জুলহাজ মান্নান আর মাহবুব রাব্বি তনয়ের হত্যাবার্ষিকী আর কিছুদিন পরেই। ২৫শে এপ্রিল। ভাবছিলাম এই দিবসটিতে ঘিরে কিছু করবো কিনা। কিছু করা উচিত হবে কিনা, কিছু করা আদৌ সম্ভব কিনা।
দু’জন মানুষ তাদের আদর্শের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ দিয়ে দিলো, তাদের স্মরণে কিছু একটা করাই তো সমুচিন। শোক সভা? ফেইসবুক লাইভ? টক শো? হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধন? প্রেস কনফারেন্স? ওদের জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো সবই সম্ভব হতো। অন্য যে কেউ। ঘুষখোর, খুনি, মাতাল, নেশাখোর, ধর্ষক … জীবদ্দশায় যাই করুক না কেন মরে গেলে সাধু আর বাকি সবাই তাদের মুরিদ। কিন্তু জুলহাজ আর তনয় তো সমকামী ছিল। সমকামীদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করত। সুতরাং তারা নরকের নিকৃষ্ট কীটের চাইতেও অধম এবং তাদের স্মরণ করা মানে সেই পাপকে নিজের গায়ে মাখানো।
আর আমরা সমকামীরা কি পাগল নাকি? এমন বিতর্কিত ব্যক্তিদের লাশ নিয়ে টানাটানি করলে তো নিজেরাই লাশ হয়ে যাবো। প্রশ্নই আসে না কোন সভা সমিতি করার। কোন বিচার চাওয়ার। যেখানে কোন মানবাধিকার সংগঠন কিছু বলছে না, জুলহাজ-তনয় এর পরিবার কিছু বলছে না, জুলহাজের কর্মস্থল আমেরিকান এমব্যাসি কিছু বলছে না, সেখানে আমরা কোন ছাড়! আর তার চাইতে বড় কথা আমরা চাইলেও কিছু করতে পারবো কিনা। সরকার আর সমাজ কি আমাদের করতে দিবে কিছু?
কদিন আগে এক ব্যক্তি গিয়েছিলেন প্রেসক্লাবের সামনে ব্যানার নিয়ে। পুলিশ তাকে দাঁড়াতে দেয়নি। পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল এক পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞার কারণে সমকামিতা সম্পর্কিত কোন কিছু নিয়ে কথা বলছে না। কিছুদিন আগে এক পত্রিকাতে একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম। ছাপায়নি। বলেছে উপর মহলের না আছে। জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা কয়েকটা মিটিং করেছে চার দেয়ালের মাঝে। কিন্তু প্রকাশ্যে তারা কিছু বলতে নারাজ। অনেকেই ই-মেইল করেন, ফেইসবুকে ম্যাসেজ পাঠান সহমর্মিতা জানিয়ে কিন্তু তারাও কোন অবস্থান নিতে পারছেন না।
আমরা বুঝি আমাদের সবারই অদৃশ্য এক শৃঙ্খলে হাত-পা বাঁধা। জানা-অজানা ভয়, শঙ্কা, চক্ষুলজ্জা, বিধি-নিষেধ আমাদের তাড়া করে। হাজার চাইলেও কিছু করতে না পারার অসহায়ত্ব, নিজের বিবেক আর অনুভূতির সাথে বিরামহীন লড়াই, নিজের পরিচয় লুকিয়ে মিথ্যার বেসাতি দিয়ে গড়া জীবন। চাপাতির কোপের চাইতেও এই শৃঙ্খল যেন অনেক বেশি বেদনাদায়ক, অনেক বেশি যন্ত্রনাময়।
জুলহাজ আর তনয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছিল যে বাংলাদেশেও সমকামীরা আছে আর তারা ধীরে ধীরে সংগঠিত হচ্ছে। অবাক হওয়া স্বাভাবিক। অন্যান্য উন্নত দেশের মতো সমকামিতা তো অতোটা প্রকাশ্য নয় বাংলাদেশে। এমন বহুবার ঘটেছে আমাকে এসে কেউ বলেছে যে তার জীবনে দেখা আমিই প্রথম সমকামী!
২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকারও একই কথা বলেছিল। জাতিসংঘে যখন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হয়, তখন বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র সুপারিশ করেছিল আইনের ৩৭৭ ধারা বাতিল করতে এবং সমকামীদের মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে। আর তার প্রেক্ষিতে সরকার বলেছিল বাংলাদেশে কোন সমকামী নেই কারণ বাংলাদেশ একটি রক্ষণশীল, প্রথাগত মুসলিম প্রধান দেশ। বলেছিল এই সুপারিশগুলো বেমানান কারণ কোন দল বা গোষ্ঠী এই নিয়ে দেশে কোন আওয়াজ তুলেনি। মিটিং শেষে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় ভীষণ কেতাদুরস্ত এক সরকারি আমলা আমাকে বলেছিলেন, আপনারা কেন এসব ‘controversial issue’ নিয়ে এখানে আসেন, দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার তো দেশেই মিটমাট করা ভালো।
আমাকে প্রায়ই জিগ্যেস করা হয় বাংলাদেশে সমকামীদের সংখ্যা কতো। ভালো মনেই অনেকে প্রশ্ন করেন। যখন বলি যে এই সংখ্যা আমার অজানা তখন হয়তো অনেকেই মনে মনে অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু সংখ্যার এই রাজনীতি খুবই বিপদজনক। যদি আমরা সংখ্যায় বেশি হই তাহলে কি আমাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া হবে? ঠিক কতজন হলে আমরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হবো? মানুষকে, মানুষের অধিকারকে সংখ্যায় নিরূপণের এই চক্রান্ত কার স্বার্থ হাসিলের জন্য? বাংলাদেশে যদি নিদেনপক্ষে একজন সমকামী থাকেন, একজন আদিবাসি থাকেন, একজন দলিত বা একজন হিন্দু থাকেন তারপরেও সরকারের উচিত সেই একজনের অধিকার সমুন্নত রাখা। কারণ আমাদের সংবিধান তাই বলে।
আর যদি সংখ্যার এই রাজনীতি শুরু করি তাহলে বলতে হয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণায় দেখা গেছে কোন দেশের জনসংখ্যার ৫-১০% সমকামী হয়ে থাকে। আমাদের জনসংখ্যা যদি ১৬ কোটি হয় তাহলে ভাবুন সমকামীদের সংখ্যা কতো! সমকামীরা আছেন সবখানে। আপনার বাসায়, আপনার অফিসে, রাস্তায়, শপিংমলে, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, পাহাড়ে, সমতলে, বঙ্গভবনে, জাতীয় সংসদে। অনেকে প্রকাশ্যে, অনেকে গোপনে। আমরা দেখি না। রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় দেখার সেই চোখ আমাদের তৈরি হয়নি। আর তার উপর আছে আমাদের কপটতা। আমরা সবাই আমাদের জগতে উটপাখি।
আমরা চাই আমাদের অস্তিত্ব জানান দিতে। কারণ পরিবার ও সমাজের গ্রহণযোগ্যতাই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু যখন পরিবার আমাদের করে ত্যাজ্য, আইন করে অপরাধী আর ধর্ম বলে পাপিষ্ঠ তখন আমাদের এই অস্তিত্ব হয়ে ওঠে এক বিরাট দায়বদ্ধতা। প্রকাশ্যে আসার পরিণতি কি তা তো জুলহাজ আর তনয় তাদের জীবন দিয়েই প্রমাণ করে গেলো।
এ এক ভয়ংকর দুষ্টচক্র। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় “politics of visibility” বা দৃষ্টিগ্রাহ্যতার রাজনীতি। সকল সংখ্যালঘুদের জন্যই এটা প্রযোজ্য কিন্তু অধিকাংশ সমকামিদের যেহেতু বাহ্যিক কোন নিদর্শন নেই তাই তাদের জন্য যেন ‘come out’ করা ফরজ। কে তার যৌন পরিচয় প্রকাশ করবে আর কে করবে না সেটা একান্তই সেই ব্যক্তির ব্যাপার। এর সাথে জড়িয়ে আছে তার আত্মস্বীকৃতি, শিক্ষাগত উৎকর্ষতা, সামাজিক অবস্থান ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রভাবিত করার ক্ষমতা। কিন্তু মোটা দাগে বলতে গেলে আমরা সমকামীরা আমাদের চেহারা দেখাতে চাই না কারণ ফলাফল। ঘৃণা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, বর্বরতা, হিংস্রতা, নৃশংসতা এগুলোর পেছনে আছে সমকামিতা নিয়ে মানুষের অজানা ভয়, অজ্ঞতা, ধর্মীয় কুসংস্কার আর পুরুষতান্ত্রিকতা। আমরা নিরুৎসাহিত হই। হয়ে যাই আরও নিভৃতচারী। আর প্রকারান্তরে আমাদের লুকিয়ে থাকা এই অজ্ঞতাকে আরও উসকে দেয়।
সবাই বলে ‘closet’ থেকে বের হও, লোকজন জানুক, দেখুক, তারপর একদিন গ্রহণ করে নিবে। কিন্তু এই যে ক্লজেট বা আলমিরা সেটা কিসের এবং কাদের তৈরি সেটা নিয়ে কথা হয় না। সবার আগে ত এই আলমিরা হটাতে হবে। এবং সেটা করার দায়িত্ব একা সমকামিদের নয়। শুরুটা করতে হবে পরিবারকে। আধুনিক শিক্ষায় নিজেদের শিক্ষিত করতে হবে। তারপর হয়ত আমরা বুঝতে পারবো বাংলাদেশে সমকামী আছে কি না সেই আলোচনা মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, যৌন পরিচয় ইত্যাদি নির্বিশেষে সমান অধিকার ভোগ করছে কিনা সেটা নিশ্চিত করা।
২০০৯ সালে যখন সরকার বলেছিল দেশে কোন সমকামী নেই তারপর থেকে আমাদের চেষ্টা ছিল এর পরেরবার যেন একই কথা না বলে। আমরা অনেক দৌড়ঝাপ করেছি এর পরের চার বছর। ২০১৩ সালে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হোল জাতিসংঘে। এবারও সুপারিশ এসেছিল সমকামীদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বন্ধ করার। কিন্তু এবার সরকার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সমকামীদের অস্তিত্ব মেনে নিলো বটে তবে সাথে এও বলল আইন থাকবে আইনের জায়গায়। তার মানে সমকামীরা আইনের চোখে অপরাধী সেটার কোন হেরফের হবে না। কিন্তু কোন আইনের কথা বলছে সরকার?
বাংলাদেশ ফৌজদারি দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারা তো আমাদের নিজেদের বানানো কোন আইন নয়। ১৮৬০ সালে ভিক্টোরিয়ান ব্রিটিশ শাসকদের তৈরি এই আইন উপমহাদেশে আমদানি করা হয়। ৩৭৭ ধারা ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌন ক্রিয়ার’-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং সেখানে সরাসরি সমকামিতা নিয়ে কিছু বলা নেই। কোন যৌন আচরণ প্রকৃতিসুদ্ধ আর কোনটা নয় সেটা নির্ধারণ করা রাষ্ট্রের কাজ নয়। বিজ্ঞান অনেক আগেই প্রমাণ করে দিয়েছে সমকামিতা সম্পুর্ণ স্বাভাবিক। আমাদের পূর্বপুরুষরা ইংরেজ তাড়িয়েছে বটে কিন্তু তাদের ফেলে যাওয়া যুগের সাথে অসামঞ্জস্য কিছু আইন এখনও আকঁড়ে আছি আমরা। যদিও এই আইনে এখন পর্যন্ত কোন সমকামী ব্যক্তির সাজা হয়নি, কিন্তু যদ্দিন এটা থাকবে ততদিন আমরা অপরাধী হয়েই থাকবো। আর যেভাবে উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এই আইনের প্রয়োগ দাবি করছে তাতে খুব শীঘ্রই হয়ত আমাদের কারও যাবজ্জীবন হয়ে যাবে।
গত বছর যখন উগ্রপন্থী ইসলামী জঙ্গিদের হাতে খুন হোল আমাদের বন্ধুরা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বানী দিলেন যে খুন করা ভালো নয়, কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু উনি মেনে নিবেন না। কি যায় ধর্মের বিরুদ্ধে? সমকামিতা। আর কোনটা যায় ধর্মের পক্ষে? সমকামীদের খুন করা। তাহলে উনি কোনটা মেনে নিলেন? মদিনার সনদের রক্ষক বলে কথা! কিন্তু সমকামিতার ব্যাপারে ইসলাম ধর্মের অবস্থান নিয়েও রয়েছে বিস্তর মতভেদ এবং ব্যাখ্যা। অনেক প্রগতিশীল ইসলামিক পন্ডিতদের মতে ইসলাম সমকামী ভালোবাসার পক্ষে।
আমাদের সংগ্রাম আমাদের অস্তিত্বের মতোই সুপ্রাচীন। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে গত ১০০ বছরে এই আন্দোলনের একটি স্বরূপ তৈরি হয়েছে। হয়েছে যৌনতা আর লিঙ্গ নিয়ে বিস্তর গবেষণা, মূল্যায়ন আর আন্দোলন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় অন্য যে কোন সামাজিক আন্দোলনের তুলনায় LGBT আন্দোলন এগিয়েছে সবচেয়ে দ্রুত কারণ ভালোবাসার আবেদন মানুষের কাছে পৌঁছায় সবচেয়ে সহজে।
ব্রিটিশ-পুর্ব ভারতীয় উপমহাদেশে সমকামিতা কোন অচ্ছুৎ বিষয় ছিল না যদিও যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা বরাবরই ছিল ট্যাবু। হিন্দু পূরাণে সমকামিতার বিস্তর নিদর্শন মেলে। এত শত বছরের মুসলিম শাসন আমলেও সমকামিতার বিরুদ্ধে কোন আইনের উল্লেখ নেই। বরং যৌন ও লিংগ বৈচিত্রের অধিকারীদের ছিল একটা সম্মানজনক অবস্থান। সুফীবাদেও রয়েছে সমকামী ভালোবাসার জয়কীর্তন। তারপর কোথায় যেন একটা ছন্দপতন। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে পুর্ব পাকিস্তান তারপর স্বাধীন বাংলাদেশ। এই পথচলায় রপ্তানি হোল ধর্মপরায়ণ সাধারণ মানুষ আর আমদানি হোল ওয়াহাবী ইসলাম। আশির দশক থেকে শুরু প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামিকীকরণের এই জয়যাত্রায় বলি হচ্ছে দেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানবতা।
দ্বন্দ্বটা সেখানেই। আমরা যারা নানাত্ববাদী, প্রগতিশীল, সমদর্শি এক সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি তাদের জন্য সমকামীদের অধিকার এক বৃহৎ আন্দোলনের একটি শাখামাত্র। অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের সাথে আমাদের আদর্শিক কোন ফারাক নেই। আমাদের কাজের ধরণ, প্রক্রিয়া, স্বরূপ এগুলো হয়ত আলাদা কিন্তু দিন শেষে আমাদের লক্ষ্য জ্ঞান আর যুক্তির উৎকর্ষসাধন। আমরা চেয়েছিলাম সমকামিতা নিয়ে নিরবতার অবসান ঘটাতে। অজ্ঞতা আর ধর্মীয় কুসংস্কারের লেবাসে মোড়ানো এই রুগ্ন সমাজকে বোঝাতে যে সমকামীরা প্রকৃতি, সমাজ বা ধর্মের শত্রু নয়।
বাংলাদেশে LGBT (Lesbian, Gay, Bisexual & Transgender) আন্দোলনের বয়স খুব বেশি নয়। উনবিংশ শতকে পৃথিবী জুড়ে HIV/AIDSকে ঘিরে যে জাগরণ তৈরি হয় তার রেশ বাংলাদেশে পৌঁছায় ৯০এর শেষের দিকে। অন্য অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও শুরুর দিকে HIV/AIDS এক বড় ভূমিকা রেখেছে সমকামী পুরুষদের, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে MSM’দের (men who have sex with men), বাস্তবতা নিয়ে কাজ করতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বেশ কিছু বড় বড় NGO এখন তাদের HIV/AIDS প্রজেক্টে MSM’দের নিয়ে কাজ করেন।
এখানে সরকারের দ্বিমুখী নীতির কথা না বললেই নয়। একদিকে HIV/AIDS এর বরাত দিয়ে সরকার কোটি কোটি টাকার প্রোজেক্ট চালাচ্ছে অপর দিকে বলছে দেশে কোন সমকামী নেই। MSM বললে আবার ঠিক আছে। এ সবই হচ্ছে শব্দের রাজনীতি। MSM
মূলত একটি ক্লিনিক্যাল পরিভাষা যার দ্বারা একজন পুরুষের যৌন আচরণ বুঝায়। অপরদিকে সমকামী, উভকামী, গে বা LGBT শব্দগুলো শুধুমাত্র যৌন আচরণ নির্দেশ করে না। এর সাথে জড়িয়ে আছে প্রেম-ভালোবাসা, আত্মপরিচয় এবং অধিকারজনিত ব্যাপারগুলো। ঠিক যেমন সরকার আদিবাসি আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শব্দগুলো নিয়ে খেলছে।
শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশ সরকার অনেক বেশি সচেতন আজকাল। এই যে IS’কে কেমন Neo-JMB বানিয়ে ফেলেছে রাতারাতি।
সে যাই হোক, জাতীয় HIV/AIDS কৌশলপত্রে MSM-এর অন্তর্ভুক্তি কিছুটা হলেও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে যৌন সংখ্যালঘুদের নিয়ে কথা বলতে। নিরাপদ যৌনসম্পর্ক, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, HIV-পজিটিভ হলে কি করণীয়, কোথায় কি সেবা পাওয়া যাবে, সেবা পাওয়া না গেলে কি করতে হবে, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি নিষেধ ইত্যাদি এই কৌশলপত্রের মূলপাঠ। এর আসল সুবিধাভোগী হচ্ছে হিজড়া জনগোষ্ঠী এবং নিম্নবিত্ত সমকামী পুরুষ। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সমকামী সমাজেকে টানতে পারেনি এই রোগ কেন্দ্রিক এবং NGO- নির্ভর উন্নয়নকর্ম। এই দুই শ্রেণির জন্য ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় ইন্টারনেট।
নতুন সহস্রাব্দের গোড়াপত্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশও খুব অল্প পরিসরে শুরু করে তার ডিজিটাল পদযাত্রা। সাথে যোগ দেয় দ্রুত বিকাশমান মুঠোফোনের কারাভ্যান। শুরু হয় অনলাইনে গুটিকয়েক শিক্ষিত, সুবিধাপ্রাপ্ত, উচ্চবিত্ত যুবকের LGBT আন্দোলন গড়ে তোলার দুঃসাহসিক স্বপ্নযাত্রা। গড়ে উঠে অনলাইন-ভিত্তিক কিছু অনানুষ্ঠানিক গ্রুপ, যাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমমনা লোকদের একই ছাতার নিচে সংগঠিত করা এবং বাংলাদেশে সমকামীদের একটা কমিউনিটি তৈরি করা।
খুব অল্প সময়েই এই গ্রুপগুলো দারুণ জমে উঠে। সদস্য সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় কয়েক হাজার। ধীরে ধীরে অনলাইন থেকে কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে অফলাইনে। অনুষ্ঠিত হতে থাকে নানাবিধ নিয়মিত কার্যক্রম। যোগাযোগ তৈরি হয় দেশ-বিদেশের অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের সাথে। সেমিনার, কনফারেন্স, গবেষণা, জরীপ, আড্ডা, র্যালি, নাটক, ডকুমেন্টারি, লেখালেখি, ওয়ার্কশপ এসবের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে চলতে থাকে সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছানোর কাজ। সর্বশেষে সংযুক্তি ছিল ম্যাগাজিন আর কমিক বই প্রকাশ।
আর এসব কাজের পিছনে ছিল জুলহাজ আর তনয়ের মতো একদল অকুতোভয় ভালোবাসার ফেরিওয়ালারা যাদের ছিল মানুষের উপর অগাধ আস্থা। জুলহাজ আসলেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো সবাইকে ভালোবাসা, জ্ঞান আর যুক্তি-তর্ক দিয়ে বুঝানো সম্ভব। কি ছেলেমানুষি চিন্তাভাবনা!
আসলে এই গ্রুপগুলো পরিচালিতই হতো এমন কাঁচা আদর্শিক মতবাদ দ্বারা, যেন সবাই একটা ইউটোপিয়ান সাম্রাজ্যের বাসিন্দা। অনিবন্ধিত, তহবিলশূন্য ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশলহীন এই গ্রুপগুলো মূলত স্বেচ্ছাসেবক নির্ভর। এদের নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, নেই সংগঠন তৈরির অভিজ্ঞতা, নেই আন্দোলন চালানোর রসদ। কিন্তু আছে রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনি হাজারো প্রতিবন্ধকতা। এত দূর্বল হয়ে কিভাবে পারতাম আমরা এমন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়াতে? কিন্তু আমাদের এই দূর্বল, কাঁচা আদর্শকে ওদের এত কেন ভয়? কেন ভালোবাসার জবাব দেয় ওরা চাপাতি দিয়ে?
হয়তো এতো কিছু ছিল না বলেই আমরা আজ এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। ১৫ বছর আগে যখন শুরু করেছিলাম তখন যদি কেউ আমাকে বলতো ২০১৬ সালে দুজন প্রাণ দিবে এই আন্দোলনের জন্য তাহলে হয়তো আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম। এত অল্প সময়ে এত কিছু হয়ে যাবে আমরা ভাবিনি। কিন্তু তার মানে কি এই হত্যাকে আমি আন্দোলনের এক প্রকার সফলতা বলতে চাইছি? হ্যাঁ এবং না। এটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার।
জুলহাজ আর তনয় এর মৃত্যু স্পষ্টভাবেই আন্দোলনের একটা পরিণাম। কেউ এটাকে ব্যর্থতা বলবে আবার কেউ হয়তো বলবে যে আন্দোলন একটা জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে বলেই এমনটা হয়েছে। অনেকটা ‘কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’ টাইপ ব্যাপার। দৃষ্টিগ্রাহ্যতার রাজনীতির একটি ক্লাসিক উদাহরণ।
ইতিহাস বলে যে কোন সামাজিক আন্দোলনের একটা ‘tipping point’ থাকে যখন সেই আন্দোলন হয় আরও বেগবান। জুলহাজ আর তনয়ের মৃত্যুর পর গত এক বছরে সেটা যে হয়নি তা শুরুতেই বলেছি। কিন্তু তাই বলে কি নিকট ভবিষ্যতে হবে না?
আমরা আশাবাদী। ঘটনার আকস্মিকতায় আমাদের পা একটু টলমলিয়ে গেছে বটে কিন্তু আমরা এখনও সেই ইউটোপিয়ান রাজ্যেই আছি আমাদের কাঁচা আদর্শিক মতবাদ নিয়ে। আমরা আশা করি একদিন জুলহাজ আর তনয়ের হত্যাকান্ডের বিচার হবে। ওদের অনুপ্রেরণায় তৈরি হবে আরও জুলহাজ, আরও তনয়। ভালোবাসার ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাকে মুখর হয়ে উঠবে আমার ফেলে আসা অলি-গলি, রাজপথ, ৩৫ নর্থ ধানমন্ডি