সাপ, স্বামী, আশালতা ও আমরা

Share this:

সাপ, স্বামী, আশালতা ও আমরা

 

আমাদের জীবনে আশালতার আবির্ভাব এমন এক সময়, যখন আমরা সাপের ভয় থেকে উদ্ধার পেতে গিয়ে বরদের খপ্পরে পড়ে হাঁসফাঁস করছি। সাপের ভয় কে না পায়? আর বর দেয় বরাভয়। তারা বলে, ‘তোমরা সাপ ভয় করো ক্যান, আমরা না আছি!’ তাদের কথায় আমরা হাসি। হাসতে হাসতে বলি, ‘কী বীর পুরুষ রে!’ তারা উত্তেজিত হয়, ফণা বিস্তার করে, আমাদের আপাদকণ্ঠ প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে সর্পজিব বের করে। বর সাপ না মানুষ! মানুষ না সাপ! আমরা শীত-শিহরনের চড়াই বেয়ে গ্রীষ্মমন্ডলে পৌঁছামাত্র তারা আমাদের ঊর্ধ্বাঙ্গ দংশন করে জিব গুটিয়ে বেষ্টনী ছেড়ে দেয়। আমাদের সর্পবিহার মাঝপথে থেমে যায়। বাকি রাত খোলা শরীর ভাঁজ করতে করতে আমরা সাপ-স্বপ্ন দেখি। পরদিন মনোচিকিৎসক ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘যৌন অবদমন’। ‘কিন্তু, আমরা বলি, ‘আমরা তো বিবাহিত। আমাদের বরও আছে।’ তিনি ফাইল বন্ধ করে স্টিলের আলমারিতে রেখে চাবি লাগিয়ে ফিরে আসেন। আমরা ডাক্তারের কাছে পরিত্রাণের উপায় জানতে চাই। তার এক হাত তখন ড্রয়ার খোলে, আরেক হাত কলবেলের ওপর। ড্রয়ারে টাকা রাখতে রাখতে তিনি বেল টেপেন। পরের রোগী তলব করেন। তখন আমাদের চেয়ার থেকে উঠতেই হয়। আমরা সাপ কে, যৌন অবদমন কেন, তা থেকে বাঁচার উপায় কী- এসব ভাবতে ভাবতে ডাক্তারের চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে আসি। গেটের বাইরে যে আশালতা, আমরা এমন চিন্তামগ্ন থাকি যে, তা জানতেও পারি না।

বাইরের যানবাহনের শব্দ শুনে আমরা ভাবি, এত মানুষ কোথায় যায়? এখানে আমাদের পরিত্রাণের আশা নেই, আমরা যদি কোথাও চলে যেতে পারতাম! সাপের ভয়ে অতিষ্ঠ হওয়ার পরই শুধু আমাদের জীবনে বরের সমাগম ঘটে। সত্যি কথা বলতে কি তখনই আমরা তা ঘটতে দিই। তার আগের সময়টা আমাদের যার যার বয়সের মাপে ধরা যাক তিরিশ, চল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ। ক্রমে তা সর্পিল আর সর্পময় হয়ে ওঠে। তখন আমাদের বরলাভ অনেকের কাছে সৌভাগ্যের নিদর্শন মনে হয়। তারা বলে, কুড়িতেই যে মেয়েরা বুড়ি, আমরা তাদের দলে পড়ি না, স্বর্গের অপ্সরা মেনকা-উর্বশীরা শুধু আমাদের স্বগোত্রীয়। আমরা স্বর্গমোহে কিছুদিন আচ্ছন্ন থাকি। তারপর বুঝি যে, বররা ওঝা না। তারা সাপ না মানুষ! মানুষ না সাপ! এ খবর আর কেউ না জানুক, মনোচিকিৎসক জানেন। তিনি লম্বা কেস-হিস্ট্রি লিখে ফাইল-বন্ধ করলে আমরা হরেক রকমের বড়ি হাতে চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসি।

গেটের বাইরের পাঁচিলে নির্বাচনি পোস্টার দেখছে আশালতা। পোস্টারের ছবিটা দেখে ওর মনে হয়, এটা গাঁয়ের বড়বাড়ির গিন্নির ছেলের এবং বাড়িটাও তার। গিন্নিমা এখন শহরে আছেন। সে দুবার ভেতরে ঢোকার কোশিশ করে দারোয়ানের গলাধাক্কা খায়। তখন গেটের ফাঁক দিয়ে চেম্বারের খোলা দরজাপথে আশালতার চোখ যায় রোগীর বসার ঘরের অ্যাকুয়ারিয়ামের দিকে। শহরে মাছের জন্য যে স্বতন্ত্র ঘর থাকে, মানুষের দোচালা টিনের ঘরের মতো, দিদিমা ওকে বলেননি। গাঁয়ের বাড়িতে গিন্নিমাও তো ডেকচির পানিতে মাছ রাখতেন। শহরে এলে মানুষের আচার-ব্যবহার কেমন পাল্টে যায়। অ্যাকুয়ারিয়ামের সমুদ্দুরে সন্তরণশীল মাছ আশালতাকে উৎফুল্ল করে না, ক্ষুধার্ত করে। সে ভাবে, দিদিমা কি জানতেন শহরে মানুষ খাবার পায় না? খিদা পেটে দুইদিন সে ঘুরছে- গাঁয়ে হলে তার শুকনো মুখ দেখে বড়বাড়ির গিন্নি ডেকে খেতে বসাতেন; এখানে চাইতে হয়, কেউ ডেকে বলে না খাও- আশালতা খাবার চেয়ে খেতে জানে না। সে ছলছল চোখে মাছগুলোর দিকে তাকায়, সেখানে শুধু জল, জলের ভেতর  দিদিমা।

দিদিমা দুর্ভিক্ষের বছর সেই একবারই শহরে আসেন। পেটে তার টিউমার। শহর যে কী জাদু করেছিল, তিনি মরার জন্য দুই বছর বাদে গাঁয়ে ফিরে বাঁশের চাটাইয়ে গড়াগড়ি দিয়ে হাপিত্যেশ করতেন। শেষ দিনগুলোতে তার মনে শান্তি ছিল না। থেকে থেকে বলতেন, ‘আশা রে, শহরে যাইস। যৌবন থাকতে থাকতে যাইবি কইলাম। শহর তোরে পায়ে ঠেলব না রে। কদর পাবি।’ দুমড়ানো-মুচড়ানো কাঁচা বাঁশের চাটাইটাও তার সঙ্গে শ্মশানে পুড়ে ছাই হয়। শহরের কোন বাজার যে তিনি যাচাই করে গেছেন, বেঁচে থাকতে নাতনিকে কিছু ভেঙে বলেননি। তার মুখের শেষ জবান ছিল, ‘একদিন বুঝবি।’

আশালতা গত বছর চৈত্র মাসের আগে বোঝেনি। আশ্বিন মাসে স্বামী বাতে পঙ্গু হলো। জিহ্বা ছাড়া সর্বাঙ্গ অবশ। আশ্বিনে আশ্বিনে এক বছর; কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র- দেড় বছরের মাথায় সে সাপ-স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

মনোচিকিৎসকের চেম্বারের গেটে আশালতাকে দেখে আমরা অবাক হই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে চুপিচুপি ওকে জিগ্যেস করি, ‘তোমার কোনো অসুখ আছে?’

আশালতা অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল তাকায়। চোখ দুটি ছলছল করে ওর। শুকনো ঠোঁটজোড়া আচমকা নড়ে ওঠে, ‘আমার কিনো রোগ নাই। তয়…’

‘তয়?’

‘আমি রাইতে হাপ দেখি।’

এবার আমাদের চোখ ছলছল করে। ওর দুবলা-পাতলা হাতে চাপ দিয়ে বলি, ‘ডাক্তার দেখাইবা?’

‘না!’ আশালতা ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে যায়। আমরা পায়ে পায়ে তার দিকে এগোই, ‘তো এখানে আসছ কেন?’

আশালতা গেটের বাঁ পাশের দেয়ালের দিকে সরে দাঁড়ায়। সেখানে পৌর কমিশনার প্রার্থীর সচিত্র নির্বাচনি পোস্টার। সে সারসের মতো লম্বা গলা উঁচিয়ে আবদার করে, ‘আমি বড়বাড়ির গিন্নির কাছে যামু, আমার ভুক লাগছে।’

আমাদের অবাক হতে দেখে আশালতা বিভ্রান্ত হয়। এই আলিশান বাড়িটা গিন্নিমার ছেলের না তো কার! ‘বেডায় এ বাইত থাকত না?’ পোস্টারের ছবির ওপর হাত রেখে আশালতা আমাদের কাছে জানতে চায়। আমরা বলি, ‘না।’ সে অপ্রস্তুত হাসে, ‘এক্কেরে এক চেহারা। বড়বাড়ির গিন্নির পোলার আর এই বেডার।’

মানুষে মানুষে যে চেহারার মিল থাকে, দিদিমা একবার বলেছিলেন। তবে ফারাকও আছে, গড়নে। নিজের হাত দুটিও একরকম হয় না। মেয়েদের এক স্তন আরেক স্তন থেকে ছোট-বড় হয়। বোঁটার রং-ও কত রকম। আশালতার এই শরীরপাঠ দিদিমার কাছ থেকে।

আশালতার দিদিমা দাই ছিলেন। মালিশের কাজও করতেন। সন্তান জন্মানোর আগে-পরে পোয়াতির শরীর বদলায়। নিজের শরীর আর নিজের একার থাকে না। গর্ভাবস্থায় দিদিমার ডাক পড়ত। খড়ের ব্যানায় আগুন জ্বেলে আশালতাকে বলতেন, ‘কি যাইবি?’ আশালতা সামনে, খড়ের মশাল ধরে দিদিমা পেছনে। সে তেলের শিশির গলায় বাঁধা দড়িটা আঙুলে ঝুলিয়ে, সরু আলপথে টাল সামলাতে সামলাতে আগে আগে ছুটত। পেছন থেকে দিদিমা ডাকতেন, ‘এই সার্কাসের মাগি, খাড়া!’ সে দাঁড়াতো বটে ক্ষেত পেরিয়ে কবরখোলার সেই মুখটায়, যেখান থেকে ভূতের রাজত্ব শুরু। দিদিমা আর আগুন দুটিই তখন দরকার। বাকি পথটুকু দিদিমার কোমর জড়িয়ে, চোখ বুজে রামনাম জপতে জপতে শেষ হতো। সেই ঘোর ভাঙত কুপির লকলকে শিখায় একটা নারীদেহকে কেঁপে কেঁপে জেগে উঠতে দেখে। যার ধামার মতো পেট, টলটলে বিশাল দুটি স্তন। দিদিমার তেলসিক্ত আঙুল মোমের উঁচু উঁচু পাহাড় ছোঁয় না, শুধু ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে ওড়ে। ঘরের ভেতর আরামের উষ্ণ শ্বাস, শরীরে তিরতির কাঁপন। আশালতার বড্ড ঘুম পায়। মোমের উঁচু উঁচু পাহাড়ের ওপর উড়তে উড়তে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। দিনের আলোয় এই নারীকে সে কোনোদিন দেখেনি। বাচ্চাভরা পেট টানতে টানতে যে এ-ঘর ও-ঘর করে, দিদিমার আঁচলে টিনের কৌটা মেপে চাল ঢেলে দেয়, এ যেন সে নয়।

প্রসবের দিনটা আশালতার জন্য বড় কষ্টের। দিদিমা বাপ-মা-মরা নাতনিকে একা ঘরের দরজায় শিকল টেনে চলে যেতেন খড়ের মশাল হাতে। তখন আতঙ্কে আশালতার শরীরে যন্ত্রণা হতো। দিদিমার সেই সময়ের কাজ-কারবার তার কাছে ছিল অজানা, রহস্যময়। জটিল কেসের বেলায় দুই-তিন দিনও কাভার হয়ে যেত। তখন তিনি গালে পান নিয়ে গভীর চিন্তায় নিবিষ্ট। হঠাৎ হঠাৎ বাড়ি এসে নাতনিকে এটা-সেটা হুকুম দিয়ে, পানের পিক ফেলে বেরিয়ে যেতেন। আশালতা অপেক্ষায় থাকত, কখন তিনি উঠোনে এসে ডাকবেন, ‘আশা লো, ফুটফুইট্টা একটা বাচ্চা অইছে, দেখতে যাইবি, চল।’

সেদিন থেকে আশালতার বহুত কাজ। আঁতুড়ঘরের আগুনের মালশা সামলায় সে। কাঠি নেড়ে তুষের আগুন উসকে দেয়। দিদিমা কাঁথা প্যাঁচানো বাচ্চাটা তুলে আনতে বললে, আনে। বাচ্চার মুখে মিছরিজল দিতে না বললেও দিতে যায়। বাচ্চা কাঁদলে মা মুখে মাই দেন। আশালতা হাঁ করে বাচ্চার নড়েচড়ে দুধ খাওয়া দেখে। এটাও কাজ। কারণ তখন তার তেষ্টা পায়। নিজের মায়ের মুখ মনে পড়ে না। উঠে গিয়ে টিউবওয়েল চেপে জল খেয়ে আসে। বাইরে বেশিক্ষণ মন টেকে না ওর। আগুনের ধোঁয়া-ধোঁয়া মিষ্টি ঘ্রাণ, বাচ্চার ঠোঁট গড়িয়ে বিছানায় দুধের টুপটাপ পতন, শাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা বাচ্চার মায়ের আলগা শরীর, যা মেরামত করতে দিদিমা তেল মালিশ করেন, আগুন সেঁক দেন- এসবই টানে ওকে। আশালতা পা ছড়িয়ে বাচ্চাকে শোয়ায়, দোল দেয়, গুনগুন করে। দোল দিতে দিতে, গান গাইতে গাইতে, আঁতুড়ঘরের রহস্যময়তায় আশালতা একদিন বড় হয়ে ওঠে।

‘আমারে কাজ দিবেন, আমি বাচ্চা পালতে জানি।’ আশালতার আরজি শুনে আমরা বলি, ‘আমাদের তো বাচ্চা নাই।’

সে আমাদের শরীরের দিকে তাকায়। ধামার মতো পেট খোঁজে, বড় বড় স্তনের সন্ধান করে। আমরা তখন তাকে হতাশ হতে দেখি। তারপর সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে চায়, বলে, ‘আপনেরা পোয়াতি অইবেন না? কবে অইবেন?’ আমাদের চুপ থাকতে দেখে তার চোখ ধু-ধু করে। এ কেমন অজন্মার দেশ! শহর যে এমন দিদিমা তো বলেননি! মরার আগে বুড়ির ভীমরতি হয়েছিল, শহর শহর করে দুদিন পর যার মরার কথা, সে দুদিন আগে মরল। নয়া বাঁশের চাটাইটাও শ্মশানে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। তখন যেমন, এখনও তার পুরোটাই ক্ষতি। শহরের এই হাল, গাঁয়ে অচল স্বামী- আশালতা উভয়সংকটে ছটফট করে।

অনেকক্ষণ চুপ থেকে আমরা তাকে বলি, ‘আমরা রাতে সাপ-স্বপ্ন দেখি।’ বলেই আমরা ভারমুক্ত হই। এবং মনোচিকিৎসকের পর, একজন ক্ষুধার্ত নারী, যে নিজে সাপ-স্বপ্ন দেখে, তার কাছেই ইলাজ আশা করি।

আমাদের স্বীকারোক্তি শুনে আশালতার মাথায় নতুন ভাবনা খেলে। ক্রমে তা পোয়াতি ও আঁতুড়ঘরের বাইরে প্রসারিত হয়। সে আমাদের নতুন চোখে দেখে এবং বোঝে যে, অন্য কারণেও মানুষের শরীরের খেদমত দরকার হতে পারে এবং তা ফেলনা নয়। দিদিমা শুধু বাচ্চাধরা এবং মালিশের কাজ জানতেন। দুর্ভিক্ষের বছর মালিশ বন্ধ হয়ে যায়। নতুন বাচ্চারা আর জানান দিয়ে জন্মাতো না। মা ও শিশুর জীবনের মূল্য হারিয়ে যায়। কিন্তু, মানুষ অনাহারে মরতে চায় না। দিদিমা ঠাঁইনাড়া হলেন- গাঁ ছেড়ে শহরে গেলেন। শহরের বন্ধ্যাত্ব সে এখন নিজের চোখেই দেখছে। দিদিমা তাহলে এখানে কী কাজ করতেন?

আশালতা আমাদের গর্ভহীন শরীরের ভাঁজে ভাঁজে দিদিমার রহস্য সন্ধান করে এবং বলে, ‘আমি শরীরের খেদমত করতে জানি, আমারে চাকরি দিবেন?’

রাস্তার পাশের আবর্জনায় হাতের ওষুধ-বড়ি ছুড়ে ফেলে আমরা আশালতাকে নিয়ে বাড়ি ফিরি। আমাদের বাসার কাজের লোকেরা রান্নাঘর কি সিঁড়ির নিচে ছেঁড়া কার্পেটের ওপর ময়লা কাঁথা বিছিয়ে শোয়। আমরা আশালতাকে থাকতে দিই সুন্দর বিছানার ছিমছাম ঘরে। তার বিছানার পাশের স্ট্যান্ডে হালকা কমলা রঙের ল্যাম্পশেড। স্ফটিক-স্বচ্ছ মশারির ওপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘোরে। আমরা প্রতিদিন তার সাইড টেবিলের ফুলদানিতে তাজা ফুল রেখে আসি। আমাদের আর আশালতার ঘরের মাঝখানে যে কমন টয়লেট, তার দরজা দুটি খোলা ও বন্ধ করার সময় ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হতো। আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ তেল ঘষে মরচে-ধরা কব্জা দুটিকে শব্দহীন করে তুলি। আমাদের কাণ্ডকারখানায় বরেরা রেগে যায়। তারা বলে, সে কোন লাটসাহেবের বেটি যে, তার জন্য আমরা তুলতুলে বিছানা পেতে দিয়েছি, যেমন শয্যায় শোয়া শুধু তাদেরই এখতিয়ার! বরদের আস্ফালনে আমরা বিরক্ত হই এবং এসবের জবাব দিই না। তারা তাতে আরও চটে যায়, একই প্রশ্ন বারবার করতে থাকে। তখন আমরা বলি, ‘আশালতা রাতে সাপ-স্বপ্ন দেখে।’

আমাদের সাপ স্বপ্নের বাড়াবাড়ি বরদের পুলকিত করে। তারা আহ্লাদিত হয়ে আমাদের পা থেকে আকণ্ঠ প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে সর্পজিব বের করে। বর সাপ-না-মানুষ! মানুষ-না-সাপ! আমরা শীত-শিহরনের চড়াই বেয়ে গ্রীষ্মমন্ডলে পৌঁছামাত্র তারা আমাদের ঊর্ধ্বাঙ্গ দংশন করে জিব গুটিয়ে বেষ্টনী ছেড়ে দেয়। আমরা ছিটকে পড়ে বিষ-যন্ত্রণায় ছটফট করি এবং বরদের নাকডাকা পর্যন্ত বিছানায় আমাদের আর কোনো কাজ থাকে না। তারা ঘুমিয়ে পড়লে কমন টয়লেটের দরজা খুলে নিঃশব্দে আমরা আশালতার ঘরে ঢুকি।

আশালতা নতুন খেলায় মেতে ওঠে। এতদিন নিজের আর আঁতুড়ঘরের মেয়েদের বাইরে নারীদেহ তার অচেনা ছিল। তাও তার চেনা ততটুকুই- দিদিমার মালিশ আর সেঁক দেওয়ার সময়টায় অদূরে বসে পোয়াতির সুখ-শিরশির অনুভূতি সে নিজ অঙ্গে যতটুকু ধারণ করতে পারত। নিজের শরীর দিয়ে আরেক নারীদেহ চেনার সূত্রপাত তখন থেকে। আসক্তিরও জন্ম তখন, দিদিমা যার মধ্যস্থতায় ছিলেন। জগৎটা রহস্যের আধার, আশালতা ভাবে। সে তো দিদিমার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে করে শেষ পর্যন্ত শহরে পৌঁছতে পারল। তিনি এক যুগ আগে এখানে যা যা করে গেছেন, তার বিশ্বাস- এখন সে তা-ই করছে। অতীত আশালতার সহায় হয়। কুপির লকলকে শিখা, আগুনের ধোঁয়া-ধোঁয়া মিষ্টি ঘ্রাণ হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় ফুলের সুবাসভরা নরম বিছানার কমলা আলোর নারীদেহের দিকে।

ভোরবেলায় আমাদের ঘুম ভাঙে আশালতার বিছানায়। আমরা ছোট্ট হাই তুলে, মুখ হাসি হাসি করে ভাবি- রাতে সাপ-স্বপ্ন দেখি নাই। আশালতা তখনও ঘুমে চুর। তার দিকে পাশ ফিরে ফিসফিস করি, ‘রাইতে হাপ দেখছো?’ সে ঘুমের ভেতর গোঙায়। আমরা তার কানে সুড়সুড়ি দিই, ‘এই, রাইতে হাপ দেখছো?’ আশালতার ঘুম ছুটে যায়। আমরা কমলা বাতি নিভিয়ে, ভোরের নীল নীল আলোয় আরেক দফা হুটোপুটি করি। ততক্ষণে বরদের ঘুম ভাঙে। তারা আমাদের বিছানায় না পেয়ে ভাবে, আমরা টয়লেটে গেছি। কিন্তু, টয়লেটে তো মানুষ এতক্ষণ থাকে না। তারা বিছানায় ছটফট করে এবং ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরটাকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমানোর চেষ্টাও তাদের বিফল হয়। আমরা কমন টয়লেটের দরজা খুলে ঘরে ঢুকলে বররা বলে, ‘এতক্ষণ টয়লেটে কী করো?’ আমরা অবাক হই, ‘টয়লেটে?’ তারা যুক্তি দেখায়, ‘এই ছাড়া তোমাদের যাওনের জায়গা আছে?’

আমরা বুঝতে পারি, তারা আমাদের বয়সের দিকে ইঙ্গিত করছে। তাদের ধারণা, এখন আমাদের এমন এক বয়স, যে বয়সে মেয়েদের আর প্রেমিক জোটে না, রাতে কি দিনে জীবনে কখনোই অভিসার আসে না, নতুন করে বর পাওয়া যায় না। এই বররা তো আমাদের সৌভাগ্যের নিদর্শন। জনমভর সাপ-স্বপ্ন দেখলেও আমরা তাদের কাছ থেকে তালাক চাইব না।

আমরা বলি, ‘টয়লেটে যাই নাই।’

বরদের চক্ষু চড়কগাছ। ‘ত-ত-ত কোথায় ছিলা?’ তারা তোত্লায়।

‘আশালতার ঘরে ছিলাম।’

‘কেন?’

‘কারণ ওর বিছানায় ঘুমালে আমরা সাপ-স্বপ্ন দেখি না।’

‘অহ অহ, এই কথা!’ আমাদের সাপের ভয় বরদের আহ্লাদিত করে। তাদের আমোদ করতে মন চায়। আমরা বিরক্ত হই। এবং এই প্রথম তাদের ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে চলে যাই। পেছনে বররা ফুঁসফুঁস করে। তাদের সর্পিল দৃষ্টি আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়।

অফিসে সারাদিন জরুরি কাজ থাকে। কাজের চাপে আমরা সকালের বিবাদ ভুলে যাই। আশালতার স্বামীর নামে মানি অর্ডার পাঠিয়ে সন্ধ্যায় ফুলের তোড়া হাতে ঘরে ফিরি। আশালতা মালিশের সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত। দিনরাতের এই বাড়তি সময়টায় সে আমাদের খেদমত করে চাকরির চুক্তি বহাল রাখতে চায়। আমরা অস্থির বোধ করি। বরদের বাসায় ফেরার সময় হয়ে গেছে। নতুন করে তাদের সঙ্গে আর বিবাদে জড়াতে চাই না। আশালতাকে বলি, ‘পার্কে বেড়াইতে যাইবা?’ বেড়ানোর নাম শুনে তেল-চন্দনের বাটি ফেলে সে কলকলিয়ে ওঠে, ‘শহরটা যে কী রহম, অহনতরি ভালো করে দেখি নাই। যাই, জলদি রেডি হই।’

আশালতা পার্কে হাঁস দেখে। ফড়িঙের পেছনে ছোটে। লেকের পানিতে বড়শি ফেলে লোকেদের মাছ ধরা দেখে। গাঁয়ে থাকতে সে যে অ্যাত্ত অ্যাত্ত মাছ মারত সেই গল্প করে। বাদাম খেতে খেতে দোলনায় দোল খায়। তার সামনে একঝাঁক শিশু রঙিন বল নিয়ে খেলে, ছুটে এসে দোলনায় চড়ে, জামা ভিজিয়ে আইসক্রিম খায়, লেকের পানির দিকে ড্যাবড্যাব তাকায়। শিশুদের মাঝখানে দোলনায় দোল খেতে খেতে আশালতা আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায়।

রাতে আশালতার ঘর থেকে বোবা-চিৎকার আসে। আমরা সেদিকে প্রাণপণে ছুটলে বরেরা বাধা দেয়। তারা বলে, ‘আগে আমরা গিয়া দেখি, অবস্থা বুঝে তোমরা যাইবা।’ আমরা তাদের কথা শুনি না, ছুটে গিয়ে দেখি- আশালতা মেঝেতে তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে, বিছানায় মস্ত বড় কালো সাপ। আমরা আশালতাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপতে থাকি। সাপ সাপই। তবু স্বপ্নে দেখা সাপ আর জ্যান্ত সাপে বিস্তর ফারাক। বরেরা আমাদের ঠেলে বীরদর্পে এগিয়ে যায়। লেজ ধরে সাপটাকে বিছানা থেকে নামায়। তাদের হাসতে দেখে আমরা অপ্রস্তুত হাসি এবং ঝটপট আশালতাকে ছেড়ে দিই। সাপটা প্লাস্টিকের। খেলনা সাপ। কিন্তু কোত্থেকে এলো? আমাদের বাড়িতে তো শিশু নেই! বরেরা আশালতার দিকে কটমট করে তাকায়। ওর শরীরটা তালপাতার মতো কাঁপতে থাকে। তাদের কথা, পার্কের ফেরিঅলার কাছ থেকে ও-ই সাপটা কিনে এনেছে। আশালতার বোবা চোখ আমাদের সাহায্য চায়। আমরা বলি, ‘না, ও কিনে নাই। আমরা ওর সঙ্গে ছিলাম।’ বলার পর মনে হয়, কোথাও একটা ফাঁক আছে। পার্কে আশালতা তো আমাদের চেয়ে শিশুদের সঙ্গেই বেশি সময় কাটিয়েছে। তখন যদি সাপ কিনে থাকে? আমরা বরদের কাছে এসব কথা চেপে যাই। ওরা কেউটে। ফণা নামায় না। চার-পাঁচ দিন ধরে অনবরত কথার প্যাঁচে আমাদের ফেলতে থাকে। আমরা বাধ্য হয়ে যুক্তি দেখাই, ‘ও নিজে সাপ কিনে, নিজের বিছানায় ফেলে রেখে, নিজেই আবার ভয় পাবে কেন?’

‘ভড়ং-ভড়ং’- বরেরা চেঁচায়, ‘ওর ভয় পাওয়াটাও ভড়ং। ও আসলে আমাদের সবাইকে সাপের ভয় দেখিয়ে বাড়িছাড়া করতে চায়।’

আমরা বলি, ‘আসলে সাপের ভয় দেখিয়ে তোমরাই ওকে বাড়িছাড়া করতে চাও।’ তারপর বরদের হুঁশিয়ার করি, ‘এই বাড়িতে তোমাদের যেমন, আশালতারও তেমন অধিকার। আমাদের প্রত্যেকের সমান অধিকার। থাকলে এক বাড়িতে আমরা সবাই মিলেমিশে থাকব। আর আশালতা না থাকতে পারলে কেউ পারবে না।’

বরেরা চুপ মেরে যায়। কথায় সময় নষ্ট না করে গোপনে ষড়যন্ত্রে মাতে। আশালতাকে সাপের বিষয়ে সাবধান করার সুযোগ আমাদের আর হয়ে ওঠে না।

সাপসংক্রান্ত কথার মারপ্যাঁচের সময়টায় আশালতার স্বামীর মৃত্যুসংবাদ আসে। সে এখন বিধবা। হিন্দু আইনে স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে পুনর্বিবাহের আইন নেই। বিধবা স্বয়ং চাইলে বিবাহ করার পথ আছে। বিদ্যাসাগর মশায় দেড় শ বছর আগে আইন করে সেই পথ পরিষ্কার করে গেছেন। আমাদের ভয়, আশালতা যদি এখন বিয়ে করে চলে যেতে চায়, আমরা ঠেকাব কীভাবে!

বিধবাবিবাহ আইন আছে কি নেই, আমরা আশালতাকে বলি না। সাপের বিষয়ে ওকে আগাম সতর্ক করার সাহসও আমাদের হয় না। স্বপ্নে দেখা সাপের চেয়ে জ্যান্ত সাপ বেশি ক্ষতিকর- এই ভেবে সে যদি চলে যায়! ওর মনমরা ভাব কাটানোর জন্য আমরা অফিস ছুটির পর রোজ ওকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে যাই।

পার্কে আশালতা আনন্দে থাকে। শিশুদের সঙ্গে খেলা করে, তাদের কোলে নেয়, গাল টিপে আদর করে। আমরা মাছধরার লোক, বাদামবিক্রেতা, ফেরিঅলার ওপর নজর রাখি। তারা ওর দিকে তাকালে কিংবা ছল-ছুতোয় কাছে ঘেঁষতে চাইলে, আমরা যত দূরেই থাকি না কেন, এক দৌড়ে আশালতার পাশে চলে আসি। তারপর এমন গভীরভাবে ওকে পর্যবেক্ষণ করি যে, পুরুষদের দিকে ওর একচুল হেলে পড়া যেন আমাদের জীবন-মরণ ব্যাপার। সে আমাদের ঈর্ষা উপভোগ করে। চোখ টিপে মুচকি হাসে। পুরুষগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না। তার যত ভালোবাসা শিশুদের প্রতি। ভাবতে বুক ভেঙে যায়, এই শিশুরাই হয়তো একদিন আমাদের কাছ থেকে আশালতাকে ছিনিয়ে নেবে। আমরা তো আর ওর কোলে শিশু দিতে পারব না! এ বাবদে আমাদের করার কিছুই নেই।

রাতে আশালতার পাশে শুয়ে আমাদের ভয় আরও বাড়ে। আশালতা বলে, ‘কী অইছে আপনেগর, কাঁঠালপাতার মতো এমন শক্ত অইয়্যা আছেন ক্যান্?’ আমরা মুখ ফুটে আশঙ্কার কথা বলতে পারি না। তবে একরাতে সাহস করে বলি, ‘আশালতা, তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাইবা?’

‘কই? কই যামু আমি? আমার কি যাওনের জায়গা আছে?’

‘এই ধরো, পৃথিবীটা তো অনেক বড়। কত মানুষ তোমারে চায়! তা ছাড়া দেশের বাড়িতে যদি চলে যাও?’

আশালতা চোখ বুজে চিন্তা করে। দিদিমা মরার আগে গাঁয়ে ফিরেছিলেন। বালবিধবার দুঃখ ছিল, সেই তো শহরে গেলেন, কিন্তু, যৌবন থাকতে গেলেন না। কাঁচা বাঁশের চাটাইটা দেহের যাতনায় দুমড়ে-মুচড়ে গেল। আশালতা তার নাতনি। সে সুযোগ পেয়েছে যৌবনকালে শহরে আসার। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আশালতা আমাদের বলে, ‘মরার সময় অইলে গাঁয়ে যামু। মরতে যামু। গাঁয়ের শ্মশানডা হাঁ কইর‌্যা আছে। ওইহানে পুইড়া ছাই অইতে যামু।’

ভয়ে আমাদের বুক কাঁপে। ভালোবাসা আর মৃত্যু যেন গলাগলি করে থাকে। ভালোবাসার বসত শুধু মৃত্যুকে নিয়ে, জীবনের সঙ্গে নয়। আমরা আবার খুশি হই এই ভেবে যে, আশালতা আমাদের আমরণ সঙ্গী। এত শখের বিয়ে যে বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারে না, আমাদের সন্তানহীন অলিখিত সম্পর্ক তা পারবে। আমরা নড়েচড়ে বসি- কিন্তু, মানুষের প্রতিশ্রুতির কি বিশ্বাস আছে? মানুষ তো ঋতুর মতো বদলায়। আশালতা যদি বদলে যায়? বড় অদ্ভুত এই ভয়, যা আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়, বুকের ভেতর কামনার আগুন জ্বালিয়ে রাখে। আশালতার প্রেমে দগ্ধ হতে হতে আমাদের দিন যায়, রাত যায়, মাস ঘোরে, নতুন বছর আসে। আমরা স্বপ্নে দেখা সাপ কিংবা জ্যান্ত সাপের কথা ভুলে যাই।

একদিন কাজ থেকে ফিরে দেখি, আশালতা বাড়ি নেই। বরেরা অসুস্থতা ছাড়াই সারাদিন সিক লিভ কাটিয়েছে। তাদের মুখে চোর-চোর ভাব। আমরা জিগ্যেস করি, ‘আশালতা কই?’ তারা সংক্ষেপে বলে, ‘পালাইছে।’ ‘কী! কী বললা?’ বরদের হুংকার, ‘খানকি-মাগি, ঘরের মালসামান লইয়া পালাইছে।’ আমরা বিশ্বাস করি না। তার ঘরের দিকে দৌড়াই। দরজায় তালা। বরেরা জানায়, থানায় লোক গেছে। খানিক বাদে পুলিশ আসবে। ওই ঘরে এখন ঢোকা নিষেধ। কিছু ভাবতে না পেরে আমরা পুলিশের অপেক্ষায় থাকি। পুলিশ আসে না। মাঝরাতে বরেরা আমাদের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘পুলিশ আস্লে কী কইবা? আশালতা তোমাদের কে আছিল- পুলিশেরে কইতে পারবা?’ আমরা চুপ করে থাকি। বুঝতে পারি, আমরা যখন আশালতার প্রেমে মজে ছিলাম, বরেরা তখন সময় নিয়ে আটঘাট বেঁধেছে। এমন নিখুঁত ষড়যন্ত্রের জাল পেতেছে যে, এখন আমাদের বাড়িটা পর্যন্ত তাদের দখলে। আশালতা পালায় নাই। তারা ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

আমরা প্রতি সন্ধ্যায় পার্কের বেঞ্চিতে বসে আশালতার জন্য অপেক্ষা করি। ও যদি বরদের ভয়ে বাড়ি ফিরতে না চায় তো একবার পার্কে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারে। পার্কে শিশুরা খেলা করে, দোলনায় চড়ে, কাপড় ভিজিয়ে আইসক্রিম খায়। আমরা তাদের মাঝখানে আশালতাকে খুঁজি। পাই না। বাদামবিক্রেতা পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায়, লোকজন লেকের পানিতে বড়শিতে মাছ ধরে, ফেরিঅলা ঝুমঝুমি বাজিয়ে চলে যায়। তাদের কাজে ও ধ্যানে আশালতার সন্ধান করি। লেকের অন্ধকার জলরাশির দিকে তাকিয়ে আমাদের মনে হয়, আশালতার কি মরার সময় হয়ে গেল? ও কি বাড়ি গেছে মরতে? অজানা এক গাঁয়ের নদীর কিনারে অন্ধকারে চিতা জ্বলে ওঠে। আমাদের ত্যাগ করে আশালতার বেঁচে থাকার স্বার্থপরতা আমরা মানতে পারি না। রাতে বাড়ি ফিরে তালাবন্ধ ঘরের সামনে দাঁড়াই। বরেরা সস্নেহে আমাদের কাঁধে হাত রাখে, ‘বুঝলা, ঘরটা কয়দিন বন্ধই থাক। আগে তোমাদের মন ভালো হউক। তখন কওয়া লাগব না। আপনেই দুয়ার-দ্বার খুইল্যা দিমু নে। তখন মন ভইর‌্যা আশালতার ম্যাজিক দেইখ্য, কেমন?’

আমরা আবার সাপ-স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। সাপের ভয়ে না-ঘুমিয়ে রাত জাগি। ঘুমে চোখ ভেঙে এলে বিছানায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসি। এক ঘুমহীন রাতে আশালতার ঘর থেকে নড়াচড়ার আওয়াজ আসে। ওই ঘরের প্রাণস্পন্দন আমাদের রোমাঞ্চিত করে। বহুদিন পর শরীরগুলো জেগে ওঠে। আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াই। বরদের বালিশের তলা থেকে চাবি নিয়ে বন্ধ ঘর খুলি। কে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্ধকার ঘরের ভেতর উঠে বসে, আড়মোড়া ভাঙে, হাই তুলে খোলা দরজার দিকে এগোয়। আমরা রুদ্ধশ্বাসে তার অপেক্ষা করি। আমাদের বুক ফাটার উপক্রম যখন, তখন খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে, বারান্দা পেরিয়ে, সিঁড়ির ধাপে গড়াতে গড়াতে একটা মোটা অজগর সাপ গেট দিয়ে রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে যায়। আমরা মাঝরাতের কুহেলিকায় বুঝতে পারি না, স্বপ্নে দেখা সাপ, না জ্যান্ত সাপ- কে আসলে বেশি ক্ষতিকর।

 

 

প্রশ্নোত্তর

শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?

শাহীন আখতার: শুরুতে কোনো তাড়না ছিল না। লেখার প্রতি ভালোবাসা থেকে কাগজে-কলমে মকশো করেছি। আমার লেখালেখি নিরবচ্ছিন্ন নয়। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, কাছের বা দূরের বিষয়/ঘটনা লম্বা লম্বা বিরতির পর লিখতে বসিয়ে দিয়েছে। লেখালেখির একেকটা পর্যায়ে এই তাড়না আসছে একেক জায়গা থেকে। ইদানীং, যেমন একটা উপন্যাস লেখা শেষ হলো তো গল্প লেখার তাড়না আসলো। আসলে আমি যখন উপন্যাস লিখি, তখন গল্প লিখতে চাই না। তখন গল্পের বিষয়গুলি জমতে থাকে। আর প্ল্যানও করি যে, আগে উপন্যাসটা শেষ হোক, তারপর লিখতে বসব, মানে গল্প।

লেখার আগ্রহই মনে হয় আমাকে গল্প লেখার জগতে এনেছে।

শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?

শাহীন আখতার: আমার মনে হয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, পঠনপাঠন, চর্চার মাধ্যমে যা শিখি, শিখতে চাই বা বুঝতে চাই– সেই শেখা, বোঝার প্রক্রিয়াটাই আমার গল্পের আকার দেয়।

শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।

শাহীন আখতার: সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব সবসময়ই মনে হয়, কিছু লেখায় থাকে, কিছু লেখায় থাকে না। একজন লেখকেরও এমন দুরকমের লেখা থাকতে পারে। কিন্তু লেখায় সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতা থাকতেই হবে– আমি এ চাপাচাপির বিপক্ষে। লেখককে স্বাধীনভাবে লিখতে দেওয়া উচিত। তাহলে সমাজ, রাজনীতির জন্য উপকারী কিছু লেখা বেরোতেও পারে।

শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।

শাহীন আখতার: গল্প পড়ে কাঁদা! সেটা ছোটোবেলায়। যেমন পোস্টমাস্টার পড়ে রতনের জন্য কানছি।

চিন্তা ও বোধকে নাড়া দেওয়ার মতো গল্প অগণিত। নানা বয়সে, মনের ভিন্ন ভিন্ন  অবস্থায় নাড়া দিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে। আবার কিছু গল্প উঠে আসছে চিন্তা ও বোধকে নাড়া দেবে বলে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।

শুদ্ধস্বর:  আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?

শাহীন আখতার: ফর্ম ভাঙা-গড়ার পণ নাই আমার। মানে সেরকম পণ করে লিখতে বসি না। গল্পের বিষয়টা নিয়েই ভাবি। অপেক্ষা করি- কীভাবে লিখব। ভাবি। ভাবনাগুলি টুকে রাখি আজকাল, মনে থাকতে চায় না বলে। কখনও কখনও হঠাৎ নিশানা পেয়ে যাই। আলো দেখতে পাই। এখন যে গল্পটা লিখছি, যার বয়ানে গল্পটা, তাকে ‘তিনি’ করে দিতে দেখি- গল্প গতি পেয়ে গেছে! এমন সামান্য অদলবদলেও মিরাকেল ঘটে। তবে উপন্যাস লেখার পর, কিছু সময় গল্প লেখাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?

শাহীন আখতার: কীভাবে একটা গল্প সার্থক হয়ে ওঠে, সেই প্রক্রিয়া জানা থাকলে তো কথাই ছিল না! কখনও কখনও কিছু ইশারা পাই। তাতেই ধন্য।

শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখককের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

শাহীন আখতার: এ প্রশ্নের একটি পাল্টা প্রশ্ন আমার- লেখকের রাজনৈতিক বোধ গুরুত্বপূর্ণ কি তার নিজের লেখার জন্য না সমাজের জন্য? সাহিত্য রচনায় স্বতঃস্ফূর্ততা একটা জরুরি শর্ত। এ সমস্ত আরোপণ সাহিত্য, সমাজ কোনো ক্ষেত্রেই ভালো কিছু বয়ে আনে না।

রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের ভূমিকা কী হবে, সেটা লেখককে ঠিক করতে দেন। তিনি লিখবেন না স্লোগান দিবেন না ফেসবুক গরম করবেন এবং কোনটা করে আনন্দ পাবেন- সেটা আমার-আপনার চেয়ে উনিই ভালো জানবেন।

শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!

শাহীন আখতার: একটু আগে যে গল্পটার কথা বললাম, এই মুহূর্তে সেটাই লিখছি।

আমার সর্বশেষ উপন্যাস ‘এক শ এক রাতের গল্প’-এর রেশ এখনও আমার মধ্যে আছে। পাঠকদের আমার এ উপন্যাসটা পড়তে বলি।

More Posts From this Author:

    None Found

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!