স্বগত শুদ্ধস্বর : ‘জাহাজ/অর্ধসমাপ্ত স্বর্গ/আমি আছি তোমার প্রতীক্ষায়’

Share this:

কণ্ঠস্বর বা গাণ্ডী আমাদের কালে ছিল না। ছিল শুদ্ধস্বর। সেটা নব্বইয়ের শুরু। এরশাদকে হটানো হয়েছে, মসনদে বেগম খালেদা জিয়া। সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে খান খান হয়েছে। আমেরিকা বোমা খরচ না-করেই রাশিয়াকে ধরাশায়ী করেছে। কম্যুনিস্টবিশ্ব হতাশ, মুক্তবাজার অর্থনীতির উত্থান। বিশ্বায়ন শুরু, তার হাত ধরে সাহিত্যশিল্পে নানা তত্ত্ব-দর্শন। সবে পাঠে হাতেখড়ি, পাখিরে দিয়েছ গান গায় সেই গান/আমারে দিয়েছ সুর আমি গাই গান। মনের আনন্দে দুচার-লাইন কবিতা লিখি। স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা একমাত্র ভরসা। জাতীয় দৈনিকে দেওয়ার সাহস সঞ্চয় করিনি। লিটল ম্যাগাজিন ধারণাও নেই। কীভাবে লিখতে হয় জানিও না। লেখালেখির সবচেয়ে বড়ো শক্তি লেখকবন্ধু ও প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, সেটাও জানি না। লেখক হওয়ার পরিকল্পনাও মাথায় নেই। কলেজে পড়ি, সাহিত্য-টাহিত্য ভালো লাগে, পড়তে ও লিখতেও। লেখা ছাপা হলে ভালোই আনন্দ লাগে। ওই পর্যন্তই। ঠিক তখন। ঠিক তখন শুদ্ধস্বর! শুদ্ধস্বর। এক স্বাপ্নিক ও অভিমানী তরুণের অন্তর্গত বিষাদ, শক্তি ও আনন্দ। আমাকে ছুঁলো। আমাকে ও আমাদেরকে। আমরা কয়েকজন তরুণ। মফস্বল শহর সিলেটে থাকি। তখন তথ্যযোগাযোগ ও প্রযুক্তির এমন উন্নতি হয়নি। চিঠির যুগ। সেই যুগে নতুন স্বর, শুদ্ধস্বর। আমাদের চিন্তাকে একাকার করল, আমাদের মননগঠনে বড়োধরনের শক্তি হয়ে আবির্ভূত হলো। স্বপ্ন ও সাহস জুগোলা। সেই শুরু। আমার, আমাদের।

আমি যুক্ত হয়েছিলাম শুদ্ধস্বরের তৃতীয় সংখ্যা থেকে। যদি ভুল না-করে থাকি, আর সম্পাদক যদি আমাকে ক্ষমা করেন তাহলে বলতে হয়; সংখ্যাটি শুদ্ধস্বর নতুন যাত্রার দ্বৈরথ ছিল। পরিকল্পিত একটি সংখ্যা। আর আমার প্রথম অগতানুগতিক লেখা, প্রথম নিরীক্ষামূলক লেখা এসংখ্যাতেই ছাপা হয়। একটি গদ্য, গল্প। গল্পের বিরুদ্ধে গল্প। কবি আফজাল চৌধুরী পড়ে বলেছিলেন ফ্যান্টাসি। কেউ বলেছিল মারত্মক কিছু, কেউ বলেছিল ফালতু। আমি পেছনে ফিরে শুধু বলি, এক তরুণ স্রষ্টার দর্পমাত্র। আর কিছুই নয়। কিন্তু সে কথা পরে।

কাগজটি বেরিয়েছিল সম্পাদকের অতি সখের ক্যামেরা-বিক্রির টাকায়; অনেক সংগ্রাম ও অপমানের ভেতর দিয়ে। চিকন-কালো আর বেঁটেখাটো হলুদরঙের হতচ্ছড়া সম্পাদক-সহকারী সম্পাদককে বিজ্ঞাপন কে দেয় বলুন, তাচ্ছিল্য ছাড়া? (অনেকে তো লেখাও দেননি!) কারণ পত্রিকাটি বেরিয়েছিল একদল তরুণের সাহিত্য ও জীবন বোধের স্বপ্ন ও অঙ্গীকার নিয়ে। শুদ্ধস্বরের সম্পাদক কখনওই একার পত্রিকা করেননি, ভাবেনওনি। একার হাতে সব করেও তিনি বলতেন শুদ্ধস্বর আমাদের পত্রিকা।একটা যৌথ আবেগ নির্মাণে তিনি ছিলেন সফল। পত্রিকাটি ছিল, যারা সত্যিকার লিখতে চায়, ভাবতে চায়, নিজের মতো একটা সৃষ্টি ছাপাতে চায়। তাদেরই। ছিল সাহিত্যের প্রতি প্রেম, শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ। সে প্রেম বাজারি ছিল না, আয়েশি ছিল না।

স্থান জেলাশহর সিলেট। তখন তো ঢাকা বাদে সবই মফস্বল। ঢাকা রাজধানী, ঢাকা কেন্দ্র। সময়টা সোভিয়েট-উত্তর। পাত্রপাত্রী কজন তরুণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেন্দ্র ভেঙে যাচ্ছে, তাই সিলেটও আসলে তখন পৃথিবীর কেন্দ্রচূর্ণ। ধ্বস্ত ব্যক্তিসত্তা, ধ্বস্ত সমাজসত্তা, ধ্বস্ত রাষ্ট্রসত্তার সময়ে পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের সচেতন ও সৃষ্টিশীল তরুণরা যেমন ভাবছিল, শুদ্ধস্বরগোষ্ঠীর পাত্রপাত্রীর ভাবনাটাও ছিল সমান। একটা পৃথিবী পেছনে, যেটা নষ্ট হয়ে গছে আগে; আরেকটা গড়ে নিতে হলে লাগে সকালের আলোর মতোন বয়েস। সেই বয়েসি দুই তরুণ; আহমেদুর রশীদ টুটুল ও আহমদ মিনহাজ আসলেন এমসি কলেজে।টুটুলও এম সি কলেজেরই ছাত্র। মিনহাজ সাস্টের প্রথম ব্যাচ।  মনে আছে সময়টা ছিল শীতের ঠিক পূর্বে। দিনটি ছিল সুন্দর, ওরাও ছিল উজ্জ্বল। সেখানেই যুক্ত হওয়া আমার। আহমেদুর রশীদ ওরফে টুটুল কথা বললেন, মিনহাজ কথা বললেন। পরে কথা মাহবুব লীলেনের সঙ্গে; এবিষয়ে। শুদ্ধস্বরের উদ্যোগ নিয়ে। কিন্তু সময়টা ছিল খারাপ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দলের উত্থান দেশে। ছাত্রশিবির হন্যে হয়ে উঠেছে। আশির সামরিক শাসনের পর যে-অবক্ষয়ী সমাজ দেশে; সামরিক চলে যাওয়ার পর সামরিকের তল্পিবাহকেরা রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হচ্ছেন। বৈশ্বিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাঁতাল রূপ দেখাতে তৎপর। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নানা দিক থেকে ভয়াবহ, হতাশাজনক। সেই সময়ের দাহ, সেই সময়ের দ্রোহ। জানি না কেন আমার তখন নিজেকে নিয়ে কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। শুধু ভেতরে অঙ্গীকার ছিল, বদলে দিতে চাই পৃথিবী। কিন্তু কীভাবে বদলাতে হবে জানতাম না। মনে হয় রাজনীতির মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলানোর স্বপ্নটাই ছিল। কিন্তু সেটা আর পথ হয়ে উঠল না। স্বপ্নে ঘোরে শুধু শুদ্ধস্বরের সংখ্যাটি বেরুল। আমার মনে হয় আহমেদুর রশীদ যে-কথাগুলো সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন সেটা তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বের যেকোনও তরুণেরই বুকফাটা আর্তি ছিল। নিচে তার একটু তুলে ধরছি :

তারুণ্যের বুকজুড়ে আজ দ্রোহ আর দাহ। আর্থসামাজিক পোড় খাওয়া পরিবেশে তারুণ্যের নিশ্বাস ফেলার জায়গা নেই। মেধো ও মননকে সৎউপায়ে কাজে লাগানোর সবগুলো সুযোগ কেড়ে নিয়ে তারুণ্যের চোখে আজ সেটে দেওয়া হয়েছে হতাশার কালো চশমা, স্বাভাবিকভাবেই তারুণ্যের চোখের সামনে এখন মাঠের পর মাঠ শূন্যতা। যে-শূন্যতা তারুণ্যের এক অংশের হাতে তুলে দিয়েছে পিস্তল-বোমা-ককটেল এবং আর অংশের বুকের ভেতর উসকে দিচ্ছে সৃজনশীলতার মোম। বিরূপতার ধোঁয়ার ভেতর যে মোম গলে পড়ছে চেতনার রূপক হয়ে।

আমাদের চলা ঐ মোমের মতোই। নিভে যেতে যেতে জ্বলে থাকতে চাচ্ছি, প্রাণের আলোটুকু ছড়াবো বলে। মানুষ ও জীবনের গভীরৈ ডুব দিয়ে বহুরঙা জীবনের বোধ ও অনুভূতি তুলে আনার ব্যাকুলতা নিয়ে আমাদের এই যাত্রা। জীবনের ভেতর-বাহির, আমাদের উপলব্ধি মোমের সলতে। শুদ্ধস্বর এই উপলব্ধিরই সংস্করণ। […]

এই বক্তব্যে আহমেদুর রশীদ যতটা আন্তরিক, স্পষ্ট, সৎ ও দায়বদ্ধ ছিলেন আমার মনে হয় না পরবর্তীকালে তিনি সেটা থেকে দূরবর্তী ছিলেন। তিনি যে খুব একটা লিখতেন তাও কিন্তু না। লেখালেখিতে তাঁকে সিরিয়াসও করতে পারেননি বন্ধুরা। মনে হয় তেমন ইচ্ছেও ছিল না তাঁর। যেমন সারা পৃথিবীতে হয়, একদল মানুষ সাহিত্য-শিল্পের একটা পরিবেশ করে দেন অন্যের জন্য। একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেন, অন্য কেউ বিচরণ করবেন বলে। সেটা উল্লিখিত দুই পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল্লাহ আবু সয়ীদ কিংবা তপন বড়ুয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। দেখা গেছে দ্রষ্টব্যের কামরুল হুদা পথিক, বিপ্রতীপের ফরুক সিদ্দিকী, নিসর্গের সরকার আশরাফের বেলায়ও। যেটাই হোক, সম্পাদকীয়টি ছিল সময়ের ক্ষত, সম্পাদকের হৃদয়ের পৃষ্ঠা ও তারুণ্যের ভাষ্য।

শুদ্ধস্বরের আগের দুটো সংখ্যা ছোটোকাগজ হিসেবে কাঙ্খিত অবস্থানে পৌঁছুতে পারেনি, সম্পাদক নিজেও স্বীকার করে থাকবেন। কিন্তু তৃতীয় সংখ্যাটিতে আগের সব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করলেন, বিষয়বৈচিত্র্য ও চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে। যতদূর মনে পড়ে বন্ধুদের দিয়ে লিখেয়ে নিয়েছিলেন লেখাগুলোও। তবে, একটা দায় থেকে তিনি যখন প্রকৃতই সাহিত্যের কাজ করতে গেলেন; আহতও হলেন মারাত্মতভাবে। তিনি এবং সারথি আহমদ মিনহাজ। পরিকল্পনা ছিল তৎকালীন দুই গুরুত্বপূর্ণ কবির সাক্ষাৎকার যাবে সংখ্যাটিতে। রাজনৈতিক ও দার্শনিক আদর্শের জায়গা থেকে দুজন আবার দুই মেরুর মানুষ হিসেবেই পাঠকের কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু শুদ্ধস্বরের উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্যিক ও শৈল্পিক পরিসরের সন্ধান। সুস্থ ও স্বাভাবিক বিতর্ক বা সমালোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি। কিন্তু সেটি সম্ভব হলো না। এটা তরুণদের খুব আহত করে। সম্পাদকীয়তে এই মর্মবেদনা উপস্থাপিত হয় এভাবে:

[…] এবারের সংখ্যায় আমাদের পরিকল্পপনা ছিল, দেশের অন্যতম দুই শক্তিমান কবির (যাদের অবস্থান আপাতঃ পাঠকবিচারে দুই ভিন্ন মেরুতে) সাক্ষাৎকার ছাপিয়ে তথাকথিত বিপরীতমুখী সাহিত্যধারার কপালে আঘাত হানবো। এই আঘাত যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, বুদ্ধিজীবীরা একে যতই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্ট করুণ না কেন; আমাদের বিশ্বাস ছিল, এই আঘাত একদিন প্রবল শক্তিতে নাড়িয়ে দেবে হিংসা আর বিদ্বেষের আস্তরমাখা বিভেদের দেয়াল। কেননা আমরা মনে করি, আদর্শিক বিভেদ ও মতাদর্শের পার্থক্য অন্তত একজন লেখককে হিংসা ও অহংকারী করে তুলতে পারে না। তাঁদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সুবিধা লুটতে পারে না নষ্ট রাজনীতির ঘাতক নখর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের পরিকল্পনা পূর্ণতা পেল না।

 

শুদ্ধস্বরের সংখ্যাটি ছিল অনবদ্য। আহমদ মিনহাজ ‘সাহিত্যে সমাজবাস্তবতা : কোন পথের যাত্রী’ শিরোনামে যে-নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি আজও এক অসাধারণ রচনা। মিনহাজ সে প্রবন্ধের সূত্র ধরে পরে অনন্যসাধারণ মননশীল লেখক হয়ে ওঠেন পরে। মাহবুব লীলেন এডগার এ্যালেন পোর কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। কামাল তৈয়ব  ‘ক্যমেলিয়া তোর উৎসের কাছে’ যে কবিতাটি লিখেন, মনে আছে সেটা তরুণদের মুখে মুখে ছিল। কিন্তু এই সংখ্যাটিতেই যে অভিজ্ঞতা হলো আহমেদুর রশীদ বড্ডো অভিমানীও হয়ে উঠলেন। সত্যিকার অর্থে তার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। তিনি লিখলেন :

টাকাওয়ালারা পিস্তল-রিভলবারের গুঁতো খেয়ে চাঁদা দিতে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে, লিটল ম্যাগাজিনের নিরীহ সম্পাদকদের পারলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। […] ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুদ্ধস্বরকে আকার-প্রকারে বর্ণাঢ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলা সম্ভব হলো না। আর নিয়মিত করার কথা তো প্রথম সংখ্যাতেই বাক্সবন্দী করেছি। […] 

কিন্তু স্বপ্ন যার সাহিত্যশিল্প নিয়ে তিনি তো দমে থাকতে পারে না। প্রিয় জিনিশের জন্য অপমান ও উপেক্ষা সহ্য করতেই হবে। তাই অব্যর্থ মনোরথ প্রকাশ করেন। তার প্রত্যয়দৃপ্ত ঘোষণা এভাবে প্রকাশিত হলো সবশেষে :

এতসব প্রতিকূলতার পরেও শুদ্ধস্বর বেরুবে। সময় ও সুযোগ হলেই আমাদের দেহমনের ঘামে ভেজা একেকটি সংখ্যা। […] উলটো বাতাস ঠেলে স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে যাবার শপথই শুদ্ধ স্বর সম্মিলনের এই প্রচেষ্টায় আমাদের মূল ধারণাআমরা মানুষ, মানুষের জীবন এবং সমাজকে পরতের পর পরত উল্টিয়ে দেখবো, তুলে আনবো অনুভব ও উপলব্ধির শানকিতে। শুদ্ধস্বরের সেতারে এই অনুভব বাজবে, জ্বলবে চেতনার মোম হয়ে এবং ধ্রুপদী নাচের মতো স্বরে গাথা আমাদের চলতেই থাকবে।

তৃতীয় সংখ্যাটি বেরোয় ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে। এসংখ্যার প্রায় সকল লেখকই ছিলেন স্থানীয়। ছোটোকাগজ যে তেলা মাথায় তেল দেয় না, সত্যিকার লেখকসৃষ্টি যে এর মূল উদ্দেশ্য; সংখ্যাটিতেই সম্পাদক তা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। সমান উদ্দেশ্য সামনে রেখে পরের বছর মার্চেই শুদ্ধস্বরের চতুর্থ সংখ্যা বের হয়।

পিছন ফিরে যখন তাকাই তখন দেখি আমাদের সাহিত্যচর্চার সঙ্গে আমাদের সমকালের ইতিহাস আষ্টেপেৃষ্ঠে বাঁধা। আন্দোলন-গণসংগ্রামের মাধ্যমেই সামরিক সরকারকে হটানো হয়েছিল। দেশে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা ছিল মানুষের অভিপ্রায়। কিন্তু বিএনপি সেই পথে না গিয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চাইল। সামরিক শাসনের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যেমন হয়েছিল আমাদের দেশেও তার ব্যতিক্রম হলো না। একটা স্বার্থপর মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হলো সত্তরের শেষ ও আশির দশকে। ক্ষমতা ও মুনাফা ছাড়া এদের কাছে সবই ছিল অর্থহীন। ফলে সাম্প্রদায়িকতা-অনাচার এগুলো থামানো গেল না। বরং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথাচড়া দিয়ে উঠতে চাইল, প্রগতিশীল শক্তি হয়ে উঠল অসহায়। আমার মনে আছে, একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের আওতায় আনার জন্য জাহানারা ইমামের অদম্য নেতৃত্বে যে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়েছিল ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। কমিটি মার্চমাসে গণআদালতের মাধ্যমে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে রায় ঘোষণা করে। এতে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শিবির বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এরা দুর্গও গড়ে তোলে। এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধমঞ্চের কর্মকাণ্ডকে প্যারোডি করে তারা গান গাইতো। প্রকাশ্য সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠান করত। জাহানারা ইমামকে ‘জানোয়ারা’ ও ‘নাস্তিক’ হিসেবে প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করে সরকারের মদদে। স্বাভাবিকভাবে সচেতন তরুণদের দল হিসেবে সৃষ্টিশীল তরুণরাও বিক্ষুব্ধ ও হতাশ ছিল। বাংলাদেশে এই প্রথম জামাতশিবিরের প্রকাশ্যকরণ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক নানা অবক্ষয়ে মুষড়েপড়া প্রজন্ম হিসেবে আমরা নিজেদের বেপথু ভাবি। চতুর্থসংখ্যার সম্পাদকীয়তে আহমেদুর রশীদ তা এভাবে প্রকাশ্য করেন :

গন্তব্যবিহীন স্বদেশের বুকে দাঁড়িয়ে আছি আমরা অর্থাৎ, তরুণ প্রজন্ম। আমাদের চোখের স্বপ্ন ক্রমাগত ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সামনে এখন আর সম্ভাবনার আলো নেই। এখানে এখন নূরজাহানরা মধ্যযুগীয় বর্বরতার নির্মম শিকার, ভালোবাসার অপরাধে নির্বাচিত সাংসদের নির্দেশে হয় বিপ্লবদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন, সত্যপ্রকাশ ও আপোষহীনতার নীতির কারণে সংবাদপত্রের উপর চলে অস্ত্রবাজদের কমান্ডো অপারেশন। আমাদের চলার পথে কেবলই আঁধার। প্রকাশ্য দিবালোকে যেখানে শহীদ মিনারের লাল সূর্য ছিড়ে ফেলার সাহস দুর্বৃত্তরা অর্জন করেছে সেখানে আঁধার ছাড়া কীইবা আর থাকতে পারে।

মনে রাখতে হবে আমরা কেউই রাজনীতির মঞ্চে ছিলাম না। কিন্তু রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আমাদের লড়াই করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। এই লড়াই ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। কিন্তু যে-সুবিধাবাদী ‘হাইব্রিড’ প্রগতিশীল গোষ্ঠী ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল, যারা ভেতরে সাম্প্রদায়িক বাইরে প্রগতিশীল ও সুবধিাবাদী, তারা  ঠিকই সম্পাদক বা গোষ্ঠীর অন্য কাউকেও প্রতিক্রিয়াশীল অভিধা দিতেও পিছপা হয়নি। বিশ বছর পরে যখন যুদ্ধাপরাধীর বিচারকে কেন্দ্র করে ব্লগার, প্রগতিশীল, লেখক, প্রকাশকের ওপর মৌলবাদীরা আক্রমণ করে তখন কিন্তু ওইসব প্রগতিশীলরা বহাল তাবয়তেই ছিলেন এবং আজও আছেন। সম্পাদক তার ক্ষোভ ঢেলেছিলেন এভাবে,

আর আমাদের সমসাময়িকদের বলে রাখতে চাই, যারা উঠতে বসতে নিজেদেরকে স্বাধীনতা ও প্রগতির পক্ষশক্তি বলে জাহির করেন, কিন্তু (তাঁদের ভাষাতেও) মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির দোসর কবির পৌরহিত্যে অমুক তমুক হওয়ার ও কবিতাপাঠের লোভ সামলাতে পারেন না, তাদেরকে চিনে রাখুন। তারা যেন তারুণ্যকেও অবহেলা করেন, যারা তারুণ্যের শক্তি, সাহস ও মেধার কবরের উপর নিজেদেরকে বিখ্যাত হিসেবে দাঁড় করাতে চান।

আমার মনে হয়, এর চেয়ে স্পষ্ট ঘোষণা আর কী হতে পারে? তখন তো দেশে একটা নতুন যুদ্ধই চলছিল, যদিও সে যুদ্ধ তিরিশ বছর পর আরও দানা বেঁধে উঠেছে। এখন কে কার বিরুদ্ধে লড়ছে তাও ঠাহর পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের যুদ্ধ তো আর ছায়ার সঙ্গে ছিল না। সৌখিন কবি-লেখকও হওয়ার উদ্দেশ্যেও ছিল না। মূলত কলমটা আর চিন্তাটা ছিল অস্ত্রবিশেষ, লিটল ম্যাগাজিন ছিল একটা উপায়। আমাদের প্রত্যয় ছিল সামরিক শাসন পেরিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশে একটা সারস্বত সমাজ প্রতিষ্ঠা। না-হলে আহমেদুর রশীদ সম্পাদকীয়তে কেন লিখবেন :

আগুনঝরা একাত্তরে প্রিয় স্বদেশে যখন হায়েনার বিষনখথাবা মেলেছিল, আমাদের তখনো এই পৃথিবীল আলোবাতাসের সাথে পরিচয় হয়নি। আমরা তাই আমাদের শক্তি ও সাহস অর্ঘ্য দিতো পারিনি জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জনের মহান যুদ্ধে। আমাদেরকে স্বাধীন দেশে মুক্ত মাটিতে জন্ম নেয়ার, নিশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিয়েছেন যারা প্রাণ দিয়ে রক্ত ঢেলে-তাদের প্রতি আমাদের অন্তর নিঙড়ানো গভীর শ্রদ্ধা। আমাদের প্রত্যাশা, তাদের সাহস, শৌর্য ও আত্মবিসর্জনের গৌরবময় চেতনাকে ধারণ করে সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সভ্যতায় আমরা এগিয়ে যাবো।

কিন্তু কীভাবে সম্ভব এই বিরুদ্ধ পরিবেশে? আশাহীন তো আর হওয়া যায় না। বিরুদ্ধ বাতাস ঠেলেই সামনে এগোতে হবে। সবচেয়ে বড়ো ‘মটো’ প্রকাশিত হয় একটি বাক্যে “আমরা চাই সব ধরনের সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে সর্বতোভাবে ‘বুদ্ধির মুক্তি।” বামন সমাজ ও বামন রাষ্ট্রে, যেখানে মুক্তির কোনও সন্ধানই নেই :

সবদিকে দুয়ার বন্ধ। আমাদের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধই আমাদের করাঘাত। দুয়ার খুলুক কিংবা নাই খুলুক আঘাত আমাদের চলবেই।-অনাগত নতুনত্বকে ধারন করে শিল্প ও সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কে আপোশ না করে। কেননা, আমরা বেঁচে মরে থাকতে চাই না।

চতুর্থসংখ্যা শুদ্ধস্বরে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন আশির দশকের কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। মিনহাজের ‘কবিতা : অবলোকনে জীবনের ভিতর-বাহির’ আরও ঋদ্ধ হয়ে উঠল। লীলেন ও আমি  লিখলাম নিরীক্ষামূলক গল্প যথাক্রমে ‘নখর’ ও ‘প্রাগৈতিহাসিক কাছিম’। বিজ্ঞানের ওপর নাসিমুল হকের প্রবন্ধটি ছিল উল্লেখ করার মতো। অন্যান্য শাখা তো ছিলই।

শুধু সংখ্যা বেরুনো বা লেখালেখিতেই কি মগ্ন ছিলাম আমরা? না, এরই মধ্যে আমাদের মধ্যে বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। ঢাকা ও কলকাতাসহ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার লিটলম্যাগ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছি, পাঠেও এসে গেছে বিচিত্রতা। আমরা অনেকেই বুঝতে শিখেছি কী পড়া উচিত, আর কী নয়? লিখতে হবে কী? আর কোথায় ছাপাতে হবে? ততদিনে ছোটোকাগজের একটি বলয় তৈরি হয়ে গেছে সারাদেশে। সেটা রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে। রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রাম, বগুড়া, বরিশাল, রাজশাহী, ময়মনসিংহ এবং সিলেট এক-একটা কেন্দ্র। আশির দশকে সামরিক শাসনে সমাজ ও রাষ্ট্র যেখানে নেতিয়ে পড়েছিল এবং পত্রিকাগুলো ছিল সামরিকজান্তার আত্মপ্রচারে মগ্ন তারই পরিপ্রেক্ষিতে ছোটাকোগজ শুধু সাহিত্য নয়, চিন্তাচর্চারও হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। আর নব্বইয়ে এসে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ফুসরতে নতুন স্বপ্ন নবোদ্যমে উপর্যুক্ত কেন্দ্র ছাড়াও দেশের অন্যান্য জেলাশহরে এমনকি থানাসদরকে কেন্দ্র করেও বলয়টার বিস্তার পেয়েছিল। মনে পড়ে একদিকে পূর্ববর্তী খোন্দকার আশরাফ হোসেনের একবিংশ,মঈন চৌধুরীর প্রান্ত, তপন বড়ুয়ার গাণ্ডীব, আনওয়ার হোসেনের কিছুধ্বনিরূপম,  ফারুক সিদ্দিকীর বিপ্রতীপ , পারভেজ হোসেনের নির্বেদ তো ছিলই, অপরদিকে বগুড়ার কামরুল হুদা পথিকের দ্রষ্টব্য, চট্টগ্রামের এজাজ ইউসুফীর লিরিক, জাফর আহমদ রাশেদের আড্ডারু, সাজিদুল হকের সুদর্শনচক্র,  হাফিজ রশিদ খানের পুষ্পকরথ, ময়মনসিংহ থেকে সরকার আজিজের অনুশীলন, ইফফাত আরার দ্বিতীয় চিন্তা, রাজশাহী থেকে হাসান আজিজুল হকের প্রাকৃত, মিমুল মাহমুদের কারুজ, বরিশাল থেকে হেনরী স্বপনের জীবননান্দ, দিনাজপুর থেকে ইতি ইব্রাহীমের শব্দশিল্প, যশোর থেকে শিমুল আজাদের বিবর, ঠাকুর গা থেকে রাজা শহীদুল আসলামের চালচিত্র, রংপুর থেকে ছাপাখানা, সিলেট থেকে শুভেন্দু ইমামের শিকড় প্রভৃতি ছোটোকাগজ নিজ নিজ লেখকগোষ্ঠী নিয়ে তৎপর ছিল। এসব ছোটোকাগজের উদ্দীপনা ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা এবং সাহসী ও  নিরীক্ষাপ্রবণ সাহিত্যের যোগান। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ এবং সাম্প্রতিকতম সাহিত্য-সাহিত্যতত্ত্বের সঙ্গে অন্বয়। সত্যিকথা বলতে উত্তরকালের শক্তিমান লেখকের ভিত তৈরি এবং প্রস্তুতিপর্বের বড়ো একটা পরিসর নির্মাণও এসব ছোটোকাগজের অভিলক্ষ্য ছিল। শুদ্ধস্বর ছিল এই বলয়ের গুরুত্বপূর্ণ রথী এবং এর ভূমিকা ছিল আরও সুদূরপ্রসারী। আর তা এই কারণে যে, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলা, আসাম ও ত্রিপুরার বাংলার লিটলম্যাগ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে শুদ্ধস্বরের আত্মপ্রকাশকে কেন্দ্র সিলেটে যে লেখকগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছিল, দেখা গেল তাদেরই ছত্রছায়ায় ও অংশগ্রহণে একই সময়ে ও পরে সিলেটে আরও কয়েকটি ছোটোকাগজের অভ্যুদয় ঘটে। কালের পরিক্রমা ও গুরুত্ববিচারে সেগুলোকেও কোনওভাবে গৌণ বলা যাবে না। শুদ্ধস্বরের অনুরণনে নব্বইয়ের দশকে আরও যে ছোটোকাগজের জন্ম হলো তার মধ্যে শামীম শাহানের গ্রন্থী, মোস্তাক আহমাদ দীনের বিকাশ, টি এম আহমদ কায়সারের প্যারাডাইম, শাহ শামীম আহমদের হৃদি, হাবিবুর রহমান এনারের খোয়াব, ফজলুর রাহমান বাবুলের ঋতি, মুস্তাফিজ শফির চোখ, আব্দুল মুমিন মানুনের স্বকাল, হেলাল আহমদ চৌধুরীর ফিনিক, হেলাল উদ্দিন সবুজের নদীপাখিমেঘ, শুভেন্দু ইমামের পাঠকৃতি, মাশুক ইবনে আনিসের কাকতাড়ুয়া, পুলিন রায়ের ভাস্কর, লিয়াকত শাহ ফরিদির নির্ব্যাজ, শ্যামসুন্দর রাধাশ্যামের ভিন্নায়ন, নাজমুল আলবাবের শস্যপর্ব, তাপু শিকদারের কীর্তনিয়া, আহমদ সায়েমের সুনৃত প্রভৃতি। এসব কাগজকে কেন্দ্র করে যেমন গোটা সময় অলোড়িত-আন্দোলিত হচ্ছিল, সমানভাবে তরুণতুর্কিরা নিজেদেরে সৃষ্টির মদমত্ততা দেখিয়ে যাচ্ছিলেন। সুতরাং শুদ্ধস্বরের আত্মপ্রকাশ নানাদিক থেকেই ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

এদিকে আবারও লেখক-বন্ধুরা শুদ্ধস্বর পঞ্চম সংখ্যার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সম্পাদক আহমেদুর রশীদও নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন নিজের কর্মকাণ্ডে, যদিও ততদিনে তিনি ঢাকাবাসী হয়েছেন। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন নাটকীয় সিদ্ধান্ত শোনা গেল,  শুদ্ধস্বর আর বেরুবে না। অন্তত আমাকে চিঠিতে লিখলেন  সম্পাদক। একপাতার চিঠি, তার হস্তাক্ষর বরাবর আমাকে চকিত করে। টেনে টেনে লেখা, গোল গোল। চিঠিজুড়ে হতাশা, জীবনের জটিলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সর্বোপরি ব্যক্তিক অপরাগতা। আমি তো আকাশ পড়ি। আমারও ডাক এসেছে চলে যেতে হবে চট্টগ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো। কিন্তু শুদ্ধস্বর আর বেরুবে না এটা ছিল ফাঁসির শামিল। শুদ্ধস্বর  না বেরুলে আমরা করবটা কী? শুদ্ধস্বরের মাধ্যমেই আমরা সংগঠিত হয়েছিল, স্ফুরণ ঘটেছে সাহিত্যিক চিন্তার। আমরা সম্পৃক্ত হয়েছি দুইবাংলার লিটলম্যাগকর্মীদের সাহিত্যিক প্রয়াসের সঙ্গে তার মাধ্যমেই, যদিও অন্যান্য পত্রিকায়ও আমরা সমানে লিখে যাচ্ছি, বন্ধুদের চিঠি লিখছি, যোগাযোগ ঘটছে প্রতিনিয়ত সবার সঙ্গেই। কিন্তু শুদ্ধস্বর তো আমাদের স্বর, আমাদের প্রেম, আমাদের নিজেদের পয়ের তলার মাটি। আমরা হতাশ হলাম।

তাহলেও কিন্তু শেষ সংখ্যাটি হতে হবে ব্যতিক্রম। বিশেষ সংখ্যা এবং ক্রোড়পত্র হবে কিশওয়ারকে নিয়ে। আশির এই কবি অত্যন্ত শক্তিমান। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত, ঢাকা থেকে সিলেটে ফিরেছেন। রাতদিন কবিতাই লিখে চলেছেন। কবিতার বই বেরিয়েছে একটিমাত্র, সংঘর্ষ, আলো-অন্ধকার। কিন্তু কে লিখবে এই কবিকে নিয়ে? আমরাই লিখব, মূল্যায়ন করব। সাক্ষাৎকার নেব। টেনে বের করে আনব ভেতরের কিশওয়ারকে।

সংখ্যাটি বেরুল ডিসেম্বরে। ক্রমাগত কয়েকদিনের বৈঠকে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হলো। আহমদ মিনহাজ, মাহবুব লীলেনের সঙ্গে আমিও ছিল প্রশ্নকারী হিসেবে। বিশাল এই সাক্ষাৎকারে কিশওয়ার প্রাণখুলে কথা বলেছিলেন। এমন বৃহৎ সাক্ষাৎকার জীবদ্দশায় তিনি আর দেননি। বলেছিলেন শ্লেষে, কবি মাত্রই আত্মপ্রতারক। কিশওয়ারের ওপর মূল্যায়নধর্মী লেখা লিখেছিলাম, আমরা তিনজনই যথাক্রমে ‘আত্মপ্রতারণা কবির নয়, অকবির’, ‘কিশওয়ার এবং কিশওয়ার’ ও ‘কিশওয়ারের কবিতা : মগ্নচৈতন্যের ডালপালা’। কিশওয়ারের নির্বাচিত রচনাও ক্রোড়পত্রে সংকলিত হয়। শুদ্ধস্বরের নিয়মিত শাখায় অসাধারণসব লেখা ছাপা হয়েছিল, যা এখনও মনে আছে। সিলেটের তরুণদের বাইরে সংখ্যাটিতে একমাত্র লিখেছিলেন সৈকত হাবিব। আমার ‘হলুদ আদম’ গল্পটি ওই সংখ্যায়ই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। মাহবুব লীলেন লিখেছিলেন গীতিগল্প ‘গ্লাডিয়েটর’ এবং কবিতা লিখেছিলেন সারওয়ার চৌধুরী, মোস্তাক আহমাদ দীন, শামীম শাহান, শাহ শামীম আহমেদ, আহমেদুর রশীদ। আমারও একগুচ্ছ কবিতা সংখ্যাটিতে ছাপা হয়। প্রচ্ছদটি একে দিয়েছিলেন অমিতাভ মহালদার।  সম্পাদকের অনুরোধে কিনা জানি না, সাদাকালো প্রচ্ছদটিতে ছিল একটা হাহাকার। একটি পত্রহীন বৃক্ষ, মাথার ওপরে মেঘ ভাসছে; মেঘ ও বৃক্ষের মধ্যে একটা দূরত্ব বিরাজ করছে। তবে মেঘ কালো, পুঞ্জিভূত। প্রচ্ছদের হাহাকার থাকলেও একটা ইশারা বিরাজ করছিল।

আহমেদুর রশীদ শুদ্ধস্বর বন্ধ করে দিলেন। সাহিত্য ইস্তেফা দিলেন। এটা কেমন করে মেনে নিলাম আমরা? আমরা আহমেদুর রশীদকে জানতাম। তিনি স্বাপ্নিক মানুষ। কিন্তু জীবন তো জটিল। জীবনের জটিলতার কাছে কি স্বপ্ন হারিয়ে যায়? এছাড়া শিল্পের বোধ নিয়েই তিনি। আপাতত শেষ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে অভিমানটা মেলে ধরলেন :

শুদ্ধস্বরের পাঁচটি সংখ্যার জন্য কমপক্ষে পঞ্চাশটি রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে। কমপক্ষে পঞ্চাশটি দরোজা থেকে ফিরে এসেছি স্রেফ অপমানটুকু হাতে নিয়ে। তারপরেও ভাবিনি এভাবে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করতে হবে। কিন্তু জাগতিক বাস্তবতার প্রবল গ্রাস থেকে মুক্ত থাকতে পারিনি শেষপর্যন্ত। এবং এই ব্যস্ততার বোঝা মাথায় নিয়ে শিল্পসম্মত সাহিত্যচর্চা সম্ভব নয়। এই চেতনাই শুদ্ধস্বরকে স্বেচ্ছামৃত্যুবরণে উদ্বুদ্ধ করেছে।

এই স্বেচ্ছামৃত্যু ঘোষণা শিল্পের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা ও প্রেম থেকেই। যে জীবনে তিনি প্রবেশ করছেন, তিনি ভাবলেন চাইলেও তিনিশিল্পজীবন যাপন করতে পারবেন না। অর্থাৎ, আত্মপ্রতারক হতে চাননি তিনি  :

এরপরে বের হবে না শুদ্ধস্বর। ব্যক্তি আমার জটিল ব্যস্ততা, সময়ের সঙ্গে আপোস, চর্চার স্থবিরতা-এসব কারণে শিল্প ও সাহিত্যের সাথে প্রতারণা করার সুযোগ হাতে না আসার আগেই স্বেচ্ছঅমৃত্যুর এই করুণ ঘোষণা দিতে হলো। শিল্পের বিকল্প মৃত্যু আর কি হতে পারে?

একদিকে মৃত্যুঘোষণা, আরেকদিকে গ্লানি ও অনুতাপ তাকে যে তাড়া করছিল তাও অনুচ্চার থাকেনি। সম্পাদকীয়তে :

যাত্রারম্ভের অনিয়মিত পরিচয় মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বাতাস ঠেলে এগিয়ে যাবার প্রতিজ্ঞা পালন করতে পারলাম না। ধ্রুপদী নাচের মতো স্বরে স্বররগাথা বন্ধ হয়ে গেল, বন্ধ দুয়ারে প্রবন্ধ-কবিতা-গল্প তথা আমাদের সৃষ্টির আঘাত থামিয়ে দিলাম। এসব কিছুর জন্যই আমি দায়ী, শুধু আমি। একজন স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে হত্যা করে কেন, কখন, কীভাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর তার পরেও জানা হয়নি আমার।

সত্যি আবেগঘন এক সম্পাদকীয়। সপ্রাণ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয় না কতটা প্রেম থাকলে এসব কথা লেখা যায়। অনুভব করা যায়। মনে হয় কোনও প্রেমিক লিখছে প্রেমিকাকে একটি প্রেমের চিঠি, আত্মহত্যার আগেই। প্রেম পেয়েও গ্রহণের অযোগ্যতায় প্রেমিকাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে আর সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করছে। আবার সে প্রেম যে মিথ্যে ছিল না, তাও তো প্রেমিক জানাতে ভুল করে না! :

নতুন ও সম্ভাবনাময়দের নিয়ে শুরু হয়েছিল শুদ্ধস্বর, শেষ হলো এদের নিয়েই। এদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ থেকে যাবে কালের পৃষ্ঠায়। যারা থাকবে না, তাদের যৌগিক ও গৌণ অবদানটুকুও অস্বীকার করা যাবে না কোনওমতেই।

প্রেমিকের উপলব্ধি ও অনুমান মিথ্যে হয় না। হয়তো এই উপলব্ধিও মিথ্যে হবেও না; কারণ শুদ্ধস্বরের লেখকরা এখনও কলম থামাননি। এখানেও সম্পাদকের দায়বদ্ধতা এবং শুদ্ধস্বর প্রকাশের উদ্দেশ্য একধরনের ভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যমে মন্দ্রিত হয়।

কিন্তু আমার কথা অন্যখানে যে, প্রেম তো হারিয়ে যায় না। শিল্পেরও মৃত্যু হয় না। এমনকি হয় না বিকল্প মৃত্যুও। তাই দেখি নগরের জটিল অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আহমেদুর রশীদ শুদ্ধস্বর নিয়ে হাজির হন আবারও, নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে, অনেক বছর পরে। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে শুদ্ধস্বর নবরূপে আত্মপ্রকাশ করে প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে। তাতেও বিলীন হয়ে যায় না ছোটোকাগজ শুদ্ধস্বর। আবারও আত্মপ্রকাশ করে, অন্যরূপে অন্যভাবে। সে গল্প পরে হবে। এখন এইটুকু বলা যে, নব্বইয়ের শুরুতে যে প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা ও শিল্পের প্রতি দায়বোধ নিয়ে শুদ্ধস্বর আত্মপ্রকাশ করেছিল; তা থেকে সরে আসেনি সুতোপরিমাণও। আর ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের সূচনালগ্ন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে যখন প্রগতিশীল লেখক-প্রকাশক-চিন্তকরা মৌলবাদীদের দ্বারা হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে আসছিলেন, তারই ধারাবহিকতায় মানবিক ও শিল্পের দায়বোধ থেকে প্রকাশনাসূত্রে আক্রান্ত হলো শুদ্ধস্বর প্রকাশনার প্রাণপুরুষ, আহমেদুর রশীদ। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ অক্টোবর তারিখে সমান আক্রমণের শিকার হলো প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতিও। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন জাগৃতির দীপন, মৃত্যুমুখ থেকে বেঁচে গেলেন কোনওক্রমে আহমেদুর রশীদ টুটুল। আর মৃত্যুর নিরন্তর তাড়া খেয়ে সপরিবার দেশান্তরীও হলেন সেবছরই। সে রক্তাক্ত-বেদনার্ত ইতিহাস পরে বলা যাবে।

তিরিশ বছর কম সময় নয়, তিরিশ বছর আগে একটি ছোটোকাগজ আত্মপ্রকাশ করেছিল মফস্বল শহর থেকে। তখন জীবন ছিল গণ্ডীবদ্ধ, কিন্তু স্বপ্নছিল বুকভরা। সাধ ছিল অনেক, সাধ্য ছিল না অতটুকু। আজ তিরিশ বছর পরে, সেই ছোটোকাগজ শুদ্ধস্বরের কাণ্ডারির যেমন বয়েস বেড়ে পৌঢ়াবস্থা, সহযোদ্ধারাও তেমনই। কিন্তু বয়েসই-কী সবকিছু? তারুণ্য কি বয়েসের সমানুপাতিক? অন্তত আমার তো তা মনে হয় না। কারণ তারুণ্যের স্পর্ধাও যৌবনের শক্তি নিয়ে শুদ্ধস্বর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন আঙ্গিকে ও নতুন বিন্যাসে যাত্রা অব্যাহত রাখছে এখনও।  ‘তারুণ্যের অহংকারকে সম্বল করে, বার্ধক্য ও সময়কে চ্যালেঞ্জ করে’ স্বৈরাচারমুক্ত ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর যে পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করেছিল তিরিশ বছর আগে, সে তারুণ্য ও স্বপ্ন আজও একবিন্দু ক্ষীয়মাণ হতে দেখি না। হয়নি যে, তার প্রমাণ পাই প্রায় তিরিশবছর পর সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত আহমেদুর রশীদের একটি লেখায়। তাতে যে আক্ষেপ ও অতৃপ্তি ফুটে ওঠে তা থেকেও তিরিশবছর আগেকার দায়বদ্ধতাকে ছিন্ন করা যায় না; বরং তা উজ্জ্বলভাবেই চিহ্নিত করা যায়। তিনি লিখেছেন,

কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে সাতচল্লিশ উত্তর পূর্ববঙে সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রীক যে অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ, উদার, ন্যয্যতা, অর্থনৈতিক এবং লৈঙ্গিক সমতা ভিত্তিক যে রাজনৈতিক চেতনার উত্থান এবং অগ্রসর চিন্তার বিস্তার লক্ষ্য করা গিয়েছিলো; একাত্তরের স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাপক চর্চা এবং উদ্যেগ পরীলক্ষিত হলেও, হতাশ হওয়ার মতো সত্য যে, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এর কোনো বৃহত্তর প্রভাব চোখে পড়েনি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন, সাহিত্য চর্চা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম; এসবের মাধ্যমে কিছু স্বতন্ত্র বৈক্তিক স্বর লক্ষ্য করা গেলেও গণতন্ত্র-বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের উপর আঘাত এবং ধমী‍র্য় উন্মত্ততা বা রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক গোষ্টির যৌথ সাম্প্রদায়িক/ সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিছু একক লেখৈালেখি ছাড়া সামগ্রিকভাবে, লক্ষ্যনীয়ভাবে তেমন কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়েনি। …সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠে লিটল ম্যাগাজিনের বা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সক্ষমতার জায়গাগুলো কোথায়?

এখানে তিনি আরও পরিণত, আরও তীক্ষ্নধী। ছোটোকাগজের পরিসর যে কত বিস্তৃত হতে পারে তারও ইঙ্গিত বক্তব্যে রয়েছে। তাই নতুন কলেবরের বিস্তৃত পরিসরের শুদ্ধস্বরেও অহংকার তো আছেই; আছে সকলপ্রকার বার্ধক্য ও মূঢ় সময়ের প্রতি চ্যালেঞ্জও। সেদিক থেকে মানবমুক্তির সাহিত্য-শিল্প-দর্শনের মুখপত্র হিসেবে শুদ্ধস্বর আজ বিশ্বমুখী। স্বপ্নের মৃত্যু নেই; মানুষ অমৃতাকাঙ্ক্ষী। এটা তারও প্রমাণ।

 

 

Zafir Setu is a poet, writer, and associate professor of the department Bangla at SUST, Sylhet.

 

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!