সংস্কৃতি কারখানা

Share this:

সংস্কৃতি কারখানা শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয় এডোর্নো এবং হরখেইমার কতৃক লিখিত Dialectic of Enlightenment বইতে। এডোর্নোরা তাদের লেখায় গণ সংস্কৃতির পরিবর্তে এই সংস্কৃতি কারখানা শব্দটি ব্যবহার করেন। এটি এমন একধরনের সংস্কৃতি যা ‘পপুলার আর্টের’ মতোই জনসাধারণের  ‘স্বতঃস্ফূর্ততার’ বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু জনসাধারণের এই আপাত স্বতঃস্ফূর্ততার বিষয়টি প্রকৃত স্বতঃস্ফূর্ত নয়। কেননা সংস্কৃতি কারখানায় জনসাধারণ ‘গৌণ’ ও নিষ্ক্রিয় কর্তাসত্তা। ব্যক্তির সত্যিকারের সেল্ফ না হয়ে ওঠার যে উদ্বেগ তাকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে সংস্কৃতি কারখানা কাজ করে থাকে।

এডোর্নোরা সংস্কৃতির সাথে কারখানা শব্দটি যুক্ত করেছেন কারণ এর সাথে মুনাফা লাভের বিষয়টি জড়িত। সংস্কৃতি কারখানা মানবীয় সমস্ত কার্যাবলিকে মুনাফামুখী করে তুলে। আঠারো শতকের পরবর্তী সময়ে ইউরোপে আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ এমন এক অবস্থানে পৌঁছায় যেখানে সংস্কৃতি কারখানা আধিপত্যশীল উপাদানের পরিণত হয়। রেডিও, সংগীত, চলচ্চিত্র, ম্যাগাজিন এগুলোই তখন সংস্কৃতি কারখানা হিসেবে কাজ করত। সংস্কৃতি কারখানা মূল লক্ষ্য হচ্ছে মুনাফা বা পুঁজি। মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে সংস্কৃতির এই পদ্ধতিকে নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যান্য কারখানার মতো সংস্কৃতি কারখানা পুঁজিবাদী নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত। সংস্কৃতি কারখানা ভোক্তাকে যেভাবে প্রধান হিসেবে উপস্থাপন করে ভোক্তারা আসলে তা নয়। এই উপস্থাপনের মাধ্যমে সংস্কৃতি কারখানা নিজেকে শুধুমাত্র সেবা প্রধানকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। বাস্তবে ভোক্তারা সংস্কৃতি কারখানার বিষয় নয় নিছক লক্ষ্য। ভোক্তারা সংস্কৃতি কারখানার বিভিন্ন পণ্যকে একক হিসেবে বিবেচনা করলেও অভিন্নতাই এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লেখকদ্বয়ের ভাষায় “সমস্ত গণসংস্কৃতি একচেটিয়া বাজারের অধীন যা অভিন্ন।….চলচ্চিত্র এবং রেডিওকে শিল্প হিসেবে উপস্থাপনের কোন প্রয়োজন নেই। বাস্তবতা হচ্ছে এগুলা ব্যবসা ছাড়া কিছু নয় যাকে ইচ্ছাকৃতভাবে তুচ্ছ বিষয় উৎপাদনের বৈধ আদর্শ হিসেবে ব্যবহৃত হয়”।ভোক্তারা এখানে পণ্য পছন্দ করতে পারলেও তা তাদের পছন্দ নয়। কারণ তাদের জন্য পণ্য পূর্ব নির্ধারিত থাকে।

এডোর্নোদের মতে সংস্কৃতির কারখানা হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর সত্যিকারের ও স্বত:স্ফূর্তভাবে অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠার প্রধান বাধা। কারণ সংস্কৃতি কারখানা ব্যক্তির হয়ে ওঠার বিভিন্ন কারণ বা শর্তাবলীকে নির্ধারণ করে দেয়। সংস্কৃতি কারখানার “পূর্বপরিকল্পিত” ও “জটিল” সম্পর্ক জনসাধারণের ইচ্ছাকে অবদমন ও নিয়ন্ত্রণের উৎস হিসেবে কাজ করে। সংস্কৃতি কারখানার সাথে মানুষের যে সম্ভাবনাময় সম্পর্ক জারি থাকে তা হচ্ছে একধরণের ক্ষমতা সম্পর্ক। এডোর্নো এবং হরখেইমারের মতে সংস্কৃতি কারখানা লক্ষ্য হচ্ছে তার ‘উৎপাদিত মতাদর্শকে’ ‘বৈধতা’ দেওয়া। এটি এমন এক প্রযুক্তি যার মাধ্যমে ‘সমাজের উপর ক্ষমতা চর্চার’ অধিকার তৈরি হয়।

সংস্কৃতি কারখানা শাসক শ্রেণীর নৈতিকতার ধারণ করে। এডোর্নো যে নৈতিকতাকে “সভ্যকরণের উৎস ক্ষমতা” হিসেবে চিহ্নিত করেন। এটি সমাজের বাস্তবিক, মূল্যবোধ ও নীতিকেন্দ্রিক পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রত্যেকটি ঘটনাকে জনসাধারণের নিকট উপস্থাপন করে। এই পর্যালোচনাগুলো হচ্ছে উদ্দেশ্যবাদী। অর্থাৎ পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র বা উদারতাবাদের মতো বিভিন্ন ডিসকোর্সের চূড়ান্ত উদ্দেশ্যগুলোকে অর্জন করাই হচ্ছে মূখ্য, এগুলোকে যে উপায়ে বা প্রক্রিয়া অর্জন করা হয় তা মূখ্য নয়।

 

জনতার গঠন ও তার নিয়ন্ত্রণ

এডোর্নোর মতে জনতার গঠনের পিছনে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে তিনি ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণকে সামনে নিয়ে আসেন। যে মনস্তাত্ত্বিক প্রেষণা ব্যক্তিসমূহকে জনতায় রূপান্তরিত করে তা হচ্ছে লিবিডো। মানুষের জৈবিক, মানসিক ও সামাজিক বিষয় কর্তৃক প্রভাবিত হওয়ার সার্বিক জৈবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে এই লিবিডো। জনতার গঠনের ব্যাপারে হিটলার নিজেও এই লিবিডিয়ান উৎসের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। হিটলার একে তার ফ্যাসিবাদের আন্দোলনের প্রচারণায় ব্যবহার করেছেন। জনগণ একত্রিত হয় তার অবচেতন প্রবৃত্তির অবদমনকে প্রতিরোধ করার জন্য।  এই প্রতিরোধের প্রেষণাকে ব্যবহার করেই হিটলার তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। এই লিবিডোর প্রযুক্তিকে নেতার সাথে তার অনুসারীর সম্পর্কে স্থাপন ব্যবহার করা হয়। হিটলার তার বাগাড়ম্বরপূর্ন বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ক্রমশ নিজেকে জনসাধারণের নিকট রাজনৈতিক প্রতিরোধ ও আন্দোলনের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ফ্রয়েড কতৃক চিহ্নিত ‘অতি পুরুষালি প্রধান’ নেতার জায়গায় হিটলারের আবির্ভাব ইউরোপে ব্যাপকভাবে  এন্টি-সেমেটিজমের জন্ম দেয়।

জনতাকে একটি নির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টার ফলে জনতার মধ্যে বিভিন্ন সম্ভাবনা অথবা সঙ্কটের মাত্রা তৈরি হয়। হিটলার সমর্থনে জনতার আবির্ভাব আর অক্টোবর বিপ্লবের ক্ষেত্রে জনতার উত্থানের ফলাফল ভিন্ন ভিন্ন। পরের ঘটনায় জনতার কর্তা হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে। জনতার হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়া,  জনতার রাজনৈতিক সংস্কৃতির দ্বৈততাকে জানান দেয়। তবে জনতার গঠনের অনেক ক্ষেত্রে নেতার চেয়ে বিষয়য়ের আবেদন তাৎপর্যপূর্ণ। এজন্য এডোর্নো মনে করেন ফ্রয়েডের নেতা সম্পর্কিত ‘অতি পুরুষালি তত্ত্ব’ অগভীর। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও দেখা যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা গণপিটুনির মতো সহিংস ঘটনার ক্ষেত্রে নেতার চেয়ে ইস্যু বা বিষয়ের ভূমিকাই বেশি। জনতার এই বিষয়গুলোকে এডোর্নো মনে করেন মনস্তাত্ত্বিক, কারণ এর যেসব অযৌক্তিক কর্তৃত্ববাদী লক্ষ্য রয়েছে তা যৌক্তিক প্রত্যয় দ্বারা অর্জিত হতে পারে না।১০ জনতার গঠনের ক্ষেত্রে একধরনের মনস্তত্ত্ব কাজ করলেও ফ্যাসিবাদের বিকাশের উৎস হিসেবে জনতার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবকে আসল কারণ হিসেবে এডোর্নো মনে করেন না। বরং ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে সমাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের অবদমিত অবস্থানের মনস্তাত্ত্বিকতাকে বিশ্লেষণ করা যায় মাত্র। এর পিছনে কাজ করে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ।১১ সংস্কৃতি কারখানা মাধ্যমেও জনতার গঠন হয়ে থাকে। সাধারণ সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় যে জনতা রয়েছে তা তৈরি করা সংস্কৃতি কারখানার কাজ নয়।  বরং তার কাজ হচ্ছে নিষ্ক্রিয় জনতা তৈরি করা। অর্থাৎ এর লক্ষ্য হচ্ছে জনতাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা। এটি জনতাকে নিয়ে পরিবর্তনের যে সম্ভাবনা তা রহিত করে। এটি তার উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে স্থিতিশীল মানসিকতাকে পুনরুৎপাদন করে। এডোর্নোর ভাষায় এটি ‘মনস্তাত্ত্বিক স্থিতিশীলতা’১২ তৈরি করে। সংস্কৃতি কারখানা জনতার মনস্তত্ত্বকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একে আধিপত্যের একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। সংস্কৃতি কারখানা সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভোক্তাদের চাহিদা তৈরি করে। নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা হচ্ছে এসব সংস্কৃতি কারখানার প্রধান ভোক্তা। সংস্কৃতির কারখানা শ্রমিক শ্রেণি বা জনমনে যে চাহিদা তৈরি করে তা কখনো নিঃশেষ হয়না। এটি ক্রমাগতভাবে চলতে থাকে। ফলে জনগণের মনোজগতে সংস্কৃতি কারখানার বাইরে ভিন্ন দর্শন, চিন্তা বা মুক্তির পথ ঘটেনা। তাঁরা তাদের সামাজিক স্থিতাবস্থার মধ্যেই সন্তুষ্ট থাকে। এটি সামাজিক স্তরবিন্যাস বজায় রাখে। শ্রমিকরা এমন একটি ব্যবস্থার মধ্যে বাস করে যা অত্যন্ত যৌক্তিক ও বিমানবিক কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ। সংস্কৃতি কারখানা হচ্ছে সামাজিক ও মানসিক নিয়ন্ত্রণের কৌশল। সংস্কৃতি কারখানা আমাদের কল্পনা শক্তির সীমানা নির্ধারন করে দেয়। সিনেমা, সংগীত, বিজ্ঞাপন আমাদের কল্পনার জগৎকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এটি একধরণের কৃত্রিম মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা তৈরি করে। জনসাধারণের মধ্যে ভ্রান্ত সচেতনতা তৈরি হয়। সংস্কৃতি কারখানা মাধ্যমে জনগণের মধ্যে যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় সেই সচেতনতা বিদ্যমান সমাজ ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর সীমানাকে স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে কাজ করে। জনসাধারণের সচেতনতাবোধ তাদের সত্তাকে নির্ধারণ করতে পারেনা, বিপরীতে সংস্কৃতি কারখানা কতৃক নির্মিত সচেতনা তাদের সত্তাকে নির্ধারণ করে দেয়। এর ফলে জনগণ নিজেদের অবদমনের সাথে নিজেরাই জড়িত হয়। ব্যক্তি মানুষের সম্ভাবনা এর দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ চিন্তা ও কাজের পদ্ধতি সংস্কৃতি কারখানা কতৃক উৎপাদিত হয়। সংস্কৃতি কারখানা যেসব মূল্যবোধ নির্মাণ করে এটি পুঁজির প্রভাবশালী চরিত্রকে সমর্থন করে। জনসাধারণকে বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি আরো বেশি অনুগত হতে প্ররোচিত করে৷ এর কাজ জনসাধারণের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ। এ নিয়ন্ত্রণ জনসাধারণের জন্য একটি বিপদজনক অবস্থান তৈরি করে। এটি পদ্ধতিগত সহিংসতার জন্ম দেয় যা সামাজিক অন্যায্যের সাথে জড়িত। সংস্কৃতি কারখানার একক কতৃত্ব ক্ষমতাকে আরো সুগঠিত করে।

সংস্কৃতি কারখানা সমজাতীয় সচেতনতার মাধ্যমে ‘একমাত্রিক ব্যক্তি ও সমাজ’ তৈরি করে। ভিন্ন চিন্তাকে ধারণ করা চর্চা করা সম্ভাবনাকে এর মাধ্যমে হ্রাস পেতে থাকে। সবাইকে সমজাতীয়ভাবে চিন্তা-চেতনায় নিয়ে আসায় বিরোধিতা করার বিষয়টি পদ্ধতিগতভাবে নির্মূল হয়ে যায়। এই একমাত্রিক সমাজের বাইরে যারা রয়েছে তাদেরকে বিভিন্নভাবে অবদমিত করে রাখাই এই সংস্কৃতি কারখানার কাজ।

 

মুক্ত  সময়ের নিয়ন্ত্রণ

প্রযুক্তি বিকাশ ও শ্রমিকদের কর্মঘন্টা হ্রাসের ফলে মানুষের অবসর সময় তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। অবসর সময় বলতে আমরা ধারাবাঁধাহীন আরামদায়ক সময়কে বুঝে থাকি। এডোর্নোর প্রাথমিক অনুসন্ধান হচ্ছে মানুষ কি প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার একটি রূপ হিসেবে তার অবসর সময়কে অনুভব করে, নাকি এটি অনুশাসতান্ত্রিকভাবে পুর্বনির্ধারিত। এডোর্নো মনে করেন মুক্ত সময়ের মধ্যে অধীনতা ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। এডোর্নো তার মুক্ত সময় (Free Time)  প্রবন্ধের শুরুতেই মুক্ত সময় এবং অবসর সময়ের ধারণার মধ্যে পার্থক্যকে স্পষ্ট করেছেন যে, মুক্ত সময় বা সময়ের অভিব্যক্তিটি সম্প্রতি উদ্ভূত হয়েছে এবং অবসর সময় তুলনামূলক পূর্ব থেকেই পরিচিত। এই অবসর সময়ের যেসব আরামদায়ক কার্যাবলী  রয়েছে তাই মুক্ত সময়ের অগ্রদূত। এডোর্নোর মুক্ত সময় সম্পর্কিত ক্রিটিক এই বাস্তবতা বুঝতে সাহায্য করে যে মুক্ত সময় এমন একটি সময় নয় যা ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই অবাধভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এডোর্নোর লক্ষ্য হচ্ছে এই ধারণার সাথে সংযুক্ত সাধারণ বিশ্বাসকে বিনির্মাণ করা,  যার মাধ্যমে মুক্ত সময় তার ‘যথাযথ স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করবে।১৩

মুক্ত সময় তার সার্বিক সামাজিক অবস্থান কতৃক নির্ধারিত হয়ে থাকে। এসময় ব্যক্তি যেসব কার্যকলাপ করে থাকে তা ব্যক্তি তার স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে করে থাকে বলে বিবেচনা করা হয়। মুক্ত সময় সম্পর্কে  এডোর্নোর ক্রিটিক মূলত পুঁজিবাদ এবং যে কোনও সমাজের প্রভাবশালী ক্ষমতা কাঠামো আমাদের মুক্ত সময়ের ব্যবহারকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তা তুলে ধরে। ব্যক্তি কাজের বাইরে তার সময় নিয়ে কী করবে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় না। এগুলো অনেকাংশেই পূর্বনির্ধারিত। ফলস্বরূপ, মুক্ত সময়ের কার্যকলাপসমূজ নিয়ন্ত্রিত হয় সংস্কৃতি কারখানা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দ্বারা । তার কারণে, আমরা অনিচ্ছাকৃত বা অসচেতনভাবে অতিরিক্ত সময়কে সংগঠিত মুক্ত সময়ের নামে নষ্ট করে থাকি এবং আমরা অবিরাম একঘেয়েমি দ্বারা বন্দী হই।

এডোর্নোর মতে যে অবসর ও মুক্ত সময়কে আমরা উপভোগ করে থাকি তা আদতে মুক্ত নয়। যদিও মানুষ মুক্ত সময়কে ‘সবোর্চ্চ স্বাধীন’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।১৪ লিবারেল ব্যবস্থাপনায় মুক্ত সময়ে উৎপাদনমূলক কাজের কথা বলা না হলেও মানুষ বিভিন্নভাবে এর সাথে জড়িয়ে পড়ে। তাই এখন মুক্ত সময় বলতে ‘শ্রমের বিপরীত ‘ কোন অবস্থানকে বুঝায় না। এটি এমন একটি ব্যবস্থায় যেখানে পূর্ণ কর্মসংস্থান নিজেই আদর্শ হয়ে উঠেছে। এডোর্নোর ভাষায় ‘মুক্ত সময় শ্রমের একটি ছদ্মবেশী ধারাবাহিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।’১৫ কাজের সময়ের সাথে মুক্ত সময়ের এই আপাত পৃথকীকরণের লক্ষ্য হচ্ছে পুনরুৎপাদন বজায় রাখা। কারণ শ্রমশক্তিকে পুনরায় তৈরি করার জন্য পুঁজির অবৈতনিক সময়ের প্রয়োজন। অর্থাৎ সংস্কৃতি কারখানার আওতায় একজন শ্রমিক বা পেশাজীবি মানুষ যে মুক্ত সময় ভোগ করেন সেটি আসলে মুক্ত নয়। এটি হচ্ছে ব্যক্তিকে তার পরবর্তী কাজের জন্য প্রস্তুত করে তোলার প্রক্রিয়া। সংস্কৃতি কারখানা নাগরিকদের মুক্ত সময়ের মধ্যেও নাগরিকদের ভোক্তা এবং ভোক্তাদের অবৈতনিক শ্রমিকে পরিণত করে। এডর্নো যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যে আমাদের মুক্ত সময় একটি “কাজের নিছক পরিশিষ্ট” অংশ হয়ে উঠবে তা প্রতিফলন বর্তমানে আরো ব্যাপক ও স্পষ্ট। কাজের জায়গাগুলো ঘরের অনুরূপ হয়ে ওঠেছে এবং ঘরসমূহ অফিসের পরিশিষ্ট কাজের অংশে পরিণত হয়েছে। এটি স্পষ্ট যে আমরা সহজেই  আমাদের কর্মক্ষেত্র থেকে স্বাধীনতার জগতে বিচরণ করতে  পারি না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে মুক্ত সময়কে ব্যয় করা হয় এটিও একইভাবে উৎপাদনমূলক অনুশাসতান্ত্রিকতা দ্বারা নির্ধারিত। সংস্কৃতি কারখানার বর্ধিত রূপ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও তার ভোক্তাদের ‘শ্রেণীবিভাগ করা, সংগঠিত করা ও আকার দেওয়ার’ কাজটি করে থাকে।

 

আমাদের সংস্কৃতি কারখানা

অন্যান্য সংস্কৃতি কারখানার মতো আমাদের দেশেও সংস্কৃতি কারখানার একচেটিয়া আধিপত্যের চরিত্রে  এক তবে তার কার্যক্রমের প্রক্রিয়া অভিন্ন নয়। পূর্ণাঙ্গ, সূক্ষ ও যৌক্তিক কাঠামোকে আমাদের সংস্কৃতি কারখানা অনুসরণ করেনা। এডোর্নো যেমন চিহ্নিত করেন; সংস্কৃতি কারখানা একধরনের ‘যৌক্তিক’ কাঠামো দ্বারা গঠিত,১৬ তার অনুপস্থিতি রয়েছে আমাদের দেশে।  এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি কারখানা পর্যাপ্ত গণতান্ত্রিকতার অভাবে সার্বভৌম ক্ষমতা দ্বারা প্রভাবিত। এর ফলে এটি নিজেই রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সার্বভৌম ক্ষমতা চর্চাকে অনুমোদন প্রদান করে। একমাত্রিক সমাজ তৈরি কোন প্রেষণা তার মধ্যে নেই।  এজন্য জাতীয় উদযাপনগুলো মধ্যবিত্তের করায়ত্ত, জনসাধারণের অংশগ্রহণ এখানে সক্রিয় নয়। সংস্কৃতি কারখানা সর্বসাধারণকে এর অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। পশ্চিমা সংস্কৃতি কারখানা মতো আমাদের দেশের সংস্কৃতি কারখানা একটি সমজাতীয় সংস্কৃতি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়নি। এজন্য বাংলা নববর্ষ পালন নিয়ে এখনো বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন রয়ে গেছে। আমাদের সংস্কৃতি কারখানার ভূমিকা জ্ঞানতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিকভাবে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়৷ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও দর্শন বিকাশে সংস্কৃতি কারখানার কারিগরদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই। সংস্কৃতি কারখানা কতৃক উৎপাদিত ‘সমজাতীয় সচেতনতার’ অভাবে এদেশের নাগরিকরা পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং একে অপরের প্রতিপক্ষ। এই বিচ্ছিন্নতা বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ও অবিচার সম্পর্কিত পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গিকে জটিল, দ্বৈত এবং অনিশ্চিত করে তুলে। যার ফলে জীবনের পক্ষে সবসময় চূড়ান্ত অবস্থান গ্রহণ ও নূন্যতম জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করে। সংস্কৃতি কারখানার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে ক্রিটিকের যে সুযোগ রয়েছে তা আমাদের দেশে সংকুচিত।

তবে সংস্কৃতি কারখানার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব উল্লেখযোগ্য।  এটি যেনো শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উৎপাদনে ও রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চার সহায়ক কর্মকান্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ক্ষমতার পক্ষে গণমাধ্যমের পক্ষপাতের বিষয়টি এখানে ব্যাপক ও স্পষ্ট। আমাদের দেশের গণমাধ্যম বিভিন্ন সংবাদের যে  ফ্রেমিং করে থাকে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সংবাদপত্র যখন তাদের রিপোর্টিংগুলো করে তখন অসংযতভাবে প্রকৃত অবস্থান বর্ণনার চেয়ে সাবজেক্টিভ মতামত বা বিশ্লেষণকে  প্রাধান্য দেয়। গণমাধ্যমে এই সাবজেক্টিভ অবস্থানের পিছনে রয়েছে রাজনীতি ও পুঁজির সম্পর্ক। অধ্যাপক আলী রিয়াজের গবেষণা প্রকল্প এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।১৭ এ গবেষণায় দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম যারা পরিচালনা করে থাকেন তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। পাশাপাশি এগুলোকে প্রভাবশালী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যাদের কাজ নিজস্ব স্বার্থে স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখা।

 

সংস্কৃতি কারখানায় রাজনৈতিক মুক্তির সম্ভাবনা

এডোর্নোর সংস্কৃতি কারখানা সম্পর্কিত ক্রিটিকটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কেননা এটি ক্ষমতা সম্পর্কের বৈচিত্র দিককে উন্মোচন করে। কিন্তু এগুলো থেকে  রাজনৈতিক মুক্তির সম্ভাবনার দিকনির্দেশনা স্পষ্ট নয়। ফলে তার সংস্কৃতি কারখানার ক্রিটিকটি একটি সর্বাত্মক ক্রিটিকে রূপ নিয়েছে। এডোর্নো মনে করতেন ‘বিশুদ্ধ শিল্প’ বলতে কিছু নেই।১৮ সংস্কৃতি কারখানা শিল্পকর্মের যে সার্বভৌমত্ব রয়েছে তাকেও কারখানার সক্রিয়তার মাধ্যমে ‘নির্মূল’ করে দেয়। এখানে এডোর্নোদের সাথে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ফারাকের জায়গাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এডোর্নো শিল্পকে একটি বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। শিল্প বিষয়টি তাদের দৃষ্টিতে কিছুটা বাণিজ্যিক, প্রলোভনসঙ্কুল এবং অগভীর,  জনগণকে প্রতারিত করার জন্য সাংস্কৃতিক পণ্য। যেখানে বেঞ্জামিন তার ‘দি ওয়ার্ক অব আর্ট ইন দি এজ অব মেকানিকেল রিপ্রোডাকশন’প্রবন্ধে এডোর্নোদের থেকে ভিন্নভাবে শিল্পকে দেখার চেষ্টা করেছেন। আলোকচিত্র বা চলচ্চিত্র শিল্প কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন করার পরিবর্তে, বেঞ্জামিন আলোকচিত্র এবং চলচ্চিত্রকে নিজেই কীভাবে শিল্পের ধারণাকে রূপান্তরিত করে তা অনুসন্ধান করেছেন। বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পের ধারণাকে প্রতিনিয়ত নবায়ন করতে হয়। বেঞ্জামিন মনে করেন যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে গণসংস্কৃতির নতুন এক রূপলাভ করেছে যার ফলে উচু মানের সংস্কৃতির আধিপত্য কমে আসছে। জনসাধারণের এর মাধ্যমে নিজের কর্তাসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ রয়েছে।

বেঞ্জামিন মনে করেন যারা চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করেন না, তারা মূলত পুরাতন নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে শিল্পের মানদণ্ড বিচার করে থাকেন। চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে নন্দনতত্ত্বের একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। যার ফলে নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা পুর্ননির্মান প্রয়োজন। বেঞ্জামিন মনে করেন উৎপাদন ও ভোগ উভয় ক্ষেত্রে যে সংস্কৃতি কারখানায় জনগণ অংশগ্রহণ করতে পারে সেটি হচ্ছে চলচ্চিত্র। জনতা নিজেই নিজেকে চলচ্চিত্রের ‘অংশ হিসেবে আবিষ্কার করতে পারেন।’১৯

প্রযুক্তির বিকাশমান এই সময় শিল্প-সাহিত্য,চলচ্চিত্র  সহ সংস্কৃতি কারখানার সর্বাত্মক ক্রিটিক আমাদের জন্য নতুন কোন সম্ভাবনা তৈরি। সংস্কৃতি কারখানার যে দ্বৈত প্রকৃতি রয়েছে এ বিষয়টিকে এডোর্নোরা উপেক্ষা করেছেন। অন্যদিকে, বেঞ্জামিন অনুভব করেছিলেন যে সংস্কৃতির পুঁজিবাদী উৎপাদন সহজাতভাবে পরস্পরবিরোধী, কারণ তিনি অনুমান করেছিলেন যে পুনরুৎপাদনযোগ্যতার কারণে গণমাধ্যম প্রযুক্তিগুলি জনসাধারণের সংস্কৃতিকে স্থান দিতে বাধ্য। যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে, গণতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তিরা তাদের ইচ্ছামত চলচ্চিত্র, সঙ্গীত বা শিল্প তৈরি করতে পারে। ইন্টারনেটের আবির্ভাব পরবর্তী সময়ে, যারা নতুন সংস্কৃতির ধরন তৈরি করতে চায় যা সংস্কৃতি শিল্পের বিদ্যমান নিয়মগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে তারা ইন্টারনেটে মাধ্যমে  তাদের কাজগুলি সহজেই বিতরণ করতে পারে। যারা এটি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক তারা খুব কম খরচেই একে বিস্তৃতভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারে। এর মাধ্যমে বর্তমান সময়ের চিন্তার একটি স্বয়ংক্রিয় জায়গাকে নির্দেশ করে। বেঞ্জামিনের মতে দর্শকই এখন ‘বাজারের নিয়ন্ত্রক।’২০ প্রযুক্তির অগ্রগতি ফলে যেকেউ এখন সংস্কৃতি কারখানার অংশ হয়ে ওঠার দাবি রাখে। অর্থাৎ ভোক্তার কর্তা হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভোক্তা ও কর্তার ভেদের জায়গায় একধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। এজন্য প্রযুক্তির উন্নতি, গতি ও প্রাচুর্যকে জনতার পক্ষে নিয়ে আসার সূত্রকে রপ্ত করে চর্চা করতে হবে।

যদিও গণমাধ্যম প্রযুক্তির মধ্যে  একটি রাজনৈতিক অর্থনীতি প্রেষণা সবসময়ই থাকে কেননা এসব বিষয়গুলো যেসব জ্ঞানতত্ত্ব উৎপাদন করে তা সামাজিকভাবে নিরপেক্ষ বা নিরীহ নয়। তাই ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ নয় বরং শিল্প হতে হবে সমাজ, রাজনীতি অথবা অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। এজন্য বেঞ্জামিন শিল্পকলাকে ‘রাজনৈতিক লড়াইয়ের’ হাতিয়ার হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।২১ সচেতনভাবে শিল্প বা সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে জনতা নিজেই সক্রিয় কর্তাসত্তা হয়ে ওঠতে পারে, তা হোক সাহিত্য চলচ্চিত্র বা অন্যান্য কোন ধারা। এজন্য প্রধানত সংস্কৃতি কারখানা উৎপাদন ও বন্টনের ব্যাপারে গণসচেতনতা বৃদ্ধি পেতে হবে। সংস্কৃতি কারখানার আধিপত্যশীল ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে জনকল্যাণকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

 

পরিশেষ

পুঁজির অবস্থানকে উদার ও স্থিতিশীল করার জন্য সংস্কৃতি কারখানার কতৃপক্ষরা হয়ত একধরনের মেকি পুঁজি বিরোধী সিন্টিমেন্ট তৈরি করতে পারেন, কিন্তু জনসাধারণ কিভাবে একে  গ্রহণ করে তার দিকটি তাৎপর্যপূর্ণ। এর একটি উদাহরণ হতে পারে মানি হাইস্ট টিভি সিরিজটি। হলিউডের অন্যান্য আমূল পরিবর্তনকামী,  পুঁজিবাদ বিরোধী চলচ্চিত্রের একটি প্রতিফলিত রূপ পাওয়া যায় এই টিভি সিরিজটি। গণআন্দোলনের চরিত্রকে উপেক্ষা করে একধরনের অদ্ভুত প্রতিরোধের রাজনীতি উপস্থাপন করা হয়েছে এ সিরিজটির মাধ্যমে। এই টিভি সিরিজটির প্রধান বিপ্লবী চরিত্র প্রসেফর একইভাবে  ডার্ক নাইটের জোকারের মতো অস্বাভাবিক বৈপ্লবিক চরিত্রের অধিকারী।  মানি হাইস্টে প্রফেসর তার সহকর্মীদের একটি গান শেখানোর পরে পুরো সিরিজ জুড়ে যে মূল গানটি গাওয়া হয় তা হল ফ্যাসিবাদ বিরোধী সঙ্গীত “বেলা সাও”। এটি ইতালীয় একটি লোক সংগীত। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নাৎসি জার্মানি এবং মুসোলিনি শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।২২

কাহিনীর কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে ডাকাতরা ইতালীয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী ‘প্রতিরোধের’ আধুনিক প্রজন্মের প্রতীক। এটি যেনো ‘প্রতিরোধের রাজনীতির’ সাথে একধরনের উপহাস। প্রফেসর ও তার দলের লোকেরা ডাকাতির মাধ্যমে রাজনৈতিক অর্থনীতি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ ঘোষণা করেন।’২৩ ডাকাতরা লুটপাটের সময় সালভাদর ডালির মুখোশটি পরে, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ব্রাজিলের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন, বিভিন্ন দেশের নারী অধিকারের মিছিলে এই মুখোশটি পরিধান করতে দেখা গেছে। ফ্রান্স এবং সৌদি আরবের স্টেডিয়ামে, এমনকি জি-২০ সম্মেলনে বিক্ষোভকারীরা এই মুখোশটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।২৪ টিভি সিরিজটি জনমানসে একটি বিভ্রম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যে জনতা নিজেরাই মুখোশ পরে থাকবে। কিন্ত বাস্তবিক, মুখোশ পরার প্রয়োজন তাদের যারা ক্ষমতার সম্পর্কে, সত্যকে আড়াল রাখেন। যারা জনসাধারণের শোষণ-দুর্দশা, ক্ষুধা, অনাহারের কারণ। এই ধরনের টিভি সিরিজ বা চলচ্চিত্র মূলত সামাজিক স্থিতাবস্থাকেই সমর্থনযোগ্য করে তুলে। বেঞ্জামিনের মতে একটি চলচ্চিত্র তখনই তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে যখন সে তার ‘সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার’ ও প্রথাগত জীবনযাপনের সাথে বিচ্ছেদ ঘটায়।২৫

চলচ্চিত্রসহ অন্যান্য সংস্কৃতি কারখানার মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত পেতে হলে গণসংস্কৃতির অবস্থানকে আরো বেশি রাজনীতিকীকরণ হতে হবে। কেননা রাজনীতি হচ্ছে মুক্তি ও সহিষ্ণুতার সত্যিকারের সংগ্রাম। সংস্কৃতি কারখানার মাধ্যমে কোন সবার্ত্মক ব্যবস্থাপনা নয় বরং এর মাধ্যমে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে। যে সংস্কৃতিক কারখানা একমাত্রিক সমাজ নয় বরং বহুমাত্রিক সমাজ তৈরি করবে।

 

 

তথ্যসূত্রঃ

১) Theodor W.Adorno, The Culture Industry: Selected essays on mass culture, Edited by J. M. Bernstein, Routledge, London and New York, 2001, p.98

২) Max Horkheimer and Theodor W. Adorno, Dialectic of Enlightenment Philosophical Fragment, Translated by Edmund Jephcott, 2002, p.95

৩) Ibid.

৪) Ibid.

৫) Ibid, p.79

৬) Theodor W.Adorno, Ibid, p.136

৭) Ibid

৮) Ibid, p.139

৯) Ibid.

১০) Ibid, p.138

১১) Ibid, p.151

১২) Ibid, p.150

১৩) Ibid, p. 197

১৪) Ibid, p.191

১৫) Ibid, p.194

১৬) Ibid, p.185

১৭) bdmediaowners.com/reports-2/

১৮) Theodor W.Adorno, Ibid, p.159

১৯) ত্রিন টি. মিন-হা ,  স্টুয়ার্ট হল ,  ওয়াল্টার বেনজামিন, বিষয় সিনেমা: তিনটি অনূদিত প্রবন্ধ, অনুবাদ: মোহাম্মদ আজম, চৈতন্য, ২০২০, পৃ.৪৮

২০) প্রাগুক্ত, পৃ.৪৭

২১) প্রাগুক্ত, পৃ.৩২

২২) Arvin Bahl, The Bizarre Political Ideology of Netflix’s La Casa de Papel, National Review, September 12, 2021.

www.google.com/amp/s/www.nationalreview.com/2021/09/review-money-heist-the-bizarre-political-ideology-of-netflixs-la-casa-de-papel/amp/

২৩) Ibid.

২৪) Ibid.

২৫) ত্রিন টি. মিন-হা ,  স্টুয়ার্ট হল ,  ওয়াল্টার বেনজামিন, প্রাগুক্ত, পৃ.৩৬

About The Author

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!