আমরা এমন একযুগে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। কালজয়ী এই উক্তির প্রবক্তা বাংলাদেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা। আহমদ ছফা তাঁর সময়কে চিহ্নিত করতে গিয়ে উল্লেখিত মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু ছফার এই উক্তি কি আজকের দিনে আরো অধিক প্রাসঙ্গিক নয়? আজকেও কি আমরা এই ভীষণ রকমের ‘anti knowledge’, ‘anti intellectual’ সময়ে রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি না? ইতিহাস সাক্ষী আক্ষরিক এবং রূপক দুই অর্থেই এই কথা সত্য।
উপরে যে জ্ঞানচর্চা এবং যেকোন প্রকারের বুদ্ধিজীবীতা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রতি চরম বিমুখ এক সময়ের কথা উল্লেখ করলাম, সেটা একদিকে যেমন বৈশ্বিক বাস্তবতা, ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের স্থানিক বাস্তবতাও বটে। অর্থাৎ বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা এমন এক সময় অতিবাহিত করছি, যা যেকোন চিন্তা ও দার্শনিক চর্চার জন্য ভীষণ রকমের প্রতিকূল এক সময়।
শুদ্ধস্বর’কে আমি এই সময়ের নিরিখেই পাঠ করি। একদিকে শুদ্ধস্বরের প্রকাশক কবি আহমেদুর রশীদ টুটুল নিজে উগ্রপন্থী ইসলামিস্টদের আক্রমণের শিকার হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, অন্যদিকে দেশের বাইরে অবস্থান করেও বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, নতুন চিন্তা দানাবাঁধার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত ভূমিকা রেখে চলেছেন। এরকম এক চরম শ্বাসরুদ্ধকর সময়ে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কী হতে পারে?
কথার জবাব কথার মাধ্যমেই হতে হবে। চিন্তার বিরোধীতা পাল্টা চিন্তার মাধ্যমেই হতে হবে। লেখার বিরুদ্ধে পাল্টা লেখা তৈরি করতে হবে। কথা-লেখা-চিন্তার জবাব যারা হামলা-খুন খারাবির মাধ্যমে দিতে চায়, তারা অন্যদের জন্য তো বটেই, এমনকি খোদ নিজেদের ধর্ম-মতাদর্শের অনুসারীদের জন্যও নিরাপদ নয়।
বাংলাদেশে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট চলছে। এই রাজনৈতিক সংকট একদিনে তৈরি করা হয়নি, এর পিছনে বছরের পর বছর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক এলিটদের ‘বিনিয়োগ’ আছে। পদ্ধতিগত চিন্তাহীনতা এবং ক্ষমতার অনুকূল চিন্তা মিলিয়েই আজকের বাংলাদেশ। কোথাও যেন কোন আশা নাই, দিশা নাই! পরিত্রাণের পথ যেন নাই! পৃথিবীর সর্বত্রই ইতিহাসের প্রত্যেক পর্বে এমন সময় আসে। এমন সময়ে গড্ডালিকাপ্রবাহে গা না ভাসানো কিংবা ক্ষমতার কাছে মাথা নত না করা বিরুদ্ধ স্রোতও থাকে, যারা একটা জনগোষ্ঠীর চিন্তা দানাবাঁধা এবং দার্শনিক গতিপথ ঠিক করে দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করে। আমি মনে করি অনলাইন স্পেসে শুদ্ধস্বর বর্তমানে সেই বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পথ দুর্গম, অনিশ্চিত কিন্তু ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা!
শুদ্ধস্বরের তিনদশক পূর্তিতে শুদ্ধস্বরের একজন লেখক হিশেবে, শুদ্ধস্বরের পাঠক হিশেবে আমি শুদ্ধস্বরের উত্তরোত্তর বিকাশ কামনা করি। লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মুক্ত বিচরণের ক্ষেত্র হয়ে উঠুক শুদ্ধস্বর! এই জনগোষ্ঠীর মন জাগিয়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ ভার বহন করে চলুক:
চিত্ত যেথা ভয়শুন্য, উচ্চ যেথা শির!
Sarwar Tusher is an author and activist; interested in studying the state, power, authority, sovereignty, violence, and social relations.