ধারাবাহিক উপন্যাস
রেহানা,এই লোক তোমার চাচা তাই না?
অঞ্জলী চোখে অনেকটা ভীতি নিয়ে জায়েদের দিকে তাকায়। জায়েদের কণ্ঠটা ওর কানে কেমন খসখসে শোনায়। ও বুঝতে পারে না, ওর এই দুঃসময়ে জায়েদের কণ্ঠে ওর জন্য এতটুকু সমবেদনাও নেই কেন? অঞ্জলী অস্ফুটস্বরে কিছু বলতে বলতে মাথা দোলায়।
তোমার চাচার কিন্তু উচিত শাস্তিটুকু হতে হতে হলো না রেহানা। জায়েদের কণ্ঠে কি হতাশা?
জায়েদের বাড়িতে, মানে শ্বশুরবাড়িতে অঞ্জলীকে কেউ ওর ডাক নামে ডাকে না,সবাই ওর ভালো নাম- দাদির দেওয়া নাম ‘রেহানা’ বলে ডাকে। প্রথম প্রথম অঞ্জলী ভাবত, জায়েদের হয়ত ওর ‘রেহানা’ নামটি ভালো লাগে তাই সে নামে ডাকে আর জায়েদের দেখাদেখি ওর পরিবরের অন্যান্য সবাইও হয়ত সে নামে সম্বোধন করে। পরে ও জেনেছে,‘অঞ্জলী’ নামটিতে বিধর্মী ভাব রয়েছে যা এই পরিবারের পছন্দ নয় তাই ওকে ‘রেহানা’ নামে ডাকা হয়। প্রথম প্রথম ‘অঞ্জলী’ নামে জায়েদ ওকে ডাকে না বলে মন একটু খারাপ হলেও এখন আর হয় না। ও জানে, বিয়ের পর মেয়েদের অনেক কিছু বদলে যায় বা বদলাতে হয়।এই অদল-বদলের শাফলিঙে এক সময় মেয়েদের অরিজিনটাই হারিয়ে যায়। সে যত বড়ো পড়ালেখা জানা পণ্ডিত নারী হোক না কেন!
এই মুহূর্তে অঞ্জলী এত কিছু ভাবছিল না, সে কেবল অবাক বিস্ময়ে জায়েদের দিকে তাকায়। মাত্র খবর পেয়েছে ও;ছোট চাচা আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে,এই সময় জায়েদ এসব কী বলছে! জায়েদ অঞ্জলীর অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নেয়, বলে; আসলে রেহানা, চাচার কী দরকার ছিল এসব আজে বাজে কাজে নিজেকে জড়ানোর? উনার কি উচিত ছিল না ফ্যামিলির অন্য সবার কথা ভাবা? আত্মীয়-স্বজনদের কথা ভাবা? উনি তো আর একা না, উনার এসব কর্মকাণ্ডের জন্য এখন পুরো ফ্যামিলিকে ভুগতে হবে, বুঝতে পারছ? সবার ফ্যামিলি’র কাছে একটা দায়বদ্ধতা থাকে, উনি তো আর সেসব কিছুর উর্ধ্বে নন।
আমি কি চাচ্চুকে দেখতে যেতে পারব না?
অঞ্জলীর কথায় জায়েদ কথার মাঝে আটকে যায়। জোর করে ঠোঁটে একটি শুকনা হাসি টেনে বলে, কেন যাবে না? অবশ্যই যাবা। কিন্তু ভেবে দেখো, চাচাকে দেখতে যেয়ে আমরা নিজেরা না আবার ফেঁসে যাই।
আমার তো চাচ্চু। আমি একাই যাই তাহলে? অঞ্জলী দ্বিধার কণ্ঠে জানতে চায়।
না চলো, আমি তোমাকে পৌঁছে দেই। ড্রাইভার আজ আবার ছুটিতে গেল।
গাড়ি লাগবে না, সিএনজি’তে চলে যেত পারব। আমি একাই যাই। তোমার ওখানে যাবার প্রয়োজন নেই, যদি কোনো সমস্যা হয়…।
শিউর? একা যেতে পারবে?
মাথা হেলিয়ে কোনো রকম দ্রুত বাসা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে অঞ্জলী। আসলে ও জায়েদকে আর সহ্য করতে পারছিল না। এই মুহূর্তে ও চাইছিল না জায়েদ ওর সাথে আসুক, তাই স্বামীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে প্রায় দৌড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। রাস্তায় দাঁড়িয়েও বারবার পেছনে তাকিয়ে ও নিশ্চিত হতে চাইছিল জায়েদ ওর সঙ্গে আসছে না। ওর আতংক হচ্ছিল, জায়েদ না আবার পেছন পেছন এসে ওর সঙ্গী হয়। একটি খালি সিএনজি দেখে কিছু না বলেই হুড়মুড়িয়ে দরজা খুলে তাতে চড়ে বসলে সিএনজিওয়ালা ভীষণ রকম অবাক হয়ে তাকায়। অঞ্জলী বলে, ঢাকা মেডিক্যাল চলেন। তাড়াতাড়ি।
আজ উপুড় করা সূর্যের আলোর মধ্য দুপুরে ঢাকার হালকা নির্জন এক রাস্তায় অঞ্জলীর ছোট চাচাকে কারা যেন উপর্যপুরি চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ফেলে রেখে গেছে। যারা কুপিয়েছে তারা তাকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে গিয়েছিল। রাস্তার কিছু সাহসী লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার জানায় তখনও তিনি বেঁচে আছেন, তবে বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম।
তখনও উদ্ধারকারী লোকজন বা হাসপাতালের ডাক্তাররা জানত না,আহত লোকটির পরিচয়। অল্প সময়ের মধ্যে লোকটির পরিচয় জানা যায়, তিনি কনক রাফিদ, একজন প্রগতিশীল নাস্তিক একটিভিস্ট, লেখক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মৌলবাদীদের হত্যার হুমকি পাওয়া তালিকার শীর্ষে, মৌলবাদীরা তাকে কুপিয়ে মেরে সমাজকে নাস্তিক শূন্য করতে চায়। আর তাই জায়েদ বলছিল, উনার শাস্তি হতে হতেও হলো না? অঞ্জলীর মাথায় আসে না একজন মানুষের মৃত্যু চাওয়ার মতো নিষ্ঠুর আরেকজন মানুষ কী করে হতে পারে!
বর্তমান সময়ে মানুষের বিভিন্ন আইডেন্টিফিকেশনের সঙ্গে সঙ্গে নাস্তিক পরিচিতিটাও ব্যাপক হয়ে উঠছে। কেন তা অঞ্জলী বা অনেকে যেমন জানে না তেমনি এই আস্তিকতা বা নাস্তিকতার ব্যাপারে সাধারণ মানুষ কোনো খোঁজ রাখে না। কে ধর্ম পালন করল কী করল না, একজনের ধর্ম পালন নিয়ে আর একজনের কেন এমন চরম মাথাব্যথা হয় তা সাধারণ মানুষদের মতো অঞ্জলীরও বোধগম্য নয়। অঞ্জলী ছোট বেলা থেকে ওর ছোট চাচাকে উদারপন্থী, ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, যুক্তি আর বিজ্ঞানের মতবাদে বিশ্বাসী আর বিশ্ব-সমাজের সব বিষয়ে সচেতন একজন মানুষ হিসাবে দেখে আসছে। পরিবারের সবাই বলে,অঞ্জলীর বাবার ব্যক্তিত্ব আর আদর্শ সবকিছুই নাকি ওর ছোট চাচার মধ্যে রয়েছে। ছোট চাচাও তা স্বীকার করে বলে, দাদা আমাকে যুক্তি আর বিজ্ঞানের মাধ্যমে তর্ক করার পথ বাতলে দিয়েছিলেন। দাদার মতে- বিজ্ঞান,যুক্তি তর্কই হলো মানুষের একমাত্র হাতিয়ার। আর আমার পাঠ অভ্যাস দাদার সংগ্রহের বই পড়ে তৈরি হয়েছে এবং সে পাঠ অভ্যাসের জন্য আমি মনে করি, আমার ভেতরের মানুষটাকে এতটুকু আলোকিত করতে পেরেছি।
এক সময় এনজিও’তে চাকরি করা ছোট চাচা চাকরি-বাকরি ছেড়ে বর্তমানে একটি অনলাইন পত্রিকা চালান, লেখালেখি করেন আর কিছু সোশ্যাল মুভম্যান্ট এবং এক্টিভিজমের সঙ্গে জড়িত-এইসব কারণে কিছুসংখ্যক তরুণের কাছে ছোট চাচা যেমন জনপ্রিয় তেমনি কিছু মানুষের কাছে অচ্ছুতের মতো নিন্দনীয়ও! অঞ্জলীও শুনেছিল, ছোট চাচাকে কে বা কারা কখন যেন থ্রেট করেছিল, হত্যা করবে বলে। ছোট চাচার সাথে তেমন দেখা হয় না বলে ডিটেলস জানাও হয় না, তারপরও কয়েক মাস আগে যখন একবার দেখা হয়েছিল তখন ও বিষয়টি জানতে চাইলে ছোট চাচা হেসে তা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ধ্যাত! আমাকে ভয় দেখানোর জন্য ওসব ফালতু লোকদের ফালতু অপপ্রচার। তারপর একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলেছিলেন, আমি কে? আমাকে কেন মারতে আসবে? আমি আমার ছোট ছোট কাজ নিয়ে মানুষের ভাবনাতে সামান্য একটু ওয়েভ তুলি হয়ত কিন্তু এই ওয়েভ কি একটা সমাজ বদলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে করিস? না, কখনই না। আমাদের সমাজে বিশাল পচন ধরেছে, এজন্য বিশাল এক সুনামির প্রয়োজন। এই সুনামির ধাক্কার জন্য আমার একটুকু কাজ কিছুই না।
তারপরও সাবধানে থেকো।
অঞ্জলীর আর ছোট চাচাকে বলা হয় না, তুমি নাকি ভ্রান্ত ধারণার একজন বাহক? তুমি আল্লাহ-ভগবান-ঈশ্বর কিছু মানো না। তুমি নাকি যুগ যুগ ধরে পালন করে আসা ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক অসাঢ় বলো! ধর্মের বিষয়-আসয়ের সমালোচনা করে মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতিতে আঘাত করছ? তুমি নাকি তোমার লেখার মধ্য দিয়ে সমাজকে অস্থির করে তুলছ? তোমার ভাবনা নাকি কখনও একজন সুস্থ্ মানুষের ভাবনা হতে পারে না, তোমার ওপর শয়তান ভর করেছে। এসব কথা অঞ্জলীর ঠোঁটের চারধারে কুঞ্চন তুলে, কিন্তু কী এক বাধায় তা বেরিয়ে আসে না। ও কিছু সময় নীরবে ছোট চাচার হাতের ওপর নিজের হাত রেখে বসে থাকে, কেউ জানে না; এমন কী ছোট চাচাও না; ও যখন ছোট চাচার হাতের ওপর হাত রাখে তখন ও বাবাকে স্পর্শ করে, অনেক বছর আগে পাওয়া বাবার হাতের উষ্ণতাও এরকম ছিল।
আজ সে ছোট চাচা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। যদি তিনি মারা যান ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে অঞ্জলীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, তাহলে ছোট চাচার হাত চিরতরে হারিয়ে যাবে, মানে বাবার হাতের উষ্ণতাটুকুও হারাবে। তাহলে এই ক্রমশ হিম থেকে হিম-শীতল হয়ে পড়া জীবনে বেঁচে থাকার জন্য স্নেহের উষ্ণতাটুকু কোথায় খুঁজবে ও!
ভাই একটু তাড়াতাড়ি চালান না। অঞ্জলীর কাতর অনুরোধে সিএনজিওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে লোহার নেটের ওপাশ থেকে ওর মুখটি দেখে নেয়। তারপর রাস্তার জ্যামের দিকে তাকিয়ে বলে, একটু ধৈর্য ধরে বসেন আফা, এই তো পৌঁছায়া যামু…আমি চেষ্টা করতাছি তাড়াতাড়ি যাওনের। দ্যাখছেন,কেমন আউলা-ঝাউলা জাম লাগছে।
অঞ্জলী রাস্তার জ্যামের দিকে তাকিয়ে ভাবে, সে কার কাছে ছুটে যাচ্ছে? ছোট চাচার কাছে নাকি বাবার হাতের উষ্ণতাটুকুর কাছে?
অঞ্জলী যখন ছোট চাচাকে স্পর্শ করতে পারে তখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। এত সময় অপারেশন, বিভিন্ন টেস্ট আর ডাক্তারদের হাতে হাতে ঘুরে ঘুরে এখন ছোট চাচাকে সিসিউ’র বেডে রাখা হয়েছে। এখানে খুব কাছের মানুষজন ছাড়া আর কাউকে এল্যাউ করা হচ্ছে না, ছোট চাচি শুষ্ক আর লাল চোখে চাচার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে, তিনি সরে গিয়ে অঞ্জলীকে চাচার পাশে দাঁড়াতে দেয়। অঞ্জলী দেখে ব্যান্ডেজ আর ব্যান্ডেজে ঢাকা পড়ে যাওয়া একটি লাশ যেন! তারপরও সে মানুষ একটি জানান দেওয়ার জন্য যেন ব্যান্ডেজ ফুঁড়ে তাজা রক্তের ছোপ মানচিত্রের মতো এখানে-ওখানে জেগে উঠেছে। উষ্ণতার জন্য ছোট চাচার হাত দুটো ধরতে পারে না ও, ব্যান্ডেজে মোড়ানো। ছোট চাচার হাত একবার স্পর্শ করার জন্য ওর ভেতর হাহাকার করে ওঠে, স্যালাইন পুশ করার জন্য বেরিয়ে থাকা ছোট চাচার পায়ের আঙুলে হাত রাখে ও, এত ঠান্ডা!
দুজন পুলিশ অফিসার এসে অঞ্জলী আর ছোট চাচির পাশে দাঁড়ায়, ওদের মুখে দেখে মনে হচ্ছে ওরা খুবই অনুতপ্ত আর দুঃখিত, হয়ত ছোট চাচার ওপর করা এই নির্মম আক্রমণ ওরাও মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু বর্তমানে পুলিশ সাধারণ মানুষের চোখে এমন সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেখান থেকে তাদের আর রক্ত মাংসের মানুষ মনে হয় না। তাই পুলিশের আবেগ বা দুঃখিত মুখ-মণ্ডল বেমানান লাগে, মনে হয়; বামুন মানুষ কাবুলিওয়ালার পোশাক পরে নিয়েছে। ছোট চাচা নিজে ছিলেন মুক্তমনা, মুক্তচিন্তক একজন মানুষ, আধুনিক ভাবনা, বিজ্ঞান মনস্ক আর উদারনীতির মানুষদের কাছে তিনি কতটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন তা আজ হাসপাতালে না এলে অঞ্জলীর অজানা রয়ে যেত। এই পুলিশ সদস্যরাও হয়ত তেমনি দুজন মানুষ ডিউটির পাশাপাশি ছোট চাচার জন্য সমব্যথী হয়ে উঠেছে। নীরবে কিছু সময়ে দাঁড়িয়ে থেকে এক সময় ওরা ছোট চাচিকে নিচুস্বরে বলে, ম্যাডাম একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
ছোট চাচি কয়েক মুহূর্ত কিছু না বুঝে ওদের দিকে বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
বুঝি এ সময় আপনি কথা বলার অবস্থায় নেই, তারপরও জরুরী… এখানেই বলব।
পুলিশ অফিসার দুজন সিস্টারদের বসার জায়গাটায় এগিয়ে গেলে ছোট চাচির পিছু পিছু অঞ্জলীও যায়।
আপনারা কি কোনো কেস করতে চান?
কেন? ছোট চাচি জানতে চান।
এত বড় একটি এক্সিডেন্ট হয়ে গেল!আপনার হাসব্যান্ডের ওপর এটাক্ট হলো তার জন্য।
কার বিরুদ্ধে কেস করব? আর কেস করে কোনো লাভ হবে?
আমরা তদন্ত শুরু করতে পারব তাহলে।
আমরা কেস না করলে তদন্ত করবেন না? যারা সারাদেশে এসব করে বেড়াচ্ছে তাদের ধরবেন না?
ম্যাডাম,আপনারা সব কিছু জানেন না, তাই আমাদের ওপর পাবলিকের এত রাগ। আমরা কিন্তু চেষ্টা করছি দুর্বৃত্তদের ধরতে।
দুর্বৃত্ত! কাদের দুর্বত্ত বলছেন? দিনের পর দিন লিস্ট করে মানুষ হত্যা করার হুমকিদাতাদের দুর্বৃত্ত বলছেন? ওরা তো নিজেদের একটি সমর্থক বলে দাবি করছে, তারপরও! না অফিসার। আমি এই মুহূর্তে কোনো কেস করতে চাচ্ছি না।
আপনাকে কিছু করতে হবে না, আপনি জাস্ট সাইন করবেন। আমরা সব লিখে এনেছি।
আমি তো এখনও কিছু বলিনি, আপনারা লিখলেন কী করে?
আমরা সব জানি। ম্যাডাম, সাইনটা করে দিলে আমরা কেস শুরু করতে পারি।
সাজানো ফর্মে আমি সাইন করব না, আমাকে ভাবতে হবে।
ছোটচাচি ওয়ার্ডের বাইরে চলে যায়, পুলিশ অফিসার দুজন কিছু সময় অপেক্ষা করে বেরিয়ে গেলে অঞ্জলী আবার ছোট চাচার বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা থেকে এই মধ্য রাত পর্যন্ত, এতটুকু সময়ের মধ্যে হঠাৎ করে ওর অভিজ্ঞতার ঝুলি কেমন ভারী হয়ে উঠেছে। হাসপাতালে যত মানুষের সঙ্গে দেখা হলো এরা কেউ ওর জগতের মানুষ নয়-কোনো ভাবে নয়! এইসব মানুষদের ও অন্য কোথাও, অন্য কোনো জগতে; অন্য কোনো সময়ে দেখেছে, হোক সে ভালো চরিত্রের কী মন্দ চরিত্রে রূপদানকারী মানুষ!
ছোটচাচি ফিরে এসে তার সেলফোন অঞ্জলীর দিকে এগিয়ে দেয়, জায়েদ।
অঞ্জলী ফোন হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসে। কয়েকজন সাংবাদিক তখনও ওখানে দাঁড়িয়ে, অঞ্জলীকে দেখে ওদের মাঝে চঞ্চলতা তৈরি হয়। কেউ কেউ অঞ্জলীর দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে ও দ্রুত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে, হ্যালো…
কী ব্যাপার তোমার ফোন বন্ধ কেন? জায়েদের কণ্ঠে বিরক্তি, ওর কুঁচকে ওঠা ভুরুর ভাঁজ অঞ্জলী হাসপাতালের করিডোর থেকে দেখতে পায়।
বন্ধ! ফোন তো ব্যাগে, চাপ টাপ লেগে হয়ত বন্ধ হয়ে গেছে।
রাত দুইটা কিন্তু বাজে। আসবে কীভাবে? কেউ কি আছে নাকি আমাকে আনতে যেতে হবে?
অনেক রাত হয়ে গেছে!… এত রাতে না গিয়ে আমি বরং থেকে যাই।
কেন? আর কেউ নেই থাকার জন্য?
চাচি আছে। আর চাচার কিছু বন্ধু-বান্ধব। আমি চাচির সাথে বরং থাকি…
থাকবে? …ঠিক আছে থাকো। শুনো, আবার কোনো ইন্টারভ্যু দিতে টিতে যেও না যেন, মানে টিভিতে তোমাকে যেন আবার না দেখা যায়। পত্রপত্রিকায় নাম না আসে। আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা দেখলে কী ভাববে, মানে ছোট চাচার কেইসটা তো সবাই সহজভাবে নিবে না। পরে আবার আমাদের না নাস্তিক-ফাস্তিক ভেবে বসে সবাই। বুঝেছ তো?
হুম…
উনি এখন কেমন আছেন?
কে?
তোমার ছোট চাচা।
এই তো…আছে। এখনও ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন, ডাক্তাররা স্টেবল বলছে না। আমি রাখছি।
অঞ্জলী ফোন কেটে দেয়। হাসপাতালে আসার কিছুক্ষণ পর থেকে জায়েদের ফোন আসছিল বার বার, জায়েদের ক্রমাগত ফোন অঞ্জলীকে এক্সট্রা মেন্টাল প্রেসার দিচ্ছিল,মনে হচ্ছিল জায়েদ বলবে; এক্ষুনি চলে আসো,তাই সে নিজেই ফোনের সুইচ অফ করে রেখেছিল। ওর খুব ইচ্ছে করে, ছোট চাচার পাশে বসে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। ওর আর ছোট চাচার বয়সের ডিফারেন্স তো খুব বেশি নয়,মাত্র দশ বছরের; ওরা একটা সময় পর্যন্ত এক বাড়িতে ভাই-বোনের আহ্লাদে বড় হয়ে উঠেছিল। অঞ্জলীর মনে পড়ে না, কখনো সে ছোট চাচার চুলে বিলি কেটে দিয়েছিল কিনা, তারচ’ বরং ওদের দুজনের মাঝে অনেক বেশি ঝগড়া-ঝাটি হয়েছে। স্কুল লাইফে ও অনেকবার ছোট চাচার হাত খামচে দিয়েছে। কিংবা ছোট চাচার পাশে বসে শাহরুখ-আমির-সালমান খানের প্রেমের ছবি দেখার স্মৃতি বেশ মনে পড়ে। কিন্তু আজ সেসব কিছু ছাপিয়ে ওর খুব ইচ্ছে করে ছোট চাচার চুলে যদি একটি বার বিলি কেটে দিতে পারতো! ছোট চাচার সব চুল আজ কামিয়ে ফেলা হয়েছে মাথায় সেলাই দেওয়ার জন্য।
জেলা শহরে এক বাড়িতে,এক উঠানে ওরা বেড়ে উঠলেও ঢাকা এসে এক শহরে বাস করেও ছোট চাচার সঙ্গে শেষ কয় বছর তো একবার কী দুইবার বছরে দেখা হতো অঞ্জলীর। প্রথম প্রথম অঞ্জলীর বিয়ের পর ছোট চাচা নিজ থেকে খোঁজ-খবর করতো ওদের। পরে সে খোঁজ-খবরে কেমন ভাটার টান ছিল, কৈফিয়ত চাইলে রাজধানীর ব্যস্ততার দোহাই দেখাত। অঞ্জলী মনে মনে কী করে যেন বুঝতে পেরেছিল, জায়েদ ছোট চাচাকে পছন্দ করে না আর তা ছোট চাচাও বুঝতে পেরেছিলেন। ছোট চাচার সঙ্গে ওর সম্পর্কের আয়নায় ধীরে ধীরে পাতলা ধুলির এক ফালি আস্তরণ পড়ে গিয়েছিল অজান্তে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোট চাচার সঙ্গে ক্রমশ ম্লান হয়ে পড়া সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে অঞ্জলীর চোখও ঝাপসা হয়ে আসে। এসময় একজন কেউ ওর কাঁধে হাত রাখে, ওরই বয়সী একজন মেয়ে; সে একটি টিস্যু পেপার এগিয়ে দেয়। মেয়েটিকে অঞ্জলী সাংবাদিকদের জটলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল।
আপনি অনেক সময় ধরে কাঁদছেন আপা। উনি আপনার কে হন?
আমার চাচ্চু। ছোট চাচা। আমার…
অঞ্জলীর জায়েদের কথা মনে পড়ে, বারবার নিষেধ করে দিয়েছে; সে যেন কোনো ইন্টারভ্যু না দেয়। আপনি কি সাংবাদিক? অঞ্জলী তটস্থ কণ্ঠে জানতে চায়।
হ্যাঁ। তবে এখন আমি আপনাকে কোনো ইন্টারভ্যু করছি না। আপনি অনেক সময় ধরে নীরবে কেঁদে যাচ্ছেন, আমার মনে হলো আপনার পাশে একজন মানুষ প্রয়োজন তাই এলাম। আপনি না চাইলে কোনো কথাই বলবেন না।
ও…। অঞ্জলী মেয়েটির হাত থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে চোখ মুছে।
আমি তার সব বই,সব লেখা পড়েছি। তিনি আমাদের এই প্রাগৈতিহাসের পথে পিছু হাঁটতে থাকা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন, বর্তমান প্রজন্মকে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করছেন, শাহবাগ মুভমেন্টের সঙ্গে প্রজন্মকে একাত্ম হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। কী অসাধারণ লিখেন তিনি, তাই না? পড়তে গিয়ে মনে হয় প্রতিটি ভাবনাই তো আমার ভাবনা! পিছিয়ে থাকা সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার আহবান করতে গিয়ে আজ তার এই অবস্থা! আমরা তার প্রজন্মের মানুষ হয়ে গর্বিত।
সত্যি! আপনি চাচ্চুর সব লেখা পড়েছেন?
হ্যাঁ, পড়েছি। আপনি পড়েননি? মেয়েটি অবাক হয়ে অঞ্জলীর দিকে তাকায়। অঞ্জলীর মাথা নুয়ে আসে, ওর চোখে আজ যেন বান নেমেছে।
না, ছোট চাচার কোনো বই অঞ্জলীর পড়া হয়নি। অঞ্জলীর ফেসবুকে একটি একাউন্ট আছে, কালে ভাদ্রে ওটা খুলেও; মাঝে মাঝে ছোট চাচার কোনো কোনো লেখার লিঙ্ক অনেকে শেয়ার দিত, তাও ওর পড়া হতো না। মাঝে মধ্যে একবার পড়ে নেওয়ার ভাবনা হলেও সে পড়া আর হয়ে উঠত না। কেন? শুধুই কি সময়ের অভাব নাকি ছোট চাচার ভাবনাকেও ও এড়িয়ে যাওয়া শিখে নিয়েছিল? অথচ ছোট চাচা যখন কলেজ ইউনিভার্সিটি লাইফে কবিতা লিখত সে কবিতার প্রথম পাঠক তো অঞ্জলীই ছিল। ছোট চাচার নতুন কবিতা পড়ার জন্য ওর ভেতরে প্রচণ্ড এক অপেক্ষা ছিল, সে অপেক্ষা তো অঞ্জলীর জীবনে অন্য কিছুর জন্য আসেনি। ওর চাচ্চু কবিতা লিখে, এটা সে গর্ব করে বান্ধবীদের বলত, বলত; দেখিস একদিন আমার চাচ্চু অনেক বড়ো কবি হবেন।
ছোটচাচা হয়ত কবি হননি,অন্য কিছু হয়েছেন; আরো বড়ো হয়েছেন,নিজের ছোট মন-মানসিকতার জন্য সে খবর অঞ্জলী রাখতে পারেনি। একবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন কলিগ মিলে বইমেলায় গেলে ছোটচাচার সঙ্গে অঞ্জলীর দেখা হয়ে যায়। অঞ্জলীকে দেখে ছোটচাচার সে কী উচ্ছ্বাস! অঞ্জলীকে নিয়ে পুরো মেলা ঘুরে ঘুরে দেখালেন, ওর ছেলে টিনটিনের জন্য একগাদা বাচ্চাদের কমিকস আর ড্রইংয়ের বই শিশু চত্বর থেকে কিনে হাতে ধরিয়ে দিলেন। আসার সময় একটি স্টল থেকে নিজের অনেকগুলো বই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, অঞ্জলী,পড়ার অভ্যাসটা একেবারে ছেড়ে দিস না। নিজের জন্য কিছু একটা ধরে রাখতে হয়, না হলে জীবনের বোঝা ভারী হয়ে ওঠে।
ছোটচাচা কী করে জানল, ওর আর পাঠ অভ্যাস বলতে কিছু নেই, অঞ্জলী বুঝে পায় না। তারপরও খুশি মনে দুই হাতে বইর ব্যাগ বুকে চেপে অঞ্জলী মনের ভেতর বসন্তের হাওয়া নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরেছিল। বাসায় ফিরে দেখে ওর আগেই জায়েদ ফিরে এসেছে, মুখ ভার করে বসে রয়েছে। অঞ্জলীকে দেখে জানতে চায়, এত দেরি যে?
কলিগদের সাথে বইমেলায় গিয়েছিলাম।
বাহ্,ফাঁকি দিয়ে বইমেলায়ও যাওয়া হয় তোমাদের?
ফাঁকি দেবো কেন? আমরা কি স্কুল পড়ুয়া বালিকা? ছুটির পরে গিয়েছিলাম, সব কলিগরা মিলে। অঞ্জলী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা থেকে হিজাবের প্যাঁচ খুলতে খুলতে বলে।
হুম। এত দেরি করে ফিরলে,আম্মা তো বুড়ো হয়েছেন, টিনটিনকে এত সময় সামলাতে তার কষ্ট হয়।
মা কেন টিনটিনকে সামলাবে? বুয়া তো রয়েছে ওকে দেখার জন্য।
বুয়াকে দিয়ে সন্তান মানুষ হয় নাকি! যত্তসব! আম্মাকেই পুরোটা দেখতে হয়।
জায়েদ গম্ভীর মুখে অঞ্জলীর আনা প্যাকেট খুলে টিনটিনের জন্য বইগুলো দেখে কিছু বলে না। ছোট চাচার বইগুলো দেখে ওর ভুরু কুঁচকে ওঠে, রেহানা,টাকা দিয়ে তুমি এতসব ছাইপাশ কিনলে?
কী সব? অঞ্জলী দেখে জায়েদের হাতে ছোট চাচার বই, সে বলে; এগুলো ছাইপাশ হবে কেন! এগুলো চাচ্চু আমাকে গিফট করল, তার লেখা বই।
এসব বই কেউ পড়ে নাকি? বিকৃত মন-মানসিকতার বই। উনি দিলেন আর তুমি ধেই-ধেই করে নাচতে নাচতে নিয়ে এলে! জায়েদের গলা চড়ে ওঠে।
এই বই এনেছি তো কী হয়েছে? আর মোটেও চাচ্চু বিকৃত মানসিকতার মানুষ নয় যে খারাপ কিছু লিখবে।
বিকৃত মানসিকতার শুধু না, বিকৃত মস্তিষ্কেরও। সাক্ষাৎ শয়তানের শিষ্য। তুমি পড়নি তাই জানো না উনি কী লিখেন! এইসব পড়ার দরকারও নাই। এসব বই বাসায় রাখলে বাসার কারো নামাজ-রোজা হবে না। ঘরে ফেরস্তা ঢুকবে না। এক্ষুনি এই বইগুলো বাসা থেকে সরাও। বলতে বলতে জায়েদ বইগুলো নিজেই দু’হাতে ধরে রুমের বাইরে নিয়ে যায় আর চিৎকার করে কাজের ছেলেটিকে ডেকে তা নিচে ডাস্টবিনে ফেলে আসতে বলে। অঞ্জলীর চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু ঘটে যায়,ও এই ঘটনায় কোনো বাধা দিতে পারে না, বুঝতেও পারেনি, ছোট চাচা কী এমন ‘নাপাক’ বিষয় লিখেছে যা ঘরে রাখলে ফেরেস্তাও আসবে না! বিমূঢ় অঞ্জলী নিজের জায়গায় বসে থাকে।
সেদিনের পর ও ছোটচাচাকে অনেক দিন এড়িয়ে চলেছে। দেখা হলে ছোটচাচা যদি জানতে চায়, বইগুলো সে পড়েছে কিনা, কী উত্তর দিত সে? ওর মনে হতো,ছোটচাচাকে মিথ্যা বললে তিনি ঠিক ওর চোখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু বুঝে যাবেন। আর সে নিজেও কখনো জানতে চায়নি ছোটচাচা কী লিখেন,আসলে নিজের সংসারে অশান্তি আনতে চায়নি। তারচে’ অফিস থেকে ফিরে নামাজে মনোযোগী হয়েছে, মাঝে-মধ্যে বেহেস্তি জেওরে চোখ বুলিয়েছে; স্বামী-শাশুড়ি দুজনেই এতে করে ওর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে।
অঞ্জলী ওর পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকায়, ছোট চুলে জিন্স,ফতুয়া আর গলায় মাফলারের মতো করে ওড়নাটি প্যাঁচানো। আর কোনো রকম সাজ নেই মেয়েটির; গায়ের রঙও বেশ গাঢ় কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি অঞ্জলীর দৃষ্টি কাড়ে তা হলো এক জোড়া দীপ্তিময় চোখ! মনে হচ্ছিল সে চোখ অঞ্জলীর ভেতরটা পড়ে নিচ্ছে। অঞ্জলী চোখ নামিয়ে নেয়, আজও ;এই মেয়েটিকেও ও’র বলা হয় না সে ছোট চাচার কোনো বই পড়েনি।
দুই
অঞ্জলী দু’দিন পর বাসায় ফিরে এসে বুঝতে পারে ওর ওপর জায়েদ আর শাশুড়ি দুজনেই ক্ষুব্ধ, মুখে প্রকাশ না করলেও ওদের ভাবভঙ্গিতে তা প্রকাশ করছে। শাশুড়ির মুখ মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর আর জায়েদ বিরক্তির সঙ্গে চিন্তিতও যেন। জায়েদ গতকাল বিকালের দিকে হাসপাতালে গিয়েছিল, যতটা না ছোট চাচাকে দেখতে তার চেয়ে বেশি অঞ্জলীকে বাসায় ফিরিয়ে আনতে। অঞ্জলী যখন জানিয়েছিল, সে ছোট চাচার জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত থাকতে চায় তখন জায়েদ ফুঁসে উঠেছিল, কেন তোমাকে থাকতে হবে! আর আত্মীয়-স্বজনরা আছে না, সবাই মিলে কি বাল ফেলাবে?
অঞ্জলী জায়েদের কথায় চমকায় না, ও স্বামীর এই ভাষার সঙ্গে পরিচিত; অন্য সময় যা বলে না ও গতকাল নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেছিল, তোমাকে কে বাল ফেলতে ডাকছে এখানে? যখন আমার বাল ফেলা শেষ হবে আমি আসব।
অঞ্জলীর কথায় থতমত খেয়ে জায়েদ আরও কিছু সময় হাসপাতালে অযথা ঘোরাঘুরি করে পরে ফিরে আসে। ফেরার আগে চাচিকে বলে, আপনাদের গাড়ি বা কোনো হেল্প লাগলে বলবেন…।
মাকে দেখে সাত বছরের টিনটিন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলে শাশুড়ি বলে, দাদা,মাকে ছাড়ো। আগে মাকে গোসল করে সাফ-সুতরা হতে দাও।
অঞ্জলী শাশুড়ির কথায় কান না দিয়ে টিনটিনকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় গড়াগড়ি খায়। গড়াগড়ি দিতে দিতে ও ছেলের গায়ে হারিয়ে যাওয়া বাবার উষ্ণতা খুঁজে ফিরে,পায় না। সন্তানের বুকে নাক গুজেঁ বাবার গন্ধ খুঁজে,পায় না। তারপরও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রাখতে ওর ভালো লাগে,মমতা আর ভালবাসায়।
দুদিন পর বাসায় ফিরলে, গোসল সেরে রক্তফক্তের গন্ধ দূর করে ফ্রেশ হয়ে না হয় ছেলের সাথে ঝাপ্টাঝাপ্টি করলে। শ্লেষের সঙ্গে কথাটুকু বলে জায়েদ।
অঞ্জলী ছেলের বুক থেকে মুখ তুলে তাকালে জায়েদ আগের স্বরেই বলে,লোকটা অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। আল্লাহ তাকে হাতে ধরে বাঁচিয়েছেন। তোমরা কোথায় তার জন্য আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করবে তা না সবাই মিলে টিভিওয়ালা-পত্রিকাওয়ালাদের কাছে ইন্টারভ্যু দিয়ে উৎসব করে বেড়াচ্ছ!
উৎসবের সময় এসেছে, উৎসব করছি। তুমি তো করছ না, তোমার সমস্যা হচ্ছে কেন?
জায়েদ অঞ্জলীর নির্লিপ্ত কথার ভঙিতে হোঁচট খায়, রেহানা! তোমার চাচার না হয় মস্তিষ্ক বিকৃতি ছিল। তাই বলে তোমরা সবাইও কি পাগল হয়ে যাবে?
কে বলল তোমাকে চাচ্চুর মস্তিষ্ক বিকৃত ছিল?
কারো বলতে হবে কেন? দুইটা বই লিখে দ্বীন দুনিয়া উল্টায় ফেলতে চায়, উন্মাদ ছাড়া আর কী? নিজের ইহ্ কাল ধ্বংস করছে, অন্যেরটাও করতে চায়।
তুমি চাচ্চুর বই পড়েছ?
বই আর কী! দেশের বাইরে ছিল টেকনিক ভালো শিখেছে, ইহুদি নাসারাদের বইপত্র ঘেঁটে এখান ওখান থেকে কাটপিস করে বাজে কিছু ইনফরমেশন আর কী! আমি ওসব বাজে বই পড়ি না।
না পড়ে জানলে কী করে ওগুলো বাজে বই? আশ্চর্য রকম নিষ্পৃহ অঞ্জলীর কণ্ঠ।
রেহানা,আমি তোমার সাথে এসব বাজে বিষয়ে নিয়ে তর্ক করতে চাই না।
তুমি যা জানো না তা নিয়ে তর্ক করার মিথ্যে ভানটুকু যে করোনি তার জন্য ধন্যবাদ।অঞ্জলী ছেলের গালে চুমো খেয়ে বলে, যাও বাবা খেলা কর গে।
জায়েদ বিয়ের এতটা বছর পর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আজ দুইবার আটকাল দেখে নিজের ওপর ওর বিরক্ত হয়। ও ভাবে,এই জন্যই মুরব্বিরা বলে, মেয়েমানুষকে বাইরে যেতে দেওয়া ঠিক না। চোখ-কান ফুটে যাওয়া কুকুরছানা সহজে বশ মানতে চায় না যেমন তেমনি মেয়ে মানুষগুলোও। কিছু সময় জায়েদ কিছু একটা ভাবে, বলে; ছেলেটা সারাদিন একা একা খেলে বড়ো হচ্ছে। আমরা কেউ ওকে টেককেয়ার করছি না। ছেলেটার নিঃসঙ্গতা দেখলে খারাপ লাগে।
জায়েদের নিচুস্বরে বলে যাওয়া কথা অঞ্জলী শুনেও না শোনার ভান করে গোসলের টাওয়েল আর কাপড় গুছিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়। স্ত্রীর বাথরুমে চলে যাওয়ার দিকে কিছু সময় গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জায়েদ,ও কিছুতেই বুঝতে পারে না; বারো বছর ধরে যে রেহানাকে ও ধীরে ধীরে নিজের ভাবনার মতো করে গড়ে তুলেছিল সে কী দুদিনের মধ্যে এতটা বদলে যেতে পারে! না,তা কী করে সম্ভব!
জায়েদ ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং-এ এসে দেখে মা বসে গম্ভীর মুখে এক হাতের তসবিহ টিপছে আর অন্য হাতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। জায়েদকে দেখে মা’র মুখ আরও গম্ভীর হয়ে ওঠে, রাগে হিঁসহিঁসিয়ে উঠেন, তোমার চাচাশ্বশুরের জন্য তো আর কারো কাছে মান-সম্মান থাকছে না। সবাই জানতে চায়, ওই নাস্তিকটা যে আপনার বেয়াই আগে তো বলেন নাই। আগেই বলেছিলাম,ওই বাড়ির মেয়ে বিয়ে কোরো না। পুরা বংশে কারো ধর্মকর্মের ঠিক নাই।
আম্মা রেহানা তো নামাজ রোজা করে। জায়েদ স্ত্রীর পক্ষে সাফাই গায়।
দেখো আর কয় দিন করে। দেখছ তো বেদ্বীন চাচার জন্য নিজের স্বামী-সন্তান-সংসার সব কেমন বাদ দিয়া দিছে। আমার কথা না হয় বাদই দিলাম,আমারে তো রেহানা ওর বুয়ার দামও দিতে চায় না।
আম্মা হাজার হোক ওর চাচা তো। এ সময় এসব কথা না তুললে হয় না?
মা কড়া চোখে জায়েদের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গেলে এসময় অঞ্জলী ডাইনিং-এ এলে মা ছেলের কথার মাঝে টান পড়ে। অঞ্জলী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বুয়াকে ডেকে চা দিতে বলে।
মাগরেবের নামাজের সময় চলে যাচ্ছে রেহানা। আগে নামাজটা পড়ে নাও।
মা আমার খুব মাথা ধরেছে। চা-টা খেয়ে নিই।
ঠিকমতো ঘুমাও নাই,তাই। তোমরা চাচার জন্য সবাই এভাবে হাসপাতালে ভিড় বাড়িয়ে কী লাভ? তারচে’ বাড়িতে বসে দোয়া-দরুদ করো। জায়েদ বলল উনার অবস্থা সুবিধার না, দোয়া দরুদে আল্লাহ চান তো জান বখস দিবেন।
আমার চাচ্চুর জন্য আল্লা তো কিছু করবেন না মা। উনি নাস্তিক মানুষ।
ছিঃ রেহানা! এটা কেমন ধারার কথা। আল্লা নারাজ হবেন। তিনি পাক-নাপাক সবার জন্য আছেন। তওবা বলো, তওবা বলো।
তওবা বলার কিছুই নাই, আমি তো অন্যায় কিছু বলি নাই। আপনারা এত ধার্মিক মানুষ আপনারাও তো আমার চাচ্চুর জন্য দোয়া-দরুদ করতে পারতেন। কই করেন নাই তো! নাস্তিকের জন্য আল্লার কাছে দোয়া চাইতে আপনাদের বাধে, সেখানে আল্লা আর কতটুকু আমার চাচ্চুর জন্য করবে?
কী সব বাজে কথা বলছ তুমি! তুমি কেমনে জানো আমরা তোমার চাচার জন্য দোয়া-দরুদ করি নাই? জায়েদ রেগে যায়।
আমি জানি তোমরা তাঁর জন্য কিছুই করো নাই। তোমরা চাচ্চুকে পছন্দ করো না। তোমরা ভাবছ, তার শাস্তি হতে হতেও কেন হলো না! কেন সে বেঁচে গেল! ধর্ম মানুষকে ভালোবাসা, হৃদ্যতা শেখানোর কথা, মানুষের মৃত্যু কামনা নয়। তোমাদের মতো মানুষরা শুধু মুখে শান্তির বুলি আউড়াতে পারো কিন্তু তোমাদের ভাবনাজুড়ে হিংস্রতা।
কথাগুলো বলে অঞ্জলী ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে চলে যায়।
মার মুখ আগের চেয়েও থমথমে,জায়েদের মুখ রাগে ভয়ানক রকম কুঁচকে উঠেছে। সে নিজেকে প্রবোধ দেয়, এখন রাগলে চলবে না; ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। আজ ওর বাসায় সাপ্তাহিক হালাকার বৈঠক আছে, এশা’র নামাজের পর মেহমানরা আসতে শুরু করবে। পূর্ব নির্ধারিত তারিখ, রেহানা জানে;বছরে কয়েকবার ওর বাসায় এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠক শেষে সদস্যরা যার বাসায় হালাকা অনুষ্ঠিত হয় তার বাসায় রাতের খাবার খায়, এটাই সংগঠনের অলিখিত রওয়াজ। বাসার দৈনিক রান্নাবান্না কাজের লোকে করলেও এই বিশেষ দিনের রান্না সব সময় রেহানার তদারকিতে হয়,আজকে একবারও জানতে চাইল না কী রান্না হবে! ওকি কি বৈঠকের বিষয়টি ভুলেই গেল! এই বৈঠক কর্মসূচি আর খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনের সঙ্গে ওর ব্যবসায়িক, সামাজিক মর্যাদার ব্যাপার শুধু জড়িত নয় ওর রাজনৈতিক মতাদর্শেরও যোগ রয়েছে, এইসব অবশ্য রেহানা জানে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে আজকের বৈঠকটি ওর বাসায় হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কোন একটি কারণ দেখিয়ে এটি বাদ দিতে হবে।
ভর সন্ধ্যায় অঞ্জলীকে আবার বাইরে বেরুতে দেখে বিস্মিত হয়ে জায়েদ জান তে চায়,এখন আবার কোথায় যাচ্ছ?
কয়েকটা প্রয়োজনীয় বই কিনতে হবে।
এক্ষুনি কিনতে হবে!
হুম।
অঞ্জলী বেরিয়ে গেলে মা বলে, তোমার চাকরি করা শিক্ষিত বউ। বউরে স্বাধীনতা দিছ, বউ’র ডাঁটের নিচে থাকবা না তো কী? নিজের দেমাগে বউ পালতে না পারলে এমনই হয়। বউরেও শাসন করা শিখে নাই তার আবার বউ পালার আব্দার। মা সশব্দে চায়ের কাপ টেবিলে আছড়ে রেখে ওঠে নিজের ঘরে চলে যায়।
চার ঘণ্টা পর অঞ্জলী যখন দু’টি বই’র ব্যাগ নিয়ে বাসায় ফিরে আসে তখনও ডাইনিং টেবিলে একই চেয়ারে বসে আছে জায়েদ।
তিন
বাংলাদেশের আরও অনেক তরুণ-তরুণীদের যেমনটা প্রেম হয় তেমনটা আর কি,বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আরম্ভ করার দুই বছরের মাথায় অঞ্জলীর সঙ্গে জায়েদের প্রেম হয়ে যায় অনেকটা প্রেম হতেই হবে এই নীতিতে। প্রেম করার সময় অঞ্জলী জায়েদের মাঝে যে গুণগুলো দেখেছিল,দেখতে সুদর্শন, পড়াশুনায় অত্যন্ত মেধাবী আর গম্ভীর ধীরস্থির গোছের ছেলেটা কিছুটা ধার্মিকও বটে, কেননা; আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ধার্মিকতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। তখন অবশ্য অঞ্জলী নামাজ-রোজা করে না আবার কেউ যদি জানতে চাইত;নামাজ পড়ে কিনা তখন সে অনেকটা কুঁকড়ে যেত। চারপাশের মানুষ নিজেদের মতাদর্শের অনুসারী মানুষ ছাড়া অন্যদের সঙ্গে মেলামশা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, অন্যদের অচ্ছুৎ মনে করে, এটা অঞ্জলী বুঝতে পারত। মাঝে মধ্যে ধর্মে মনোযোগী না হওয়াকে ওর ভীষণ গর্হিত কাজ মনে হতো। অথচ ওদের বাড়িতে ধর্মীয় চর্চাগুলো ছিল অনিয়মিত, ধর্ম পালনের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। তখনও অঞ্জলীর বাবা বেঁচে, দাদিও বেঁচে ছিলেন। দাদির কল্যাণে বাড়ির ধর্মীয় আবহ কিছুটা ছিল, মা দাদির সঙ্গে অনিয়মিতভাবে নামাজ রোজা করতেন। তবে দাদি ধর্ম নিয়ে পুত্রবধু আর মেয়েদের ওপর খবরদারী করলেও নিজের দুই ছেলেকে তিনি কখনোই ধর্মমুখী করতে পারেননি। অঞ্জলীর বাবা মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে পাশ করে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রনেতা আর পরবর্তীকালে নির্ভীক সাংবাদিক হয়েছিলেন। আর ছোটচাচা তখন পড়াশুনার জন্য দেশের বাইরে। বৃদ্ধা দাদি সারাদিন কুঁজো হয়ে কোরান নতুবা অজিফা পাঠে মগ্ন থাকতেন। মা স্কুলে শিক্ষকতা শেষে ইচ্ছে হলে হেলায়-ফেলায় ধর্ম অনুশীলন করতেন অথবা করতেন না। বড়ো বোন সাঝঁবাতির বিয়ের পর প্রবাসী জীবন আর বাবার অপরিসীম ব্যস্ততা,অঞ্জলী পারিবারিকভাবে অনেকটা একা আর অনুসরণীয় মানুষের অভাবে ভুগছিল। তখনই ওর সঙ্গে দুই বছরের সিনিয়র জায়েদের ঘনিষ্টতা হয় আর ক্রমশ তা বাড়তে থাকে।
জায়েদ নিজে যদিও ক্যাম্পাসে থাকার সময় নিয়মিত নামাজের রুমে গিয়ে নামাজ পড়তো কিন্তু অঞ্জলীর নামাজ পড়া বা না পড়া নিয়ে কখনো আগ্রহ দেখায়নি। তখন অন্য বন্ধুদের মতো সেও অঞ্জলীকে ‘অঞ্জলী’ বলে ডাকত, অঞ্জলীও জায়েদকে ‘জায়েদ’ বলে ডাকত। তখন অঞ্জলীকে কেউ বন্ধুদের মধ্যে ছেলে বা মেয়ে বলে বিভাজন তৈরি করতে কেউ শেখায়নি, সব বন্ধুদের সঙ্গেই ওর আড্ডা হতো নিঃসকোচে।
ওদের বন্ধুদের আড্ডায় অনেক সময় জায়েদ এবং ওর দু’একজন বন্ধুও যোগ দিত। সেই বন্ধুদের একজন ছিল সুমন। একদিন অঞ্জলী আর জায়েদ ক্যাম্পাসের নিরিবিলি কোণে কাছাকাছি বসেছিল আর ওদের পাশ কাটিয়ে সুমন যেতে যেতে হাত তুলে হাই বললে প্রত্যুত্তরে অঞ্জলী হাত নেড়ে ডেকে বলেছিল, সুমন আসো,আড্ডা দেই।
সুমন মাথা নেড়ে না বলে চলে গেলে জায়েদ মুচকি মুচকি হাসছিল, অঞ্জলী জানতে চেয়েছিল; হাসছ কেন?
আছে একটি ব্যাপার।
কী ব্যাপার বলা যাবে না?
তুমি যদি রাগ না করো…
রাগ করব কেন? প্লিজ বলো জায়েদ।
সুমনের মনে পাপ। ওই বেটা তোমাকে পছন্দ করে।
যাহ্ কী বলছো! হয়ত এম্নি বন্ধু হিসাবে করে।
না। ও তোমাকে প্রেমিকা হিসাবেই চাইছিল।
কী বাজে বকছো!
বাজে না সত্যি। ও আমাকে বলেছিল,ও একদিন রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখেছিল; তুমি নাকি একেবারে খালি গা হয়ে ওর পাশ শুয়ে আছ,ও তোমার সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। তোমাকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়েছে।
জায়েদের কথা শুনে অঞ্জলীর ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকে, সুমন নিজের মুখে এই কথাগুলো ওকে বললেও এতটা বিব্রত হতো কী না জানে না, জায়েদের মুখ থেকে শোনার পর নিজেকে বিবস্ত্র আর লাঞ্ছিত লাগছিল ওর।
জানো অঞ্জলী, সুমনের কথা শোনার পর আমার বুকটা এমন ফাঁকা হয়ে গেল, মন হচ্ছিল সত্যি বুঝি তুমি ওর সাথে শুয়েছ। অথচ দেখো, সুমনও আমার ঘনিষ্ট বন্ধু!
আর কতবার সুমন ওকে ন্যাংটো করে বিছানায় তুলেছ জানে না অঞ্জলী কিন্তু এরপর থেকে সুমনের সঙ্গে ওর একটি দূরত্ব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সে দূরত্বের সীমারেখা এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, ওদের বিয়েতে সুমন উপস্থিত থাকে না। শুধু কী সুমন, একে একে অঞ্জলীর সব ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে একটি অলিখিত নিয়মের দূরত্ব তৈরি হতে থাকে আর ও ক্রমশ জায়েদের অধিকৃত নারীতে পরিণত হয়ে উঠে। তারপর মেয়ে বন্ধুরাও এক এক করে পরের ঘরের বৌ হয়ে হারিয়ে যায়। অঞ্জলী যখন বন্ধুহীন হয়ে সম্পূর্ণ একা, জায়েদের একার রাজত্বে বাস; তখন জায়েদ ওর দাবি দাওয়া খুব সন্তর্পণে একে একে পেশ করতে থাকে,
আমাদের বাসার সবাই অন্ধ ধার্মিক না তবে নামাজটা রেগুলার পড়ে। জায়েদের প্রস্তাবনা অনেকটা এমন ধাঁচের শোনাত প্রথমে।
আম্মা কয়দিন পর তোমাদের বাসায় যাবে। তখন দেখবে,আম্মা কেমন মিশুক, একদম কট্টর নয়। তোমাকে পাশে বসিয়ে কত রকম গল্প করবে। তখন হয়ত জানতে চাইবে,তুমি নামাজ পড়ো কিনা; তুমি যদি হ্যাঁ বলো আম্মা খুব খুশি হবেন।
অঞ্জলী দাদির কাছে খুব নিচুকণ্ঠে অনুরোধ করে, দাদি, আমাকে নামাজ পড়াটা একটু শিখিয়ে দিবা?
নাতনির মতি ফেরাতে বৃদ্ধা দাদি খুব খুশি হয়েই অঞ্জলীকে নামাজ পড়া শেখাতে থাকেন। ফরজ,সুন্নত আর নফলের মেলবন্ধন, তাহজ্জুদের বুজরুকী এই সব শিক্ষায় অঞ্জলী নিজের ভেতর ক্রমাগত লতিয়ে যেতে থাকে। একদিন দাদির সঙ্গে অঞ্জলী যখন নামাজ পড়ছিল বাবা তা দেখে পরে মেয়েকে কাছে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন, দেখলাম নামাজ পড়ছ। তুমি কি বুঝে শুনে নামাজ পরবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছ? কারো অনুরোধ বা ফোর্সে নয় তো?
অঞ্জলী মৃদুস্বরে জানিয়েছিল, সে নিজের ইচ্ছাতে নামাজ পড়ছে। মেয়ের কথায় বাবার মুখ কিছুটা গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, তুমি তোমার এক বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে বলেছিলে, ওকে একদিন ডাকো; পরিচিত হই।
বাবার আর জায়দের সঙ্গে পরিচয় হওয়া হয়ে ওঠে না। অফিস থেকে বের হওয়ার মুখে কারা যেন বাবাকে গুলি করে, সঙ্গে সঙ্গে অফিস গেটে তার মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যুর পর ছোটচাচার দেশে আসা হয় না, তখন তার পিএইচডি’র ফাইনাল চলছিল আর বড় কথা তিনি অর্থ কষ্টে ছিলেন; চাইলে হুট করে চলে আসা সম্ভব ছিল না। তাই বাবার দাফন-কাফন-মিলাদ সবকিছুর আয়োজনে জায়েদকে থাকতে হয়েছিল।
কী আশ্চর্যের বিষয়, যে লোকটি বেঁচে থাকা অবস্থায় ধর্মীয় পরিচয় ত্যাগ করেছিলেন স্বেচ্ছায়,চেয়েছিলেন তাঁর ডেডবডি কোনো হাসপাতালকে মানবকল্যাণে দান করবেন, মৃত্যুর পর সে মানুষটির ডেডবডি পবিত্র লাশ হয়ে যায় যথা সময়ে উইল না করার কারণে। তাঁর মৃত্যুতে শোকগাঁথা গাইতে আসে মুখমণ্ডলে মিহি দাড়ির প্রলেপ নিয়ে সদ্য বেড়ে ওঠা কয়েকজন তরুণ, যাদের স্বর তখনও মেয়েলি কণ্ঠের মতোই মোলায়েম। পেটমোটা বড়ো হুজুর তর্জনী দিয়ে মাড়ি থেকে ঘষে পানের খুঁচড়া তুলে তুড়ি বাজিয়ে দূরে ছুড়ে দিয়ে দীর্ঘ মোনাজাত শুরু করেছিলেন। সে মোনাজাত শুনে দাদি আর জায়েদের মা কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন। জায়েদের মা বলেছিলেন, হুজুর অনেক এলেমদার মানুষ। দেরাদুন থেকে পাশ করা তিনি। তোমার বাবা নিশ্চয় কোনো নেক কাজ করেছিলেন। তা না হলে হুজুরের মতো এমন মুমিন বান্দা কী করে তাঁর জানাজায় নামাজ পড়াতে আসেন!
মা পুরো সময়টাই ছিলেন নীরব,নির্বিকার। শুকনো চোখে আগত অতিথিদের আপ্যায়ণ ছাড়া তার আর কোনো কাজ ছিল না। অঞ্জলী সেসময় নিজের বোধ-ভাবনা সবকিছুই জায়েদের কাছে বন্ধক রেখেছিল। জায়েদের ইচ্ছানুযায়ী অন্ধের মতো বাংলায় লেখা আরবী ভাষার কোরান শরীফ পড়েছে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে। তা দেখে আল্লাহ বা ফেরেস্তার দল কতটা খুশি হয়েছিল জানা নেই অঞ্জলির তবে জায়েদের পরিবার খুশি হয়েছিল আর ওদের বিয়েটা তখনই কনফার্ম হয়ে গিয়েছিল। এসব হুজ্জত-হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে বাবা গম্ভীর শোকাবহ আর জাঁকজমকের সঙ্গে কবরের ঠান্ডা মেঝেতে শুতে চলে গেলেন। ফোনে বাবার দাফনের কথা শুনে ছোটচাচা জানতে চেয়েছিল, দাদা তো এটা চাইত না তবে তোরা কেন এটা করলি? তোরা কেউ দাদার ইচ্ছার সম্মান দিলি না!
অঞ্জলীর মনে হয়েছিল,চাচ্চু কী অবাস্তব কথা বলছে! মৃত্যুর পর মানুষের কবর হবে; কবরের পর মানুষের আত্মা বেহেস্ত বা দোজখে চলে যাবে আর তার দেহ অনন্তকাল কবরে শুয়ে আখেরাতের নির্ভুল বিচার দিনের প্রতীক্ষা করবে এর চেয়ে চরম সত্য আর কিছু হতে পারে না। ওর একবারও মনে হয়নি, আত্মা যদি স্বর্গ বা নরকে চলেই গেল তবে আর নশ্বর দেহের কবরে শুয়ে থাকলেই কী না থাকলেই বা কী? দেহ তো এমনিতেই মাটিতে মিশে যাবে- বারো বছর পর অঞ্জলী এখন যা ভাবতে পারছে বাবার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে সে এইসব ভাবতে পারেনি। কেন তখন অঞ্জলীকে এইসব ভাবনা পায়নি? সে কি তখন ইচ্ছে করে অন্ধ-বধির হয়েছিল?
বাবার মৃত্যুর পর ব্যাপক আয়োজন এর কোথাও বাবার ইচ্ছা বা জীবিত বাবার ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ছিল না। আজ,অনেক বছর পর অঞ্জলীর মনে হয়, বাবার প্রতি সবার কী বেপরোয়া ক্ষোভ কাজ করছিল, জীবিত বাবাকে যারা জব্দ করতে পারেনি তারা মৃত বাবার ইচ্ছার প্রতি সম্মান না করে যথাযথ শোধটাই নিতে পেরেছিল।
অঞ্জলীর আর জায়েদের বিয়ে হতে আরও বছরখানেক সময় লেগেছিল। জায়েদের নিজের ব্যবসা গুছিয়ে নিয়েছিল আর অঞ্জলীর পড়াশোনা শেষ করতে। এছাড়া মা আর দাদির একার পক্ষে বিয়ের বিশাল ঝক্কি সামলানো সম্ভব ছিল না, তাই অপেক্ষা করতে হয়েছিল বড়ো বোন সাঝঁবাতি আর তার বরের দেশের ফেরার জন্য। বড়ো বোন আর তার স্বামীকে নিয়ে বিয়ের সব কেনাকাটা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ অঞ্জলিকেই করতে হয়েছিল। ছোটচাচা দেশে ফিরে এসেছিল ওর বিয়ের দু’দিন আগে,ধুম করে; কাউকে আগে থেকে না জানিয়ে। এসেই অঞ্জলীর বিয়ের আয়োজন দেখে বলেছিল, আমি তো ভেবেছিলাম তুই বুঝি বন্ধুর দল নিয়ে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করবি। কিংবা হয়ত এসে দেখব লিভ টুগেদারে আছিস।
ছোট চাচার কথায় অঞ্জলীর কান-ফান ধাঁ ধাঁ করে ওঠেছিল, কী বলে চাচ্চু! বিদেশে থাকতে থাকতে মাথা পুরাই নষ্ট! ভাগ্যিস জায়েদ বা ওর পরিবারের কারো সামনে এমন বেফাঁস কথাটি বলে ওকে শরমিন্দা করেনি।
পরে একা হওয়ার পর চাচ্চুর বলা লিভ টুগেদার অঞ্জলীর মাথায় কিলবিল করে। লিভ টুগেদার? জায়েদের সঙ্গে কি কখনও সম্ভব ছিল? জায়েদের সঙ্গে অঞ্জলী কয়েকবারই নির্জন ঘরে একান্ত নিজেদের আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার মতো সময় কাটিয়েছে। এমন পরিবেশে দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক প্রেমিকযুগলের মধ্যে একটি শারীরিক সম্পর্ক হতে পারে, এই নিয়ে অঞ্জলীর ভেতরে সংগোপনে একটি মানসিক প্রস্তুতিও ছিল, তাই তো ও জায়েদের সঙ্গে দেখা করার জন্য বন্ধুর একা ফ্ল্যাটে যেতে দ্বিধা করেনি। প্রথম প্রথম মানসিক প্রস্তুতির সঙ্গে মনের গোপন পুলক অঞ্জলীকে প্রজাপতির মতো হাওয়ায় উড়িয়ে রাখত,ও অদ্ভুত আত্মপ্রেমে নিজেকে সাজিয়ে তুলত, রাঙিয়ে তুলত।
অঞ্জলীকে চুমো খেতে খেতে জায়েদের যখন কিছুটা হলেও বেহুঁশ হওয়ার কথা তখন সে আঙুলের আলতো পোঁছে অঞ্জলীর ঠোঁটের লিপস্টিক তুলতে নিতে নিতে বলেছিল, তোমার ঠোঁট লিপস্টিক ছাড়াই অনেক সুন্দর, তা কি তুমি জানো?
তাই! অঞ্জলী জায়েদের কথা শুনেছিল কী শুনেনি, ও তখন ভাবছিল; পৃথিবী ধুলায় মিশে যাক আর আমি জায়েদের শরীরে মিশে যাই। জায়েদ তখন বিস্ময়কর জাদুকরের আঙুলের ইশারায় অঞ্জলীর শরীরের তন্ত্রে তন্ত্রে সম্মোহনের জাদু ছড়াচ্ছে। এক বিস্ফোরণের অপেক্ষায় অঞ্জলীর শরীরের কোষ-কোষ, তখন; তখনই জায়েদ নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সরিয়ে আনে নিজের দেহ অঞ্জলীর ওপর থেকে, অঞ্জলী অবাক হয়ে জায়েদের দিকে তাকায়,
ছি! আমরা কি পশু হয়ে যাচ্ছি! আমাদের এখনই এটা করা ঠিক হবে না রেহানা। ততদিনে জায়েদ অঞ্জলীকে রেহানা বলা শুরু করে দিয়েছে। কারণ হিসাবে ও বলেছে, রেহানা নামটি ওর মার খুব পছন্দ।
নারীটি তখনও কাঁপছিল। নারীর শরীরের মধ্যে জেগে ওঠা অজগরটি তপ্ত নিশ্বাস ছুঁড়ে দিয়েছিল ওর ওপর থেকে সরে যাওয়া পুরুষটির দিকে। অজগরটি হা করে আস্ত পুরুষটিকে গিলে নিতে চাইছিল নিজের ভেতর, আর তখনই পুরুষটি নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল নারীটির ওপর থেকে।
আমরা তো ক’দিন পর বিয়ে করছি। তখন সবকিছু হবে-তাই না? তখন তুমি আমার জন্য জায়েজ আর হালাল হবে। তাহলে এক্ষুনি এসব করে নিজেদের পাপী করছি কেন?
নারীর মুখে কোন কথা আসে না। নারীটি বালিশে মাথা চেপে ধরে, চোখ বন্ধ করে নিজের ভেতর হা করে তপ্ত নিশ্বাস ছুঁড়তে থাকা অজগরের টুঁটি টিপে ধরতে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা বোধ করে। কপালের দু’পাশের শিরাগুলো দপদপিয়ে রোষে ফেটে পড়তে চায়।
জায়েদ কোমল হাতে অঞ্জলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নসিহত করে চলে, অঞ্জলীর গায়ের কাপড় টেনে ঠিক করে দেয়। জায়েদের কোমলতা দেখে অঞ্জলী লজ্জা পেয়ে দ্রুত ওঠে কাপড় ঠিকঠাক করে নেয়। অঞ্জলী নিজেকে ধমকায়, তোমার মনে পাপ আছে। দেখো, জায়েদ কত ভালো আর নিরাপদ একজন মানুষ।
জায়েদের সঙ্গে অসমাপ্ত শারীরিক সম্পর্কের কারণে অঞ্জলীর চোখে জায়েদ ভালো আর নিরাপদ হয়ে উঠলেও তা ওর নিজের জন্য খুব ভালো কিছু ছিল না। জায়েদের সঙ্গে দেখা করে ফেরার পর ও’র মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতো অযথাই। আর পরবর্তী দিনগুলোতে জায়েদের সঙ্গে বন্ধুর ফ্ল্যাটে গোপনে দেখা করার জন্য মানসিক সায় পেত না। দিনের পর দিন জায়েদের অসমাপ্ত সেক্স পার্টনার হতে মন চাইত না। সে সঙ্গে অঞ্জলীর মনে ভাবনা দৃঢ় হচ্ছিল, ওরই মানসিক কোনো সমস্যা আছে; নইলে বিয়ের আগে সেক্সের জন্য এমন উন্মুখ হয়ে থাকা কেন! এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, সেক্সের জন্য বিয়ে কোনো বিষয় নয়, দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের পারস্পরিক আস্থা আর সমর্থন হলো বিষয়; তা প্রাপ্ত বয়স্ক একজন নারীর বোধে কী করে আসে না!