাতে জীবনের অর্থের কাছে মানুষ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়।
কিংবা- সে পাঠক যখন পুরদস্তুর এক লেখক, তখন? মার্কেজ যখন হেমিংওয়েকে পড়ছেন কিংবা বোর্হেস পড়ছেন জয়েসকে, তখন? লেখক যখন পাঠক, তিনি তখন শুধু যে আনন্দের জন্য সাহিত্য পড়বেন তা তো নয়, তিনি একাধারে একজন বোদ্ধা বিশ্লেষক এবং কঠোর সমালোচকও, সেই সঙ্গে তিনি খুঁজে নিচ্ছেন নিজের পথটিও। পাঠ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি নিজেকেও চিনতে পারছেন। এভাবে সাহিত্য এগিয়ে চলে। লেখক নিজের পথ স্পষ্ট করে দেখতে পান। যেখানে, সব কথা বলা হয়ে গেছে, সেখানে- তিনি কীভাবে নতুন ভঙ্গিতে বলবেন, এবার? মানুষ এভাবেই সাহিত্যে তাঁর নিজস্ব স্মৃতিকোষ নির্মাণ করে নেয়। নিজেকে সে ভবিষ্যতের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে! সাহিত্য তখন বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই। লেখা তাহলে কী? কেন এই লেখার এত বিশাল আয়োজন!
এজন্যই লেখককে যে-প্রশ্নটি যুগের পর যুগ ধরে করা হচ্ছে, আগামীতেও যতদিন লেখালেখি হবে, লেখাপত্র টিকে থাকবে, ততদিনে এই জিজ্ঞাসাটি আরও ধ্রুপদী হবে-
কেন লেখেন?
আর, পাঠকের জন্য- কেন পড়েন?
এইসব প্রশ্নের আশ্চর্য সব উত্তর পড়তে গিয়ে আমাদের একদিন মনে হয়েছিল একটা আর্কাইভ করে ফেলা যাক। ‘দ্য প্যারিস রিভিউ’য়ের ইন্টার্ভিউ আর্কাইভের মতো। যেখানে রক্ষিত থাকবে আপনার আমার শুনতে চাওয়া কিছু কথা, মহাদেশের কথকরা যা বলে গেছেন। আমরা চেয়েছিলাম–এইসব থাকুক, একটি বইয়ে, পাঠক আশ্রয় খুঁজে পাক প্রতিটি প্রশ্নে, প্রতিটি উত্তরে।
জীবনকে আমরা ভালবেসেছিলাম, জেনেছিলাম তার রঙটি সবুজ; ভেবেছিলাম জীবন এক ফুল…সে ফুলের পাশে কিছু শামুক, তার সঙ্গে পাতা, গন্ধ, ঘ্রাণ আর স্মৃতি; বৃদ্ধা ইভলিন আর তার কুকুর,– প্যারিস, গন্ধ আর ঘ্রাণ, স্মৃতি আর জীবনের, যে জীবন শরণার্থীর, উন্মুল সব মানুষের।
এই ছিল কয়েকঘণ্টা আগের খুব চেনা, আটপৌরে এক জীবন, ঠিক যেন স্টিল লাইফ। এর মাঝে হাতে এসেছে ‘জার্মান ডায়রি’জ ১৯৩৬-১৯৩৭’; ধূসর মলাটের ওপর সবুজরঙে লেখকের নামটি লেখা- স্যামুয়েল বেকেট!
জীবনের তখন কী হয়? দেখো জীবন, কতকিছু শিখিয়েছ তুমি…কত কত আশ্চর্য অনুভূতি! মনে হয় কী যেন… কোথায়, কোন দেশে এই এখন, হত্যাকাণ্ড ঘটছে! তারপর, মনে হয়, পিটার্সবার্গের কনসার্টে গান গাইছে ‘পোয়েটিক জাস্টিস’, কবি জয় হার্জো স্যাক্সোফোন বাজাতে বাজাতে গাইতে শুরু করেছেন ‘দ্য বার্ডস…’ এখনই জেগে উঠবে সমস্ত মানুষ! একটা বই হাতে নিলে কতকিছু হয়। কত ভাঙচুর। এই যে একটি ভয়ানক অভিনয় দৃশ্য-
শুয়োরের বাচ্চারা, সাবধান হবি, সা আ আ আ আ ব ধা আ আ আ আ আ ন…
ধুপধাপ আওয়াজ হয়। বাতাসে গোঙানি। চাপা। গন্ধ আসে। গন্ধ যায়। ভেঙে যাওয়া থেঁতলে যাওয়া এক কণ্ঠস্বর :
হরিদাস, হরিদাস… সাবধান হবি…
রাজা সাবধান করে দিয়েছেন। কেউ কারো মুখের দিকে তাকাবি না।
কেউ কারো মুখের ভাষা পড়বি না।
ঘেউ ঘেউ। দূরে। থেমে থেমে। ঘেউ ঘেউ।
বাতিগুলো নিভে যায়। আসলে, নিভে যেতে চায়…ঘুমন্ত মানুষের জেগে উঠবার সময় হয়ে যাচ্ছে!
পাশের জানালা দিয়ে প্যারিসের রাতের আকাশ দেখি। মেঘ করেছে। রাস্তায় যুবক-যুবতীরা, চুম্বনরত। সেপ্টেম্বরে, হঠাৎ ঠাণ্ডা নেমেছে। হাসান আজিজুল হককে মনে পড়ে, তাঁর গল্পকে : এখন নির্দয় শীতকাল। ঠাণ্ডা নামছে হিম… এইসব। খোলা জানালার কারণে ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ ভয়ানকরকম টের পাওয়া গেল। মনে হচ্ছে গান গাইছে পৃথিবীর সমস্ত স্ট্রিটলাইট- ওলমৌস্ট হ্যাভেন… লাইফ ইজ ওল্ড দেয়ার… কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ… ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া…
বুকটা হু হু করে উঠে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া! ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ আর ‘ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া’ আমাদের কোথায় নিয়ে যায়? ছোট বোনটির কাছে? মায়ের কাছে? শমসেরনগরে? জানালা খোলাই থাকে। কোরাস ঢুকে পড়ে বুলেভার ম্যাক্সিম গোর্কির এক কুঠরিতে।
আত্মজা ও একটি করবী গাছের ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে আর খোলা জানালায় আকাশ! মনের ভিতর কোরাস- কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ… ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া; যেন শমসেরনগর থেকে হেঁটে হেঁটে চলে গেছি কোনও এক অচেনা ইস্টিশনে! কেবল, ছাদের ওপর বসে থাকবে একজন- ফিডলার। রাতের ক্রমশ শেষ হওয়া দেখে দেখে ভায়োলিন বাজাবে সে। ছাদের ওপর ফিডলার। নিঃসঙ্গতা! আহা, নিঃসঙ্গতা! গন্ধ ও ঘ্রাণ; স্মৃতি ও জীবন! বাবার খুব প্রিয় ছিল সূর্যমুখী ফুল। তার মৃত্যুর পর, ফুলগুলি কোথায় ফোটে? ভোরে, মা যখন বাবার কবরের দিকে তাকান, আমার স্থির বিশ্বাস সূর্যমুখী ফুলগুলি তখন তার বুকের ভিতর ফুটতে থাকে।
ওলমৌস্ট হ্যাভেন… লাইফ ইজ ওল্ড দেয়ার… কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ… ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া…
শুয়োরের বাচ্চারা, সাবধান হবি, সা আ আ আ আ ব ধা আ আ আ আ আ ন… নতুন দিনের খবরের কাগজের শিরোনাম– স্টপ দিজ ম্যাডনেস! … আর, শিশুদের লাশ। বাবার সূর্যমুখী ফুল মায়ের বুকে ফুটছে! ভোর হচ্ছে প্যারিসে, রোমে, হ্যাম্পশায়ারে, শমসেরনগরে, ভেনিসে, লন্ডনে। ছাদের ওপর ফিডলার। ভায়োলিন বাজাচ্ছে। তখন, আলবেয়ার কামু তাঁর নোটবুকে লিখছেন- ‘আমি অস্তিত্বের অভিঘাতের দিকে অগ্রসর হতে অস্বীকার করি না, কিন্তু আমি এমন কোনও যাত্রাপথও আকাঙ্ক্ষা করি না, যা মানুষ থেকে দূরে সরে গেছে। আমরা কি আমাদের তীব্রতম অনুভূতিগুলোর শেষে ঈশ্বরকে খুঁজে পাব?’
আজ শরীর কাঁপছে স্মৃতি ও কথার অভিঘাতে। কিছু কথা এখনি পড়তে হবে। দ্রুত খুঁজে বের করলাম ভার্জিনিয়া উলফের উপন্যাস। পড়তে লাগলাম শেষপৃষ্ঠার কিছু কথা, আজকের এই অস্থির সময়ে-
Quickly, as if she were recalled by something over there, she turned to her canvas. There it was — her picture. Yes, with all its green and blues, its lines running up and across, its attempt at something. it would be hung in the attics, she though; it would be destroyed. But what did that matter? she asked herself, taking up her brush again. She looked at the steps; they were empty; she looked at her canvas; it was blurred. With a sudden intensity, as if she saw it clear for a second, she drew a line there, in the centre. It was done; it was finished. Yes, she thought, laying down her brush in extreme fatigue…
রাত শেষ হচ্ছে। বুলেভার ম্যাক্সিম গোর্কির রাত! এখনই, ঘুমিয়ে পড়বার আগে, আমাদের আরও কিছু অমৃতকথা পড়ে ফেলতে হবে। হে সময়। হে অধিরাজ। হে বাতিঘর। সময়ের যে তীব্র স্রোত বয়ে যাচ্ছে আমাদের ওপর দিয়ে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসের এই কথাটির মুখোমুখি হলে আমরাও যেন বহু কিছু আবিষ্কার করি- ‘জীবনের রহস্যময় গলিঘুপচি’। আমরাই যেন এক একটি উপন্যাস। আমরাই কথা বলছি পরস্পরের সঙ্গে। বড় লেখকরা বড় অনুভবের দিকে আমাদের নিয়ে চলেন। আমরা তো সারথি।
৩
কী হয় পাঠে? হয়তো, কথায় কথায়, শব্দে-বাক্যে-গন্ধে পাঠকের সঙ্গে লেখকের এক সংযোগও তৈরি হয়, ব্যক্তিজীবন আর অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞাই তো প্রকাশ পায় কথা রূপে। এই যে নতুন এক সংযোগ, আমরা তো এভাবেও, ভাষার সীমান্ত পেরিয়ে লেখকের কাছে পৌঁছই, এ এক আশ্রয় আমাদের- পাঠকের, লেখকের; আর এভাবেই হয়তো পৌঁছেও যাওয়া যায় এক সমগ্রতার কাছে, যেখানে শতবছরের নিঃসঙ্গতা কেটে যায় আত্মার চিৎকারে।
Emdad Rahman is a storyteller, translator and associated with editing Wavemag Galpapath. Higher studies on politics and public administration at Shahjalal University of Science and Technology. He worked in newspapers and also Non-governmental organization. First published book – Patalvumi o onyanyo galpa (Innerland and other stories, 2014). Currently living in Paris.