সমস্ত কুসুম ভরে জেগে আছে মৌলবাদী মধু

Share this:

সাক্ষাৎকার

 

শুদ্ধস্বর: আপনি কবিতার মাধ্যমে কী আবিষ্কার করার এবং বোঝানোর চেষ্টা করে থাকেন?

শেলী নাজ: কবিতার মাধ্যমে আমি কোনো কিছু আবিষ্কার করতে চাই না; বরং উপলব্ধির, চিন্তার, পুরুষজগতে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রকে নিয়ে নারীবাদী ভাবনার কোনো নতুন বিন্দু আবিষ্কৃত হলে তা কবিতায় তুলে আনতে চাই। তবে এটাও ঠিক যে, যদি আক্ষরিক অর্থেই আমার নিজের কবিতার মধ্য দিয়ে আমি কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টা করে থাকি তবে সেটা নিঃসন্দেহে ভাষার আর শব্দের নতুন দুনিয়া, ছন্দের জগত। যদিও পুরুষতন্ত্রের শিকার নারীর নিত্যদিনের উৎপীড়িত, নিষ্পেষিত, লুণ্ঠিত সেলফ অটোনমি বা তার সার্বভৌম এজেন্সির পীড়ন, তার নানা মনোসামাজিক মাত্রাকে তুলে ধরার জন্য কবিতার ভাষাভুবন যথেষ্ট না। চিরায়ত ছন্দের মাত্রা আর পর্বও নারীর বহুমাত্রিক অস্তিত্ব সংকট, শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিটি স্তর আর তার ভাংচুর, তার সাইকোসোমাটিক প্রতিটি অভিঘাতকে জায়গা দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে না বলে মনে হয়। ফলে সীমিত শব্দভাণ্ডার আর ছন্দের কাঠামোর মধ্যে নারীর আবেগ, অবদমন ও বিদ্রোহকে কত সফলভাবে উপস্থাপন করা যায় সেটা আবিষ্কারের চেষ্টা করি। ফরাসি কবি বোদলেয়ার মনে করতেন আত্মার একটি অবস্থার নামই কবিতা। অর্থাৎ এই কথাকে সত্যি ধরলে বলা যায় কবিতার মধ্য দিয়ে কবি নিজের আত্মার অনুসন্ধান করেন ও তুলে ধরেন। সেটা করতে গিয়ে আবারও নারী হিসেবে আমার নিজের সমস্ত ক্ষত ও অক্ষত অভিলাষ, লৈঙ্গিক রাজনীতির বিরুদ্ধে বিরামহীন যুদ্ধের দিকেই ফিরে থাকাই। কারণ আমার নিজের যুদ্ধই পৃথিবীর সমস্ত নারীর যুদ্ধ, হোয়াইট ওমেনও হোয়াইট  পেট্রিয়ার্কির শিকার। সেই অবস্থাটাই তুলে ধরি, পাঠককে শুধু নির্মল কবিতা সম্মোহনের আনন্দই না, নারীর যুদ্ধাবস্থাটাও বোঝানোর চেষ্টা করি। নারীর মনোদৈহিক সংকেত আর পুরুষতন্ত্রের সাথে তার সংঘাতময় অবস্থাটি বোঝানোর চেষ্টা করি।

 

শুদ্ধস্বর: আপনি বর্তমান বিশ্বকে কিভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং বর্তমান ঘটনাগুলো আপনাকে লেখার ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে?

শেলী নাজ: বিশ্ব মানচিত্রের দিকে তাকালে স্পষ্টত দুটি বৃহৎ ভৌগোলিক বিশ্বকে দেখতে পাই। ধনীবিশ্ব (তথাকথিত উন্নত)ও দরিদ্রবিশ্ব (তথাকথিত তৃতীয় বিশ্ব)। একাডেমিক আলোচনায় ‘ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থিয়োরি’ বলে একটা বিষয় আছে। আশির দশকে ইমানুয়েল ওয়ালারস্টেন এই থিয়োরির প্রবক্তা, তিনি বিশ্বকে ব্যাখ্যা করেছেন তিনটি মাত্রায় ভাগ করে। এই তত্ত্বমতে বিশ্ব  কোর কান্ট্রি (ধনী ও উন্নত), সেমি পেরিফেরি কান্ট্রি (উন্নয়নশীল)আর পেরিফেরি কান্ট্রি (অনুন্নত-এই তিন চেহারায় বিরাজমান। পেরিফেরি কান্ট্রি আর সেমি পেরিফেরি কান্ট্রিগুলি কোর কান্ট্রির ওপর অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা ধনী রাষ্ট্রগুলি চিরন্তন করে রেখেছে অর্থনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য। এ-তত্ত্ব না-জেনেও আমরা জানি প্রাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী ধনী রাষ্ট্রগুলি প্রাচ্যের দারিদ্র, মেধা আর শ্রমবাজারকে এক্সপ্লয়েট করে আরও ধনী হচ্ছে। জানি তা চকচকে পশ্চিমা সভ্যতা আর শিল্পায়নের পেছনে স্লেভ ট্রেড এর গল্প,  জাহাজ ভর্তি কৃষ্ণকায় দাসদের অশ্রু, রক্ত, ঘাম ঝরানোর কাহিনি।

সহজ করে  বললে বর্তমান বিশ্বকে আমি একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ হিসেবেই দেখি। আমরা সকলেই সেই গ্রামের বাসিন্দা। যদিও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গ্লোবাল ভিলেজের সাউথও নর্থের অর্থনৈতিক বৈষম্য অতীতে ছিল এখনও আছে। সেই বৈষম্য কমাতে গিয়ে নরথ-সাউথ অথবা সাউথ-সাউথ কোলাবরেশন যতই হোক না কেন অবস্থা তথৈবচ। বিশ্বায়নের ফলে  মুক্তবাজার অর্থনীতি এই অবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক আন্দোলন হিসেবে দেখা দিলেও বিশ্বের ধনী ও দরিদ্র রাষ্ট্রের মধ্যে সমতায়ন সম্ভব হয়নি। বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র এক চতুর্থাংশ বাস করে নর্থে যারা দখল করে আছে পৃথিবীর পাঁচভাগের চারভাগ সম্পদ, অন্যদিকে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার চার ভাগের তিনভাগই বাস করে গ্লোবাল সাউথে যারা ভোগ করে পৃথিবীর মাত্র পাঁচভাগের একভাগ সম্পদ।

বর্তমান বিশ্ব করোনা মহামারীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই অদৃশ্য ভাইরাস পুঁজিবাদী বিশ্বের আসল চেহারা উন্মোচন করেছে। বিশ্ব ১৯৩০-এর গ্রেট ডিপ্রেশনের পর এমন অর্থনৈতিক মন্দা আর দেখেনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নতবিশ্বও করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ধ্বসে পড়েছে, নতুন দরিদ্র আর নতুন বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। পুঁজিবাদ উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে মানবিক বানায় নাই, তাদের ব্যবসা বেড়েছে, অর্থ বেড়েছে, সেই অর্থ রাষ্ট্রগুলো জনস্বাস্থ্যে খরচ করে নাই। ফলে মানুষ মরছে।

করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ কোথাও কোথাও তৃতীয় ওয়েভ চলছে। বলা যায় মহামারী আমাদের মনোজাগতিক দুনিয়ায় চরমভাবে  ছাপ ফেলেছে । কোয়ারেনটিন, লক ডাউন আইসলেশন এইসব নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে সাধারণ মানুষ। জীবনাচার পালটেছে। মহামারী, জীবাণু, জীবাণুনাশক, মাস্ক, কঠোর লকডানের জনশূন্য শহর মেটাফরিকেলি আমার কবিতায় এসেছে। আমার লকডাউন কবিতায় একা নারীর বিবাহ ও পরিবার প্রথায় অভ্যস্ত সমাজে একা থাকাটা লকডাউনে থাকার মত মনে হয়েছে, বিবাহবিচ্ছেদ যেন এমন এক জীবাণু, করোনার জীবাণু থেকে সেটা কম ক্ষতিকারক নয়। বর্তমান ঘটনা আমাকে আক্রান্ত করে, আর কবি যেহেতু ভিনগ্রহ থেকে আসা জনবিচ্ছিন্ন কোনো এলিয়েন নয় তাই বর্তমান ঘটনার ছাপ কবির লেখা্য স্বাভাবিকভাবেই থাকে।

 

শুদ্ধস্বর: কোন সাহিত্য-ফিকশন বা নন-ফিকশন-বা কোন লেখক/লেখকরা আপনার নিজের লেখাকে প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেছেন? কারা এবং কীভাবে?

শেলী নাজ: তখনও আমার কিশোরীকাল, একটু-আধটু লিখি। এক বন্ধু তসলিমা নাসরীনের  প্রথম কবিতার বই নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে পড়তে দিয়েছিল। সে-বই পড়ে ভেতরে এক তুমুল আলোড়ন টের পেলাম। আমার কথাগুলোই কিংবা অসংখ্য নারীর অশ্রু, অবদমন এবং পুরুষের পৃথিবীতে নারীর ক্রমাগত নিপীড়িত, প্রতারিত হওয়ার কথাই তাতে লেখা হয়েছিল। শুধু তাই না, বাঙলা  কবিতায় তিনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নারীর কামের জগতকে সেই ধারা পুরুষাধিপত্যবাদী সাহিত্যে ছিল নতুন। নারী শুধু পুরুষের সম্ভোগের পাত্রী, সেক্স টুল না, নারীর পক্ষেও যে পুরুষসম্ভোগ করা সম্ভব তার ‘বিপরীত খেলা’ কবিতায়  যেভাবে প্রথাগত একটি পুরুষতান্ত্রিক চিত্রকে পরিবর্তন করে উপস্থাপন করেছিলেন, তা অভাবনীয়। অই কবিতায় নারী তার সমাজ নির্ধারিত জেন্ডার রোল ভেঙে দেখা দিয়েছিল নতুন রূপে, নতুন ভূমিকায় ।

তখনও লোরকা-বোদলেয়ার পড়িনি, তখনও সিল্ভিয়া প্লাথের বা এন সেক্সটনের কবিতার জগত আমার কাছে অচেনা।ধীরে ধীরে পাঠের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই অচেনা ভুবনেও পা রাখলাম। আমেরিকান কবি সিলভিয়া প্লাথকে ‘কনফেশনাল পোয়েট’ বলা হলেও তার অনেক কবিতাই আমার মনে হয়েছে নারীবাদী কবিতা। উদাহরণ স্বরূপ তার ‘ড্যাডি’ কবিতার কথা বলা যায়, যেখানে পিতা প্রভু, পুরুষতান্ত্রিক পরিবার প্রথায় যার আসন শিখরে, আর কন্যা তার ছায়াতলে এমনকি শ্বাস নিতেও ভয় পায় আর তাঁকে হত্যা করে প্রবল পুরুষশক্তির কাছ থেকে মুক্তি পেতে চায়। নারীর নিজের জগতের নিগূঢ় উদ্ভাসন ঘটিয়েছেন আরেক কবি এন সেক্সটন (১৯২৮-১৯৭৪) । তাঁর কবিতায় মাস্টারবেশন, এবরশন আর ম্যান্সট্রুয়েশনের বিষয়গুলো এসেছে যা সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল এক বৈপ্লবিক চেষ্টা। সিমোন দ্যা বভয়ারের নন-ফিকশন ‘দ্যা সেকেন্ড সেক্স’ কেইট মিলেটের ‘সেক্সুয়াল পলিটিক্স’ আর ভার্জিনিয়া অলফের ‘অ্যা রুম অফ ওয়ান্সঅউন’  লেখালেখির ক্ষেত্রে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর সর্বোপরি রয়েছে জীবনানন্দ, তাঁর কবিতা আমাকে প্রাণ দেয়, রস দেয়, জীবন দেয়।

 

শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার কবিতাকে আকার দেয়?

শেলী নাজ: ব্যক্তিগত যোগাযোগ কবিতাকে আকার দিতে পারে না। তবে অভিজ্ঞতা অবশ্যই কবিতাকে আকার দেয়। নারী হিসেবে আমার জীবন, একটা প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমার নিত্যদিনের সংঘাত, প্রেম, প্রহেলিকা, অনুশাসন, ধর্ষণভয় আর ধর্মভয় ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে জার্নি তা বর্ণাঢ্য, ঘটনাবহূল, পথের বাঁকে বাঁকে সহস্র পাথরের আঘাত যেমন আছে; তেমনি প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পাহাড় চূড়ো ছোঁয়ার অভিজ্ঞতাও আছে। এসবই আমার কবিতার আকার দেয় । বানিয়ে কখনো লিখতে পারি না। কোনো ঘটনার অভিঘাত যখন চরমভাবে আমাকে ভেঙে ফেলে তখন আমার ভেঙে-যাওয়া প্রতিটি টুকরো কুড়িয়ে এনে কবিতার আকার তৈরি করি ।

 

শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার বক্তব্য উচ্চারণ করতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?

শেলী নাজ: পুরুষবাদী বিশ্বে আমার কবিতার বক্তব্য তৈরি করতে গিয়ে আমাকে হতে হয়েছে কঠোর, আমি সচেতনভাবে ব্যবহার করেছি এমনসব শব্দ-চিত্রকল্প-বিষয় যা পুরুষতন্ত্রকে আঘাত করে। সমাজে বহুবার বহুভাবে ধর্ষিত ও নিপীড়িত নারী, সাহিত্যের ইতিহাসেও ধর্ষিত, নিগৃহীত হয়েছে। পুরুষ নারীর শরীরকেই তার কবিতায়, ভাষায়, চিত্রকলায় শিল্পসৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরেছে যুগ যুগ ধরে, সেই পথ অনুসরণ করে নারীও পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্যভুবনে ব্যবহৃত রূপক ব্যবহার করেছে; ফলে নারী-সাহিত্যিক আর তার সাহিত্যের মধ্যে, নারী-শিল্পী আর তার শিল্পের মধ্যে থাকেনি কোনো দূরত্ব বা বিভেদরেখা। দেরিদা কলমকে শিশ্নের সঙ্গে আর  যোনিচ্ছদকে কাগজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নারী শূন্যপৃষ্ঠা, আর পুরুষ সেই পৃষ্ঠা ভরিয়ে তুলবে অক্ষরে, শিল্পরসে কবিতার সৌন্দর্যে ও বীর্যে; এই  চিন্তা সনাতন, সর্বজনীন।এটি প্রমাণ করে পুরুষ লেখক, শিল্পী আর নারী শিল্পচেতনা তৈরির এক অভূত মাংসপুঞ্জ। সে লিখে না, লিখিত হয়; সৃষ্টি করে না বরং সৃজিত হয়।নারীবাদীরা পিতৃতান্ত্রিক এই সাহিত্যতত্ত্বকে সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন ফিকশন, নন-ফিকশনের মধ্য দিয়ে। আমি কবিতায় ঘটাতে চেয়েছি সেই বিপ্লব যা পুরুষসৃষ্ট শিল্পকাঠামোকে ভাঙার চেষ্টা।তা করতে গিয়ে ‘আবেগাতুর ও গীতিময়’ কবিতার পৃথিবী থেকে সরে গিয়ে তৈরি করেছি নিজের ভাষাপৃথিবী, নিজের স্বর, আঙ্গিক  ও কাঠামো। পুরুষতান্ত্রিক  লিঙ্গবাদকে আক্রমণ করেছি।

আমি মনে করি কবিতার শৃঙ্খলা দরকার।আমার কাছে মনে হয়েছে ভাবের আর ভাষার পরিমিতিবোধকে সুশৃঙ্খল করতে কবিতায় ছন্দের ব্যাবহার জরুরি।মাঝে মাঝে কবিতার ভাব ও ভাষার প্রয়োজনে সেটা অনেক সময় ভেঙেছি।

 

শুদ্ধস্বর: রাজনৈতিক কবিতা এবং  সাধারণ কবিতার মধ্যে সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব এবং সংহতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

শেলী নাজ: রাজনৈতিক কবিতা উচ্চস্বর-বিশিষ্ট, শ্লোগানধর্মী; ফলে তাতে সাহিত্যের শৈল্পিক সৌন্দর্য সৃজনের চেষ্টার চেয়ে বেশি প্রাধান্যপায় কী বার্তা পাঠককে দিতে চাই সেটা। রাজনৈতিক কবিতায় থাকে গণমানুষের চিৎকার কোলাহল, তাতে নেই  নন্দিত নৈঃশব্দ্য, নীরব জোছনাপাত অথবা অবিরল বৃষ্টিধারার শব্দ। সেইসব কবিতায় নাই মেঘদূত, যক্ষের বিরহ অথবা কালিন্দীর কূলে কূলে বেজেওঠা রাধার নূপুর। এতে স্বাভাবিকভাবেই শিল্পকলার মান নিম্নগামী হয়। তবে এটা ঠিক, কবিতায় ব্যক্তি-সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিসবই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে । চর্যাপদ থেকে উদাহরণ দেয়া যাক-

টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী।

হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।

[টিলার ওপর আমার ঘর, আমার কোন প্রতিবেশী নেই।আমার হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ নিত্য অতিথি আসে।]

এই যে এক আর্তের আর্থসামাজিক অবস্থা যার ঘরে ক্ষুধা আছে, নগ্ন দারিদ্র আছ-এই সবই বুর্জোয়া রাজনীতির ফল। শোষণের বিরুদ্ধে শোষিতের হাহাকার মূর্ত হয়ে ওঠা এই কবিতা অবশ্যই রাজনৈতিক। সুভাষ মুখোপাধ্যায়র বিখ্যাত ‘মে-দিবসের কবিতা’ পড়া যাক-

প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য

ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,

চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য

কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।

প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য

কোনোভাবেই এই কবিতার শিল্পসৌন্দর্যের কমতি নেই। সাহিত্য ও জীবনবোধের সঙ্গে এখানে কোনো সংঘর্ষ দেখিনা, বরং রয়েছে চমৎকার সংহতি। রাজনৈতিক কবিতায় শিল্পবোধ সৃষ্টি করা একটু কঠিন, কেউ কেউ তা সফলভাবে করতে পারেন।

 

শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতা কি জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে বলে আপনার ধারণা? এটি অন্যান্য জাতীয়তা বা ভাষাগোষ্ঠীর কাছে আবেদন রাখতে পারে বলে কি আপনার মনে হয়? তাহলে কীভাবে?

শেলী নাজ: কবিতা স্থানিকভাবে সৃষ্ট হলেও তা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে, তা আঞ্চলিক থেকে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারে। ভাষার বাধা ছাড়া বিশ্বমহলে আদৃত হওয়ার জন্য কবিতার আর কোনো বাধা নেই। বস্তু  স্থির হলেও ভাব গতিশীল, তা সংক্রমিত হতে পারে অন্য জাতিসত্তার হৃদয়ে যদি তা হয় হৃদয়স্পর্শী। আমার কবিতার প্রেক্ষাপট পুরুষের পৃথিবীতে লৈঙ্গিক রাজনীতির শিকার নারী, তার অধঃস্থিত, নিপীড়িত ও অবদমিত অবস্থা, যা ঐতিহাসিক আর নারীর নিয়তি বলে ধরে নেওয়া হয়। প্রাচ্য আর প্রাশ্চাত্য উভয় দুনিয়াতেই নারীর অবস্থা কমবেশি একইরকম। সর্বত্রই নারী পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার। ফলে আমার কবিতার ভাব ও বিষয় জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক, পূবের নারীর রক্তমাংসপ্রেম পশ্চিমের নারীর চেয়ে আলাদা না, প্রেমের ভাষা একই, পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তের নারীর অশ্রু ও আগুনের রংও একইরকম,  তাই তা সহজেই জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে অন্য ভাষাগোষ্ঠীর কাছেও অবদান রাখতে পারবে বলে মনে হয়, যদি তা ভাষান্তরিত হয় ।

 

শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন কবিতার সংক্রাম দিয়ে মানুষের ইতিহাস পালটানো সম্ভব? আপনার জবাবের পক্ষে বলুন।

শেলী নাজ: ‘If you want to change the world’s spirit, I will suggest that only poetry can do this.’_Andrei Voznesensky, a Russian rock-star poet

কবিতার ‘ইথিকাল পাওয়ার’ শিল্পের অন্য যে-কোনো শাখার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী । কবিতা যেমন ইতিহাসের রক্ত ও সংঘর্ষের প্রামাণ্য দলিল হয়ে উঠতে পারে, তেমনি  মানুষের ভাষা এবং ইতিহাস  দুইই পালটে দিতেও পারে। সারাবিশ্বে স্পোকেন ওয়ার্ড বা  পারফর্মেন্স পোয়েট্রি সিভিল সোসাইটি মবিলাইজেশনে  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কবির জীবনের ইতিহাস এবং সে যে ভাষাভূমিতে বাস করে তার ইতিহাস পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিধায় কবির কলম সেই রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের গান যেমন লিখে, তেমনি ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি পালটে দিতে বৃহত্তর মানবসমাজের মধ্যে সাম্যতা, এম্পাথি তৈরি করতে সাহায্য করে। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’-শ্লোগান বুকে এঁকে স্বৈরাচারের গুলিতে জীবনদান করেছিলেন কোনো এক অখ্যাত নূর হোসেন, তারপর তিনিইতিহাস হয়ে যান আর  বাংলাদেশের কবি শামসুর রাহমান সেই বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন ‘বুক তার বাংলাদেশেরহৃদয়’; কবিতায় চিত্রিত করেছিলেন গণতন্ত্রকামী মানুষের আবেগ ও বিদ্রোহ, অই কবিতা হয়ে উঠেছিল ইতিহাসের অংশ। একশ বছর আগে উনিশ শতকের নারীবাদী লেখক, কবি Charlotte Perkins Gilman লিখেছিলেন শতাব্দীর অন্যতম উদ্দীপনাময় লাইন তার As We Women কবিতায়, ‘We, as women’/are coming to change the world,’-এই কবিতার শক্তি উজ্জীবিত অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল নারীদের ভোটাধিকারের আন্দোলন ‘The Women’s Suffrage Movement’-কে। ব্ল্যাক পোয়েট্রি এন্থলজি ‘The New Negro’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে রেসিজম আর কালো-সাদার বৈষম্যের রাজনীতির বিরুদ্ধে আমেরিকার কালো মানুষকে সংগঠিত করতে। তাই কবিতা একাধারে ইতিহাসের ধারক এবং ইতিহাসের নতুন পথ পাথর খুঁড়ে তৈরি করে দেয়।

____________________________________

 

 কবিতা

 

 

প্রতিশোধ

তোমার বুটের তলে পৃথিবীর দমবন্ধ গ্রীবা

নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে, ছটফট করছে অরণ্য

জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে দর্পভরা কুচকাওয়াজে

স্তব্ধ পাখোয়াজ, মাঠে মৃত তৃণ, শস্যের দাক্ষিণ্য

ভুলে আজ তোমার বন্দুক তাক করা বনদেবীর মস্তকে

রাত্রির পশম-ঢাকা কুমারীপ্রকৃতির স্তনে, ছুটছে ফিনকি দিয়ে রক্ত আর দুধ

তাতে তৃপ্ত হচ্ছে তোমাদের জঠর ও তৃষ্ণা, কুসুমমঞ্জরি পায়ে দলে চলে গেছ

ধর্ষিতা অরণ্যযোনি ধুয়ে দিয়ে গেছে রাতভর বৃষ্টি

 

তোমার রাক্ষুসে ক্ষুধা, জন্মাবধি খেয়েই চলেছ

বিল, ঝিল, গ্রাম, পক্ষিণীর মাংস, নদীর পাঁজর

ঢেউ মুছে গেছে, জেগে আছে জলে ঘর্ঘর ইঞ্জিন

পানকৌড়ির বুক ভেদ করে চলে গেছে তোমাদের গুলি

নিজেরই খুলি ভরে পান কর রক্তমাখা জল, তোমার কুঠার

চিরে ফেলেছে পুস্পসম্ভবা গাছ আর বসন্তের মন,

কারখানার বর্জ্যে, তেলে ও গরলে মরে যাচ্ছে মাছ,  তুমি লোভী, খুনি

তোমাদের লুণ্ঠনের নিচে তবু দুয়েকটি জোনাকি জ্বেলে রেখেছে লন্ঠন

 

তোমার বুটের তলে নিঃশ্বাস আটকে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত

মনে আছে হরিণীর, নিসর্গ রেখেছে মনে তার ফুসফুসে আগুন লাগানো

বুটের তলায় পিষ্ট হতে হতে প্রতিশোধ স্পৃহায় জেগেছে সবুজাভ বনভূমি

ছড়িয়েছে পৃথিবীর প্রতিপ্রান্তে জীবাণুপুস্পের রেণু, বেণুবনে

ক্ষমতার চুড়োয় বসেও আজ শ্বাসবদ্ধ হয়ে মরে যাচ্ছ তুমি!

 

 

করোনাকালে, পুরুষের প্রতি

করোনা পৃথিবী দখলের আগে অশ্লীল বলাৎকারে

তোমরা দখল করেছিলে আমার পৃথিবী, সামান্য ঝিনুক

সমরাস্ত্রহীন, ক্ষুদ্র এ-দুনিয়া ঠেসে ধরেছিল তোমাদের গোঁয়ার্তুমি

চুম্বনের নামে শ্বাসনালীতে অনল, লালাবিষ, ছিল উৎসুক

যে বসন্ত, সমবেত সংক্রমণে মৃত তার কুচফুল, দেহভর্তি মীন

 

সমস্ত উড়াল মুছে আকাশ দেখেছি মৃত্যুঅবসরে

শরীরের  রন্ধ্র বন্ধ, জেটি ও জাহাজ স্থির, রানওয়ে ছুঁয়ে

নামেনি দূরের তারা, রাত্রিতে কবন্ধ দেহজুড়ে

ক্রুর বেহালার ছড় গান নয়, এনেছিল জ্বর

 

মৃত্যুর ভ্রূকুটি দেখে রণনীতি ফেলে, জীবাণুর

মধু, ক্ষার ও লবণ ভালোবেসে, লুফে নিয়েছি এ-গৃহকোণ

তোমার মুঠোয়উদ্গমহীন, নির্বায়ু আমার পৃথিবী

সেই থেকে আমারও শ্বাসকষ্ট, তীব্র জ্বর ও মর্মবেদন

 

আত্মনির্বাসন মেনে তবু থেকে গেছি তোমার থাবায়,

করোনা পৃথিবী দখলের পর, তোমরা ফিরেছ জতুগৃহে

গৃহে তোমাদের হাঁসফাঁস, যেন হায় আছ গিলোটিনে

 

অথচ আমি তো জন্মাবধি আছি শেষহীন এ-কোয়ারেন্টিনে !

 

 

লকডাউন

বিবাহবিচ্ছেদের জীবাণু সংক্রমণের পর

এগার বছর ধরে বাড়িটি লকডাউনে, বাহিরে উড়ছে লাল ফ্ল্যাগ

ধুকপুক বুকে কতোটা মধু ও ধুতুরার বিষ, কতোটা অসুখ

দেখতে বাড়িটি ঘিরে জমে ওঠে উৎসুক,বিবাহিতের উদ্বেগ

পুরুষের ভিড়, গনগনে লোভ, আমাকে আরও বেশি

অচ্ছুৎ, অসতী আর একা করে তুলতে তারা

গলিতে বসায় রাত্রিচর কামুকের পাহারা

 

তোমাদের ধর্ষকাম প্রেমের জীবাণু থেকে বাঁচতে

হৃদয়ও গেছে জরুরি লকডাউনে,  বহুদিন জ্বর

আছি গর্তে মৃতবৎ, শিরদাঁড়া দুহাতে কুড়িয়ে, নিঝুম

ভাঙ্গা দেহে ফিরি, নিচু ছাদ, লৌহগরাদ, তাতে ফুটে থাকে

বিবাহউদ্যান থেকে বিচ্যুত নগ্নতাশোভিত কুসুম

আত্মঅবদমনের আংরাখা পরে হাসি,চোদ্দোশিকের ভেতর

একাকী স্বৈরিণী, তার সোনালি মুখোশ ভেঙে দেয় তোমাদের যৌথঘুম

 

মেঘের পাথর-ফেটে-বৃষ্টি এলে আড়ষ্ট গন্ধম ফাটে, একা লাগে

দেহভরতি দাহ্যকাঠ, তাতে ধুপগন্ধে জড়ানো গাউন

একার সিংহাসনে বসে দেখি, তোমরাও একা হচ্ছ খুব, পরস্পর

আর তোমাদের শহরে অচেনা অসুখ, লকডাউন!

স্বাধীন ডানা

 

 

 

করোনাবিধুর দিনে

হে বিপুলা পৃথিবীর ধিকিধিকি জলাশয়

তোমাদের গায়ে পেট্রল ঢেলেছি, ক্ষমা করো

 

কুঠারে কর্তিত করে অরণ্যের হাত পা, তার পেটে

তাঁবু গেড়ে রাত্রিভর খেয়েছি হরিণের ঝলসানো মাংস, মদ

ভেঙেছিপাখির ডিম, কত তুচ্ছ  নিষ্ঠুর উল্লাসে

ক্ষমা করো পাখিমাতা, আমাদের সহিংস্র প্রমোদ

 

উর্বশী বাঘিনী, আমি সে নিষাদী, শিকারের পর

তোমার চামড়া দিয়ে বানিয়েছি জুতো, হে উদার

নির্মল বাতাস তোমাকেও ভরে তুলেছি সীসায়,

চিমনির ধোঁয়ায়, মায়ের চোখের মতো শান্ত পুকুর ভরাট করে

গড়েছি প্রহ্লাদ-নগর, জলহীন, জ্বর হলে তাই পাব না কখনো জলপটি

 

নিসর্গের হন্তারক আমি, পাতার ঘাগরার নিচে লুকিয়ে রেখেছি গ্রেনেড

উড়িয়ে দিয়েছি টিলা, অতিথি পাখির গলা কেটে নিতে

ধারালো করছি ব্লেড,  হে গর্ভবতী হস্তিনী, আমি কৌশলে

তোমার ভেতরে চালান করেছি বোমা,

 

হে অরণ্য, ঘাসফুল, হস্তিনী ও জলাশয়

পাষণ্ড মানুষ আমি, করোনাবিধুর দিনে, পাব তোমাদের ক্ষমা?

 

 

 

ঘরে ফেরা 

তোমাদের ট্রেন কররেখা ছুঁয়ে দূরে চলে গেছে

আমি তার গভীর জানালা থেকে হারানো সে মুখ

 

বোমারু বিমান, যুদ্ধ, সাইরেন ফিরেছে শিবিরে

ফিরে গেছে আস্তাবলে রাগী অশ্ব, সহিসের গান

সরাইখানার হট্টগোল বুকে ফিরেছে মাতাল

ঘৃণার বারুদ-ঠাসা মারণশাস্ত্র ভুলেছে শত্রুর কামান

 

যে কুসুম ট্যাবু ও টোটেমে বিদ্ধ হয়ে

একতিল বাঁচবার লোভে হয়েছে ফেরারি, এশিয়ার

মেঘ ও মল্লার ফেলে চলে গেছে বিদেশপাথারে

সে-ই আজ মৃত্যুচক্রে, মাস্কপরা মৃতের শহরে

 

এত যে থাকতে বল ঘরে স্থির, শান্ত ও সন্ত্রস্ত

সে কোথায় যাবে, বহুদিন নিরাশ্রিত প্রেমহীন,

নিজেকে ছত্রখান করে ছড়িয়েছে যত্রতত্র

ঘোরের কবলে পড়ে ঘর ছেড়ে হয়েছে ভিখিরি

 

পড়ে আছি পথে, খড়বিচালিতে, শহরে নতুন শরণার্থী

সে শুধু চিনেছে ঘরহীন পথ পরিত্রাণহীন মরণবীথি

 

 

সাদাদের দেশে কালো মেয়ে

একটা নতুন জন্ম পরে আছে শ্রমিকের কালো শার্ট

ছেড়া তাঁবু থেকে বের হয়, স্বল্প নিদ্রা থেকে বের হয়

জিরো ডিগ্রি ঠান্ডার চাদর ফুঁড়ে কালো কুচকুচে ভোর

কালো জুতো ছুটছে কারখানায়, জীবন দিয়েছে কালো মণিহার

ঝুলানো লকেট, অপমানখচিত মুক্তোর

 

ঝিনুকের খোলসের নিচে লুকিয়ে কালো জলের কালিন্দি

অবিরাম গিলে ফেল বালি, তোমার তৃষ্ণাকে ঘিরে আছে বালিয়াড়ি

ভুলে গেছ বারো হাত বালুচরি শাড়ি,

কালো ভোর, কালো স্কার্ট, কালো বুট, কালচে ওভারকোট

তার নিচে জ্বলছে একটা দাসখত,

কালো কফি অন দ্যা গো

কলোনিয়াল আকাশে কখনও কি চাঁদ উঠত?

 

ওহে মোর এশিয়ান মন জাগো জাগো

ভাঙো নিজ হাড়, সেই হাড়ে গড়ো সাঁকো আজ

দু-মহাদেশে পড়ে-থাকা তোমার ছিন্ন দু-জীবনের মধ্যে

বাজাও কিঙ্কিণী, যেন নিজেকে আমার না-ভুলি,

যেন নিজেরে এশিয়া বলে চিনি!

 

 

অগ্নি সিরিজ

ও সজনি ও রাধিকা খুলে রাখি

আমি, তুই ও আমরা, আগুনের নীল প্রহেলিকা

শরীরে আগুন নিয়ে কালো সাদা রূপে জন্মাই আমরা

আমি, তুমি ও সজনি ও রাধিকা

 

এক্সোটিক এশিয়ার জঙ্গলে বেড়েছি বুনো ফুল

আদিম অর্কিড, পার্পল ঠোঁটের শিখা,

আমি জ্বালাই কথার অগ্নিশ্রেণি, ঠিকানাহারা মাস্তুল

ভাঙা-জাহাজের হারানো কম্পাস, আমার জিভের নিচে আগুন

 

স্ট্রিপ ক্লাবে যে-মেয়েটি এখন নগ্ন নৃত্যরত

যে-মেয়েটি ব্লো-পাইপ জবে কান্না ও আগুন গিলতে গিলতে

উগড়ে দিয়েছে বমি

যে-মেয়েটি ধর্ষণের লজ্জা নিয়ে, গর্ভে অগ্নিবীজ নিয়ে অগ্নিউপদ্রুত কূলে

পুরুষসংকুল

বার উপচানো অগ্নি থেকে এইমাত্র যে-মেয়েটি

ককেশাস পুরুষের কাঁধে মাথা রেখে খেতে এল

বেকন ও ফিস অ্যান্ড চিপস

 

আমরা সকলে একই রকম বিক্রি হই পৃথিবীর বাজারে

মোহ ও মুদ্রার কাছে, স্বপ্ন দেখি ঘরের, মায়ার

আমাদের চারপাশে ব্ল্যাক হোল আর ফাঁদ

মাংসাশী সিটিতে বিক্রি হচ্ছে

আমাদের গরিমা ও চাঁদ

 

সাদা, কালো, বাদামি ত্বকের সোনালি, সবুজ, ম্যাজেন্টা চুলের

 

ভেতরে কফিন, তাতে শুয়ে আছে আরেকটা আমি, অস্থিচর্মসার

আমরা সকলে বহন করছি একই রকম বুভুক্ষু হৃদয়

একই রকম অগ্নিশ্রেণি, শ্রেণিহীন প্রেমের ক্ষুধার!

 

 

পোতাশ্রয়

 তবে কি আশ্রয় পেতেছে বেলাভূমি

যদিও তাড়নার নীলাভ দরজায়

ঝিনুক অপাঠ্য বাজায় ঝুমঝুমি

হাওয়া শনশন, কাড়া ও নাকাড়ায়

 

সোনার আংটায় আমার ধরিত্রী

জাগছে একফোঁটা, ওটা কি মাস্তুল?

এই তো ছেঁড়া জুতো, পেরেক রাত্রির

ঠুকছে চাঁদটাকে, গলায় বিষফুল

 

বইছে গলগল রক্তে বঞ্চনা

মুচড়ে ওঠে ব্যথা, ভাসাই সমুদ্রে

ভেবেছি সাদা ফেনা ঢাকবে কারখানা

যেখানে চুল্লিতে খতের উদ্রেক

 

যদিও লুণ্ঠিত ওগো পোতাশ্রয়

যদি সে আশ্লেষে আঁকড়ে ধরে লতা

ভাঙা জাহাজের সারাবে কি হৃদয়?

 

 

তিলোত্তমা নগরী  

রাষ্ট্রকাঠামোয় সুস্বীকৃত ছিল বেশ্যাদের গ্রাম

ফরসা নগরীর চিবুকে কৃষ্ণতিলের মতো ছিল বনিতারা

তোমাদের যৌবন ও শরীরের বর্জ্য, ভাষা, দম্ভ

ধারণ করেছে যারা বহু বন্দরের অভিজ্ঞতা

তাদের সহস্র ভাঁজে, কোমল গান্ধারে, গরিমায়

 

তাদের মদিরা লাগে হোমাগ্নিতে, তোমার সেবায়

ভাসমান, যত্রতত্র ঘোরে, এঁটো হয় রাজপথে

ভবঘুরে আগুনেরা, বিপজ্জনক এ-মাংস, অস্থি

জ্বলন্ত কয়লারাশি, ঢাকা থাকে প্রমোদপল্লিতে

পুরুষের প্রয়োজনে তৈরি এই নির্গমন নালা

 

সমাজপতিরা চায় ভ্রাম্যমাণ কামনার চিহ্ন

অশোকের ছায়া, আদিম কুয়োর জল, কামমুক্তি

তাই তিলোত্তমা নগরীতে মঠ ও গির্জার সাথে

গড়ে ওঠে বেশ্যালয়, ধর্মসংগীতের উলটোদিকে

 

সিটি করপোরেশনের ময়লা পরিষ্কারক যান

তুলে নেয় বর্জ্যরাশি, শহরকে ঠিকঠাক রাখে

স্বীকৃত অসতী, রসদ যোগায় পরপুরুষের

তাদের নিয়েই তৈরি তিলোত্তমা মেট্রোপলিটান

 

 

পাখি

যে-পাখি উড়াল দিল তার পালকে পালকে ছিল দাসখত

উৎপীড়নের দাগ, ছিল ক্ষত সঙ্গমসম্মত

 

মহাজগতিক নীল, সোনার খাঁচায় থেকে চিনেছে অল্পই

তূণীর ও তীরন্দাজ, চারিপার্শ্বে নিষাদপ্রকল্প

 

ভূলোক গোলকধাঁধা, অস্ফুট বাতাস তার বুক চেপে ধরে

ডানায় বোমারুমেঘ, অভিশাপ রাশি ঈশ্বরের

 

উত্তরে যাবে না উড়বে দক্ষিণে, ডানায় সমুদ্রের শিস এসে লাগে

অপমান, হলাহল, চূর্ণ মন গুছিয়েছে লাগেজ

 

পাখি ঝাঁপ দেয় একা, জ্বলন্ত কড়াই থেকে দীর্ঘ অগ্নিকুণ্ডে

লুপ্তস্বর, গরাদের গাঢ় ছায়া, শাস্তি বিনাদণ্ডে

 

পুড়েছে অরূপ পাখা, রক্ত ও উজ্জ্বল ক্ষত, সুন্দর একাকী

শেকলের দাগ পায়ে সীমা ছেড়ে উড়ে যায় কুলভাঙা পাখি!

 

 

গণধর্ষণের পর   

 ঝড়ে ও বর্ষণে ধর্ষিতা অরণ্য জানে কীভাবে ঝরাতে হয় ছিন্ন পাতা

আমিও ঝরাব চুম্বনের দাগ-লাগা চামড়া আমার

ফুটপাতে উরু বেয়ে নামবে রক্তের স্রোত, তাতে দেবো বাঁধ

লিখব নতুন করে রাক্ষসের পিঠে ধুলো-ওড়া সন্ধ্যার কবিতা

দাঁতেই কাটব নিষাদ-নগরে পেতে-রাখা জাল

ফাঁদব সেসব পঙক্তি, যারা অপঠিত, শুভ্র আর সতী

 

গণধর্ষণের পর জেগে ওঠা শরীরের মৃত্যু চিৎকার

বেদনাপ্রুফ ত্রিপালে ঢেকে দিয়ে

দু-চামচ তীব্র জীবনের ফোঁটা বিষকুম্ভে মেশাচ্ছি আবার।

 

 

তুমি ভালো নেই, বাংলাদেশ

সমস্ত কুসুম ভরে জেগে আছে মৌলবাদী মধু

মশলাবাগানে কেউ পুঁতে রেখেছে গ্রেনেড

সীসাভরতি হয়ে ফুলে আছে বাতাসের জার

চুপকথা ঠোঁটে আর শিরাগুলি কেটে দিচ্ছে ব্লেড

 

তোমার অশ্রু ও রক্ত পান করে হাসছে জল্লাদ

বাইজিনাচন শেষে ক্লান্ত তুমি প্রমোদ-বজরায়

গণধর্ষণের পর, লিঙ্গবাদী বল্লম তোমাকে

সহস্র টুকরো করে রেখে গেছে বিষের জলায়

 

তোমার যোনির মধ্যে ঢুকে গেছে হার্মাদের নখ

তোমার ত্বকের নিচে জ্বলছে না রত্ন, অভ্রখনি

মাথার ওপর ছাদ নেই আছে ভেঙে পড়া চাঁদ

বিক্ষত শরীরে ছুটে যাচ্ছ গুলি-খাওয়া বাঘিনী

 

তোমার গভীর অসুখ, কবি আছে, কবিরাজ নেই

তুমি ভালো নেই বাংলাদেশ, আমিও তো ভালো নেই!

 

 

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!