বহুমাত্রিক সেকুলারিজম

Share this:

প্রস্তাবনা :

পৃথিবীব্যাপী বিরাজমান নানা দ্বন্দ্ব ও সংঘাত—বুদ্ধিবৃত্তিক জগত এবং বাস্তবিক বিশ্ব—উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। পৃথিবীর ইতিহাস যেমন এগিয়ে চলে সময়ের সমান্তরালে, পৃথিবীর বয়স বাড়তে থাকে, তেমনি পৃথিবী নিয়ে চিন্তাভাবনাও চলতে থাকে একই গতিতে। ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতোটুকু জানি’ এ কথা মনে প্রাণে স্বীকার করে নিয়েই চিন্তাবিদেরা পৃথিবীকে নিয়ত অধ্যয়ন করতে থাকেন। পরিবর্তনের সূত্রগুলো যেমন আবিষ্কার করেন তাঁরা, তেমনি পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে কোন অবস্থায় আছে সেটাও জানতে চেষ্টা করেন। এই পরিবর্তন ঘটে চলে জড় ও অজড় সব ক্ষেত্রে: পৃথিবীর গাঠনিক আকারে-উপাদানে, জীবের শারীরিক ও মানসিক বিন্যাসে, রাজনৈতিক, দার্শনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সকল পর্যায়ে। পরিবর্তনগুলোর বেশিরভাগই আকস্মিক ও বৈপ্লবিক নয়, বরং ধীর এবং ক্রমিক। আজকের জৈবিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনো অবস্থা, অবস্থান বা ঘটনার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস। শুধু ঘটনা নয়, সমস্ত আইডিওলোজিরও প্রেক্ষাপট থাকে। কোনো পটভূমিকা ছাড়াই হঠাৎ করে বিশেষত কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক তত্ত্ব জন্মায় না। তাই যে কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক ঘটনা সম্যকভাবে বুঝতে গেলে ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক এবং তার সাথে জড়িত ইতিহাসটা বোঝা জরুরি। কারণ ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের পথ ধরেই আমাদের আজকের উন্নত প্রযুক্তিগত সভ্যতা, আমাদের গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, ধর্মীয় পুনরুত্থান, ধর্মনিরপেক্ষতা…। তবে ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ধারায় বর্তমানের সমাজ, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির যে অবস্থা বা অবস্থান সেটা ঐতিহাসিক অনিবার্যতা কিনা সেটা বলা মুশকিল। হয়তো ভিন্ন কিছুও হতে পারতো। যাহোক, আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েই কিছুক্ষণ ভাববো। এক্ষেত্রে আমরা ধরে নেবো যে ইংরেজি Secularism-এর বাংলা প্রতিশব্দই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। সেকুলারিজম শব্দটা আমরা পাই ১৮৫১ সালে। ব্রিটিশ লেখক George Jacob Holyoake-কে Secularism শব্দটির জনক বলা হয়।

সেকুলারিজমের নান্দীপাঠ :

ইউরোপে আধুনিক যুগের শুরুতে (ইউরোপের ইতিহাসে সময়টাকে Early Modern বলা হয়েছে) অর্থাৎ ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে রোমান ক্যাথলিক চার্চের সাথে প্রোটেস্টেন্টদের যে বিরোধ, সেই বিরোধিতার ফলাফলের মধ্যেই সেকুলারিজমের আদিপর্বের সূত্র প্রোথিত আছে। ক্যাথলিক চার্চের সাথে প্রোটেস্টেন্টদের বিরোধটাকে ইউরোপের ইতিহাসে Reformation বলা হয়। আর চার্চকে রাষ্ট্রের ওপর বা রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির ওপর হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখাকে বলা যায় সেকুলারাইজেশন এবং চার্চ বা অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার নীতিকে বলা যায় সেকুলারিজম।

সেকুলারিজম নিয়ে লিখতে গিয়ে Nader Hashemi শুরুতেই সতর্কবার্তা দিয়েছেন: “Secularism is inherently an ambiguous concept. There is no global consensus on what the term refers, where its origins lie and its various dimensions especially in relation to political questions.” একই রকম কথা লিখেছেন কানাডিয়ান লেখক Charles Taylor. তিনি লিখেছেন: “[i]t is not entirely clear what is meant by secularism.” তাঁরা এমনটা বললেও চিন্তাবিদ এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যে সেকুলারিজম বিষয়ে বেশখানিকটা ধারণা আছে। যেমন সেকুলারিজম শব্দের জনক Holyoake এটাকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: “Secularism is not an argument against Christianity, it is one independent of it…. Secularism does not say there is no light or guidance elsewhere, but maintains that there is light and guidance in secular truth, whose conditions and sanctions exist independently, and act forever. Secular knowledge is manifestly that kind of knowledge which is founded in this life, which relates to the conduct of this life, conduces to the welfare of this life, and is capable of being tested by the experience of this life.” এখানে সেকুলারিজমের সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ানিটির একটা সম্পর্কের কথা পাচ্ছি। সম্পর্কটা বিরোধাত্মকও নয়, বন্ধুত্বপূর্ণও নয়, বরং পরস্পর স্বাধীন এবং ইহজাগতিক ও মানবকল্যাণমুখী।

Nader Hashemi সেকুলারিজম সম্পর্কে ধারণাটাকে আরো স্পষ্ট করতে গিয়ে একে সামাজিক বিজ্ঞানের প্রধান তিনটি শাখা যথা দর্শন, সমাজবিজ্ঞান এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাঁর মতে, দর্শনের দিক দিয়ে সেকুলারিজম বলতে বোঝায় অতীন্দ্রিয়বাদ (Transcendental) ও অধিবিদ্যাকে (Metaphysical) পরিত্যাগ করে অস্তিত্ববাদ (Existential) এবং অভিজ্ঞতাবাদের (Empiricism) দিকে নজর দেওয়া। এটাকেই Harvey Cox বলেছেন “the liberation of man from religious and metaphysical tutelage, the turning of his attention away from other worlds and toward this one.” সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সেকুলারিজম—মডার্নিজমের (Modernization) সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ব্যাপার। আধুনিকীকরণ একটি ক্রমিক পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া যতোই অগ্রসর হতে থাকে, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব হ্রাস পায়। এটাকে Peter Berger বলেছেন “process by which sectors of society and culture are removed from the domination of religious institutions and symbols.” রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেকুলারিজম নির্দেশ করে ব্যক্তিগত জীবন (Private sphere) থেকে জনপরিসরকে (Public sphere) আলাদা করা। বৃহৎ অর্থে এটা দ্বারা বোঝানো হয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিচ্ছিন্নকরণ। এই তিনভাবে দেখলে সেকুলারিজম সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা অধিকতর পরিষ্কার হয়। একটা রাষ্ট্র কতোখানি সেকুলার বা তার সেকুলারাইজেশন প্রক্রিয়া কতোখানি গতিশীল তা আমরা তিনটা নির্ধারক দ্বারা পরিমাপ করতে পারি :

১. সেকুলার বিশ্বাস ও চর্চায় আস্থাশীল লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি

২. জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রগুলোতে ধর্মের প্রভাব হ্রাস এবং

৩. রাষ্ট্র থেকে ধর্মের ক্রমবর্ধমান পৃথকীকরণ।

পশ্চিমা আধুনিকীকরণ তত্ত্ব (Modernization Theory) মতে ধর্মনিরপেক্ষতা গণতন্ত্রেরও অন্যতম পূর্বশর্ত। আবার এমনও বলা হয় যে সেকুলার হওয়া মানেই আধুনিক হওয়া, আধুনিক হওয়া মানেই সেকুলার হওয়া। প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। আর যে দেশে বহু ধর্মের, বহু সংস্কৃতির এবং বহু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বাস সেদেশের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা অনিবার্য। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা নিয়ে অস্পষ্টতা এবং বিতর্ক আছে। আগেই বলা হয়েছে সেকুলারিজম খুব সহজবোধ্য জিনিস নয়। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজমের ধারণা কোনো নিশ্চল বিষয় না ; অর্থাৎ সর্বকালে এবং সর্বদেশে সেকুলারিজম বলতে একই রকম ধ্যানধারণা বোঝায় না। যেমন কেউ বলেন “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়”, কেউ বলেন “ধর্মনিরপেক্ষতা আর নাস্তিকতা একই।”

উপরে আলোচিত সেকুলারিজমের ধারণা থেকে আমরা এখন বলতে পারি, প্রথম উক্তিটি সত্য তবে সংকীর্ণ, দ্বিতীয়টি একেবারেই মিথ্যা। কারণ আমরা জেনেছি ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে রাষ্ট্র থেকে ধর্মের পৃথকীকরণ বোঝায়। (আমরা পরবর্তীতে দেখবো, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল এই সংজ্ঞা মেনে চলে না)। অর্থাৎ রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক কার্যক্রমকে ধর্মের প্রভাব বলয়ের বাইরে রাখা। নাস্তিকতা বলতে যা বোঝায় সেকুলারিজম ঠিক সেই বিষয়কে নির্দেশ করে না। একজন ব্যক্তি নাস্তিক না হয়েও অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস রেখেও সেকুলার হতে পারেন। যেমন কোনো একজন আস্তিক দর্শনের দিক দিয়ে নন-সেকুলার, (কারণ তিনি সৃষ্টিকর্তা অস্তিত্বে বিশ্বাস করছেন) এবং সমাজবিজ্ঞানের বিবেচনায়ও নন-সেকুলার (কারণ তিনি একটি নন-সেকুলার সমাজে বাস করছেন, ধর্মকর্ম করছেন, ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করছেন, ধর্মীয় উৎসব পালন করছেন) হয়েও রাজনৈতিকভাবে সেকুলার হতে পারেন (কারণ তিনি ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের বিভাজন চান, এবং ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনে পালনের বিষয় মনে করেন)। সুতরাং নাস্তিকতার সাথে ধর্মনিরপেক্ষতা এক করে দেখা একটা বিরাট বিভ্রান্তি। National Secular Society’র ওয়েবসাইটে what is secularism নামক একটা আর্টিকেলে লেখা হয়েছে:

“Atheism is a lack of belief in gods. Secularism simply provides a framework for a democratic society. Atheists have an obvious interest in supporting secularism, but secularism itself does not seek to challenge the tenets of any particular religion or belief, neither does it seek to impose atheism on anyone.Secularism is simply a framework for ensuring equality throughout society– in politics, education, the law and elsewhere, for believers and non-believers alike.”

সেকুলারিজমের জন্মকথা :

এই পর্বের মুখ্য প্রশ্ন হচ্ছে সেকুলারিজমের উৎপত্তি কেন হলো। সেই আলোচনায় প্রথমেই আসবে Reformation। ইউরোপের ইতিহাসে বিদায়ী মধ্যযুগের সঙ্গে নবাগত আধুনিকতার বিচ্ছেদের প্রধান সুরের নাম Reformation. স্বস্ত্যয়নেই উল্লেখ করেছি যেকোনো রাজনৈতিক মতবাদের উৎপত্তির একটা পটভূমি থাকে। বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে যেহেতু পটভূমি বিভিন্ন হয় তাই বলা যায় সেকুলারিজমের ইতিহাস একটি নয়, একাধিক। তবে সারকথা হলো যে কোনো বিদ্যমান মতবাদ বা রাজনৈতিক এবং সমাজকাঠামো যখন ওই সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য আর উপযোগী থাকে না, যখন কাঠামোর ভেতরে অনেকগুলো কন্ট্রাডিকশন জন্ম নেয় এবং কাঠামোটা দুর্বল হয়ে পড়ে, যখন ওই নির্দিষ্ট রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য বিরাজমান কাঠামোটা অপূর্ণ এবং অপর্যাপ্ত বলে প্রতীয়মান হয়, তখনই নতুন মতবাদ বা নতুন কাঠামো জন্ম নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। যেমন পশ্চিমে সেকুলারিজমের উত্থানের পেছনে চারটি শক্তিশালী প্রবণতার ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়:

১. আধুনিক পুঁজিবাদের উত্থান

২. আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র (nation-state) ও জাতীয়তাবাদের উদ্ভব

৩. বৈজ্ঞানিক বিপ্লব এবং

৪. প্রোটেস্টেন্ট রিফর্মেশন এবং ষোল শতকের ইউরোপের ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধ। শেষেরটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেকুলারিজমের ক্ষেত্রে। ১৫২৪ -১৬৪৮ পর্যন্ত উত্তর ও মধ্য ইউরোপে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও তার সমর্থকদের সাথে প্রোটেস্টেন্টদের সংঘর্ষ ও যুদ্ধ হয়েছে। মার্টিন লুথার ক্যাথলিক চার্চের কর্তৃত্ব ও দুর্নীতি, চার্চপ্রদত্ত নানারকম ফতোয়া, চার্চের বিভিন্ন প্রথা প্রভৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং চার্চ রিফর্ম করার দাবি জানান। ক্যাথলিক চার্চের একগুঁয়েমিতে রিফর্মের সম্ভাবনা যখন ফিকে হয়ে আসে তখনই ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটানোর পালা শুরু হয় এবং লুথারান, প্রেসবাইটেরিয়ান এবং বিভিন্ন রিফর্মড চার্চ গঠিত হতে থাকে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে। এই প্রক্রিয়াটারই একটা উপজাত হিসেবে রাষ্ট্র থেকে ধর্মের পৃথকীকরণ, এবং জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর চার্চের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে।

মধ্যযুগে এবং আধুনিক যুগের শুরুতেও ইউরোপে ধর্মের ভূমিকা ছিল বিশাল। সেই ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে John Spurr লিখেছেন, “religion in the seventeenth century was not a modern political ‘problem’; it was not an issue like inflation or the use of resources in the health service, to be managed or solved through the application of political strategies. Religion was part of the way that society and politics were constituted.” এই অবস্থা থেকে চার্চের ভূমিকা যখন হ্রাস পেলো, তখন রাষ্ট্রের হাতে অধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলো। তবে সেই সঙ্গে সমাজে প্রোটেস্টেন্ট ও ক্যাথলিক দ্বন্দ্বও থেকে গেল। এমনকি প্রোটেস্টেন্টদের মধ্যেও কয়েক রকমের উপবিভাগ তৈরি হয়ে ইউরোপের সমাজগুলো ধর্মকেন্দ্রিক বিবাদ বিসম্বাদে জর্জরিত থাকলো। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা থেকে জাত সংঘাত থেকে মুক্তির রাজনৈতিক সমাধান হিসেবেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সেকুলারিজমকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়।

সেকুলারিজমের টাইপোলজি :

রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সেকুলারিজম মেনে চলার ক্ষেত্রে একটা প্রশ্নের দেখা দেয়। প্রত্যেক রাষ্ট্রেই বহুসংখ্যক বিভিন্ন ধর্মানুসারী নাগরিক বাস করে এবং অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থাকে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ওইসব নাগরিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? এটি একটি বাস্তব সমস্যা বিশেষ করে যেসব দেশে ধর্মের প্রভাব খুব বেশি ও নাগরিকদের মধ্যে সেকুলারিজম নিয়ে বিরূপ মনোভাব প্রবল এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বিরাজমান। রাষ্ট্র কি সেখানে সকল ধর্মের প্রতি সমান মনোযোগ এবং পৃষ্ঠপোষকতা দেবে নাকি সকল ধর্ম থেকে সমান দূরত্ব বজায় রাখবে? নিরপেক্ষতার নীতি এই দুইভাবেই সেখানে পালন করা যায়। হয় সকলকে সমান সুবিধা প্রদান, কারো প্রতি বিশেষ পক্ষপাত না করা অথবা কারো সঙ্গেই কোনো সম্পর্ক না রাখা। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বলা যায় সেকুলারিজমের যেমন একাধিক ইতিহাস আছে তেমনি এর রয়েছে নানা ধরন এবং মাত্রাগত পার্থক্য।

নাদের হাশেমি দুটো প্রকরণের কথা উল্লেখ করেছেন: Anglo-American secularism এবং French secularism বা laicité.Anglo-American সেকুলারিজম প্রকাশ্যে ধর্ম পালনের ব্যাপারে উদার। ব্যক্তি যে কোনো ধর্ম বিশ্বাস ধারণ, পালন এবং ধর্ম বিশ্বাসহীন হওয়ার অধিকার ভোগ করবে। রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীর প্রতি কোনো বিশেষ আগ্রহ দেখাবে না। অন্যদিকে French secularism প্রকাশ্য ধর্ম পালনের বিরুদ্ধ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। এখানে রাষ্ট্র ধর্মের হাত থেকে নাগরিকদেরকে রক্ষার দায়িত্ব নেয়।

Ahmet T.Kuru সেকুলারিজমের রাজনৈতিক মডেলগুলোকে দুটো ধারায় ভাগ করেছেন। একটার নাম দিয়েছেন Assertive Secularism অপরটার নাম Passive Secularism. তাঁর মতে Assertive Secularism হচ্ছে সেই রাষ্ট্রনীতি যেটা জনপরিসর থেকে ধর্মকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন করে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনে অনুশীলনের মধ্যে ঠেলে দেয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেকুলারিজমের। যেমন ফ্রান্সে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব ধর্মের ছাত্রছাত্রীদের ধর্মীয় প্রতীক বা পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ। Passive Secularism ধর্মকে প্রকাশ্যে পালনের অনুমোদন দেয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারে কোনো নিষেধ নেই। অধ্যাপক আলী রীয়াজ সেকুলার রাষ্ট্রের চারটি মডেলের কথা আলোচনা করেছেন: ফরাসি, ব্রিটিশ, আমেরিকান এবং ভারতীয় মডেল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে একটা ধারা যোগ করা হয় “Congress shall make no law respecting an establishment of religion, or prohibiting the free exercise thereof”… এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বেশ বড় একটা অংশের—ধর্মের সঙ্গে নিবিড় বন্ধন থাকলেও, অর্থাৎ সমাজে ধর্ম চর্চিত হলেও রাষ্ট্র নিজেকে ধর্ম থেকে দূরে রাখে। ইংল্যান্ডের সেকুলার আইনবিভাগ এবং বিচারবিভাগ থাকলেও তাদের রয়েছে স্টেট চার্চ।

“চার্চ অব ইংল্যান্ড”—যার সুপ্রিম গভর্নর হন রাজতন্ত্রের প্রধান অর্থাৎ রাজা বা রানী। ফ্রান্স সকল ধর্ম থেকেই রাষ্ট্রকে সমান দূরত্বে রাখার নীতি গ্রহণ করেছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার মডেলটা বাকি তিনটা থেকে ভিন্ন। ভারত সকল ধর্মকে সমান মর্যাদা দেওয়ার নীতিতে পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশী সেকুলারিজমের সাংবিধানিক খিচুড়ি :

রাষ্ট্র সেকুলারিজমের যে মডেলই গ্রহণ করুক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করা। অর্থাৎ একজনের ধর্ম পালন যদি অন্যের সাংবিধানিক অধিকার সংকুচিত করতে উদ্যত হয় রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করবে জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের পক্ষে। ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় যেমন বলা হয়েছে যে এটি রাষ্ট্র থেকে ধর্মের বিযুক্তি, সেই সূত্রে রাষ্ট্রের উচিত কোনো ধর্মকেই কোনো প্রকার পৃষ্ঠপোষকতা না দেওয়া। সেই বিবেচনায় ধর্মনিরপেক্ষতার ভারতীয় মডেলটিকে আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায় না। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্র এবং ধর্মের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা কঠিন। এখানে কোনটা ক্লাস পলিটিক্স আর কোনটা রিলিজিয়াস পলিটিক্স বোঝা দুরূহ। ধর্মের টানে ক্লাসের বেড়া টপকিয়ে কখন কোন গোষ্ঠী এসে হাজির হচ্ছে কোন দলে, নাকি রাজনৈতিক প্রভু ভৃত্য(Clientalism) সম্পর্কের দ্বারা সৃষ্ট স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীতন্ত্রের আনুগত্যে শ্রেণী ও ধর্মের ভেদরেখা ডিঙিয়ে জনসাধারণ এসে দাঁড়াচ্ছে রাজনৈতিক দলের পেছনে—সেইটা দুরূহ গবেষণার বিষয়। কোনো একক ফ্রেমওয়ার্ক বা তত্ত্ব দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতি সম্যকভাবে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। এখানকার ধর্মনিরপেক্ষ দল আওয়ামীলীগ ধীরে ধীরে ধর্মের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এখন লাফিয়ে লাফিয়ে ধর্মকে আলিঙ্গন করতে শুরু করেছে। সেনাবাহিনীকে অপেক্ষাকৃত স্যেকুলার প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছে সেনাবাহিনী থেকে আসা দুজন সামরিক শাসক। তারা বিশুদ্ধ ধর্মীয় প্রেরণা থেকে কাজটি করেননি; করেছেন রাজনৈতিক প্রেরণা থেকেই। রাজনীতির খেলায় ধর্মের কার্ড খেলেছে তারা। আবার প্রতিষ্ঠাগতভাবেই ধর্মপন্থী দল জামায়াতে ইসলাম, যাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল পরজাগতিক, তারাই বরং সবচেয়ে ইহজাগতিক হয়ে প্রচুর সম্পদ এবং শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে রাজনীতিতে প্রতাপশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। একদিকে বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবেই সৌদি আরব, ইরানের মতো একটি ধর্ম রাষ্ট্র। আবার সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর গ্রেট পাজল!

প্রবন্ধের অন্তর্জলী যাত্রা :

ব্যক্তি তার নিজ দায়িত্বে ধর্ম পালন করুক। রাষ্ট্র কাউকে ধর্ম পালনে উৎসাহিত করবে না, অনুৎসাহিতও করবে না। কারো ধর্ম পালনে কেউ বাধা সৃষ্টি করলে রাষ্ট্র সেটাকে ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বিবেচনায় সেই বাধা অপসারণের চেষ্টা করবে মাত্র। আবার ধর্ম পালন করতে গিয়ে কেউ যদি অন্য কারো ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সংকুচিত করে তাহলেও রাষ্ট্র একই বিবেচনায় সেই অপরাধের বিচার করবে। এই প্রক্রিয়াতে ব্যক্তি তার নিজ ধর্ম পালনের সীমানাটুকু সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে। ব্যক্তি তখন বুঝতে শিখবে ধর্মাচার বা ধর্মপালন একটা ব্যক্তিগত বিষয়। ধর্মনিরপেক্ষতা কেউ জন্ম থেকে শিখে আসে না। এবং আমাদের রাজনৈতিক বা সামাজিক সংস্কৃতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা একেবারেই আনকোরা নতুন বিষয় নয়। আমাদের সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গৃহীত হয়েছে তার একটা প্রেক্ষাপট আছে। বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশেষ করে সাতচল্লিশে ধর্মের ভিত্তিতে বেদনাদায়ক দেশভাগ এবং পাকিস্তানের কাছে চব্বিশ বছরের শোষণের ইতিহাস, ইসলামের নামে বাঙালির প্রতি বিদ্বেষ এবং ফলশ্রুতিতে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ এসব প্রেক্ষাপটেই তো আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গৃহীত হয়। তাই রাষ্ট্রকেই এটা পালনে উদ্যোগী হতে হবে। রাষ্ট্র সেটা পালন করতে বাধ্য। রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে একসময় নাগরিকেরাও ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠবে। ইউরোপের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রথম পর্যায়ে সব নাগরিক ধর্মনিরপেক্ষতা চায়নি। কিন্তু রাষ্ট্র তার নীতি থেকে সরে আসেনি। ফলে সারা বিশ্বের কাছে তারাই এখন সেকুলারিজমের আদর্শ। বড় কথা হচ্ছে যে ধর্মনিরপেক্ষতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সহায়ক নীতি। সেটার চর্চা জরুরি। ব্যক্তিজীবনে আপনি ধার্মিক বা নিধার্মিক হতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক হতে হলে রাষ্ট্রকে আগে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। আর ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করবেন তখন তাকেও অতি অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার সারকথা এইটুকুই।

পুনর্ভাবনা :

স্বীকার করতেই হবে পশ্চিমা আধুনিকীকরণ তত্ত্বে যেমন বলা হয়েছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন, শহরায়ন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ইত্যাদির সাথে সাথে সেকুলারাইজেশনও ত্বরান্বিত হবে, বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে সেটা আসলে হয়নি। একুশ শতকে আমরা আবার ধর্মীয় প্রভাবের পুনরুত্থান দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তারা নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে শাসনক্ষমতায় যেতে সক্ষম হয়েছে। এসব বিষয়ে আমাদের নিজ দেশের প্রেক্ষাপটে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। সেকুলারিজম যে শেকড় গাড়তে পারলো না সেটা কি সেকুলারিজমের অন্তর্নিহিত ব্যর্থতা, নাকি মডার্নাইজেশন তত্ত্বের ভুল সিদ্ধান্ত নাকি বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দোষ, সে বিষয়ে অনুসন্ধান জরুরি।

তথ্যসূত্র

Nader Hashemi, ‘The Multiple Histories of Secularism:Muslim Societies in Comparison’, Philosophy & Social Criticism, vol 36 nos 3-4 March and May 2010, SAGE Publications Ltd.

Ahmet T. Kuru, Secularism and State Policies toward Religion : The United States, France and Turkey .Cambridge University Press, 2009.

Wilfred M. McClay, ‘Two Concepts of Secularism’, Journal of Policy History, Cambridge University Press, 2001.

আলী রীয়াজ, ‘সেক্যুলারিজমের রূপ ও রূপান্তর’, প্রতিচিন্তা, তৃতীয় সংখ্যা, ঢাকা, ২০১৬।

Amartya Sen, The Argumentative Indian, Picador, 2005.

John Spurr, The Post-Reformation, 1603-1714, Harlow : Pearson Longman, 2006.

  • More From This Author:

      None Found

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!