সাক্ষাৎকার
শুদ্ধস্বর: আপনি কবিতার মাধ্যমে কী আবিষ্কার করার এবং বোঝানোর চেষ্টা করে থাকেন?
লাকী আক্তার: আমার অনুভব এবং আমার দর্শন কবিতার মধ্যে ফুটে উঠে। তা প্রকাশ করার চেষ্টা থাকে।
শুদ্ধস্বর: আপনি বর্তমান বিশ্বকে কিভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং বর্তমান ঘটনাগুলো আপনাকে লেখার ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে?
লাকী আক্তার: একজন কমিউনিস্ট যেভাবে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করে, পাল্টাতে চায়। আমি সেরকমই একজন কমিউনিস্ট। সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমি লিখতে, বলতে এবং গাইতে ভালোবাসি।লেখার মধ্য দিয়েও আমি মানুষের সংগ্রামের সারথি হতে চাই।
শুদ্ধস্বর: কোন সাহিত্য-ফিকশন বা নন ফিকশন-বা কোন লেখক/লেখকরা আপনার নিজের লেখাকে প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেছেন? কারা এবং কীভাবে?
লাকী আক্তার: বহু লেখক। জীবনের একেক সময়ে একেক ধরণের সাহিত্য ভালো লেগেছে। একটা সময় ফিকশন ভালো লাগলেও , এখন নন ফিকশনের দিকে ঝোঁক।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার কবিতাকে আকার দেয়?
লাকী আক্তার: সবসময় হয় না। যদি অনুভব করি তবেই লিখতে পারি।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার বক্তব্য উচ্চারণ করতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
লাকী আক্তার: আমি আসলে এভাবে ভাবিই না। নিজের মতন করে লিখতে থাকি। হয়ত তা কোন না কোন ফর্মে পড়ে। তবে কবিতার ক্ষেত্রে গদ্য কবিতা ভালো লাগে।
শুদ্ধস্বর: রাজনৈতিক কবিতা এবং সাধারণ কবিতার মধ্যে সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব এবং সংহতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
লাকী আক্তার: দুটোই শৈল্পিক হতে পারে, আবার নাও হতে পারে । কবিতার সাথে তো আর কবিতার সংঘাত হয় না। হয় একেকজন মানুষের চিন্তা এবং দর্শনের সাথে আরেকজন মানুষের চিন্তা ও দর্শনের পার্থক্য। সেই দর্শনের কারণেই দ্বন্দ্ব, নৈকট্য কিংবা সংহতি গড়ে ওঠে।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতা কি জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে বলে আপনার ধারণা? এটি অন্যান্য জাতীয়তা বা ভাষা গোষ্ঠীর কাছে আবেদন রাখতে পারে বলে কি আপনার মনে হয়? তাহলে কীভাবে?
লাকী আক্তার: হ্যাঁ করে। হ্যাঁ রাখে। কারণ আমি মনে করি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান। আর পৃথিবীর সকল প্রান্তেই বৈষম্য আছে, লড়াইও আছে।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন কবিতার সংক্রাম দিয়ে মানুষের ইতিহাস পাল্টানো সম্ভব? আপনার জবাবের পক্ষে বলুন।
লাকী আক্তার: সেটা সম্ভব নয়। ইতিহাস বদলাতে হলে নিরন্তর সংগ্রাম প্রয়োজন হয়। আর কবিতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে মানুষকে সাহস বা শক্তি যোগাতে পারে। সংগ্রাম শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে একটি উপকরণ মাত্র।
____________________________________
কবিতা
আমিই ফিলিস্তিন
স্বাধীনতার দাবি নিয়ে,
রক্তাক্ত, বিধ্বস্ত হতে হতে
বারবার উঠে দাঁড়ানো,
আমিই সেই ফিলিস্তিন।
রামাল্লার পথে পথে
গাজা উপতক্যায় কিংবা
ভূমধ্যসাগরের পাড়ে
দাবকের তালে তালে,
জানান দেয় যে সংগ্রামের কথা,
আমিই সেই ফিলিস্তিন।
অগুণিত শবের ভারে,
কিংবা লক্ষ লক্ষ বন্দীর
আর্তনাদে যারা এই পৃথিবীকে ক্লান্ত করে দেয়।
আমিই সেই ফিলিস্তিন।
আমাদের ঘর, আমাদের জমিন
ঝাঝরা হয়ে গেলেও,
আমরা বলে যাই,
আমিই ফিলিস্তিন।
এই ভূমি আমার,
এই ভূমি আমার পূর্বপুরুষের।
আমি শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ,
কিংবা নওজোয়ান যেই হই না কেন,
তোমাদের সাথে আমাদের অসম লড়াই চলে।
তোমাদের হাতে থাকে
জেডিএএম, জিবিইউ-৩১
সহ আরও কত বিষ্ফোরক !
আর মুকলেয়া হাতে উদ্ধত আমরা,
রক্তের লহরে ভেসে যেতে যেতে
বারবার বলে উঠি,
দেখো আমিই ফিলিস্তিন।
এই ভূমি আমার।
এই ভূমি আমার স্বজনদের।
সীমাহীন স্পর্ধা দেখিয়ে,
প্রবল ক্রোধ, ক্ষোভ আর ঘৃণায়,
তোমাদের এফ-১৬ এর দিকে ,
আমরা মুকলেয়ার গুলতি ছুড়ে দেই।
আর তোমরা আমাদের মায়েদের বুক বরাবার,
মুহুর্মুহ নিক্ষেপ করতে থাকো,
ঝাঁক ঝাঁক প্যারেল বোমা।
তোমাদের ছুড়ে দেয়া রহস্যময় গ্যাসের ধোয়া ,
ছড়িয়ে যায় আমাদের ঘরে ,
আমাদের শহরে, আমাদের কবরে।
আগুণ লেগে যায় আমাদের বনে।
তোমাদের তাক করা রাইফেলের বুলেটে
ঝাঁঝরা হয়ে যায় আমাদের বাবার প্রশস্ত বুক!
তোমাদের শক্তিশালী বোমায়,
আমাদের ভাইয়ের ছোট ছোট পা দুটো
উড়ে যায়, আকাশের দিকে।
তারপর ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে
আমাদের উর্বর ভূমিতে।
শত ছিন্ন হয়ে
আমাদের স্বজনেরা
জন্মভূমির কোলে লুটিয়ে পড়তে থাকে।
স্বজনের শবদেহ বইতে বইতে
আর শেষ নিঃশ্বেস ফেলতে ফেলতে,
আমরা বলে যাই
আমরাই ফিলিস্তিন,
এই ভূমি আমার,
এই ভূমি আমার মায়ের।
আমাদের ছোট শিশুটি যখন,
তোমাদের সেনাবাহিনীর সামনে,
পতাকা হাতে নিয়ে আঙ্গুল তুলে শাসায়,
কিংবা ছোট্ট ছোট্ট নরম হাত দিয়ে
তোমাদের সেনাবাহিনীকে ধাক্কা দিয়ে
এই রাস্তা ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয়।
জেনে রেখো সে শিশুটিই ফিলিস্তিন,
এই ভূমি তাদের,
এই জমিন আমাদের অনাগত শিশুদের!
জলপাই গাছের নিচে,
যেখানে আমি জন্মেছিলাম,
আমাদের পুর্বপুরুষেরা শ্বাস নিতেন এখানেই।
জলপাই গাছের শিকড়ে শিকড়ে
আমরা আমাদের জন্মভূমিকে আঁকড়ে রাখি।
তোমরা আমাদের সেই প্রিয়
জলপাই গাছটিকেও বাঁচতে দাও নি,
বোমার আঘাতে জলপাই গাছগুলো,
আজ ছিন্ন ভিন্ন।
তবুও আমরা জলপাই গাছ
লাগাই পৃথিবীর এই প্রান্তে,
এই জলপাই গাছের নিচেই,
আমরা পুনঃজন্ম নেই।
আর সদ্য বেড়ে উঠা
জলপাই গাছটিও বলে উঠে
আমরাই ফিলিস্তিন!
এই জমিন আমার।
এই জমিনেই আমার শিকড়!
জেনে রেখো এই ভূমিতেই আমরা ফিরবো,
বারবার জন্মাবো আমরা এ মাটিতেই!
জেনে রেখো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে
এফোড় ওফোড় করে ধ্বনিত হবে একই আওয়াজ
আমিই ফিলিস্তিন,
এই জমিন আমার!
তোমার দোষেই তুমি ধর্ষিত!
তোমার দোষেই তুমি ধর্ষিত!
যা কিছু হয়েছে সব কিছু এড়ানো যেত,
যদি তুমি নিজের ব্যাপারে আরেকটু দায়িত্বশীল হতে!
তোমার দোষেই তুমি লাঞ্ছিত!
যা কিছু হয়েছে সব কিছু এড়ানো যেত,
যদি তুমি বোরকা কিংবা জিন্স না পরতে।
রিকশা-বাস-ট্রেন কিংবা ট্যাক্সিতে না চড়তে।
তুমি নিজেকে রক্ষা করতে পারতে,
যদি তুমি কৃশকায় কিংবা স্থূলকায় না হতে,
কালো, সংকর কিংবা সাদা না হতে।
তোমার কোনো ক্ষতি হত না,
যদি তুমি লম্বা কিংবা খাটো,
সুস্থ, প্রতিবন্ধী কিংবা পাগল না হতে।
যা কিছু হয়েছে সবকিছু এড়ানো যেত,
যদি তুমি শিশু-কিশোরী-যুবতী কিংবা বৃদ্ধা না হতে,
বিবাহিত, ডিভোর্সি কিংবা অবিবাহিত না হতে,
ধনীর দুলালী কিংবা গরীবের ছেমরি না হতে।
যদি তুমি নাস্তিক বা আস্তিক না হতে,
পাহাড়ি কিংবা সমতলের না হতে,
বাঙালি কিংবা আদিবাসী না হতে।
যা কিছু হয়েছে সব কিছু হয়ত এড়ানো যেত,
যদি তুমি বাড়ির ভেতর কিংবা বাহিরে থাকতে,
স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে না যেতে,
ডাক্তার-নার্স-পুলিশ-সরকারি আমলা কিংবা গৃহিণী না হতে।
কাজের সন্ধানে কর্পোরেট অফিস কিংবা কারখানায় না যেতে।
হয়ত সব কিছু এড়ানো যেত,
যদি তুমি আমেরিকান, কিংবা আফ্রিকান না হতে,
পৃথিবীর উত্তর কিংবা দক্ষিণ মেরুর না হতে।
যা কিছু হয়েছে সব কিছু এড়ানো যেত
সব কিছু এড়ানো যেত,
যদি তুমি বিংশ কিংবা একবিংশ শতকে না জন্মাতে,
যদি তুমি আইয়ামে জাহেলিয়াত ,
রাজতন্ত্র- স্বৈরতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রের কালে না জন্মাতে।
বিশ্বাস কর,
সব কিছু এড়ানো যেত,
সব কিছু এড়ানো যেত মেয়ে,
তুমি যদি নারী না হয়ে পুরুষ হয়ে জন্মাতে!
হাইপেশিয়া ফিরে এসেছিল
আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে
তার বক্তৃতার দিন
মোহর গুনে গুনে
শ্রোতার আসনগুলোয় হুমড়ি খেতো
তাবৎ জ্ঞানী গুণী!
আর তার আত্মা যেন নির্ঘাত প্লেটো!
তার জ্ঞানের ছটায়,
মন্ত্রমুগ্ধ ছাত্রদের মধ্য থেকে হঠাৎ কেউ বলে উঠতো
ঐ-তো দেখো, মিনার্ভা!
আবার কেউ কেউ বলে উঠতো,
রূপে সে যেন সাক্ষাৎ আফ্রোদিতি!
তার ধারালো যুক্তিতে পরাস্ত হয়ে
‘প্যাগান সাইন্টিস্ট’ বলে চেচিয়ে উঠত পুরোহিত!
যাদের চোখে সে ছিল
‘সাপের চেয়েও ধূর্ত’!
তার প্রতি নগরপাল অরিস্টিসের ভরসা,
যেন পুরোহিতের দগ্ধ ঘায়ে নুনের ছিটা!
এর শোধ নিতে উদগ্রীব তারা,
সময়ের অপেক্ষায় প্রহর গোনে।
তারপর একদিন এক বসন্তে,
সে সুযোগ ধরা দেয় তাদের হাতে,
তাকে হত্যা করা ছাড়া যেন বিকল্প নেই।
পিটার নামধারী এক ল্যাক্টর-
তাকে ধরে নিয়ে যায় কেসারিয়ামে,
ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আক্রোশে
তারা চেঁছে ফেলে তার চামড়া!
তাদের আক্রোশ দেখে মনে হয়,
যেন তার চামড়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে,
যুক্তির বাণ নির্গত হয়।!
তাতেও সাধ মেটেনা তাদের,
তাই সেদিন মহোল্লাসে তাকে হত্যা করে।
আর সেই নগ্ন মৃতদেহকে
খণ্ড বিখণ্ড করে,
যেন যুক্তি আর প্রগতিকেই টুকরো টুকরো করে তারা!
কিন্তু তাতেও স্বস্তি মেলেনা তাদের,
সে টুকরো টুকরো মৃতদেহও,
আতংকিত করে তাদের।
তারা ভীত হয়ে দেখে,
সে মৃতদেহের ভগ্নাংশ থেকেও,
যুক্তি আর জ্ঞানের আলো,
যেন জ্বল জ্বল করে উঠছে!
ভয় পেয়ে উদ্ভ্রান্ত তারা,
সিনারনের মাটিতে তার দেহাংশকে,
পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়।
আর তারা হাসতে হাসতে ভাবে,
সে গতরের সাথে সাথে,
তারা পুড়ে ছাই করতে পেরেছে,
দর্শন আর যুক্তির লহর!
অবিনাশী সে নারীর নাম ছিল হাইপেশিয়া!
যার মৃত্যুতে পৃথিবী দেখেছিল
এক নিকষ অন্ধকার সহস্রাব্দ!
কিন্তু সেদিন সিনারনের ছাইভস্ম
হতে ফিনিক্স পাখির মতো বহুকাল পর,
আবারো জন্মেছিল সে,
এই বাংলা তার নাম রেখেছিল খনা!