সাক্ষাৎকার
শুদ্ধস্বর : আপনি কবিতার মাধ্যমে কী আবিষ্কার করার এবং বোঝানোর চেষ্টা করে থাকেন?
দাউদ হায়দার: কবিতার মাধ্যমে কোনও কিছু আবিষ্কার হয় কী? না। কোনও কবি করেছে? বোধ হয়, না। ন্যারেটিভ কবিতায় কিংবা বলা ভালো, মহাকাব্যে ঘটনার ঘনঘটা, বক্তব্যের বিস্তার নানা প্রতীকে, উপমায়। কখনও উপদেশমূলক। বাংলায় একমাত্র এবং যথার্থ মহাকাব্য মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য। ‘উপদেশ’ নেই, ‘আবিষ্কার’ আছে। তাও ধার করা। ইটালীয় কবিতা থেকে বাংলায় ১৪ মাত্রার ‘আবিষ্কার।’ মধুসূদনের আগে কেউ যথাযথ করেনি। বাংলা সনেটও তাঁর হাতে তৈরি।
ঠিক সব কবিই, ‘আবিষ্কার’ করতে চান। (‘আবিষ্কার’ ঊর্ধ্ব কমার মধ্যে অর্থাৎ বিষয়টির গুরুত্বে) ভাবনা, বক্তব্যে, শব্দ প্রয়োগে। একই কবিতায়, কখনও কখনও মাত্রাবৃত্ত, পয়ার ব্যবহারে। এক্সপেরিমেন্ট। বাংলায় বলা যায় পরীক্ষামূলক। সব আবিষ্কারই যে স্থায়ী, নিশ্চয় নয়। আবিষ্কারের মধ্যে চেষ্টা বা প্রচেষ্টায় নিজেকেও আবিষ্কার। কবিতায় পাঠকের সঙ্গে একাত্মতার সোপান রচনাই ‘চেষ্টার’ ‘আবিষ্কার’। আবিষ্কার? না। কবিতা আবিষ্কার হয় না। লেখ্যরূপে নির্মিত হয়। নির্মাণ করেন কবি। ভাবনা থেকে ‘আবিষ্কার’অগোছালো যুক্তিতে হবে হয়তো। বাল্মীকির ‘মা নিষাদ’ আবিষ্কার নয়, বিস্ময়সূচক ধ্বনি থেকে শ্রব্য নির্মিত।
শুদ্ধস্বর : আপনি বর্তমান বিশ্বকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং বর্তমান ঘটনাগুলো আপনাকে লেখার ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে?
দাউদ হায়দার: দেশ-সমাজ-মানুষ, বিশ্ব, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি আজকাল এক অর্থে, মন-মননে আবিষ্কার করতে হয়। গত পরশু, গতকাল যা ছিল আজ নেই। ‘রক এন রোল’ গত শতকের পঞ্চাশ দশকেও ছিল না। কিংবা র্যাপ। শুদ্ধ সংগীতের মধ্যে, বিশেষত ধ্রুপদী সংগীতে ফিউশন, মিশ্রণ ছিল না। ইদানীং আবিষ্কার কেন প্রয়োজন ব্যাখ্যা আছে। হালের বিশ্ব এতটাই গোলমেলে, সকাল বা রাতে ওলোটপালোট। আগে মেয়েরা ভ্রু চাঁছতো না, এখন ফ্যাশন। জিন্স প্যান্ট হাঁটুর উপরে নিচে, নিতম্বের নিচে কাটাছেঁড়াও ফ্যাশন। পথে যেতে যেতে দেখছেন সুন্দরী, সুন্দরীও এক লহমায় নজর দিচ্ছেন সুপুরুষের শরীর-স্বাস্থ্য-চেহারায়, এই এষণায় কাম-কামনা দুই-ই, অর্থাৎ পরস্পরকে আবিষ্কারের, এখানেই উন্মোচন ভিতরমহল। ওই মহলে কারও সাধ্য নেই প্রবেশের। ভিতর মহলেই আবিষ্কৃত বোধের।
বর্তমান বিশ্ব ব্যাখ্যার অতীত। আর্থিক, রাজনৈতিক, বিজ্ঞানের কারণে তথা কল্যাণে। মন-মানসিকতার দ্রুত পরিবর্তন। দ্রুত পরিবর্তিত ঘটনাবলির প্রত্যহের জীবন। ভূমিকায় আসঙ্গ। কবিতায় (সাহিত্য) সম্পর্কিত। এখানেও ‘আবিষ্কার’।
শুদ্ধস্বর : কোন সাহিত্য-ফিকশন বা নন-ফিকশন বা কোন লেখক/লেখকরা আপনার নিজের লেখাকে প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেছেন? কারা এবং কীভাবে?
দাউদ হায়দার: মহাকাব্য, ধ্রুপদী সাহিত্য প্রিয়। ঘুরেফিরেই পড়ি। শিক্ষণীয়। সফোক্লিস, ইউরোপেদিস, শেক্সপিয়র, মলিয়ের কেন বার বার পড়তে হয়? কেন রবীন্দ্রনাথ? মহাভারতের কথক সৌতির কথা : ঘটিত ঘটনা ইতিপূর্বে অন্য কবিরা বলেছেন, এখন বলছেন ভবিষ্যতেও বলবেন। আমরা কি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছি না? নানাভাবে?
টলস্টয়, দস্তয়ভোস্কি, পুশকিন, বালজাক এবং আরও ছয় সাতজন আন্দোলিত করেছিল, প্রভাবিত নয়। কবিতায় কাভাফি, মায়াকোভস্কি, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার। বাংলায় রবীন্দ্রননাথ, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে প্রেরণাদায়ক। ওই পর্যন্তই। দোষ নেই স্বীকারে অমিয় চত্রবর্তীর পরবাস, বিশ্ব, সর্বজনীনতা, বিষ্ণু দে-র দেশ-মানুষ-সমাজ মনস্কতা, শব্দচয়ন গেঁথে যায় মনে। চেক কবি মিরোশ্লাভ হোলুরের কথা : ‘মনে গাঁথলেও একই ভাব, শব্দ ভিন্ন রূপে, স্বরূপে প্রকাশিত কবি।’
শুদ্ধস্বর : কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার কবিতাকে আকার দেয়?
দাউদ হায়দার: সব কবিতাই ব্যক্তিগত। ব্যক্তির ব্যক্তিগত তত্ত্বই প্রকাশিত। দেশ-সমাজ-বিশ্ব চারিত নিজস্ব কাহনে। প্রেম, রাজনীতিও আছে। কোনও কবি কীভাবে বলছে, বলায় জড়িয়ে নিচ্ছে পারিপার্শ্বিক, রাষ্ট্র, মানুষকে। ধরা যাক, যে-প্রেম কামনা বাসনা উপলব্ধি করলেন, উপলব্ধি নিজের, ছড়িয়ে দিলেন সাধারণ্যে।
জীবনানন্দের একটি কবিতার শিরোনাম ‘সুরঞ্জনা’। সেই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত প্রচণ্ড ধমক আছে : ‘কি কথা তাহার সাথে?’ এই লাইনেই ‘তাহার’ ও ‘তার’। ‘তাহার’ ভদ্রতার খাতিরে, ‘তার’ তাচ্ছিল্যে, ইতরতায় সম্বোধিত।
এখানে ‘ব্যক্তির’ অভিজ্ঞতার সঙ্গে ক্রোধ, রূপ নিচ্ছে কবিতায়। জীবনানন্দর ‘সুরঞ্জনা’ থেকে চুরি করি : ‘কার সংস্পর্শে এতটা উদ্বেল?/ কে তোমায় দিয়েছে মোচড়?/ কার মোহনায় ঢেউ অঢেল? কে সেই রাত্রির ভোর?’
এই অভিজ্ঞতা থেকেই ব্যক্তির সংবৃত্ততা নির্ভর করে কবিতার বিষয়। বিষয়ের সঙ্গে ভাষার সংযোগ। প্রতীকে, উপমায় হবে, না কি সরাসরি? রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ প্রচ্ছন্নতায় আবিষ্ট। ‘হঠাৎ দেখা’ কিংবা ‘কিনু গোয়ালার গলি’ পুরোপুরি গল্প বলছেন কবিতায়।
রবীন্দ্রনাথকে চতুরঙ্গ পড়ে আত্মস্থ করতে না-পারলে, দামিনী চরিত্রের পূর্বাপর রূপান্তর এবং বিষ্ণু দের ‘দামিনী’ কবিতা বোঝা দুষ্কর। ‘দামিনী’ অংশে ‘মিটিল না সাধ’ এই বাক্য নিয়ে বিষ্ণু দে প্রেমের চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘দামিনী’ হয়ে গেছে বিষ্ণু দে-র নিজস্ব :
সেদিন সমুদ্র ফুলে ফুলে হল উন্মুখর মাঘী পূর্ণিমায়
সেদিন দামিনী বুঝি বলেছিল মিটিল না সাধ।
পুনর্জন্ম চেয়েছিল জীবনের পূর্ণচন্দ্রে মৃত্যুর সীমায়,
প্রেমের সমুদ্রে ফের খুঁজেছিল পূর্ণিমার নীলিমা অগাধ,
সেদিন দামিনী, সমুদ্রের তীরে।
আমার জীবনে তুমি প্রায় বুঝি প্রত্যহই ঝলন-পূর্ণিমা,
মাঘী বা ফাল্গুনী কিংবা বৈশাখী রাস বা কোজাগরী,
এমন কী অমবস্যা নিরাকার তোমারই প্রতিমা।
আমারও মেটে না সাধ, তোমার সমুদ্রে যেন মরি
বেঁচে মরি দীর্ঘ বহু আন্দোলিত দিসব-যামিনী,
দামিনী, সমুদ্রে দীপ্র তোমার শরীরে
(‘দামিনী’, বিষ্ণু দে, ১১ জানুয়ারি ১৯৬০)
এই কবিতায় উচ্চারণের গাঁথুনি, সঙ্গে ব্যাকরণ, ব্যবহার, নির্মাণ নিজস্বকর্মে গড়া ও ভাঙায় বিষ্ণু দে যে বিধির আশ্রয় নিয়েছেন, উদাহরণ ‘সমুদ্রের তীরে’ হঠাৎই উত্তরণ।
শুদ্ধস্বর : আপনার কবিতার বক্তব্য উচ্চারণ করতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
দাউদ হায়দার: বিষ্ণু দে-র মতো আদৌ পোক্ত নই, সাহসও নেই, তবে ফর্ম ভাঙি, গড়ি; ব্যাকরণেও ওলোটপালোট করি। করার মধ্যে নিজস্বতা নির্মাণ দুই-ই। মাঝে মাঝে উল্লম্ফনও। পংক্তির বিভাজন।
প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে, ঢাকার একটি দৈনিকের রবিবাসরীয় সংখ্যায়। পাঁচ দশক আগে।
শুদ্ধস্বর : রাজনৈতিক কবিতা এবং সাধারণ কবিতার মধ্যে সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব এবং সংহতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
দাউদ হায়দার: কখনও কখনও। সবক্ষেত্রে নয়। কীভাবে বলা হচ্ছে, বলার প্রসঙ্গ কী, নির্ভরশীল। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’, রাজনৈতিক চিৎকারে ভরপুর, আমিত্ব জাহির, আস্ফালন, যথার্থ কবিতা নেই।
রবীন্দ্রনাথও রাজনৈতিক কবিতা, গান লিখেছেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ ‘ভিক্ষা অন্নে বাঁচাবে বসুধা।’ ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী।’ ইত্যাদি। বাক্যগঠনেই তীব্র রাজনীতি।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের, সমর সেনের শামসুর রাহমানের বিস্তর কবিতা (বিদেশি কবিদের কবিতা প্রসঙ্গ বাদ দিলুম) রাজনীতি মাখা। শিল্পগুণে উত্তীর্ণ। রাজনীতির মিশ্রণে কবিতা শৈল্পিক কি-না, পয়লা বিবেচ্য। মেরুকরণই শিল্প, কবিতার শিল্প। দ্বন্দ্ব তৈরি অশিল্পে। ছবির ক্ষেত্রেও যেমন। পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’ সাংঘাতিক রাজনৈতিক চিত্রকর্ম কিন্তু শিল্পিতগুণ এতটাই, ছাপিয়ে গেছে রাজনীতি।
দ্বন্দ্ব ও সংহতি যদি সামীপ্যে, দেখতে হয় দ্বন্দ্ব কোথায় সংহতি কোথায়। দুয়ের মিলন একাত্মতায় বিরোধ গৌণ। স্বর ও শ্রুতির কর্ষণে সমতা না-থাকলে শিল্পের গরিমা তৈরি হয় না। রাজনৈতিক শিল্প ও শিল্পবোধ তথা শৈল্পিকতার সম্মিলন জরুরি। অন্যথায় শিল্প নেই, কবিতাও নেই। ‘টু বি অর নট টু বি’(শেক্সপিয়র)।
শুদ্ধস্বর : আপনার কবিতা কি জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে বলে আপনার ধারণা? এটি অন্যান্য জাতীয়তা বা ভাষাগোষ্ঠীর কাছে আবেদন রাখতে পারে বলে কি আপনার মনে হয়? তাহলে কীভাবে?
দাউদ হায়দার: নিজের সম্পর্কে গলা ফাটাই না। অভ্যেস কখনও ছিল না, এখনও নেই। পৃথিবীর নানা ভাষায় কবিতা অনূদিত। প্রকাশিত। আমেরিকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সতেরটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইসরাইলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। হয়তো অন্য ভাষাগোষ্ঠী, জাতির কাছে আপন বা কাছাকাছি। ফারাক নেই খুব। মূলত বৈশ্বিক মনমানসিকতার সংমিশ্রণ।
দ্য সিটি অব জয়-এর লেখক দোমিনেক ল্যাপিয়রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘পৃথিবীর এত দেশ থাকতে কলকাতা কেন বেছে নিয়েছেন?’ উত্তর : ‘রবীন্দ্রনাথ আর দাউদ হায়দারের কবিতা।’ তা চোখে দেখিনি তাঁর বাঁশিও শুনিনি। ভদ্রলোক নিশ্চয় প্রগলভ। রবীন্দ্রনাথ যে পথে হেঁটেছেন (কলকাতায়, শান্তিনিকেতনে) ওই পথের ধারে ঘেঁষতেই বুক কম্পমান। ধূলি মাখাও অপরাধ।
শুদ্ধস্বর : আপনি কি মনে করেন কবিতার সংক্রাম দিয়ে মানুষের ইতিহাস পালটানো সম্ভব? আপনার জবাবের পক্ষে বলুন।
দাউদ হায়দার: কবিতার সংক্রমণে পৃথিবীর কোনও দেশে, কোনও কালে ইতিহাস পালটেছে? আন্দোলিত হয়েছে কিছু সময়, তাও কিছু মানুষ। সবকালেই কবিতার পাঠক শিক্ষিত, গুটিকয়েক। গোটা দেশ, জনগোষ্ঠী নয়।
বাল্মীকির রামায়ণের রাম বেঁচে থাকাকালীন রামায়ণ (মহাকাব্য) সংক্রামিত হয়নি। রাম নপুংসক, উপরন্তু রাজা। নির্দোষ বানররাজা বালী, নির্দোষ শূদ্রকের হত্যাকারী, সীতাকে একবার পোড়ালেন, পুড়েও সশরীরে, এক্ষেত্রেও ক্ষোভ, রাগ, ছলেবলে পাঠালেন নির্বাসনে। প্রজার সাহস নেই প্রতিবাদের, সমালোচনার। করলেই হত্যা।
রামের মৃত্যুর বহু বহু যুগ পরে একদল লোভী ও ত্যাঁদোর ব্রাহ্মণ প্রচার করলে রাম প্রজার সুখদুঃখে ছিলেন সহমানব, রাম ধর্মনিষ্ঠ, রাম ভগবান। অতএব রাম নামই সত্য, পবিত্র (রাম নাম সৎ হ্যায়) রাম একজনকেই বিয়ে করেছিলেন।
কেউ কেউ দোষারোপ করেন ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়’ প্রকাশের পরেই (প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪, সংবাদ)। জামায়েত ইসলামি, ধর্মান্ধরা, উগ্র মৌলবাদীরা বেরিয়ে আসে, সংগবদ্ধ হয়। সুযোগ করিয়ে দিয়েছে ওই কবিতার একটি লাইন। তৈরি করেছে জামায়াত ইসলামির উগ্র মৌলবাদীর জাগরণ। উত্থান। ইতিহাস।
তা হলে, কবিতার সংক্রমণে ইতিহাস পালটেছে?
ইতিহাসের গূঢ়তায় চোরাবালি, কবিতা নিমিত্ত।
____________________________________
কবিতা
আঘাত দিচ্ছ
উঠোনে বৃষ্টির জল, ঘোলা
পাশের বাড়ির দরোজাজানালা খোলা
আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে
একটি হলুদ পাখি বসে আছে মগডালে
লাল টিপ তার বিবর্ণ কপালে
আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে
চাঁদের ভিতরে অর্ধনগ্ন বুড়ি
বেহেশতের ছিনাল, লোকে কয় ‘হুরি’
আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে
‘সোনার মন্দির’ কেন রবীন্দ্রসংগীতে?
বসন্তের বৈভবে, পড়ন্ত শীতে
আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে
প্রিয়তমা সুন্দরী ঘরণী
যৌনসঙ্গমে শয্যায় হিজাব পরোনি
আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে
[২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, কলকাতার ‘আজকাল’-এ প্রকাশিত]
হিজাব
মাগিরা গ্রামপ্রান্তরে দেশে
ভ্রু-ছেঁটে কাজল মেখে সাজছে সুন্দরী
গা গতরে দুর্গন্ধ, ছড়াচ্ছে পরিবেশে।
কৃষ্টি
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক শকুনি
জনসমাবেশে তোমার গুণকীর্তন।
মুনির আশ্রমে কম্পিত আরুনি
প্রাত্যহিকে নাভিশ্বাস, বিচিত্র মারণ
তোমাকে দেখলে মনে হয় সমস্ত মত্যেই শ্যেনদৃষ্টি
তোমার চামড়ার পালকে যে-হিল্লোল
ধারণ করেছে অসুরের কৃষ্টি
আমাদের জীবনে অশুভ কলরোল
মনুষ্যজীবন
শরীর বিগড়ে যাচ্ছে ক্রমশ কাহিল
রাত্রিদিন বিপদে আচ্ছন্ন।
প্রতিদিন মহামারী আর শকুন চিল
মাথার ওপরে, চেতনেঅবচেতনে দুঃস্বপ্ন
আমরা অকালবোধনে যমের যূপকাষ্ঠে
আমাদের চিৎকার আমাদের ক্রন্দন
কোন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে
অজানা, বৃথা শুধু অরণ্যে রোদন
চে
চাল নেই চুলো নেই অনাহারে দিনকাল
গ্রামশহরজুড়ে শাসকের দলীয় ক্যাডার।
অভুক্ত মানুষ কেন হয়ে যায় নকশাল
কেন গ্রামগঞ্জে জন্মায় চারু মজুমদার?
জীবিত বা মৃত যে-ই হোক
বিষবারুদে শরীর গাঁথা।
দু’হাতে আর দুই চোখ
দেখে নিচ্ছে কে শত্রু কে পরিত্রাতা
আমাদের ভূমিভিটেমাটি
কেড়ে নিচ্ছে যারা
দেখা হবে কুরুক্ষেত্রে। যুদ্ধঘাঁটি
প্রস্তুত। মন্ত্রণাদাতা এর্নেস্তো চে গুয়েভারা
মহাশ্বেতা
বলো মহাশ্বেতা
এই দেশ নিয়ে কেন আদিখ্যেতা?
কী পেয়েছে দেশের মানুষ, সাধারণ?
দিনরাত্রি কেবল ভাষণ
কান ঝালাপালা। নিশ্চয় নির্বোধ
আমরা। কখনও প্রতিরোধ
করিনি সদলে।
শুনেছি দিনদুপুরে ভূতে মারে ঢেলা
তাই যদি হয় সারাবেলা
ভূত আনাচেকানাচে
দূরেকাছে
জানো মহাশ্বেতা, এই জাতি
প্রতিনিয়ত স্বঘাতী
সমাজের প্রতিগৃহে
বহুব্রীহে
মিথ্যে
নিষেধ সত্ত্বেও পার হয়ে যাচ্ছ লক্ষণরেখা
কি স্পর্ধা তোমার?
যে-অরণ্যে বাস, রামলক্ষণ ছাড়াও স্বর্ণমারীচ, প্রেক্ষা-
পটে ষড়যন্ত্রের গভীর সমাচার
চোখে যা-দেখছি নিশ্চিত অশনি
রক্তমশাল আর অগ্নির শিখা চারদিকে
তোমাকে বলা বৃথা। অযথা। তোমার তর্জনী
আমাদের মৃত্যু, রাজ্যশিরে বসে আছ সশস্ত্র অনীকে
যোদ্ধারা কখনও নিশ্চুপ নয়, যথাকালে কৌশলে
ফিরে আসে অরণ্য থেকে রণাঙ্গনে, প্রান্তরে
মৃত্যুকে থোড়াই কেয়ার, সঙিন হাতে জলেস্থলে
সংবিধানে সেকুলারিজম মিথ্যে, ধর্মান্ধতা অক্ষরে-অক্ষরে
[রচনাকাল : ২০১৭-১৮-২০-২১। আমেরিকা ও বার্লিনসহ ইউরোপের নানা দেশে]
স্বপ্নে দেখলুম তোমাকে
তুমি আমার
তোমার জন্যে জাগ্রত মহাদেশ,
তুমি সর্বকালীন।
তোমার জন্যে বহমান সমুদ্র, মন্দাকিনী
তুমি জোয়ারভাটায় উচ্ছল ক্লান্তিহীন
তোমাকে বর্ষায় শ্রাবণে আশ্বিনে
স্রোতের বিভিন্ন পরিমণ্ডলে
সমারোহ করি খরস্রোতা উজ্জীবনে
প্রত্যহের নির্বাসিত বিঁভূইয়ে,
তুমি এই বৈশ্বিক ভূগোলে
নিশ্চিত আলোকিত।
তোমাকে ঘিরেই এই সূর্যালোক
তুমি আমার সমস্ত উৎসে উদ্দীপ্ত
[২৭ মে ২০২১, বার্লিন, জার্মানি]