হাসপাতালের লাইটপোস্টের উপরে একটা রাতজাগা পাখি, শীতে। কুয়াশার চাপ নিচ থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে এসেছে অনেক উঁচুতে। বরফের অজস্র কুচি নীরবে ভেঙে ভেঙে ঢুকছে অবিরাম বাতাসে। ঘিরে ধরেছে বিস্তৃত চারপাশ; দৃষ্টি যতোটুকু যায় কুয়াশার ধোঁয়া ডুবিয়ে দিয়েছে খণ্ডকালীন আকাশ। এ-বছরের ঠাণ্ডায় কেমন মানুষজন মরতে পারে-এইসব আলোচনা চলছে। সখিচান ঘরে। পরেই উষ্ণ হবে। চৌদ্দ বছরের ঋতুবতী মেয়েটা দরোজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বাবার আসর শুরু হবার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। সখিচানের প্রধান শিষ্য গোবিন্দ গেছে মদ আনতে। কথা ছিলো হারাধনের। হারাধন টাকা খরচ করে ফেলেছে, পরন্তু কোনো দোকান তাকে বাকি দেয়নি। খালি হাতে ফিরছিলো হারাধন, বেশ কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুর দিয়ে পথ থেকে এক মুসলমান বন্ধুকে নিয়ে ঘরে ঢুকে সোজা সখিচানের পার ওপর পড়লো, ‘মাফ করে দে সখিচান-টাকা হাতে এলেই খরচ হয়-এ-আমার বড়ো দোষ-বিশ্বাস কর, লুকিয়ে কিন্তু মাল খাইনি।’ হারাধন সখিচানের সমবয়সী ও আপন শালা। সখিচানের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ হবার আগেই দুলারী দরোজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে ফাল্গুনীকে ডেকে বিশেষ এক জায়গা থেকে (একটা লাল কৌটা খুলে) টাকা বের করে এনে গোবিন্দ’র হাতে দিয়ে বললো, ‘যা গোবিন্দ আজ দু’বোতল নিয়ে আয়, ঘরে কষা মাংসও আছে।’ -শুনে নড়েচড়ে বসে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বাম চোখ টিপে দিলো সখিচান। দুই-একবার শিস দিয়ে বাঁশের বাঁশিটা হাতে তুলে নিলো। ঘরে ছোটো জানালাটা যেখানে ওরা বসে আছে সেই চৌকির আধহাত ওপরে, যার একটা পাল্লা বন্ধ করা।
কুয়াশা দেখতে-দেখতে সজোরে বলে উঠলো, ‘সখিচান, আজ তোর বিদায়!’ আস্তে-আস্তে আবার বললো, ‘চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কী’… একটু ভাবলো, মনে হলো- ‘হ্যাঁ ফেয়ারওয়েল না কী যেন বলে তা-কি হয়, কি দরকার? হলে ভালো হতো, না হলে আর কী করা।’ আজ পর্যন্ত কি কম লোক তাকে চেনে- হ্যাঁ, ওই তো সখিচান, নাটক করা রাজার দেহের মতো কখনও পেছনে দু’হাত দিয়ে, কখনও জোরে পা ফেলে লম্বা চওড়া ভারি দেহটা নিয়ে যখন রাস্তা থেকে হাসপাতালে ঢোকে তখন দূরত্ববোধে অথবা নিকটবর্তী জায়গা থেকে তার প্রতি কৌতূহলের প্রক্ষেপণ বুঝতে পারে। মানুষ তাকে কেন এভাবে দেখে- প্রশ্নের উত্তর খোঁজে না। বোঝে- এই আগ্রহ কেবল তার পেশার জন্যে। ভাবে, শেষ বয়সটা খারাপ যাবে না। সে তো পেনশন পাবে; টাকাও জমিয়েছে কিছু; কিন্তু সে-তো ভবিষ্যৎ। আজ থেকে সখিচানের কোনো পেশা নেই। গোবিন্দ জায়গাটা নিয়েছে। অস্থির, তবুও কাজ ভালো শিখেছে। সখিচান মাথা নিচু করে আঙুল নাড়িয়ে বিড়বিড় করে এসব কথা বলতে লাগলো।
দুলারী, হারাধন ও সঙ্গে আনা মুসলমান বন্ধু আর মেয়ে ফাল্গুনী এদের সবার দিকে একবার তাকিয়ে, সখিচানের ঘোলাচোখের দিকে আড়চোখে লক্ষ ক’রে জানালার যে খোলা পাল্লা দিয়ে সখিচান তাকিয়ে ছিলো লাইটপোস্টের দিকে, সেইদিকে তাকিয়ে ভাবলো অতীব নিরাপত্তা বিষয়ক কিছু; দুলারী প্রথম ভাবতে লাগলো, সখিচানের চাকরির মেয়াদ শেষ এখন। না খেয়ে তারা মরবে না। সখিচান করিৎকর্মা, তাছাড়া সরকার থেকে পেনশন পাবে; চিন্তার দানাটা বাঁধছে অন্যখানে, ঘর ছেড়ে দিতে হয় কি-না! নির্দিষ্ট কোনো ঘর ওদের জন্যে বরাদ্দ হয় না; কর্মক্ষেত্রের ঘরটার পাশে একটা ছাড়া মতো দেয়া হয়- সখিচান আগে ওখানে থাকতো কিন্তু দুলারী বিয়ের পরে সেখানে থাকতে চায়নি। ফাঁকা জায়গা খুঁজে চারিধার থেকে পুরনো ইট জোগাড় করে কাদা দিয়ে গেঁথে উপরে টিন দিয়ে ছাদ বানিয়ে আর ইটের উপর ডিস্টেম্পার লাগিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জায়গায় থাকছে। সব মিলিয়ে আঠারো হাজার টাকা খরচ পড়েছে। দুলারীকে বিয়ে করার আগে সখিচানের কোথাও কোনো বিষয়ে আপত্তি ছিলো না কিন্তু দুলারী আসার পর আরএমও সাহেবদের সঙ্গে ঘর তোলা নিয়ে প্রায় দশ-পনের বছর নানারকম দাপ্তরিক উৎকণ্ঠা সখিচানের ভেতর কাজ করেছে। -তো হঠাৎ শোঁ করে, এইমুহূর্তে একটু, শীতের বাতাস ঘরে ঢুকলো। দুলারীর একবার মনে হলো পাল্লাটা বন্ধ করে খিল আটকে দেয়। এখন ভয়ানক শীত দুলারীর দুই কানের লতিতে, হাতের তালুতে আর কপালের ওপর এসে বসতে চাচ্ছে। হারাধন আর তার মুসলমান বন্ধুটা কে কতো হিন্দি ছবির গানের নাম বলতে পারে এরকম সংখ্যা গুণে গুণে, কখনও আবেগে ছবির নাম বলে, গুনগুন সুরে গান গেয়ে পরস্পরের এই বিষয়ক জানাশোনার প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করছে। দুলারীর একবার মনে হলো সখিচানের তুলনায় গোবিন্দ’র দ্রুত না আসার বিষয়টি নিয়ে ওরা উদগ্রীব। সখিচান জানালা দিয়ে লাইটপোস্টের ওপর রাতজাগা ঝিমানো পাখিটার দিকে তাকিয়ে হাতের বাঁশিটা তুলে নিলো; কুয়াশায় প্রায় দেখা যাচ্ছে না পাখিটাকে। সখিচানের তামাটে রঙের শরীরের তলে উড়ুউড়ু-মনটা পাখিটার নির্জীব অস্তিত্বকে জাগিয়ে তুলে একাত্ম হতে চাচ্ছিলো। এই সময় দরোজায় খট করে শব্দ করে ভেজানো দরোজা দিয়ে গোবিন্দ মুখ দিয়ে উহ্ উহ্ করে ঘরে ঢুকলো। বাইরের ঠাণ্ডায় মুখটা লাল। মদ নিয়ে সে এসেছে। ঘরে ঢুকে গোবিন্দ চৌকির উপরে উঠে বসলো শীতের কবল থেকে যেন রক্ষা পেয়েছে এইরকম ভাবে; বসে হারাধনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোর বন্ধু কী করে রে? আমাদের সঙ্গে জানাশোনা করিয়ে দে।’ হারাধনের বন্ধু এতোক্ষণ ভাঙা একটা চেয়ারে বসেছিলো। হারাধন তার দিকে তাকিয়ে এবার ঘাড়টা বেঁকিয়ে বেশ কাঁচুমাচু করে মুখ ভার করলো, ‘ও কবি কিন্তু লেখে না। মুখে মুখে লেখে; কোটি টাকা দিলেও লিখবে না কিন্তু যে বিষয়ে বলবা গুছিয়ে বলে দেবে। বড়ো বড়ো অফিসারদের বিদায়ের সময় যেসব কথা বলে সেগুলো পারে কি-না জিজ্ঞেস করেছি, বললো পারে। পুরো সখিচানের কাজকাম বিস্তারিত বলেছি। আমাদের ভেতর ও-ই সব গুছিয়ে সখিচানকে বলবে।’ ভেতর ভেতরে অবাক হলো সখিচান। খানিকটা বোকার মতো তাকালো হারাধনের দিকে; হারাধনের মন বুঝতে পারার ক্ষমতাটা আছে। কখনও বলেছিলো হারাধনকে? না, সেরকম মনে পড়ছে না। নিজে একবার শুনেছিলো একজন ডাক্তারের ফেয়ারওয়েলের আলোচনা। সখিচান পড়াশোনা জানে না। ভালো বাংলা আর ইংরেজির অনেক শব্দ বোঝে। চেষ্টা করে ভালো বাংলায় কথা বলতে। চিন্তাশীল লোক সে। মনে পড়লো ডাক্তার সাহেবের ফেয়ারওয়েলে, একটা লেখায়, কী সুন্দর গুণগান করা হয়েছিলো। দেখা যাক, হারাধনের বন্ধুটা কেমন কথাগুলো তাকে নিয়ে বলে।
হারাধনের বন্ধুর নাম মনোহর। সে মদের বোতলের দিকে আড় চোখে চেয়ে বললো, ‘আমি কয়েকটা কথা বলে আপনাদের খুশি করতে পারলে খুশি হবো।’
সখিচান হেসে উঠে বললো, ‘আরে হ্যাঁ-হ্যাঁ তাই তো।’
দুলারী চৌকি থেকে নেমে খুব দ্রুত পাত্রভরা মাংস চুলো থেকে তুলে এনে পাশে রাখলো। সঙ্গে থালা এবং অনুষঙ্গ। মনোহর সবার দিকে একবার তাকালো। কথাগুলো ভাঙা গলায় সাবলীলতার সঙ্গে বেরিয়ে এলো,
‘হে বিদায়ী বন্ধু,
উপচে পড়া এই শীতের রাত। চারিদিকে কুয়াশা আর শিশিরভেজা বাতাস। রাতের এই মধ্যপ্রহরে তোমাকে বিদায় দিতে বসে থৈ-হীন শোক-নীরে অবগাহন করছি। তোমার বিদায় আর শুনবে না আমাদের রোদন, যেতে তোমাকে হবে; যেতে দিতেই হবে। এ-বড়ো নিষ্ঠুর নিয়ম। নতুনের আগমন আর পুরনোর বিদায় সূর্যধারার মতো স্বতঃসিদ্ধ।’
‘ঠিক বলেছে’-সখিচানের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো গোবিন্দ।
‘হে সাথী,
তবুও কথা থাকে। কথা বলতে হয়। তোমার বিদায় বড়ো বেশি বাজে। বাজে করুণ সানাই এই মনে। তোমাকে বিদায় দিতে বসে ভাবছি-তোমার এই ভারি দেহখানা আর রাজার মতো পথচলা এইসব প্রতিবিম্ব কদাচিৎ হয়তো দেখা যাবে। আমরা হারাচ্ছি তোমাকে। তোমাকে হয়তো আমরা অনেক সময় তুচ্ছ করে দেখেছি; কিন্তু আজ মনে হয়:
যা কিছু হেরি চোখে
কিছু তুচ্ছ নয়
সকলি দুর্লভ বলে আজি মনে হয়।
আর এটাই ঠিক। কোনো মানুষের অনুপস্থিতিতে তার প্রয়োজনীয়তা, কর্মকাণ্ড, তার স্নেহভরা মন ফাল্গুধারার কথা বুঝিয়ে দেয় মর্মে মর্ম-তখনই মূল্যায়ন হয়।’
‘একদম ঠিক-বলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার নিস্তেজ হয়ে গেলো সখিচান। এমনিই মনোহর এইটুকু বলেই শেষ করতো। হঠাৎ সখিচানের এই মন্তব্যে আর ঘরের সবার চোখের মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে আরও কিছু বলতে গিয়ে না পেরে থেমে-থেমে বললো, ‘সখিচান তুমি অনেক দিন বাঁচো। আমরা তাই চাই। তোমার নতুন জীবন হোক। তাই চাই।’
সখিচান হাসলো। হারাধন ততোক্ষণে বোতল থেকে মদ ঢালতে শুরু করেছে। দুলারী একহাতে একটা গ্লাস ধরে অন্যহাতে ফাল্গুনীকে টেনে এনে নিজের বুকের আঁট ব্লাউজের ওপর, যেখানে স্তনযুগলের ভাঁজের মাঝের খাঁজ দেখা যাচ্ছে, সেখানে ফাল্গুনীর মাথাটাকে আলতো হাতে চেপে রাখলো। গ্লাসটাকে রেখে সত্তার গভীরে এক সুখানুভব করলো সে। সংসারে ধাত্রীবিদ্যায় পোক্ত, চাকরানীগিরি এবং চপল মনোহারিনী, সখিচানের পকেট থেকে টাকা চৌর্যবৃত্তি করায় পারদর্শিনীসহ সুকণ্ঠী এবং দুর্মুখ এই দুটোর অধিকারিণী-বহুবিধ গুণী হয়ে দুলারী আজও সুন্দর, ভারি শরীর হলেও তার কটিদেশে মাংস জমেনি। চোখদুটো মায়াময়ী। সখিচানকে ধরে রাখার জন্যে যতোটা চপলা আর কূটবুদ্ধির ভারসাম্য রেখে যেভাবে চলতে হয়েছে তাতে তার রূপ বেড়েছে বৈ কমেনি।
মদ ঢালা শুরু করেছে গোবিন্দ। চেহারায় অনুতাপ। সূক্ষ্ম। দুলারীর মনে হলো, গোবিন্দ শক্ত-সমর্থ কিন্তু ভীতুচোখে সবকিছু দেখে নেয়ার অভ্যাসটা প্রখর। চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিলো গোবিন্দ। হারাধনের ছিপছিপে শরীরটা পুরনো মার্কেট থেকে কেনা লম্বা নীল ওভারকোটের ভেতর যৎকিঞ্চিৎ ওম পাচ্ছিল। মনোহরের গায়ে ভারি গরম পোশাক।
চেহারায় শীতকাতুরে ভাবটা বেশি। সখিচান নিষ্প্রভ হয়ে হাতে মদের গ্লাসটা তুলে নিলো কোলের উপর থাকা বাঁশিটা কয়েকবার নাড়াচাড়া করে। বিশাল দেহের সখিচানের গায়ে লাল মোটা সোয়েটার আর মাথাটা ডোবানো ছাই রঙের গোলটুপিতে। মনোহরের কাছে এইমুহূর্তে ভিন্ন গ্রহের মানুষ হিসেবে সখিচানকে মনে হলো। শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকে। হাসপাতালের দেয়ালের ওপর শিকে-গাঁথা রাত আকাশসমান উঁচু। ওই রাতের উত্তুঙ্গে শীতের কুয়াশা ধোঁয়াটে নিশ্বাস ফেলে টানটান সুতোর থান কাপড়ের আকাশ বানিয়ে সেখানে টুকরো অভ্রের মতো ক্ষুদ্র তারা জ্বালিয়ে আবহ তৈরি করেছে নিস্তব্ধতার। সখিচান জানালা দিয়ে পাখিটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো: মৃত্যু নিয়ে আমার কারবার অথচ কেউ কি বিশ্বাস করবে যে, মৃত্যুকে আমি দেখিনি। যাচাই করার চেষ্টা করি-তাও-বা কতোটুকু? চুক করে একটানে শেষ করলো পুরো গ্লাসটা। তবুও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশ্লেষণের সহায়ক হওয়া, অবাঞ্ছিত আঘাতের শনাক্তকরণ, ঘেঁটে-ঘেঁটে, কেটে-ছিঁড়েও কী বুঝতে পেরেছি-শীতার্ত বিষণ্ন বিহঙ্গের দিকে তাকিয়ে ভাবলো- মৃত্যু কী? মৃত্যু কেমন?
মনোহর সুন্দর করে বলে উঠলো, ‘সখিচান আমাদের সামনে নিজের স্মৃতি-বৃত্তান্ত বলুক।’
সবাই চাচ্ছিলো এমন কিছু একটা।
সখিচান হো-হো করে হেসে উঠলো, ‘তা মন্দ না।’
পূর্বপুরুষের ভিটেঘর ভারতের লক্ষ্মীসরাই। ব্রিটিশ পিরিয়ডে দাদা ভনু এসে প্রথমে এদেশে ডোমের কাজ নিলো। ভনু ডোমের ছেলে পাকিস্তান পিরিয়ডে ভাচু ওই ডোমের কাজই পেলো। ভাচু ডোমের বড়ো ছেলে সখিচান, গোলাপচান ছোটো ছেলে। দাদা ভনু ডোমের আর এক বউ ছিলো-সে ঘর ওখানেই আছে-এপারে আসেনি। সে ঘরে দুই ছেলে অর্থাৎ ভাচু ডোমের সৎভাই অর্থাৎ সখিচানের সৎকাকা, ননকা ও বাজুচানের সঙ্গে-একসময় ওই পরিবারের সঙ্গেও কিছুদিন এই পরিবারের চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিলো, এখন নেই। বাবা ভাচুর সঙ্গে লাশকাটা ঘরে সখিচান বড়ো হলো, কাজ শিখলো, ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে খুলি ভাঙতে পারলো, ছুরি দিয়ে গলা থেকে নাভি পর্যন্ত চিরতে লাগলো-এই সখিচান। খ্যাতিতে লোক লেগে গেলো। গোবিন্দ-তার জাতভাই না, সামনে বসা এই গোবিন্দ ডোম না, আসলে মুচি; লাশকাটা ঘরে পোস্টিং পেলো মুচি গোবিন্দ; আর ঝাড়ুদার হিসেবে সরকারের খাতায় সখিচান থাকলো। দুইপুরুষ এবং সে নিজেও দীর্ঘদিন লাশকাটা কাজে সংযুক্ত থেকেও সরকার তাকে বিদায় দিচ্ছে কাগজপত্রে ঝাড়ুদার হিসেবে-তাও আগে-সাতান্ন পুরে যাওয়ারও আগে-। এই যে গোবিন্দ-চোখেমুখে আজ অনুতাপ-কী দলবাজিই-না জানে, লোক দিয়ে রটিয়ে দিলো সখিচান নাকি লাশ কেটে পার্টির কাছ থেকে আলাদা করে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়-‘তাজ্জব কী বাত’-দুলারী জিজ্ঞেস করলে গোবিন্দ বলেছিলো, ‘তুমি আমার মা আর সখিচান বাবা, কাজ শিখেছি বাবার কাছ থেকে। একথা যে বলে তার মুখে ছাই ঢালো। শত্তুর। আরএমও সাহেবরা রেগেছে কোন কারণে সেটা আগে খোঁজো। বাবা-মা হারা গোবিন্দ তোমাদের ছেলে গো, তোমাদের আশীর্বাদ পেয়েই তো এতোটুকু-!’
সখিচানের শরীরের মতো তার রাগ অতো ভারি না। কাকে আর বলবে? এসব নিয়তি! মাসে কম করে দশটা অর্থাৎ বছরে একশো বিশটা লাশ, ট্রেনে কাটা, গাছ থেকে পড়া, ছুরিতে মরা, কারেন্টে শক, আগুনে পোড়া, গলায় দড়ি দেয়া, এন্ড্রিন খাওয়া-কতো মৃত্যুই সে নাড়াচাড়া করলো অথচ মরণ কী বুঝলো না? সখিচান কেমন-মৃত্যু খোঁজে? কে বলে ঝাড়ুদার? চওড়া বুক এই চওড়া দেহ! ইস্পাতের মতো মসৃণ আর শক্ত। দুই হাতের তালু ঘষে-ঘষে আগুন তৈরি করে। মৃত্যুকে খুঁজতে চায়। লোকে বলে নাকি রাজার মতো। অথচ ‘রেনুর ফাঁসি’ নাটকে বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চে তাকে যে সিনটায় প্লে করতে দিলো সেটা ছিলো জল্লাদের-এক বন্ধু বলেছিলো, ‘সখিচান, জল্লাদ আর রাজা একই। একজন হুকুম দেয় অন্যজন হাতে মারে। দুজনই মৃত্যুদূত। কই, সখিচান ভাবে, মৃত্যুদূত হয়েও মৃত্যু বুঝলো না। রাত ভালোবাসে। জানে, মৃত্যু রাতের মতোই নিস্তব্ধ আর মৃত্যুভাবনাটা মদের মতো। শালা যে-সময় আসবে সে মরেই আসবে, জিন্দা লাশ এসে আর সামনে শুয়ে পড়বে না যে- তখনই বুঝবে মরা আর জিন্দা কোনটা কেমন? তো একবার ফাঁসিতে ঝোলা এমন একজনের পোস্টমর্টেম করার সময় দেহের মাংস কোথাও-কোথাও লাফাচ্ছিলো। সখিচানকে ডাক্তার সাহেব বলে দিলেন লাশটা কেটে দিতে। লাশ কাটলো। আবার সেলাইও করলো। ডাক্তার চলে যেতেই লাশ কিছুক্ষণ পরে গঁ গঁ করে উঠলো। ভাচু ডোম তখন বুড়ো। সখিচানের পাশে-বললো, ‘ভয় পাসনে বেটা।’ কিন্তু সখিচান ভয় পেলো কেননা অবিরত লাশটা গঁ গঁ করে উঠতে লাগলো। রাত নেমে আসছে দেখে সখিচান বাবাকে আবারও ডাকলো। ভাচু ডোম বললো, ‘ও, মরা-কিন্তু শব্দ করছে সে ও না।’
‘কে-ও’-সখিচান বাবার কথায় চমকে উঠেছিলো।
‘দ্যাখ তাহলে’-বিড়বিড় করে বলতে লাগলো ভাচু ডোম।
সিধা জ্ঞান, সিধা জ্ঞান।
মরা ঘাটকা মাস্তান।
উল্টা খুবড়ি সিধা জ্ঞান,
মরা ঘাটকা মাস্তান।
আড় খাটকা খোপড়ি,
আড় খাটকা খোপড়ি,
ইয়া বাবা ডিডিভার।
ইয়া বাবা ডিডিভার।
ওঁম কালী ওঁম নমস্তে।
‘ও-ইয়া হাকড়া’ বলে থাপ্পড় বসালো ভাচু ডোম লাশের গায়ে। সখিচান লক্ষ করেছিলো লাশের অবিরাম গঁ গঁ শব্দ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ওইদিন জিন্দা আর মরার তফাৎ তার কাছে প্রকট হয়ে গিয়েছিলো। ভাচু ডোম আরও শিখিয়ে দিয়েছিলো ভূত হয়ে কেউ এলে মাত্র দু’বার ঘরের বাইরে এসে ডাকবে। ওরা তিনবার ডাকতে পারে না। এখনও তিনবার না ডাকলে সখিচান রাতে দরোজা খোলে না। এমন মেনে নেয়া নরম মানুষকে রাজা, জল্লাদ বানানো-একি খেলা? ডাক্তার সাহেবদের পাশে লাশ কাটার সময় তাকে খুব সতর্ক থাকতে হয় কেননা সে মালঝোল খেয়ে থাকে। ভুল কথা যদি বলে ফেলে কখনও। যদি সামান্যও আউট হয়ে যায়, সর্বনাশ! যদি ডাক্তার সাহেব তার ওপর অসন্তুষ্ট হয় এই ভয়েই থাকে। তবুও একদিন মদের আবেগে নেশাগ্রস্ত হয়ে মতিভ্রমে কীসব দেখে যা সে করলো তাতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলো। -ধবধবে শাদা রঙের এক মেয়ে, রূপসী, সদ্যপ্রসূত এক বাচ্চা রেখে এন্ড্রিন খেয়েছে-স্তনযুগলে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তৃষিত মেঘনা; অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার আহ্বানে ক্ষেত্রপট থেকে টপটপিয়ে বেরিয়ে পড়ছে অজস্র শ্বেতবিন্দু। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সখিচান, ‘রূপ, কী রূপ!’ ‘মরবো তো আমি, তুই ক্যান? লাশ আমি কাটতে পারবো না’ বলে সখিচানের হাউমাউ কান্না-থামায় কে? রাতে দুলারী জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘ওতো মাসুম বাচ্চা না (দুলারী জানতো বাচ্চাদের লাশ কাটার সময় সখিচান কষ্ট পায়)। তুমি কাঁদলে কেন?’ সখিচান সাফ জানিয়েছিলো, ‘কেঁদেছিলাম রূপ দেখে! রূপ তো আলো। মরে কেন?’
‘কখনও কালো মেয়েকে মরতে দেখেছো?’ -ঠাণ্ডা গলায় দুলারী সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলো।
‘এতো বছরে একটা কালো মেয়ে নিজে মরেছে তা দেখিনি কেন?’-শুনে সখিচান যেন সেদিন দুলারীকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলো।
‘ওরা যে মরণ নিয়ে বেঁচে থাকে। অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়-আমার মতো। না হলে কী রামপিয়ারী মানুষের ভেতর ঢোকে। (যদিও দুলারী কালো না, শ্যামলা) রামপিয়ারীর সুরত খুব ছিলো?’-পরক্ষণেই জানতে চায় দুলারী। ‘আরে না-না’-বলতে বলতেই সখিচানের মনে হয়েছিলো, বনগাঁয় বেড়াতে গিয়েছিলো সখিচান, যাত্রাদলে নাচতো রামপিয়ারী, রূপ মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো; বলেছিলো, ‘রাত ভালোবাসিস সখিচান?’ জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘হ্যাঁ রে, রাতেই আমার কাজ, তুই মানবি তো?’ মজেছিলো দুইজনে; দুলারীর দিকে তাকিয়ে ঝুটঝামেলায় যায়নি।
রামপিয়ারী সংক্রান্ত দুলারীর কথাটা তাড়াতাড়ি কাটিয়ে দিলেও সখিচান জানে, বহুরাত ঘুমাতে পারেনি। দুলারী চতুর কিন্তু কতোটুকুইবা বুঝতে পেরেছে? সখিচান বুঝতে দিয়েছে? সংসারে বাস করাটা জিন্দালাশ কাটা! এ কেন সখিচান বোঝে? সংসার মানে একে অপর থেকে সরে যাওয়া, পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে ব্যথা-বেদনা… এসব-তো সভ্য মানুষের চিন্তা। রামপিয়ারী তাকে কী এমন দিয়েছিলো যাতে দুলারী ঠিক ওই মুহূর্তেই হেরেছিলো? জানে সখিচান-মৃত্যু-রামপিয়ারী মৃত্যু, যা হারিয়ে যায় তা মৃত্যুর ছায়া। রামপিয়ারী হারিয়ে গিয়ে কিংবা সখিচান রামপিয়ারীকে হারিয়ে দিয়ে মৃত্যু থেকে সরে এলো-জীবনের প্রতি তা মমতা না বিদ্বেষ? -ঘুমের ভেতর বারবার তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে, বুকের দ্রুত নিশ্বাস আপনকার অন্তর্গত ঢালাই আর নির্মাণে হু-হু করে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। রামপিয়ারীকে সে ভোলেনি। ‘কী হলো গুরু-পোস্টের উপর কী দেখো-পাখিটা’-জড়ানো গলায় বললো গোবিন্দ।
‘শীতে বড়ো কষ্ট পাচ্ছে, হয়তো উড়তে চাচ্ছে, পারছে না।’ -সখিচান চোখ ঘুরিয়ে বললো। তারপর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে গোবিন্দ’র দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ভুলে যাবো ওকে, মরুক গে।’
‘না-না’-নেশা জড়ানো উত্তেজিত কণ্ঠ গোবিন্দ’র, ‘আমি বরং একটু পরে ওকে উড়িয়ে দিয়ে আসবো। না উড়তে পারলে ধরে নিয়ে আসবো।’
ফাল্গুনী বললো, ‘আমাকে এনে দিলে ওটাকে বাঁচাবো।’
দুলারীর এবার একটু শীত লাগলো হয়তো। চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘কই জমছে না তো-করছো কী তোমরা?’
‘আরেকটু ধরুক’-বললো হারাধন। ‘আজ মদ খেয়ে মরে যাবো দিদি।’
‘তাড়াতাড়ি মর্’-গোবিন্দ হারাধনের দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বললো, ‘তোর মরাই ভালো। গা-ভরা শাপ নিয়ে বেঁচে আছিস।’
হারাধনের দশটি ছেলেমেয়ের ভেতর তিনজন বেঁচে আছে আর সব বিচিত্র রোগে গতায়ু হয়েছে, যে তিনটে বেঁচে আছে তাদের অসুখ করেছিলো-যাই-যাই আর কি? হারাধন তখন রাস্তায় দাগ দিয়ে ষোলোগুটি খেলছিলো, বললো, ‘তিনটে গুটি আমার থাকবে।’ কেন সে বলেছিলো কে জানে? খেলা হয়েছিলো সমান সমান। ফিরে এসে দেখে তিনটে বাচ্চা বেঁচে আছে এবং সেই থেকে আজও ভালো আছে। বিপদ-আপদ ও অনেক ঝড় যায় হারাধনের ওপর। কিছুদিন আগে-সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান শুরু হলো, সেরকম একরাতে রাস্তায় আবোল-তাবোল বকতে বকতে হাঁটছিলো, গভীর রাতে হাঁটতে দেখে সেনাসদস্যরা তাকে পেশা জিজ্ঞেস করলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলো যে, সে সুইপার। ওরা তার নাম-ঠিকানা নিয়ে গিয়েছিলো আর যাওয়ার সময় খুব ভারি একটা শীতের কম্বল দিয়েছিলো। পরদিন একশ টাকায় কম্বলটা বেচে ব্রাউন পাউডার জ্বালিয়ে নাকে গন্ধ নিয়ে নেশা করেছে। খুঁজতে এসেছিলো সেনাসদস্যরা। পালিয়ে ছিলো দুইদিন। হেরোইন রাজনেশা-জানে হারাধন-এই নেশা বড়োলোকের, মদ তাকে মাতাল করে আর কিছুই না; কিন্তু ওই নেশায় মুরগির মতো পিটপিট করে তাকিয়ে ঝিমিয়ে কতো কিছু দেখে; রক্তের ভেতর অযুত-নিযুত কোটি-কোটি টিকটিকি ঝিম ধরিয়ে কাঁপায়-সাঁতরায় নিঃশব্দে, লাফ দেয়, টুপ করে গিলে খায় জেগে-থাকা যাবতীয় সুখের পোকা। তাকে অভিশপ্ত বললো গোবিন্দ-সে কী করে টাকা জোগাড় করে, প্রতিদিন এর জন্য কতো ব্যয় নির্বাহ হয়-সেসব কি চাট্টিখানি কথা। এ-এক অদ্ভুত গতি; ভালো-মন্দ দুটো পথেই সমান। নেশা টাকা জোগাড় করে। ব্যাটা গোবিন্দ তাকে অভিশপ্ত বললেও গোবিন্দ পরের পয়সায় শুধু মদ খায় আর বমি করে। হারাধন যখন এইসব ভাবছিলো, নেশার ঠিক গোলাপি ধাপে সবেমাত্র পা দেবে মনোহর, ‘শালা সাহিত্যিকরা এখনও ধরেই রেখেছে যে সুইপার, ডোম, ঝাড়ুদারদের জীবন মানেই নোংরা ঘিঞ্জিতে বসবাস। মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত রুচিবোধ ওদের ভেতর কোন পর্যায়ে যে চলে এসেছে না মিশলে তা বোঝা যায় না; অবশ্য সার্বিক পরিস্থিতি লক্ষ করেই শুধু না, একটু আগে দুলারী কাঠের এবং কাচের শোকেস থেকে মাংস বেড়ে দেয়ার জন্যে চিনামাটির প্লেট যখন নিপুণভাবে বের করছিলো-সেটা হয়তো মনোহরের চিন্তাকে উস্কে দিয়েছে। তখন গোবিন্দ’র মনে হলো পাখিটাকে সে উড়িয়ে দিতে পারবে নাকি ধরে নিয়ে আসবে। সখিচান মদের গ্লাস রেখে কোলের ওপর থেকে আড়বাঁশিটা তুলে তার সাতছিদ্রে মুখ আর অঙুলিসমষ্টির মৃদু কম্পনে আর ওঠানামায় একটু একটু করে যে তীব্র-তীক্ষ্ণ অথচ দূরগামী সুর ওঠালো তা তার ঘর চিরে মুহূর্তে সারা হাসপাতালের বিশাল-বিস্তৃত এলাকা নিস্তব্ধতায় স্তম্ভিত ক’রে, শীতের কুয়াশা ফুঁড়ে লক্ষ্যমুখী অজস্র তীরের মতো শোণিতে আঘাত করে যেন-বা আশ্রয় নিচ্ছিলো। এতো শিবরঞ্জন! -চমকে উঠলো দুলারী। এই রাগ অপেরার। রাতে যাত্রাপালার সুর! আয়োজনের জন্যে টেনে একাত্ম করায়, লক্ষ্যমুখ একই দিকে নেয়, কেউ একজন আসবে কিংবা আকাঙ্ক্ষিত কিছু গ্রহণ করার অচেতন প্রস্তুতি-বিমূর্ত-সম্মোহন! অর্থাৎ, গ্লাসধরা হাতটা কেঁপে উঠলো দুলারীর, রামপিয়ারী-যে মৃত্যু নিয়ে ঘুরছে, মৃত্যুর হাতেরই ছায়া, সখিচানের নিশ্বাসে যে সুর তা মৃত্যুরই অর্চনা-সে সুরমূর্ছনায় রামপিয়ারী থাকে, আপন করে নিজের মতো আসে আর যায়। কোন্ সুরে সখিচান রাখে যে ডাকলেই ভেসে আসে, ছড়িয়ে দিতে পারে অবলীলায়, বিশ্বস্ততায়। ভাবছিলো দুলারী, সখিচানের বাঁশির সুর দুলারীকে নির্দিষ্ট এই চিন্তায় একাত্ম হতে দিচ্ছিলো না। বারবার কেটে যাচ্ছিলো, তবুও তারই ফাঁকে দুলারী ভাবছিলো নানান কথা। রামপিয়ারী দেখেছিলো মরদের উন্মত্ততা আর সখিচান শুনেছিলো মৃত্যুর করতালি। কেউ মন বুঝেছিলো? সে জানে, রামপিয়ারী মোহ-দুলারী মায়া। রামপিয়ারীকে বিয়ে করলেও তবু ফিরে আসতে হতো। মৃত্যুর মোহ আর জীবনের মায়া সখিচানের সুরে সবকিছু অতিক্রম করে গভীরে এবং অনুক্তভাবে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিলো বেঁচে থাকার সাধারণ সূত্রগুলোকে। দুলারী যখন এসব ভাবছিলো গোবিন্দ তখন নেশার মধ্যস্তরে। সে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘যাই পাখিটারে ধরে আনি।’ কেউ উত্তর দিলো না। যেন গোবিন্দ যা কিছু করতে চায়, করুক। কেউই আর কাউকে কিছু বলবে না এখন।
সখিচানের শিবরঞ্জন যেন সুরের সমুদ্র; কোটি-কোটি অনুধ্বনির অদৃশ্য ঢেউগুলো ভিজিয়ে দিয়েছিলো আর অদ্ভুত রহস্যময় কোনো এক জগতে একে-একে ঢুকিয়ে নিচ্ছিলো প্রত্যেককে। ওই সুর ঘরে বসা সবাইকে অদ্ভুত এক কল্পনাজগতে তীক্ষ্ণনীরবতায় নিয়ে গিয়ে উন্মত্ত সব মস্তিষ্কের জন্যে আনছিলো অবিরত ভাবনার খোরাক। পরে সখিচানের জন্যে গ্লাস পুরে মদ এগিয়ে দিলে দুলারীর দিকে তাকালো সখিচান, বাঁশিটা কোলে রেখে গ্লাসটা ধরে ঢক ঢক করে একটানে পুরোটা শেষ করলো। দুলারীর চাদরের কোণা দিয়ে মুছলো মুখটা। জানালার পাল্লাটা সামান্য খুলতেই ঢুকে এলো হু-হু বাতাস-তার ভেতর লক্ষ করা গেল লাইটপোস্টের আলোয় পাখিটার লেজ হালকা লাল কালো, লম্বা ধরনের, ঘাড়টা উঁচু, বসে থাকার ভঙ্গিটা হাঁসের বাচ্চার মতো। খুঁটিয়ে লক্ষ করতে গিয়ে চোখে পড়লো পিলারের গোড়ায় মাটি-কাদা উঁচু হয়ে ঢিবি হয়ে আছে। পিলারটা হাসপাতালের পশ্চিমপাশের রাস্তার দিকে ছিলো; হাসপাতালের একটা বিল্ডিং তিনতলা করতে গিয়ে পিলারের তারগুলো বিল্ডিং-এর রেলিংয়ে বাঁধছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পশ্চিমপাশ থেকে পিলারটা উঠিয়ে নিয়ে এসে পূর্বপাশের রাস্তার গোড়ায় বসিয়ে দিয়েছে অর্থাৎ সখিচানের জানালার সামনা-সামনি। এতোক্ষণে খেয়াল হলো সখিচানের, তাই তো, পিলারটা এইপাশে নতুনই বসেছে; হাল্কা কুয়াশার ভেতর দেখা যাচ্ছে, শর্টসার্কিট থেকে একটা তারের জয়েন্ট ঢিলা করে ওপরের তারগুলো থেকে অনেক নিচে নামিয়ে এইপাশের বিল্ডিংয়েরও নিচের রেলিংটা বাঁচিয়ে বেঁকিয়ে তারটা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই বরাবরই পাখিটা বসা। সে-কারণে তারটার জন্যে পাখিটার মুখের দিকটা ভালো করে লক্ষ করতে পারছে না। সখিচান পাখিটার গায়ের রঙগুলো দেখতে লাগলো; দুলারী সেইদিকে তাকিয়ে জানালার পাল্লাটায় হাত দিয়ে, আহ্ কী বাতাস, এই বলে পাল্লাটা ভেজিয়ে দিয়ে গায়ে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে ভাবতে লাগলো। গোবিন্দ দু’বোতল মদ আনলেও সে দেশি আনেনি, এনেছে ‘রেডসিল’। এক-এক বোতল রেডসিল দু-তিনটা দেশি বোতলের সমান শক্তিশালী। ফাল্গুনী মা’র কোল থেকে এতোক্ষণ পর সোজা হয়ে বসলো। চোখদুটো ওর ওপর দিকে একটু টানা। নাকের গোড়ার থেকে দুই চোয়ালের হাড় পর্যন্ত দুষ্টামির অসংখ্য ক্ষুদ্র রেখা। নাকের একপাশের বাঁশি কাঁপছে। সলজ্জ এমন হাসিতে বোঝা যায় সুগঠিত দাঁত। শ্যামলা মুখের রঙ কিন্তু উজ্জ্বল মসৃণ ত্বক; শরীরের গঠনও প্রগতির। মা’র চোখে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছিলো ওকে নাচতে বলে কিনা; শূন্যে ওড়ার মতোই নাচে ফাল্গুনী- ক্যাসেটের গানে বা কারও গানের সঙ্গে না-নিজেই গান গেয়ে নাচে। মা বললেই ওড়না জড়িয়ে এক্ষুণি শুরু করে দেবে এটাই ভাবছিলো এতোক্ষণে। দুলারী চোখ দিয়ে এদিকে কোনো ইঙ্গিতই করলো না। সখিচান দুলারীর কাছে আরও একগ্লাস মদ চাইলো। আর এই সময়ই ফাল্গুনীর মুখের দিকে তাকিয়ে এই নম্র-দুষ্টামির ভাব লক্ষ করে প্রাণবন্ত কিশোরীর এই আনন্দ-উচ্ছল গোপন লীলায় সখিচানের নির্লিপ্ত নিষ্প্রভ মুখে জেগে উঠলো যেন প্রাণ। জানালার পাল্লার থেকে ছুটে আসা শীতের হাওয়া আর কুয়াশার ভেতর দূর ছায়াপথের ধবধবে মুক্তোর হারের তারাগুলো, সখিচান দেখলো, ফাল্গুনীর চোখেমুখে। মৃত্যু আর জীবনের ভেদাভেদ করতে না পারলেও সুন্দর সে চিনতে শিখেছে-যা মুগ্ধ যা বিস্মিত করে। দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণ করে মগজের ভেতর ধাপে-ধাপে নানা চূড়ায় নিয়ে যায়। এরকম মগজে ডুব দেওয়াই তো স্বপ্নপুরী। মাংসের বড়ো একটা টুকরো মুখে দিয়ে ভাবলো সখিচান। তখন মনোহর ছিলো ভিন্ন বাস্তবতায়। পরিমিত মদ্যপান করে। বেকার-স্নাতক। ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে তার কিছু বদনাম আছে। সচ্ছল পরিবারের ছেলে মনোহর। মাসকয়েক আগে মনোহরদের টয়লেটের সেফটি ট্যাঙ্ক ফেটে গিয়ে সেখান থেকে দুর্গন্ধযুক্ত মল বেরিয়ে পড়েছিলো। মেথরপট্টিতে গিয়ে হারাধনের সঙ্গে মনোহরের যোগাযোগ হলে ভালো টাকার চুক্তিতে বাড়িতে এনে মনোহর কাজ করিয়ে নেয়। হারাধন সামান্য রাজমিস্ত্রির কাজও জানে। মল পরিষ্কার করে সিমেন্ট ও বালি দিয়ে আটকে দিয়েছিলো ট্যাঙ্কের মুখ ভালো করে জমিয়ে। ওইদিনই মনোহর ওকে সঙ্গে নিয়ে নাস্তা করলো অভিজাত হোটেলে। এর তিন-চারদিন পর রাস্তায় আবার হারাধনের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো মনোহরের, ‘বাবু, আপনাদের মতো চার-পাঁচজন থাকলে আমরা বেঁচে থাকার প্রেরণা পেতাম।’ কী বললে? (আসলে ‘প্রেরণা’ এই শব্দটা হারাধন উচ্চারণ করেছে এটাই অবাক করেছিলো মনোহরের)। হারাধন আবার বললো, ‘আমাকে নিয়ে যে হোটেলে খেলেন, বুকটা তখন ধড়ফড় করছিলো। সবাই যে তাকিয়েছিলো আপনি তো দেখেননি। ওরা বললে আপনারও যে কথা ছিলো তা-ও জানি।’ (কী জানে হারাধন, কেউ আপত্তি তুললে কী বলতো মনোহর: কেন আপনারা ছোটো করে দেখছেন, ওদের জন্যেই তো আমাদের এই পরিচ্ছন্নতা, ওদের ওপর দাঁড়িয়েই আমাদের এই সভ্যতা-এইসব কথা কি বলতো মনোহর যা হারাধন জানে)। হারাধন আরও বলেছিলো, ‘আপনি ভালো মানুষ; মর্যাদা দিতে জানেন।’ সেদিন থেকেই হারাধন বন্ধু। সহজ করে শ্রেণিবৈষম্য ভোলাতে অনেক সময় নিয়েছিলো; শোনালো কতো কথা, হেরোইনের বিষয়টা একদম জানিয়েছিলো শেষে। চাকরিটা পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত। প্রকট কষ্ট-দুঃখ আছে ওদের জীবনে। দেড়-দুশো বছর ধরে এখানে বাস করলেও সারা দেশে ওদের নিজস্ব আবাসস্থল কোনো সরকারের আমলেই উন্নীত না। দিনদিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। আগে তো বাবা-কাকারা মারা গেলে কাঠ আর একটু ঘি চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে চাইলে পাওয়া যেতো। এখন সেটুকুও পাওয়া যায় না। ‘যা আমি আসছি’-এই বলে চেয়ারম্যান সাহেবরা সরে পড়ে, অথচ ভোটের সময় একেবারে ভাইয়ের মতো বুকে জড়িয়ে ধরে। গোলপাতা পচে গেলে হাজারবার বললেও কোনো ব্যবস্থা পৌরসভা থেকে এখন আর নেয় না। কুড়িয়ে-কাড়িয়ে ছয়শো টাকা বেতন। এই ওদের নিত্য যাপন। ক’দিন আগে পুলিশের কয়েকজন লোক হারাধনকে নিয়ে গিয়েছিলো এক অপরাধীর জন্যে। লোকটা চোরাচালানী। ধরার সময় ছোটো-ছোটো সোনার বার গিলে ফেলেছিলো। মারা হলো। তারপর একটা আলগা পাত্র এনে হারাধনের হাতে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো পুলিশের লোক। মলত্যাগ করলো চোরাচালানী। এরপর হারাধন পুলিশ বাবুদের জানিয়ে দিলো মলের ভেতর কিছু নেই। কয়েকটা সোনার সরু-বার হারাধন ঠিক চিনে পাত্র থেকে কৌশলে চুরি করেছিলো। সোনা দিয়ে কিছুক্ষণ পরেই সে হেরোইন কিনে খেয়েছে; মনোহরকে আরও কথা বলেছে হারাধন। মনোহরের এই বাস্তব ভাবনার ভেতর… ‘কই বাবুর গ্লাস খালি’-সখিচান হারাধনকে মনোহরের গ্লাসে মদ ঢেলে দিতে বললো। -মনোহর ভাবনা ছিন্ন করে সখিচানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘শেষ লাশটার মৃত্যু কিসে হয়েছিলো?’ সখিচান বললো, ‘চাকরির শেষ দিনেরটা?’ মুখে কৌতূহল নিয়ে মনোহর বললো, ‘হ্যাঁ।’ ‘গোবিন্দ জয়েন করলো যেদিন তার আগের দিন দুটো লাশ কেটেছি। বাপ মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখে কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা, রাতদিন স্বামী পেটায়। মেয়ে বললো, বাবা নিয়ে চলো-বাপ মেয়েকে নিয়ে এসে পথে খুব দুঃখ পেয়ে এক কাজী অফিসে গিয়ে নিজের মেয়েকে বিয়ে করে বললো, ‘চল সংসার করি।’ বাড়ি গিয়ে ঢুকতেই উঠোনে দাঁড়ানো ছিলো বড়ো ছেলে, মেয়ের বড়ো ভাই। বোনের মুখে শুনেই হাতের কুড়াল দিয়ে বাপের মাজায়, কোমরের নিচে তিন কোপ দিয়ে মেরে ফেলে ভাইটা। ওই লাশটার পরেও আরেকটা লাশ এসেছিলো।’ মনোহর দুলারীর দিকে তাকালো তখন। দুলারী একচোখে মনোহরকে লক্ষ করে পরে ফাল্গুনীর দিকে তাকালো। গোবিন্দ মাথা নিচু করে কী যে বললো তা বোঝা গেলো না। ফাল্গুনী আরও একটু জড়োসড়ো হয়ে বুকের ওড়না ঠিক করে মা’র দিকে চেয়ে থাকলো। ‘দুই নম্বরটা হলো একটা বাচ্চা। আমাকে মামা বলে ডাকতো। এই হাসপাতালের একজনেরই মেয়ে-ওই তো পুলিন আর সবিতার মেয়ে নিরু। ওর লাশটাই শেষ ছিলো।’
শুনতে-শুনতে মনোহর একটু অন্যমনস্ক। গোবিন্দ টলতে-টলতে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি পাখিটাকে নিয়ে আসি, যাই।’ গোবিন্দ দরোজা খুলে বেরিয়ে যেতেই সখিচান উৎসাহে বললো, ‘না নিয়ে ফিরে আসিস না।’ ফাল্গুনী বললো, ‘আমি কিন্তু ওটাকে পুষবো।’
দুলারী সেইমুহূর্তে বোতল থেকে মদ ঢেলে দ্রুত গ্লাস শেষ করলো। মদ্যপানে পটু। গ্লাস শেষ করে দুলারী চড়া গলায় কোমল সুরের গান ধরলো, গুপ্তদুঃখে ভরা দীর্ঘনিশ্বাস আর কণ্ঠনিঃসৃত কোমল স্বরের ক্ষীণ কাঁপন কিছুক্ষণ বুঁদ করে রাখলো; নিজের ভেতর ঢুকে গেলো দুলারী। গানের সাথে ছোটো-ছোটো তাল দিচ্ছিলো মনোহর আর হারাধন। সখিচানের মনে হলো, ফাল্গুনীর দুই চোখ আর পায়ের আঙুলগুলো সন্তর্পণে মা’র গুনগুন সুরের সঙ্গে মৃদু ওঠানামা করছে। ফাল্গুনী নিজের ভেতর আপন ছন্দের লয়ে রণিত। হারাধন আবারও মনোহরকে হিন্দি গানের ছবি আর নাম বলে গুনগুন করে কখনও সুর ভেজে তার জানাশোনা প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করছে। সখিচানের যেন এরকম মনে হলো: না, আর না, রাতটাকে বিষণ্নতায় যেতে দেবো না। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। মনে হলো-এখন জিতে যাবার সম্ভাবনা- অনেকটা এগিয়ে গেছে। অনুৎসাহে মনমরা হয়ে আজ কতোদিন একইভাবে সে অপমান আর যন্ত্রণা চেপে রেখেছে। ইদানীং সখিচান যখন মানুষের সঙ্গে হাসে নিজেই বোঝে কেমন-জানি দেখানো। সময়টা তার অসহনীয়। দিনকয়েক আগেও লাশকাটা ঘর থেকে সরে এসে সে বিমূঢ়! কাকভোরে সারা হাসপাতাল ঝাড়ু দিতে কোনো কুণ্ঠা ছিলো না; নিবেদনও ছিলো। কাজগুলো তখন সে অবসরে হারাধনকে দিয়ে করিয়ে নিতো। হারাধন পৌরসভার লোক। হাসপাতালের কাজ করতো সখিচানের কথায়। ঝাড়ুদার হিসেবে চাকরির মেয়াদ আগে শেষ করে দিয়ে সরকার ভালোই করেছে। যাইহোক, লাশকাটা ঘরই ছিলো উপযুক্ত ভবিতব্য। এখনই শুধু দুঃসহ না, অতীতও অসহনীয়; সখিচানের মনে হয়, ভবিষ্যতের সৌন্দর্য অতীতের কদর্যতাকে গিলে ফেলে। বাপ ভাচু ডোম বেঁচে থেকে বলতেন: ‘লাশকাটার সময় মনে করবি না বেঁচে আছিস, ভাববি তুই মরা।’ কথাটার অর্থ আজও বোঝেনি সখিচান, সংসারে যখন জিন্দাদের লাশ কাটতে হয়, ভাবতে হয় সে-ই একমাত্র জীবিত। তারই সমস্ত অধিকার। -নিজের প্রতি এই জ্ঞানবাক্য তার মস্তিষ্ক থেকেই শুধু আসেনি, এসেছে অভিজ্ঞতায়, সজ্ঞায়। ভবিতব্য হবে ফাল্গুনীর টানধরা হাসি, ওর দাঁতের মতো ধবধবে, পরিপাটি, শক্ত আর সুনিবিড়। সখিচান আড়বাঁশিটা আবার তুলে হঠাৎ মনোহরকে বললো, ‘কই কবি সাহেব (সাহেব না ছায়েব বললো বোঝা গেলো না), নিজের একটা ছোটো কবিতা বলেন। শুনি দেখি।’
মনোহর একটু সময় নিলো। তারপর বললো,
‘থাকি দুর্যোগে, উৎসবে নয়,
মমতায়, কোনো বস্তুতে নয়।’
শুনে সখিচান বললো, ‘বাহ, কিন্তু উৎসবে না কেন?’
মনোহর বললো, ‘তা জানি না।’
জানালার পাল্লাটা হালকা খোলা। গোবিন্দ লাইটপোস্টের গোড়ায় পৌঁছে গেছে। দুলারী গান বন্ধ করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। চোখ ঢুলুঢুলু। হারাধন জড়ানো গলায় মনোহরের সঙ্গে শেকড়-বাকড়ের প্রসঙ্গ নিয়ে শুরু করলো আলোচনা। মাঝখানে জানালার শিকে সখিচানের চোখ। মুখে ফূর্তির ভাব। লাইটপোস্টের গোড়ায় গোবিন্দকে শীতের কুয়াশার ভেতর প্রথমদিকে তুষার-মানব মনে হলো, কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাওয়া লাইটপোস্টের ঝাপসা আলো আর তার নিচে গোবিন্দ যখন একটু বাঁয়ে সরে এসে দাঁড়ালো তখন সে ছায়া হলো শাদাকালো ছবির নেগেটিভের মতো। দুই হাতের তালু ঘষে পকেটের ভেতর হাতদুটো ঢুকিয়ে ভাবছিলো, কতোটা গতিতে, শক্তিতে, আর কোন কৌশলে দ্রুত উঠতে পারা সুবিধাজনক। পিলারের গোড়া থেকে উঠতে গিয়ে উঁচু হয়ে থাকা মাটির একটা ঢেলায় পিছলে গিয়ে পরক্ষণে ভারসাম্য ঠিক করে শরীরটাকে খাড়া করে তুললো, তারপর স্টিল-পিলারে ঠাণ্ডায় সজোরে হাতের আঙুলগুলো বারকয়েক ঘষে শক্ত-সমর্থ শরীরটাকে হালকা করে ঠিক নারিকেল গাছে ওঠার ভঙ্গিতে কোনোরকম ধীরে-ধীরে উপরে উঠতে লাগলো। পায়ে হালকা কেডস্ ছিলো বলে রক্ষা। খালি পা হলে শিশিরে পিছলে যাবার আশঙ্কা এখনকার চেয়ে অনেক বেশি থাকতো।
দেহের জমাট রক্তগুলো প্রথমে বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে পরে উষ্ণ হয়ে বইতে শুরু করলো। মাংসপেশিগুলো আড়ষ্ট আর নরম হয়ে যাচ্ছে। গোবিন্দ ভাবছিলো, একটু উপরে উঠতে পারলে দ্রুত তরতর করে এগিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু তা পারলো না এইজন্যে যে, শুধু দুই হাতের আঙুলগুলো দিয়ে এগোতে পারছিলো না-বাহু এবং শরীরের সঙ্গে চেপে-ঠেসে প্রায় হেঁচড়ে উঠতে হচ্ছিলো তাকে। বেশ আস্তে-আস্তে গোবিন্দকে পিলার বেয়ে উপরে উঠতে হচ্ছিলো সন্তর্পণে যে, সে চাচ্ছিলো না পাখিটা উড়ে যাক। পাখিটাকে হাতে ধরে নিয়ে যেতে চায়, শুধু উড়িয়ে দেবার জন্যে সে আর এখন আগ্রহী না-বরং বন্দি করাটাই এখন বীরত্ব-এমন একটা ধারণা তার তৈরি হলো। ভীতু প্রকৃতির লোক গোবিন্দ সবচেয়ে বড়ো যুদ্ধে এখন নেমেছে। গণ্ডারের মতো শরীরটাকে শুধু শক্ত করে এঁটে রাখলো ভেজা পিলারের গায়ে, বারবার পিছলে নিচে নেমে যাবার মুহূর্তগুলোয়। মধ্যপিলার পর্যন্ত গোবিন্দ উঠে পড়েছে নিশি-পাখিটার জন্যে। পাখিটা সামান্য নড়লে এখন তার মুখ, ঠোঁটের রঙ আর আকৃতিটা বোঝা গেলো। পলক ফেলছে পাখিটা। আগুনের শিখার মতো। নড়ার কাঁপন আছে কিন্তু ওড়ার দহন নেই। স্টিল-পিলারের মাথায় চিনামাটির স্যাকেল ইনসুলেটরে বাঁধিয়ে তারগুলো চলে গেছে। পাঁচটা তার। কালো চওড়া মোটা। তিনটে গ্রাহকদের, একটা পৌরসভার, একটা নিউট্রাল। এই পাঁচটার ভেতর একটা অন্যান্য তারের সমান্তরালে হয়নি, বিল্ডিং-এর একটা রেলিং বাঁচানোর জন্যে প্রায় একহাত নিচে বেঁকে ইনসুলেটরের পাশ দিয়ে গিয়ে তারপর উঠে সমান্তরাল হয়েছে। তারগুলো পিলারের ওপাশে। এইপাশে পাদানির মতো মোটামুটি একহাত লম্বা একটা স্টিলের ব্রাকেট। হুকে আঁটা। ওর ওপর বসা নিশি-পাখিটা। লম্বা-চৌকো বাইরের পালকের রঙ সরু-শাদা আর কিছুটা ছাইরঙা। মাথা উঁচু করলে ঘোলাটে কুয়াশায় চকচক করে উঠলো বুকের ওপর শাদা-কালো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাইন, পাদুটোর রঙ সামান্য বেগুনি। দু’ডানার উপরাংশে হালকা লালের ঔজ্জ্বল্য। চোখ কালো। দুটো ঠোঁট অতোটা বাঁকানো না। ঘোলাটে আলো-আঁধারির পরিবেশে লক্ষযোগ্য লাল আর ছাই রঙের অদ্ভুত পাখিটাকে তখন শতকষ্টের ভেতর গোবিন্দ’র মনে হলো অপার্থিব। আর জানালা থেকে সে-সময় পাখিটার চোখে হঠাৎ সখিচান এমন কিছু সত্য দেখলো যা গোবিন্দ দেখলো না, হয়তো-বা গোবিন্দ’র চোখে তখন ধ্রুব-গন্তব্য আর সখিচানের উপলব্ধিতে কোনো সত্যের ক্রূর সৌন্দর্য।
ঘরের ভেতর হারাধন আর মনোহর গোগ্রাসে শুরু করলো মাংস খেতে। ফাল্গুনী জানালার শিকের ভেতর দিয়ে মাঝে-মাঝে গোবিন্দ আর পাখিটাকে দেখার চেষ্টা করছে। দুলারীর মনে হচ্ছিলো, সখিচানের সুরে রামপিয়ারী আসে-মানুষ যখন মৃত্যুর সন্নিকটবর্তী, আকাঙ্ক্ষা আর সমগ্র ইন্দ্রিয় তখন মৃত্যুকেই চায়। তাই রামপিয়ারী মৃত্যু-লোভী-মরণ-যাকে ধরে রক্ত পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ওই পাখিটার গায়ের মতো। সখিচান কোল থেকে বাঁশিটা তুললো। সে সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা করে এইভাবে কখনও বাজায়নি। লেবুর পাতায় দুঠোঁট দিয়ে হালকা ফুঁ-তে যখন গানের সুর উঠতো সে-সময় থেকেই সে সুর তোলে, প্রথমে নলের বাঁশিতে কিছুদিন, তারপর এলো বাঁশের বাঁশিতে; বাঁশি তার কথা শোনে।
যে কথা সে বলে সুরের ভেতর দিয়ে তা-ই।
তো-এখন গোবিন্দ যেপাশ থেকে উঠেছে তার পেছনের দিক থেকে স্যাকেল-ইন্সুলেটরে যুক্ত হয়ে তারগুলো সরে গেছে। ব্রাকেটটা পিলারের বামপাশের গায়ের সঙ্গে পূর্ব-পশ্চিম কোণে লোহার হুক দিয়ে আটকানো। পাখিটা ওখানে। গোবিন্দ, যেভাবে নৌকার দাঁড় টানা হয় সেভাবে সে দুইহাত দিয়ে পিলার জড়িয়ে ধরে উঠতে লাগলো উপরে। তার গতি দ্রুততর আর ক্ষিপ্র হতে লাগলো। ঠিক এ-সময়ের ভেতর একটা সমস্যায় পড়লো। পাখিটা পূর্ব-পশ্চিমে অবস্থিত ব্রাকেটের উপর যখন বসেছিলো তার মুখটা ছিলো তারগুলোর দিকে; গোবিন্দ’র দিকে পেছনটা। গোবিন্দ’র ইচ্ছে ছিলো পেছন থেকে পাখিটাকে ধরবে সে, নীরবে হঠাৎ ওটা ঘুরে গেলে গোবিন্দ কিছুটা বিরক্ত হলো। এরকম হতে পারে ভাবেনি। এখন তাকে যেটা করতে হবে হয় তাকে হই-হই শব্দ করে পাখিটাকে উড়িয়ে দিতে হবে না হলে তাকে পিলারের পেছন থেকে ঘুরে ওটার পেছনদিক থেকে গিয়েই খপ করে ধরতে হবে। গোবিন্দ তখন আরও সতর্ক হয়ে কিছুক্ষণের জন্যে নিশ্বাস চেপে রাখার চেষ্টা করলো। ওটা তখন আনমনা হয়ে আবার ঘাড় গুঁজে ঝিম ধরলে গোবিন্দ খুব ধীরলয়ে ঘুরে গিয়ে পেছনদিক থেকে উঠতে লাগলো। সমস্যা শুধু ওখানেই হয়নি, আরও কিছু প্রভাব সনাক্ত করলো গোবিন্দ। পাখিটা পূর্ব-পশ্চিমে অবস্থিত ব্রাকেটে একেবারে উল্টো হয়ে ঘুরে বসে নেই, সেইসঙ্গে স্টিলের ব্রাকেটটার শেষ মাথায় আবার নিচু হয়ে যাওয়া তারটা ব্রাকেটের গা ছুঁয়ে গোবিন্দ’র একহাত উপর দিয়ে উঠে গেছে; অর্থাৎ তার, ব্রাকেট, পাখি এবং পিলার-এই বস্তু-চতুষ্টয়ের জ্যামিতিক বিন্যাসের একটা নিয়ম কোথায় যেন কঠিন হয়ে গেলো। পাখি ধরতে গিয়ে দ্রুত ঝুঁকি নেবে নাকি প্রচুর সময় নিয়ে অঙ্কটা কষবে-ভাবনাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো গোবিন্দ। শরীর থেকে পানি শুকিয়ে যাবার মতো নিজের প্রতি একটা মমতা বারবার উগ্র হয়ে উঠতে লাগলো ধারালো ছুরির মতো, একটা নিশ্বাস নিচ থেকে চিরে উঠে এলো তার নিজের ভেতর। এমনকি নেমে যেতেও ইচ্ছে হলো একবার-সামান্য সময়ের জন্যে। কোনোকিছু না করে খুব বেশিক্ষণ এভাবে থাকা যাবে না-দুটো কাজ তাকে একই সময়ে করতে হবে: বাম হাতে শরীর এবং দুই-পা দিয়ে তাকে সে-সময় হাতখানেক কিম্বা তার কিছু কম উপরে শুধু উঠলেই হবে না, নিঃশব্দে এবং ক্ষিপ্রতায় একইসময় ডান হাতে ব্রাকেটের শেষ মাথায় থাকা পাখিটাকে ধরতেও হবে।
তখন সখিচান ঠোঁটে ফুঁ-র প্রস্তুতি নিলো। দুই ঠোঁট স্পর্শিত হলো মুহূর্তে এক নিবিড় সুরবিন্যাসে। ক্রমে-ক্রমে মাঘ-শীতের নিষ্ঠুর-শীতার্ত-নিরপেক্ষতায় আর হিম-রজনীর চাকের ভেতর পাক খেতে খেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেসে গেলো অতিদূর এক ঘননীলে। আর সেই সুরে বাতাস ক্রমশ বাহিত হয়ে এগিয়ে গেলো ভূলোক-দ্যুলোক পরিবেষ্টিত এক মহাশূন্যতায়। সখিচানের সুর বিস্তারিত কথা বললো, কতো ইঙ্গিত; যেন-বা এক ভয়াবহ শূন্যতা প্রতিমুহূর্তে নিশি-ঝিঁঝির ডাককে স্তব্ধ করে দিয়ে সুরলোকের প্রতিবিম্বে ভেসে-ভেসে বেড়াতে লাগলো। সখিচান নিজেও হারিয়ে গেলো তার সুরের শুদ্ধতায় আর সুগভীর ঐক্যতানে।
ঠোঁটে বাঁশি নিয়ে সখিচান ভাবলো: আসল-আবহটা… আকাঙ্ক্ষাটা আসন্ন হলেও গৌরচন্দ্রিকা আরও আছে। নামযজ্ঞের আগে অনেক অধিবাস প্রস্ফুটিত তথাপিও শ্রীকৃষ্ণের অন্তরাত্মা তার আত্মায় বারবার ধাক্কা দিতে লাগলো। রাজা সে, না-জল্লাদ না-ঝাড়ুদার। প্রেমিক। তার পৌরুষ একজন বংশানুক্রমী পেশাজীবী মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। তার বাঁশি বলে, ‘চাল এইসি জ্যাগায়ে এ দিল, যাহা জুলুম, সিতাম না হো। ও-ও।’ সখিচান অদ্ভুত এক সুর তুললো। দূর থেকে আসা বায়ুপ্রবাহে তা দ্রবীভূত হয়ে ঘরের উদ্বেলিত সবাইকে জাগিয়ে তুললো। বাঁশিতে সুর তুললেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিলো লাইটপোস্টের দিকে। গোবিন্দ তখন স্বল্প সময়ের ভেতর একটা সিদ্ধান্ত নেবে বলে সেইমুহূর্তে দৃঢ় হলো। দুলারী পাখিটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, রামপিয়ারীর এতো রঙ! ফাল্গুনী পাখিটাকে নিয়ে কল্পনার ঘোরে ছিলো; তার অনুভবে কোনো শাদা-রক্তের অদৃশ্য অতিশয় গন্ধ। মনোহর কিছুটা ক্লান্ত। চেয়ার থেকে উঠে হালকা ব্যায়ামের ভঙ্গিতে দুই হাত এবং শরীর কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক করলো। হারাধন ভাবলো, সেদিন খেলায় ড্র হয়েছিলো, সে বলেছিলো, তার তিনটে গুটি বাঁচবে। অভিশপ্ত সে! সখিচান দেখলো গোবিন্দ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে: একহাতে-দুপায়ে এবং শরীরটা দিয়ে পিলারটা ধরে ত্বরিত উপরে এগিয়ে ক্ষিপ্রতায় অন্য হাতে পাখিটাকে ধরতে যাচ্ছে, সখিচান বাঁশিটা কোলের ওপর রেখে জানালাটা বন্ধ করে দিলো। আবার বাঁশিটা ঠোঁটে তুললো-কোনো স্পৃষ্টি-আর্তনাদের আগেই এক সুর উঠে এলো তার বাঁশিতে: পাখির পায়ের মতো তীক্ষ্ণ অথচ কোমল এমন সুর।
লাল আর ছাইরঙা পাখিটার অস্তিত্ব পুড়িয়ে দিচ্ছিলো শীতের সমস্ত নিরপেক্ষতা; পরম্পরায়। কাল সকালে তাকে মর্গে যেতে হবে-সখিচান ভাবলো। মৃত্যুর নিশ্চিত পাঠে।
তারেক শাহরিয়ারকে।
প্রশ্নোত্তর
শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?
সেলিম মোরশেদ: প্রান্তিক মানুষের জীবন তো আছেই। তাছাড়া সব শ্রেণির ভেতর- আসলে যেটা আমি বলতে চাই, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত এই খাপছাড়া শ্রেণিগুলোর ভেতর- শ্রেণি উত্তরণে যারা মার খাচ্ছে কিংবা দীর্ঘদিন যে শ্রেণিতে তাদের অবস্থান সেখান থেকে তারা নামছে- অর্থাৎ সুষ্ঠু পুঁজির বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়ে যারা শ্রেণিদ্বন্দ্বে জর্জরিত- তাদের জীবন দেখা আর চলার গতিটা লেখায় আমার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?
সেলিম মোরশেদ: পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে সূত্রটা পাওয়া যায়; আর অভিজ্ঞতা বলতে আমি যা মনে করি, সেটা অর্জন করা বেশ কঠিন। শুধু দু’একদিন ঘুরে এসে, প্লট খুঁজে, মনন দিয়ে কল্পনায় রঙ চড়িয়ে টেবিলে বসে লেখায় আমি বিশ্বাসী না। এক কথায়, যে বিষয় বা বিষয়বস্তু নিয়ে আমি লিখি, সেখানে গিয়ে আমি বসবাস করি। আমার সাধ্যমতো, বিষয় ও ঘটনাকে জেনে-ভেবে-বুঝে, কথাবস্তুর উপজীব্য করি।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।
সেলিম মোরশেদ: অবশ্যই। রাজনীতি না বুঝলে সমাজ বোঝা সম্ভব না। সমাজ না বুঝলে লেখক কী লিখবে? একজন প্রকৃত লেখক হবে প্রতিভাবান ডাক্তারের মতো; পারফেক্ট ডায়াগোনোসিস করবে অথচ ওষুধ কম দেবে। ’৪৭ এর দেশভাগে ব্যক্তি ও পরিবারের যে দুর্ভোগ পশ্চিম বাংলার লেখকদের হাতে আমরা সেটা নানানভাবে পেয়েছি। কিন্তু এ বাংলায় ও বাংলা থেকে আসা লেখকদের লেখায় তেমনভাবে সেটা আসেনি। হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’তে কিছুটা পাওয়া গেল। কলকাতার নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে সমরেশ মজুমদারের মতো জনপ্রিয় লেখকরা যেমন লিখেছেন, তেমন গৌরকিশোর ঘোষ থেকে অমিয়ভূষণ মজুমদার পর্যন্ত এ আন্দোলনকে আস্বীকার করতে পারেননি। ফলে পশ্চিমবাংলার সর্বস্তরের লেখকরা- বিষয়বস্তু, আঙ্গিক ও ভাষায়- যতদূর এগিয়েছে- এর কারণ তাদের রাজনীতিমনস্কতা। ওখানে অল্টারনেটিভ পলিটিক্স, বাংলাদেশের মতো কোনো কোনো বিশেষ শহরের পাড়া ও মহল্লার মধ্যে, সীমাবদ্ধ না। একটা ফ্রন্ট হয়ে রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে নেতৃবৃন্দ তাদের রাজনৈতিক দল নিয়েই যুক্ত হয়েছে।
এখানে ’৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট হিসেবে সফল- নিঃসন্দেহে। এশিয়ার গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ সফলতা হলেও- এই তৃপ্তিতে ‘কম বৈষম্যের সমাজ’ এর যে রাজনীতি, তা শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি সবসময় বলি অল্টারনেটিভ পলিটিক্স ছাড়া অল্টারনেটিভ লিটারেচার হয় না। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে কোনো ধরনের বিকল্প-চিন্তা সহ্য করছে না। কথিত উগ্র-প্রগতির আধিপত্য বিস্তার আর আত্মস্থ হওয়া ধর্মের আচারগুলোর বিরুদ্ধে নতুন ফতোয়া- এই দুই দলই উদ্ভ্রান্ত। একটা চেতনা সমৃদ্ধ আন্দোলন প্রাগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গি- অসংখ্য মানুষের মনন তৈরি করে। যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপর প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। এটা উচিতও। কিন্তু সেই লেখাগুলো বর্তমান বা ভবিষ্যতের গঠনমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগত বই না; রাষ্ট্র জন্ম নেয়ার কৃতিত্ব শুধু।
সার্বভৌমত্ব রক্ষা, অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন, নতুনধারার রাজনীতি- সবকিছুই মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোন রাজনীতি আপনি লেখায় আনবেন? ফলে লেখকরা পরিচিত এবং ঐতিহাসিক চরিত্রের ওপর ভর করে কথাসাহিত্যে চরিত্রের নামে খড়ের পুতুল বানাচ্ছে অথবা নারী-পুরুষের জৈব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লীলা-লাস্যে পাতা ভরছে।
শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
সেলিম মোরশেদ: দেশ-বিদেশের অনেক গল্পই আমাকে একসময় কাঁদিয়েছে আবার বেশ কিছু গল্প চিন্তাবোধকে ধাক্কা দিয়েছে। এখন তো কান্নার ভঙ্গিমা অন্যরকম- ভেতরে গুমোট হয়ে থাকে।
যাই হোক, বরং অন্যভাবে বলি, এই একুশ শতকের দুই দশকে বেশ কিছু ভালো গল্প লেখা হয়েছে। তার ভেতরে একজন তরুণের গল্প আমাকে ভয়ানকভাবে নাড়া দিয়েছে। গল্পটির নাম ‘মেলো ইয়েলো, শিউলিগাছ আর বারান্দা হচ্ছে’। ইশরাত তানিয়া গল্পটি লিখেছেন। বিষয়বস্তু- পুঁজিবাদের প্রোডাক্ট কোকাকোলা কোম্পানিকে প্রতীকী করে একটি চরিত্রের নিঃসঙ্গতা, অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়া এবং স্বপ্ন দেখা। আমি গল্পটাকে এই সময়ের গল্প বলে চিহ্নিত করেছি।
শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
সেলিম মোরশেদ: আমার লেখায় সব সময় বিশেষ্য-বিশেষণের আকস্মিক স্থানবদল, শব্দের অচেনা ব্যবহার, ক্রিয়ার কালরূপের সচেতন বিপর্যয়, এমনকি সর্বনামের ব্যবহারের কম-বেশি করাসহ বাক্যের গতি অনুসারে যতিচিহ্নের বিভিন্ন প্রয়োগ নিয়েই নিজস্ব ফর্ম গড়ি। ব্যাকরণকে গুরুত্ব দিই না। সেই আটের দশক থেকে আমরা দু’একজন এখনও এভাবে লিখে যাচ্ছি। লেখক বন্ধুরা এবং আমার পাঠকরা জানেন।
শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?
সেলিম মোরশেদ: চরিত্রকে ঘটনার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো।
শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখককের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
সেলিম মোরশেদ: আগের একটি প্রশ্নের উত্তরে আমি এ প্রসঙ্গে কিছুটা বলেছি। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখককের প্রবল ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি। এখানে একটা কথা উল্লেখ্য, রাষ্ট্র কিন্তু একটা ভূখণ্ড, দার্শনিক সীমানা। রাষ্ট্র চালায় তো সরকার। লেখককে ফোকাসটা এখানেই দিতে হয়।
শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!
সেলিম মোরশেদ: ছয় বছর ধরে গাজী, কালু ও চম্পাবতী নিয়ে ‘দর্পিত নেকড়ে ও কুমিরগুলো’ এই নামে একটা উপন্যাস লিখছি। তবে উপন্যাসটি শুধু ভালোবাসার কাহিনি নয়; শাস্ত্রীয় দেবতাদের সমান্তরালে বনজীবী ও ব্রাত্যজনদের প্রতিনিধি হিসেবে বরখান গাজীর তৎপরতা ও উত্থান। যদিও গাজী, কালু, চম্পাবতী, বদর আর মানিক- এই পাঁচ মোকাম কনসেপচুয়ালি পরস্পরের বিকল্প অহম।
More Posts From this Author:
- None Found