সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও বর্ণবাদের ‘আগুন’

Share this:

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকার মহানবীকে কোন এক ‘কটূক্তি’ করেছে, এরপর তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হলো, সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হলো, তার শাস্তি চেয়ে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী ছাত্রসংগঠনও রাস্তায় নামল। একটা কালেক্টিভ ও প্রাতিষ্ঠানিক জুলুম করা হচ্ছে তার প্রতি।এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

 

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি

গত কয়েকদিনে বাংলাদেশে কোরআন ও নবী ‘অবমাননা’কে কেন্দ্র করে নানামুখী তাণ্ডব ঘটে গেছে। লালমনিরহাটে একজন ব্যক্তিকে কোরআন ‘অবমাননার দায়ে’ পিটিয়ে-পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে ‘তৌহিদি জনতা’, পরে অবশ্য জানা গেছে যাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তিনি কোরআন ‘অবমাননা’ তো দূরে থাক, একজন বিশ্বাসী মুসলমান। কিন্তু কোরআনের মর্যাদা রক্ষায় উন্মত্ত মবের আসলে প্রয়োজন ছিল নিজেদের সার্বভৌম সন্ত্রাস প্রয়োগ করতে পারার মতো একটি কাঙ্ক্ষিত বলি, সেই বলি বিশ্বাসী কি অবিশ্বাসী তাতে সামান্যই কিছু যায় আসে। যদিও স্পষ্ট করেই বলে রাখা প্রয়োজন, এমনকি একজন অবিশ্বাসী, সত্যিকার অর্থেই ‘অবমাননাকারী’ ব্যক্তিকেও কোনভাবেই পিটিয়ে কিংবা পুড়িয়ে মারা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এও উল্লেখ্য যে, যে ইসলামিক আইনের দোহাই দিয়ে প্রায়শই নাস্তিক মুরতাদদের ‘কতল’ করার প্রচার প্রচারণা চালানো হয়, সেই আইন-বিধিবিধানও খোদ রাজনৈতিক ইসলামের নানা ধারার দ্বারাই নিদারুণ অপব্যাখ্যার শিকার।

লালমনিরহাটের ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা কাটতে না কাটতেই কুমিল্লার মুরাদনগরে হিন্দুপল্লীর বেশ কয়েকটি বাড়িতে পরিকল্পিত হামলা ও লুটপাট চালানো হয়েছে। সেই একই ‘অবমাননা’র ছুতায়। যদিও বাংলাদেশের ইতোপূর্বের এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার সাথে মুরাদনগরের হামলার ঘটনার কাঠামোগত সাদৃশ্য আছে। পরিকল্পনা, লোক জড়ো করা, মাইকিং করা, সমাবেশ করা, পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করা এবং হামলা করা; সেই একই চক্র কুমিল্লার হামলার ঘটনার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। আমরা পরবর্তীতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করব।

একই সময়ে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কথিত অবমাননার জের ধরে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বহিস্কারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান। পুরো প্রক্রিয়াটা খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রথমে একজন শিক্ষার্থীর ফেসবুক পোস্টকে ছাত্রলীগ ভাইরাল করে, পোস্টদাতা শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ভার্চুয়াল ‘মব’ জড়ো করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, শাস্তির দাবি জানায় এবং শেষতক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কয়েক মাস আগে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘কটূক্তি’, ‘মানহানী’, ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যৌথ প্রযোজনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একের পর এক মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। সেই একই প্রক্রিয়ায় এখন ‘ধর্ম অবমাননা’র দোহাই দিয়েও বহিস্কারের মতো ঘটনা ঘটছে।

উল্লেখিত তিন ধরনের নিপীড়নের প্রেক্ষিতে স্বভাবতই যে প্রশ্ন তৈরি হয়, বাংলাদেশে হঠাৎ কী এমন ঘটল যে নবী ও কোরআন ‘অবমাননা’র দায়ে একের পর এক বীভৎস জুলুমের ঘটনা ঘটে চলেছে? এমনকি ফ্রান্স নিয়ে ট্রল করা কিংবা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের পক্ষে অবস্থান নেয়াকেও ‘অবমাননা’ হিশেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে। ধর্ম ‘অবমাননা’র সংজ্ঞা ও পরিসর এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে!

 

ফ্রান্সের ঘটনাবলি

ঘটনার শুরু সুদূর ফ্রান্সে। ফ্রান্সে একজন ইসলামিস্ট মৌলবাদী স্যামুয়েল প্যাটি নামক এক শিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করেছে নবী মুহাম্মদের ব্যঙ্গচিত্র ক্লাসরুমে প্রদর্শনের জের ধরে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপসহ গোটা বিশ্বেই এই বর্বরোচিত খুনের তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ফ্রান্সের মুসলিম কমিউনিটিও দ্যর্থহীনভাবে এই খুনের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। মুশকিল হয়েছে যখন ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের দোহাই দিয়ে ফ্রান্স সরকার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নবী মুহাম্মদের ব্যঙ্গচিত্রগুলো জনপরিসরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে ফ্রান্সসহ ইউরোপে আগে থেকেই বিরাজমান মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদকে অত্যন্ত পদ্ধতিগতভাবে আরো একদফা উস্কে দিয়েছে। যেকোন মানবিক সমাজে সেই দেশের সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দায়িত্ব থাকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ সংবেদনশীলতা ও সহানুভূতির পরিবেশ নিশ্চিত করা। বিশেষত যেহেতু ফ্রান্সে মুসলিম নাগরিকরা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সবভাবেই ব্যাপকভাবে প্রান্তিক।

এখানে স্পষ্ট করেই উল্লেখ থাকা আবশ্যক, একজন শিক্ষক কিংবা অন্য যে কেউ সর্বোচ্চ ব্লাসফেমাস কোন উক্তি বা কাজ করলেও তাকে হত্যা করা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। হত্যাকারীকে শাস্তি পেতেই হবে। কিন্তু একজন ব্যক্তির কৃত অপরাধকে কেন্দ্র করে যখন গোটা একটি কমিউনিটিকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে আহত করার আয়োজোন চলে, তখন তা স্পষ্টতই বর্ণবাদ। বিশেষত খোদ ফ্রান্সেই এমনকি ইহুদিবাদের (zionism) বিরুদ্ধে যৌক্তিক সমালোচনা কার্যত আইনত নিষিদ্ধ। ইহুদিবিদ্বেষ (anti-semitism) বর্ণবাদ, কিন্তু ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ ইজরায়েলের মতাদর্শিক যুক্তি/ভিত তৈরি করে যে ইহুদিবাদ সেটারবিরোধীতা/সমালোচনা (anti-zionism) তো রাজনৈতিক অবস্থান! তো, ফ্রান্সে anti-zionist অবস্থান নেয়া না গেলেও, ইসলাম প্রশ্নে বর্ণবাদী বক্তব্য, ঘৃণাসূচক কর্মকাণ্ড মত প্রকাশের ‘স্বাধীনতা’! এক্ষেত্রে ফ্রান্স সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ‘পরম’ অবস্থান গ্রহণ করে।

ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ফ্রান্সের মুসলিম কমিউনিটির প্রতি বর্ণবাদী ট্রিটমেন্টের তীব্র সমালোচনা হয়েছে বিশ্বজুড়েই এবং সেই সমালোচনাসমূহ অত্যন্ত যৌক্তিক। যে শার্লি হেবদোকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স মত প্রকাশের ‘স্বাধীনতা’ বিষয়ক চূড়ান্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে, খোদ সেই শার্লি হেবদো তাদের প্রতিষ্ঠাতাকালীন একজন কার্টুনিস্ট  Maurice Sinet কে বহিস্কার করেছিল কয়েক বছর আগে কারণ তিনি মন্তব্য করেছিলেন ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারোজির ছেলে অর্থের লোভে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেছে। কেবলমাত্র এই মন্তব্যের জের ধরে শার্লি হেবদো তাদের কার্টুনিস্টকে চাকরিচ্যুত করে। শার্লি হেবদো বর্তমানে সেই ভূমিকাই পালন করছে, যেটা গত শতকের তিরিশের দশকে ইহুদিবিদ্বেষী জার্মান পত্রিকা Der Stürmer করে থাকত। ইউরোপের তৎকালীন সংখ্যালঘু ও নির্যাতিত সম্প্রদায় ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো ছিল এই পত্রিকার প্রধান কাজ।

আসলে ইমানুয়েল মাক্রোঁ তার সরকারের অব্যাহত ব্যর্থতার মুখে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লি পেনের সাথে ডানপন্থী দৌড়ে পাল্লা দেয়ার চেষ্টার করছেন। যে কারণে ‘লিবারেল’ মাক্রোঁর পর্যন্ত ডানপন্থী রেটরিক দরকার। ইয়েলো ভেস্টসহ ফ্রান্সে জনসংশ্লিষ্ট দুর্দান্ত সব আন্দোলনের বিরাজমান বাস্তবতায় ফ্রান্সের জনগণের মনোযোগ সরানো দরকার আর মনোযোগ সরাতে চাই কল্পিত ‘শত্রু’। আপাতত মুসলমান আর আফ্রিকান অভিবাসীরাই সেই ‘শত্রু’। তাদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত ঘৃণা উস্কে দিয়ে নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চান মাক্রোঁ ও লি পেন উভয়েই। এ যেন কে কার চেয়ে বেশি ডানপন্থী হতে পারেন সেই প্রতিযোগীতা! যাই হোক, তবে এটাও সত্য যে বিগত কয়েক বছরে ফ্রান্স একাধিক সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে। এসব হামলাকে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স ‘সভ্যতার সংঘাত’ আকারে পাঠ করতে ও করাতে চায়, যে ‘সভ্যতার সংঘাত’ এ ইসলাম ও মুসলমানরা সভ্যতার ‘অপর’। কোন ‘সভ্যতা’? যে (পশ্চিমা) সভ্যতা নিজেই এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকাসহ মেজরিটি দুনিয়া জুড়ে শতশত বছর ধরে নির্মম উপনিবেশ চালিয়ে নিজে ‘সভ্য’ হয়েছে।

ফ্রান্সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ বর্ণবাদী ঘৃণার বাতাবরণ বিরাজ করে। এই বাস্তবতা না জেনে বা না বুঝে ফ্রান্স সরকারের বর্তমান মুসলিমবিদ্বেষী অবস্থানকে ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’ ইত্যাদি হিশেবে আখ্যায়িত করা হয় শঠতা অথবা নির্বুদ্ধিতা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ফরাসি সমাজে বিদ্যমান বর্ণবাদী ঘৃণার বাস্তবতা নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে বিস্তারিত আলাপের প্রয়োজন আছে। আবার এ কথাও সত্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বর্ণবাদ কোনভাবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তির কৃত অপরাধের জাস্টিফিকেশন হতে পারে না। হত্যাকাণ্ড বা হামলার মতো ঘটনা কখনোই জাস্টিফাইড হতে পারে না। অপরাধীর শাস্তি অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু উদ্বেগটা রাজনৈয়িক বয়ানকে কেন্দ্র করে। একটা খুনকে কেন্দ্র করে গোটা একটা কমিউনিটিকে যেভাবে ‘উগ্রপন্থী’, ‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘জঙ্গি’ তকমা দেয়া হচ্ছে এটা পরিস্কারভাবে দানবায়ন প্রকল্প।

আবার খোদ ফ্রান্সেই এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যাখ্যা করার নজিরও আছে। উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক গবেষক অলিভিয়র রয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর Jihad And Death বইতে অকাট্য যুক্তিতে দেখিয়েছেন ফ্রান্সসহ ইউরোপে চলমান জঙ্গি তৎপরপতা ও হামলা radicalization of Islam নয়, Islamization of radicalism; স্বতন্ত্র কোন লেখায় এ নিয়ে বিস্তারিত আলাপের আশা রাখি। আপাতত বন্ধু ও সহযোদ্ধা সহুল আহমদের এই লেখাটি দেখা যেতে পারে।

 

বাংলাদেশ: ‘অবমাননা’র জের ধরে জুলুমের রাজনীতি

প্রাসঙ্গিক কারণেই ফ্রান্সের প্রসঙ্গ টানতে হলো। ফ্রান্সে স্যামুয়েল প্যাটির নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাকাণ্ড পরবর্তী ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ফ্রান্সের সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি উস্কে দেয়া বর্ণবাদকে কেন্দ্র করে সারা দুনিয়ায় নানামুখী প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তবে বলাই বাহুল্য, সেইসব প্রতিক্রিয়ার সবটাই ন্যায্য কিংবা যৌক্তিক কোনটাই নয়। স্যামুয়েল প্যাটির হত্যাকাণ্ডের নিঃশর্ত, নিঃসঙ্কোচ নিন্দা এবং ফ্রান্স সরকারের মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদের সমান্তরাল সমালোচনা ও নিন্দার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু বিশেষত বাংলাদেশে আমরা ফ্রান্সের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি, বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে, তার বেশিরভাগটাই ডানপন্থা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার দোষে দুষ্ট।

এখানে আরেকবার নিজের অবস্থান পরিস্কার করার প্রয়োজন বোধ করছি, বাংলাদেশের বিরাজমান ইসলামপন্থী দলসমূহের রাজনৈতিক এজেন্ডা, বক্তব্য বিবৃতি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার ঘোরতর সমালোচনা ও বিরোধীতা আছে, কিন্তু আমি তাদের শান্তিপূর্ণ রাজনীতি করার অধিকারের পক্ষে নিঃশর্ত, এমনকি যদি সেই রাজনীতির প্রতি আমার ব্যক্তিগত সায় নাও থেকে থাকে। ফলে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক নবী মুহাম্মদের ‘অবমাননা’র প্রতিবাদে তারা রাজপথে কোন কর্মসূচি নিলে (যেটা তারা করেছে), সেখানে আমার আপত্তি বা সমালোচনা করার কিছু নেই। কিন্তু সমালোচনা আছে তাদের বক্তব্য কিংবা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অপরাপর কর্মকাণ্ডের।

যেমন ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে একটি বিক্ষোভ কর্মসূচি আয়োজিত হয়। সেই কর্মসূচি থেকে অস্ত্রের ছবিযুক্ত ব্যানার ব্যবহার করেছে হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী। একইসঙ্গে ‘ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রোকে হত্যা করার’ প্রত্যাশা জানিয়ে ফেস্টুনও ব্যবহার করেছেন বিক্ষোভকারীরা। এসব ফেস্টুন মাদ্রাসার ভেতরেই তৈরি করেন সংশ্লিষ্ট কয়েকজন শিক্ষার্থী। অনেকটাই জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস-এর পতাকার আদলে তৈরি এই ব্যানারে ইসলামের ‘কালেমায়ে শাহাদাত’কে ব্যবহার করা হয়েছে। একটি রাইফেলের ছবি ব্যানারের ডানদিকে ও ব্যানারের নিচের অংশে একটি তরবারিতে একটি হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে, যার অর্থ ‘আমরা মোহাম্মদের (সা.) হাতে বায়াত হয়েছি, যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন জিহাদ করে যাবো’। কওমি মাদ্রাসার একাধিক শিক্ষার্থী জানান, স্লোগানটি আল কায়েদার স্লোগান ছিল, এখনও বিশ্বের জিহাদপন্থীরা এটি ব্যবহার করে। (বাংলাট্রিবিউন, অক্টোবর ২৭)

গত নভেম্বর ২ তারিখে, হেফাজতে ইসলামের আয়োজনে ঢাকায় ফ্রান্স দূতাবাস ঘেরাও এর কর্মসূচি ছিল। সেই কর্মসূচি থেকে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরি বলেন, “আমরা চাই আমাদের সরকার আরও ১০০ বছর ক্ষমতায় থাকুক। কিন্তু আমাদের দাবি পূরণ করে ক্ষমতায় থাকতে হবে। সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শুকরিয়া আদায় করছি। আপনাদের কথা রক্ষা করে এখানেই থেমে গেলাম। প্রয়োজনে আগামী কর্মসূচিতে এখানে থামব না।”

একই কর্মসূচি থেকে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিও জানানো হয় সরকারের প্রতি।

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই ‘ঘেরাও’ কর্মসূচি থেকে লালমনিরহাটের পুড়িয়ে মেরে ফেলার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা কিংবা মুরাদনগরের হিন্দুপল্লীতে ভয়াবহ হামলার ঘটনা কিংবা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বহিস্কারের নিন্দা জানানো হয়েছে বলে অন্তত পত্রিকা মারফত আমরা জানতে পারিনি!

আপত্তি মূলত এখানেই। সুদূর ফ্রান্সে মহানবীর ‘অবমাননা’ নিয়ে যে বিপুল তৎপরতা দেখা গেছে, তার কিয়দংশ তৎপরতা সহিংসতার সম্মুখে উন্মোচিত বাংলাদেশের মানুষের জন্য দেখা যায়নি। অথচ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম তো ইসলামই! সেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী একজন ব্যক্তিকেই আগুনে পুড়ে মরতে হলো। এই পুড়িয়ে মারার মতাদর্শিক ভিত তিলতিল করে গড়ে তোলা হয়েছে।

আগেই পরিস্কার করেছি যে ইসলাম ধর্মের মহানবীর অবমাননাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ-কর্মসূচিতে কিংবা মোটাদাগে ইসলামিক মতাদর্শকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করার মধ্যে আমি কোন সমস্যা দেখিনা। সেই রাজনীতির প্রতি আমার সমালোচনা ও বিরোধীতা থাকতে পারে কিন্তু তাদের রাজনীতির অধিকার নিঃসন্দেহেই আছে। কিন্তু ফ্রান্সের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত ইসলামিক রাজনৈতিক মহলে যে ধরনের মবিলাইজেশন লক্ষ্য করা গেছে, তা আসলে সম্পূর্ণতই এইসব রাজনৈতিক দলের নিজস্ব শক্তি-বৃদ্ধি, সরকারের সাথে দর-কষাকষি আর কোন না কোন সুযোগে নিজেদের দৃশ্যমান করে তোলার অভিলাষের বাইরে তেমন কোন জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নয়। এটাও মনে রাখা দরকার, ফ্রান্সে মুসলমান সম্প্রদায় প্রান্তিক সম্প্রদায়, বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায় অন্তত ধর্মের দিক থেকে প্রবল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়।

 

ব্যক্তির ‘ভুল/অপরাধ’ বনাম প্রাতিষ্ঠানিক জুলুম

একজন ব্যক্তির কৃত কোরআন বা নবীর ‘অবমাননা’, কোনভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক বা কালেক্টিভ জুলুমের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। কেউ যদি মনে করে কারো কোন আলাপে ‘মুশকিল’ আছে, তাহলে সেই আপত্তি/মুশকিলের শান্তিপূর্ণ সুরাহা করতে পারার বন্দোবস্ত যদি সেই সমাজে না থাকে, যদি অন্যের ওপর জুলুম না করে ভিন্নমত (এমনকি ‘কটূক্তি’) মোকাবেলা করতে পারার মেকানিজম কোন সমাজে না থাকে, যদি কোন না কোন ফর্মের শাস্তি/দণ্ডবিধিই শেষ কথা হয়, তাহলে সেই সমাজ সমাজ ও জনগোষ্ঠী মৃত জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর অন্তরে আসলে সিলমোহর মেরে দেয়া হয়েছে।

 

‘ভুল’ বা ‘কটূক্তি’ করা ব্যক্তি যদি ধর্মীয়/জাতিগত/লিঙ্গগত সংখ্যালঘু হয়, সেক্ষেত্রে তার/তাদের করা কোন ‘ভুল’কে আরো বিশেষ সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বিগত দিনগুলোতে যে ফ্রান্সের সমালোচনা হয়েছে, সেটা তো এইজন্যই হয়েছে যে একজন ব্যক্তির অপরাধকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স সরকার-রাষ্ট্র তার ইতোমধ্যেই প্রান্তিক সংখ্যালঘু কমিউনিটিকে আঘাত করছে, তাদেরকে সিস্টেমেটিকালি আরো কোণঠাসা করছে। ব্যক্তির ‘ভুল’ বা ‘অপরাধ’ আর সমষ্টির কাউন্টার-অপরাধ তো কোনভাবেই এক পাল্লায় মাপার সুযোগ নেই। ব্যক্তির অপরাধের পেছনে যদি কোন ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠানের আস্কারা-আশ্রয়-প্রশ্রয় থাকে(যখন ছাত্রলীগ আওয়ামীলীগের কেউ কোন অপরাধ করে), সেটা ভিন্ন ব্যাপার।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকার মহানবীকে কোন এক ‘কটূক্তি’ করেছে, এরপর তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হলো, সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হলো, তার শাস্তি চেয়ে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী ছাত্রসংগঠনও রাস্তায় নামল। একটা কালেক্টিভ ও প্রাতিষ্ঠানিক জুলুম করা হচ্ছে তার প্রতি।এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।

এই শিক্ষার্থীর ‘ভুল’ যদি ক্ষমা/সহানুভূতি পাওয়ার অযোগ্য হয়, যদি তাকে শুধরানোর কোন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকে ; তাহলে একই যুক্তিতে তো ফ্রান্স সরকার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সাথে ঠিক কাজই করছে।একদিকে ফ্রান্সের নীতির সমালোচনা, আর অন্যদিকে ‘কটূক্তি’র ছুতোয় একজন শিক্ষার্থীর সাথে হওয়া কাঠামোগত জুলুমের বৈধতা দেয়ার মানে আসলে ফ্রান্স সরকারের বর্ণবাদী রাজনীতিই অন্য কোন মোড়কে বহন করা।

ফ্রান্স সেক্যুলারিজমের নামে জুলুম করলে, মাইনরিটির বিরুদ্ধে বর্ণবাদ উস্কে দিলে তা যেমন কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না, ঠিক একইভাবে ফ্রান্সের নীতির বিরোধীতা করার আগে ভেবে দেখা দরকার ফ্রান্সের উল্টোপিঠের জুলুম চালানো হচ্ছে কিনা ইসলামের নামে।

এমন ভাবার কোন কারণ নাই যে মনোলিথিক ‘পশ্চিম’ বলতে কিছু আছে। ফ্রান্স সরকারের ‘ইসলাম-নীতি’র সমালোচনা খোদ পশ্চিমের বিভিন্ন মহল থেকে হচ্ছে। সেই আলাপগুলো আমাদের বোঝা দরকার ‘ওয়েস্ট ভার্সাস নন-ওয়েস্ট’ এর স্টেরিওটাইপের ফাঁদ এড়ানোর জন্য। আমাদের অঞ্চলেও ফ্রান্স সরকারের কার্বন কপি রাজনীতি বিরাজমান, আবার পশ্চিমেও ফ্রান্স সরকারের কাউন্টার রাজনীতি-বুদ্ধিজীবীতা বিরাজ করে। তারা দুর্দান্ত সব যুক্তিতে ফ্রান্স সরকারের সিস্টেমেটিক রেসিজমের জারিজুরি ফাঁস করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম এই বাস্তবতা এড়ানোর কোন সুযোগ নাই। এখন বাংলাদেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে, ইসলামের নামে তারা এমন কিছু চলতে দিতে চায় কিনা যা আসলে ফ্রান্সের তথাকথিত ‘সেক্যুলার’ রাজনীতিরই অন্য পিঠ কিংবা আসলে আওয়ামীলীগের চেতনা রাজনীতির যে জুলুম, সেই জুলুমেরই এক্সটেনশন মাত্র!

যদি উত্তর হয় “না”, তাহলে নবী-কোরআন এর ‘অবমাননা’ ঠেকানোর নামে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী জুলুমের রাজনীতি, কেউ কিছু বললেই তার ওপর সমস্ত কালেক্টিভ-প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিসহ ঝাপিয়ে পড়ার যে রাজনীতি ; সেই রাজনীতি পরিহার করতে হবে।

যদি সত্যিই কেউ নবী-কোরআনের মর্যাদা-সম্মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে, তাহলে সবার আগে এই উপলব্ধি প্রয়োজন যে নবী বা কোরআন এত হালকা নয় যে কিছু বললেই একেবারে ভিতসহ কেঁপে উঠবে। যে বুড়ি নবীর পথে কাঁটা বিছাতেন, তার অসুখের খবর পেয়ে সবার আগে নবীই দৌঁড়ে গেছেন, বুড়ির সেবা শুশ্রূষা করেছেন। পাশাপাশি এও মনে রাখা দরকার, কোন ধর্মের নিকৃষ্টতম অপমান-অবমাননা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই ধর্মের মানুষদের দ্বারা অন্য ধর্মের মানুষের জানমাল বসতভিটার ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা।

শিক্ষার্থীর করা ‘কটূক্তি’কে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক বহিস্কার কিংবা মামলা করার মতো ঘটনা আসলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান কাঠামোগত স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম নমুনা। গত জুন মাসে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থী মাহিরের বিরুদ্ধেও ‘মানহানী’র অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্যও হয়েছিল। সেই সময়ে শাবিপ্রবির প্রায় তিনশতাধিক সাবেক শিক্ষার্থী এক যৌথ বিবৃতিতে যা বলেছিলেন, তার প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উল্লেখ করা জরুরি:

আমরা শাবিপ্রবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে মনে করি, মাহিরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ও মামলা দায়ের স্বাধীন ও মুক্ত ক্যাম্পাস এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চেতনা-বিরোধী। শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কারোরই কোনো ‘অসৌজন্যমূলক’ লেখার কারণে মামলা করার এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নেই। আমরা জানি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় মামলা করতে পারে যদি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে জানমালের কেউ ক্ষতি সাধন করে, এবং, বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তাকর্মীরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় বাদী হয়ে মামলা করতে পারেন। কিন্তু, মাহির চৌধুরীর ফেসবুক পোস্টে এমন কোনো আলামত ছিল না যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে কোনো জানমালের ক্ষতি হতে পারে। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে আইনের (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) বলে মাহির চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে, বিগত কয়েকবছর যাবত বাংলাদেশের প্রায় সকল মহল থেকেই খোদ সেই আইন বাতিল করার দাবি জানানো হচ্ছে। তদপুরি, বিভিন্ন গ্রুপের উস্কানির বিরুদ্ধে যেখানে প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীর নাগরিক অধিকারের পক্ষে লড়াই করা সেখানে উল্টো এই মামলা দায়ের শাবিপ্রবি প্রশাসন এক কলঙ্কজনক নজির স্থাপন করেছে। 

শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের নাগরিক অধিকার হরণ ও বাকস্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-সম্মান বৃদ্ধি পায় না। বরঞ্চ, জ্ঞান উৎপাদনে জ্ঞানগত ও আইনি শর্তের যে চেতনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে শাবিপ্রবি প্রশাসনের এমন কর্মকাণ্ড তার চূড়ান্ত বরখেলাপ। এভাবে জিঘাংসামূলক নিষ্ঠুর আচরণ করে কখনো জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চা অব্যাহত থাকতে পারে না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুক্ত প্রাঙ্গণ, মুক্তবুদ্ধির মিলনমেলা; এখানে থাকবে অবারিত তর্ক, বিতর্ক, আলাপ, আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনার পরিসর। নৈতিক-অনৈতিক, সৌজন্যমূলক-অসৌজন্যমূলক, ঠিক-বেঠিক এমন হাজারো সমস্যার সমাধান হবে মুক্ত ও স্বাধীন চর্চার মাধ্যমে। এমনকি কোনটা কুরুচিপূর্ণ এবং কোনটা সুরুচিপূর্ণ তাও নির্ধারিত হবে ক্রমাগত আলাপ-আলোচনা ও অনুশীলনের ভেতর দিয়ে। তাই মত -দ্বিমত-ভিন্নমতের সহাবস্থানই একটা স্বাধীন ও মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে প্রশাসন কর্তৃক কোনোভাবে আইনি আশ্রয় নেয়া যেমন চরম নিন্দনীয় কাজ, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সাথেই সাংঘর্ষিক।

 

ধর্মের নামে রাজনৈতিক হামলা, ‘নৈতিক’ মুরুব্বিদের সিলেক্টিভ সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তা এবং বিজেপির হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা

কুমিল্লার মুরাদনগরে ধর্ম ‘অবমাননা’র ধোয়া তুলে তাণ্ডবের প্রেক্ষিতে বিজেপির প্রভাবশালী সুব্রামানিয়াম স্বামী টুইট করেছেন। তিনি বলতে চাইছেন, ‘ক্র‍্যাকডাউন’ চালাতে হবে অথবা বাংলাদেশ সরকারের হয়ে ইন্ডিয়াই ক্র‍্যাকডাউন চালিয়ে দিবে। সৈন্য-সামন্ত যা লাগে পাঠানো হবে। এদিকে বিডি নিউজের একটা সংবাদ থেকে জানা গেল, মুরাদনগরের হিন্দুদের বাড়িতে হামলা, লুটপাট সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। আগের দিন থেকেই মাইকে সমাবেশের প্রচার-প্রচারণা, লোক জড়ো করা, আগুন দেয়ার জন্য পেট্রোলের বন্দোবস্ত। সবই প্রস্তুত ছিল।

এসব বীভৎস তাণ্ডবের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায়, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে একটা সময় পর্যন্ত সিস্টেমেটিক ইনঅ্যাকশন, সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করে। ঘটনা ঘটতে পারার পরেই কেবল পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসনের নানাবিধ ‘তৎপরতা’ দেখা যায়।

আপাত অর্থে অনেককেই হিন্দুত্ববাদবিরোধী কিংবা বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী ভ্যানগার্ড মনে হয়। কিন্তু তাদের কথাবার্তা, সিলেক্টিভ সক্রিয়তা এবং নিষ্ক্রিয়তা থেকেও বিজেপি-আরএসএস পুষ্টি পেতে পারে। এটা যখন জানাই যে বিজেপি-আরএসএস এর রাজনৈতিক বিকাশ অনেকাংশেই নির্ভর করে মুসলিমবিরোধী, বাংলাদেশবিরোধী এবং বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সুতরাং ইন্ডিয়ায় বিজেপির রাজনৈতিক বিকাশ আরো শক্তিশালী হওয়া দরকার ; এইসব প্রচার-প্রচারণার ওপর, তখন ‘নবীপ্রেম’ এর নাম করে যারা মিনিমাম যাচাই বাছাই ছাড়াই জিহাদি জোস তৈরি করে, সমর্থন করে, তারা আসলে ইসলামের নামে সুব্রামানিয়ামদেরই রাজনীতি করে।

রামু, সাঁথিয়া, নাসিরনগর, ভোলার বোরহানউদ্দিন এবং সর্বশেষ মুরাদনগর বলতে গেলে প্রায় একই ধাঁচের সহিংস ঘটনা। মুরাদনগরের আগের প্রত্যেকটি সহিংস হামলার ঘটনায় সরকারি দলের লোকেদের জড়িত থাকার নজির আছে। একইরকম গুজব, মুহুর্তের মধ্যে সংঘবদ্ধ ফ্যানাটিক মব তৈরি হয়ে যাচ্ছে প্রত্যেকটি সহিংস হামলার ক্ষেত্রে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধারাবাহিক সহিংস ঘটনাগুলো ঘটার পর এইদেশের কথিত জাতির ‘নৈতিক’ মুরুব্বি আর ‘তৌহিদি জনতা’র ম্যানুফেকচারারদের মূল্যায়ন কী?

কেন একই রকম ঘটনা বারবার ঘটতে পারছে? কেন একজন নিরীহ হিন্দু/বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর নামে ফেইক আইডি খুলে বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা লিখে তারপর সেটাকে ভাইরাল করা, মব তৈরি করার মতো ঘটনা প্রায় একই রকমভাবে ঘটতে পারছে? ইসলামের ‘রক্ষাকর্তা’ দাবিদাররা কি তা ভেবে দেখেছেন? যদি ভেবে দেখতেন, তাহলে এরকম ঘটনা যেন না ঘটতে পারে সেজন্য সবার আগে ব্যবস্থা তারাই নিতেন। সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতেন। ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা লোটার রাজনীতিও ভেস্তে দিতেন।

মসজিদে মসজিদে বয়ানের মাধ্যমে সাধারণ মুসুল্লিদের বলতেন নবীর অবমাননার ধোঁয়া তুলে এই দেশকে অশান্ত করতে চায় কোন স্বার্থান্বেষী মহল। মুসুল্লিদের সজাগ থাকতে বলতেন। তারা যদি মনেই করেন, ইসলামকে নিয়ে কোন চক্রান্ত চলছে, সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতিকে উস্কে দিয়ে কোন চক্র ফায়দা লুটতে চাইছে, তাহলে এই এমন কৌশল অবলম্বন করতেন যেন সকল ধরনের ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়ে যায়। তাতে করে তাদের প্রজ্ঞার পরিচয় মিলত। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে তারা দাবি করেন, সেই দাবিটাই প্রতিষ্ঠিত হত। কিন্তু ধর্মের নামে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল সহিংস ঘটনা ঘটে চলেছে বাংলাদেশে, তাতে কথিত ‘নৈতিক মুরুব্বি’দের বড় অংশের দায়িত্বশীল ভূমিকা তো দেখা যায়নি, বরং ‘তৌহিদি জনতা’র মতাদর্শিক ভিত তৈরির ক্ষেত্রে তাদের অগ্রণী ভূমিকা দেখা গেছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইসলাম ন্যায়, ইনসাফ ও জুলুমবিরোধী নানামুখী, নানা ধারার রাজনীতির একটা ধারা হিশেবে বিকশিত না হয়ে যদি নিজেই ফ্যাসিবাদী রাজনীতি হিশেবে গড়ে ওঠে কিংবা বিদ্যমান নব্য বাকশালী রাজনীতির লেজুড় হয়ে থাকে ; সেক্ষেত্রে তারা সবচেয়ে বেশি উপকার তো করবে দক্ষিণ এশিয়াকে তছনছ করে দিতে চাওয়া হিন্দুত্ববাদের! বরং, ইসলাম ধর্মের মধ্য থেকেই চাইলে এমন ন্যারেটিভ, এমন বয়ান খুঁজে বার করা সম্ভব, যা পরমতসহিষ্ণুতাকে প্রমোট করতে পারে।

বাংলাদেশের হিন্দুরা এতটা উগ্র কিংবা নির্বোধ হয়ে যায়নি যে ইসলামের নবীকে নিয়ে কটূক্তি করবে। যদি কেউ করেও, সেই একজনের দায় গোটা সম্প্রদায়ের উপর সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন চালানোর দোহাই হিশেবে ব্যবহার করা চরম অন্যায়, ভন্ডামি। এটা তো ইসলামের নামে ফ্রান্স আর ইন্ডিয়ার বর্ণবাদী রাজনীতিকেই এন্ডোর্স করা!

ধর্ম যদি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির মাধ্যম না হয়ে থাকে, যদি মুরাদনগরের মতো সহিংস পরিস্থিতি তৈরি এবং ‘তৌহিদি জনতা’র উত্তেজনার উপর ভর করে পলিটিকাল এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার মানসিকতা না থেকে থাকে, তাহলে ইসলাম ধর্মকে তথাকথিত কটূক্তি>উস্কানি> সহিংসতা>প্রাণহানি>রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ>ফের প্রাণহানির চক্র থেকে বার করে আনার দায়িত্ব সবার আগে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ওপরেই বর্তায়।

কিন্তু সেই লক্ষণ দেখা যায় না, উল্টো ব্লাসফেমির মতো চরম প্রতিক্রিয়াশীল দাবি জানিয়ে রাষ্ট্রকে আরো শক্তিশালী, আরো কর্তৃত্বপরায়ণ করে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় কোন কোন পক্ষকে। এই চরম কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার উপর ভর করেই রাষ্ট্র  ‘তৌহিদি’ মবের উপর গুলি চালায় (গত বছরের ভোলার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা স্মর্তব্য)।

ধর্ম-বর্ণ-মতাদর্শ নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের এই ধরনের সহিংস ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

ধর্ম কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে কোন সহিংসতাকেই বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, এরকম ঘটনাকে পুঁজি করে দক্ষিণ এশিয়ার কোন ধর্মীয়, জাতিবাদী দানবীয় মতাদর্শকেই মহাদানবে পরিণত হতে দেয়া যাবে না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, কোনভাবেই ইতোমধ্যেই প্রচণ্ড সহিংস রাষ্ট্রকে আরো সহিংস, আরো কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়ার সুযোগ করে দেয়া যাবে না। পাশাপাশি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও আমাদের জোরেশোরে তুলতে পারতে হবে :

>ম্যানুফ্যাকচার করা ‘উস্কানি’ ‘গুজব’ ইত্যাদি মোকাবেলায় পুলিশিং ছাড়া রাষ্ট্র আর কোন পন্থা নিতে পারে না কেন? আইন-দণ্ডবিধি-গুলি চালানো কি আদৌ কোন পন্থা?

 

এবং

 

>একই রকম, একই প্যাটার্নের ঘটনা রামু, সাঁথিয়া, মালোপাড়া, নাসিরনগর, বোরহানউদ্দিন, মুরাদনগরে বারবার ঘটলেও রাষ্ট্রকে একই রকম ‘অপ্রস্তুত’ দেখায় কেন?  দণ্ডবিধি ছাড়া, দণ্ডিবিধির হুমকি দেয়া ছাড়া গুজব, উস্কানিরোধে রাষ্ট্র আর কোন ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবতে পারে না কেন?

গবেষক আলতাফ পারভেজের মন্তব্য দিয়ে এই লেখাটি শেষ করছি:

 

সুব্রমানিয়াম স্বামীর টুইট সবার নজর কেড়েছে। এটা স্বাভাবিক। ‘টুইট’ মানে পাখির কিচির মিচির। আপাতত কিচিরমিচির দিয়ে শুরু। হৈ-হট্টগোলও হতে পারে। বাকি দৃশ্যও অনুমান করা যায়। ৪-৫ মাস পরই পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। বিজেপির জন্য বড় ব্যাটল। ‘বেশি দেরি করা চলে না।’

ব্লাসফেমির দাবি উঠবে বলে মনে হয়। মাঠ ইস্যু চায়। ইস্যুও তাই পাল্টাবে। ভোলা বুঝলে লালমনিরহাট হতো না। লালমনিরহাট বুঝলে কুমিল্লার আগুন থামানো যেতো হয়তো। দিন শেষে বাংলাদেশের জনগণের সামনে ম্যাচিউরিটির কঠিন পরীক্ষা আবারও।

 

ছবি কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো ও টুইটার

 

 

Sarwar Tusher is an author and activist; interested in studying the state, power, authority, sovereignty, violence, and social relations.

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!