শব্দকে ভাঙাগড়া করা, নতুন শব্দ তৈরি করা আমার কাছে নেশার মতো

Share this:

প্রশ্নোত্তর:

শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বা বোধের ব্যাপারটা প্রথম কীভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?

আনিফ রুবেদ:  আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। শীতকালের ভোরগুলোতে মাদুর বিছিয়ে পড়তে বসতাম বাড়ির বাইরে একটাফাঁকা মতো জায়গায়। সেখানে টমেটো, বেগুন, পালং, টকপালং, মরিচ লাগাতেন আমার দাদা। দাদার সাথে সাথে আমিও সেগুলোতে পানি ঢেলে দিতাম কখনো কখনো। তেমনই এক শীতের সকালে পড়তে বসে রুলটানা খাতাতে লিখে ফেলি আমার জীবনের প্রথম লেখাটা। একটা ছড়া। আট লাইন। লেখার পর বহুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম নিজেই। নিজের কাজে নিজেরই বিস্ময়। বিস্মিতি কাটছিল না বহুক্ষণ। তারপর থেকে নেশা ধরে গেল। শীতকাল নিয়ে, ঘোড়া দেখলে ঘোড়া নিয়ে, পায়রা দেখলে পায়রা নিয়ে, পাখা দেখলে পাখা নিয়ে; যা দেখি তাই নিয়ে ছড়া লিখতে শুরু করি। আমার বাবাকে, মাকে, খালাকে, বন্ধুদেরকে দেখাই। বাবা তো বিশ্বাস করতেই চান না, এগুলো আমি দেখেছি। তিনি বলে দেন, গ্রীষ্মকাল নিয়ে একটা লিখ্ তো দেখি। আমি লিখি। তিনি বলেন, গাছ নিয়ে লিখ্ তো দেখি। আমি লিখি। আজিব এ খেলা।

আমি ছবির মতো এখনো দেখতে পাই সেদিনের সেই মাদুরাসনে বসা আমাকে। বলপয়েন্ট। রুল টানা খাতা। প্রথম লেখা। আমি এখনো ভেবে বের করার চেষ্টা করি, কেন হঠাৎ করে লিখেছিলাম? উত্তর পাই না। ছন্দ কবিতা কিভাবে আমার শিশুমনে কিভাবে কাজ করেছিল তার একটা চিত্র তৈরি করার চেষ্টা করি এই এখন পর্যন্ত। সেই চিত্রে ভেসে ওঠে আমার দাদার মুখ। তিনিই আমাকে অক্ষর শিখিয়েছিলেন, পড়তে শিখিয়েছিলেন এবং নিয়মিত পড়তে বসাতেন। হাটে বাজারে নিয়ে যেতেন। হাটে গিয়ে গজা বাতাসা চানাচুর কিনে দিতেন। আমি তার সাথেই ঘুমাতাম। তার সাথে ঘুমিয়েছিলাম যেদিন রাতে তিনি মারা যান সেই রাতেও। মরণের রাতের ভোররাতে তিনি আমাকে ঘুম থেকে জাগালেন।আমি জাগলাম। বললেন, তোর মাকে ডাক, আমি চলে যাব মনে হয়। আমি মাকে ডেকে আনলাম। তিনি আমার মায়ের হাত ধরে, আমার হাত ধরে থাকলেন কিছুক্ষণ। তার চোখ দিয়ে কয়েকফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তার চোখ থেকে বের হওয়া অশ্রুর গড়ানো তখনো শেষ হয়নি; তিনি চলে গেলেন। তখন তার বয়স একশ বছরেরও বেশি। এবং তারও দুবছর আগে আমার বাবা মারা গেছেন।

প্রসংগের বাইরে চলে গেলাম। এখানে এসে আমার এমনটা হয়ে যায়। যা হোক প্রসঙ্গে ফিরি। দাদার সাথে ঘুমাতাম আমি আর ভোর রাতে দাদা বিছানাতেই বসে বসে নামাজ পড়তেন। আমি এক কোণে ঘুমাতাম। নামাজ পড়া শেষে যখন তিনি মোনাজাত করতেন তখন আমার ঘুম ভেঙে যেত। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম তার মোনাজাত। কবিতার মতো ছিল তার মোনাজাত। দারুণ ছন্দ আর তার আবৃত্তি। তার কিছু কিছু এখনো মনে আছে আমার, যেমন, ওহে আল্লা বারিকালা, তুমি নিরাকার/ আখিরাতে যত কিছু সকলই তোমার। আমি ধারণা করি, তার শেষ রাতের এই মোনাজাতের ছন্দ আমার ভেতর কাজ করেছিল আমার ভেতর। আরো কিছু ব্যাপার ছিল, আমাদের বাড়িতে প্রায়ই সংগীতের আসর বসত রাতে। স্থানিয় গানের স্কুলের ছাত্র আর শিক্ষকগণ এসে গান করতেন। বাড়ির বাইরের আঙিনায় বসত আলকাপ আর গম্ভিরার আসর। আর ক্লাসের বাংলা বইটা ছিল আমার সবচে প্রিয় বই।

উল্লেখ করা যেতে পারে, আমার লেখা প্রথম কবিতাটি এবং প্রথম প্রকাশিত কবিতাটি এই বছরে বের হওয়া ‘শরীরীয়ত শরীরীয়া’ বইতে আছে।

 

শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষাশৈলীর বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে শুনতে আগ্রহী।

আনিফ রুবেদ:  আমার ব্যাপারে ভেবে রেখেছি, আমি আগে দেখক তারপর লেখক। আমি একধরনের বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টি নিয়ে চারদিকে দৃষ্টিপাত করি।দেখার সাথে সাথে লেখার তাড়না বোধ করি। মনে মনে লিখতেও থাকি হাটে মাঠে ঘাটে। পরে খাতাতে লিখি। মনে মনে যা লিখেছিলাম তা খাতাতে লিখতে পারি না যদিও।

সমসাময়িক বা রাজনৈতিক বা সামাজিক বা প্রাকৃতিক ঘটনার যে দৃশ্যই দেখি সে দৃশ্য বা ঘটনা দেখার পর সেই দৃশ্য বা ঘটনার কারণ খুঁজেবের করার চেষ্টা করি আমি। এমন ঘটনা বা এমন ধরনের ঘটনা পূর্বে ঘটেছে কিনা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। ফলে ঘটনাকেন্দ্রিক একটাগভীর ইতিহাস চেতনা আমার ভেতর কাজ করে। এসব ঘটনার যখন ইতিহাস খুঁজে পাই তখনও থামি না আমি। তখন আবার অনুসন্ধানকরার ইচ্ছে জাগে মানব জীবনে এসব ঘটনা যে বারবার ঘটে যাচ্ছে তাতে ব্যক্তি মানুষের বা মানুষসমগ্রের চেতনাজগতের ঠিক কোন কোন জায়গাগুলো ক্রিয়া করে তা চিহ্নিত করার চেষ্টা করি। এবং আমি খেয়াল করে দেখেছি জগতের প্রায় সকল ঘটনায় যা ঘটছে এবং ঘটবে তা বহুপূর্বেও ঘটে গেছে। ফলে কোনো ঘটনাকেই আমার সমসাময়িক বা অতীত বলে মনে হয় না, তা রাজনৈতিক হোক আর সামাজিক হোক বা প্রাকৃতিক হোক।

ধরা যাক, এখন বৈশ্বিক করোনা মহামারি চলছে। করোনা কতৃক মহামারি এর আগে ঘটেনি কিন্তু জীবাণু কতৃক মহামারি পূর্বেও পৃথিবী বহুবার দেখেছে। ফলে আমার দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মহামারি সময় মানুষ মানুষের জন্য কি করছে, মানুষ নিজের জন্য কি করছে, কতটুকু স্বার্থত্যাগ করছে বা সুযোগ হিসেবে নিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।

অথবা, ধরা যাক, রাজনীতিক নিপীড়নের কথা। ঠিক এই সময়ে যে ধরনের পীড়ন ঘটছে তা বহুকাল পূর্বের রাজাগজাদের পীড়নের সাথে ফারাক আছে কিনা। বা ঠিক এই সময়ে রাজনীতি সাধারণ মানুষকে যেসব সুবিধা দিচ্ছে তা তার পূর্বেও ছিল কিনা। আমি খেয়াল করে দেখি, পীড়ন করা বা সুবিধা দেবার ক্ষেত্রে অঙ্গগত, ইনস্ট্রুমেন্টগত প্রভূত পার্থক্য থাকলেও মনের ভেতরের কারণগুলো ঐ প্রাচীনকালের মতোই রয়ে গেছে।

অথবা, ধরা যাক, সামাজিক অপরাধগুলোর কথা। খুন, পিটাপিটি, ঘুষ, ধর্ষণ, অপমান। এগুলো বহুকাল আগের বহু উদাহরণের সাথে একেবারে মিলে যায়। সংখ্যার তারতম্য আছে অনুপাতের তারতম্য নাই। পদ্ধতির তারতম্য আছে কারণের পার্থক্য নাই। গলাটিপে মারার জায়গায় লাঠি এসেছে, লাঠির জায়গায় ছুরি এসেছে, ছুরির জায়গায় এসেছে বন্দুক। কিন্তু খুন তো খুনই। ধর্ষণ তো ধর্ষণই। অপমান তো অপমানই।

আমার লেখাতে সমসাময়িকতা আছে, রাজনীতিকতা আছে এবং আছে এর সাথে মানুষের মনের মূল; যে মূল দিয়ে রস আহরণ করে মানুষ নিজেকে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করে আলাদা হয়ে গেছে সেই মূলের সাথে মিলিয়ে দেখার প্রবণতা।

প্রত্যেকটা মানুষ, প্রত্যেকটা মানুষের দেখার ভঙ্গি আর তার প্রকাশভঙ্গি সহজাতভাবেই আলাদা ফলে তার ভাষাশৈলিও নিজস্ব হতে বাধ্য বলে আমি মনে করি। আমাকেও এর ব্যতিক্রম হিসেবে দেখি না। কোনো ক্ষেত্রে কোনো ভঙ্গিমা যদি কারো সাথে মিলেও যায় তবুও খুব খারাপ কিছু আমার কাছে মনে হয় না। কারণ ঐ একই; প্রত্যেকটা মানুষ যেমন একেবারে আলাদা ঠিক তেমন ভাবেই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের সাথে প্রত্যেকটা মানুষের সাধারণ কিছু মিলও আছে; জৈবিকভাবে এবং মানসিকভাবেও।

আমার রচনাশৈলির ক্ষেত্রে শব্দ আর দর্শন একটা বড়ো ভূমিকা পালন করে। শব্দকে ভাঙাগড়া করা, নতুন শব্দ তৈরি করা আমার কাছে নেশার মতো। ফলে বাক্য অনেকসময় কিছুটা বেঁকেচুরে যায়। কোনোকিছু লেখার পর, এসব বাঁকাচোরা বাক্যকে ঠিক করতে আমার বহুসময় যায়। এতে আনন্দই পাই আমি।

 

শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

আনিফ রুবেদ:  সকল ক্ষেত্রেই শ্লীল এবং অশ্লীল ব্যাপারটা আমি ধর্তব্যের মধ্যে নিই; যদিও জানি ব্যাপারটা খুবই আপেক্ষিক। কবিতার ক্ষেত্রেও আমি শ্লীল এবং অশ্লীলতার গ্রহণ বর্জন করি নিজের মাপকাঠিতেই। যৌনতা মানেই অশ্লীলতা নয়। বরং যৌনতা কতটুকু শৈল্পিকতা এবং সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হচ্ছে সেটাই বড়ো কথা। সাহসিকতার নামে রগরগে বর্ণনার কবিতা দেখতে পাই অনেকসময়। আমি চাই না কবির পেন পেনিস হয়ে উঠুক। আমি চাই কবির পেইন তার পেন হয়ে উঠুক; কবিতা হয়ে উঠুক।

 

শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আাপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যে-কোনো সময় ধরে হতে পারে,আপনার যেমন ইচ্ছে।

আনিফ রুবেদ:  আমি মনে করি কবিতা বা শিল্প-সাহিত্যের যে কোনো শাখার প্রাথমিক কাজটা একান্তই ব্যক্তিগত। নিজস্ব চিন্তা চেতনা থেকেই প্রতিটা কবিতা বা শিল্পের যেকোনো কিছু জন্ম নেয় তারপর ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ভেতর। কবিতা মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা অনেকটা ব্যাপক প্রক্রিয়ার মতো। খুব ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবীর মানুষের কাছেই পৌঁছাতে চায়। একটা কবিতার এসেন্স যতটুকু থাকে ততটুকু ব্যাপিতহতে পারে তারপর থেমে যায়।

একজন কবি যেকোনো দেশে বাস করতে পারে কিন্তু তার প্রেমের বা বিরহের অন্যান্য সুখ-দুঃখ বা সৌন্দর্য-কদর্য উপভোগের বিষয়গুলো একইথাকে। এবং আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা করি তবে দেখতে পাব, ভাষা প্রয়োগ বা বাক্য প্রয়োগ খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার।

ফলে আমি যখন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, জয় গোস্বামী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ি তখন তাঁদেরকে পড়ি একজন ব্যক্তি হিসেবেই।

পরবর্তীকালেরও বাংলাদেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের কবি যারা আমার সমসাময়িক বা কিছু আগে পরের; তাঁদের প্রচুর কবিতা পাঠ করার সুযোগ হয়েছে দশক ভিত্তিক বিভিন্ন সংকলনে। কিন্তু যখনই কারো কবিতা পড়েছি তখন একজন কবির কবিতা হিসেবেই পাঠ করেছি। সামষ্টিক বিচারে পাঠ করিনি। টোটাল বাংলাদেশের কবিতা এবং পশ্চিমবঙ্গের কবিতার তুলনা তৈরির কোনো মনোভাব আমার মনে তৈরি হয়নি। হয়ত মোটা দাগে কিছু পার্থক্য বা সাজুয্য বের করা সম্ভব। কিন্তু আমার পাঠের অভ্যাস এবং পদ্ধতির কারণেই এমন মূল্যায়নধর্মী বিশ্লেষণ ক্রিয়া করেনি। ফলে এমন মূল্যায়ন এবং বিশ্লেষণ থেকে বিরত রইলাম।

 

শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।

আনিফ রুবেদ:  আমি পাঠক হিসেবে কিছুটা অগোছাল ধরণের। একই সময়ে দুটা বই পড়ি আমি। একটা পড়ি বসে আর একটা চলতে চলতে।চলতে চলতে মানে পথে ঘাটে বাজারে। আমি যখন যেখানেই থাকি বেশিরভাগ সময়ই একটা বই আমার হাতে থাকে। ফলে যানবহনে বা চায়ের স্টলে চা খেতে খেতে বা কারো জন্য অপেক্ষা করার সময়টুকুতে সেই বইটা পাঠ করি।

আমি বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের রাজাদের আচার আচরণ কেমন ছিল সেই ব্যাপারটা জানার চেষ্টা করছি। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত যুদ্ধগুলোর কারণ, নির্মমতা এবং ফলাফল জানার চেষ্টা করছি। জানার চেষ্টা করছি পুরাতন পৃথিবী থেকে বর্তমান পৃথিবীর রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধানদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, তাদের বিলাসব্যসনের জন্য সাধারণ মানুষের উপর তাদের অত্যাচারের ধরন, পদ্ধতি, মাত্রা জানার চেষ্টা করছি। জানার চেষ্টা করছি প্রাচীন পৃথিবীর রাজা বাদশাদের জীবনি। এই পাঠ উদ্দেশ্যের সর্বশেষ পাঠপরিক্রমায় আমার হাতে আছে এখন চেঙ্গিজ খানের উপর লেখা ভাসিলি ইয়ানের একটা বই।

অগোছাল পাঠস্বভাবের পরেও এই এই পরিকল্পিত পাঠের কারণ একটা আছে। কারণটা কোনো একসময় বলব; এখন না।

এসব পাঠের ফাঁকে ফাঁকে পাঠ করছি বর্তমান সময়ের কবিদের কবিতার বই, গল্পকারদের গল্পের বই।

 

 

কবিতা: 

আমাদের জীবনের যোগফলের লালবাতি

১.

পৃথিবীর বিরাট মুখ।

হা করে মুখটা আর বন্ধ করল না,

সবাই ঢুকে যাচ্ছে এই বিরাট ‘হা’ এর ভেতর।

আহা! প্রাণে নেমেছে বাতাসের নামতা, আয়ুর নামতা, স্বাধীনতার নামতা।

বাতাস ভালো নেই, আয়ূ ভালো নেই, স্বাধীনতা ভালো নেই যন্ত্রণার জাঁতায়।

আর কী কী জিজ্ঞাসা বুনে দিলে এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে না?

লাল আলো, সবুজ আলো, অন্ধকার আলো জীবনের হাঁটাচলার গহিনেই গুছিয়ে রাখতে চাই।

যদি একটা ফুলের বাগান করা যায়, নাকফুল বিক্রি করে সোনার টিয়ে কেনা যায়।

 

২.

জীবন একটা আমরা পেয়েছি, পৃথিবীরই এই এক সময়ের গর্তে।

কিন্তু এই কি জীবন? এই কি একটা জীবনের মতো জীবন, যে জীবনের ভেতর দিনরাত চরিতেছে লাল তেলাপোকার আয়ু?

রক্তচাপ আর বিরক্তচাপ আর শক্তচাপ ঘেরা স্নায়ু।

স্নায়ুচাপ ঘেরা ক্লান্তকায় আয়ূ।

আমি রজনীগন্ধার আত্মা ছুঁয়ে দেখার আর বকুলের আত্মা ছুঁয়ে দেখার যে কথা বলতে চেয়েছিলাম তা তোমার মনে আছে হয়ত।

ঝগড়া করার বয়স পার হয়ে গেলেও,

দিন রাত আলো জ্বলে উঠলেও,

তেমন আর ফল নাই জীবনের এঁটো রস খেয়ে।

কেন যে দেখা হয়ে যায় একজনের সাথে আর একজনের?

আবার দেখা হয়ে যায় হঠাৎ বহুদিন পর তখন মনে পড়ে যায় –

হৃদয়ের ভেতর দিয়ে নিশ্চয়ই একদিন সাপ হেঁটে গেছিল পুর্ণকলার দিকে।

আমি তোমাকে আর কখনো ‘স্বাধীন মানুষ’ অপবাদে দণ্ডিত করব না।

এসো মানুষ, কিছু খাবার খাও

আর কিছুটা শান্ত হলে মন, হৃথিবীরঙের পোশাক পরে নিও।

বহুমাইল হেঁটে যেতে হবে। সকাল সকাল সূর্যটা ধরতে পারলেই হয়।

তুমি বললে – ‘সবাই যাচ্ছে স্বর্ণনগরের ট্রেন ধরতে আর তুমি কিনা সূর্যের মধু পান করতে চাও।’

তা হোক।

আমি ভুলিনি সেই ড্রেন, সেই ডিসেম্বর, সেই আগুন, সেই কবরের মন

আর আমাদের জীবনের যোগফলের লালবাতি।

 

৩.

মানুষ, তুমি কেমন আছ? তুমি কেমন থাকতে চাও?

তুমি যেমন আছ তেমন যদি থাকতে চাইতে তা থাকতে পারতে না।

যেমনভাবে – তুমি যেমন থাকতে চাও তেমন থাকতে পারছ না।

হাসপাতালের বেডে যেদিন ধান বোনার স্বপ্ন দেখেছিল কৃষক

আর তাদের বুকগুলি গুলি খেয়েছিল ইউরিয়া সারের বস্তা হাতে পাবার আগে

তখন কিন্তু তুমি কান্না থামাতে পারনি।

আমি বলেছিলাম – ‘মানুষদের স্বপ্ন দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এখানে, স্বপ্নের মূর্তি তৈরি হবে না কখনোই।’

ঈশ্বর যদি ক্যাপসুল আর ট্যাবলেট বোনার ক্ষমতা দিত, ওষুধ চাষ করতে তোমাদের আঙ্গিনায় কৃষকের মতো আর তোমার মাথায় মাথালদেখে হাসতে হতো আমাকে।

কলমকমল শুধু ফুটে থাকছে যন্ত্রণার ঝিলে।

জাম রস দিয়ে, কমলা রস দিয়ে, যেকোনো ফলের রস দিয়ে, যতই তুমি কালি বানিয়ে দাও আমাকে, তা দিয়ে আর লিখব না একবিন্দুও।

মানুষের ঘর পুড়ছে বোমায় বোমায়,

মুখ পুড়ছে এসিডে এসিডে,

বুক ফুটো হয়ে রক্ত ঝরছে, আমি কালি নেব সেখান থেকে।

আর অপ্রাপ্ত বয়স্ক শ্মশানগুলো থেকে সংগৃহীত বস্ত্রতে লিখতে চাই

তোমার নাম,

আমার নাম,

পৃথিবীর নাম,

ধর্ম গ্রন্থের নাম,

নেতাদের নাম,

সমস্ত কিছুর নাম,

সমস্ত অকিছুর নাম,

সমস্ত বিচ্ছুর নাম।

 

৪.

‘যন্ত্রণার দিন পার হয়ে যাবে কোনো একদিন’ একথা আমি স্বীকার করব না।

এ কথা চলে আসছে শুরুর কাল থেকে, চলবে অন্তহীন…

যতদিন না প্রাণাপ্রাণীর খেলা শেষ না হবে।

পাখি সব উড়ে গেলে তাদের বাসায় যেসব ডিম থেকে যায়

আর বাতাসেরা সেসব ডিমের গায়ে অক্সিজেন মাখিয়ে দিয়ে সরে পড়ে,

তা কেউ দেখতে পায় না।

এই যে বাতাসের অক্সিজেন মেশানের ষড়যন্ত্র,

এটা প্রতিহত করবে কে অক্সিজেনহীন এই পৃথিবীতে?

অক্সিজেন অভ্যাস্ত করানোর এই ষড়যন্ত্র বাতাসের না থাকলে মানুষেরা বাঁচত, মানুষেরা বেঁচে থাকত হৃথিবীর ভেতর।

ষড়যন্ত্র প্রতিহত হলে মানুষেরা বেঁচে থাকবে হৃথিবীর ভেতর।

 

৫.

আমেরিকার চেয়ে,

বৃটেনের চেয়ে,

রাশিয়ার চেয়ে,

যেকোনো শক্তিধরের চেয়ে

আমি তোমার ওপরেই বেশি রাগতে পছন্দ করি।

তোমার কাণ্ডজ্ঞান! বলিহারি!

‘জিতেন কাকার রক্ত লাগবে’ বলতেই তুমি এক মগ জামের রস এনে হাজির করলে।

তোমার এ কাণ্ড দেখে বুকের ভেতর মধু চরে – ‘আহা, আমার মানুষেরা যদি ঈশ্বর হতেন এই পৃথিবীর তবে কত সুবিধাই না হতো। জামরসশরীরে নিয়ে বেঁচে যেত সব রক্তক্ষরা, রক্তঝরা মানুষ।’

সেদিন তো রাত পোহায়নি,

তবু তুমি ডাক দিলে এক মহান নেতার কণ্ঠস্বরে –

‘উঠরে পাখিরা, সকাল করে দে।’

পাখি কি আর তেমন করে আছে যে, সকাল করে দেবে যখন তখন।

কিছুদিন পর আর সকালই হবে না এই পৃথিবীতে।

পাখির মাংস প্রিয় হয়েছে মানুষের, পাখির ডাক আর প্রিয় হয়ে নাই।

বৃক্ষের ওপর ক্রোধ হয়েছে মানুষের।

বৃক্ষ খুঁজতে যেতে হবে বৃক্ষ যাদুঘরে।

পারবে এতটা পথ হাটতে?

‘পারব না’ বলে ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে চলে গেলে হবে না।

 

৬.

‘তোমার প্রিয়কাজ কী?’

একথা সে পুরুষ জিজ্ঞাসা করতেই

কিছু না বুঝেই সে নারী বলে দিল – ‘চুম্বন করা, তোমাকে চুম্বন করা। তোমার প্রিয় কাজ কী?’

এই প্রশ্ন সে নারীর মুখ থেকে সমাপ্ত হবার সাথে সাথেই সে নারীর স্তনের দিকে, বেণীর দিকে, যোনির দিকে চোখ চলে গেছে সে পুরুষের।

আর কিছু না বুঝেই উত্তর করেছে – ‘চুম্বন করা, তোমাকে চুম্বন করা।’

আর কোনোদিন আমরা প্রিয়কাজ করব না।

ইরাকের রাস্তায় মৃত চুম্বন পড়ে আছে।

আফগানিস্তানের রাস্তায় মৃত চুম্বন পড়ে আছে।

আফ্রিকা আর এশিয়ার রাস্তায় মৃত চুম্বন পড়ে আছে।

সমগ্র পৃথিবীর পথে পথে পড়ে আছে মৃত চুম্বন।

এসো, সেসব চুম্বন কুড়িয়ে কুড়িয়ে কবর দিই। চুম্বনের কবর।

আমরা আর কোনোদিন চুম্বন বনে যাব না,

জন্ম দেব না চুম্বনের, জন্ম দেব না আর কোনো সন্তানের।

 

৭.

থেকে থেকে বলে উঠছ – ‘জ্বলছে!’

‘কী জ্বলছে মানুষ?’

প্রশ্ন করলে আর উত্তর দাও না।

তোমার বুক জ্বলছে? বুকের ভেতর?

বুকের ভেতরের ভেতর?

বুকের ভেতরের ভেতরের ভেতর?

বুকের ভেতরের ভেতরের ভেতরের ভেতর জ্বলছে?

কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, শুধু বলে উঠছ – ‘জ্বলছে!’

সময়ের গানে আগুন লেগে গেছে।

থাক, আর বলব না কোনো ক্রোধের কথা।

থাক, আর প্রশ্ন করব না কোনো।

হাঁটব ওদিকে, ঐদিকে, ঐদিকেরও ঐদিকে, হৃথিবীর দিকে।

এসো, গরম রাতটাকে জুড়োতে দিই।

More Posts From this Author:

    None Found

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!