শেয়ার মার্কেট ধস, ঈশ্বরের বাজারদর সর্বনিম্নে

Share this:

কবিতা  ভাবনা

কবিতা বিষয়ে ভাবনা কী? কবিতায় দর্শন কতটা রচিত,কবিতা লেখার উৎস এবং কবিতা কতটা জরুরী আজকের কর্পোরেট যুগে।

কবিতা নিয়ে কখনও কিছু ভেবেছি কি আদৌ? স্মরণ হচ্ছে না। পারিপার্শ্বিকের চলমান ঘটনায় বিচলিত হয়েছি,হোক তা সমাজ-রাজনীতির, দেশি-বিদেশি,লিখেছি চট জলদি।কবিতার নামে,গদ্যের আদলে। কবিতা হয়নি নিশ্চয়। ছন্দ-টন্দ নিয়ে লেখাপড়া নেই তেমন, মাথাও ঘামাইনে। কান-এ যদি বেসুরো শোনায়, ঘঁষেমেজে দাঁড় করানোর চেষ্টা। এবং যা বলতে চাই,অর্থাৎ; যাকে বলেন ‘বক্তব্য’ পরিষ্কার কিনা সেটাই বিবেচ্য।

পাবনার জিসিআই  গোপালচন্দ্র ইন্সটিটিউট-এ ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন স্কুলের দেয়াল পত্রিকায় নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে লিখেছিলুম:

নজরুল জীবনে করেছে মস্ত ভুল

দাড়ি না রেখে রেখেছে চুল।

পড়ে, বাংলার শিক্ষক ডাস্টার দিয়ে পিটিয়েছিলেন।

কবিতা লেখার বাতিক পারিবারিক। ছোটচাচা আবুল কাশেম নাটক লিখতেন। তাঁর নাটক পাবনার বনমালী ইন্সটিটিউটে অভিনীত হতো। পরিচালকও তিনি। অগ্রজ জিয়া হায়দার কবিতা লেখেন,রশীদ হায়দার গল্প, মাকিদ হয়দার কবিতা, তো, সর্দির মতো ছোঁয়াচে! সংক্রামিত!

শুনেছি,খাঁটি কবি ভাবনাচিন্তা পোক্ত করে, এ লাইনে, ও লাইনে বা  স্তবকের পরতে পরতে তত্ত্বকথা লেখেন। দর্শনও থাকে।

মজার ঘটনা বলি। সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে গিয়েছিলুম। উপলক্ষ,আন্তর্জাতিক সাহিত্যানুষ্ঠান। দশ দিনের অনুষ্ঠান। পৃথিবীর নানা দেশের লেখক। কবির সংখ্যা বেশি। চল্লিশ জন। আয়োজকদের মহৎ উদ্দেশ্য। তিন দিন কবিতার ওয়ার্কশপ। একটি বড়ো হলঘরে। চল্লিশ জন কবি উপস্থিত। কবিতা লিখিয়েরা আসবে,শিখবে। আমরা ওয়াজ নসিহত করবো। প্রথম দিনে নয় জন হবু কবি,বয়স কুড়ি থেকে পচিঁশ। দ্বিতীয় দিনে তিন জন। তৃতীয় দিনে হল ফাঁকা।

আয়োজকদের একজন, যিনি দায়িত্বে ছিলেন আমাদের;মোলায়েম স্বরে বললেন,‘আপনাদের কবিতায় কী দর্শন, আগামীকাল ও পরশু অনুষ্ঠানে যদি বলেন (প্যানেল ডিসকাসন। ছয় জন,ছয় জন করে দুই অনুষ্ঠানে বারো জন),বিষয়টি উপভোগ্য হবে।’ সুইস কবি টেডিয়ুস ফাইফার মহাক্ষিপ্ত। টেডিয়ুস ফাইফারের মূল বক্তব্যের শানে-নযুল বাংলায় অনুবাদ করলে এই দাঁড়ায়: ‘ ধ্যাৎ মশাই,কবিতায় ফিলোসফি কী? যে কবি কবিতায় ফিলোসফি ফলায়, তা কবিতা নয়। কবি ও ফিলোসফার আলাদা। কবিতায় ফিলোসফি ফালতু বাতুলতা।’

নিজের কবিতা বিষয়ে বলতে অপরাগ। জ্ঞান পাপীরা বলে না। আজকের টাল-মাটাল পৃথিবীতে,কর্পোরেট আচ্ছাদিত পৃথিবীতে, ধনতন্ত্রের যাঁতাকলে,রাজনীতিমাখা হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে কবিতার কদর প্রায় নেই। ইউরোপে কবিতার বই অচল, বিক্রি হয় না। স্ক্যান্ডেনেভিয়ার সরকার কবিদের অর্থ সাহায্য করে কবিতার বই প্রকাশার্থে এবং সরকারই কেনে সারা দেশের লাইব্রেরির জন্যে।

পৃথিবীতে আবেগ, ভাবাবেগের দিন অচল। নিত্য দিন আর্থিক সমস্যা,বেকারত্ব শনৈ শনৈ। কঠোর-কর্কশ জীবন। কবিতা নিয়ে কে আর ঘিলু খামচায়? বাংলাদেশে ভিন্ন চিত্র।

আপনার একটি প্রশ্ন মন্দ নয়,‘কখন কীভাবে কবিতার উৎস, মুহূর্ত তৈরী। কীভাবে বিস্তারিত।প্রেক্ষিতে সমাজ,দেশ, রাজনীতি কতটা ঘনবদ্ধ, প্রকাশিত।’ হাল-আমলে সমসাময়িক বিষয়াবলী টানা-পোড়েনই কবিতার উৎস। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কেউ লিখবো না আজ । টেডয়ুস ফাইফার লিখেছেন,‘মেঘের চরিত্রে বিষ/অহর্নিশ /কামানের গোলা।’

প্রেরিত কবিতাগুলোয় রাজনীতি স্পষ্ট, কোনো বিশেষ দেশ, বিশেষ শাসক, রাজন্যবর্গ নয়,বিশ্বের আজকের রাজাধিরাজের শাসন,চরিত্র,সমাজ রাজনীতির চিত্রন। বলেছি প্রতীকে, আড়ালে আবডালে। বলেছি, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দৃশ্যমানতায়। কবিতা নয় হয়ত, দরকারও নেই, কবিতার আদলে মূল বক্তব্য, মনোবেদনা।

মানি, আনন্দ ও বেদনা থেকেই কবিতা, কবিতার উৎস।কীভাবে বিস্তার সে অন্য প্রসঙ্গ। কবিতার দেশকাল একাকার।

সংস্কৃত ভাষায় কবিকে ‘ক্রান্তদর্শিন’ বলা হয়। বাংলায় ‘ক্রান্তদর্শী।’ অর্থাৎ সর্বদর্শী বা সর্বাজ্ঞ। কবি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। সেই অর্থে দার্শনিকও। প্রাচীন গ্রিসেও এরকম ধারণা ছিলো। কিন্তু প্লেটো এসে ওলোট-পালোট করেন,বলেন; সব মিথ্যে, গাঁজাখুরি। প্রমাণ- নেই। দেবতাদের মুখ দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প-কেচ্ছা। কবি কি দেবতা দেখেছেন? কবে, কোথায়, কী বলেছেন, শুনেছেন? কবির কানে -কানে কথা বলেছেন? প্রমাণ কী?

‘কবিরা মিথ্যুক।’ আরো অভিযোগ প্লেটোর,‘কবির বাস ইউটোপিয়ায়।’ অতএব ,কবি দার্শনিক হতে পারে না।ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিলেন,পারেননি। প্লেটোকে মান্য করেছেন বহু দার্শনিক, সেকালে, একালেও। কবি দার্শনিক না হলেও,দার্শনিক কবি। দর্শন থেকে বিস্তর কবিতার উৎপত্তি। নানা ভাষ্যে, নানা চিন্তায়,নান প্রতীকে, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে।

নিজের কথা বলতে পারি, কবিতায় কোনো দর্শন নেই, যা আছে নিজের সময়কালীন রাষ্ট্র সমাজের মূল সমস্যার স্তর রচনা। প্রেমের কবিতায় কল্পনা বিলাসীর যে বিরহ-কাতরতা, রাজনীতি ও ইতিহাসবোধে সমকালীনতার সমস্যা,নাগরিকের অসহায়তা প্রকাশ করেছি। কখনো নিম্নস্বরে, কখনো বজ্রনিনাদে,কখনো-বা গল্পোচ্ছলে। নিজেকে জড়িয়ে বা আড়ালে রেখে। প্রত্যেককে সামিল করে। বোধ হয়, একজন কবির দায়িত্ব তাই।

পাঁচ দশকের বেশি পদ্যটদ্য লিখি,অনেক বছরই টানা মুক্তগদ্যে,ভাবলুম,লিখলুম, চটজলদি সবই। এই অভ্যেস নেই আর, অনেক, অনেক দিনই। অন্ত্যমিলে ঝোঁক এখন। মনে হয়, অন্ত্যমিলে আবশ্যকতা কবিতার জন্য জরুরী, আদি শর্তও। অন্ত্যমিলে নাকি কবিতার বক্তব্য মার খায়,বলেন কেউ কেউ। দেখার বিষয়,কখন প্রয়োজন কখন নয়।শুনেছি, এখন অন্ত্যমিলের কবিতা পড়তে পাঠকের অনীহা, কয়; ‘সেকেলে’। কালের বিচারে হয়ত একালের নই, অনাধুনিক।

ওই যে বলেছেন ‘কবিতার উৎস’,মনে পড়লো, লিসবনের সাহিত্যানুষ্ঠান চলাকালীন, এক সুন্দরী ‘গুম।’ মিডিয়ায় হৈচৈ। পর্তুগিজ ভাষা জানিনে। লোকমুখে শোনা,গুম নয় কেবল,রাজনীতিও আছে।’ বিষয়টি চক্কর দিলো মগজে। এক বোতল রেড ওয়াইন যখন শেষ, আরে আমাদের দেশীয়!!’ কোন দৃশ্যকল্পে, কোন চালচিত্রে অঙ্কন জরুরী? প্রেম, রাজনীতি, অর্থ, মূল্যবোধ, পুলিশ, র‍্যাব, ব্রাহ্মণ(শাসক) প্রত্যেকের উপস্থিতি অল্পকথায়।

এই কবিতা পড়ে পাঠকের ধারণায় দানা বাঁধবে না,মূল উৎস কী।কবিতার মূলে কে?
কবিতাটি ‘যোজনের পর যোজন-বিস্তৃত প্রান্তর’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত। প্রকাশক ঢাকার ‘নান্দনিক।’

 

শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ

ব্লাডব্যাঙ্কে রক্ত দিয়েএসেছি
মথুরা,রাধিকার খোঁজে
শুনলুম কারা যেন ফুসলিয়ে
নিয়ে গেছে মুঘল হারেমে,পাওয়া দুষ্কর সহজে।
একজন বললেন,‘হয়তো গিয়েছে ফ্যাসন প্যারেডে
কিংবা শুয়ে আছে চাণ্যকের বেডে’
‘প্রেম আর রাজনীতি এখন সমার্থ,
আর্থসামাজিকে এই মূল্যবোধই নৈতিক,যথার্থ’
-মিথ্যে নয়।তথাপি তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
ক্রসফায়ারে পড়েছে কিনা,সন্দেহ করছে বেদজ্ঞ ব্রাক্ষণ
ব্যাপারটি নিয়ে র‌্যাব-পুলিশ নিশ্চুপ। চারদিকে সারপ্লাস
গুঞ্জরণ। ঘটনা লক্ষণীয়,শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ

*আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলকে লিখিত চিঠি।

 

 

 

 

 

মাটির শরীর

দুনিয়ার যত শয়তান
প্রত্যেকে আমার ভগবান

আমাদের দেশকাল নেই
আমাদের সকাল-বিকাল নেই
আমাদের জাতি-ধর্ম নেই
আমাদের ত্রিবর্গ, ত্রিশূল, বর্ম নেই
আমরা জীবনমৃত
আমরা বহিরাগত

শয়তান ছাড়া মুক্তি নেই মানুষের পৃথিবীর।
রক্তকণা  দিয়ে মাটির শরীর
গড়েছে যে-শয়তান
সে  আমার বিশ্বস্থ- কুলীন ভগবান

 

অসীম জলধি

শেয়ার মার্কেট ধস, ঈশ্বরের বাজারদর সর্বনিম্নে।
বানিজ্যে বসতে লক্ষ্ণীঃ উধাও। ঘটনার মূলে কে, বিশ্বব্যাঙ্ক,
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, কর্পোরেট সংস্থা হদিস পাচ্ছে না।

কমিউনিজম গোল্লায় গেছে বলে বগল বাজিয়ে তা ধিন তা ধিন
নাচছিল যারা, কান্ড দেখুন, ধনতন্ত্রের ভবিষৎ নিয়ে মাথা
খামচিয়ে দিশেহারা।

আমাদের জমিজমা-বাস্তুভিটে কার হস্তগত, কোন
শাসক, মস্তান কেড়ে নিচ্ছে প্রত্যেকে জানেন, আমরা রা কাড়িনা,
শিরোচ্ছেদেও হাহুতাশ করবে না কেউ, পাছে গর্দান কাটা যায়।

দলিত মানুষগুলো সমবেত হবে একদিন, শেয়ার মার্কেট আবার
চাঙ্গা, ঈশ্বরের নামগন্ধ মুছে যাবে, রবীন্দ্রনাথই তখন অসীম জলধি

 

ক্ষমতাবান

না-বলা কথার কণ্ঠস্বরে
আর্তনাদ রয়ে গেল কিছু?
চোখের সামনেপেছনে ভদ্র-ইতরে
খুলছে মুখোশ, মাথা উঁচু।

আমার বাকল খুলে গেছে গভীর গোপনে,
আপাদমস্তক ভিন্ন জট।
নিজেকে আড়াল রেখে বাঁচি অকাল বোধনে,
ঘাড়ে দু’টি মাথা নেই। সেজেছি অলীক নট।

আমার নিজস্ব কিছু নেই তোমার জগতে,
তুমি অমিত ক্ষমতাবান।
তোমাকে কুর্নিশ ছাড়া পথে ও বিপথে
খতম নিশ্চিত, নিমিষে উধাও কবর-শ্মশান।

মেঘের ভিতরে সিঁদুরের মেঘ,
মেঘে মেঘে বেলা
সঞ্চিত উদ্বেগ

সারাদিন নিমোর্ক-নৃত্য, সারারাত ট্যারেন্টেলা

 

কিসের আওয়াজ?

‘এই দেশে
বেঁচে থাকা সমূহ বিপদ।
দমবন্ধ পরিবেশে
ওৎ পেতে আছে সহস্র শ্বাপদ।

‘নিশ্বাস নিতে ভয়, সূর্যকরোজ্জ্বল দিনে
ঘোর অন্ধকার।

‘কোথায় পালাবে তুমি, কোন অরন্যগহীনে?
নেকড়ে-হায়েনা ছিঁড়ে খাবে রক্তমাংসহাড়।

‘জীবন এখানে অসহনীয়, কণ্ঠরোধ।
প্রতিবাদের ভাষাও হারিয়ে গিয়েছে আজ।
মৃত্যু যে আসন্ন, ভুলে গেছি সেই বোধ।

হৃৎপিন্ডে কিসের ধ্বনি, কিসের আওয়াজ?

 

আমিই দেশকাল, বিধাতা

শুনুন দা ভিঞ্চি
এদেশের প্রতি ইঞ্চি
আমার চাই

যত খুশি আঁকুন সুন্দরী
আপনার দেহঘড়ি
আপনার ভিতরে নাই

কখন কী ভাবে আমার দখলে
কোন ছলে, মন্ত্রবলে
জানা মূর্খামি

আজ যা আছে কালকে নয়
পাল্টিয়ে গিয়েছে পৃথিবী, সময়
গৃহকর্তাও নয় গৃহস্বামী

আমি-ছাড়া সামনে-পেছনে
আর কে আছেন সংগোপনে
কার ঘাড়ে কয়টি মাথা?

বিনাশমন্ত্র আমার গান
সুর-লয়ে বাধা দিলে ছিন্ন হবে জন্মের গর্দান
আমিই দেশকাল, বিধাতা

 

 

 

 

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!