কবিতা মূলত সর্বনাশপন্থিদের আখড়া
কবিতা এক কালোবর্ণ কুহক। বিষয় ও আঙ্গিক জেনে, ভাষার ওপর দখল নিয়েও এ কুহক চূর্ণ করা যায় বলে মনে হয় না। সারা জীবন কবিতা লিখেও এ কুহকের শেষ দেখা যায় না। অধরা মাধুরী যেন। যিনি কবি, তার উপর সেই কবিতা দেবীর জন্ম-জন্মান্তরের দণ্ডাজ্ঞা।এ দণ্ড থেকে, দায় থেকে তার মুক্তি নেই। রক্তাক্ত ও দণ্ডিত হওয়াই তার নিয়তি। আমি কবিতা লিখি; না লিখে পারি না বলে। নিজেকে নিজের কাছে, কাগজের সাদার কাছে প্রকাশের এমন সহজতম, দুরূহতম পদ্ধতি আর নেই। প্রেম-প্রত্যাখ্যান-দেশ-কাল-পুষ্প-বৃক্ষ-বিহঙ্গ সবই আমার কবিতার প্রেক্ষায় থাকে। বলা যায়, এদের প্ররোচনাই জন্ম দেয় এক একটি শব্দের, লাইনের এবং গোটা একটি কবিতার।যেন এক লঘু-ডানা অরণ্যের পরি।
গরল ভরা গান গাইতে পারে একমাত্র কবি। বিষ-সুরের স্বত্ব তারই, রক্তাক্ত হবার জন্য যে প্রতীক্ষা করতে জানে। মৃত্যুরে লভে অমৃতকরি। কবি। দু’ অক্ষরের শব্দ, এক শব্দ থেকে আরেক শব্দের মাঝামাঝি ভূমধ্যসাগর, আগ্নেয়গিরি, কুসুম কিংবা কর্দমের ডাঁই। বোবার স্বরে কবি বলে যে অন্ধরাই সঠিক পথ চেনে, শ্রবণ বধির করে সে টের পায় শত শত শূকরের চিৎকার, শত শত শূকরীর প্রসব বেদনা, সহস্র সমাধির শ্বাস, উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, ছন্দ, ছন্দহীনতা- এভাবে পৃথিবীর এই আদিমতম রসায়নে পড়ে পান্না হয় সবুজ। পুরুরবা হয় যযাতি, যযাতি হয় পুররবা। রাত্রি ভোর হয়ে যায় বন্দির বন্দনায়। যীশুর মত গামলায় যুগপৎ জন্ম আর মৃত্যু ঘটেস্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যতের। এদের কাউকে কেঁদেও পাওয়া যায় না বর্ষার অজস্র জলধারে। কবিতা। হেরেমে বন্দি রাজকন্যা, কিন্তু কেমন গেরস্ত-মেয়ের মত কয় ‘কবুল, কবুল’! কবিতা। হলুদ নদীতে চন্দ্রের আলিঙ্গন। বাতাসে কীসের গন্ধ আর ফুলের হাহাকার। সোনালি তারাদের সানন্দ শহীদান। স্বর্গ সহজলভ্য, কিন্তু জীবৎকালে নরকে ঋতু যাপনের অভিজ্ঞতা কেবল কবিরই। উদ্যাপন করে সে এলিজির অনুপম আনন্দ। ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে সে মরে যেতে পারে। কখনোবা সামান্য মাছকে ঈর্ষা করে শুধায় ‘মাছ তুমি চলেছ কোথায়?’ অথচ কবির সমস্ত গন্তব্যে তালা ঝুলছে, তবু হে মাধবী, তবু হে দ্বিধা, ব্যর্থতা জিন্দাবাদ। পেয়ে গেলেই তো ফুরিয়ে গেল। জলকে ভয় তার, তাই সতত তৃষ্ণা অন্বেষী। কবিতা। ভাঙা দেউল, বাসি বেলপাতা, অসুরের আরাধনা। সারা শীতকালজুড়ে একটিও ঝরাপাতা নেই, শুধু হেমন্তক্বাসিদায় ভরা মাঠ। রাহুর শ্রী জাজ্বল্য, বাকি কিছু ধূসর-বাসর। সমস্ত সিডার বৃক্ষ পতিত হইয়াছে। আমরা আবার তাহা নতুন করিয়া রোপণ করিব। বাইবেল এমত বলিলেও আমাদের রক্তে নিরন্তর পতনের প্ররোচনা। কবিতা। উড়ন্ত বিহঙ্গের পতিত কাকলি, মালঞ্চের শত্রু; কিছু দিকভ্রষ্ট ফুল, তোমরা যে যার সিঁড়ি পেয়ে গেছে, উপরে ওঠার, বাঁয়ে কিংবা ডানে যাবার, একলা কবি বিভ্রান্তির রাজসভায়। এইমাত্র তার অভিজ্ঞান হলো যে কবিতা মূলত সর্বনাশপন্থিদের আখড়া।
আমার সময় কিংবা মহাকালের মর্গ
আজ সব ভোরের বীণা নিচ্ছে
নরকের তালিম
যখন কোনো কালো তীর্থের দিকে
আমাদের অশুভ অভিযাত্রা
তখন এই-ই তো
গানের দেশের একমাত্র রীতিপদ্ধতি।
তুমি তার ভেতরে খোঁজ করো
কোন অলীক সুর!
অসুরের নিশ্বাসে ছেয়ে আছি
সানন্দ সবাই।
আমাদের জন্য বরাদ্দ
যত মরণের মিউজিক
তাকে চেটেপুটে নিয়ে
এইবেলা বুঝে নিই
নিরক্ষর কে কতটা পাব
সাপের শীর্ষবাক্য
অথবা বিষবিন্দুর ভাষা।
দুপুর আর বিকেলের
বাস্তবিক বিবাহবাসরে
শিল্পরানিভূত ঢুকে গেছে
তার বিমূর্ত হুল্লোড়ে
কুলগ্ন সবই;
আজ তাই
রোদনই
একমাত্র অভিসার।
আমরা যারা হারিয়ে যাই
রাতের রাজনীতিতে
অথচ
ঘাসগালিচা সংবর্ধনার
সবুজ মোহর পেতে চাই
তারা নিজেদের লিখতে পারি না
নিজেদেরই অগোপন অক্ষরে।
এভাবেই
মূক-বধির এগিয়ে যাওয়া
কালকুটিল হাওয়ার সাগরে
স্নান করে
কতদূর কতদূর
পেছাল প্রহর!
পাঠে পাঠে
ঘুমের দেশে
আরও কিছুকাল জাগিয়ে রাখি
অন্ধের অভিজ্ঞান
তাই
সোমেন চন্দের গায়ে
ভোজালির কোপ পড়ে ;
সেই গল্প অমর করি
কিন্তু এরপর কত মায়ের সৈকতে
সন্তানের রক্তঢেউ আছড়ে পড়ে;
সেই কথা মুখে আনতে মানা।
রক্তের চিত্রলেখায়
ইতিহাসও আহত দাঁড়ায়
কিন্তু আমাদের এগিয়ে যাওয়া
বোবা কালা !
আলো তো আলো
শুষে নিই
নক্ষত্রের ঘামও
তবু
আদিম অন্ধকার তারানার দিকে
না চাইতে বাড়িয়ে রাখি
বাগানের বিনম্র গোলাপ।
ধূসর নিহিতার্থের সন্ধানে
দিবা ও প্রকাশ্য নিশিলোক
খান খান হয়ে যেতে দেখি,
দেখার যত চোখ আছে
তারও আড়ালে
দৃষ্টির তাবত রঞ্জন দিয়ে উড়াই
মূঢ়তার রঙিন নিশান।
রাঙা আর কৃষ্ণকন্যাতেও ভেদ কী
‘রাজ’ শব্দে যদি তার
অভিষেক ঘটে থাকে।
অশোকতলার দিকে
যতই পা বাড়াতে থাকি
আঁকড়ে ধরে
গোছা গোছা শোকের সিম্ফনি।
রৌদ্র কিংবা মেঘের দীপনে
যা কিছু তুমি দিয়েছ আমাকে
প্রবৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাসে
সব জায়মান
ধ্বংসের শ্বাশত সারগামে।
এভাবেই এগিয়ে যাওয়া
তবু কেন ভেতরকুঠিতে
ঘাই মারে
আমার অবশিষ্ট আমি?
হেই সামালো
হেই
জল না আগুন দাও
আমার
শিখরে
ও
শেকড়ে।
আগুনের আলপনায়
সেরে উঠকু
ঘুণ আর ঘুম-ধরা জীবনের
যাবতীয় কাঠ।
কে না জানে
মৃত্যুর পরিণত লাবণ্য
অগ্নিফুলেই ফোটে ভাল।
Pias Majid was born in 1984 in Bangladesh. He completed his graduate and post graduate degrees in History from Jahangirnagar University, Bangladesh, and currently is Assistant Editor at the Bangla Academy, Dhaka. He has written and published 20 books, including poetry, short stories, and articles both on Bengali and world literature. He is editor of 30 books, including a volume on William Shakespeare’s 400th Death Anniversary. He has received several awards for his writing.