সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদ, সহিংসতা ও সংখ্যাগুরুবাদী চৈতন্য প্রসঙ্গে

Share this:

পরিস্থিতির বিবরণ

এক ভয়াবহ বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সদ্যই বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার বেদনাদায়ক ‘উদযাপন’ সম্পন্ন হয়েছে। কুমিল্লায় দুর্গাপূজার এক মণ্ডপে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় কেতাব কোরআন পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতভিটা-ব্যবসা বাণিজ্য-জানমাল ও মন্দির-মণ্ডপে যে তাণ্ডব শুরু হয়েছিল, তা লাগাতারভাবে বিগত কয়েকদিন বাংলাদেশের আপামর মানুষকে প্রবল এক ঝাঁকুনি দিয়েছে। প্রচণ্ড তীব্রতায় দেশের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। এই সহিংসতা আপাতত স্তিমিত হলেও, সহিংসতার সমস্ত শর্ত এখনও বহাল তবিয়তেই আছে। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের এক ধরনের নিরবতা/নিষ্ক্রিয়তা, সাথে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ধরনের গুজব বা ফেক নিউজের কারণে সহিংসতার পূর্ণ চিত্র এখনও বোঝা যাচ্ছে না। বিশেষ করে নানামুখী জটিল চেহারা ধারণকারী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যাবতীয় হিসাব-নিকাশ এবং জাতীয় ও স্থানিক শর্তগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য মাঠপর্যায় থেকে যে ধরনের সংবাদ বা স্টাডি আসার কথা তা এখনও আসেনি। কিন্তু উত্তাপ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে পুরোমাত্রায়। কিছুদিন আগ পর্যন্তও প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনো না কোনো স্থানে মন্দিরে আগুন দেয়া বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাড়ায় আগুন দেয়া বা ‘তৌহিদি জনতা’র হাতে কারো প্রাণ হারানোর মর্মান্তিক দুঃসংবাদ পাওয়া যাচ্ছিল। যে বন্ধুকে কখনও ‘হিন্দু’ বলে আলাদাভাবে ভাবতে হয়নি, হঠাৎ করে তাকে ‘হিন্দু’ বলে তার খোঁজ নেয়ার জরুরত দেখা দিয়েছে। বহতা নদীর চোরাস্রোতের মতো যে পরিচয় বহন করে চলি, আলাদা করে যার অস্তিত্ব কখনও খতিয়ে দেখতে হয় না, এ ধরনের সহিংস মুহূর্তগুলোতে সেই পরিচয় যেন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িক ও পরিচয়-তাড়িত এ ধরনের সহিংস মুহূর্তগুলোতে আমরা যেন আরও গভীরভাবে ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’, ‘বাঙালি’, ‘আদিবাসী’ হয়ে উঠি।

এমন উত্তপ্ত অবস্থাতেও প্রাপ্ত সংবাদ ও ভুক্তভোগীদের বিবরণ থেকে যে ধরনের আলামত টের পাওয়া যাচ্ছে তা উপমহাদেশের অন্যান্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে খুব একটা পৃথক নয়। মন্দিরে মুসলমানদের পবিত্র কেতাব কোরআন রাখা থেকে শুরু করে পরবর্তীতে মন্দিরে বোমা পাওয়ার সংবাদ, এইসব কিছু যেমন পরিকল্পিত ও সংগঠিত হামলার ইঙ্গিত প্রদান করে; তেমনি এ সকল হামলাতে দাঙ্গাবাজ ‘তৌহিদি জনতা’র বিপুল সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে। দাঙ্গাবাজ ‘তৌহিদি জনতা’ যে ভাষায় ‘সংখ্যালঘু’ হিন্দুদের আক্রমণ করেছে, তা বাংলাদেশের সমাজে জারি থাকা সংখ্যাগুরুর দাপুটে দৈনন্দিন অবস্থানের বাস্তবতাই হাজির করে এবং ‘অপর’ তৈরির কাঠামোগত কলকব্জার সন্ধান দেয়। তবে, কুমিল্লার ঘটনার অব্যবহিত পর দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে লাগাতারভাবে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক হামলা থেকে প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং [সরকারের] সক্রিয় নিষ্ক্রিয়তাও লক্ষ্যণীয়। এই প্রবন্ধের লেখকদ্বয়ের অন্তত একজন আক্রান্ত স্থানগুলো সরেজমিনে প্রদর্শন করতে গিয়ে সার্বিক প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা ও নির্লিপ্তি প্রত্যক্ষ করেছেন। এমনকি, কিছু স্থানে হামলা সংগঠনে আওয়ামীলীগ নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছে। তবে শুধুমাত্র আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরাই নন, ‘তৌহিদি জনতা’র ফর্মেশনে দেশের অন্যান্য ক্ষমতাপন্থী রাজনৈতিক পক্ষের অংশগ্রহণও দেখা গেছে। সবমিলিয়ে এই পরস্পর বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষ মিলেমিশে এক সহিংস সংখ্যাগুরুবাদী সংস্কৃতি পয়দা করেছে। পুরো চালচিত্র এখনও পাওয়া না গেলেও, অন্তত এটুকু পরিস্কার যে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য যে ধরনের ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি জারি থাকা দরকার, তার রসদ বেশ কড়াভাবেই বিদ্যমান রাষ্ট্রপ্রণালী সরবরাহ করে চলেছে। উল্লেখ্য, আওয়ামী রেজিমে এ পর্যন্ত যতগুলো হামলা হয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর, সবগুলোতে আওয়ামীলীগের নেতাদের অংশগ্রহণ স্পষ্ট। কখনও কখনও দলীয় অন্তর্কোন্দলের ‘বলির পাঠা’ বানানো হয়েছে হিন্দুদের। নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় অংশ নেয়া (এবং অভিযুক্ত) ব্যক্তিদের নির্বাচনে মনোয়ন দেয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাথে এই রেজিমের পিরিতির দগদগে স্মারক।

 

ব্যর্থতা নাকি সক্রিয় নিষ্ক্রিয়তা?

এই মাসের ১২ তারিখে, দুর্গাপূজার প্রাক্কালে, র‍্যাব জানিয়েছিল, দুর্গাপূজায় নাশকতা ও জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নেই। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘটা করেই তা বলা হয়েছিল। নাশকতা ঠেকাতে র‍্যাব কী কী প্রস্তুতি নিয়েছিল তার বিবরণও সেদিনের প্রকাশিত সংবাদ থেকে পাওয়া যায়: “সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজায় সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কেউ যাতে কোনো গুজব, অপপ্রচার ও জঙ্গি হামলার তৎপরতা চালাতে না পারে সেজন্য সাইবার মনিটরিং করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে জঙ্গি হামলা বা নাশকতার কোনো তথ্য (আশঙ্কা) নেই।… উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা উদযাপনে দেশের প্রতিটি পূজামণ্ডপে র‍্যাবের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা থাকবে। সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় র‍্যাব পর্যাপ্তসংখ্যক সদস্য মোতায়েন ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে। র‍্যাবের এয়ার উইংয়ের হেলিকপ্টারও সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পূজামণ্ডপসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্যুইপিং পরিচালনার পাশাপাশি র‍্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, র‍্যাব স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো টিমও প্রস্তুত রয়েছে। যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য র‍্যাব ডগ স্কোয়াডকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। র‍্যাব ডগ স্কোয়াড সার্বক্ষণিকভাবে পূজামণ্ডপ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রয়োজনীয় স্যুইপিং কার্যক্রমে অংশ নেবে।” বেশ যুদ্ধংদেহী প্রস্তুতি! অথচ, কয়েকদিনব্যাপী লাগাতার সহিংসতার মহড়া চলাকালীন, রাষ্ট্র-প্রশাসন বলতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব আদৌ টের পাওয়া যাচ্ছিল না।

অন্যদিকে, গবেষকরা বেশ আগেই জানিয়েছেন, কীভাবে স্বৈরতন্ত্র কায়েম, রাজনৈতিক ময়দানে তীব্র দ্বন্দ্ব ও সামাজিক ময়দানে ইসলামি আন্দোলনের অস্তিত্ব এই তিনের যুগপৎ মিশেলে ‘সেকুলার’ আওয়ামী রেজিম ইসলামিকরণের দিকে ঝুঁকেছে। কর্তৃত্বপরায়নতা, অভিজাত-বিরোধীতা এবং জাতিবাদ— ‘র‍্যাডিকেল ডানপন্থা’র এই তিন প্রধান বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের মধ্যেও লক্ষণীয়। এটা উল্লেখ করার কারণ এই যে, পরিকল্পিত ঘটনার নাটেরগুরুদের সাথে আক্রমণে যুক্ত হওয়া সহিংস ‘তৌহিদি জনতা’কে মবিলাজ করার মতাদর্শিক ভাষা সমাজে মজুদ করার ক্ষেত্রে ইসলামপন্থীদের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই। ওয়াজ-মাহফিল ও সোশ্যাল মিডিয়ার পরিসরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও ধর্মের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় আগ্রাসী রাজনীতির সমালোচনা করতে গিয়ে ভারত রাষ্ট্র ও হিন্দুত্ববাদ এর সাথে সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী হিন্দুদের গুলিয়ে ফেলার যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে সমাজে ‘অপরায়ন’এর শর্ত তৈরি হয়েছে। সহিংসতার বিরুদ্ধে ফেসবুকে কয়েকজন ইসলামি বক্তার ওয়াজ-নসিহত ছড়ালেও সেটা এই পরিস্থিতিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে নাই, বরঞ্চ ইসলামপন্থী দলগুলোর নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করেছে।

 

আলোচনার গৎবাঁধা ছক

কুমিল্লা, হাজিগঞ্জ, চৌমুহনী, লামা, পীরগঞ্জ, কক্সবাজারসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বাস্তবতায়, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এন্তার আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এসব আলোচনাকে প্রধান কয়েকটি প্রবণতার মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব। দাঙ্গা নিয়ে লিখতে গিয়ে ইতিহাসবিদ জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে খেয়াল করেছিলেন, খোদ সহিংসতা নিয়ে যেন কারো কিছু বলার নেই! সকলেই যেন সহিংসতা, হামলার রূপরেখা সম্পর্কে আগে থেকেই ওয়াকিবহাল! ফলে খোদ সহিংসতার ইতিহাস আলোচনার আড়ালে থেকে যায়, সহিংসতার পটভূমি ও পরিপ্রেক্ষিত মুখ্য হয়ে ওঠে। সহিংসতা নিয়ে নতুন কোন অনুসন্ধানের প্রয়োজন আর কেউ অনুভব করে না। দেশভাগ ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সুমহান প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস, হিন্দু-মুসলমান সংঘাত নিতান্তই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৌণ ঘটনা হিসেবে দেখার চল বহু পুরানা। যদিওবা কদাচিৎ, সাম্প্রদায়িকতা আলোচনায় আসে, সেক্ষেত্রেও আসল কর্ণধার দেখানো হয় সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের, যারা কলকাঠি নেড়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত জিইয়ে রাখত।

আমরা এক প্রকারের বিপন্নতার বোধসহ লক্ষ্য না করে পারি নাই যে, আলোচনা ও বিশ্লেষণের এই ছকই এখনও প্রধান ছক। পার্থক্য শুধু এই যে, এখন সাম্রাজ্যবাদকে দায়ী করা অতি হাস্যকর লাগবে বিধায় সবক্ষেত্রেই রাষ্ট্র-রাজনীতি-সরকার কিংবা পার্শ্ববর্তী দেশের সংশ্লিষ্টতা খোঁজার প্রবণতাটাই প্রধান। এটা মনে করার কোনো কারণই নেই যে, রাষ্ট্র-রাজনীতি-অর্থনীতি-ভূরাজনীতির স্বার্থ ও দ্বন্দ্বগুলোর কোনো ভূমিকা থাকে না। আলবৎ ভূমিকা থাকে। কিন্তু আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি, মানুষের জীবন ও সামাজিক মনস্তত্ত্ব কেবলই কতগুলো বস্তুগত স্বার্থের অধীন কিনা, নাকি এর অতিরিক্ত কিছুও আছে? প্রশ্নটা আরেকভাবেও করা যায়, চৈতন্য কি আবশ্যিকভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল? মানুষ কি কেবলই কতগুলো ‘নৈর্ব্যক্তিক’ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সূত্রের ঘুঁটি? কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনার ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ কি একেবারেই থাকে না? জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে উল্লেখিত প্রবন্ধে লিখেছেন: সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির পেছনে জমি বা সম্পত্তির ভূমিকার গুরুত্বকে অস্বীকার করা কিন্তু আমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য নয়। শুধু এইটুকু বলা যে ওইসব উপাদানগুলির ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও বোধের জায়গাগুলো হারিয়ে যায়, এক কথায়, তাদের সক্রিয়তাকে উপেক্ষা করা হয়। বর্তমান প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে আমরা দেখানোর চেষ্টা করবো, সাম্প্রদায়িকতাসহ আধুনিক জমানার যে-কোন সহিংসতাকে কেবলই রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সংকীর্ণ বস্তুবাদী ব্যাখ্যার বশবর্তী করে তোলা আদতে ইতিহাস-রচনার এক ধরনের উচ্চবর্গীয় ঝোঁক; যা ‘জন’সমষ্টিকে নিষ্ক্রিয় পুতুলে হিসেবে ধরে নেয় কিংবা জনগণকে ইতিহাসের বাইরে রাখে। ইতিহাস ও রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ হয়ে ওঠে উচ্চবর্গের কলকাঠি নাড়ার অবাধক্ষেত্র।

এ ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বরাবরই একটা বিশেষ উত্তরের প্রত্যাশা লুকিয়ে থাকে। অনেকটা বানানো স্ক্রিপ্টের মতোন। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে পূর্ব-নির্মিত সূত্রগুলো মিলিয়ে অঙ্কের সমাধান করে ফেলাটাই কেবল বাকি থাকে। এভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে ‘আসল’ কারণ উন্মোচন করতে গিয়ে, খোদ সাম্প্রদায়িকতাকে ‘অরাজনৈতিক’ কিংবা ‘ভুল দ্বন্দ্ব’ কিংবা ‘মিথ্যা চৈতন্য’ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।

আরও একটা প্রবণতার কথা না বলাটাও অন্যায় হবে। আগে উল্লেখ করা হয়েছে, অতিমাত্রায় বস্তুবাদী ও রাজনৈতিক কারণ অনুসন্ধানের ঝোঁক। কিন্তু বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি ও এলিট সংস্কৃতি আবার আরেক কাঠি সরস। তাদের আলোচনায় আবার সমস্ত দায় চাপানো হয় সাধারণ মানুষের ওপর। রাষ্ট্র-রাজনীতি-সরকার-প্রশাসন-পুলিশ-আইন কোনোটারই কোনো অসঙ্গতি বা ব্যর্থতা তাদের চোখে পড়ে না, কিন্তু গরীব-মেহনতি জনগণের যেন পান থেকে চুন খসার কোনো জো নেই। মানুষকে ক্রমাগত তাদের অস্তিত্বের জন্য শরমিন্দা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এই এলিট সংস্কৃতির মজ্জাগত। প্রত্যেকটি সহিংসতার পর জনগণ কত অশিক্ষিত ও বর্বর এই ফতোয়া দিতে তারা যতটা ওস্তাদ, তার সিকিভাগ ওস্তাদিও তারা সরকার-রাষ্ট্রের জন্য বরাদ্দ রাখে না।

 

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও হাওয়াই ব্যাখ্যা

আবার, বুদ্ধিজীবী ও অ্যাক্টিভিস্ট মহলের যে অংশ কুমিল্লার ঘটনা নিয়ে আলাপ করেছেন, তাদের আলোচনার প্রায় পুরোটা জুড়ে ছিল নানাবিধ ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান তত্ত্ব ছিল যে, বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ফলে জনমনে যে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছিল, সেখান থেকে জনগণের মনোযোগ ‘সরানো’র জন্যই নাকি এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাঁধানো হয়েছে! কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে জনমনে যে খুব ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল, বা এটাকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ইস্যু বানিয়েছিল, বা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে সরকার ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মুখে ছিল তার কোনো জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে যেটা এই সহিংসতার ‘পরিণাম’ হতে পারতো, সেটাকে এ ধরনের ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ‘কারণ’ হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। অর্থাৎ, সেই একই ক্লান্তিকর ক্লিশে ‘আসল’ কারণ উন্মোচনের চেষ্টা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে ‘মিথ্যা চৈতন্য’ কিংবা নিদেনপক্ষে গৌণ করে দেখানোর প্রবণতা। যেন সাম্প্রদায়িকতাকে কোনো না কোন ‘বস্তুগত’ কারণের ফলাফল হতেই হবে! যেন পরিস্থিতি মোতাবেক খোদ সাম্প্রদায়িকতাই ‘কারণ’ হতে পারে না!

এরপরে আসে ভারতের কলকাঠি নাড়ার তত্ত্ব: ভারত, বিশেষত বিজেপি, তার দেশে নির্বাচনী সুবিধা আদায়ের জন্য (বা, আওয়মীলীগকে চাপে ফেলার জন্য) এই সহিংসতা ঘটিয়েছে— বিপুল সংখ্যক রাজনীতিমনষ্ক মানুষ এই বিবৃতিকে বেদবাক্যের মতো বিশ্বাস করেছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের যে সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে, যেভাবে এক দেশের ঘটনা অন্য দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে, এবং প্রধানমন্ত্রী যেভাবে ভারতকে ইঙ্গিত করে মন্তব্য করেছেন, সে বাস্তবতায় এই ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাথে ভারতের সম্পর্ক থাকতেও পারে, সেটা নিয়ে আলোচনাও হওয়া দরকার। কিন্তু এটাকে ‘কারণ’ হিসাবে দাঁড় করালে স্থানিক সকল শর্ত উবে যায়। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই,ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা মাত্রই স্থানকালিক ব্যাখ্যা। স্থান ও কালকে আমলে না নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করলে, তা জনপ্রিয় হতে পারে, কিন্তু তা অনৈতিহাসিক আধ্যাত্মিকতা ছাড়া আর কিছু হয় না।

ভারতের রাজনীতিতে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একটা প্রভাব পড়বে, সঙ্ঘ পরিবার যে এই সহিংসতা থেকে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে (বিশেষত হিন্দু সমাজের ওপর আক্রমণকে) কেবলই ভারতের ভূ-রাজনৈতিক ঘুঁটির অংশ হিসেবে হাজির করার অর্থ হচ্ছে, জনগোষ্ঠী হিসেবে বিকশিত হওয়া ও অস্তিত্বশীল থাকার ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব সংখ্যাগুরুবাদী জুলুমবাজির অন্ধকার ইতিহাসকে আমলে না নিয়ে অস্বীকার করা।

যদিও ‘বাংলাদেশ আদতে সাম্প্রদায়িক নাকি অসাম্প্রদায়িক’— বরাবরের মতন এবারও একটা বড়ো অংশের আলাপ এমন আজগুবি প্রশ্নে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ ধরনের আলোচনা সারবাদী [এসেনলশিয়ালিস্ট] ও অতি-সাধারণীকরণের দোষে দুষ্ট। কারণ এ ধরনের সারবাদী অনুমান ও ইতিহাসবীক্ষায় মোটেই স্বীকার করা হয় না যে, হিন্দু, মুসলমান, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা, সেক্যুলারিত্ব ইত্যাদি বর্গ ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত হয়েছে এবং ভীষণভাবে সাময়িক, পরিবর্তনসাপেক্ষ ও পরিস্থিতি-নির্ভর। এই ইতিহাসবোধ জনজীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে কতগুলো পূর্ব-প্রদত্ত তাত্ত্বিক-শব্দের খোপে আটকাতে চায়। অসাম্প্রদায়িকতার ভাবালুতায় যাদের আসক্তি, তারা মূলত যুগ যুগ ধরে দুই ধর্মের সহাবস্থানের ওপর জোর দেন এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা ও ‘রাজনৈতিক মহলের চাপিয়ে দেয়া’ ঘটনা বলে মনে করেন। অন্যদিকে যারা ‘সাম্প্রদায়িক’ বলতে চান তারা আসলে বিভিন্ন সময়ের হিন্দু-মুসলমান সহিংসতার দিকে নজর দেন, এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্ব থেকে তারা এর অস্তিত্বের সন্ধান করেন। ফলে এই জনপদ, বিশেষত বাঙালি মুসলমান যে আদতে সারগতভাবে ‘সাম্প্রদায়িক’ সেটা প্রমাণেই তাদের জোর বেশি।

এই প্রবন্ধের পরবর্তী আলোচনায় আমরা এটা খানিক স্পষ্ট করার চেষ্টা করবো যে, প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বে ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে হানাহানি-রেষারেষি হতো সেটাকে ‘কমিউন্যাল’ হিসাবে না বুঝে ‘সেকটারিয়ান’ হিসাবে ভালো বোঝা যায়। কেননা  এগুলো ছিল আংশিক, স্থানিক ইস্যুভিত্তিক, বা প্রায়শই আন্তঃধর্মীয় ও আন্তর্ধর্মীয়। বর্তমানে এই জটিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জমানায় ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলতে আমরা যা বুঝি সেটা প্রাক-ঔপনিবেশিক ধর্মীয় হানাহানি থেকে একেবারেই আলাদা। ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিকতা-বাহিত রাষ্ট্রপ্রণালী, আধুনিকতা আর সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতার ইতিহাস সমান্তরাল।

 

মানুষ মাত্রই ‘সাম্প্রদায়িক’ জীব কিংবা সাম্প্রদায়িকতা ‘ভালো’ জিনিস?

গত কয়েকদিন ধরে আরেকটা আলাপ বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। যেহেতু আমরা কোনো না কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত, সেহেতু‘সাম্প্রদায়িকতা’ আমাদের মধ্যে সহজাত ও অন্তর্গত। বেশ গর্ব সহকারে দাবি করা হয়েছে, মানুষ মাত্রই ‘সাম্প্রদায়িক’, বা মুসলমান মাত্রই‘সাম্প্রদায়িক’ বা ‘সাম্প্রদায়িকতা ভালো জিনিস’। এ ধরনের বালখিল্য কথা শুনলে মনে হয়, দীর্ঘদিন ধরে স্থানকাল দ্বারা জারিত হয়ে ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক বর্গের যে অর্থপ্রাপ্তি ঘটে, এ কথা যেন তাদের অজানা! ঐতিহাসিকতায় জারিত হয়ে‘সাম্প্রদায়িক’ বা ‘সাম্প্রদায়িকতা’র বর্গের একটা অর্থ তৈরি হয়েছে, যেন চাইলেই এই বর্গকে তার ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে বিযুক্ত করে আক্ষরিকভাবে পাঠ করা সম্ভব! অবশ্য যারা এ ধরনের শিশুতোষ কথাবার্তা বলছেন, তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় জয়া চ্যাটার্জির ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা’ কথাটাকে কিভাবে পাঠ করবেন? না জানি তারা কি উত্তর দিবেন! অর্থাৎ, বাংলাভাগের জন্য ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা’কে পুষ্পবর্ষণ না করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জয়া চ্যাটার্জিসহ অপরাপর ঐতিহাসিকরা তাহলে মহা অন্যায় করেছেন!

সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার কারণে মানুষ মাত্রই সাম্প্রদায়িক- এই আলাপটা ‘পরিচয়’ ও ‘পরিচয়বাদী রাজনীতি’র মধ্যকার যে ফারাক সেটাকে অস্বীকার করে। মানুষ বহু পরিচয় ধারণ করে, কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে কোনো একটা ‘পরিচয়’মুখ্য হয়ে উঠতে পারে। সেই ‘পরিচয়’ রাজনৈতিক দেনদরবারের একটা জমিনও হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু এই ‘পরিচয়বাদী রাজনীতি’ ও‘পরিচয়’কে গুলিয়ে ফেলা একধরনের বেওকুফিও বটে। ঠিক যেমন পরিচয়বাদী রাজনীতি পরিত্যাগ করা মানে খোদ ‘পরিচয়’টা ত্যাগ করা বোঝায় না। আমরা হিন্দুত্ববাদী বা মুসলমানিত্ববাদী রাজনীতিকে খারিজ করছি, এর মানে কি এই যে, আমরা আমাদের হিন্দু বা মুসলমান বা বাঙালি, চাকমা পরিচয়টাকেই খারিজ করে দিচ্ছি? তা না কিন্তু।

 

ইতিহাস ও বর্তমান

কোনো সন্দেহ নেই যাপিত জীবনের ধর্মনিষ্ঠার পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণের একাংশের কাছে ‘ইসলাম’ একটা পরিচয়বাদী রাজনীতিও বটে। আমাদেরকে বরঞ্চ আমলে নিতে হবে, বা বিশ্লেষণ করতে হবে, কখন কোন পরিস্থিতি মানুষের কোন ‘পরিচয়’ প্রধান পরিচয় হয়ে ওঠে এবং কেন হয়ে ওঠে? উপমহাদেশের ইতিহাস আসলে এই ‘পরিচয়’কে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে, খেয়েছে। সতর্ক থাকা দরকার, বাঙালি মুসলমানকে যারা ‘মজলুম’ হিসাবে হাজির করতে চান, তারাও সংখ্যাগুরুবাদী পরিচয়বাদী রাজনীতির ফাঁদে পা দিতে পারেন। কারণ ইতিহাস-বাহিত ‘বাঙালি মুসলমান’ আর বর্তমান-তাড়িত ‘বাঙালি মুসলমান’ এর গড়নের বিবর্তন এক নয়। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র বিশেষ টার্গেট বানানো হয়েছে মুসলমানদের— এমন বাস্তবতা মুসলমানদেরকে ‘মজলুম’ হিসাবে হাজির করলেও, আমাদের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ঐতিহাসিকভাবে যে সাংস্কৃতিক ‘অপরায়ন’ এর স্বীকার এই জনগোষ্ঠীকে হতে হয়েছে, তা আর বর্তমানের বাস্তবতা নয়। বর্তমানে অনেক বেশি প্রত্যয়ের সাথে বাঙালি মুসলমানের সাথে ঘটা ঐতিহাসিক বঞ্চনা ও জুলুমের কথা বলা সম্ভব হচ্ছে। সত্য যে, ঐতিহাসিক জুলুমের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের বর্তমানতা যদি কোনো এক ঐতিহাসিক ক্ষতকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে, তাহলে ইতিহাস সাক্ষী, এই ঐতিহাসিক ক্ষতবোধ নতুন জুলুমের শর্ত তৈরি করবে। বাঙালি মুসলমানের আজ আর স্রেফ ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া নয়, বরং নিজেই ক্রিয়া। তার সাংস্কৃতিক-সামাজিক সার্বভৌমত্বের ইতিহাস অন্তত সত্তুর বছরের, আর রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের ইতিহাস অন্তত পঞ্চাশ বছরের। ইতিহাসের [বাংলাদেশী] বাঙালি মুসলমান আজ আর ‘মুসলমান’ পরিচয়ের কারণে নির্যাতিত নয়, বরঞ্চ ‘নাগরিক’ হিসাবেই সে নির্যাতিত। এই দিকটা বিশেষ করে মনে রাখা দরকার।

 

সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর সম্পর্ক মূলত ক্ষমতা-সম্পর্ক

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর [বিশেষত হিন্দু ও মুসলমান] সম্পর্ককে সাধারণত ব্যক্তিগত পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়, বা সংখ্যালঘুদের যারা উঁচু শ্রেণির বাসিন্দা তাদের উদাহরণ টেনে এনে সংখ্যালঘুর [হিন্দুদের] ভালো অবস্থানের কথা উল্লেখ করা হয়। তারা কেন দেশ ছাড়তে চান, এটাকে তখন তাদের দেশপ্রেমের অভাব ও ভারতমুখীনতা হিসাবে তুলে ধরার রেওয়াজও আছে। যেমন, কই আমার গ্রামের তো কোনো হিন্দু (বা সংখ্যালঘু) পরিবারকে কেউ কিচ্ছু বলে নাই, তাইলে এরা ভারতে চলে যেতে চায় কেন? কই আমার তো অনেক হিন্দু বন্ধু আছে, তাদের সাথে আমার সম্পর্ক তো খুবই ভালো, তবু তারা ভারতে যাওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকে। এই ধরনের আলাপ তখনই জন্ম নেয় যখন আপনি সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর ইস্যুটাকে ব্যক্তিগত সম্পর্কে পর্যবসিত করেন। এ থেকে আরও প্রতীয়মান হয় যে, দেশপ্রেম কিংবা আনুগত্য প্রমাণের দায় সংখ্যালঘুর ওপরেই বর্তায়। যেমন, এবারকার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে একজন অপেক্ষাকৃত ‘উদার’ ইসলামিক বক্তা, বহু আপাত ‘সহিষ্ণু’ কথাবার্তার বলার ফাঁকে, এক পর্যায়ে হিন্দু সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে বলেন, বুকে হাত দিয়ে বলেন অন্য অনেক দেশের তুলনায় আপনারা ভালো আছেন কিনা! যদি না বলেন তাহলে আপনারা ‘মিথ্যা’ বলছেন! মূলত সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু আগাগোড়া একটা রাজনৈতিক নির্মাণ। এটা নির্মিত হয় ‘বিশুদ্ধ’ পরিচয়ের ওপর কেন্দ্র করে কল্পিত (কাল্পনিক নয়) ‘বিশুদ্ধ’ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর ওপর ভিত্তি করে। সংখ্যালঘু নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছে কি না এটা একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তির সাথে আমার যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তার ওপরে নির্ভর করে না। দেখার বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে পারছে কি না। এইখান থেকেই আসবে সে নিরাপদবোধ করতে পারছে কি পারছে না সে প্রসঙ্গ। বাস্তবে আমরা দেখি যে, কোনো সংখ্যালঘুকেই আমাদের রাষ্ট্র ধারণ করতে পারছে না। না হিন্দু সম্প্রদায়, না আদিবাসী। বিভিন্ন জায়গায় মন্দির-মূর্তি ভাঙচুরের পর তার কোনো ধরনের বিচারের ব্যবস্থা কি এই রাষ্ট্র করতে পেরেছে? বরং, পুলিশ কর্তৃক উল্টো সাঁওতালদের ঘর পুড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে।

আগেই বলেছি, মানুষ বিবিধ পরিচয়ের মোহনায় জীবনযাপন করে। একেক সাপেক্ষে একেক পরিচয় মুখ্য হয়ে ওঠে। যেমন, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে মুসলমানদের ওপর হামলা হলে আমাদের এখানকার মুসলমানরাও কষ্ট বোধ করেন। এই যে কষ্টের বোধ, এর কারণ কী? কারণ, ঐ যে একটা সাধারণ পরিচয়! এখন, ধরা যাক, বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ হলে, এবং দেখা গেল রাষ্ট্র কোনো দায়ভার নিলো না, তখন আপনার গ্রামের ‘সংখ্যালঘু’ যার সাথে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো বলে দাবি করছেন সে-ও অস্তিত্ব সংকটে ভুগবে। তার সাপেক্ষে আচানক আপনার নিজেকে ‘মুসলমান’ মনে হবে। অথচ এতদিন কিন্তু দৈনন্দিনতার মধ্যে অষ্টপ্রহর আপনারা বাছবিচার করেন নাই কে ‘হিন্দু’ আর কে ‘মুসলমান’! অর্থাৎ, একটা বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আগে থেকেই বিরাজমান ‘হিন্দুত্ব’ ও‘মুসলমানিত্ব’ এইবার প্রকট হয়ে উঠল। এই সংকটের জন্ম ও বিস্তার ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে সম্পর্কিত। এইখানে ‘রাষ্ট্র’ বলতে শুধু সরকারী দলকেই বোঝানো হচ্ছে না। পুলিশ-আইন-আদালত-রাজনৈতিক দলের সমন্বিত নেটওয়ার্ককে বোঝানো হচ্ছে। এই সম্পর্ক তাই ক্ষমতা-সম্পর্কও। অসম-ক্ষমতার মাধ্যমেই তৈরি হয় কেন্দ্র-প্রান্ত বিভাজন। এই ক্ষমতাতন্ত্র ধর্ম, লিঙ্গ, জাতি অনেকভাবেই তৈরি হয়। ধর্মের দিক থেকে প্রান্তিকে আছে হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধরা। আবার ইসলাম ধর্মের প্রান্তিকে অবস্থান করছে আহমাদিয়া, শিয়া, কাদিয়ানি। লৈঙ্গিক-ক্ষমতা সম্পর্কের দিক থেকে প্রান্তিকে আছে নারী। আবার জাতিগত দিক থেকে প্রান্তে আছে চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা-সাঁওতাল। আবার এইসব কিছুর ঊর্ধে আছে শ্রেণী। উপরোক্ত প্রান্তিক বর্গের অনেকেই আবার উঁচু শ্রেণিতে অবস্থান করেন। রাষ্ট্র যেহেতু উচ্চবর্গের প্রতিষ্ঠান, তাই রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক মধুর থাকে। তাই, দেখা যায় উপরোক্ত প্রান্তিক বর্গের যারা উঁচু শ্রেণিতে আসীন তারা নিজেরাই নিজেদের কম্যুনিটিকে শোষণ করেন, আবার মন-মর্জিমত ফায়দাও নেন। উঁচু শ্রেণির এইসব ব্যক্তিবর্গ ধর্ম-লিঙ্গ-জাতি এসবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রান্তিক বর্গে অবস্থান করলেও তাদের যাতায়াত কিন্তু কেন্দ্রে। তাই, এদের কর্মকাণ্ড দিয়ে আসলেই যারা প্রান্তিক পর্যায়ে (শ্রেণিগত দিক থেকেও) অবস্থান করেন তাদের হালহকিকত নির্ধারণ করতে গেলে মুশকিলে পড়তে হয়। অর্থাৎ, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর সম্পর্ক সম্পূর্ণ ক্ষমতার সম্পর্ক।

 

মব ভায়োলেন্সের উর্বর জমিন

রাজনৈতিক দেনদরবার ও প্রশাসনিক সহায়তা ছাড়া যেমন দাঙ্গা/সহিংসতা সম্ভব নয়, তেমনি ‘তৌহিদি জনতা’র ‘মুসলমানিত্ব’ বুঝতে পারাটাও জরুরি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবশ্য আরও জরুরি বিষয় হচ্ছে এই দাঙ্গাবাজ উন্মত্ত জনতা, যাকে ইংরেজিতে বলি ‘মব’। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে একটা ভয়ঙ্কর মব তৈরি হয়েছে। এই মব যে কেবল ‘মুসলমানিত্বে’র জোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তা না, বছর দুয়েক পূর্বের ‘পদ্মা সেতুতে কল্লা’ নিয়েও ভয়ঙ্কর মব-ভায়োলেন্স, বা পিটিয়ে মারা শুরু হয়েছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বিভিন্ন বাৎসরিক রিপোর্টে, মব ভায়োলেন্সে বেশ ভালো সংখ্যক মানুষজন নিহত হন। ছিনতাইকারী সন্দেহ থেকে শুরু করে নানান অজুহাতে মানুষজনকে পিটিয়ে মারা হয়। ভারতেও মব ভায়োলেন্স প্রচুর ঘটে। সেখানে স্পষ্টত দেখা যায় সামাজিকভাবে মার্জিনালাইজড গোষ্ঠী, যেমন দলিত বা মুসলমানরা মব ভায়োলেন্সের শিকার হন। বাংলাদেশে স্পষ্টত এমন কোনো প্যাটার্ন এখনো খেয়াল করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের গত তিন চারবছর খেয়াল করলে এই ধরনের ভয়াবহ লিঞ্চিং মবের হদিস পাওয়া যায়। যেমন, পদ্মা সেতুতে কল্লা, লালমনিরহাটে ইমানি জোশে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা। বর্তমানেও একইভাবে সেই মবের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন মণ্ডপের আক্রমণকে যেমন বেশ সংগঠিত মনে হচ্ছে, তেমনি তাৎক্ষণিক ‘মব’ও সেখানে উপস্থিত। এই মব যে কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে জেগে উঠছে তা না, এই অনুভূতি ছাড়াও এই মব ক্রিয়াশীল। মবের সাথে যখন ধর্মীয় উন্মাদনা যুক্ত হচ্ছে তখন সেটা আরও ভয়াবহ হচ্ছে। তবে, যে বিষয়টা খোলা চোখে অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, এই মব মেট্রোপলিটন-শহর ও মফস্বল-শহর কেন্দ্রিক। পদ্মা সেতুতে কল্লার ঘটনার পর ঢাবির কয়েকজন শিক্ষকের মতামত একটা পত্রিকার রিপোর্টে পড়েছিলাম, তাদের আলাপ আমাদেরকে হতাশ করেছে। তারা দাবি করেছিলেন, শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দিলেই মব-ভায়োলেন্স বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ এই মব ভায়োলেন্সের দিকে আমাদের নজর ফেরাতে হবে। এটাকে আমলে নিতে হবে। মব ভায়োলেন্সের শহরকেন্দ্রিকতাকে মাথায় রেখে আশিস নন্দীর একটা প্রাসঙ্গিক মন্তব্য তুলে ধরতে চাই; যদিও তিনি সেটা দাঙ্গা বা রায়ট সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, তবে সেটা আমাদের উল্লিখিত দাঙ্গাবাজ ‘তৌহিদি জনতা’ বা মবের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়:

riots primarily take place in cities because of the anonymity factor and because people don’t know each other very well. Once prosperity comes, people become atomised, more isolated and individualistic. Increasing modernisation leaves you more and more as an individual. It weakens communities. The modern state always tries to weaken communities because it feels communities are a handicap to modernisation…. Modern states want uniformity, detest decentralisation and don’t want to leave any communities in the area of politics except the state and the individual. They want to ensure that the individual stands alone against the state. And they will go any distance to ensure that happens.

 

পূর্ব-নির্ধারিত ব্যাখ্যা থেকে ঘটনায় নয়, ঘটনা থেকে ব্যাখ্যায় যেতে হবে

বাংলাদেশে চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যাবতীয় কার্যকারণ ব্যাখ্যা করার কাজটা আসলে মাঠ-পর্যায়ের ডকুমেন্টেশন ও অধ্যয়ন ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। প্রত্যেকটা ঘটনার সাথে আগের ঘটনার মিল-অমিল দুই-ই থাকে। শুধু মাত্র সাধারণ স্ট্রাকচার খুঁজতে গেলে, অনেক অভিনব নিত্য-নতুন দিক আড়ালে থেকে যায়। আমরা উপরে এই সংক্রান্ত কিছু মন্তব্য কেবল পেশ করেছি। এই ঘটনার প্রভাব ভারত ও বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাবে পড়বে, ইতোমধ্যে পড়া শুরুও করেছে। সম্প্রতি হিমাদ্রি ঘোষ এক নিবন্ধে বলেছেন, ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনী প্রচারণায় বিজেপি নেতারা বাংলাদেশের সহিংসতাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু করেছেন। তারা এটাকে ব্যবহার করে বিতর্কিত নাগরিক বিলের পক্ষে সম্মতি আদায় করছেন। বিজেপি সমর্থকরা এই ঘটনাকে প্রায় লুফে নিয়েছেন বলেও দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আরও কট্টর ‘হিন্দু’ হয়ে ওঠার এই মওকা সঙ্ঘ পরিবার ও তাদের ভক্ত-মুরিদ-সমর্থকেরা কোনোভাবেই ছাড়বে না। কোনো সন্দেহ নেই, এই ঘটনার প্রভাব ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে পড়বে এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এর ষোলআনা ফায়দা নেয়ার চেষ্টা চলবে।

 

সংবিধানের ‘মূলনীতি’ সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র ঠেকানোর আবশ্যিক নিশ্চয়তা দেয় না

ভারতে যখন সহিংসতাকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী ফায়দা হাসিলের ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘বাহাত্তরের সংবিধান’ ফিরিয়ে আনার জিগির তুলছে কোনো কোনো মহল। এই আলাপগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত। বাহাত্তরের সংবিধানের অন্তর্নিহিত ফ্যাসিবাদ ও ঔপনিবেশিকতা নিয়া ইতোমধ্যে বহু লেখালেখি হয়েছে কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনার আলাপ আসলে দিনশেষে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিমের ভিত্তিকেই আরো জোরদার করে তুলবে। দু:খের বিষয় হলেও সত্য, আমাদের এখানে সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে যত আলাপ হয়, সেই তুলনায় সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো নিয়ে তেমন কোনো আলাপ হয় না বলতে গেলে। অথচ সংবিধানেই স্পষ্ট বলা আছে, রাষ্ট্র যদি তার ঘোষিত মূলনীতি অনুযায়ী না চলে, তাহলে প্রতিব্যবস্থা হিসেবে  আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে না। বাংলাদেশের সংবিধানের নিবিড় পাঠ আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করে যে, এখানে রাষ্ট্র-ক্ষমতাকে যেভাবে নিরঙ্কুশভাবে একব্যক্তিতে ন্যস্ত করা হয়েছে— এর ফলে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন যে দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা যত বিস্তৃত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ, মিডিয়া, সাংস্কৃতিক জগতকে যে দল যতবেশি কব্জা করতে পারে; ক্ষমতায় আসীন হয়ে— নিপীড়নমূলক এবং মতাদর্শিক দুই বিবেচনাতেই— সেই দল তত ভয়াবহ স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে সক্ষম হয়। কাজেই সংবিধানের মূলনীতি ও ঘোষণাপত্রে জান্নাত কায়েমের প্রতিশ্রুতি থাকলেও, খেয়াল করা দরকার সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামোটা গণতান্ত্রিক কিনা, সেখানে ক্ষমতার ন্যূনতম ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা আছে কিনা। তা যদি না থাকে, তাহলে কেবলমাত্র বাহাত্তরের সংবিধান ‘ফিরিয়ে দাও’ মার্কা মাতম কোনো কাজে আসবে না। এমন না যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ স্বৈরাচার খুব আরামপ্রদ কোনো ব্যপার! ধর্মনিরপেক্ষতার কান্ধে ভর করে বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনার পক্ষে যারা শোরগোল তুলছেন, তাদের দাবি থেকে অবশ্য হলফ করে বোঝা যাচ্ছে না, গণতন্ত্রহীন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ স্বৈরতন্ত্রই তারা ফরমায়েশ করেন কিনা? এই সওয়ালের জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য এই মহলে রয়েছে কবরের নিস্তব্ধতা।

 

সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা

‘সাম্প্রদায়িকতা’ বহুল ব্যবহৃত বর্গ হলেও, এই বর্গকে ঘিরে রয়েছে একরাশ তর্ক-বিতর্ক, এবং বিভ্রান্তি। এ প্রসঙ্গে আগে খানিকটা আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু আরও বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে। ইতিহাসহীন শূন্য সময়ে মানুষের পয়দা হয় না। প্রত্যেক মানুষ জন্মগ্রহণ ও বেড়ে উঠতে উঠতে নিজেকে একাধিক সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে আবিষ্কার করে। এই সম্প্রদায়গততা আমাদের দৈনন্দিনতার মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে। গণপরিবহনে চড়বার সময়ে পাশের যাত্রী কিংবা চালকের জাত-কুলজি-ধর্ম জেনে কেউ গাড়ি চড়ে না। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে খাবার-পরিবেশনকারীর ধর্ম-জাত নিশ্চিত হয়ে কেউ খেতে বসে না। অর্থাৎ, আমি অমুক সম্প্রদায়ের সদস্য এবং সে তমুক সম্প্রদায়ের সদস্য এই ভেদবুদ্ধি করে কেউ তার সাধারণ জীবনের প্রত্যেক মুহূর্ত নির্বাহ করে না। কিন্তু ক্ষেত্র ও পরিস্থিতি বিচারে, সম্প্রদায় পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠতে পারে বা মুখ্য করে তোলা হয়। ফরাসি দার্শনিক জঁ-লুক ন্যান্সির Inoperative Community-র বরাত দিয়ে দীপেশ চক্রবর্তী দেখাচ্ছেন, কম্যুনিটিকে স্থায়ী রূপ দিতে চাওয়ার পেছনে একটা ক্ষমতা-চর্চার বাসনা থাকে। আদতে কম্যুনিটিকে এমন হতে হবে যা কম্যুনিটি হিসেবে কাজ করবে না। সাধারণ জীবনের দৈনন্দিনতায় কম্যুনিটি সেভাবেই বিরাজ করে। যেমন আমাদের মুসলমানিত্ব বা হিন্দুত্ব বা বাঙালিত্ব বা চাকমাত্ব। হিন্দু বাড়িতে বড় হওয়া কেউ পৈতা দেখে বড় হয়। কিন্তু সেটা কোনো স্থায়ী সর্বজনীন রূপ পায় না। দীপেশ চক্রবর্তীর জবানেই উল্লেখ করা যাক:

নিশ্চই আধুনিক হবার আগে মানুষ সবসময়ই আইডেন্টিটির একটা কনটেক্সচুয়াল ব্যবহার করে।…. আধুনিক হবার মানে হচ্ছে, ওই যে বললাম, জনজীবনে রিসোর্স ডিস্ট্রিবিউশনের সঙ্গে পরিচিতি কনডাকটেড। এই পরিচিতিগুলি স্থায়ী হবার চেষ্টা করেঅন্তত পাঁচ বছর, দশ বছর, পনেরো বছর বাদে। আচ্ছা, তখন যদি আমি বলি হিন্দুদের এতগুলি চাকরি দিতে হবে। উনিশ শতকের ইতিহাস যা নিয়ে তখনকার মুসলমানরা বলল: আমরা কমসংখ্যক গ্র‍্যাজুয়েট হই। ফলে বেশিসংখ্যক গ্রাজুয়েট করার জন্য পাঁচ বা দশ বছরের জন্য আপনার ওই আইডেন্টিটি ফিক্সড করে রাখতে হবে। তাহলে আপনি মাপবেন কী করে? তার মানে স্ট্যাটিস্টিকস খুব important হয়ে যাচ্ছে এই নতুন সরকারি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে। এবং আপনি যদি এখন racism দেখেন বর্তমান পপুলেশনে দেশ বা বিদেশ যেখানেই হোক এটা popular use of demography হয়। সেটা কিন্তু ওইভাবে আসে যে: মুসলমানরা বেশি reproduce করছে, ওরা অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ে, আমরা কম বাড়ি এ কথাগুলি কিন্তু আদমশুমারি না হলে বলতে পারতেন না। কারণ সেনসাস হতো না, এটা মাপার প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু এই সেনসাস হচ্ছে কেন? এই সেনসাস হবার একটা মূল কারণ হচ্ছে যাতে নাকি so-called সুষম বণ্টন হয়। এই সুষম বণ্টন কাদের মধ্যে হবে? ফলে power-এর প্রশ্নটা এসেই যাচ্ছে। … আসলে যে মুহূর্তে আমি কম্যুনিটিকে স্থায়ী করার চেষ্টা করব, তখনই বুঝতে হবে যে এর মধ্যে কোনো সুচতুর শয়তানি আছে।” ১০

প্রকৃতপক্ষে, ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমেই স্থায়ী ও অনড় সম্প্রদায় গড়ে তোলা হয়। এই সম্প্রদায়বোধ কিন্তু কেবল ধর্মের ভিত্তিতে ছিল না— যদিও ধর্ম একটা প্রধান ক্যাটাগরি বিবেচিত হয়েছিল— বরং, ধর্ম-বর্ণ-নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এমনকি লৈঙ্গিক পরিচিতিকে ঘিরেও অলঙ্ঘনীয় সম্প্রদায় নির্মাণ করা হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রয়োজনে, ব্রিটিশদের শাসকদের প্রত্যক্ষ মদদে। এ কথা আজকাল আর কারোর জানতে বাকি নেই, ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে প্রামাণিক আইনি ব্যবস্থা গড়ে তোলার সাথে সাথে ধর্ম-বর্ণকেন্দ্রিক পরিচিতিকে অনিবার্য করে তুলেছিল। দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর অন্য আরেক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, সম্প্রদায় ও পরিচয়কেন্দ্রিক এই আধুনিক সমস্যা আধুনিক প্রশাসনিকতার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।১১ এই অর্থে, হিন্দুত্ববাদ কিংবা রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান ও বিকাশকে কোনো অতীতস্মৃতি নয়— বরং, ভারতবর্ষে আধুনিক জনজীবনের ইতিহাসের সাথেই মিলিয়ে পাঠ করতে হবে। এই ইতিহাসের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটে ব্রিটিশদের দ্বারা। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে জাতীয়তাবাদী শাসকেরা এই একচেটিয়া ও অলঙ্ঘনীয় সম্প্রদায়-পরিচিতি অক্ষুণ্ণ রাখে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুদীপ্ত কবিরাজ দেখান যে, ভারতবর্ষে প্রাক-ব্রিটিশ পর্বে সম্প্রদায়ের ধারণা ছিল বেশ অস্পষ্ট ও ঢিলেঢালা। ব্রিটিশ-পর্বে সম্প্রদায় হয়ে উঠল গণনাযোগ্য।১২ প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বের কম্যুনিটি সীমানার ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি ‘fuzzy’ শব্দটি ব্যবহার করেন, যার মানে তখন সম্প্রদায় বলতে সুনির্দিষ্ট সীমানাজ্ঞাপক কিছু বোঝানো হতো না। ‘হয়…/অথবা’র নির্দিষ্টকরণ সম্ভব ছিল না। কিন্তু আদমশুমারি বা অপরাপর প্রশাসনিক নথিপত্রের স্বার্থে একজন ব্যক্তিকে একক পরিচয়ে পরিচিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। একজন তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষ কেবল এবং কেবলমাত্র তফসিলি সম্প্রদায়েরই মানুষ। অর্থাৎ, সত্তা ও আত্মতার এই রাজনীতিকরণ বিশেষভাবে আধুনিক জমানার মামলা। তবে আধুনিক জনজীবন গড়ার সাথে সাথে পরিচিতিকে এভাবে একচেটিয়ারূপে ঢেলে সাজানো হলেও, আজও মানুষ বন্ধুত্ব কিংবা কুটুম্বিতার ক্ষেত্রে পরিচয়ের অনির্দিষ্টতাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কেবলমাত্র ‘বিশুদ্ধ’ একচেটিয়া জাতীয় পরিচয়কে কেন্দ্র করে যখন কোনো পলিটি কল্পিত হয়, তখনই কেবল সম্প্রদায় ও পরিচিতি একটা রাজনৈতিক অর্থ পায়। অন্যভাবে বললে, [রাজনৈতিক অর্থে] ‘হিন্দু’ বা‘মুসলমান’ বা ‘বাঙালি’ আসলে হয়ে ওঠার মামলা।

এক্ষেত্রে দোহাই হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক মোহাম্মদ আজমকেও আমরা টানতে চাই। ‘বাঙালি মুসলমান’ সম্পর্কে আহমদ ছফার গোলমেলে বোঝাপড়ার সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলমান বিরোধ-মিলন, সমন্বয়-স্বাতন্ত্র‍্যের মধ্য দিয়ে গেছে, দুনিয়ার যে-কোনো অঞ্চলের জনমানুষের মতোই।১৩  কিন্তু আধুনিক ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’ বর্গ এবং তজ্জনিত দ্বন্দ্ব-সংঘাত মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র ঘটনা যার সাথে প্রাক-ঔপনিবেশিক ইতিহাসের কোনো আবশ্যিক ধারাবাহিকতা নেই। আজম আরও জানাচ্ছেন, ‘বাঙালি মুসলমান’ বর্গটি উনিশ শতকে গড়ে উঠেছে। ‘কলোনিয়াল দরকারে’ ও ‘কলোনির ছত্রছায়ায়’ এমনকি পুরনো ইতিহাস-ব্যাখ্যায় হিন্দু ও মুসলমান বর্গ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এবং ‘বাঙালি’ সংজ্ঞার বিকাশের ঘটনাগুলি ঘটে।

 

বদরুদ্দীন উমরের ‘সাম্প্রদায়িকতা’র পর্যালোচনা ও আমাদের মতামত

এবারে আসা যাক, সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে। সাম্প্রদায়িকতা কী? বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমর সেই ষাটের দশকেই সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞায়ন করেছেন। উমরের সংজ্ঞাটি দেখা যাক: কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িকতা আখ্যা দেয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে।১৪ এই সংজ্ঞার সংকট অন্তত দুটি স্তরে। প্রথমত, উমর কেবলমাত্র ধর্মকেই সাম্প্রদায়িকতার উৎস মনে করেন। অর্থাৎ, উমরের ‘সাম্প্রদায়িকতা’ মাত্রই ‘ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা’ এবং তা এতটাই যে— এমনকি তিনি যখন ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’র আলোচনা করেন— তখনও তা মূলত ‘ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা’রই রূপ বিশেষ: তত্ত্বগতভাবে সংস্কৃতিকে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত মনে করাকেই সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার মূলসূত্র বলে ধরা যেতে পারে।১৫

এক্ষেত্রে ধর্ম প্রশ্নে বদরুদ্দীন উমরের অবস্থানকে সারবাদী [এসেনশিয়ালিস্ট] না বলে কোনো উপায় নেই। গণ্ডগোলটা এখানেই। এই সংজ্ঞা মানলে, বাংলাদেশের বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিগত জনগোষ্ঠী (সাঁওতাল/চাকমা), উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি সংখ্যাগুরু বাঙালি সম্প্রদায়ের মনোভাব ও আচরণকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলা যাবে না!  দ্বিতীয়ত, উমর মানছেন যে, ‘সাম্প্রদায়িকতার যোগ হচ্ছে সম্প্রদায়ের সাথে।’ কিন্তু ‘সম্প্রদায়’ বলতে তিনি বুঝছেন কেবল ধর্মকে। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শুরু হচ্ছে ‘বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত’ থাকার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ, অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের মনোভাব অন্তত এই সংজ্ঞানুসারে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ নয়। এমনকি কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে কেবল তখনই ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলা যাবে, যখন তিনি অন্য [ধর্মীয়] সম্প্রদায়ের ‘বিরুদ্ধাচরণ ও ক্ষতিসাধন’ করতে প্রস্তুত থাকেন, এর আগে নয়। অর্থাৎ, অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি স্রেফ বিদ্বেষ ও ঘৃণার মনোভাব [উমরীয় অর্থে] সাম্প্রদায়িকতা নয়। এটাও উল্লেখ করা দরকার, উমরের ‘সংখ্যালঘু’র যে বর্গ সেখানে তিনি হিন্দুদের বাইরে অন্যান্য জাতিগত জনগোষ্ঠীকে প্রধান হিসাবে দেখে থাকেন। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, বর্তমান বাংলাদেশে ‘সাম্প্রদায়িকতার সামাজিক ভিত্তি’ নেই, বরঞ্চ ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আছে; এবং সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্ব বিষয়ক আলাপকে তিনি ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সাথে ওতপ্রতভাবে মিলিয়ে দেখেন।১৬

কিন্তু আমরা ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতা’কে একাকার করে ফেলতে চাই না। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ কেবলমাত্র একশন নয়, একটা সেন্টিমেন্টও বটে। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে তাদের সম্প্রদায়গত আচার-বিশ্বাসের দরুন স্টেরিওটাইপ তথা অতি-সরলিকরণ করার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার শুরু হয়। সেই ‘অপর’ সম্প্রদায়ের মানুষকে ‘ডিজিজ’ বা ‘অসুখ-বিসুখ’, ‘স্বাভাবিকের বিকৃতি’ও ভাবা হয়। অর্থাৎ, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ এক ধরনের বর্ণবাদও বটে। এটা কেবলই একশন নয় আরও এক অর্থে। যে সমস্ত দেশে মোটাদাগে প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়বিচার কায়েম হয়েছে, সেইসব দেশেও সাম্প্রদায়িকতা বহাল তবিয়তেই আছে। যদিও সেখানে হামলা বা শারীরিক জুলুমের মতো ঘটনা কমই ঘটে। কিন্তু প্রান্তিক বা সংখ্যালঘুকৃত সম্প্রদায়কে ‘চিড়িয়া’ ভাবার খাসলত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উন্নত দেশেও আছে। এই ‘দেখার ধরন’ তথা gaze এর উৎস সাম্প্রদায়িকতা। এটা এক ধরনের ‘বিশুদ্ধতাবাদী’ মনোভাব। ‘নিজ’ সম্প্রদায়কে ‘শ্রেষ্ঠ’ অথেনটিক এবং অন্য সম্প্রদায়কে‘ইনঅথেনটিক’ ‘অসুখে আক্রান্ত’ হিসেবে ভাবার-দেখার প্ররোচনা তৈরি হয় এই শ্রেষ্ঠত্ববাদী দম্ভ থেকে। অনেকে একে ‘শ্রেষ্ঠত্ববাদী অহংকার’ বলতে চান। কিন্তু এটা আসলে ‘অহংকার’ নয়, ‘দম্ভ’। ‘অহংকার’ অদাম্ভিকও হতে পারে। অহংকার মানে দম্ভ নয়— আমাকেই আমি করে তোলার ক্রিয়া।১৭ কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার ‘নিজ’ ভীষণভাবে ‘অপর’ নির্ভর। আমরা যেহেতু ভাষার মধ্য দিয়েই জগৎকল্পনা ও ব্যাখ্যা করি,ফলে এই ফারাকগুলো নেহাতই তাচ্ছিল্য করার মতোন নয়। পরিস্থিতি মোতাবেক সাম্প্রদায়িকতা কেবল মনোভাবে সীমাবদ্ধ থাকে না, হামলা-সহিংসতা এমনকি জেনোসাইডেও গড়াতে পারে। সুতরাং, ‘বিরুদ্ধাচরণ’ এবং ক্ষতিসাধন’ এর প্রস্তুতি সাম্প্রদায়িকতার অন্তত দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ।

তবে বদরুদ্দীন উমর অন্তত একদিক থেকে ঠিক। তিনি ধর্মনিষ্ঠা (আমরা যাকে যাপিত জীবনে ধর্মচর্চা বলছি), ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ও সাম্প্রদায়িকতাকে আলাদা আলাদা নিক্তিতেই বিচার করেন। বাংলাদেশের বহু মার্ক্সবাদী ধর্ম সম্পর্কে এক ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বর্ণবাদী মানসিকতা লালন করেন। মানুষের ইতিহাসের একটা দীর্ঘ সময়জুড়ে যে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ ও র‍্যাশনাল থিংকিং এর সিলসিলা ধর্মীয় আবহেই হয়েছে, এই সরল সত্য তারা বুঝতে চান না। তারা উমরের কাছ থেকে অন্তত এই পার্থক্যকরণটুকু শিখতে পারেন। নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি ভক্তি-অনুরাগ-আনুগত্য আর অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ ও হিংসার মনোভাবকে পার্থক্য করতে পারা কান্ট কথিত সাবালকত্বের লক্ষণ। প্রথমটা শুরু হয় ‘নিজ’ থেকে, ‘নিজ’-এই সীমাবদ্ধ থাকে। দ্বিতীয়টা শুরু হয় ‘অপর’ থেকে। ‘অপর’ নির্মাণ করা ছাড়া সাম্প্রদায়িকতার ‘নিজ’ নির্ধারণ করা যায় না। উল্লেখ্য, নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরাগ বা ভক্তি মানে আবার এই না যে তা নিঃশর্ত ও নিরঙ্কুশ হতে হবে।

তাহলে আমরা বদরুদ্দীন উমরের ‘সাম্প্রদায়িকতা’র মূলগত বিরোধীতা করছি। আমরা বলার চেষ্টা করছি যে, আধুনিক সম্প্রদায়ের ধারণা যা নিজেকে একটি একচেটিয়া, অখণ্ড ও খাঁটি ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী’ কিংবা ‘নেশন’ হিসেবে কল্পনা করে, সাম্প্রদায়িকতা তারই উপজাত। এই‘নেশন’ কিংবা ‘জাতিগত বিশুদ্ধতা’র প্রেরণা ধর্ম-নৃতাত্ত্বিক পরিচয় যে-কোনো কিছু থেকেই উৎসারিত হতে পারে।

এক্ষেত্রে যাপিত জীবনের ধার্মিকতা, সাংস্কৃতিকতা ও নৃ-তাত্ত্বিকতার সাথে ‘মতাদর্শরূপে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ এর পার্থক্য করতে পারা দরকার। আমরা মনে করি আশিস নন্দীর religion as ideology শব্দবন্ধনীটি এক্ষেত্রে বেশ কার্যকর। অর্থাৎ, অন্য অনেক কিছুর মতোই আধুনিক রাষ্ট্র, নেশন ইত্যাদির প্রয়োজনে ধর্ম ব্যবহৃত হতে পারে। তবে কেবলই ধর্ম ব্যবহৃত হবে তা নয়। বাংলাদেশের প্রগতিবাদী১৮মহলে বাংলা ভাষাকে ঘিরে এক ধরনের থরোথরো আবেগ এবং উর্দু ভাষার প্রতি বর্ণবাদী ঘৃণা ও কুসংস্কারকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা করা যায় না। এক্ষেত্রে এই মতাদর্শরূপী ‘ধর্ম’কে পরিচয়বাদী রাজনীতি ছাড়া অন্য কিছু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। বদরুদীন উমর যাকে বলেন—‘ধর্মনিষ্ঠা’— সেই ধর্মনিষ্ঠা আর নন্দী কথিত মতাদর্শরূপী ধর্মকে একাকার করে ফেলার বিভ্রান্তি যেন আমাদের পেয়ে না বসে। উমর জানাচ্ছেন, ‘সত্যকার ধর্মনিষ্ঠা পরকালমুখী’ এবং ‘ধর্মনিষ্ঠার জন্য অন্যের বিরুদ্ধাচরণের প্রয়োজন নেই।’ ধর্মনিষ্ঠা ও সাম্প্রদায়িকতার ‘প্রভেদ থাকা সত্ত্বেও’ অনেকে এই দুইকে ‘অবিচ্ছেদ্য’ মনে করেন। উমরের মতে ‘এ ধারণাকে [পড়ুন মানসিকতাকে] একটি সংস্কার হিসাবে গণ্য করা চলে।’১৯

 

সাম্প্রদায়িকতা ও প্রাক-উপনিবেশ ধর্মীয় সংঘাত এক নয়

বর্তমানে আমরা ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলতে যা বুঝি তা সারগতভাবে সাম্প্রতিক কালের ঘটনা, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক আধুনিক আমলের ঘটনা। এটা বলার অর্থ আবার এই না যে, প্রাক-আধুনিক আমলে ভারতবর্ষে কেবল ধর্মীয় সম্প্রীতিই ছিল, কোনো ধর্মীয় সংঘাত ছিল না। যারা প্রাক-আধুনিক আমলকে কেবলই সম্প্রীতির আমল হিসেবে ভাবতে চান, তারা মূলত অতীত নিয়ে এক ধরনের ভাবালুতায় আক্রান্ত। আবার যারা সাম্প্রদায়িকতার একটা প্রাক-আধুনিক বংশলতিকা আবিষ্কার করতে চান— তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন— এটা না করলে বোধহয় প্রাক-আধুনিক যুগকে একরকম দায়মুক্তি দেয়া হবে। আসলে এই দুই ধরনের চিন্তাপদ্ধতিই অনৈতিহাসিক। বিপুল পরিমাণ ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সহকারে দেখানো সম্ভব, সম্প্রীতি, মিশ্র ও সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির পাশাপাশি প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতবর্ষ আন্তঃধর্মীয় (interreligious) ও আন্তর্ধর্মীয় (intrareligious) ধর্মীয় সংঘাতে পরিপূর্ণ ছিল। হিন্দু ও বৌদ্ধ, শিয়া ও সুন্নী, মুঘল ও সাতনামী, ব্রাহ্মণ ও নাথপন্থী ইত্যাদি নানা ফেরকাগত দ্বন্দ্ব ও সহিংসতার ইতিহাস আছে।

তাহলে কেন আমরা বলছি ‘সাম্প্রদায়িকতা’ আধুনিক যুগের ঘটনা এবং প্রাক-আধুনিক জমানার ধর্মীয় সংঘাতের সাথে একে মেলানো যাবে না?

ইতিহাসবিদ প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখাচ্ছেন, ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষে আসে, তখনও মুঘল শাসন চলছিল। ফলে ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনকে আড়াল করতে ‘মুসলিম বর্বরতা’র হাত থেকে ‘হিন্দু মুক্তি’ ও ‘আইনের শাসন’ এর ধোয়া তোলে। সতেরো, আঠারো এমনকি উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, দিল্লী হিন্দু-মুসলমান উত্তেজনা থেকে মুক্তই ছিলই। কিছু বিছিন্ন ধর্মীয় দ্বন্দ্বের নজির আছে। কিন্তু গোটা হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে দেখা যায়নি। তখন এমনকি হিন্দু, মুসলমানের ধর্মীয় সীমানা আজকের মতো এত সুসংগঠিত ও অমোচনীয়ও ছিল না। আবার এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পেছনে পুরোপুরি ধর্মীয় কারণ ছিল এমনটাও বলা যাবে না। দিল্লির সীমান্তে সাতনামী সম্প্রদায়ের সাথে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সংঘাতের কথাই ধরা যাক। যদিও আজকাল এই ইতিহাসকে ‘মৌলবাদী’ মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে পরিশ্রমী ও ধর্মপ্রাণ হিন্দু কৃষক সম্প্রদায়ের সংঘাত হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আসলে এটা ছিল অভিজাত ভূ-স্বামীর বিরুদ্ধে গোত্রগত প্রতিবাদ এবং রাজ-খাজনার বিরুদ্ধে কৃষকদের বিদ্রোহ। আরও কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, খোদ সাতনামী সম্প্রদায় ছিল হিন্দু-মুসলমান সংকর সংস্কৃতির অনুসারী। মূলত এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলি ছিল ইস্যুভিত্তিক, ক্ষণস্থায়ী, স্থানিক ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব।২০ ঔপনিবেশিকতা ভারতবর্ষে ‘সভ্যতার সংঘাত’ ধারণা হাজির করেছে হান্টিংটনের বহু আগেই। প্রথমার ভাষ্যে:

Europe’s was a Christian history, engaged in demonising Islam from the time of the Crusades to the 18th century and after, when European states faced the mighty and majestic Ottoman Empire literally knocking at their doors. The British, when they came to India, carried that bias and weaponised it for political purposes, as did many orthodox Hindu nationalists right from the late 19th century. ২১

দ্বিতীয়ত, ঔপনিবেশিক আমল মূলত গণনা ও পরিসংখ্যানের যুগ। গণনা এর আগেও ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমল থেকে মূলত পরিসংখ্যানকে কেন্দ্র করে বিপুল প্রশাসনিকতা শুরু হয়। পরিসংখ্যানকে এজন্য ‘রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান’ও বলা হয়। পরিসংখ্যান ও প্রমিতায়ন [স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন] ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র ভাবাই যায় না। ব্রিটিশরা তামাম দুনিয়াকে ধর্মের ভিত্তিতে চিহ্নিত করেছিল। ইউরোপ মানে খ্রিস্টান, ভারত মানে হিন্দুত্ব, মধ্যপ্রাচ্য মানে ইসলাম, পূর্ব এশিয়া মানে বৌদ্ধধর্ম। আসলে পরিসংখ্যানের প্রয়োজনেই একজন ব্যক্তিকে হয় হিন্দু অথবা মুসলমান হিসেবে পরিচিতিকরণের জরুরত দেখা দিল। শিয়া বা আহমাদিয়া বা সুন্নি বা বৈষ্ণব বা লিঙ্গায়ত এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিপ্রেক্ষিত-নির্ভর পরিচয় আঁকড়ে ধরে থাকা সম্ভব ছিল না আর। মিও সম্প্রদায়ের মতো যেসকল সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান মিলিত সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ছিল, তাদেরকে এবার হিন্দুত্ব অথবা মুসলমানিত্ব যে-কোনো একটা বেছে নিতে বাধ্য করা হলো। সত্তা ও পরিচয়কে বেশ অনড়, পরস্পরের বিরোধী এবং স্থায়ীরূপে নির্ধারিত করে গড়ে তোলা হয় প্রশাসনিক নথিপত্রে। অথচ খোদ ইংল্যান্ডে পরিচয়ের একটা বর্গ হিসেবে ধর্ম কখনোই বাধ্যতামূলক কিংবা নির্ধারণযোগ্য কোনো বিষয় ছিল না। ১৮০১ সাল থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত পরিচালিত আদমশুমারি বিশ্লেষণ করে মার্কিন ইতিহাসবিদ কেনেথ জোনস দেখিয়েছন, কেবলমাত্র ১৮৫১ সালের আদমশুমারিতে ব্রিটিশ নাগরিকদের ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গের মুখোমুখি হতে হয়, যদিও নথিপত্রে তা জানানো ছিল নাগরিকদের ঐচ্ছিক বিষয়।২২

তৃতীয়ত, ১৮৭০ সাল থেকে ভারতে স্থানীয় সরকার ও প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থা শুরু হয়। এর ফলে আদমশুমার ও জনমিতির সমন্বয়ে এবং সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক শাসনের উদ্বোধন সম্প্রদায়-পরিচিতি ধারণার খোলনলচে বদলে দিল। এতদিন যা ছিল দৈনন্দিন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের মামলা, এবার তাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সম্প্রদায় গড়ে উঠতে শুরু করল। এটাই ভারতবর্ষে সংখ্যাগুরুবাদী রাজনৈতিক মনস্তত্বের গোড়াপত্তনের ইতিহাস। এর ফলে গণতন্ত্রের মানে হয়ে দাঁড়ালো সংখ্যাগুরুবাদী দাপট। ‘শত্রু/মিত্র’কিংবা নিদেনপক্ষে ‘আমরা আর ওরা’র গোড়া খুঁজতে হবে এখানেই।

চতুর্থত, পার্সোনাল আইনের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয় ধর্মকে। এতে করে বিভিন্ন অঞ্চলের একই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিপুল বৈচিত্র্য ও পার্থক্য আছে তা অস্বীকার করা হলো। কাজি, মুফতি, মাথাপ্রধান ইত্যাদি আইনগত পদকে সম্পূর্ণ ধর্মীয় বর্গ ব্রাহ্মণ, উলামায় প্রতিস্থাপন করা হলো।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, ঔপনিবেশিক আমলের আধুনিক রাজনীতি ধর্মকে নেশন ধারণায় পর্যবসিত করে এবং ধর্মীয় পরিচিতিকে ঘিরে নেশন-কল্পনা চালু করে। হালে আমরা ধর্মকেন্দ্রিক যে-সকল জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক বিন্যাস ও সমাবেশ দেখি, তার দিকে খেয়াল করলেই পরিস্কার হবে এগুলি মূলত ধর্মকে রাজনৈতিক পরিচয় ও সম্প্রদায়ের ভিত্তি ধরে সংগঠিত তৎপরতা।

আসলে একটু আন্তরিক হলেই কিছু নিখাদ বাস্তবতা যে-কারোর নজরে পড়ার কথা। ইসলাম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধধর্মের অতীত ও বর্তমান ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে, মানুষ যেখানে জন্মায় এবং যেখানে জীবন-যাপন করে তার সাথে তাদের অনুসৃত ধর্মের ভৌগলিক সাদৃশ্য পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব। উল্লেখিত তিন ধর্মের ভৌগলিক উৎপত্তি একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে হলেও, বর্তমানে এসব ধর্মের অনুসারী পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে। একই ধর্মের মানুষেরা বিভিন্ন ভাষা, জাতীয়তা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধীন। মূলত এই বহুধা-বৈচিত্র‍্য এবং আন্তর্ধর্মীয় বাহাস-মিলনই ধর্মের অন্তস্থিত প্রাণ। এমনকি ভারতবর্ষের ভক্তি ও সুফি সিলসিলা প্রমাণ করে যে, এক অঞ্চলের ধর্ম ও সংস্কৃতি, অন্য অঞ্চলের ধর্ম ও সংস্কৃতির মিশেলে নতুন পরিণত রূপ পায়। এক্ষেত্রে হুমায়ুন কবিরের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য: পশ্চিমবাংলার হিন্দুমানসে ইসলামের সংঘাতে জেগেছিল বৈষ্ণব গীতিকা, পূর্ব-বাংলার হিন্দুমানসে সে-সংঘাতে জাগল মনসামঙ্গল।২৩ হুমায়ুন কবিরের বাংলার কাব্য কিতাবে সওয়ার হয়ে আমরা আরও বলতে পারি, বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার বাংলা অঞ্চলে একটা প্রায় সামাজিক বিপ্লবের মতোন ঘটনা। বিশেষত পূর্ব-বাংলায় বৌদ্ধ-বিপ্লব আর মুসলিম সংস্কৃতির প্রসারের অভিঘাত যতটা না ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক।

ধর্মকে রাজনৈতিক সম্প্রদায় অর্থে জাতিতে পরিণত করা এবং সেই জাতিকে ঘিরে ধর্মীয় উন্মাদনা কেবল জাতি ধারণাকেই হুমকির মুখে ফেলছে না, বরং খোদ ধর্মকে স্রেফ এবং স্রেফ পরিচয়বাদী রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে তুলছে।

 

ধর্ম ও রিলিজিয়ন

‘ধর্ম’ আর ‘রিলিজিয়ন’ এক কথা নয়। কিন্তু যে-কোনো উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষের মতো আমরাও হীনমন্যতায় আক্রান্ত। যেন ইউরোপীয় সকল রাজনৈতিক-দার্শনিক বর্গের এমন এক তেলেসমাতি ক্ষমতা আছে, যা কিনা চাইলেই ভারতবর্ষের বিচিত্র মত-পথ প্রকাশক বর্গকে অর্থ সহকারে আত্মস্থ করতে পারে। এটা অবশ্য অনুবাদ প্রক্রিয়ারও একটা সংকট। আমরা ধরে নিয়েছি অনুবাদ করার অর্থ হচ্ছে ভাষান্তর করা। যেন এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহের স্থানিকতা ও ঐতিহাসিকতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা চলে। বিশেষত ইউরোপের নির্দিষ্ট স্থানিক বর্গও নিজেকে ইতিহাস-সংস্কৃতি ছাপানো সর্বজনীন বর্গ হিসেবে জাহির করতে পারে। কিন্তু অবশ্যই ইউরোপ ভিন্ন অপরাপর অঞ্চলের ঐতিহাসিক বর্গসমূহের সেই হিম্মত থাকতে পারবে না! এই বর্গগুলো অতি অবশ্যই স্থানিক, নির্দিষ্ট কালের এবং নির্দিষ্ট ইতিহাস সম্বলিত হতে হবে। আধুনিক জমানায় এই বর্গগুলোর মধ্যে থাকা ঐতিহাসিকতা ও দার্শনিকতার সন্ধান করা যেন পণ্ডশ্রম মাত্র!

এজন্যই ইতিহাসবিদ প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা আরও একবার বিচার মানবো। তিনি এক চমৎকার প্রবন্ধ লিখে আমাদের জানাচ্ছেন, ‘রিলিজিয়ন’ বর্গটি আমরা আত্মস্থ করেছি ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্য থেকে এবং ভারতের বিভিন্ন দার্শনিক ও পৌরাণিক ধারা, প্রথা-চর্চা বোঝাতে কোনো প্রকার বিচার-বিবেচনা ছাড়াই একে ব্যবহার করছি।২৪ ইউরোপীয় ‘রিলিজিয়ন’ বর্গটি দ্বারা যা বোঝানো হয়, ভারতবর্ষে সত্যিই এর কোনো পরিভাষা নেই। কখনোই ছিল না। ভারতবর্ষীয় ‘ধর্ম’ (dharma) বর্গটির সাথে রিলিজিয়ন এর আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ‘ধর্ম’ বলতে মূলত বোঝায় কর্তব্য। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর এক প্রবন্ধে বলছেন: বলা বাহুল্য এখানে ‘ধর্ম’ মানে ইংরেজি অর্থে ‘রিলিজিয়ন’ নয়। ধর্ম মানে কর্তব্যকর্ম, সৎকর্ম, ধর্ম মানে সমাজহিতকর নিয়ম, ধর্ম মানে সুনীতি। ধর্মের বিধি কোনো শাসকের তৈরি নিয়ম নয়, তা যেন নিত্য, ধ্রুব, চিরসত্য।২৫

আমরা প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সূত্র ধরে আরেকপ্রস্থ আগাবো। ধর্ম অর্থে ‘কর্তব্য’ হতে পারে সামাজিক কর্তব্য। ধর্মশাস্ত্রগুলোতে সচরাচর বর্ণবিভাজনের ভিত্তিতে যা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন ক্ষত্রিয় ধর্ম হলো যুদ্ধ করা, শুদ্র ধর্ম হলো সেবাদান। কর্তব্য আবার সর্বজনীনও হতে পারে। যেমন অহিংসা ও অনৃশংসতা। কর্তব্য হতে পারে ব্যক্তিগত, যেমন দেবতাদের প্রতি কর্তব্য। পূর্বপ্রজন্মের প্রতি কর্তব্য, গুরু ও দুস্থদের প্রতি কর্তব্য। এসব ক্ষেত্রে কর্তব্য-ঋণের অর্থদ্যোতনা এমন যা কোনোদিন পরিপূর্ণভাবে শেষ হবার নয়। ধর্মের সমান্তরালে অবস্থান করে ‘কর্ম’ (Karma)। প্রার্থনা, আরাধনা, উৎসর্গ, পবিত্রস্থান ভ্রমণ ইত্যাদিকে মনে করা হতো পবিত্রকর্ম। এগুলো আবার অঞ্চল ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভীষণ রকমের আলাদা আলাদা ছিল।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে তামাম ভারতবর্ষে বিপুল পরিমাণে ভক্তি-উপাসনামূলক গোষ্ঠী ও সুফি তরিকা সক্রিয় ছিল। সৃষ্টিকর্তা, আচার-বিশ্বাস, গুরু পরম্পরা সম্পর্কে তাদের জগৎকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জনপ্রিয় রুহানির এই স্তরগুলো গড়ে উঠেছিল প্রতাপশালী রীতিনীতিকে অগ্রাহ্য করেই। এদের মধ্যে কোনো কোনো গোষ্ঠী পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্যবাদ কিংবা ওয়াহাবিবাদে বিলীন হয়ে গেলেও, কিছু গোষ্ঠী কিন্তু উপাসনা-বিরোধী শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসেবে টিকে গেছে। শিখ সম্প্রদায় তেমনই একটি সম্প্রদায়। কোনো কোনো সম্প্রদায়কে ঘিরে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঘরানাতেই শক্তিশালী বর্ণাশ্রমবিরোধী শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই সম্প্রদায়গুলো বর্ণাশ্রম ও লৈঙ্গিক মান্যতাকে অনেকাংশেই বিপাকে ফেলে দিয়ে বিকল্প সামাজিক বিন্যাস গড়ে তুলেছিল। এই গোষ্ঠীগুলো বরাবরই ব্রাহ্মণ ও আশরাফ শ্রেণীর মতো সামাজিকভাবে অত্যন্ত ক্ষমতাধর পক্ষসমূহের চক্ষুশূল ছিল। নাথপন্থী ও ফরায়েজিদের মতো গোষ্ঠীবর্গ নিজেদের অধিকার আদায় করার লক্ষ্যে এমনকি সশস্ত্র লড়াই-প্রতিরোধেও জড়িয়েছে। আবার বাউল-ফকিরদের মতো ভক্তি পরম্পরায় বিকশিত প্রেম ও সুন্দরের সাধনায় মশগুল গোষ্ঠীর অস্তিত্বও ছিল।

এখানে বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গ আনতেই হয়। সুদীপ্ত কবিরাজ বৌদ্ধধর্ম আবির্ভাবের দার্শনিক পটভূমির আলোচনায় দেখিয়েছেন, বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব প্রধানত প্রতিবাদ হিসেবে। বৈদিক সমাজের ভেতর থেকেই বৌদিক-সংস্কৃতির প্রতি বৈরাগ্য দেখিয়ে বৌদ্ধধর্ম নিজেকে বিকশিত করেছে। মানুষের জীবনের ভালো-মন্দ সংক্রান্ত এথিকসের উৎস হিসেবে বৌদ্ধরা ধর্মের কোনো কেন্দ্রীভূত ধারণায় বিশ্বাস করেন না। একটা কাজ ভালো কী মন্দ সেটার সম্পর্কে ভাববার দায়িত্ব কর্মের কর্তা থেকে সরিয়ে কোনো ধর্মপদ্ধতি বা সমাজের কর্তাদের হাতে তুলে দেয়ার আচারে বৌদ্ধরা অবিশ্বাসী। আচারের বলে দেয়া কাজ ভালো আর তা না করলে খারাপ— বৌদ্ধরা এমন ধারণা মানতে রাজি নন। তাঁদের মতে ভালো জীবন হচ্ছে জীবন যেসব কাজের উপাদানে তৈরি, সেগুলো সম্পর্কে এথিকাল ভাবনা করে জীবন কাটানো। এথিকাল মনন অন্যের হাতে তুলে দিয়ে ধার্মিক জীবন হতে পারে না। পূর্ব-প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী চললে জীবন সহজ হতেও পারে, কিন্তু তাতে কোনো মহত্ত্ব নেই বলে বৌদ্ধরা মনে করেন। বৌদ্ধরা ঈশ্বর-ধারণায় বিশ্বাসী নন— বৌদ্ধরা ধার্মিক কিন্তু নিরিশ্বরবাদী। তাঁরা মনে করেন ধর্মে বিশ্বাস ঈশ্বর ধারণার ওপর নির্ভরশীল নয়।২৬ অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে, ভারতবর্ষে ‘ধর্ম’ ও ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে ধারণা এত বৈচিত্র্যপূর্ণ যে এক ‘রিলিজিয়ন’ বর্গে একে আঁটানো অসম্ভব।

একইভাবে, ভারতীয় চিন্তা-পরম্পরায় ‘দর্শন’ বলতে কোন মেটা-ক্যাটাগরি পাওয়া যায় না। বরং, মত, দর্শন, আগম ইত্যাদি নানা বর্গে এ অঞ্চলের চিন্তা-ঐতিহ্যকে ধরা যায়। বেদান্ত, মীমাংসা, যোগ, বৌদ্ধ, জৈনর মতো ধারাগুলো সৃষ্টি ও বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে নিগূঢ়তম দার্শনিক প্রশ্নের চর্চা করত। কোনো কোনো চিন্তা-ঐতিহ্য স্রষ্টা ও দেবতা নিয়ে দারুণরকমের সংশয়ী ছিল। তবে এসব চিন্তা-ধারাকে ইউরোপীয় অর্থে ধর্মতত্ত্ব বলার সুযোগ নেই। এই ধারাগুলো যুক্তি বনাম বিশ্বাস এর অতিসরলীকৃত ফাঁদে কখনোই পড়েনি। মূলত এই চিন্তা-পরম্পরাগুলো ব্রহ্মা বাস্তব নাকি মায়া, পরিবর্তনশীল নাকি শাশ্বত এমন যুক্তিবাদী ও দার্শনিক প্রশ্নের মোকাবেলা করত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এগুলোর কোনোটাই চার্চকেন্দ্রিক কোনো রাজনৈতিক শক্তির অধিকারী ছিল না, যার মাধ্যমে নিজেদেরকে মতকে কায়েমি সত্যে পরিণত করা যায়।

ভারতের সনাতন ইতিহাসে ভক্তি-প্রার্থনা-বন্দনা-যুক্তি-আরাধনার এই বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ কাঠামোকে কখনোই ‘হিন্দুত্ব’ বলতে কোনো একক রিলিজিয়নের ছাদে আনা সম্ভব ছিল না। তবে ব্রাহ্মণ্যবাদ ছিল, কিন্তু এর পাশাপাশি চিরকাল ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলনও জারি ছিল।

‘হিন্দুত্ব’ বলতে কোনো মনোলিথিক রিলিজিয়াস ট্র‍্যাডিশনের উদ্ভব ঔপনিবেশিক আমলে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ গোটা বিশ্বের ম্যাপকে ধর্মের নিক্তিকে মেপেছে। তারা ইউরোপীয় খ্রিস্টানধর্মের আদলে ভারত=হিন্দুত্ব, মধ্যপ্রাচ্য=ইসলাম, চীন=কনফুসিয়াসবাদ এমন সরল ও বিপজ্জনক বিভাজনরেখা তৈরি করেছে। পরবর্তীতে উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষেরা খুশিমনে এই ধর্মতান্ত্রিক ভুয়া ম্যাপকে মেনে নিয়েছে এবং নিজেদেরকেও এভাবে পরিচিত করেছে। ফলে বিকল্প জগৎকল্পনা ও সামাজিক সংহতিবোধ এ সকল অঞ্চলের মানুষেরা বেমালুম ভুলে গেছে। এ এক নির্মম ট্র‍্যাজেডিই বটে। ভারতবর্ষ তার নিজের ঐশ্বর্যময় চিন্তা-ঐতিহ্যকে ভুলে গিয়ে নিজস্ব দার্শনিক সৃজনীশক্তির মৃত্যু ঘটিয়েছে। ইউরোপে ষোড়শ শতকের রক্তাক্ত ধর্মযুদ্ধের পর যেমনটা হয়েছিল, তেমন করে প্রাচীন ভারতবর্ষের ধর্মীয় বিবাদ ও সংঘাত কখনোই রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়নি। ইউরোপের তৎকালীন নব্য বিকশিত আধুনিক রাষ্ট্র এক ভয়াবহ তীব্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিজস্ব আর্মি ও পুলিশবাহিনী সম্পন্ন চার্চকে রাজনৈতিক ক্ষমতাশূন্য করেছিল। ষোড়শ শতকের অব্যবহিত পরেই ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো রাষ্ট্রধর্ম গঠন করতে শুরু করে এবং নিজস্ব রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে ইহুদি, মুসলমান, এমনকি প্রচলিত প্রথা-বিরোধী খ্রিস্টানদের নির্বিচারে বধ করতে থাকে। চার্চ কিংবা অন্য কোনো অ-রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যেন প্রজাদের ওপর কোনো প্রকারের রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক প্রভাব খাটাতে না পারে সেজন্য এই বধযজ্ঞ চালানো হয়। এটাই আধুনিক হওয়ার পথে ইউরোপের ধর্মীয় ইতিহাস, যাকে নজিরবিহীনভাবে আমরা আমাদের ‘ইতিহাস’ ভেবে এমনসব সংকট নিয়ে ভুগছি, যা কোনোদিনও আমাদের সংকট ছিল না।

 

চেনা ‘তৌহিদি জনতা’র ‘পৈতা’ লাগে না

কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর, পত্রিকার খবরাখবরের বরাত দিয়ে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, হামলাকারীদের আচরণ ও চেহারা ‘সাম্প্রদায়িক’ বলতে আমরা যা বুঝি ঠিক তা নয়। বরং, হামলাকারী সহিংস পক্ষের আচরণ ও ভঙ্গি অনেকটাই ‘সেক্যুলার’। এই বক্তব্যের মাধ্যমে আসলে কি প্রমাণ করতে চাওয়া হচ্ছে বোঝা মুশকিল! সাম্প্রদায়িকতাকে একচেটিয়াভাবে ‘ধর্মীয়’ ঘটনা বলে মনে করলেই কেবল এমন দাবি করা সম্ভব। অর্থাৎ, ‘তৌহিদি জনতা’ যেহেতু পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচার-ভঙ্গিতে ধর্মের চিহ্ন বহন করে না, তার মানে দাঁড়াচ্ছে হামলা ও সহিংসতাগুলো ঠিক ‘সাম্প্রদায়িক’ নয়!

আসলে লেবাস দিয়ে সহিংসতার সাম্প্রদায়িকতা/অসাম্প্রদায়িকতা ফয়সালার মুশকিল অনেক। লেবাস দিয়ে আসলে ‘সাম্প্রদায়িক হামলা’কে চেনা যায় না। প্রথমত, সাম্প্রদায়িকতা লেবাসের ওপর নির্ভরশীল নয়। বদরুদ্দীন উমর সেই ষাটের দশকে (যার কথা আমরা আগেও উল্লেখ করেছি) দেখিয়েছেন, ধর্মীয় আচার-বিচারের সম্পর্ক ধর্মনিষ্ঠার সাথে। অন্যদিকে, সাম্প্রদায়িকতা দুনিয়াবি স্বার্থের বিষয়। এর লাভালাভ উমরের ভাষায় ‘ইহলোকে’। উমর আরও বলছেন, ‘ঐহিক স্বার্থই সাম্প্রদায়িকতার জনক। সাম্প্রদায়িকতার জন্য তাই ধর্মে নিষ্ঠাবান হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাম্প্রদায়িকতা এ অর্থে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ।’২৭

বদরুদ্দীন উমরের সাথে আমাদের দ্বিমত কোথায় তা আমরা আগেই পরিস্কার করেছি। কিন্তু এখানে আমরা উমরের সাথে সম্পূর্ণ একমত। অপরাপর সাম্প্রদায়িকতা তো বটেই, এমনকি ধর্মজাত সাম্প্রদায়িকতাও আগাগোড়া ‘সেক্যুলার’। সুতরাং, হামলাকারী ‘তৌহিদি জনতা’কে বহিরাঙ্গে ধর্মের চিহ্ন বহন করতেই হবে এমন কোনো দিব্যি নাই। লেবাসের দিক থেকে চরম ‘সেক্যুলার’ হামলাকারীর উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়‘সাম্প্রদায়িক’ হতে পারে। আবার হামলাকারীর লেবাসে ধর্মের চিহ্ন থাকতেও পারে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হামলার প্রণোদনা যেহেতু কেবল ধর্মজাত নয়; কিংবা বলা ভালো, সাম্প্রদায়িকতা যেহেতু বিশেষভাবে কেবল ধর্মের সাথেই সংশ্লিষ্ট না, বরং, সম্প্রদায় ও পরিচয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার। ফলে হামলাকারীরা ধর্মীয় লেবাসধারী হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। বাঙালি কম্যুনিটি যখন একযোগে ‘অ-বাঙালি’ চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা কম্যুনিটিকে বর্ণবাদী চোখে দেখে, তাকেও সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে চিনতে শেখা জরুরি। অর্থাৎ, [মতাদর্শরূপে] ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার একটা উপাদান মাত্র, একমাত্র নয়। সাম্প্রদায়িক হামলায় অংশগ্রহণকারীরা ব্যক্তিজীবনে কতটা ধার্মিক কি অধার্মিক এই বিশ্লেষণের সামান্যই গুরুত্ব আছে। পীরগঞ্জের হিন্দুপল্লীতে আগুন দেয়ার ঘটনায় স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা ও মসজিদের ইমামের আঁতাতের২৮মনস্তত্ত্বটা গভীরভাবে বোঝা দরকার। এমন না যে, অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে এই দুই ভিন্ন ঘরানার মানুষ একই সুরে চালিত হন, কিন্তু আগুন লাগানোয় নেতৃত্ব দেয়ার ওই মুহূর্তে তারা ‘মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই’ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হতে পেরেছেন। অন্য ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ ও আগ্রহ স্থানীয় ক্ষমতার অন্যান্য আর দশদিক দ্বারা গঠিত ও নির্ণীত হবে এটাই স্বাভবিক।

 

‘বিশুদ্ধ’ জাতি, সংখ্যালঘুকরণ ও ক্ষুদ্র সংখ্যা-বিদ্বেষ:

হামলাকারীদের প্রেরণা তাদের ধর্মীয় বোঝাপড়া থেকে আসতে পারে, কিন্তু খেয়াল করা দরকার, তারা কেউই অতীতে ফিরে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে না। আধুনিক রাষ্ট্র, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী ও ‘বিশুদ্ধ’ জাতি-কল্পনা থেকেই সাম্প্রদায়িকতার আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে‘অন্য’ (নৃ-তাত্ত্বিক, ভাষিক, ধর্মীয় এমনকি উপধর্মীয়) সম্প্রদায়কে এ ধরনের ‘জাতীয় বিশুদ্ধতা’ অর্জনের ক্ষেত্রে একটা উপদ্রব ও অন্তরায় ভাবা হয়। এই ‘বিশুদ্ধ’ জাতি-কল্পনা বাঙালি-নির্ভর হতে পারে, আবার মুসলমান, হিন্দু-নির্ভর (ভারতের ক্ষেত্রে) হতে পারে এবং এহেন‘বিশুদ্ধ’ কল্পিত জাতি-সম্প্রদায় বোধ যে-কোনো মুহূর্তে স্রেফ উন্মাদনায় পরিণত হতে পারে। ইতিহাসে এর বহু নজির পাওয়া যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ‘জাতি-সম্প্রদায়’, যারা কেবলই নিজেদেরকে জড়িয়ে একটা ‘বিশুদ্ধ’ ও একচেটিয়া রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী ভাবতে অভ্যস্ত হয়, তারা নিজেদের পছন্দসই ‘সংখ্যালঘু’ বেছেও নিতে পারে। নৃবিজ্ঞানী অর্জুন আপ্পাদুরাই একেই বলছেন, fear of small number;২৯ ‘বিশুদ্ধতা’ অর্জনের পথে ‘অবিশুদ্ধ’, ‘অসুখে আক্রান্ত’ সংখ্যায় অল্প জাতি-সম্প্রদায় এভাবে সংখ্যাগুরুর মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে। এভাবে সাম্প্রদায়িকতা-জাতিবাদ-বর্ণবাদের সংকরে এক ভয়াবহ ডানপন্থী মহাদানবীয় মতাদর্শের উত্থান ঘটতে পারে। উল্লেখ্য, ইতিহাসে কোনো জনগোষ্ঠী কতটা নির্যাতিত ছিল, এর ওপর বর্তমানে সেই জনগোষ্ঠী কতটা মহানুভব তা নির্ভর করে না। বরং, বহুক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অতীত বঞ্চনার ইতিহাস বর্তমানকালের জালিম হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পেছনে দোহাই হতে পারে। জায়নবাদে কেবল ইহুদিবাদীদের একচেটিয়া অধিকার নেই। তার মানে আমরা বলতে চাইছি:

এক. সাম্প্রদায়িকতাকে কেবলই ধর্মজাত মনে না করা যুক্তিযুক্ত।

দুই. ধর্মজাত সাম্প্রদায়িকতাকে কেবলই ধর্মীয় লেবাস কিংবা আচার-বিধি দিয়ে না বোঝা উচিত। কিন্তু এটা মনে রাখা উচিত, এমনকি সাম্প্রদায়িকতার বহিরাবরণে ধর্মের চিহ্ন থাকলেও, তা কোনোভাবেই ‘মধ্যযুগীয়’ ব্যাপার নয়।

তিন. এই পর্যায়ে এসে আমাদের তৃতীয় সিদ্ধান্ত। সাম্প্রদায়িকতা মূলগতভাবে আধুনিক ও সেক্যুলার ঘটনা/মতাদর্শ।

তৃতীয় সিদ্ধান্তে আধুনিকতাবাদী ও সেক্যুলারবাদী ভাই-বোনদের মন খারাপ করার কিছু নেই। এমনকি ধর্মীয় ভাবাবেগে জীবন-যাপন করা ভাই-বোনদের গদগদ হওয়ার কোনো কারণ নেই; তারা যদি সাম্প্রদায়িকতাকে ‘সেক্যুলার’ দাবি করা আমাদের তৃতীয় সিদ্ধান্তের সাথে একমত হন, তার মানে দাঁড়াচ্ছে, এমনকি ধর্মজাত সাম্প্রদায়িকতাও ‘সেক্যুলার’। সেই অর্থে ‘সেক্যুলার’ বর্গটি সেক্যুলারবাদীদের একক সম্পত্তি নয়।

 

কাকে বলে ‘সেক্যুলার’?

বর্তমানে বাংলাদেশে গালি আর ট্রল সংস্কৃতির দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিরাজ করছে। বিশেষত নানা ফেরকার মাননীয় অনলাইন নাৎসিবৃন্দ সবকিছুকেই অনবদ্য দক্ষতায় গালি ও ঠাট্টা-তামাশার বিষয়ে সংকুচিত করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে পারদর্শী। ফলে ‘সেক্যুলার’, ‘সাবলটার্ন’ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক-ঐতিহাসিক বর্গসমূহ এখানে গালিবাজি ও তকমা সেঁটে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমরা অবশ্য এতে বিচলিত নই। বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে চরম হীনমন্য ও অলস একটা জনগোষ্ঠীর যা করার কথা, অনলাইনে তার অতি-উৎকৃষ্ট মহড়া উপভোগ করা যায়।

সেক্যুলার, সেক্যুলারিজম, সেক্যুলারাইজেশন, সেক্যুলারিটি এগুলো অভিন্ন ধাতু-উদ্ভূত হলেও, এই প্রত্যেকটা বর্গের ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা ও তাৎপর্য বিদ্যমান। আমরা অন্য কোনো আলোচনায় এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার ওয়াদা রাখি। আপাতত শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট, ‘সেক্যুলার’ বর্গের বংশলতিকা খুঁজতে গিয়ে বিখ্যাত সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ দেখিয়েছেন, একটি আধুনিক জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অস্তিত্বগত [ontological] দশা হিসেবে ‘সেক্যুলার’ আর রাজনৈতিক মতবাদ [political doctrine] হিসেবে সেক্যুলারিজমের ফারাক না করা কোনো কাজের কথা নয়। আসাদের মতে ‘সেক্যুলার’ হচ্ছে: that brings together certain behaviours, knowledges, and sensibilities in modern life.৩০

তার মানে, আধুনিকতার সাথে বিজড়িত এক বিশেষ জ্ঞান-পদ্ধতি ও অস্তিত্ব-বোধ হচ্ছে ‘সেক্যুলার’। উল্লেখিত সংজ্ঞায়ন অনুধাবন করলেই কেবল পরিস্কার হবে আশিস নন্দী কেন সাম্প্রদায়িকতাকে ‘আধুনিক ও সেক্যুলার’ হিসেবে সাব্যস্ত করেন। একইভাবে আমরাও সাম্প্রদায়িকতাকে বলছি, বিশেষ এক ধরনের ‘বিশুদ্ধ’ জাত-সম্প্রদায়বোধ, যার সাথে আগের আমলে ফিরে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্য, বাংলাদেশে ও ভারতে অদ্ভুতভাবে ‘সেক্যুলার’ বলতে ধর্মবিরোধী ও নিধর্মী পরিচয়বাদী মতাদর্শ ও সেই মতাদর্শের মুরিদদের বোঝানো হয়। কিন্তু এই প্রবন্ধে আমরা সেই অর্থে ‘সেক্যুলার’ কথাটা ব্যবহার করছি না। সেক্যুলার, সেক্যুলারবাদ, সেক্যুলারকরণ, সেক্যুলারিত্ব ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ-তাৎপর্যকে এক করে আমরা কোনো জগাখিচুড়ি পাকাতে চাই না। তবে এই পরিসরে এতটুকু বলা যুক্তিযুক্ত হবে, বাংলাদেশে‘সেক্যুলার’ বলে যাদের নিন্দামন্দ করা হয় বিপরীত মতাদর্শিক শিবির থেকে, তারা মূলত ‘সেক্যুলারবাদী’। ফলে ‘সেক্যুলার বনাম ধর্ম/ইসলাম’বাইনারি আদতে ‘সেক্যুলারবাদী বনাম ধর্মবাদী/ইসলামবাদী’ নামক দুই পরষ্পর-বিরোধী মতাদর্শিক শিবির। এই দুই পক্ষই পরিস্থিতি-পরিপ্রেক্ষিত মোতাবেক, ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে উঠতে পারে; এবং আসাদীয় অর্থে এরা উভয়েই আবার বাসনা ও অভিপ্রায়ের দিক থেকে ‘সেক্যুলার’ও বটে! আবার এই দুই ক্যাম্পেই স্থিতধী, সমন্বয়বাদী ও পরমতসহিষ্ণু ব্যক্তিবর্গও দেখা যায়।

 

ফতোয়ামূলক চিন্তাপদ্ধতির অধিকারী হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধীতা করা বৃথা আস্ফালন মাত্র

ভারত, বাংলাদেশের এলিট বলয়ে অবস্থানরত অধিকাংশ মানুষেরা মোটাদাগে বর্ণবাদী, অগণতান্ত্রিক ও ফতোয়াবাজ। সাধারণ মানুষকে তাদের প্রাত্যহিক জীবনাচার ও বিশ্বাসের দরুন হেয়-প্রতিপন্ন করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, আধুনিক দুনিয়ার ‘অনুপযুক্ত’ সাব্যস্ত করা এই এলিট শ্রেণীর মজ্জাগত। তারা যদি একবার কোনো কিছুকে ‘সর্বজনীন মঙ্গল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন, তারপর থেকে তারা প্রত্যাশা করেন আপামর মানুষের কাজ হচ্ছে কেবল চোখ বন্ধ করে তাদের পেছন পেছন লেফট-রাইট, লেফট-রাইট করা। যদি আপামর মানুষ তা না করে,সেক্ষেত্রে বেত্রাঘাত করে হলেও মানুষকে ‘লাইনে’ আনার ফরমায়েশ এই এলিটকুল করতে চান। এই চিন্তাপদ্ধতিকেই আমরা বলছি‘ফতোয়ামূলক চিন্তাপদ্ধতি’, যা সাধারণ মানুষের সাথে আন্তরিক গণতান্ত্রিক সংলাপে লিপ্ত হওয়ার দায় বোধ করে না। এই চিন্তাপদ্ধতিকে‘সাম্প্রদায়িক চিন্তাপদ্ধতি’ও বলা যেতে পারে।

আমরা এখানে ‘পিপল ক্যান্ট ডু রং’ মার্কা রোম্যান্টিক আপেক্ষিকতার পক্ষ নিচ্ছি না। শুধু বলার চেষ্টা করছি, একটা সমাজের জন্য যা কিছু মঙ্গলজনক, তার উৎপাদন ও ভোগ হতে হবে তল থেকে চূড়ার দিকে আরোহী কায়দায় সামষ্টিকভাবে। এলিটদের নাকউঁচু মনোভাব এক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না। বরং, ভেজাল বাড়ায়। সেটা কেমন? রাষ্ট্র ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতাশ্রিত এলিটদের একাংশ যদি সাধারণ মানুষকে অষ্টপ্রহর তাদের অস্তিত্বের জন্য খাটো করতে থাকে, হীনমন্যতা ছড়িয়ে দেয় এবং দুয়োধ্বনি দিতে থাকে; মধ্যবিত্ত এলিটদেরই আরেক অংশ এর বিরোধীতা করতে গিয়ে আপেক্ষিকতার [রিলেটিভিজম] খপ্পরে গিয়ে পড়ে। তাদের চিন্তাপদ্ধতি হয়ে ওঠে দুরভিসন্ধিমূলক, ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব নির্ভর। তারা এবার সমস্ত কিছুতে সরকার ও রাষ্ট্রের দায় খুঁজতে থাকে। সরকার ও রাষ্ট্রের দায় যে থাকে না আমরা তা মোটেও মনে করি না। দায় থাকেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে  সাধারণ মানুষ কেবল বিপ্লব ও বিদ্রোহপ্রবণ, উচ্চবর্গের দাবার ঘুঁটি ও হাতের পুতুল। জনসাধারণ যে সুযোগমতো সহিংস হয়ে উঠতে পারে, হয়ে উঠলে সেক্ষেত্রে সেই সহিংসতাকে কেন্দ্র করে ভাবালুতায় না ভুগেও কী করে কার্যকর আলাপ তোলা যায় দুরভিসন্ধিযুক্ত ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব নির্ভর এলিটিস্ট চিন্তাপদ্ধতি তা বুঝতে অক্ষম।

এজন্যই ধর্মবিদ্বেষ কিংবা আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে ‘ইসলাম-বিদ্বেষ’ হয়ে যাচ্ছে কিনা এই আশংকা থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হলেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অ্যাক্টিভিস্টদের একাংশ (তাদের সৎ নিয়তের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল) চট-জলদি রাজনৈতিক কানেকশন খুঁজতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক হামলা আগাগোড়া রাজনৈতিক ঘটনা। কিন্তু ‘সাম্প্রদায়িক’ নয়, এই অর্থে হামলা-সহিংসতাগুলোকে ‘রাজনৈতিক’ হিসেবে সাব্যস্ত করতে চাওয়া রীতিমতো আত্মপ্রবঞ্চনার সামিল। সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলেও কি করে ‘ধর্মবিদ্বেষী’ (ব্যক্তি পর্যায়ে ধর্মে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই, ধর্মবিদ্বেষ এক ধরনের বর্ণবাদ) না হতে হয় সেই তাত্ত্বিক-সামগ্রী উৎপাদনের কাজে হাত দেয়া দরকার। ধর্মাশ্রয়ী জগৎবীক্ষার অংশীদার হওয়ার মানেই কেউ ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ এমন ক্ষতিকর প্রগতিবাদী ভাবনার আজকাল আর কোনো গুরুত্ব নেই। পাশাপাশি ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরও এটা উপলব্ধিতে থাকা দরকার যে, ইতিহাসের স্ট্রাকচারগুলো যেভাবে আমাদের জীবনের সরঞ্জামকে আমাদের জন্মের আগের থেকেই সাজিয়ে রাখে, তা-ও অনেক সময়েই ধর্ম থেকে আমাদেরকে বাহ্যিকভাবে বা মনের দিক থেকে সরিয়ে রাখে।৩১

আসলে ধার্মিকতাই হোক আর সেক্যুলারিত্বই হোক, দুটো আচার বা জীবনচর্চার পক্ষেই নানা দার্শনিক যুক্তি আছে। আন্তরিকভাবে পরস্পরের অস্তিত্ব স্বীকার করেই সেগুলোর ব্যাপারে সহিষ্ণু হওয়া উচিত। তা না করে পরস্পরের বিরুদ্ধে ফতোয়া দাগাতে থাকলে সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদের উর্বর জমিন প্রস্তুত হতে থাকে। এক ধরনের সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদী মনোভাব পোষণ করে অন্য ধরনের সাম্প্রদায়িকতার সমালোচনা আদতে‘সমালোচনা’ নয়, দুই প্রতিপক্ষ মতাদর্শিক শিবিরের ‘অনন্তযুদ্ধ’। কিন্তু আমরা ধর্মপ্রশ্নে সহিষ্ণু ও আন্তরিক মানুষদের উদ্বেগকে আমলে নিয়েই বলছি: ধর্ম ও ধর্ম-বিশ্বাসী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা, ধর্ম বিশ্বাসের/অবিশ্বাসের দরুন জুলুমের শিকার হলে তার/তাদের পাশে থাকা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা একইসাথে চলতে পারে। কারণ সাম্প্রদায়িকতা ভীষণভাবে পরিস্থিতি-নির্ভর এবং মুসলমানের একার সমস্যা নয়। প্রগতি-আধুনিকতা-ধর্ম-নাস্তিকতা-সেক্যুলারবাদ সব মোড়কেই সাম্প্রদায়িকতা হাজির হতে পারে। ‘হিন্দু’ প্রশ্নে উদার মুসলমান ‘চাকমা’ প্রশ্নে চরম সাম্প্রদায়িক হতে পারে। ‘হিন্দু’ ও ‘চাকমা’ প্রশ্নে উদার ‘প্রগতিশীল’ ব্যক্তি ‘মুসলমান’ প্রশ্নে চরম বর্ণবাদী মনোভাবের অধিকারী হতে পারে। আবার যে ‘হিন্দু’ ব্যক্তি ‘মুসলমান’ এর সাম্প্রদায়িকতার শিকার, অন্য আরেক পরিপ্রেক্ষিতে সেই একই ব্যক্তি বাংলাদেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর প্রতি সাম্প্রদায়িক মনোভাবযুক্ত হতে পারেন। এক্ষেত্রে আবার আগের পরিপ্রেক্ষিতের ‘হিন্দু’ ও মুসলমান’ মিলেমিশে ‘মাছে-ভাতে আমরা বাঙালি’ পরিচয় বরণ করতে পারে।

 

নানা বর্ণের পরিচয়

দীপেশ চক্রবর্তীর বরাত দিয়ে আমরা আগেই দাবি করেছি, পরিচয়কে স্থায়ীরূপ দিতে চাওয়ার মধ্যে একটা দুরভিসন্ধি থাকে। আসলে মানুষের সত্তা ও পরিচয় পরিস্থিতি-নির্ভর, সতত পরিবর্তনশীল। বেশিরভাগক্ষেত্রেই যাপিত-জীবনে পরিচয় সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো আমাদের অস্তিত্বের সাথে থেকে যায়। আসল প্রশ্নটা হলো, একটা বিশেষ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মানুষ কিভাবে তার সত্তা ও অস্তিত্বকে অনুভব করে? এ প্রসঙ্গে এখানে আমরা বিস্তারিত আলাপ করতে পারব না। শুধু এইটুকু বলা দরকার যে, মানুষের পরিচয় ও সত্তার সংকটকে ‘ভুল দ্বন্দ্ব’ কিংবা‘অপ্রধান’ সংকট সাব্যস্ত করে কোনো একটা আপাত-বৃহৎ ‘আসল’ রাজনৈতিক সমাধান হাজির করে মানুষকে সেই সাইনবোর্ডের নিচে সমবেত হতে বললেই মানুষ তাতে পিলপিল করে গিয়ে জমা হবে না। যে ব্যক্তি তার চাকমাত্ব সহকারে নাগরিক পরিচয়ে পরিচিত হতে পারেন না কিংবা যে ব্যক্তি [ভারতের ক্ষেত্রে] তার মুসলমান পরিচয়ের কারণে নির্যাতনের শিকার; তাদের ক্ষেত্রে তাদের পরিচয়ের স্বীকৃতির দাবির সাথে নাগরিক অধিকারের দাবির কোনো বিরোধ নেই। অর্থাৎ, তাদের ক্ষেত্রে তাদের সম্প্রদায়গত পরিচয়ের স্বীকৃতি অর্জন করাই ‘প্রধান’ দ্বন্দ্ব। তাদের কাছে গিয়ে স্রেফ বললেই হবে না, জাতপাত, হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা, সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা ‘ভুল’ সমস্যা, আসল সমস্যা লুকিয়ে আছে কোনো না কোনো বর্ণের ‘বস্তু্বাদ’ এর আড়ালে। একইভাবে একজন ‘নারী শ্রমিক’ কেবলই ‘শ্রমিক’ নয়, তার ক্ষেত্রে তার লিঙ্গীয় পরিচয় সহকারে তার শ্রেণী অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।

 

মানুষের চৈতন্য রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল নয়

কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা নানা কিসিমের অর্থনীতিবাদে (ইকনমিজম) আটকে থাকে। আমরা মনে করি, অর্থনীতিই সকল সমস্যার ভিত্তি। মার্কসবাদী অর্থনীতিবাদ মনে করে শ্রেণী আর অর্থনীতির ইতিহাসই ‘আসল’ ইতিহাস; বাকিসব জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির ইতিহাস ‘ভুয়া’ ইতিহাস। মালিকশ্রেণীর ষড়যন্ত্র! কিন্তু একটা বিশেষ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একজন শ্রমিক নিজেকে ‘শ্রমিক’ না ভেবে, ‘হিন্দু’ বা‘মুসলমান’ কেন ভাবে তা এই ব্যাখ্যা থেকে বোঝা মুশকিল।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের অ-মার্কসবাদী অর্থনীতিবাদীরা শ্রেণীর ইতিহাসকে ‘প্রধান’ মনে না করলেও; সাম্প্রদায়িকতা, জাতি সমস্যা এসব ইতিহাসকে ‘ভুয়া’, নিদেনপক্ষে ‘গৌণ’ সংকটই মনে করে। তারা মনে করে ‘নাগরিকবোধ’ জাগ্রত হচ্ছে না বলেই লোকে হিন্দু-মুসলমান, চাকমা-বাঙালি ইত্যাদি ‘ভুল’ দ্বন্দ্বে মেতে থাকে। আসলে নাগরিক ‘হওয়ার’ মধ্যে এমন কোনো তেলেসমাতি নাই যা মানুষকে মহান ‘অসাম্প্রদায়িক’ করে তুলবে। এজন্য সাধারণ মানুষের চৈতন্যকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। চৈতন্য যে রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল না তা আজকাল আর কারোর জানতে বাকি নেই। আধুনিক জমানার সমস্ত সমস্যার মূলেও রাজনৈতিক অর্থনীতি না। নিছক উপনিবেশ-বিরোধী কিংবা কোনো এক রেজিম-বিরোধী ইতিহাস-ব্যাখ্যার পদ্ধতি এলিটিস্ট এই অর্থে যে, এটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু-ইতিহাস আত্মসাৎ করে উচ্চবর্গের রাষ্ট্র নির্মাণের মতাদর্শিক হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। সমগ্র জনগোষ্ঠীর একটা কোনো ‘অখণ্ড ইতিহাস’ আছে ভাবলে যে-ইতিহাস তৈরি হয়, তার অনিবার্য পরিণত হিসেবে এলিটিস্ট উচ্চবর্গের অনুকূল অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরি হয়। কৃষক-শ্রমিক-নারী-হিন্দু-উর্দুভাষী-চাকমা-মারমা-ম্রোদের আলাদা আলাদা সংকটকে আত্মসাৎ বা অস্বীকার করে নয়; আমলে নিয়েই ‘ঐক্যের গণতান্ত্রিক’ রাজনীতির কথা ভাবতে হবে। আসলে সহজ সত্যটা হলো, একটা জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের বহুধা-বিচিত্র সমস্যা সমাধানের কোনো একটা সহজ সূত্র নেই। থাকলে ভালো হতো, বাস্তবতা হচ্ছে নেই।

 

‘ক্ষুদে মানব’ এর উত্থান

‘ক্ষুদে মানব’ (little man) আকারে ক্ষুদ্র নয়। ‘ক্ষুদে মানব’ বলতে সেই ধরনের প্রান্তিক মানুষদেরকে বোঝানো হয়, যাদের মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড বঞ্চনা ও প্রতারণার বোধ। যারা মনে করে আলোকায়ন, আধুনিকতাসহ সমস্ত লিবারেল মূল্যবোধ আসলে ফাঁকা বুলি। এলিটদের কায়কারবার। আধুনিক জনপরিসর আর তার নানাবিধ প্রতিশ্রুতি থেকে সে কিছুই পায়নি। বরং, ক্রমাগত প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর হতে হয়েছে। ফ্যাসিবাদ ও ডানপন্থার গণ-মনস্তত্ত্ব বুঝতে হলে ‘ক্ষুদে মানব’ সম্পর্কে বোঝাপড়া কোনো বিকল্প নাই। বিশ্বব্যাপী ডানপন্থার উত্থান নিয়ে ম্যালা কাজ হয়েছে। এখানে আমাদের সেই সব কাজের সবগুলোর আলোচনা করার ফুরসত মিলবে না। কেবলমাত্র ডানপন্থার বৈশ্বিক উত্থান সংক্রান্ত অর্জুন আপ্পাদুরাই এর তত্ত্বতালাশের হদিশ দিয়ে আমরা ‘ক্ষুদে মানব’ প্রসঙ্গে ফিরে যাবো।৩২

আদিত্য নিগম এর কাছ থেকে জানতে পারছি ‘ক্ষুদে মানব’ শব্দবন্ধটির প্রবর্তক মার্ক্সবাদী সাইকোএনালিস্ট উইলহেম রেইখ।৩৩ এই ‘ক্ষুদে মানব’ সনাতনী ‘প্রলেতারিয়েত’ নয়। এই ‘ক্ষুদে মানব’ হচ্ছে সেইসব প্রান্তিক ক্রুদ্ধ মানুষেরা, অন্তত গড় দেড় শতাব্দিজুড়ে যাদের কথা বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছে। তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। এই ‘ক্ষুদে মানব’ দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রথমত, তাদের প্রায় দাসোচিত জীবন এবং এর ফলে তাদের মনিব-প্রীতি। ‘ক্ষুদে মানব’ অত্যন্ত প্রভুভক্ত। তবে এই নিরঙ্কুশ ভক্তি সুপার-লিডারদের প্রতিই কেবল নয়, ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের প্রতিও বটে। দ্বিতীয়ত, ক্ষুদে মানবেরা বিদ্রোহী। এই দুইয়ে মিলে এত তীব্রতা ও ভয়ংকর দানবীয় মূর্তি সহকারে জনপরিসরে ক্ষুদে মানবের উত্থান ঘটেছে যা বিগত দুই দশক আগেও অকল্পনীয় ছিল।

সমস্ত রকমের ডানপন্থী ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য: ফাদার-ফিগার খোঁজা, নিদেনপক্ষে কোনো একটা মতাদর্শে আসক্তি ও বিদ্রোহ। আরেকজন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী সাইকোএনালিস্ট এরিখ ফ্রম ক্ষুদে মানবের মধ্যে স্বাধীনতা-ভীতি এবং সমর্পণ-প্রীতি খেয়াল করেছেন। ক্ষুদে মানব কোনো আধুনিক ধর্মাবতার (যেমন নরেন্দ্র মোদি) কিংবা মতাদর্শে আসক্ত হতে চায়।

ফ্যাসিবাদ ও ডানপন্থার যৌথতায় এক বিশেষ ধরনের বিকৃত জাতীয়তাবাদের বাতাবরণে ‘ক্ষুদে মানব’ এর ধারণাটি আরও নিবিড় পর্যালোচনার দাবি রাখে। নিগমের ভাষ্যে:

Against the mythical belief of modernity that all human beings desire autonomy and freedom, Fromm claims that ‘freedom’ is actually a very ambiguous thing: for many people it can mean powerlessness – from which they try to escape by aligining with a father-figure or with a larger community or cause. The panic generated at the sudden loss of a protective authority-figure is identified by both Reich and Fromm as lying at the bottom of the search of the figure of a Leader/ Il Duce/ Fuhrer and is not unrelated to a masochistic yearning for domination (which is of course simultaneously, a sadistic one of killing or maiming the ‘other’).৩৪

আমরা কিন্তু এখানে ইউরোপীয় নাজিবাদের অভিজ্ঞতার আলোকে ফ্যাসিবাদ কিংবা ডানপন্থাকে বুঝতে চাইছি না। বরং, আরও সাধারণ অর্থে একটা বিকৃত ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা অর্থে ‘ফ্যাসিবাদ’ প্রত্যয়টিকে ধরতে চাইছি। এই অর্থে ‘ফ্যাসিবাদ’ কেবলই একটা সর্বাত্মক রাষ্ট্রপ্রণালী নয়, বরং একটা গণ-হিস্টেরিয়া, তৃণমূল পর্যন্ত জালের মতো যার ব্যাপ্তি। এ এমন এক উন্মাদনা পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী সজ্জন, যুক্তিশীল, শিক্ষিত মানুষও স্রেফ গুজব ও হুজুগের পাল্লায় পড়ে উন্মাদনার জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিতে পারে। ভারতের শিখ গণহত্যার সময়ে কংগ্রেস সমর্থক ‘সেক্যুলার’ ভদ্রলোক কিংবা মুসলমান গণহত্যার সময়ে হিন্দু শিক্ষিত ভদ্রলোকের আচরণ, যুক্তিবিন্যাস রাতারাতি বদলে যাওয়ার মনস্তত্ত্ব নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও, বহু ‘উদার’ ও ‘সংবেদনশীল’ মানুষ পাহাড় প্রশ্নে যেভাবে হিস্টেরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তার সাথে আমরা ক্যানসারাস ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির মিল খুঁজে পাই। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে যেন এমনকি‘সভ্য’ লোকেদের সুপারইগো ধরে রাখার আর কোনো বালাই থাকে না, একেবারে নাঙ্গা সহিংস সত্তার আবির্ভাব ঘটে। সহিংস হয়ে ওঠা কিংবা সহিংসতার পক্ষে চক্ষুলজ্জাহীন বৈধতা উৎপাদনের এই ‘সত্তা’ যে ওই একই ব্যক্তির ‘যুক্তিবাদী’ সত্তার সমান্তারালেই হাজির ছিল, এই সত্য না বুঝলে ঠিক সহিংসতার আগ মুহূর্তের নিপাট ভদ্রলোকটি সহিংসতার মুহূর্তে কি করে এমন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হতে পারছে, তা বোঝা সম্ভব নয়।

কাজেই এ ধরনের ফ্যাসিবাদ বা ডানপন্থাকে আমরা একটা গণ-সমাবেশ হিসেবেও দেখি, যার সাথে সরকার ও রাষ্ট্রের আঁতাত থাকে। আরও সাধারণভাবে বললে, এটা এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাপার। পাশাপাশি আরেকটা নোক্তা দিয়ে রাখি; বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদকে নিজের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার আলোকে বোঝা দরকার। অর্থাৎ, এখানকার ফ্যাসিবাদের বিস্তারের সাথে উপনিবেশিক আইন-কানুন, সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র, বাঙালি জাতিবাদী [কখনো কখনো বাংলাদেশী-মুসলমান জাতিবাদী] মতাদর্শ এবং বিদ্যমান নব্য-উদারনীতিবাদের সম্পর্ককে আমলে নেয়া বিশেষ দরকার। এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রণালী ও ফ্যাসিবাদী ‘ক্ষুদে মানব’ পরস্পরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সরকার, ফাদার-ফিগার ও [বাংলাদেশী পরিপ্রেক্ষিতে] ‘তৌহিদি জনতা’র উত্থান ও বিকাশ সমান্তরালেই ঘটতে থাকে। এমনকি কোনো নির্দিষ্ট দেশের বাস্তবতায় যদি দেখা যায়, ডানপন্থী সরকার ও ফ্যাসিবাদের ‘ক্ষুদে মানব’ এর সম্পর্ক দ্বন্দ্বসংকুল, তারপরেও এই পরস্পর বিবদমান পক্ষসমূহ কিভাবে একটা নেটওয়ার্ক গঠন করে স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত রাখে তা বোঝা দরকার। যেমন, বাংলাদেশের হালের ডানপন্থী সংস্কৃতি যদি খেয়াল করা যায়। একদিকে আছে সিংহভাগ মানুষের আচার-বিশ্বাসের প্রতি গুটিকয়েক সুবিধাপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত অ্যাক্টিভিস্ট সমাজের চূড়ান্ত অবহেলা, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশই যাবতীয় লিবারেল মূল্যবোধকে স্রেফ প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে কেবলমাত্র আবেগ-অনুভূতি-বঞ্চনার গল্পসহ জনপরিসরে হাজির। যুক্তি-ন্যায়-বিজ্ঞান সম্পূর্ণ তিরোহিত। দুইপক্ষই যার যার উন্মাদনাকে ‘অথেনটিক’ উন্মাদনা হিসেবে জাহির করছে। বলা বাহুল্য, বর্তমান অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের জন্য এহেন পরিস্থিতিই কাম্য।

 

‘রাজনৈতিকতা’র প্রশ্ন

সাম্প্রদায়িক হামলা-সহিংসতার ঘটনার ক্ষেত্রে দুই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। প্রথমত, সাম্প্রদায়িকতাকে কেবলই ধর্মজাত মনে করা। ফলে গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল-পল্লীতে পুলিশের আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনাকে আর যাই বলা হোক, অনন্ত ‘সাম্প্রদায়িকতা’ হিসেবে সাব্যস্ত করতে কাউকে দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত, যেহেতু আধিপত্যশীল চিন্তায় ‘সাম্প্রদায়িকতা’ কেবলই ধর্মজাত বা ধর্মাশ্রয়ী, এর প্রতিক্রিয়াও আবার দুই ধরনের হয়। একদিকে, কেবলমাত্র হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রদায় আক্রান্ত হলেই তাকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং মুসলিম-ঘৃণা আরও উস্কানি পায়। অন্যদিকে, যারা মুসলিম-ঘৃণার মতো বর্ণবাদ এড়াতে চান, তারা হামলা-সহিংসতাগুলোর পেছনে রাজনৈতিক সংযোগ খুঁজতে থাকেন। এ নিয়ে আমরা আগে খানিকটা আলোচনা করেছি। এই ধাপে কেবল [সাম্প্রদায়িক না] অর্থে ‘রাজনৈতিক’ কথাটার মানে বোঝার চেষ্টা করবো এবং কোনো কিছু কি কি বিবেচনায় ‘রাজনৈতিক’ হয় বা হয় না এই প্রশ্নের মুখোমুখি হবো।

যেমন, এবারকার দেশব্যাপী লাগাতার তাণ্ডবের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন লিখেছেন, “মিছিল করে ‘তৌহিদী জনতা’ কিন্তু হামলা চালাতে লাগে গ্রাম-শহরের লুম্পেন ক্রিমিনাল এলিমেন্ট। রামু থেকে শাল্লায় ক্ষমতাসীন রাজনীতির আশ্রয়ে থাকা মাঠ পদাতিক ঠ্যাঙ্গাড়েদেরই দেখা গেছে। এদের কৌশলীভাবে এখানে-সেখানে হামলায় নামিয়ে দেওয়ার যে প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে, সেটা কেন্দ্রীয় সমন্বয় ছাড়া সম্ভব না।”

এই বক্তব্যের সমস্যা দুটি স্তরে। প্রথমত, ধরে নেয়া হচ্ছে ‘তৌহিদি জনতা’ আর ‘গ্রাম-শহরের লুম্পেন ক্রিমিনাল এলিমেন্ট’ আবশ্যিকভাবে আলাদা দুই এন্টিটি এবং রামু থেকে শাল্লায় ক্ষমতাসীন রাজনীতির আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রসঙ্গ হাজির করে খুব সূক্ষ্মভাবে বলতে চাওয়া হচ্ছে, হামলা-সহিংসতাগুলো ‘সাম্প্রদায়িক’ না অর্থে ‘রাজনৈতিক’। আমরা বরং প্রশ্ন করি, ‘তৌহিদি জনতা’ যদি উমরীয় অর্থে‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ক্যাটাগরি হয়, তাহলে খোদ গ্রাম-শহরের ক্ষমতাশ্রিত ওই ‘লুম্পেন এলিমেন্ট’-কে ‘তৌহিদি জনতা’ ভাবতে বাধা কোথায়? আরও প্রশ্ন করি, রামু থেকে শাল্লায় সরকারী দলের আঁতাত ও যোগসাজশ এর ফলে ঠিক কী করে প্রতিয়মান হয় যে হামলাগুলো আর ‘সাম্প্রদায়িক’ না?

দাঙ্গা প্রসঙ্গে আশিস নন্দী এক সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন, তার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়: দুই ধরনের মানুষই সাম্প্রদায়িক হামলায় অংশ নেয়।৩৫ এক. উল্লেখিত উদ্ধৃতিতে যাদের বলা হয়েছে ‘গ্রাম-শহরের লুম্পেন এলিমেন্ট’। এই অংশ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুণ্ডা-মাস্তান। তারা ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক কি অধার্মিক তাতে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু এ ধরনের হামলার সময়ে তারা (ভারতে) ‘হিন্দু’, (বাংলাদেশে) ‘মুসলমান’বা ক্ষেত্রবিশেষে ‘বাঙালি’ হয়ে ওঠে। আরেক ধরনের মানুষও হামলায় অংশ নেয়। যারা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিপাট ভদ্রলোক। আমার আপনার মতোই সাধারণ মানুষ। যারা নিজেরাও হয়তো জানে না তার মধ্যে একটা খুনী মন তৈরি হয়েছিল। নানা কারণে তার মধ্যে একটা প্রতারিত, নিজেকে বঞ্চিত ভাবার মন আছে। এ ধরনের সহিংস মুহূর্তগুলো তার জন্য চারপাশ, পরিবার ও নিজের কাছে নিজেকে ‘হিরো’ প্রমাণ করার সময়। সাধারণত গুজব, হুজুগ ও মিডিয়া ক্যাম্পেইন (এবং মিডিয়া ব্ল্যাকআউট) সাধারণ মানুষকে সহিংসতায় প্ররোচিত করে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘তৌহিদি জনতা’র গাঠনিক সূত্র বুঝতে আমরা এই দুই দিকই আমলে নিতে চাই।

দ্বিতীয়ত, ‘কেন্দ্রীয় সমন্বয়’ আবিষ্কার করা। এটাও সেই সরকারকে দায়ী করা তথা হামলাগুলোকে ‘সাম্প্রদায়িক না অর্থে রাজনৈতিক’ প্রমাণের মরিয়া প্রচেষ্টা। কেন্দ্রীয় সমন্বয় বা নির্দেশনা যে থাকে না বা থাকতে পারে না তা নয়। গত বছরের দিল্লির মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কেন্দ্রীয় সমন্বয়েই ঘটেছিল। কিন্তু তাই বলে সবক্ষেত্রেই একই প্যাটার্ন খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন। স্থানীয় ক্ষমতার বহু হিসাব-নিকাশ থাকে। হাজিগঞ্জে মন্দির হামলার ক্ষেত্রে স্থানীয় সাংবাদিকেরা ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্রসেনার সমন্বয়ে গঠিত হামলাকারীদের দিকে আমাদের মনোযোগ টেনেছেন। ‘কেন্দ্রীয় সমন্বয়’ না থাকলেই যে সরকারের দায় থাকবে না তা-ও নয়। দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে সরকারকে দায় নিতেই হবে। এত এত গোয়েন্দা তৎপরতা এসব ক্ষেত্রে কেন সক্রিয়ভাবে নিষ্ক্রিয় থাকে সেই প্রশ্ন তোলাও জরুরি। কিন্তু তাই বলে গৎবাঁধা ছকে ‘সাম্প্রদায়িক না অর্থে রাজনৈতিক’ এটা প্রমাণের জন্য সরকার ও সরকার দলীয় ক্যাডারদের সংশ্লিষ্টতার ওপর অন্ধ-মনোযোগ অন্য আরও বড় সত্য আড়াল করে।

হামলাগুলো ‘রাজনৈতিক’ এই দাবির মাধ্যমে আসলে কোনো কোনোভাবে বলতে চাওয়া হয় হামলাগুলো সরকার-রাজনৈতিক দল-প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদে ঘটেছে। এই দাবির সত্যতা আছে। অর্থাৎ, বিগত দিনের বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোতে সরকার দলীয় লোকজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের কথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। তাছাড়া সরকার ও প্রশাসনের সক্রিয়/সচেতন নিষ্ক্রিয়তা তো থাকেই। কিন্তু এই দাবির অন্তর্নিহিত অর্থের সাথে আমরা অন্তত দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দ্বিমত করি।

এক. সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা মানেই তা আর ‘সাম্প্রদায়িক না অর্থে রাজনৈতিক’ আমরা এমনটা মনে করি না। আমরা মনে করি সরকারি দল, সরকার, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ কমিউনিটির‘সরকার ও রাষ্ট্র’ হয়ে ওঠে। সাঁওতাল-পল্লী পোড়ায় যে পুলিশ, তা আমাদের বিবেচনায় ‘বাঙালি পুলিশ’। হিন্দু-পল্লীতে আগুন লাগায় যে সরকারদলীয় ক্যাডার, সে আমাদের বিবেচনায় ‘মুসলমান সরকারি ক্যাডার’। অর্থাৎ, আমরা সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক এই দুই বর্গের আবশ্যিক বিভাজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বরং এদের মিলনবিন্দু শনাক্ত করতে আগ্রহী।

দুই. এমনকি যদি সরকার ও রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলেও এ ধরনের হামলাকে আমরা ‘রাজনৈতিক’ই মনে করি। কারণ সরকার-সরকারি দল-প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অর্থে ‘রাজনৈতিক’ তথা পলিটিক্যাল বর্গের ব্যাখ্যা আমাদের কাছে অদ্ভুত ঠেকে।

ক্লদ লেফোর্ট, জঁ–লুক ন্যান্সি, ফিলিপ্পে ল্যাকোও–ল্যাবার্থে, আলাঁ বাদিয়্যু ও জ্যাক রঁসিয়ের প্রমুখ ফরাসি দার্শনিকেরা ‘রাজনীতি’ ও‘রাজনৈতিক/রাজনৈতিকতা’ বর্গ দুটিকে আলাদা করেই ব্যাখ্যা করেন। ‘হোয়্যাট ইজ পলিটিক্যাল’ প্রশ্নে উল্লেখিত দার্শনিকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করলেও, তারা সকলেই একমত ‘রাজনীতি’ ও ‘রাজনৈতিকতা’ পৃথক দুই বর্গ। অর্থাৎ, সরকার ও রাজনৈতিক দল সরাসরি জড়িত না থাকলে কোনো কিছু আর ‘রাজনৈতিক’ হবে না এমন নয় মোটেও। রাজনৈতিক দল অর্থে ‘রাজনৈতিক’ নির্ধারণের চেষ্টা ‘পলিটিক্যাল’ বর্গ সম্পর্কে এক অতি সংকীর্ণ ব্যাখ্যা-বোঝাপড়ার ফলাফল। ‘কাকে বলে রাজনৈতিক?’ এ সংক্রান্ত এক বিস্তারিত সাক্ষাৎকারের৩৬ হদিশ দিয়ে এই পরিসরে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, সরকার-রাজনৈতিক দল-পুলিশ ইত্যাদি নিয়ে রাজনীতির (politics) ডোমেইন গঠিত হয়। আর‘রাজনৈতিক’ (political) তথা ‘রাজনৈতিকতা’ (politicality) হচ্ছে এক ধরনের চৈতন্য। ক্ষমতার প্রতি মানুষের বিশেষ এক ধরনের অ্যাপ্রোচ/অভিমুখিনতা। ক্ষমতার সাথে যে-কোনো প্রকারের লেনদেন-দেনদরবার-দ্বন্দ্ব ‘রাজনৈতিক’ হয়ে উঠতে পারে। তার মানে ‘রাজনীতি’ও‘রাজনৈতিক’ হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু সভা-সমিতি-নির্বাচন-দল-সরকার-পুলিশ এর সংশ্লিষ্ট না থাকলে তা আর ‘রাজনৈতিক’ নয় এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।

মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ব্যক্তিগত যে-কোনো ক্রিয়াকলাপই ‘রাজনৈতিক’ নয়। মানুষের ব্যক্তিগত-সাংস্কৃতিক-সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ঠিক কেন ও কোন পরিস্থিতিতে ‘রাজনৈতিক’ হয়ে ওঠে সেটাই বিবেচনার বিষয়। সুতরাং, সমস্তকিছুই অবধারিতভাবে ‘রাজনৈতিক’ বলার চেয়ে; সমস্তকিছুই ক্ষমতা দ্বারা নির্ধারিত, সীমায়িত ও নির্দিষ্ট বলাই যুক্তিযুক্ত।

এই প্রবন্ধে আলোচ্য প্রসঙ্গে, তার মানে বলতে হয়, মানুষের সম্প্রদায়গততা সর্বোতভাবে ‘রাজনৈতিক’ নয়। কিন্তু ‘সাম্প্রদায়িকতা’ তথা অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বর্ণবাদী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উভয়ই ‘রাজনৈতিক’। সরকার-পুলিশ-রাষ্ট্রসহ আধুনিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানাদি জড়িত হলে তা আক্রান্ত সম্প্রদায়ের জন্য নজিরবিহীন অসহনীয় জুলুমে পরিণত হয় কেবল। সম্প্রদায় ও পরিচয়বোধ প্রাত্যহিকতার মধ্যে নিষ্ক্রিয়/সুপ্ত অবস্থায় থাকে, কিন্তু ঠিক কোন কোন মুহূর্তে ক্ষমতাতন্ত্র দ্বারা সংজ্ঞায়িত ও নির্ধারিত হয়ে ‘সংখ্যাগুরুত্ব’ ও‘সংখ্যালঘুত্বের’ নির্মাণ ঘটে ত খেয়াল করা দরকার। এই ‘সংখ্যাগুরু’ ও ‘সংখ্যালঘু’ বর্গ ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ পরিচয় যে-কোনো কিছু দ্বারাই নির্ণীত হতে পারে। অর্জুন আপ্পাদুরাই এর বরাত দিয়ে আমরা আগেই দাবি করেছি, মেজরিটি ও মাইনরিটি প্রাকৃতিক কিংবা যথাপ্রদত্ত নয়। বিশেষ ধরনের মেজরিটি তার কাঙ্ক্ষিত মাইনরিটি বাছাই করে নেয়। ফলে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’ এর একদেশদর্শী মেজরিটেরিয়ান চোটপাটের জন্য দরকার মুসলমান। ‘বাঙালি’ (মুসলমান ও হিন্দু যুগপৎভাবে) মেজরিটির জন্য দরকার ‘অ-বাঙালি’ চাকমা-মারমা-সাঁওতাল-রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। আবার ‘বাঙালি মুসলমান’-এর কাঙ্ক্ষিত সংখ্যালঘু ‘বাঙালি হিন্দু’।

 

শেষ কথা: সংখ্যাগুরুবাদী চৈতন্য খোদ এক সাম্প্রদায়িকতা

সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে ‘সাম্প্রদায়িক না অর্থে রাজনৈতিক’ প্রমাণের মরিয়াপনা কিংবা একে কেবলই সরকার/ভারতের দুরভিসন্ধি হিসেবে প্রচার করার যে প্রবণতা এবার দেখা গেল, সেটা কিন্তু হালের বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলের চরম দীনতা ও অন্ধকার এক দিকের উন্মোচন ঘটাল— সংখ্যাগুরুত্ববাদী চৈতন্য। সবাই যে জেনেবুঝেই এই চৈতন্যের অধিকারী তেমন দাবি আমরা করি না। তবে কোনোভাবেই যেন আমরা ভুলে না যাই, সংখ্যাগুরুর সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থান থেকে সংখ্যালঘুর প্রতি ‘উদার’ থাকাও এক ধরনের প্রিভিলেজ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ‘আমরা’ [অর্থাৎ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়] কিছু ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বাদে ‘শান্তিতেই রেখেছি’ এমন মনোভাব ক্ষমতারই ভিন্ন একটা প্রকরণ মাত্র— যে ক্ষমতা দেশপ্রেম ও আনুগত্য প্রমাণের দায় চাপায় খোদ সংখ্যালঘুর ওপর। [স্মরণ করুন এই প্রবন্ধে আমরা যে‘আপাত-উদার’ সংখ্যাগুরু চৈতন্যের হদিশ দিয়েছি: “বুকে হাত দিয়া বলেন আপনারা এই দেশে ভালো আছেন কিনা?”….]

আমরা কোনোভাবেই মনে করি না যে, সরকারের সংশ্লিষ্টতা বা পার্শ্ববর্তী দেশের উস্কানি থাকে না। নিশ্চই থাকে। ফলে এদিকে যারা খেয়াল রাখতে চান, তাদের সতর্কতা ন্যায্য। আমরা শুধু বলছি যে, এই করতে গিয়ে যেন আমরা আমাদের সমাজের নিজস্ব বিন্যাস ও সমাবেশকে লঘু করে না তুলি। সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোতে সাধারণ মানুষের উৎসাহ, উদ্দীপনা, সমর্থন ও অংশগ্রহণ থাকে। এটা বলার মানে গোটা সম্প্রদায়কে দায়ী করা নয় কিংবা সকল দোষ পাবলিকের ঘাড়ে চাপানো নয়। বরং, একটা ডানপন্থী-বর্ণবাদী বাতাবরণে ক্ষমতার সাথে সাধারণ্যের লেনদেনের নানা মাত্রিকতার দিকে ইঙ্গিত করা। এই লেনদেন কেবল বিদ্রোহ-প্রসূতই নয়; বরং আপোষ-সুবিধা-যোগসাজশ সব ধরনেরই হতে পারে।

আরও একবার আমরা ইতিহাসবিদ জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডকে দোহাই মানবো। তিনি সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ও নির্মিতি নিয়ে কাজের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হন। “দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়?শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলছেন: জনগণের সক্রিয়তা সম্পর্কিত একটি বিশেষ দিককে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। ‘দাঙ্গা’ প্রসঙ্গে আমাদের বহু আলোচনায় ‘জন’সমষ্টি নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিক স্বার্থ, জমির লড়াই, বাজার দখলের খেলা এবং উচ্চবর্গের কলকাঠি নাড়া— এই সবই ঘটনাকে বেগবান করে তোলে। ‘জনগণ’  যেন আবার ইতিহাসের বাইরে থেকে যায়। এইভাবে বোধহয় তাদের আদিম ‘শুদ্ধতা’  রক্ষা করা হয়।৩৭

ইতিহাস ও সমকালীন রাজনীতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আমরা অভিজাততান্ত্রিক [এলিটিস্ট] প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকতে চাই। ফলে আমাদের কাছে আপামর মানুষের সক্রিয়তা এবং উচ্চবর্গীয় রাজনীতির শৃঙ্খল সত্ত্বেও তাদের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র‍্যের গুরুত্ব অপরিসীম।‘আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র‍্য’ বলতে আমরা আপামর জনসাধারণের স্বাতন্ত্র‍্য ও পরাধীনতা দুই-ই বুঝতে চাই।

এই মুহূর্তে তাহলে আমাদের করণীয় কী? একেবারে আশু করণীয়র মধ্যে আছে সরকার ও রাষ্ট্রকে আক্রান্তের নিরাপত্তা ও দোষীদের সনাক্ত করতে বাধ্য করা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আমাদের বিপুল কর্মযজ্ঞ হাতে নেয়ার আছে। এ ধরনের একেকটা ঘটনা আমাদের নিজেদের এমনসব ব্লাইন্ডস্পটগুলোর উন্মোচন ঘটায়, যা অন্যসময়ে আমরা খেয়াল করতে চাই না। কার দোষ বেশি কার দোষ কম এই বিবাদের চেয়ে বেশি দরকার আমাদের সমাজের অজস্র রকমের শুভ উদ্যোগ। এজন্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে লেনদেন, আন্তরিক আলাপ-আলোচনা-সংলাপের কোনো বিকল্প নাই। আর তাছাড়া, সক্রিয়তার সত্যিই কোনো বিকল্প নেই। কোনো বিশ শতকী দুনিয়াবি জান্নাত-প্রত্যাশী বিপ্লবে আমাদের আস্থা নেই, কিন্তু ইতিহাসের সামান্য ছাত্র হিসেবে আমরা একথা ভুলি না যে, ইতিহাসের কোনো একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে যত পরাক্রমশালী শক্তিই সমাজের বুকের ওপর চেপে বসুক না কেন, তা পরিবর্তনযোগ্য। এটা কেবল ‘ইতিহাসের অনিবার্য যুক্তি’ মার্কা কোনো নিয়তিবাদী সিদ্ধান্ত থেকে আমাদের অবস্থান নয়। বরং, মানুষের সামষ্টিক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে-কোনো ঘোর অমানিশা উতরে যাবার মানুষী সক্ষমতায় আমরা আস্থা রাখি। এজন্যই গৎবাঁধা-ক্লান্তিকর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে বের হয়ে সংকটের বহুমাত্রিকতা সাফ দিলে উপলব্ধি করা দরকার। এটা করা ছাড়া আর অন্য কোনভাবে একটা ন্যায়ভিত্তিক ‘সমাজ বিন্যাস’ এর রূপকল্প ভাবা সম্ভব তা আমাদের জানা নেই।

এছাড়াও রিলেটিভিজম তথা আপেক্ষিকতার ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। যা-অন্য কোনো পরিচয়বাদী রাজনৈতিক পক্ষ করলে নিন্দনীয়, তা‘বাঙালি মুসলমান’ করলে তাকে পাশ কাটানো এক ধরনের আত্ম-প্রতারণার মতো। ‘বাঙালি মুসলমান’ আল্লাহর ফেরেশতা কিংবা দেবদূত নয়; আবার দানবও নয়। তার যেমন নিপীড়িত হবার ইতিহাস আছে, সংগ্রামের ইতিহাস আছে, ঠিক তেমনি ‘আধুনিক’ হওয়ার পরিক্রমায় এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিসেবে বিকশিত হবার প্রক্রিয়ায় নানা অন্ধকার দিকও আছে। এই অন্ধকার দিকের মোকাবেলা বাইরে থেকে ঢিল ছুঁড়ে যতটা করা সম্ভব, তার চেয়ে ঢের বেশি সম্ভব এই সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে। ফলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া কিংবা অস্বীকার করার ফল আখেরে কোনো কাজে আসবে না। এ কথা ঠিক যে, রাষ্ট্র-রাজনীতি-প্রশাসনের দায়টাই মুখ্য। এই মুহূর্তে এই প্রশ্নটা অবশ্যই তোলা দরকার যে, কেন হিন্দু সম্প্রদায় নিরাপত্তা পেল না। পাশাপাশি এই প্রশ্নটাও সদা জারি থাকা দরকার একটা অধিকতর ন্যায্য ও আধুনিক পৃথিবীতে সম্প্রদায় হিসেবে ‘বাঙালি মুসলমান’ নিজেকে কোথায় দেখতে চায়।

 

 

দোহাই:

১. যুগান্তর, দুর্গাপূজায় নাশকতা ও জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নেই: র‌্যাব প্রধান, ১২ অক্টোবর ২০২১

২. Lorch, Jasmin. “Islamization by Secular Ruling Parties: The Case of Bangladesh.” Politics and Religion 12 (2018): 257 – 282.

৩. Arild Engelsen Ruud & Mubashar Hasan. “Radical Right Islamists in Bangladesh: A Counter-Intuitive Argument”, South Asia: Journal of South Asian Studies, 44:1 (2021), 71-88

৪. জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, “ভগ্নাংশের সমর্থনে: দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়?”, নিম্নবর্গের ইতিহাস, সম্পাদনা: গৌতম ভদ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, অষ্টম মুদ্রণ ২০১৫

৫. দীপেশ চক্রবর্তী, [সাক্ষাৎকার] “ভারতে পরিচয়কে কেন্দ্র করেই ইতিহাস চালিত হয়েছে”, অনুবাদ: সহুল আহমদ, শুদ্ধস্বর, ২০২১

৬. চার্লস টেইলরের বরাত দিয়ে দীপেশ চক্রবর্তী historical wound তথা ঐতিহাসিক ক্ষত ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন। ঐতিহাসিক ক্ষত সত্তা বা পরিচয়ের রাজনীতিতে খুবই কেন্দ্রীয় অবস্থানে থাকে। বিশেষত অতীত অপমান বা নির্যাতনের স্মৃতি বর্তমান সময়ে জাগরুক রাখার ক্ষেত্রে। আবার ‘ঐতিহাসিক ক্ষত’–তে সত্যের বীজ থাকলেও, এই ক্ষত কেবল ইতিহাসকে নির্ভর করে নিজেকে জিইয়ে রাখে না; ‘ইতিহাস–নির্ভর–মিথ’ জাতীয় বয়ানে পরিণত হয় যা স্রেফ ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে বিচার করা যায় না। দীপেশ চক্রবর্তীর মতে, এই ক্ষত কিংবা ক্ষতের নামে কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপের কথা বলতে পারার মানে হচ্ছে ইতোমধ্যেই সেই ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। বিস্তারিত দেখুন: Dipesh Chakrabarty, “History and the politics of recognition”, Manifestos for History, ed. Keith Jenkins, Sue Morgan and Alun Munslow, Routledge, London & Newyork, 2007; দীপেশ চক্রবর্তী, “আনিসুজ্জামান-মানস ও মুসলিম বাংলা সাহিত্য”, রাষ্ট্রচিন্তা, বর্ষ ৫, সংখ্যা ১, ২০২১।

৭. আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গণপিটুনি বা মব ভায়োলেন্সে বা মব লিঞ্চিং-এ ২০১৬ সালে প্রাণ হারিয়েছেন ৫১ জন, ২০১৭ সালে ৫০ জন, ২০১৮ সালে ৩৯ জন, ২০১৯ সালে ৬৫ জন, ২০২০ সালে ৩৫জন, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৬ জন।

৮. Asish Nandy, “It’s very difficult to go back to pre-violent days after you’ve once participated, killed”, The Tribune, 2020

৯. Himadri Ghosh, West Bengal: BJP Leaders Use Bangladesh Violence to Polarise Before Upcoming By-Polls, The Wire, 18 October 2021

১০. দীপেশ চক্রবর্তী, “আধুনিকতা: চেতনার অনুষঙ্গ”, মনোরথের ঠিকানা, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ২০১৮

১১. Dipesh Chakrabarty, “Governmental roots of modern ethnicity”, Habitations of Modernity: Essays in the Wake of Subaltern Studies, The University of Chicago Press, Chicago, 2002

১২. Sudipta Kaviraj, “On the Construction of Colonial Power: Structure, Discourse, Hegemony”, The Imaginary Institution Of India, Columbia University Press, New York, 2010

১৩. মোহাম্মদ আজম, “আহমদ ছফার ‘মুসলমানের মন’: বাঙালি-মুসলমানের ইতিহাস-প্রণয়নের সংকট”, তত্ত্বতালাশ, সম্পাদনা: মোহাম্মদ আজম, দ্বিতীয় সংখ্যা, অক্টোবর ২০২১

১৪. বদরুদ্দীন উমর, সাম্প্রদায়িকতা, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৫ [প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৬]

১৫. বদরুদ্দীন উমর, “সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার শ্রেণীগত ভূমিকা”, ধর্ম, রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা, রুক্কু শাহ্‌ ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স, বাংলাবাজার, ২০১৬ [১৯৯৩]

১৬. বদরুদ্দীন উমর, “বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?”, যুগান্তর, ৫ জুন ২০১৬

১৭. সুদীপ্ত কবিরাজ, “মার্কসবাদ ও স্বর্গের সন্ধান”, অনুষ্টুপ ৫৫ বর্ষ, গ্রীষ্ম-বর্ষা ও প্রাক-শারদীয় যুগ্ম সংখ্যা, ২০২১

১৮. প্রগতি নিয়ে এক ধরনের অন্ধ-বিশ্বাস লালনকারী ব্যক্তিবর্গ।

১৯. বদরুদ্দীন উমর, ২০১৫, পৃ. ১১

২০. Prathama Banerjee, “Are communal riots a new thing in India? Yes, and it started with the British”, The Print, 2020

২১. প্রাগুক্ত

২২. দীপেশ চক্রবর্তীর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: “Counting Hindus, Muslims, Sikhs, and untouchables, then, became a critical political exercise, particularly in the twentieth century, as the British began to include Indian representatives in the country’s legislative bodies in very measured doses.” বিস্তারিত দেখুন: Dipesh Chakrabarty, “Governmental roots of modern ethnicity”, Habitations of Modernity: Essays in the Wake of Subaltern Studies, The University of Chicago Press, Chicago, 2002

২৩. উদ্ধৃতি, মোহাম্মদ আজম, “সূচনাপত্র”, কবি ও কবিতার সন্ধানে, কবিতাভবন, চট্টগ্রাম, ২০২০

২৪. Prathama Banerjee, “India was a land of dharma but Europeans reduced it to Hinduism, Islam. And we accepted it”, The Print, 2019

২৫. পার্থ চট্টোপাধ্যায়, “নীতি, নেতা, প্রজাতন্ত্র”, প্রজা ও তন্ত্র, অনুষ্টুপ, ২০১৬

২৬. সুদীপ্ত কবিরাজ, ২০২১

২৭. বদরুদ্দীন উমর, ২০১৫

২৮. “হামলার উসকানি, নেতৃত্ব দেন সৈকত”, কালেরকণ্ঠ, ২৪ অক্টোবর, ২০২১

২৯. Arjun Appadurai, Fear of Small Numbers: An Essay on the Geography of Anger, Duke University Press Books, 2006

৩০. Talal Asad, Formations of the Secular: Christianity, Islam, Modernity, Stanford University press, Stanford California, 2003

৩১. সুদীপ্ত কবিরাজ, ২০২১

৩২. সারোয়ার তুষার, “ডানপন্থার বৈশ্বিক উত্থান: অর্জুন আপ্পাদুরাই এর তত্ত্বতালাশ ও পর্যালোচনা”, শুদ্ধস্বর, ২০২০

৩৩. Aditya Nigam, “Fascism, the Revolt of the ‘Little Man’ and Life After Capitalism – Manifesto of Hope III”, Kafila.online, 2020

৩৪. প্রাগুক্ত

৩৫. “Two kinds of people participate in riots. The first are local miscreants who often lead the riots. The others are ordinary citizens mobilised through the media and election campaigns and momentarily swayed by that. For local thugs, it’s about access to easy money. But for ordinary citizens socialised into violence, it’s about coming back temporarily as local heroes. In the long run, however, it’s a very different story. Killers can never go back to being normal again.” – Asish Nandy, “It’s very difficult to go back to pre-violent days after you’ve once participated, killed”, The Tribune, 2020

৩৬. প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার: “পশ্চিমা তত্ত্বচিন্তার আলোচনা বা প্রাদেশিকরণই আর যথেষ্ট নয়; খোদ তত্ত্বেরই নতুন তত্ত্বায়ন জরুরি..”, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: সারোয়ার তুষার, অরাজ, ২০২১; এছাড়াও দেখা যেতে পারে প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বই: Elementary Aspects of the Political: Histories from the Global South, Durham and London: Duke University Press, 2020.

৩৭. জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, “ভগ্নাংশের সমর্থনে: দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়?”, নিম্নবর্গের ইতিহাস, সম্পাদনা: গৌতম ভদ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, অষ্টম মুদ্রণ ২০১; সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ও নির্মিতি বিষয়ক জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডের জরুরি বই: The Construction of Communalism in North India, Oxford University Press, 1990

 

 

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!