সন্ত্রাসবাদ (টেররিজম) আমাদের কাছে বা আমাদের অঞ্চলে মোটেও আনকোরা কোনো শব্দ নয়, বরঞ্চ সেই ব্রিটিশ খেদানোর জমানা থেকে নানা কায়দায় নানা অর্থে নানা বেশভূষায় আমাদের সামনে হাজির হতে দেখা যায়। ইতি ও নেতি – উভয় ‘বাচকতা’ নির্বিশেষে রাজনৈতিক পরিসরে বিপ্লব, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদ প্রায় হাতে-হাত ধরাধরি করে চলছে। তবে কখনো-সখনো নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডকে ‘সন্ত্রাস’ নাকি ‘বিপ্লব’ বলা হবে সেটাও মোটাদাগে নির্ভর করেছে বয়ানকারীর মেজাজ-মর্জি ও মতাদর্শিক অবস্থানের ওপর। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সহিংতাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে দাগা দিলে আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবাদ ইতিমধ্যে এক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ফেলেছে। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে এই ধরনের কর্মকাণ্ডের যেমন স্পষ্ট ধারাবাহিকতা রয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াসমূহেরও ধারাবাহিকতা রয়েছে। তবে, আশির দশকে আফগান যুদ্ধ, তালেবানদের উত্থান এবং নাইন/ইলেভেনের পর ‘সন্ত্রাসবাদ’ এর ধরন-ধারনে বিরাট পরিবর্তন আসে। বিশেষত, দুটো বিষয় এই আলাপে নতুন করে যুক্ত হয়েছে। এক, সন্ত্রাসবাদ বলতে পূর্বে যা বোঝানো হতো, তা প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রীয় সীমানার ভেতরেই কার্যকর ছিল, অর্থাৎ তার ধরন ছিল স্থানিক। ডমেস্টিক আইনের ভাষায় সবধরনের সন্ত্রাসবাদকে এক ধরনের বলে মনে হলেও, বর্তমানে যাকে সন্ত্রাসবাদ বলা হচ্ছে সেটা আসলে গ্লোবায়িত। গ্লোবায়ন যে রাষ্ট্রীয় সীমানা – অন্তত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে – ভেঙে দেওয়ার কথা বলে, এই সন্ত্রাসবাদও একইভাবে সীমানাকে তছনছ করে দিতে পছন্দ করে। তার রসদ ও কৌশল গ্লোবায়নের ছক অনুসরন করে বাস্তবায়িত হয়। দুই, বর্তমানে সন্ত্রাসবাদের মতাদর্শের সাথে ইসলাম ধর্মের এক বিশেষ রূপের সংযোগের কারণে এই সন্ত্রাসের সাথে ইসলামের নামটা শক্তভাবে সেটে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ইউরোপজুড়ে ইসলামবিদ্বেষী রাজনীতি কখনো সন্ত্রাসবাদের কারণ হিসেবে হাজির হয়েছে, কখনোবা এর পরিণতি হয়েছে। এসবের সাথে ইসলাম প্রশ্ন এতো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, বর্তমানে কেউ সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা করলে ধরেই নেওয়া হয় তিনি আসলে ইসলামি মিলিট্যান্সি বা জিহাদি রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন।
সদ্য প্রকাশিত সাইমুম পারভেজ ও মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমানের দি পলিটিক্স অফ টেরোরিজম এন্ড কাউন্টারটেরোরিজম ইন বাংলাদেশ নামের গ্রন্থে বর্তমানে চলতে থাকে ইসলামি মিলিট্যান্সি অর্থে সন্ত্রাসবাদকে কেন্দ্রে রাখলেও অপরাপর ‘সন্ত্রাসবাদ’কেও বাদ দেয়নি। বরঞ্চ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে কিছু জরুরি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনার আগে বাংলাদেশের আলাপের পরিসর নিয়ে দুয়েকটা নোক্তা দেওয়া দরকার। নব্বই দশক থেকে বাংলাদেশে ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ – জনপ্রিয় মাধ্যমগুলোতে যাকে জঙ্গিবাদ বা জিহাদিবাদ বলা হয়ে থাকে – নিয়ে জনপরিসরে অজস্র আলোচনা চাউর থাকলেও, সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষাপট থেকে তা বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রতি যেমন ঘাটতি রয়েছে, তেমনি ইউরোপজুড়ে চালু থাকা ইসলামবিদ্বেষের প্রকাণ্ড প্রভাবের রেশে সন্ত্রাসবাদের সমালোচনা কখনো কখনো ইসলাম ধর্মের সমালোচনা ও ধর্মবিদ্বেষে পর্যবসিত হয়েছে। কিছু রেটরিকের জন্মদান ব্যতীত তাতে আখেরে কোনো লাভ হয়নি। উপরন্তু, ইসলামের নামে চালু থাকা সন্ত্রাসবাদকে উপলক্ষ্য করে রাজনৈতিক ময়দানে যে বিকট গলাবাজি চলছে, তা থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক/একাডেমিক পরিসরও নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি। ফলে, রাজনৈতিক ময়দানে যা উৎকট ভঙ্গিমায় বলা হলো, একটু পরিশীলত ভাষায় সেটা পত্র-পত্রিকায় লেখা হতে থাকলো। এর প্রভাবও হয়েছে নানামুখী। সরকারি পক্ষ যখন সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে বিভিন্ন নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার দমন করা শুরু করলো, তখন বিরোধীপক্ষ ‘সন্ত্রাসবাদের দোসর’ ট্যাগ খাওয়ার ভয়ে উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানাতে ব্যর্থ হলেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক ইসলাম বা পলিটিক্যাল ইসলাম নামে যে বস্তু দুনিয়াতে রয়েছে, তার সাথে সন্ত্রাসবাদের কোনো ফারাক করা হলো না। রাজনৈতিক ইসলাম মিলিট্যান্ট ইসলামের পূর্বশর্ত নয় – এমনতর মতামত দুনিয়ার চিন্তার বাজারে চালু থাকলেও, আমাদের এখানে এই দুই বর্গের পৃথক বৈশিষ্টের প্রতি ন্যূনতম মনযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে ইসলামপন্থী রাজনীতি মাত্রই সন্ত্রাসবাদী-কিসিমের রাজনীতি – এমন বিপজ্জন সরল বয়ান আধিপত্যশীল হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ময়দানে শত্রুপক্ষ-কে দাগা দেওয়া ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য যেহেতু নেই, সেহেতু এই ধরনের বক্তব্য/বয়ান সমাজ-বিশ্লেষণের কোনো তলায় যেতে সক্ষম হয়নি। খুব হাতেগোণা কয়েকটি অধ্যয়ন ব্যতিরেক প্রায় অধিকাংশ লেখা অনৈতিহাসিক, স্টেরিওটাইপে ভরপুর এবং বিদ্বেষপ্রসূত। এসব বিবেচনায় নিলে আলোচিত গ্রন্থের গুরুত্ব বোঝা যাবে।
দি পলিটিক্স অফ টেরোরিজম গ্রন্থের মোট ৯টি অধ্যায়। মোটাদাগে দুইভাবে ভাগ করা যায় : বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের বর্তমান হালচাল এবং সন্ত্রাসদমনের রাজনীতি। টেরোরিজম বা সন্ত্রাসবাদ বলতে যা বোঝানো হচ্ছে তা সাধারণ সহিংসতা বা খুনোখুনির চাইতে ভিন্নতর প্রপঞ্চ। কোনো গোপন ব্যক্তি/গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় অঙ্গাদি যখন আতঙ্ক বা ত্রাস তৈরির জন্য পুনঃপুন সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, যেখানে সহিংসতার সরাসরি টার্গেটরা আদতে প্রধান টার্গেট থাকে না; মানে, সহিংসতাকে উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা না করে একে স্বতন্ত্র, অপরাধমূলক বা রাজনৈতিক কারণের উপায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সহিংসতার মাধ্যমে টার্গেট জনগোষ্ঠীর প্রতি নিজের বার্তা জানানো হয়; কখনোবা নিজেদের রাজনৈতিক ঘোষণা দেওয়া হয়। অথবা, এভাবেও বলা যায়, সন্ত্রাসবাদ হল রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কৌশল যেখানে হুমকি, বা শক্তিপ্রয়োগ বা সহিংসতার ব্যবহার যুক্ত থাকে; এবং প্রচারণার চেষ্টাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।ভূমিকা-তে সম্পাদকদ্বয় সন্ত্রাসবাদের ‘সংজ্ঞাজনিত’ সমস্যার কথা উল্লেখ করার পর স্বাধীনতার পর বিগত পাঁচ দশকে সন্ত্রাসবাদের হালচালের এক সাধারণ চিত্র তুলে ধরেছেন। মতাদর্শ, ক্ষোভ, নেটওয়ার্ক এবং সহায়তাকারী কাঠামো ও পরিবেশ – সন্ত্রাসবাদকে উষ্কে দেওয়ার সাথে জড়িত এই চারটি ফ্যাক্টরের ভিত্তিতে মোট ৯টি প্রবন্ধের মাধ্যমে এই গ্রন্থ বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের বিকাশ ও বিবর্তনকে হাজির করেছে।
সন্ত্রাসবাদের ধরন ও হালত
বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতি ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক কাজে সর্বাধিক মশহুর হচ্ছেন আলী রীয়াজ। সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে যেমন তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন, তেমনি সন্ত্রাসবাদের একধরনের কালানুক্রমিক ইতিহাসও রচনা করেছেন। জনপরিসরে ইসলাম ধর্মের নানান চেহারার মধ্যে পার্থক্য ও স্বাতন্ত্রের প্রতি তিনি যথেষ্ট মনযোগ দেন; তার আলোচনায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও মিলিট্যান্ট ইসলাম ইত্যাদি বর্গের উপস্থিতি তা-ই প্রমাণ করে। এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে আলী রীয়াজ ইসলামপন্থী সহিংস রাজনীতির বিগত তিন দশকের ছক তুলে ধরেন। যে সংগঠনগুলো ইসলামকে রাজনৈতিক মতাদর্শরূপে গ্রহণ করেছে এবং তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য সহিংস উগ্রতাবাদকে কৌশল হিসেবে বিবেচনা করে তাদেরকে ইসলামিস্ট মিলিট্যান্ট হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
আলী রীয়াজ শুরুতেই বলে দেন, তিনি সন্ত্রাসবাদের কারণ খুঁজেননি, বরঞ্চ কীভাবে এই সংগঠনগুলো বাংলাদেশে গঠিত হয়েছিল এবং সময়ের সাথে সাথে তাদের মতাদর্শ, কৌশল, লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতি পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়েছে, তা খোঁজা হয়েছে। এগুলোর ভিত্তিতে আলী রীয়াজ ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদকে পাঁচটি প্রজন্মে বিভক্ত করেন। আশির দশকে আফগান যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা মুজাহিদিনদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। হুজিবি-কে প্রথম প্রজন্মের দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জিহাদের মাধ্যমে ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েম করাই ছিল তাদের মতাদর্শিক ভিত্তি। আঞ্চলিক, বিশেষত পাকিস্তানের বিশেষ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সময়ের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা ছিলেন গ্রাম ও মাদ্রাসা ভিত্তিক, আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মাদ্রাসাই ছিল সংগঠনের সদস্য রিক্রুটের প্রধান স্থল। তাদের যেমন জিহাদি/সামরিক বিভাগ ছিল, তেমনি বেসামরিক/দাওয়া বিভাগ ছিল। দ্বিতীয় প্রজন্মে রয়েছে জেএমবি, জেএমজিবি সংগঠনগুলো। কেবল জিহাদের মাধ্যমে ইসলামি শাসন কায়েমে তাদের লক্ষ্য সীমিত ছিল না; দেশ থেকে অনৈসলামিক শক্তি ও চর্চাগুলোকে খতম করার ঘোষণা দিয়েছে। বিদ্যমান আইন ও বিচার-বিভাগকে সরিয়ে শরিয়া শাসনব্যবস্থা কায়েমের কথা বলার পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলে বামপন্থী রাজনীতিবিদদের খতম করা শুরু হয়। সংগঠনগুলো স্থানিক হলেও, পাকিস্তান, সৌদি আরবের সাথে যুক্ততা ছিল বলে ধারণা করা হয়। শহুরে যুবকরাও যুক্ত হতে থাকেন এগুলোতে। হিজবুত তাহরীর হচ্ছে তৃতীয় প্রজন্মের সংগঠন। তারা খলিফার অধীনে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেয়। গ্লোবাল জিহাদি মতাদর্শ প্রচার শুরু করে এবং কিছু সামরিক ক্যু করার ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল বলে ধারণা রয়েছে। এই প্রজন্মে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক চরিত্র ধারণ করে। প্রথম দুই জেনারেশনের সাথে বিভিন্ন দেশের সংগঠনের লেনদেন থাকলেও সেগুলোর চরিত্র – মতাদর্শগত জায়গা থেকে – আন্তর্জাতিক ছিল না, বরঞ্চ অনেক বেশি স্থানিক ছিল। এতে যারা যুক্ত হন তাদের অধিকাংশ হচ্ছেন শহুরে মধ্যবিত্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন যুবকরা। এরপরে আসে চতুর্থ প্রজন্ম। তারাও একইভাবে গ্লোবাল জিহাদি মতাদর্শ প্রচার করে। ধর্মের সমালোচনাকারী ও নাস্তিকদের খতম এবং সেকুলার প্রকাশনার ওপর হামলা করার কথা বলে। বিভিন্ন ব্লগার হত্যার দায় স্বীকার করে। অর্থের যোগান আসে প্রধানত দেশের বাইরে থেকে। এই সময়ে অনলাইন বা সাইবার-পরিসরের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। রিক্রুট বা টার্গেট ঠিকঠাক করতে সাইবার পরিসরকে কাজে লাগানো হয়। যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদের অধিকাংশ ছিলেন শিক্ষিত, শহুরে ও মধ্যবিত্ত। পঞ্চম প্রজন্মও একইভাবে সাইবার-পরিসর নির্ভর। তুলনামূলকভাবে আরও বেশি প্রযুক্তিগত দক্ষ। যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদের শ্রেণিগত অবস্থান ওপরের দিকে। ইংরেজি মাধ্যম বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। ইরাক ও সিরিয়াতে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য গোপনে দেশ ত্যাগ করে। ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহিংস কায়দা-কানুন গ্রহণ করে। বিদেশী, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করা হয়। আলী রীয়াজ বাকি প্রজন্মের সাথে এই প্রজন্মের একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করেন, তারা সামূহিকভাবে মুসলমানদের ওপর জারি থাকা অন্যায়-অবিচার-জুলুমের দিকে ইঙ্গিত করে। তারা ‘জিহাদ’কে উনিশ শতকে বাংলায় যে ধর্মীয় জাগরনবাদী আন্দোলন চলছিল তার সাথে যুক্ত করে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার বয়ান হাজির করতে চায়।
আলী রীয়াজের মতে, মতাদর্শগত জায়গা বাদে এই সংগঠনগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে, এগুলো আইনের গণতান্ত্রিক শাসন ও ব্যক্তির মানবাধিকারকে অস্বীকার করে। পাশাপাশি দেখা যায়, নাইন/ইলেভেনের পর সন্ত্রাসবাদ ধীরে ধীরে বৈশ্বিক চেহারা পাচ্ছে এবং দেশের ভেতর ও বাইর দুই জায়গাতেই তারা ফাংশন করতে আগ্রহী। তবে, ইসলামি সন্ত্রাসবাদের সাথে মাদ্রাসার সংযোগের জনপ্রিয় থিসিসকে এই প্রবন্ধ প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। দেখা যাচ্ছে, নব্বই দশকের দুটো প্রজন্মের পর সন্ত্রাসবাদের সাথে ‘ধর্মীয়’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাইতে ‘সেকুলার’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংযোগ বেশি। পাশাপাশি, সন্ত্রাসবাদের সাথে শহুরে, স্বচ্ছল, এমনকি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের অংশগ্রহণ অর্থনৈতিক দুরাবস্থাকে সন্ত্রাসবাদের কারণ হিসেবে দেখার রেওয়াজকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। এই দিক থেকে সন্ত্রাসবাদের বৈশ্বিক অন্যান্য প্রবণতার সাথে এর মিল রয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে আশেক হক একজন মতাদর্শিক গুরুকে নিয়ে আলোচনা করেন। যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদে মতাদর্শ প্রচারে মতাদর্শিক গুরুর ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। জসিমউদ্দিন রাহমানিকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আদর্শিক নেতা এবং সর্বাধিক আগ্রাসী ও স্পষ্টভাষী জিহাদি নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আশেক হক বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের মতাদর্শিক অবস্থান বিচারের জন্য রাহমানির ওয়াজের বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গিকে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে রাহমানি তার ওয়াজের মাধ্যমে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম গঠন, মতাদর্শ প্রচার এবং অন্যান্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাহমানি কওমী মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করলেও পরবর্তীতে ভারতের দেওবন্দ ও হায়দ্রাবাদ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। সৌদি আরবেও কিছুদিন খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। আনসারুল্লাহ বাংলাটিম ২০০৭ সালে কর্মকাণ্ড শুরু করার পর থেকে হাতেগোনা যে কয়জন এর প্রধান মাথা ছিলেন এর মধ্যে রাহমানিও ছিলেন। আশেক হক তার পুস্তকাদি ও ওয়াজের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে বলেন, রাহমানি যেমন ইসলামি ইমান ও আক্বিদা দিয়ে আলোচনা করেছেন, তেমনি সালাফি-জিহাদি মতাদর্শকে প্রচার করেছেন। যে কোনো মতাদর্শিক নেতার মতো তিনিও ওয়াজ/লেখালেখি সাজাতেন: মুসলমানদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে এর জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতেন; নিজস্ব মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে সমাধান হাজির করতেন এবং এর জন্য অনুসারীদের কাজে নেমে পড়ার আহ্বান করতেন। সালাফি-জিহাদি মতাদর্শই তার কাজের ন্যায্যতা প্রদান করতো।
সালাফি মতাদর্শের যে পাঁচটি প্রধান বৈশিষ্টের কথা শিরাজ মাহের উল্লেখ করেন তার ভিত্তিতে আশেক হক রাহমানিকে বিচার করেন : জিহাদ, তওহিদ, তাকফির, আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা এবং হাকিমিয়া। সালাফি-জিহাদিদের কাছে জিহাদ হচ্ছে সর্বাধিক আলোচিত ও শক্তিশালী সহিংসতার ডিসকোর্স। পৃথিবীতে আল্লার ধর্ম প্রতিষ্ঠায় জিহাদ ছাড়া কোনো উপায় নেই। জিহাদকে এই দিক থেকে সর্বদা সহিংস কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরপরেই রয়েছে তওহিদ। এটা ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও সালাফি-জিহাদিরা একে তাদের সহিংস ডিসকোর্সে অন্তর্গত করে নেন। তাদের মতে, আল্লাহর প্রতি নিজেদের পূর্ণ বিশ্বাস প্রদর্শনের জন্য একশন বা কাজ করা জরুরি। সে কাজ হচ্ছে জিহাদ, যা দুনিয়ার বুকে আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠা করবে। তৃতীয় দিক হচ্ছে তাকফির: কোনো মুসলিম ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাফির ঘোষণা করার প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, কে মুসলমান আর কে মুসলমান না/মুসলমানিত্ব থেকে বের হয়ে গেছেন- এমন একটা সীমানা টেনে দেওয়া হয়। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা ধারণা। এর মাধ্যমে বিশ্বস্থতা ও অবিশ্বস্থতার মধ্যে বাইনারি জগত তৈরি করা হয়। আপনি হয় বিশ্বাসী, না হয় অবিশ্বাসী। এর বাইরে আর কোনো স্থান নেই। এরপরেই রয়েছে হাকিমিয়া; সালাফি-জিহাদি মতে যার অর্থ হচ্ছে আল্লার সার্বভৌমত্ব কায়েম করা; অর্থাৎ ইসলামের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপন। আশেক হকের মতে, রাহমানি তার ওয়াজে হুবুহু এই শব্দগুলো ব্যবহার না করলেও তার বিষয়বস্তুতে সালাফি-জিহাদি মতাদর্শের উপর্যুক্ত উপাদানগুলো সর্বদা উপস্থিত থাকতো। রাহমানির ওয়াজ বা বক্তব্যের সাথে আগের/অন্যান্য ইসলামি নেতাদের পার্থক্য প্রায় চোখে পড়ার মতো। আশেক হকের মতে, দেলওয়ার হোসেন সাইদি বা ফজলুল হক আমিনিরা যখন ইসলামি দেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন, সেখানে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থাকতো; রাহমানির বিষয়বস্তু ও কৌশল উভয় দিক থেকে আলাদা।
জেসমিন লর্চ ও আবুল কালাম আজাদ তৃতীয় অধ্যায়ে আমাদের নজর ফিরিয়েছেন বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদের অনালোচিত ও অনালোকিত বিষয়ের দিকে : সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ। গত কয়েকবছর, বিশেষত আইএস এর উত্থানের পর সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সাথে নারীদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইএস-এর উত্থানের পর বৃদ্ধি পেলেও জঙ্গিবাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকেই নারীদের সম্পৃক্ততার নজির পাওয়া যায়। তবে, এই সময়ে অনলাইন পরিসরের ক্রমাগত বৃদ্ধি নারীদের অংশগ্রহণের মাত্রা ও তীব্রতাতেও ভিন্নতা নিয়ে এসেছে। নারীদের অংশগ্রহণ দুনিয়াব্যাপী সালাফি প্রপঞ্চের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে, এমন অংশগ্রহণের স্পষ্টত কোনো কারণ পাওয়া যায় না। কিন্তু, কারণ হিসেবে জনপ্রিয় যতগুলো মতামত রয়েছে, সেগুলোর প্রতি গবেষণা কোনো সম্মতিসূচক সাক্ষ্য প্রদান করে না। যেমন, পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, “নব্য জেএমবির যে কয়জন নারী সদস্য এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন বা আত্মসমর্পণ করেছেন, তারা সবাই স্বামীর চাপে বা সামাজিক কারণে ওই পথে গেছেন বলে ধারণা পেয়েছে পুলিশ। নব্য জেএমবিতে এমন কোনো নারী নেই যিনি নিজের ইচ্ছায় জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন।” অর্থাৎ, ধরে নেওয়া হয় যে, নারী তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সালাফি মতবাদে ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। যদিওবা, স্বামী বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মারফতে নারীরা সালাফি আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এই সাক্ষ্যও বহন করছে যে, নারীরা নিজ উদ্যোগেই র্যাডিকালাইজেশনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন, বা তারা নিজেরাই তাদের মতাদর্শিক অবস্থান গ্রহণ করছেন। এমনকি, এমন ঘটনাও ঘটেছে, যেখানে নারী নিজে অনলাইন পরিসরে তার মতাদর্শের ছেলে খুঁজে বিয়ে করেছেন। পূর্বেকার সকল আলোচনাতে নারীর এই এজেন্সিকে গায়েব করে দিয়ে কেবল বহিরাগত ফ্যাক্টরের দিকে জোরারোপ করা হয়েছে। আবার, নারীদের আর্থ-সামাজিক আলোচনাতে বারেবারে বলা হয়ে থাকে যে, অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য তারা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সহজ টার্গেট হচ্ছে; অর্থাৎ, তাদের দুর্দশা তাদেরকে আন্দোলনে যোগ দিতে প্রেরণা দিচ্ছে। কিন্তু লর্চ ও আজাদ দেখাচ্ছেন যে, নারী মিলিট্যান্টদের অধিকাংশ আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা এবং শিক্ষিত। উল্লেখ্য, এই প্রবণতাতে পুরুষের সাথে নারীদেরও মিল লক্ষ্য করা যায়।
সন্ত্রাসবাদে নারীদের ভূমিকা নানা কিসিমের হয়ে থাকে। দাওয়াহ কার্যক্রম থেকে শুরু করে, অস্ত্র বহন ও আক্রমণ করা পর্যন্ত নারীদের ভূমিকা বিস্তৃত। আবার, লর্চ ও আজাদের মতে, নিরাপত্তার বিভিন্ন ধরনের কাঠামোগত দুর্বলতার সুযোগে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমত, পুরুষতান্ত্রিক স্টেরিওটাইপের কারণে বাংলাদেশের এজেন্সিগুলো একদিকে কখনোই নারীকে পুরুষের মতো করে সন্ত্রাসবাদের উপাদান হিসেবে ভাবতে পারেনি; দ্বিতীয়ত, নারীর র্যাডিকালাইজেশনের কারণ উল্টো বোঝার কারণে কখনোই বিষয়টাকে আমলে নেওয়া সম্ভব হয়নি; তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিণতিতে অনেকে জড়িয়েছেন। এখানে নানাভাবে পুরুষতন্ত্রের উপস্থিতির কথা বলেছেন গবেষকদ্বয়। একদিকে কখনো কখনো পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দ্বারা নারী প্রভাবিত হচ্ছে, অন্যদিকে কখনো কখনো নারীরা সালাফি মতাদর্শে ঝুঁকেছেন বিদ্যমান অধার্মিক পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে, যদিওবা সালাফি বা আইএস মতাদর্শও ভয়াবহ পুরুষতান্ত্রিক। পাশাপাশি, সরকারি বাহিনীদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীদের এই অংশগ্রহণের কারণ এখনো ঠাহর করতে পারেননি। গবেষকদ্বয়ের মতে, নারী অংশগ্রহণের ক্রমাগত বৃদ্ধি সমাজে সালাফি মতাদর্শের গোড়া আরো ঝেঁকে বসতে পারে, এবং সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা তেতিয়ে তুলতে পারে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, এই যে শহুরে তরুণদের দোরগোড়ায় জিহাদি দাওয়াত পৌঁছে যাচ্ছে সেটা কোন ধরনের বয়ানের ঘাড়ে সওয়ার হচ্ছে, এবং এর সাম্প্রতিক কার্যকর বাহন-ই-বা কী। সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো কোন ধরনের বয়ান তাদের টার্গেট শ্রোতার সামনে হাজির করে তার বিবরণ চতুর্থ অধ্যায়ে বুলবুল সিদ্দিকী দিয়েছেন। তিনি যে কয়েকটি প্রবণতার বলেছেন সেগুলো বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট নয়, বরঞ্চ সারাদুনিয়াতে একই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন, মোটাদাগে দুটো বয়ানের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, সারা দুনিয়ার মুসলমানদের (অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহ) মজলুম হিসেবে উপস্থাপন করে এর থেকে নিস্তার পাওয়া, এবং দ্বিতীয়ত, ইসলামের স্বর্ণযুগে ফেরত যাওয়া। উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে একেবারে হাল আমলের ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়াতে ইউরোপ ও মার্কিনীদের সামরিক আগ্রাসন ‘মজলুম’ পরিচয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি করে বা জুলুমের নজির হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে। পশ্চিমা বা ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরির উপলক্ষ হিসেবে মুসলমানের দুর্দশার কথা বারংবার বলা হয়। পশ্চিমারা যেমন শত্রু, তেমনি পশ্চিমা শিক্ষিত দেশীয় লোকেরাও শত্রু। পশ্চিমাদের আদলে এই যে পুরো ব্যবস্থা তৈয়ার হয়েছে তা ভেঙ্গে এক স্বর্ণযুগে ফিরে যাওয়ার স্বপ্নের কথাও প্রচার করা হয়। ইসলামের এক স্বর্নালী অতীতের গল্প যখন বলা হয় তখন সেখানে নানা সত্য ও মিথের এক মিলমিশ তৈরি করা হয়। রিক্রুটের উদ্দেশ্যে জিহাদ ও সহিংস রাজনীতির পক্ষে বৈধতা উৎপাদনে নবীজির ও তার চার সাহাবির জীবন থেকে নানা গল্প বলা হয়; নিজেদের রাজনীতির জন্য উপযোগী খণ্ডিত অবস্থায় গল্প/কাহিনীগুলোকে উপস্থাপন করা হয়। জিহাদি দাওয়াতের জন্য যে বয়ান প্রচার বা ব্যবহার করা হয় তাতে একদিকে যেমন শত্রুর চিহ্নায়ন সম্ভব হয়, তেমনি আশু সমাধানের পথও বাতলে দেওয়া হয়।
বুলবুল সিদ্দিকি বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে যে অধ্যয়ন চালিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, তরুণরা ধর্মীয় অনুভূতির কারণে জিহাদি দাওয়াতের প্রতি সহানুভূতি অনুভব করলেও, মোটাদাগে সমাধানের উপায়কে খারিজ করে দেন। যেমন, তারাও মনে করেন, দুনিয়াব্যাপী মুসলমানরা দুর্দশাগ্রস্থ ও নির্যাতিত। এর জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তিও দাবি করেন। কিন্তু সন্ত্রাসবাদী দাওয়াতের মধ্যে সমাধানের যে তরিকা ও ঘৃণা জড়িত থাকে এর সাথে তারা দ্বিমত পোষণ করেন।
দাওয়াতি কার্যক্রমে এই যে বয়ানের কথা বলা হচ্ছে, বা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রিক্রুটের কথা বলা হচ্ছে, তাতে বর্তমানের পরিবর্তিত ও তথ্য-প্রযুক্তির চূড়ান্ত মুহূর্তে এর সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম কোনটা? সন্দেহ নেই, অনলাইন পরিসর আমাদেরকে এক নতুন বাস্তবতায় নিয়ে এসেছে। তবে ইন্টারনেটের ভূমিকা নিয়ে নানাবিধ তর্কবিতর্ক রয়েছে; যেমন, ইন্টারনেট কী আদৌ সহিংসতা বা সন্ত্রাসবাদী বা র্যাডিক্যাল রাজনীতিতে অংশগ্রহণে ভূমিকা পালন করে, নাকি এটা ইতোমধ্যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে সংস্পর্শে চলে আসা যুবকদের কাজের কেবল গতিটাই বৃদ্ধি করে। অথবা, অনলাইন পরিসরে যারা প্রভাবিত তারা কী অফলাইনেও সহিংস কার্যক্রমে অংশ নেন, নাকি তাঁদের কার্যক্রম অনলাইনে ঘৃণা প্রচার ও বৈধতা উৎপাদন বা প্রচারণাতেই সীমিত? এই তর্কগুলোর কোনো স্পষ্ট উত্তর না পেলেও এটা স্পষ্ট যে, ইন্টারনেটের কল্যাণে যে জটিল জনপরিসর ও যোগাযোগের বাহন তৈরি হয়েছে তার কিছু মাত্রার প্রভাব সমাজের অন্যান্য অংশের মতো সন্ত্রাসবাদের ওপরও পড়েছে। ২০১৭ সালে পুলিশের একটা গবেষণা জানিয়েছিল যে, তখন পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া প্রায় ৮৭ শতাংশ আসলে অনলাইন দাওয়াতি কার্যক্রমের মাধ্যমে র্যাডিকেলাইজড হয়েছিলেন। সাইমুম পারভেজ পঞ্চম অধ্যায়ে এই দিকটাতেই আলো ফেলতে চেয়েছেন : সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো তাদের রিক্রুট কার্যক্রমে ইন্টারনেটকে কীভাবে ব্যবহার করে। তিনি দেখাচ্ছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহ অনলাইনের নানা পরিসরে ছড়িয়ে থাকা জিহাদি প্রপাগান্ডামূলক ভিডিও, ফতোয়া রিক্রুটমেন্টে গুরুতর ভূমিকা পালন করছে। তবে এর প্রবাহ একমুখী নয়। সন্ত্রাসবাদী সংগঠন যেমন অনলাইনের মাধ্যমে তার সদস্যকে নিযুক্ত করছে, তেমনি সম-মতাদর্শের লোক একইভাবে সংগঠনকেও খুঁজে বের করছে। অনলাইন পরিসরে প্রপাগান্ডার বিস্তার জনগোষ্ঠীর এমন কিছু বর্গের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে যাদের কাছে পূর্বে দাওয়াত পৌঁছানো তুলনামূলক কষ্টসাধ্য ছিল : নারী এবং ‘পশ্চিমায়িত’ ও স্বচ্ছল পরিবারের যুবক। তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কেবল যে সংগঠনে যুক্ত হচ্ছে তা-ই নয়, বরঞ্চ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়ে নিজেরা একধরনের গোষ্ঠীও গড়ে তুলছে, যেখানে নিজেদের অবস্থান প্রতিনিয়ত জানান দেওয়া যায়; অর্থাৎ নতুন সেন্স অফ বিলংগিং তৈরি করছে। সে তার পরিবার-পরিজনের সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নতুন এক সম্পর্কের মধ্যে জড়াচ্ছে। যেমন, একজন জিহাদি বলছিলেন, “আমরা আমাদের বাড়ি ছেড়ে হিজরত করেছি, আমাদের সবই ছিল… সব ছিল… সব ত্যাগ করেছি জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ চর্চার জন্য। হয় আমরা মারবো, না হয় মরবো, আমাদের জন্য রয়েছে বেহেশত। আপনাদের আসল জিনিস বুঝতে হবে এখানে, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ আদতে শরিয়া পালনের বিষয়। আমরা আদতে এটাই করছি”। এই বার্তা থেকে যেমন তাদের আগের সামাজিক সম্পর্কের সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নতুন ধরনের সেন্স অফ বিলঙ্গিং তৈরির ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তেমনি মৃত্যুর প্রতি তাদের আকুল বাসনাও টের পাওয়া যায়। অনলাইন পরিসরের যে স্বাভাবিক বৈশিষ্ট – সমমনাদের সহজ সন্ধান – সেটার প্রভাব অস্বীকার করা অসম্ভব; বরঞ্চ যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে একজন ব্যক্তি সহজে সমমানের সন্ধান পেতে পারে। তবে, সাইমুম পারভেজ এটাও বলে দেন যে, এই ধরনের প্রপাগান্ডা কাউকে ‘সন্ত্রাসী’ বানিয়ে দেয় না। বরঞ্চ এটা কেবল প্রাথমিক পদক্ষেপ। অর্থাৎ, যার মধ্যে এই ঝোঁক আছে, তাকে বরঞ্চ সমমনা ও এমনতর সংগঠনের পাশে নিয়ে আসতে সাহায্য করে।
কাজলী সেহরিন ইসলাম ২০১৬ সালের হলি আর্টিজেন আক্রমণকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে এই ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের উপস্থাপন বিষয়ে বিস্তর আলোকপাত করেছেন। আক্রমণের পর বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্র কীভাবে ঘটনাকে তুলে ধরেছে, ভুক্তভোগী ও আক্রমণকে কীভাবে হাজির করছে এবং কী ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছে তার বিচার করে কাজলী সেহরিন ইসলাম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমাদের জানাচ্ছেন। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সন্ত্রাসবাদী আক্রমণকে নিয়ে বিস্তর সংবাদ প্রকাশ করলেও, ঘটনার সংবাদযোগ্য হয়ে ওঠা আসলে নির্ভর করে মৃত্যুর সংখ্যা সহ আরও নানাবিধ কারণ। হলি আর্টিজেনের আক্রমণ যেহেতু আকারে বৃহৎ ছিল, ঢাকার নিরাপদ স্থানে সংঘটিত হয়েছিল এবং ভুক্তভোগীদের মধ্যে দেশি অভিজাত ও বিদেশীরা ছিলেন, সেহেতু এই ঘটনা মনযোগ কেড়েছে তুলনামূলক বেশি। প্রতিটি সংবাদপত্র তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনার আদ্যোপান্ত, সরকারি বিবৃতি, হামলাকারী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এবং ভুক্তভোগীদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তবে, তাৎক্ষণিকতার রেশ কেটে গেলে সংবাদের ধরন পালটে যায়। এই সময়ে, কাজলীর মতে, প্রধানত দুটো বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা হয়। প্রথমত, রাজনৈতিক দোষারোপ করা। সরকারি দলের নেতাকর্মী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত, দাবি করেন যে, এই জঙ্গি হামলার পিছনে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীর হাত আছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা দেওয়ার জন্য এই হামলা চালানো হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো দাবি করেন, সরকার দমন-পীড়নের মাধ্যমে স্বৈরশাসন কায়েম করেছে এবং এহেন পরিস্থিতিতেই উক্ত ধরনের হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বা সন্ত্রাসবাদের দিকে তরুণরা ঝুঁকছে। দ্বিতীয়ত, আক্রমণকারীদের নিয়ে নানা ধরনের তদন্তমূলক প্রতিবেদন ছাপা হতে থাকে। পাশাপাশি, সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের কারণও খোঁজা হয়। হলি আর্টিজেন হামলার পর দেখা গেলো, সন্ত্রাস বা জঙ্গিদের বিষয়ে বাজারে চালু থাকা ধারণাসমূহ ধাক্কা খেলো। জঙ্গিরা মাদ্রাসার ছাত্র, গরিব, গ্রামের যুবক ইত্যাদি বলে যে ধরনের স্টেরিওটাইপ চালু ছিল, তার বিপরীতে দেখা গেলো, হলি আর্টিজেনের সাথে সম্পৃক্তরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং শহুরে। ধনী পরিবারের উচ্ছন্নে যাওয়া পোলাপান- এমন এক বয়ান নিয়ে সংবাদপত্রগুল হাজির হলো। যেহেতু অধিকাংশ ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল, সেহেতু অভিযোগের তীর গেলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে। এমনও দাবি করা হলো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড না থাকায় সেখানে সন্ত্রাসবাদ ডালাপালা মেলছে এবং তাদেরই দায় নেওয়া উচিৎ। এই ধরনের প্রতিবেদনে বিশ্লেষণের বিপরীতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিমানবিকীকরণের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল যেন তারা মূলধারার জনগোষ্ঠীতে অন্তর্ভূক্ত কেউ নয়; কাজলীর ভাষায়, তাদের ‘অপরায়ন’ (আদারিং) করার পর্যাপ্ত প্রমাণাদি পাওয়া যায় প্রকাশিত সংবাদ ও প্রতিবেদনে।
কাজলী আরেকটি গুরুতর প্রবণতার কথা উল্লেখ করেছেন। সংবাদমাধ্যমগুলো অধিকাংশ সময় সরকারি বয়ান বা বিবৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। নিজেরা প্রায়শই কোনো ধরনের অনুসন্ধানে লিপ্ত না হয়ে বরঞ্চ বারেবারে ভর করেছে সরকারি বিবৃতির ওপর। এখানে আবার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, সন্দিহান ও তাদের পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে চান না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশে নিরুৎসাহিত করে এবং মিডিয়াহাউজগুলো সাংবাদিকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে না। সাথে যুক্ত হয় সময়ের অপর্যাপ্ততা, গণমাধ্যমের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের উপস্থিতি স্বীকার বা অস্বীকারের দিকে সরকারি অবস্থান। ফলে, যুদ্ধের কালে যেমন এক ‘অস্বাভাবিক অবস্থা’ তৈয়ার হয়, যেখানে সরকারের পক্ষে জনমত গঠন করতে হয়, ভিন্নমতকে অনুৎসাহিত করা হয় এবং ভিন্নমতকে প্রায়শই দেশ ও রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, সন্ত্রাসবাদী হামলার কালেও একই অবস্থা জারি করা হয়। ফলে, গণমাধ্যম আরও বেশি সরকারি বিবৃতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কাজলী বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম যদি সরকারি বিবৃতিকে চ্যালেঞ্জ করে তখন সেটাকে কেবল সরকারি বিবৃতির বিরোধীতা হিসেবে না দেখে বরঞ্চ সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসবাদের প্রতি সহানুভূতি হিসেবে দেখা হয়, যা রাষ্ট্র ও সরকার বিরোধীতায় পর্যবসিত হয়ে যায়। তার মতে, এই ধরনের সংবাদ প্রতিবেদন ও ফ্রেমিং – যা কিনা বিনা প্রশ্নে সরকারি বয়ান গ্রহণ ও প্রচার করে – একদিকে পাবলিককে গণমাধ্যমের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে, অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত জটিল আর্থ-সামাজিক ও গ্লোবাল বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করতে ব্যার্থ হয়।
দমন ও রাজনীতি
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, দি পলিটিক্স অফ টেররিজম গ্রন্থকে মোটাদাগে দুইভাবে ভাগ করা যায়। প্রথম অংশে রয়েছে বর্তমান সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের প্রবণতাসমূহ এবং দ্বিতীয় অংশে রয়েছে সন্ত্রাসবাদী দমনের রাজনীতি। রাষ্ট্র কীভাবে সন্ত্রাসবাদ দমনের উছিলায় নাগরিকের নাগরিক অধিকার দমন করে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, এবং অপরাপর জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের নজরে ‘সন্ত্রাসী’ দাগা দেয় – গ্রন্থের পরবর্তী তিনটা অধ্যায়ে এগুলোর নিরীক্ষা রয়েছে। সপ্তম অধ্যায়ে বিনা দি কস্তা ও হানা শামস আহমেদ পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তামূলক নজর নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইয়ের বাকি অংশের সাথে এই অধ্যায়ের মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, বাকি অংশে সন্ত্রাসবাদের আলোচনায় সাম্প্রতিক ‘ইসলামি মিলিট্যান্সি’কে কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। কিন্তু, এখানে বিনা ও হানা মনযোগ দিয়েছেন একেবারে অন্য জায়গায় : রাংলাদেশ রাষ্ট্র কীভাবে সন্ত্রাসবাদের ডিসকোর্সকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাত মোকাবিলায় ব্যবহার করেছে। সত্তর-আশি দশকে পাহাড়ে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর সেটাকে ‘ইনসার্জেন্সি’ বলা হলেও শান্তিচুক্তির পর সেখানে ‘টেররিজম’ বয়ান ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। এই বয়ানে ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনার নির্মাণ-বিনির্মাণের পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসীদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য ‘হুমকি’স্বরূপ বিবেচনা করা হয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ডকে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা হিসেবে দেখার পাশাপাশি সরকারি বয়ান আদিবাসীদের রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বস্থ হিসেবে সাব্যস্থ করে আসছে। এই বয়ানের মাধ্যমে যে কোনো আদিবাসী এক্তিভিস্টকে সহজেই ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। যেমন, ২০১৫ সালে পাহাড়ি এলাকায় সামরিক বাহিনীর গুলিতে পাঁচজন জুম্মা এক্টিভিস্ট নিহত হন। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার এই সংবাদ প্রকাশ করলে ডিজিএফআই পত্রিকা দুটোকে সতর্কবার্তা পাঠায়। কারণ, প্রকাশিত সংবাদে নিহতদের পরিচয়ে ‘সন্ত্রাসী’ না লিখে ‘আদিবাসী’ লেখা হয়েছিল। সতর্কবার্তা পাঠিয়েই ডিজিএফআই ক্ষান্ত দেয়নি, দুটো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রদানে বিরত থাকতেও বিভিন্ন কোম্পানিকে আদেশ/নির্দেশ/অনুরোধ করা হয়েছিল। এই ‘সন্ত্রাসী’ বলার যে বয়ান তা দিয়ে একদিকে যেমন পাহাড়ে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে জায়েজ করা সম্ভব হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি সামরিক বাহিনী ও তাদের সহায়ক ব্যবসায়ীগোষ্ঠী একত্রে পাহাড়কে ব্যবসায়িক হাব বানিয়ে তুলেছে, যা থেকে আর্থিক ফায়দাও হাসিল হচ্ছে। শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে আদিবাসীদের সশস্ত্র সংগ্রাম হ্রাস পেলেও, সরকারের পক্ষ থেকে ‘বি-সামরিকীকরণ’ এর উল্টো ‘পুনঃসামরিকীকরণ’ ঘটেছে। ‘সন্ত্রাসবাদ’ এর এই বয়ানে এবং পাহাড়ে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির প্রশ্নে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, সামরিক ও দেশের অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে মৌলিক কোনো ফারাক নেই।
অষ্টম অধ্যায়ে রিদওয়ানুল হক বাংলাদেশের সন্ত্রাসদমনের আইন বিষয়ে একটি পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। বাংলাদেশের আইনি কাঠামো যে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করে চলছে, সেটা সন্ত্রাস দমনের আইনের ক্ষেত্রেও থাকে। উপনিবেশ আমল থেকেই ‘সন্ত্রাসবাদ’কে ঠেকানোর জন্য মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ-জমানাতেও এমন সব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যেখানে ‘সন্ত্রাসীমূলক’ কর্মকাণ্ড দমনের জন্য ঔপনিবেশিক কায়দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অফুরন্ত ক্ষমতা দেওয়া যায়, যা প্রায়শই আইনি কোনো প্রক্রিয়ার তোড়াই কেয়ার করে। তবে নাইন-ইলেভেনের পর আগের আইনের ধারাবাহিকতার সাথে আরও নতুন যুক্ত হয়েছে। এখন আর সন্ত্রাসবাদ কেবল রাষ্ট্রের সীমানার ভেতরকার মামলা থাকেনি। দুনিয়াব্যাপী একত্রে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে ২০০১ এর পর বিভিন্ন দেশে কাউন্টার টেররিজম ল বা সন্ত্রাস দমন আইন প্রণয়ন করা শুরু হয়। বাংলাদেশও ২০০৭-২০০৮ সালের দিকে Counterterrorism Ordinance 2009 এবং Counterterrorism Act 2009 এর মাধ্যমে এই জগতে প্রবেশ করে। রিদওয়ানুল সন্ত্রাসদমন আইন ও এর সাথে জড়িত অন্যান্য আইনের (যেমন, মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন এক্ট ২০১২ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮) নানা দিক ক্রিটিক্যালি তুলে ধরেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশের সন্ত্রাসদমনের আইনের ভেতরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। প্রথম সমস্যা হচ্ছে, তাঁর মতে, সন্ত্রাসবাদ বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সংজ্ঞার ব্যাপকতা, অস্পষ্টতা ও অসংলগ্নতা। সংজ্ঞার সাথে এমন শব্দবন্ধ – যেমন, জননিরাপত্তা, রাষ্ট্রের অখণ্ডতা বা সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি- যুক্ত করা হয়েছে যার কোনো স্পষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। সন্ত্রাসদমন আইন, মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন এক্ট ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যেও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে অসঙ্গতি রয়েছে। যেমন, সন্ত্রাস দমন আইন সন্ত্রাসী অর্থায়নের অপরাধকেও সংজ্ঞায়িত করে এবং এ অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি প্রদান করে, মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন এক্ট সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের জন্য অর্থ পাচারের একটি জটিল সংজ্ঞা প্রদান করেছে। পাশাপাশি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাত ব্যবহার করে তুচ্ছ কারণেও যে কারোর বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করা যেতে পারে। এমনকি, শাস্তির অসমতা, ম্যাজিস্ট্রেট এর মতো প্রশাসনিক কর্মকর্তার হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা, আইনের অধীনে নাগরিকের মামলা করার অধিকার না থাকা ইত্যাদিকে সমস্যা বলে উল্লেখ করেছেন রিদওয়ানুল হক। এই আইনের অধীনে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিয়মিতই আইন-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ে।
রিদওয়ানুল হক বলেন, “বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমন আইনের বিভিন্ন ধারা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে এগুলো সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান সম্পূর্ণরূপে মেনে চলে না।” তার মতে, সন্ত্রাসবাদের প্রতি এই আইনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিরোধমূলক বা সুরক্ষামূলক না হয়ে বরঞ্চ রিয়েক্টিভ হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ দমন আইন নির্বাহী কর্তৃপক্ষের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়েছে এবং কার্যত বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য বাধা তৈরি করে রেখেছে। এখানে অভিযুক্তরা প্রায়শই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। উল্টো, ক্রসফায়ারের মতো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সন্ত্রাসদমনের উছিলায় কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনই করা হয়নি, বরঞ্চ বাংলাদেশে গত এক দশক যাবত যে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়েছে তাতেও ‘সন্ত্রাসবাদ’ বয়ান গুরুতর ভূমিকা পালন করেছে। আমার অনুমান, বিদ্যমান আওয়ামী রেজিমে সামগ্রিকভাবে ‘টেররিজম’ নিয়ে আলোচনা করার প্রতি যে অনীহা সেটা মূলত এই আশংকা থেকে যে, ‘সন্ত্রাসবাদ’ বিষয়ক আলোচনা থেকে যাবতীয় রাজনৈতিক ফায়দা আওয়ামীলীগের ঝুলিতে চলে যাবে। অর্থাৎ, আওয়ামীলীগের কর্তৃত্ববাদী চেহারা নিয়ে হাজির হওয়ার সাথে সন্ত্রাসবাদ দমনের রাজনীতির এক ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের অস্বীকার করা হয়েছে, অন্যদিকে আওয়ামীলীগ না থাকলে দেশ জঙ্গিদের দখলে চলে যাবে – এমনতর বয়ান ক্রমাগত উৎপাদন-পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে নিজেদের জায়েজ করা হয়েছে/হচ্ছে। সাজ্জাদুর রহমান নবম অধ্যায়ে সন্ত্রাসবাদ দমনের এই রাজনীতিকে খোলাসা করে দেখিয়েছেন যে, সন্ত্রাস দমনের উছিলায় কেবল অভিযুক্তদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে না, বরঞ্চ সামগ্রিকভাবে নাগরিক অধিকারকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর আলোচনা কেবল আওয়ামী রেজিমের মধ্যে সীমিত রাখেননি। বিএনপি আমলের সংঘটিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও আওয়ামী লীগ আমলের হলি আর্টিজেন হামলার ঘটনাকে পাশাপাশি বিশ্লেষণ করে দুটোর মধ্যকার ধারাবাহিকতাগুলোও তুলে ধরেছেন। দুটো ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো একই ধরনের নিপীড়নমূলক হাতিয়ার ব্যবহার করেছে এবং সন্ত্রাসবাদের পুরো আলোচনার ‘রাজনীতিকরণ’ (অথবা আমার ভাষায় ‘দলীয়করণ’ও বলা যায়) ঘটিয়েছে। দুটো ঘটনার বেলাতেই বিচারব্যবস্থার কেবল রাজনীতিকরণ-ই ঘটেনি, বরঞ্চ দেদারছে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।
একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার ক্ষেত্রে অজস্র নাগরিককে গ্রেফতার, মিথ্যে মামলা, নির্যাতনের মাধ্যমে সাক্ষ্য আদায়ের কথা প্রায় সবাই জানি। জজ মিয়ার নাটকের কথাও কমবেশি সবাই জানেন। সাজ্জাদুর রহমান দেখাচ্ছেন, জজ মিয়ার আগে অন্তত ২২জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে পার্থ নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়, যিনি ভারতের একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছিলেন। ভারত থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও নিজের হিন্দু পরিচয়ের কারণে তাকে ‘ভারতীয় দালাল’ বানিয়ে গ্রেফতার করে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছিল। এমনকি নির্যাতনের মাধ্যমে, লোভ দেখিয়ে সাক্ষ্য আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এই হামলার রায় বিষয়ে সাজ্জাদুর রাহমান বলছেন, এই ঘটনা – অর্থাৎ ঘটনার সাথে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাবাহিনীর লোকদের সম্পৃক্ততা – সন্ত্রাসবাদের সাথে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর গভীর সখ্যতার প্রমাণস্বরূপ। তবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে কীভাবে জবাবদিহি করতে হবে সে বিষয়ে আদালতের রায়ে কোনো ধরনের নির্দেশনা/আলাপ ছিল না, উল্টো পুরো বিষয়টাকে কেবল পার্টিজান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করা হয়েছে।
অন্যদিকে হলি আর্টিজেনের হামলার ক্ষেত্রে সাজ্জাদুর রাহমানের বক্তব্য হচ্ছে, এখানে খোদ ভুক্তভোগীই সন্দেহভাজনে পরিণত হচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কয়েকজন ভুক্তভোগীকে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাদের কয়েকজন শ্রেণিগত অবস্থানের কারণে যত সহজে ‘ছাড়’ পেয়েছেন সবার নসিব তেমন ছিল না। যেমন, হলি আর্টিজেনের ঘটনার রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। তাকেও রাষ্ট্রীয় বাহিনী প্রথমে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তার সহযোগী শাওন আহত হওয়ার প্রায় ছয়দিন পর মারা যান। তার পরিবার দাবি করেছে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। তাদের নাম চার্জশিটেও ছিল না। কিন্তু তারা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাননি।
উপর্যুক্ত দুটো ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, উভয় পক্ষই ‘সন্ত্রাসবাদ’কে নিজ নিজ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের হাতিয়ার বানিয়েছে। বিএনপি তৎকালে কোনো ধরনের ইসলামি সন্ত্রাসবাদের উপস্থিতিকে অস্বীকার করেছে, উল্টো দায়ভার আওয়ামীলীগের কান্ধে চাপিয়েছে। একইভাবে আওয়ামীলীগ দেশে সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের উপস্থিতি অস্বীকার করেছে, এবং পুরো দায়ভার চাপিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের কান্ধে। দুটো রেজিমই সন্ত্রাসবাদের ডিসকোর্স ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ‘দুষেছে’। বর্তমানে আওয়ামীলীগ আরও সফল কায়দায় এই বয়ানকে ব্যবহার করে নিজেদের দমনমূলক শাসনব্যবস্থাকে দীর্ঘায়িত ও জায়েজ করে চলছে। সাজ্জাদুর রাহমানের মতে, আওয়ামীলীগ সন্ত্রাসবাদ দমনের ডিসকোর্স মোটাদাগে দুটো বয়ান গ্রহণ করেছে : এক, দেশ ও বিদেশের ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করতে যাচ্ছে; দুই, বিএনপি-জামাত হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের জন্মদাতা ও পৃষ্ঠপোষক।
রাজনীতির মাঠে এর ব্যবহারও হয়েছে পুরোদমে। বিরোধী দলগুলো বারেবারে অভিযোগ জানিয়েছে যে, বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসবাদ দমনের উছিলায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার করা হয়েছে। আওয়ামী পন্থী বুদ্ধিজীবীরাও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক আলাপ-আলোচনায় রাজনৈতিক ইসলামের সাথে সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ককে গুলিয়ে সমার্থক বানিয়ে উপস্থাপন করেছেন; যার ফলে বিএনপি-জামায়াতকে সন্ত্রাসবাদের সাথে তুলনা করে বিস্তর লেখাপত্র জনপরিসরে উৎপাদিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার সন্ত্রাসবাদ দমনের অজুহাতে বিভিন্ন ধরনের নজরদারিমূলক আইন প্রণয়ন করেছে, নাগরিকদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বেড়া দিয়েছে, নাগরিকের প্রাইভেসির অধিকার লঙ্ঘন করেছে, এমনকি ন্যায়বিচারের অধিকার হরণ করেছে। সাজ্জাদুর রাহমানের মতে, এই সবকিছু মিলিয়ে বর্তমানে যে অরওয়েলিয়ান ডিস্টোপিয়া আওয়ামী রেজিম কায়েম করেছে, তাতে সন্ত্রাসবাদ দমনের রাজনীতি গুরুতর ভূমিকা পালন করেছে।
শেষ কথা
সাইমুম পারভেজ ও মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত দি পলিটিক্স অফ টেররিজম গ্রন্থ বাংলাদেশ অধ্যয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির সাম্প্রতিক ওভারভিউ পাওয়ার জন্য, অন্যদিকে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রেজিমের সাথে সন্ত্রাসবাদের ডিসকোর্সের জটিল সম্পর্ক অনুধাবনের জন্য। কেন সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটছে, বা কেন শহুরে তরুণরা এতে জড়াচ্ছেন, এরকম কোনো সহজ ব্যাখ্যা আসলে নেই। এই গ্রন্থেও এমন কোনো সামাজিক কারণ অনুসন্ধান করা হয়নি। বরঞ্চ ওই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কিছু রসদ এতে যোগাড় করা হয়েছে বলা যায়। এমনকি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির তত্ত্বায়নের জন্য যে ধরনের পূর্ব-প্রস্তুতি জরুরি তাতেও এটি কিছুটা ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদী ডিসকোর্সের সাথে আওয়ামী রেজিমের কর্তৃত্ববাদের নিবিড় সম্পৃক্ততার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের জনপ্রিয় আলাপের পরিসরগুলোতে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বিষয়ক আলাপে যে কিঞ্চিৎ নিরবতা বিরাজ করছে, সেটা কাটিয়ে উঠতেও এটি সাহায্য করবে। আমাদেরকে সন্ত্রাসবাদের নানা দিক যেমন আমাদের আমলে নেওয়া দরকার, তেমনি রাষ্ট্র কীভাবে এই ডিসকোর্স ব্যবহার আরও নিপীড়নমূলক হয়ে উঠছে/ওঠে, আওয়ামী লীগ কীভাবে নিজের বৈধতা হাসিল করছে/করে সেটা নিয়েও বিস্তর বাতচিত করা দরকার। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটার আলাপ পুরো পরিস্থিতি ঠাহর করা সম্ভব নয়।
এই গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে দুটো বিষয়ের মধ্যে টানাপোড়ন চলছে। একদিকে সন্ত্রাসবাদ দমনের জরুরত অন্যদিকে মানবাধিকার নিশ্চিত করা। সবাই সন্ত্রাসবাদ দমনের ব্যাপারে একমত, কিন্তু দমনের জন্য অভিযুক্ত ও নাগরিকের মানবাধিকার হরণ নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন। উক্ত টানাপোড়নের কোন সহজ সরল উপায় বাতলে না দিলেও এই গ্রন্থ সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত বিদ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক, মতাদর্শগত ও কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে।