অনুবাদকের ভূমিকা: নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সদ্য প্রকাশিত বই হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: আ মোমোয়ার থেকে তুলে আনা একটি প্রবন্ধ ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে প্রকাশিত হয় যুক্তরাজ্যের দ্য গ্যার্ডিয়ান পত্রিকায়, ২৯ শে জুনে। সেখানে তিনি ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের অর্জন প্রসঙ্গে যে সমস্ত গালগল্প ছড়ানো হয়, তার একটি যথোচিত জবাব প্রস্তুত করেছেন। এই লেখাটি এই অঞ্চলের দীর্ঘ উপনিবেশায়নের ঘোর কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টার একটি অংশ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। এই প্রবন্ধে তিনি আলোচনা করেছেন বৃটিশ উত্তরাধিকার থেকে পাওয়া বহুদলীয় নির্বাচনী গণতন্ত্র ও মুক্ত সংবাদমাধ্যম কিভাবে বৃটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষ থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কার্যকরী হয় নি। বৃটিশ শাসন ভারতে দুর্ভিক্ষের পর দুর্ভিক্ষ উপহার দেওয়ার পরেও পৃথিবীজুড়ে দাবি করেছে, তারা তাদের সাম্রাজ্যগুলোতে অনাহার রোধ করেছে। বৃহত্তর বাংলাদেশের উপনিবেশপূর্ব সমৃদ্ধ অর্থনীতিতে নজিরবিহীন লুটপাট চালানোর মাধ্যমে “বাংলার অর্থনৈতিক রক্তপাতের”সৃষ্টি করেছে। এত কিছুর পরেও উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের ‘অবদানের‘ আলোচনা থেমে থাকবে না। অমর্ত্য সেনের মতো মানুষেরা সে আলোচনায় ভারসাম্য আনার চেষ্টা করে যাবেন।
অনুবাদক: জাকির হোসেন
১.
১৭৫৭ সালের ২৩শে জুনে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্য কার্যকরীভাবে স্থাপিত হয়। ভোরবেলায় শুরু হয়ে যুদ্ধটি খুব দ্রুতই সূর্যাস্তের আগে শেষ হয়ে যায়। এটি ছিল একটি সাদামাটা বর্ষার দিন। বৃটিশদের ঘাঁটি কলকাতা ও বঙ্গ সাম্রাজ্যের রাজধানী মুর্শিদাবাদের মাঝামাঝিতে অবস্থিত পলাশীর আমবাগানে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। এই সেই আমবাগান যেখানে বৃটিশ বাহিনী নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সেনাদের সাথে মুখোমুখি হয় এবং নবাবের সৈন্যদলকে পুরোপুরি পরাস্ত করে।
তার প্রায় দুইশ বছর পরে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মাঝরাতে ভারতের “ভাগ্যবিধাতার সাথে মিলন“ সম্পর্কে জওহরলাল নেহেরুর দেওয়া ভাষণের সাথে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে। দুইশ বছর একটি লম্বা সময়। ভারত শাসনের এই দুই শতাব্দীতে বৃটিশদের অর্জন কী ছিল এবং কী অর্জন করতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল?
১৯৪০ এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রগতিশীল বিদ্যায়তনের ছাত্র থাকাকালীন এই প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আসত আমাদের আলোচনায়। আজও সেই প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে, যার কারণ হিসেবে এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, বিশ্ব শাসনের সফল উদাহরণের আলোচনায় প্রায়ই বৃটিশ সাম্রাজ্যকে ডেকে আনা হয়। আজকের অগ্রগণ্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদানে প্ররোচিত করার চেষ্টা করতেও বৃটিশ সাম্রাজ্যের দৃষ্টান্তকে সামনে আনা হয়। ইতিহাসবিদ নিয়াল ফার্গুসন প্রশ্ন রেখেছেন: “উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সাম্রাজ্যবাদীতার বোঝা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহন করা উচিত, নাকি সেটি ত্যাগ করাই উ ত্তম?” নিশ্চিতভাবেই এটি একটি আগ্রহোদ্দীপক প্রশ্ন। তাছাড়া ফার্গুসন যথার্থই বলেছেন যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন এবং তার অর্জন সম্পর্কে কোনোরূপ বোঝাপড়া ছাড়া এর উত্তর পাওয়া অসম্ভব।
কয়েক দশক আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে বসে এই বিষয়ে যুক্তি-তর্ক চালিয়ে যাওয়ার সময় আমরা পদ্ধতিগতভাবে একটি জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হতাম। সেটি হলো: বৃটিশ শাসন না থাকলে ১৯৪০ এর দশকের ভারতবর্ষের অবস্থা কেমন হতো, সেটি আমরা অনুমান করব কিভাবে?
১৭৫৭ সালের (যখন বৃটিশ শাসন শুরু হয়) ভারতবর্ষের সাথে ১৯৪৭ সালের (বৃটিশরা যখন ভারত ত্যাগ করে) ভারতবর্ষের মধ্যে তুলনা করার পৌনপুনিক প্রলোভন থেকে আমরা তেমন কোনো সদুত্তর পাই না কারণ, বৃটিশ শাসন ব্যতিরেকেই ভারতবর্ষ পলাশীর যুদ্ধের সময়ে যেমনটা ছিল, ঠিক সে জায়গায় চিরকাল স্থির থাকত না। তবে বৃটিশ শাসনে ফলে কী পরিবর্তন ঘটেছিল, এই প্রশ্নের জবাব আমরা কিভাবে দেব?
এমন একটি “বিকল্প ইতিহাসের”প্রাসঙ্গিকতাকে বোধগম্য করে তোলার জন্য আমরা অন্য একটি বিষয়কে পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে পারি। এমন একটি সাম্রাজ্যবাদী দখলাভিযানের কথা ভাবা যায় যেটি বাস্তবে কখনো ঘটে নি। ১৮৫৩ সালে জাপানের এদো উপসাগরে চারটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে নোঙর করা মার্কিন নৌবাহিনীর সদস্য কমোডোর ম্যাথিউ পেরির কথা ভাবা যাক। এমন একটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট কল্পনা করুন যে, পেরি সে সময়ে স্রেফ মার্কিনিদের শক্তির কোনো প্রদর্শনী (যেটি ছিল আসল ঘটনা) করেন নি বরং তিনি ছিলেন মার্কিন দখলাভিযানের অগ্রবর্তী সেনা, যেটি কিনা সূর্যোদয়ের দেশে নতুন এক মার্কিন সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিল। উক্ত দৃশ্যকল্পকে রবার্ট ক্লাইভের ভারত দখলের সাথে তুলনা করা যায়। এখন আমরা যদি জাপানের উপর কল্পিত মার্কিন শাসনের অর্জন মূল্যায়ন করতে গিয়ে ১৮৫৩ সাল পূর্ববর্তী সময়ের জাপানের সাথে মার্কিনি শাসন অবসানকালের জাপানের পার্থক্যকে মার্কিন সাম্রাজ্যের প্রভাব বলে ধরে নিই, তাহলে ১৮৬৮ সাল থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী সময়ের জাপানে মেইজি সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অবদানগুলোর সাথে সাথে তখনকার সময়ে সেখানে ঘটে চলা বিশ্বায়নের পরিবর্তনগুলো বাদ পড়ে যাবে। জাপান একজায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নি; যেমনটা থাকত না ভারতবর্ষও।
মেইজি শাসনের অধীনে জাপানের পরিবর্তনগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে বৃটিশ শাসনবিহীন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের গতিপথ নিশ্চয়তার সাথে আন্দাজ করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান হারে বিশ্বায়নের দিকে ঝুঁকে পড়া পৃথিবীতে ভারতবর্ষ কি জাপানের মতো আধুনিকায়নের দিকে এগুতো? অথবা, আফগানিস্তানের মতো পরবর্তন থেকে নিজেকে বিরত রাখত? কিংবা, থাইল্যান্ডের মতো ধীর পায়ে সামনে অগ্রসর হতো?
প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া অসম্ভব রকমের কঠিন কাজ। তারপরও বিকল্প কোনো ঐতিহাসিক দৃশ্যপট ছাড়াও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেতে পারে, যেগুলো কিনা ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসন যে ভূমিকা পালন করেছিল, তা বোঝার কাজে সহায়ক হতে পারে। আমরা জিজ্ঞেস করতে পারি: বৃটিশদের ক্ষমতা দখলের পর ভারতবর্ষ কোন সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিল? এবং বৃটিশ শাসনামলে সে সব সংকটাপন্ন এলাকায় কী ঘটেছিল?
২.
বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পশ্চাৎপদ ভারতবর্ষে নিশ্চিতভাবেই বড়সড় বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। আঠারো শতকের মাঝামাঝির ভারতবর্ষে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে অতীতে এই অঞ্চলের দর্শন, গণিত, সাহিত্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য, চিকিৎসাশাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব ও জ্যোতির্বিদ্যায় অসামান্য অর্জনের ইতিহাস উপেক্ষা করার প্রয়োজন নাই। বহু কট্টর ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা এ নিয়ে একটা ভীতির মধ্যে থাকেন। উপনিবেশকালের পূর্বেই ভারত একটি বর্ধনশীল বাণিজ্য-ব্যবস্থার সাথে সাথে সমৃদ্ধশালী একটি অর্থনীতি গড়ে তোলার কাজেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছিল। অ্যাডাম স্মিথের মতো বৃটিশ পর্যবেক্ষগণও ভারতবর্ষের অর্থসম্পদের অকুন্ঠ স্বীকৃতি দিয়েছেন।
আসল ঘটনা হলো, এইসব অর্জন সত্ত্বেও সমকালীন ইউরোপের অর্জনের তুলনায় আঠারো শতকের মাঝামাঝির ভারতবর্ষ বিভিন্ন দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। আমার বিদ্যায়তনের সান্ধ্যকালীন প্রাণবন্ত তর্ক-বিতর্কের বিষয় হিসেবে ভারতবর্ষের এই পশ্চাৎপদতার প্রকৃতি ও তাৎপর্যের আলোচনা ঘুরেফিরে আসত।
ভারতবর্ষের ব্যাপারে কার্ল মার্কসের অন্তঃদৃষ্টিপূর্ণ একটি লেখা বিশেষভাবে আমাদের মধ্যে কয়েকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ১৮৫৩ সালের এক লেখায় ভারতবর্ষের এক আগাগোড়া পুনর্মূল্যায়ন ও আত্মবিবেচনার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে মার্কস ভারতে বৃটিশ শাসনের গঠনমূলক দিকটি তুলে ধরেছিলেন। তাছাড়া, বিশেষতঃ উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে বৃটেন আসলে প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের সাথে পশ্চিমা যোগাযোগের সেতু রচনা করেছিল। বৃটেনের এইধরণের প্রভাবের গুরুত্বকে উপেক্ষা করা কঠিন কাজ। ভারতবর্ষের ভেতরে উদীয়মান বিশ্বায়নের দেশীয় সংস্কৃতি শুধুমাত্র বৃটিশ লেখনীর কাছে নয় বরং বৃটিশদের মাধ্যমে ভারতে পরিচিতি পাওয়া ইউরোপের অ-ইংরেজভাষী বই ও প্রবন্ধ-নিবন্ধের নিকট গভীরভাবে ঋণী।
১৭৭২ সালে জন্মগ্রহণ করা কলকাতার দার্শনিক রামমোহন রায়ের মতো ব্যক্তিগণ শুধুমাত্র সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি পুঁথির জ্ঞানের দ্বারাই নয় বরং ভারতে ক্রমশ পরিচিত হয়ে ওঠা ইংরেজি লেখনীর দ্বারাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। রামমোহনের পরে শুধু বাঙলাতেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের কয়েকটি প্রজন্ম এবং তাদের অনুসারীরা তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভারতবর্ষকে আঠারো ও উনিশ শতকের ইউরোপে দেখা ঘটনাবলির আলোকে পূনর্মূল্যায়ন করে দেখছিলেন। তাদের তথ্যপ্রাপ্তির প্রধানতম বা কখনো কখনো একমাত্র উৎস ছিল বৃটিশ শাসনের সুবাদে ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বইসমূহ (সাধারণত ইংরেজি ভাষায় লেখা)। বৃটিশদের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ার পরেও ইউরোপীয় সংস্কৃতিসমূহের বিপুল বিস্তৃত পরিসরকে ধারণ করা এই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব আজও প্রবলভাবে টিকে আছে।
ভারতবর্ষের আগাগোড়া একটি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মার্কসের উপলব্ধি প্রাথমিকভাবে সঠিক বলে আমার বিশ্বাস জন্মিয়েছিল। কারণ, রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লব পুরো বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক যে বিশ্বায়নের (দুঃখজনকভাবে, এর সাথে উপনিবেশবাদেরও) সূচনা ঘটিয়েছিল, তার একটি অংশ না হওয়ার ফলে ভারতবর্ষের পুরানো বিন্যাস ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল।
যাইহোক, মার্কসের তত্ত্ব বিশেষত, তার অন্তঃর্নিহিত এই স্বতঃসিদ্ধের মধ্যে তর্কসাপেক্ষভাবে একটি গুরুতর সমস্যা আছে যে, বৃটিশ দখলদারিত্ব ছাড়া ভারতবর্ষের জন্যে আধুনিক বিশ্বমুখী আর কোনো জানালা খোলা যেত না। সে সময়ে ভারতবর্ষের প্রয়োজন ছিল তুলনামূলক অধিক গঠনমূলক বিশ্বায়নী প্রক্রিয়া, যার সাথে সাম্রাজ্যবাদের কোনো যোগসূত্র ছিল না। এই দুয়ের পার্থক্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের সুদীর্ঘ কালব্যাপী ভারতবর্ষ নিরবচ্ছিন্নভাবে বর্হিবিশ্বের সাথে বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা এবং দ্রব্যসামগ্রীর আদান-প্রদান করে গেছে। আজ থেকে দুই হাজার বছর পূর্বে থেকে শুরু করে বহু শতাব্দীব্যাপী ভারতবর্ষ এবং দূরপ্রাচ্য যেমন- চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ছাড়াও অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসায়ী, বসতি স্থাপনকারী এবং পন্ডিতের আনাগোনা ছিল। বিশেষতঃ ভাষা, সাহিত্য এবং স্থাপত্যের মধ্যে এই যাতায়াতের সূদুরপ্রসারী প্রভাব আজও ব্যাপকভাবে চোখে পড়ে। বহুপ্রাচীন কাল থেকেই বর্হিবিশ্বের পলাতকদের জন্যে ভারতের খোলা সীমান্ত নীতির ফলে বিপুল বৈশ্বিক প্রভাবের সূত্রপাত ঘটেছিল।
প্রথম খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেমের পতনের ঠিক পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে বহু শতাব্দীব্যাপী ভারতবর্ষে ইহুদী অভিবাসন চলমান ছিল। সাশুনদের মতো ব্যাপক সফলকাম বাগদাদী ইহুদীরা আঠারো শতক পর্যন্তও বিপুল সংখ্যায় ভারতে এসেছিল। খ্রিষ্টানরা কমপক্ষে চতুর্থ শতাব্দী কিংবা সম্ভবত আরো আগে থেকেই ভারতবর্ষে আসা শুরু করেছিল। এই ব্যাপারে ভারতে বেশ কিছু বর্ণাঢ্য কিংবদন্তী চালু আছে। এর মধ্যে একটা হলো, প্রথম শতাব্দীতে যীশুর বারো শীষ্যের একজন সেইন্ট থমাস যখন ভারতবর্ষে আসেন, তিনি প্রথম যে মানুষটিকে দেখেন, সেটি হলো এক ইহুদী বালিকা যিনি কিনা মালাবার উপক‚লে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। আমাদের শ্রেণিকক্ষের আলোচনায় আমরা এই শৈল্পিক এবং নিঃসন্দেহে অপ্রামাণিক কাহিনীটি উপভোগ করেছিলাম কারণ, এর মাধ্যমে ভারতবর্ষীয় ঐতিহ্যে প্রোথিত বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির শেকড়ের প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়েছিল।
অষ্টম শতকের শুরুর দিকে পারস্যে সেখানকার অধিবাসীরা নির্যাতনের শিকার হলে ভারতবর্ষে আসতে শুরু করে। একই শতাব্দীর শেষের দিকে আর্মেনীয়রা কেরালা থেকে বাঙলা পর্যন্ত তাদের পদচিহ্ন রাখতে শুরু করে। একই সময়ের আশেপাশে ভারতের পশ্চিম তীরে আরব মুসলিম ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী উপস্থিতির ইতিহাস রয়েছে। এরও বহু শতাব্দী পরে উপমহাদেশের ঊষর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে মুসলিম বিজেতাদের আগমন ঘটেছিল। ইরানের নির্যাতিত বাহাইরা ভারতবর্ষে এসেছিল উনিশ শতকে।
পলাশীর যুদ্ধের সময়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতির ব্যবসায়ী, বণিক এবং অন্যান্য পেশাজীবী মানুষেরা গঙ্গামুখের কাছাকাছি অঞ্চলগুলোতে ভালোভাবে থিতু হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং, ভিনদেশীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা কিংবা তাদের কাছে থেকে কিছু শেখার একমাত্র উপায় সাম্রাজ্যবাদীশাসনের অধীন হওয়া নয়। ১৮৬৮ সালের জাপানে মেইজি সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন যখন একটি সংস্কারবাদী সরকার গঠন করে, (যেটি কিনা এক দশক আগে কমোডোর পেরির শক্তিপ্রদর্শনের ঘটনার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রভাবের আওতার বাইরে নয়) তখন জাপানিরা সাম্রাজ্যবাদের প্রজা না হয়েই পশ্চিমের কাছে সরাসরি শিক্ষা নিতে গিয়েছিল। তারা নিজেদের দেশীয় লোকদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠিয়েছিল এবং স্পষ্টই নানাধরণের পশ্চিমা অভিজ্ঞতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা জবরদস্তি বিশ্বায়নের আওতায় আসার অপেক্ষা তারা করে নি।

৩.
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী তাত্ত্বিকদের মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষ নির্মাণের ক্ষেত্রে বৃটিশ শাসকদের ভূমিকা র ব্যাপারে প্রচুর পরিমাণে জোর দেওয়ার একধরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই বিশ্লেষণ মতে, বৃটিশরা ভারতবর্ষে বিদ্যমান বৈচিত্র্যময় শাসনের মধ্যে থেকে একটি দেশ নির্মাণের আগ পর্যন্ত ভারত ছিল বিভিন্ন খন্ড খন্ড রাজ্যের সমষ্টি। বলা হয়ে থাকে যে, ভারতবর্ষ পূর্বে একটিমাত্র দেশ ছিল না বরং ছিল পুরোপুরি বিভক্ত নানা ভূখন্ডের সমষ্টি। সে দাবি মতে, বৃটিশ সাম্রাজ্য এই টুকরো টুকরো ভূখন্ডগুলোকে জোড়া লাগিয়ে ভারতীয়দেরকে একটি জাতিতে রূপান্তরিত করেছিল। উইনস্টন চার্চিল এমনকি এও মন্তব্য করেছেন যে, বৃটিশ আগমনের পূর্বে সেখানে ভারতীয় জাতি বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। তিনি একদা বলেছিলেন: “ভারতবর্ষ হলো একটি ভৌগলিক পরিভাষা। এটি নিরক্ষরেখার চেয়ে বেশি কোনো ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বোঝায় না।”
এটা যদি সত্য হয়, তাহলে বলতেই হয় ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে এর আধুনিকায়নের ব্যাপারে বৃটিশ সাম্রাজ্য একটি পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছিল। তারপরেও ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ করার এই বৃহৎ কৃতিত্বের পেছনে বৃটিশ রাজের এই বিশাল ভূমিকা র বিষয়টি কি যথাযথ? ১৭৫৭ সালে ক্লাইভ যখন বাংলার নবাবকে পরাজিত করেন, তখন নিশ্চিতভাবেই পুরো ভারতবর্ষের একক কর্তৃত্ব কারো হাতে ছিল না। এরপরেও পুরো ভারতের উপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কায়েমের কাহিনী থেকে (যেটি আসলেই ঘটেছিল) শুধুমাত্র বৃটিশরাই একগুচ্ছ বিসদৃশ রাজ্য থেকে ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষ নির্মাণ করতে পারত, এমন একটি বিশাল দাবিতে গিয়ে ঠেকতে হলে একটি লম্বা লাফ দিতে হয়।
ভারতবর্ষের ইতিহাসকে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গি উক্ত সহস্রাব্দে ভারতবর্ষকে চিহ্নিত করে যাওয়া এই অঞ্চল শাসন করা বৃহৎ দেশীয় সাম্রাজ্যগুলোর বাস্তবতার বিরুদ্ধে যায় চরমভাবে। তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দের উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও কর্মচঞ্চল সম্রাটেরা তাদের দখল করা ভূখন্ডের সিংহভাগ যতক্ষণ না তাদের শাসনের আওতায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি দেশে পরিণত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের শাসনব্যবস্থাকে অসম্পূর্ণ বলে মনে করতেন। অশোক মৌর্য, গুপ্ত সম্রাটগণ, আলাউদ্দিন খিলজি, মুঘলগণ এবং অন্যান্যরা এক্ষেত্রে বৃহৎ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে আমরা একগুচ্ছ খন্ড-বিখন্ড রাজ্যসমেত দেশীয় বিভিন্ন বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে একের পর এক পালাবদল দেখতে পাই। সুতরাং, আঠারো শতকের মাঝামাঝির ভারতবর্ষে চলমান বিচ্ছিন্ন শাসনব্যবস্থা দেখে ভুলবশত এমন একটি অনুমানে উপনীত হওয়া উচিত হবে না যে, এই পরিস্থিতি উক্ত অঞ্চলের ইতিহাসে পূর্বেও দীর্ঘকালব্যাপী জারি ছিল এবং তারপর বৃটিশরা একে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সাহায্যার্থে এগিয়ে এল।
ইতিহাসের বইগুলোতে যদিও বৃটিশদেরকে প্রায়ই মুঘলদের উত্তরসূরী বলে মনে করা হয়, একটি বিষয় লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে, বৃটিশরা যখন ভারতবর্ষের উল্লেখযোগ্য একটি শক্তি হিসেবে বিদ্যমান ছিল, তখনও তারা আসলে মুঘলদের দায়িত্ব গ্রহণ করে নি। মুঘলদের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথেই বৃটিশ শাসনের সূচনা হয়েছিল, যদিও বৃটিশদের কাছে পরাজিত বাংলার নবাবও রীতি অনুযায়ী মুঘলদের প্রজা ছিলেন। নবাব তখনো সম্রাটের নির্দেশনার প্রতি খুব বেশি কর্ণপাত না করেও মুঘলদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতেন। ভারতবর্ষের উপর মুঘল কর্তৃপক্ষের রাজকীয় মর্যাদা এমনকি শক্তিশালী এই সাম্রাজ্যটির অনুপস্থিতির কালেও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত বিষয় ছিল।
১৮৫৭ সালে সংঘটিত তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহ যখন বৃটিশ ভারতের ভিত্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন বৃটিশবিরোধী বিদ্রোহীদের বৈচিত্র্যময় দলগুলো ভারতবর্ষের শাসক হিসেবে মুঘল সম্রাটের পোশাকি আনুগত্য মেনে নেওয়ার মাধ্যমে তাদের সম্মিলিত বিদ্রোহে জোটবদ্ধ হতে পারত। সম্রাট আসলে সেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তবে সেটি বিদ্রোহীদেরকে তাকে সমগ্র ভারতবর্ষের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে নি। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পরিচিত ছিলেন জাফর নামে। বিরাশি বছর বয়ষ্ক এই সম্রাট যুদ্ধ করা কিংবা ভারত শাসন করার চেয়ে কবিতা পড়তে এবং লিখতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। এই বিদ্রোহ নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে গিয়ে বৃটিশরা দিল্লীর যে ১,৪০০ জন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছিল এবং শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা এড়াতে সম্রাটের খুব বেশি কিছু করার ছিল না। পরবর্তী সময়ে এই কবি-সম্রাটকে বার্মায় নির্বাসিত করা হয় এবং সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৩০ এর দশকের বার্মায় বড় হওয়া শিশু হিসেবে বাবা-মা আমাকে বিখ্যাত শেডাগন প্যাগোডার কাছাকছি রেঙ্গুনে জাফরের কবর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কবরটিকে বিশেষত্বহীন ঢেউখেলানো লোহায় মোড়ানো পাথরের ফলকের চেয়ে বেশি কিছু বানানোর অনুমতি ছিল না। ভারত ও বার্মার বৃটিশ শাসকগণ খুব পরিষ্কারভাবে শেষ মুঘল সম্রাটের অবশিষ্ট শৈল্পিক ক্ষমতাকে কেমন ভয় করতেন, সে ব্যাপারে বাবার সাথে আমার আলাপচারিতার কথা মনে পড়ে। সমাধিফলকে লেখা ছিল “বাহাদুর শাহ ছিলেন দিল্লীর প্রাক্তন রাজা”। “সম্রাট” শব্দের কোনো উল্লেখ ছিল না সেখানে! বহু বছর পর ১৯৯০ এর দশকে শেষ মুঘল সম্রাট হিসেবে জাফরের কবর ন্যূনতম সম্মানের অধিকারী হয়।
৪.
পর্যায়ক্রমে মুঘলদের রাজধানী লুটপাট করে এবং পুরো ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার জন্য ক্ষমতার অনুশীলন করার মাধ্যমে বোম্বাইয়ের আশেপাশে উদীয়মান নতুন হিন্দু মারাঠা শক্তি বৃটিশ রাজের অনুপস্থিতিতে মুঘলদের সম্ভাব্য উত্তরসূরী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারত। দ্রুতগতিতে একেবারে হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রমে সক্ষম মারাঠা অশ্বারোহী বাহিনীর বৈদ্যুতিক আক্রমণের গতি কমিয়ে দিতে ১৭৪২ সালের দিকেই বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার সীমান্তে এক বিশাল “মারাঠা পরিখা”খনন করেছিল। তবে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মতো কোনো পরিকল্পনা থেকে মারাঠারা তখনও বহু দূরে অবস্থান করছিল।
অন্যদিকে বৃটিশরা উপমহাদেশের সিংহভাগ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি হয়ে না ওঠা পর্যন্ত সন্তুষ্ট হয় নি এবং এই দিক দিয়ে তারা বিদেশ থেকে ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষের কোনো ধারণা আমদানি করে নি বরং ভূতপূর্ব দেশীয় সাম্রাজ্যগুলোর উত্তরসূরীর মতোই আচরণ করেছে। পলাশীর যুদ্ধের পরপরই বৃটিশ শাসন তার সাম্রাজ্যের ভিত্তিভূমি কলকাতা থেকে দেশের বাদবাকি অংশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। কোম্পানির ক্ষমতা পুরো ভারতবর্ষব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কারণে কলকাতা নতুন উদীয়মান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়েছিল এবং অষ্টম শতক থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত (যখন রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়) তার এই অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কলকাতা থেকে ভারতবর্ষের অন্য অংশগুলোতে দখলাভিযানের পরিকল্পনা ও পরিচালনার কাজ করা হতো। সাম্রাজ্য বিস্তারকালে পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে যুদ্ধ পরিচালনার কাজে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিচালিত অর্থনৈতিক অভিযানের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফার বেশিরভাগই বিনিয়োগ হতো।
পলাশীর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর খুব শীঘ্রই “বাংলার অর্থনৈতিক রক্তপাত”শুরু হয়েছিল। স্থানীয় বণিকদের নিকট থেকে নিয়মিতভাবে আদায় করা তথাকথিত উপঢৌকনের হিসেব বাদ দিলেও নবাবদেরকে নিজেদের আয়ত্ত্বের মধ্যে রেখে কোম্পানি শুধুমাত্র আঞ্চলিক রাজস্ব থেকেই নয় বরং বাংলার সমৃদ্ধ অর্থনীতিতে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার নজিরবিহীন সুবিধা নিয়ে বিপুল পরিমাণে অর্থ উপার্জন করেছিল। বৃটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবে যারা গৌরবান্বিত হতে চান, তারা অ্যাডাম স্মিথের ওয়েলথ্ অব নেশন পড়া থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখলেই ভালো করবেন, সাথে তার সেই আলোচনাটিও এড়িয়ে যাওয়া ভালো, যেখানে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে একটি “ব্যবসায়িক কোম্পানি পূর্ব ভারতের অধিবাসীদের উপর নিপীড়ন চালায় এবং শাসন করে” বলে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ড্যালরিম্পলের পর্যবেক্ষণ ছিল এমন: “অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানগুলো নিজেই কথা বলে। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন পৃথিবীর সর্বমোট জিডিপি’র মধ্যে বৃটেন ১.৮% এবং ভারতবর্ষ ২২.৫% জিডিপি’র যোগান দেয়। বৃটিশ রাজের রমরমা অবস্থায় এই পরিসংখ্যানটি কমবেশি উল্টে যায়। ভারতবর্ষকে পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রবর্তী নির্মাণশিল্প সমৃদ্ধ জাতি থেকে দুর্ভিক্ষ ও বঞ্চনার প্রতীকে পরিণত করা হয়।”
অর্থনৈতিক রক্তপাতের মাধ্যমে লুটপাটের অর্থ সবচেয়ে বেশি পুঞ্জীভূত হয়েছিল বাংলায় অবস্থিত বৃটিশ কোম্পানির কর্মকর্তাদের হাতে। তারপরেও এক্ষেত্রে বৃটেনের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। পলাশীর যুদ্ধের পর লন্ডনের আইনসভার চারভাগের একভাগ সদস্য পুঁজিবাজারে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্টক কিনেছিল। এভাবে ভারতীয় সাম্রাজ্য থেকে পাওয়া অর্থনৈতিক সুফল বৃটেনের ক্ষমতাশালী মহল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
দস্যুরাজের এই লুটপাট ধীরে ধীরে আইন ও শৃঙ্খলাসমেত কিঞ্চিত যৌক্তিক শাসনপ্রণালীর প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সাথে সাথে অবশেষে চিরায়ত সাম্রাজ্যবাদীতায় পরিণত হচ্ছিল। তবে পূর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা বাংলার অর্থনীতিকে ব্যাপক চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ১৭০৩ সালে মানচিত্রবিদ জন থর্নটোন কর্তৃক এই অঞ্চলের উপর আঁকা তার বিখ্যাত মানচিত্রে বর্ণিত “সমৃদ্ধশালী বাংলা সাম্রাজ্য”১৭৬৯-৭০ সালের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। তৎকালীন শুমারি অনুযায়ী বাংলার মোট জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে বলে জানা যায়। এটি প্রায় নিশ্চিতভাবেই একটি অতিরিক্ত অনুমান। তারপরেও দীর্ঘ সময় ধরে কোনো দুর্ভিক্ষের কবলে না পড়া একটি অঞ্চলে গণহারে অভুক্ত থাকা এবং মৃত্যুহারের বিষয়টি নিঃসন্দেহে এটি একটি বিশাল বিপর্যয়।
এই বিপর্যয়ের কমপক্ষে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল দেখা গিয়েছিল। প্রথমত, শুরুর দিকের ভারতে অন্যায় বৃটিশ শাসন স্বয়ং বৃটেনেই বিলক্ষণ রাজনৈতিক সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। সে সময়ে অ্যাডাম স্মিথ তাঁর ওয়েলথ্ অব নেশন বইয়ে খোলাখুলি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি “তার দখলকৃত আঞ্চলিক সম্পদকে শাসন করার জন্য পুরোপুরি অযোগ্য।” সে সময়ে অ্যাডমন্ড বার্কের মতো বহু বৃটিশ গণ্যমান্য ব্যক্তি একইভাবে কোম্পানির সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বাংলার অর্থনৈতিক ক্ষতি ক্রমান্বয়ে কোম্পানির ব্যবসাকেও লোকসানের মুখে ফেলার মাধ্যমে বৃটিশ বিনিয়োগকারীদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এবং তাতে করে লন্ডনের ক্ষমতাশালীরা ভারতবর্ষে তাদের ব্যবসার ধরণ পরিবর্তন করে অনেকটা রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে কর্মকান্ড পরিচালনায় যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল।
আঠারো শতকের শেষাবধি তথাকথিত “পলাশী-পরবর্তী লুন্ঠনের” সাথে যে বৃটিশ শাসনের সূত্রপাত ঘটে, সেটি এমন কিসিমের একটি সাম্রাজ্যবাদী দখলদারিত্বের পথ তৈরি করে, যেটি কিনা খুব দ্রুতই সাম্রাজ্যবাদীতার মানদন্ডে পরিণত হয় এবং যার সাথে পরবর্তী দেড় শতাব্দীব্যাপী উপমহাদেশ ক্রমশ পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে।
৫.
আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত এই লম্বা সময়ব্যাপী বিরাজমান বৃটিশ ভারতের চিরায়ত সাম্রাজ্যবাদীতা কতটা সফলকাম হয়েছিল? গণতন্ত্র, আইনের শাসন, রেলপথ, যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান এবং ক্রিকেট সহ অর্জনের এক লম্বা ফিরিস্তি ধরিয়ে দেয় বৃটিশরা। তবে দুই দেশের মাঝে বিদ্যমান সাম্রাজ্যবাদীতার সম্পর্কের ইতিহাসজুড়ে শুধুমাত্র ক্রিকেট বাদ দিয়ে বাকিগুলোর ব্যাপারে বলা যায়, তত্ত্ব ও চর্চার মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বছরগুলো মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই দুই হিসেবকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে নানা অর্জনের বাগাড়ম্বরের সাথে প্রকৃত অর্জনের বিশাল পার্থক্য খুব সহজেই চোখে পড়ে।
রুডইয়ার্ড কিপলিং তার সাম্রাজ্যবাদীতা বিষয়ে লিখিত কবিতায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীপ্রশাসকদের আত্ম-অভিনন্দনসূচক দৃষ্টিভঙ্গিটিকে দারুণভাবে পাকড়াও করেছিলেন:
সাদা মানুষদের বোঝা হালকা করুন-
বন্ধ করুন শান্তির জন্য এই বর্বর যুদ্ধ-
ক্ষুধার্ত মুখগুলোতে খাবার তুলে ধরুন-
পীড়িতদের সেবায় হোন ঐক্যবদ্ধ-
কিন্তু হায়! দুর্ভিক্ষ রোধ কিংবা অসুস্থদের সারিয়ে তোলার কোনোটিই ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের উচ্চমার্গীয় অর্জনের অংশ ছিল না। এই বাস্তবতা থেকে কোনোকিছুই আমাদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না যে, বৃটিশ শাসনের শেষ দিকে ভারতের নবজাতক শিশুদের প্রত্যাশিত আয়ু ভয়ঙ্করভাবে কমে গিয়ে সর্বোচ্চ ৩২ বছর পর্যন্ত ঠেকেছিল।
প্রজাসাধারণের প্রাথমিক শিক্ষালাভের অধিকারকে উপেক্ষা করার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসনের মিতাচারী প্রবণতা প্রতিফলিত হয় পদানত জাতির প্রভাবশালী প্রশাসক কর্তৃক গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিরাট অসামঞ্জস্য বিদ্যমান ছিল। উনিশ শতকে বৃটিশ সরকার তার দেশীয় বৃটিশ জনগণের মাঝে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে ক্রমাগত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে থাকল। অন্যদিকে, বৃটিশ রাজের অধীনে ভারতবর্ষের প্রজাদের স্বাক্ষরতার হার ছিল খুবই কম। সাম্রাজ্যের শেষের দিকে ভারতবর্ষের প্রাপ্তবয়ষ্ক প্রজাদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার ছিল মোটে ১৫%। স্বাধীনতার পর কেরালা রাজ্যের সিংহভাগ গঠনকারী ট্রাভাঙ্কোর ও কোচির “দেশীয় সাম্রাজ্য” (আনুষ্ঠানিকভাবে বৃটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে ছিল) ছিল ভারতবর্ষের একমাত্র অঞ্চল যেখানে তুলনামূলকভাবে স্বাক্ষরতার হার বেশি ছিল। বিদেশনীতি ও প্রতিরক্ষার জন্যে বৃটিশ প্রশাসনের উপর নির্ভর করলেও এই রাজ্যগুলো কৌশলগতভাবে বৃটিশ সাম্রাজ্যের বাইরেই অবস্থান করত এবং অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করত, যেটি তারা অধিকতর প্রাথমিক শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যবহার করেছিল।
ভারতবর্ষে সত্যিকারের মাথাপিছু মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিএনপি) আদৌ কোনো অগ্রগতি ছাড়াই দুইশ বছরের ঔপনিবেশিক আমল একইসাথে অর্থনৈতিক এক মহামন্দারও কাল ছিল। স্বাধীনতার পরেই কেবল নতুন মুক্তির স্বাদ পাওয়া সংবাদমাধ্যমে এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, সংবাদমাধ্যমের এই সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি আংশিকভাবে বৃটিশ নাগরিক সমাজের কাছে থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। বাংলায় ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের সময়কে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিলে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসনের সমালোচনাকে নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রায়ই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা দেওয়া হতো। তারপরেও বৃটেনে খুব গুরুত্বের সাথে প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ঐতিহ্যবাহী চর্চা অনুসরণের ক্ষেত্রে স্বাধীন ভারতবর্ষের জন্য একটি ভালো নমুনা হয়ে উঠেছিল।
বৃটেনের কাছে থেকে ভারতবর্ষ আসলেই বেশ কিছু গঠনমূলক জিনিস আয়ত্ত করেছিল যেগুলো কিনা স্বাধীনতা পাওয়ার আগে পর্যন্ত নিজে থেকে প্রকাশিত হয় নি বা হতে পারে নি। ভারতীয় বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য ইংরেজি সাহিত্য থেকে কিছু অনুপ্রেরণা এবং বেশ কিছু সাহিত্যিক ঘরানা ধার করেছিল, যার মধ্যে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করার ক্রমবর্ধমান ঐতিহ্যও অন্তর্র্ভূক্ত ছিল। বৃটিশ রাজের শাসনামলে লেখা প্রকাশ ও প্রচার করার ক্ষেত্রে (এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু বইও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল) বেশ কিছু বিধিনিষেধ বলবৎ ছিল। আজকের দিনে ভারত সরকারের এমন কোনো বিধিনিষেধের প্রয়োজন না থাকলেও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ঘরোয়া রাজনীতির মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে বর্তমানে আরোপিত বেশ কিছু বিধিনিষেধ ঔপনিবেশিক আমলের চেয়েও কোনো অংশে কম অবাঞ্চিত নয়।
সম্ভবত, এই প্রসঙ্গে বহুদলীয় একটি কার্যকরী গণতন্ত্র এবং একটি মুক্ত সংবাদমাধ্যমের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় থাকতে পারে না। তবে সঙ্গত কারণেই ঔপনিবেশিক কালে বৃটিশ প্রশাসনের অধীনে এই মহার্ঘ্য বিষয়গুলোর চর্চা করা যেত না। বৃটিশদের চলে যাওয়ার পরেই কেবল সেগুলো অনুধাবনযোগ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। বৃটেনের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে শেখারই ফল ছিল সেগুলো। শুধুমাত্র বৃটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পরই ভারত স্বাধীনভাবে সেগুলো ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় স্বৈরতন্ত্রের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অসামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষমতার সাথে একটি মুক্ত সংবাদমাধ্যম কিংবা ভোট গণনাকারী গণতন্ত্রের কোনো সংযোগ নেই কারণ, এই দুয়ের কোনোটিই উপনিবেশের প্রজাদের দমিয়ে রাখার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।
৬.
বৃটিশরা ভারতবর্ষের মতো বিভিন্ন পরাধীন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দূর করেছে- এমন একটি দাবির ব্যাপারেও একইভাবে সংশয় প্রকাশ করা যথাযথ হবে। ১৭৬৯-৭০ সালের দুর্ভিক্ষের ঘটনা দিয়েই বৃটিশ শাসন শুরু হয়েছিল এবং তাদের পুরো শাসনামল জুড়ে ভারতবর্ষে নিয়মিত দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ১৯৪৩ সালের ভয়ানক দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়েই বৃটিশ রাজত্ব শেষ হয়। অন্যদিকে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে আর কোনো দুর্ভিক্ষ দেখা যায় নি।
পরিহাসের ব্যাপার হলো, স্বাধীন ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণতন্ত্র ও মুক্ত গণমাধ্যম এসেছে সরাসরি বৃটেন থেকে। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের সাথে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ক বোঝা খুবই সহজ। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করা কঠিন কোনো বিষয় নয়। তুলনামূলক অল্প পরিমাণ খাবার বিনামূল্যে বন্টন করা কিংবা বেকার জনগোষ্ঠীকে মোটামুটি চলার মতো পারিশ্রমিকের কোনো কাজ সরবরাহ করার মাধ্যমে (যেটি সুবিধাভোগীদেরকে খাবার কিনতে সক্ষম করে তোলে) দুর্ভিক্ষের হুমকীর মুখে পড়া মানুষদের চরম অনাহার এড়ানোর সামর্থ্য তৈরি করা যায়। সুতরাং, কার্যকরী একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থাকা এবং একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে মোকাবিলা করা কোনো সরকারের নিজের স্বার্থে হলেও ছোট বা বড় যে-কোনো আকারের দুর্ভিক্ষের হুমকী সামাল দেওয়ার সক্ষমতা থাকা উচিত। একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যম সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সকলের সামনে তুলে ধরে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের নির্বাচনী ক্ষমতা দুর্ভিক্ষ চলাকালীন বা তার পরবর্তী সময়ে কোনো সরকারের জন্য নির্বাচনে জেতা কঠিন করে তোলে, যে-কারণে সরকারগুলো অবিলম্বে অতিরিক্ত উদ্দীপনার সাথে দুর্ভিক্ষ সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ভারতবর্ষের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো পুরোপুরি বুঝে না-পাওয়ার আগ পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পায় নি, যদিও তারা শাসিত হয়েছিল পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় গণতান্ত্রিক একটি জাতির দ্বারা এবং যে দেশটির মুক্ত সংবাদমাধ্যমের সুখ্যাতি রয়েছে, যেটি কিনা আবার সে দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে চর্চিত হলেও তার উপনিবেশগুলোতে চর্চিত হতে পারত না। মুক্তিমুখীন এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধুমাত্র শাসকদের জন্য বরাদ্দ ছিল, সাম্রাজ্যের প্রজাদের জন্য নয়।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী অভিযোগটি উত্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেন, বৃটেনের সাহচর্যে ভারতবর্ষের অর্জনের সংখ্যা অনেক। উদাহরণস্বরূপ, “শেক্সপীয়রের নাটক থেকে শুরু করে বায়রনের কবিতা এবং সর্বোপরি… উনিশ শতকের ইংরেজ রাজনীতির খোলা মনের উদারনীতিবাদ।” সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো “মানবিক সম্পর্কের মর্যাদাকে উর্দ্ধে তুলে ধরার মতো যা কিছু তাদের নিজেদের সভ্যতার জন্য কল্যাণকর, তার কোনো স্থান এদেশে বিরাজমান বৃটিশ প্রশাসনে নাই।” প্রকৃতপক্ষে, স্বয়ং বৃটিশ সাম্রাজ্যকে হুমকির মুখে না ফেলে বৃটিশরা তাদের ভারতীয় প্রজাদেরকে এইসব স্বাধীনতার চর্চা করার সুযোগ দিতে পারত না।
ভারতবর্ষে বৃটেনের ভূমিকার সাথে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকার প্রভেদ এর চেয়ে আর স্পষ্টভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। ভারতবর্ষজুড়ে বৃটেনের পতাকা অর্ধনমিত হতে শুরু হওয়ার কালে এই প্রভেদটির ব্যাপারে আমরা গভীরভাবে অবগত হয়েছিলাম।