English Synopsis
In several societies, critisizing or disobeying social norms and rules is treated as blasphemous. This type of practice is not regulated by the law of the state, but its informal trial and verdict can be as punitive as formal blasphemy laws. This type of practice can be termed ‘Social Blasphemy.’ It can be further classified as religious, political, cultural, and local social blasphemy. ‘Religious-social blasphemy’ is fixed by interest of the prevailing religious group of an area. When critisizing leaders, deeds, or policies of a political group becomes blasphemous, then it can be marked as ‘Political-social blasphemy.’ If critisizing any cultural figure or group, their works and norms becomes blasphemous, then it can be called ‘Cultural-social blasphemy.’ When someone challenges local norms and beliefs, then in some places it can be treated as blasphemy. This type of blasphemy can be called ‘Local-social blasphemy.’ Local groups that execute informal social blasphemy laws try to cohere with ruling parties of the state or with the state itself. It is a symbiotic relationship where each group takes the help from the other in order to remain in power and to harvest personal benefits. Fighting against social blasphemy thus needs long-term and far-reaching organizational activities to develop consciousness among people to form a rational, humane, and secular society.
ইংলিশ Blasphemy শব্দটিকে বাংলায় সাধারণত ‘ঈশ্বরনিন্দা’ বলা হয়, কিন্তু ব্লাসফেমির সংজ্ঞার্থ বিবেচনায় ‘ঈশ্বরনিন্দা’ শব্দটি যথার্থ হয় না। তাই বাংলায় যতক্ষণ পর্যন্ত না এর একটি যথার্থ ও লোকমান্য প্রতিশব্দ আবিষ্কৃত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ব্লাসফেমি শব্দটি ব্যবহারই সঙ্গত হয়। অভিধানগুলোতে প্রদত্ত সংজ্ঞার্থ অনুসারে ঈশ্বর, দেবতা, ধর্মীয় পবিত্র কিছু, সাধারণভাবে পবিত্র বা প্রশ্নাতীতভাবে শ্রদ্ধেয় বলে বিবেচ্য হয় এমন কিছু সম্পর্কে অশ্রদ্ধা প্রকাশ বা ব্যঙ্গ করা বা অবমাননা করাকে ব্লাসফেমি বোঝায়। এই সংজ্ঞার্থে সমালোচনা করার কথা উল্লেখ করা না হলেও কার্যক্ষেত্রে সমালোচনাকে অবমাননা বা বিদ্রুপ হিসাবে বিবেচনা করে সেটিকেও ব্লাসফেমি হিসাবে গণ্য করা হয়। এই সংজ্ঞার্থে এটি স্পষ্ট যে, ধর্মীয় বিষয়াদির বাইরে যদি কোন কিছুকে ঐশ্বরিক পর্যায়ের গুরুত্ব দেয়া হয় তবে তার প্রতি অশ্রদ্ধাকর (কার্যত সমালোচনামূলক) কিছু প্রকাশ করাও ব্লাসফেমি বলে গণ্য হবে। যেমন, অনেক দেশে জাতির পিতা, জাতীয় বীর, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য লড়াই করা যোদ্ধা এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ধর্মীয় পবিত্রতাতুল্য জ্ঞান করা হয়। ফলে ঐসমস্ত বিষয়াদি সম্পর্কে অশ্রদ্ধাকর (কার্যত সমালোচনামূলক) কিছু প্রকাশ করাও ব্লাসফেমি হিসাবে গণ্য হয়ে যায়। সাধারণত ব্লাসফেমি বলতে আনুষ্ঠানিক আইনের আওতাভুক্ত বিষয় বোঝায়। শাস্তির মাত্রা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে এটি —(ক) মৃত্যুদণ্ড যোগ্য, (খ) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যোগ্য, (গ) কারাদণ্ড যোগ্য, (ঘ) জরিমানা ও সাধারণ নিষেধাজ্ঞা যোগ্য, এবং (ঙ) স্থানীয় নিষেধাজ্ঞা যোগ্য অপরাধ বলে শ্রেণীবদ্ধ।
যে সব দেশে সরাসরি ব্লাসফেমি আইন নেই তার অনেকগুলোতে এমন অনেক আইন বিদ্যমান আছে অথবা অন্য আইনের ভেতরে এমনসব ধারা যুক্ত আছে যা কার্যত ব্লাসফেমি আইনের অনুরূপ বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন, বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ যেখানে কিছু কিছু কাজকে ব্লাসফেমির অনুরূপ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, এবং সেসব অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৩ (তিন) কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আইনে নেই এমন অনেক ক্ষেত্রে অলিখিত সামাজিক বিধি থাকে যা কার্যত ব্লাসফেমির অনুরূপ হয়ে থাকে। এই প্রকার অনানুষ্ঠানিক ও অলিখিত ব্লাসফেমিকে ‘সামাজিক ব্লাসিফেমি’ বলা যেতে পারে। সামাজিক ব্লাসফেমির শাস্তি আইনবদ্ধ ব্লাসফেমির মতো স্বল্পমাত্রার শারিরীক বা আর্থিক শাস্তি থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রে আদালতে আনুষ্ঠানিক বিচার না করে শাস্তি দেবার বিধি না থাকলেও বাস্তবে অনেক দেশে তা অনুসৃত হয় না। ফলে রাষ্ট্রের সমান্তরালে শক্তিশালী সংগঠন হিসাবে স্থানীয় সমাজ কাউকে সামাজিক ব্লাসফেমিতে অভিযুক্ত করে, বিচার করা, শাস্তি দেয়া ও তা কার্যকর করা পর্যন্ত করে ফেলতে পারে। অনানুষ্ঠানিক ও অলিখিত সামাজিক ব্লাসফেমিকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় যথা, (১) ধর্মীয়, (২) রাজনৈতিক, (৩) সাংস্কৃতিক এবং (৪) স্থানীয়। এর প্রত্যেকটির স্বরূপ আলোচিত হল।
(১) ধর্মীয়-সামাজিক ব্লাসফেমিঃ এই প্রকার ব্লাসফেমি একটি লোকালয়ের প্রভাবশালী এক বা একাধিক ধর্মীয় গোষ্ঠীর পবিত্র বিষয়াবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়। যে ধর্মীয় গোষ্ঠীটি ঐ স্থানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আছে তার সাথে যে গোষ্ঠীটি আর্থিক বা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী সেটিও কর্তৃত্ব করে। যেমন, কোন শহরে মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু রাজনীতি বা ব্যবসায়ের কর্তৃত্ব হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে থাকলে সেক্ষেত্রে সেখানে ইসলামের সাথে সাথে হিন্দু ধর্মের বিষয়গুলোও গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। এই প্রকার সামাজিক ব্লাসফেমিতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে ব্লাসফেমি সংক্রান্ত কোন আইন প্রণীত না হয়ে থাকলেও ঐ শহরে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের কিছু নিয়ে সমালোচনা ব্লাসফেমি হিসাবে গণ্য হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই প্রকার ব্লাসফেমি শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা তাদের অনুকূলে হয়।
যেমন, বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে বিশেষ কোন ইসলামী গোষ্ঠীকে প্রভাবশালী হিসাবে দেখা যায় এতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর ‘লাল সালু’ উপন্যাসে যেমন বলেছিলেন, “শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি” — অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এতে তদঞ্চলে ইসলাম সংক্রান্ত ব্যাপারে নূন্যতম সমালোচনাও স্থানীয়ভাবে ব্লাসফেমি হিসাবে চিহ্নিত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়। ২০১২ সালের ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার রামুতে সামাজিক মাধ্যমে ইসলাম, কোরান ও নবী মুহাম্মাদকে অবমাননার কথিত অভিযোগে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর, ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নাসিরনগরে সামাজিক মাধ্যমে ইসলাম বিদ্বেষী ছবি দেবার কথিত অভিযোগে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুর জেলার গঙ্গাচড়ায় সামাজিক মাধ্যমে নবী মুহাম্মাদকে অবমাননার কথিত অভিযোগে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত সহিংস হামলার ঘটনাবলী এই প্রকার ব্লাসফেমি চর্চ্চার উদাহরণ। পরম বিচারে এই ঘটনাগুলো বানোয়াট কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিকল্পনায় সংঘটিত বলে প্রমাণিত হলেও এখানে হামলায় অংশগ্রহনকারী সাধারণ মুসলিমদের আচরণে ধর্মীয়-সামাজিক ব্লাসফেমির বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই প্রকার ব্লাসফেমির একটি সাবসেট হচ্ছে ধর্মের লোকায়ত অংশসংক্রান্ত ব্লাসফেমি। এতে একটি এলাকার কোন পীর বা ধর্মগুরু ও তার মতবাদ নিয়ে সমালোচনা ব্লাসফেমি হিসাবে গণ্য হয়। যেমন, এক সময়ে গুরমীত রাম রহিম সিং ইনসানের কার্যকলাপ নিয়ে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ডেরা সাচা সৌদা অঞ্চলে কোন প্রকার সমালোচনা ব্লাসফেমি হিসাবে গণ্য হত এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি তার অনুসারীদের দ্বারা অপদস্থ বা নির্যাতিত হতেন।
(২) রাজনৈতিক-সামাজিক ব্লাসফেমিঃ পরম বিচারে সকল প্রকার ব্লাসফেমিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। একটি বিশেষ গোষ্ঠী অন্যদের ওপর যে কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে অথবা ক্ষমতাকে নিজেদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করে ব্লাসফেমি তার একটি উপায় হিসাবে কাজ করে। কিছু সামাজিক ব্লাসফেমি আছে যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস জড়িত নয়। যখন একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদ, একজন বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অথবা একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিবার ধর্মের ন্যায় প্রশ্নাতীত আস্থা ও মান্যতার দাবিদার হয়ে দাঁড়ায় তখন তাদের সমালোচনা ব্লাসফেমির পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে। এই প্রকার গোষ্ঠী সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী বা অংশীদার হলে তারা এটিকে আইনে রূপান্তর করতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটির ওপর ঐশ্বরিক মহিমাও আরোপিত হতে পারে। যেমন, বর্তমান বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, এর প্রয়াত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৃহত্তর পরিবারের সদস্যরা, এবং এই সরকারের কার্যকলাপ উগ্রপন্থী আওয়ামী লীগারদের কাছে ব্লাসফেমি পর্যায়ের অপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য। প্রায়ই এই প্রকার ‘অপরাধের’ জন্য কোন প্রকার বিচার ছাড়া অভিযুক্তকে স্থানীয়ভাবে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। আবার কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ বা অনুরূপ কোন অবমাননা আইনে মামলা দায়ের করে শাস্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। যেমন, ২০১২ সালে সামাজিক মাধ্যমে প্রদত্ত অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত পোস্টকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি বলে চিহ্নিত করে দায়েরকৃত মামলায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক হাফিজুর রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
(৩) সাংস্কৃতিক-সামাজিক ব্লাসফেমিঃ এই প্রকার ব্লাসফেমি বিশেষ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, গোষ্ঠী বা ধারার সাথে সংশ্লিষ্ট। এখানে এদের কোন প্রকার সমালোচনা, বিদ্যমান চর্চ্চার পরিবর্তনের চেষ্টা ব্লাসফেমি হিসাবে গণ্য হয়। এই প্রকার ব্লাসফেমি অভিযুক্তকে স্থানীয় নিষেধাজ্ঞার চেয়ে বেশি শাস্তি দিতে সক্ষম না হলেও এতে অভিযুক্ত ব্যক্তি একঘরে হয়ে পড়তে পারেন যা তাঁর জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। যেমন, সামাজিক মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানকে বিকৃতভাবে পরিবেশনের অভিযোগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বেলেঘাটা থানায় ১০ মার্চ ২০২০ সালে ‘শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠন অনির্বাণ রায় ওরফে রোদ্দুর রায়ের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। সংগঠনটি সারা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বিভিন্ন থানায় রোদ্দুর রায়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের উদ্যোগ নেবে বলেও জানায়। ইতিপূর্বে, ৫ মার্চ ২০২০ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে দোল উৎসব চলাকালে কিছু ব্যক্তি তাঁদের পিঠে ও বুকে রোদ্দুর রায়ের গাওয়া কথিত বিকৃত রবীন্দ্র সঙ্গীত আবীর দিয়ে লিখলে সেটির ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিঁথি থানায় অভিযোগ করলে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ সংশ্লিষ্টদের থানায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
(৪) স্থানীয় সামাজিক ব্লাসফেমিঃ এই প্রকার ব্লাসফেমির পরিসীমা অঞ্চলভিত্তিক এবং এর উৎস স্থানীয় আচার বা বিশ্বাস। সাধারণত কোন বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ কোন বিশ্বাস বা আচারের সমালোচনা বা অমান্য করাকে ব্লাসফেমি হিসাবে গণ্য করা হয়। এই প্রকার ব্লাসফেমির শাস্তি ও প্রতিক্রিয়া প্রায়ই ভয়াবহ হয়ে থাকে। যেমন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কোন নারীর স্বামী দীর্ঘ সময়ের জন্য সুন্দরবনে কাজ করতে গেলে তাঁর ওপর অন্য পুরুষের সাথে কথা বলা, চুল আঁচড়ানো বা তেল মাখা, প্রসাধনী ব্যবহার করা, রান্নার জন্য ভাজা-পোড়া করার ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে সামাজিক নিষেধাজ্ঞা থাকে। এর সমালোচনাকারী ও অমান্যকারীকে সামাজিকভাবে একঘরে করা হয়ে থাকে। সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে কোন পুরুষ নিহত হলে তাঁর স্ত্রীকে এই ব্যাপারে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাঁকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করে একঘরে করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁদেরকে দ্বিতীয়বার বিবাহ করতেও বাধা দেয়া হয়। এই প্রকার রীতির বিরোধিতাকারী, সমালোচনাকারী ও অমান্যকারীকে শারিরীক শাস্তি, জরিমানা করার পাশাপাশি কখনো কখনো একঘরেও করা হয়ে থাকে।
সামাজিক ব্লাসফেমি রাষ্ট্রকর্তৃক বিধিবদ্ধ ব্লাসফেমির মতোই ব্যক্তির চিন্তা, মতপ্রকাশ, আচরণ ও সংঘপ্রচেষ্টাকে নিয়ন্ত্রণ করার ও অবদমিত করার চেষ্টা করে; অমান্যকারীকে শারিরীক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক শাস্তি প্রদান করার চেষ্টা করে। ক্ষমতাকাঠামো বা কর্তৃত্বকাঠামো সংলগ্ন গোষ্ঠীগুলো তাদের পছন্দনীয় রীতির ব্যতয়কে অস্বীকার বা অগ্রাহ্যকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে শাস্তিপ্রদান করে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্য রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে তখন খোদ রাষ্ট্রও স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর সহায়ক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। এতে পূর্বে বিধিবদ্ধ ব্লাসফেমি আইনে নতুন সংযোজন ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীলতা ও ইহজাগতিকতা বিরোধী কার্যক্রম পরিণতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তৃত্ববাদী নীতি, ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল এবং প্রগতিশীল ও সরকারের নীতির সমালোচক গোষ্ঠীগুলোকে নির্মূলে সহায়ক বলে এরা একে অপরের সহায়ক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এবং আওয়ামী লীগ সরকার হেফাজতে ইসলামকে সরকারী জমি প্রদান, আর্থিক সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি তাদের স্বার্থের অনুকূলে প্রায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীস সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তরের সমপর্যায় প্রদান করেছে। তাছাড়া ইতিপূর্বে প্রণীত আইসিটি আইনকে পরিমার্জন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এ ধর্মের নূন্যতম সমালোচনার পথ আইন করে রুদ্ধ করা হয়েছে।
একটি রাষ্ট্রের শুরুতে ব্লাসফেমি আইন নাও থাকতে পারে। কালক্রমে সামাজিক গোষ্ঠীগুলো তাদের চাহিদা অনুসারে রাষ্ট্রের ওপর এই প্রকার আইন প্রণয়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করে থাকে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীগুলোর ওপর নির্ভরশীল বলে স্থানীয় পর্যায়ের চাপ কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের অনুকূল পরিস্থিত সৃষ্টি করে। অনানুষ্ঠানিক সামাজিক ব্লাসফেমি এইভাবে আনুষ্ঠানিক ব্লাসফেমি আইনে পরিণত হতে পারে।
সামাজিক ব্লাসফেমি লড়াই করা খুব সহজ নয়। এখানে আনুষ্ঠানিক কোন আইন বা বিধি না থাকায় কোন কিছু রদ করার উপায় নেই। স্থানীয় ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর ক্ষমতার উৎস বুঝে সেখানে আঘাত করার বা পরিবর্তন আনার জন্য বিপুল ও সুপরিকল্পিত সাংগঠনিক কার্যক্রম আবশ্যক হয়। তার পুর্বে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে সক্ষমতা অর্জন করতে হয়। এর কোনটিই সহজে এবং দ্রুত অর্জন সম্ভব নয়। বস্তুত এই কারণে রাজনৈতিক-সামজিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্লাসফেমিকে প্রশমণ করা সম্ভব হলেও সামাজিক পর্যায়ে এর প্রশমণ করা খুব সহজ নয়।
রাষ্ট্র একটি যুক্তিনির্ভর, মানবিক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধসম্বলিত, ঐহিক সমাজ গঠনে অগ্রসর হলে যেসব কর্মসুচী নেয় যথা, মৌলিক চাহিদার যোগান, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক সুরক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিযুক্তিকরণ ইত্যাদি সেগুলো সামাজিক ব্লাসফেমির উদ্ভব বা প্রসারকে হ্রাস করতে পারে। এটি দুটি উপায়ে অর্জিত হতে পারে — প্রথমত, জনমত গঠন করে রাষ্ট্রের ওপর এই সকল বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করা বা ক্ষমতার অংশীদার গোষ্ঠীগুলোকে অনুকূলে এনে তাদের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়ত, বৈপ্লবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে প্রগতিশীল ও মানবিক কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়। উভয় ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনের জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন আবশ্যক যার জনভিত্তি শক্তিশালী, বিস্তার ব্যাপক এবং নেতৃত্ব দৃঢ়।
সমাধান যদি উপরোক্ত অবরোহী পদ্ধতিতে সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী আরোহী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সেটি আর কিছু নয় — সাধারণ মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যুক্তিনির্ভর, মানবিক, ঐহিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই ক্ষেত্রে সংগঠন ও নেতৃত্বে দৃঢ়তার সাথে ধারাবাহিকতা আবশ্যক।
Sameer Chowdhury is a writer and online activist. He likes to write mainly on contemporary issues in South Asia. He is interested in constructing new commentaries by examining the conventional political history from the point of view of the lower class people.