শুদ্ধস্বরের ৩০ বছরের প্রায় ‘অবিশ্বাস্য’ এই পথচলায় আমি নিজে যুক্ত হয়েছি একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে, কিন্তু সেটা এমন এক সময়ে যখন আমরা এক ভয়াবহ স্বৈরতন্ত্রের কবলে, যে স্বৈরতন্ত্র কোনো একজনকেই কেবল ‘স্বৈরাচার’ বানিয়ে তুলছে না, বরঞ্চ এর স্বৈরাচারী হাত ছড়িয়ে দিচ্ছে দিকে দিকে, চতুর্দিকে। রাষ্ট্রীয় সহিংসতার সাথে সাথে সামাজিক সহিংসতার উর্ধ্বমুখী রেখাচিত্র আমাদেরকে বারেবারে এই সত্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে।
শুদ্ধস্বরের এই যাত্রাকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলার কারণ হচ্ছে এই যে, বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্ম (বিভিন্ন আকার ও প্রকারে) হিসেবে শুদ্ধস্বরের এই যাত্রাপথে ঝরে গেছে বহু ‘রক্ত’। শুদ্ধস্বরের প্রকাশক টুটুল ভাইয়ের উপর মৌলবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণে সৌভাগ্যের ফেরে বেঁচে যাওয়ার ঘটনা আশা করি মনে করিয়ে দেয়ার দরকার নেই। অর্থাৎ, কেবল চিন্তাচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য এই রাষ্ট্র বা সমাজে প্রাণ দিতে হয়, জেল জুলুমের শিকার হতে হয়- এই বাস্তবতায় ৩০ বছর ধরে টিকে থাকাটা অবিশ্বাস্যই বটে।
বাংলাদেশে জ্ঞানজাগতিক কোনো সমাজ গড়ে না উঠার পিছনে উপনিবেশিক খাসলত ও এর দায়ভারের কথা সকলেই বলেছেন, এটা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশে একটা সংগ্রামও চলছে, তা পরিসরে ছোট হলেও। কিন্তু আপাতত আমাদের রাষ্ট্রকে দেখে মনে হচ্ছে, সে যেন আরো জোরেশোরেই উপনিবেশিক খাসলতকে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্কিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ এর বিভিন্ন ধারা-উপধারার দিকে চোখ বুলালে সেটা টের পাওয়া যায় সহজেই। ফলে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মাথায় জ্ঞানজাগতিক সমাজ গড়া দূরে থাক, উল্টো জ্ঞানচর্চার পথে বিস্তর কাঁটা বিছিয়ে দেয়া হচ্ছে।
জ্ঞানচর্চার পথ সুগম না হলে, পথ থেকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বাঁধা না সরালে, নিজেদের রাষ্ট্রটা নিজেদের জ্ঞানে চালানো সম্ভব হবে না। এই ‘চালানো’র জন্য দরকার মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মত ও চিন্তা প্রকাশের বিভিন্ন স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম যেখানে কিনা নাগরিকগণ নিজেদের ভালো-মন্দ নিয়ে ডায়লগে প্রবেশ করতে পারবেন। অর্থাৎ সমাজের জন্য কোনো ভালো কোনটা মন্দ সেটা কেবল উপর থেকেই নির্দেশিত হবে না, সেটা নিজেদের আলাপ-আলোচনার চর্চা থেকেই উৎসারিত হবে। অর্থাৎ, গণতন্ত্র কেবল তখন আর কেবল পাঁচ বছর পরপর ‘ভোট’ দেয়ার মতো ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, [অবশ্য পাঁচ বছর পর পর ‘সামান্য’ ভোট দেয়ার সৌভাগ্যও আমাদের কপালে জুটছে না] এটা বরঞ্চ চর্চার বিষয় হয়ে উঠবে, একটা প্রক্রিয়া হয়ে উঠবে। ‘শুদ্ধস্বর’ – এর মতন বহুমুখী প্ল্যাটফর্মের জরুরতের জায়গাটা আসলে এখানেই। আমাদের দরকার এমন আরো বহু ‘স্বর’।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা এই জরুরতকে আরো বড়ো আকারে সকলের সামনে হাজির করছে। কিছুদিন পূর্বে জিন শার্পের ‘ফ্রম ডিক্টেটরশিপ টু ডেমোক্রেসি’ নামক ছোট একটা পুস্তিকাতে একটা চীনা প্যারাবল পড়েছিলাম। শিন শার্প অহিংসবাদী আন্দোলনের প্রচারক; এই জমানার স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তিনি অহিংস আন্দোলনকেই সহি বলে মানেন। তো, প্যারাবলটা হচ্ছে এরকম: একদা চীনের এক প্রদেশে বাস করতেন এক ‘বানর সর্দার’, তার যাবতীয় কাজকারবার করে দেয়ার জন্য একপাল বানর সর্বদা কাজ করতো। প্রতিদিন বানরদের আদেশ দেয়া হতো পাহাড় থেকে খাবার-দাবার সংগ্রহ করার জন্য, বানররা সারাদিন পরিশ্রম করে যে খাবার সংগ্রহ করতো তা দিয়েই বানর সর্দারের দিন গুজরান হতো। যদি কোনো বানর নিয়মমাফিক কাজ করতে ব্যর্থ হতো তার জন্য ছিল কঠিন শাস্তি। তো, একদিন কাজের বেলা এক পিচ্ছি বানর জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বনের এই গাছপালা কি সর্দার লাগিয়েছিল? উত্তর আসলো, না, ওগুলো প্রাকৃতিক। এই প্রশ্নের পিঠে আরেকজন প্রশ্ন করলো, তাহলে কি আমরা বুড়া সর্দারের অনুমতি ছাড়াই এই ফলমূল নিতে পারি না? উত্তর আসলো, হ্যাঁ। আরেক পিচ্ছি বানর প্রশ্ন করলো, তাহলে আমরা বুড়া সর্দারের উপর নির্ভর করে আছি কেন? কেন তার গোলামী করছি? এই প্রশ্ন শুনেই বানররা আলোকিত হয়ে উঠলো, জেগে উঠলো। এবং, সে রাতেই বানররা বুড়া সর্দারের সকল ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলে; সর্দারের জন্য যোগাড় করা সকল খাবারদাবার নিয়ে চলে যায়। মুক্তির আস্বাদ পায়।
জিন শার্প এই প্যারাবলের বরাত দিয়ে কর্তৃত্বের বা ক্ষমতার উৎসগুলো খুঁজে বের করার বিভিন্ন তরিকা বাতলে দিয়েছিলেন। আমার কাছে এই প্যারাবলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, ‘প্রশ্ন’ করা: ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, ক্ষমতার বিষয়ে প্রশ্ন করা, ক্ষমতার কেন্দ্র নিয়ে প্রশ্ন করা। বাংলাদেশে আমরা আম-জনতারা যে জিন্দেগি বয়ে বেড়াচ্ছি, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে বিভিন্ন ধরণের ক্ষমতা ও‘হেজেমনি’কে প্রশ্নবিদ্ধ করাটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করি। এখানেই আবারো আসে ‘শুদ্ধস্বর’ এর মতন প্ল্যাটফর্মের জরুরত; আবারো বলছি, আমাদের দরকার এমন আরো বহু স্বর।
জিন শার্প তার বইতে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেছিলেন; এক, তিনি বলছেন যে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় এটা সবসময় মাথায় রাখা জরুরি, আন্দোলন কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, বরঞ্চ পুরো স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধেই। স্বৈরাচার হটানোর বহু নজির আমাদের দেশে আছে। আমাদের দেশের মানুষেরই আছে। আমি মনে আমরা আমাদের নিজেদের ইতিহাস ভালো করে পাঠ করলেই স্বৈরাচার হটানোর যুতসই পথ পেতে পারি। সবচাইতে বড়ো কথা, আমাদের স্বৈরাচার হটানোর ইতিহাস এই শিক্ষাও দেয় যে, স্বৈরাচার হটানো আর স্বৈরতন্ত্র এক জিনিস না। স্বৈরতন্ত্র বজায় রেখেও স্বৈরাচারকে হটানো যায়, তবে সেক্ষেত্রে স্বৈরাচার বারেবারে ফেরত আসবে। জিন শার্প এটাই বলছেন। কিন্তু আমার লেখার প্রধান আগ্রহ দ্বিতীয় পয়েন্টে।
দ্বিতীয় পয়েন্টটা হচ্ছে, যেহেতু আন্দোলন স্বৈরতন্ত্রেরই বিরুদ্ধে, তিনি সমাজে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতির গুরুত্বের কথা বলেন। একটা গণতান্ত্রিক সমাজ ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি প্রয়োজন, যেগুলো ধরণে হবে গণতান্ত্রিক এবং যেগুলোর ভেতর রাষ্ট্র ও সরকারের শুঁড় অনুপস্থিত থাকবে। বাংলাদেশে যে ধরণের ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চালু আছে সেখানে উপরোক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি ভীষণ প্রয়োজন। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এমনতর গণতান্ত্রিক (এবং রাষ্ট্রীয় ও সরকারী শুঁড়বিহীন) প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নেহাতই অল্প। বাংলাদেশে এই লড়াইয়ের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমন প্রতিষ্ঠান, তা আকারে যত ছোটই হোক, গড়ে তুলতে হবে। এইসব প্রতিষ্ঠান হতে পারে আমাদের মধ্যে ক্রমাগত আলাপ-আলোচনা-তর্ক-বিতর্কের মাধ্যম। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় ‘শুদ্ধস্বর’ এর সবচাইতে বড়ো ফজিলত হতে পারে এটাই।
‘শুদ্ধস্বর’ জেগে থাকুক, চিন্তাচর্চার জমিনে পরিণত হোক, এক স্বর থেকে আরো বহু স্বর গজিয়ে উঠুক- বাকস্বাধীনতাহীন সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করে এই ‘স্বাভাবিক’ চাওয়াটাইকে আজ খুব বড়ো মনে হচ্ছে।
Sohul Ahmed, activist, and author. Topics of interest are politics, history, liberation war, and genocide. Published Books: Muktijuddhe Dhormer Opobabohar (2017), Somoyer Bebyocched (2019), and Zahir Raihan: Muktijuddho O Rajnoitik Vabna (2020)