জীবন সুন্দর। ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’—রবীন্দ্রনাথের এই আকুতি শুধু তার একার নয় সকল মানবের। তাই বেঁচে থাকার অধিকার (Right to life) আইনি সুরক্ষা পেয়েছে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রে।
এই আইনের মোদ্দাকথা, মানুষ নিজেই নিজেকে হত্যার চেষ্টা (Attempt to Suicide) করতে পারবে না।অন্যকে হত্যা (Murder) করতে পারবেনা। এমনকি গর্ভস্থ ভ্রূণ পর্যন্ত হত্যা (Abortion) করা নিষেধ।
জীবনের বিপরীত মৃত্যু। জন্ম যেমন জীবনের আগমনী বার্তা জানান দেয়, মৃত্যু ঘোষণা করে পরিসমাপ্তির। মৃত্যু আসে আচমকা, আকস্মিক। তাছাড়া জীবনকে স্বাভাবিক মৃত্যু অবধি টেনে নিয়ে যাওয়ার আকুলতা সকলের থাকে না। তাঁদের সাধ জাগে স্বেচ্ছামৃত্যুর। তাঁরা ইচ্ছার ফুঁৎকরে জীবনকে নির্বাপিত করতে চায়। জীবনানন্দের ভাষায়—
ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ।
রাষ্ট্র নামক ধারণা বিকশিত হবার পর থেকে আইন অধিকার সংরক্ষণ করে। পৃথিবীর বেশিরভাগ রাষ্ট্রে, এমনকি সমাজ ও ধর্মে, স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার আইন সম্মত নয়। যেমন আমাদের সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদ১ জীবনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও স্বেচ্ছামৃত্যু কিংবা আত্মহত্যার অধিকারকে অনুমোদন করেনি। উপরন্তু দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩০৯ ধারা২ মোতাবেক আত্মহত্যার দণ্ডনীয় অপরাধ।
আত্মহত্যা (Suicide) ও স্বেচ্ছামৃত্যু (Euthanasia/Assisted Suicide) এক নয়। সাধারণত আত্মহত্যা সংগঠিত হয় ব্যক্তির ইচ্ছায় সকলের অগোচরে। অজ্ঞাতে, নিভৃতে। কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাকে কিছু প্রক্রিয়া মেনে বৈধ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে, চিকিৎসকের সহায়তায় কার্যকর করা হয়(Voluntary Euthanasia)। অতিবিরল ক্ষেত্রে ব্যক্তি মৃত্যু সম্পর্কে সম্মতি বা অসম্মতি প্রকাশে সমর্থ হলেও তার মতামতকে বিবেচনায় না নিয়ে তা কার্যকর করা হয় (Involuntary Euthanasia)। অত্যন্ত উদ্ভট অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অসহ্য যন্ত্রণা দুর করার জন্য মৃত্যু অপরিহার্য হয়ে ওঠলেই কেবল এটি প্রযোজ্য। বিশেষ ক্ষেত্রেব্যক্তি মতামত প্রদানের অক্ষম হলে পরিবারের অনুমোদনক্রমে তা বাস্তবায়িত হয় ( Non-voluntary Euthanasia)।
বয়স্ক, নিরাময় অযোগ্য রোগী ইত্যাদি ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে রোগী নিজে অথবা তার স্বজনের লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দিতে পারে। বর্তমানে লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, কানাডা ও কলম্বিয়ায় ইত্যাদি দেশে স্বেচ্ছামৃত্যু প্রচলিত আছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডো ও রোগন রাজ্যে স্বেচ্ছামৃত্যু আইনত বৈধ। অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াসহ আরেকটি রাজ্যে স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমোদিত।
তাছাড়া স্পেন, জার্মান, ভারত, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশে স্বেচ্ছামৃত্যু আইনি অধিকার পেতে যাচ্ছে—
স্পেনে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু সংক্রান্ত একটি বিল অনুমোদন করেছে। এটি উচ্চকক্ষ সিনেটে পাস হলেই আইনে পরিণত হবে।
কিছুদিন আগে জার্মানের উচ্চ আদালতে মৃত্যুপথযাত্রী রোগী যদি স্বেচ্ছায় জীবন অবসান ঘটাতে চায় তাহলে ডাক্তারী সহযোগিতা পাবে কি-না তা নিয়ে শুনানি হয়েছে।
অতিসম্প্রতি ভারতের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ রায় দিয়েছে : ‘সম্মানজনক মৃত্যু জীবনের অধিকার।’
নিউজিল্যান্ডে ‘এন্ড অফ লাইফ চয়েজ অ্যাক্ট’-এর পক্ষে গণভোটে গণরায় পড়েছে। ৬৫.২ শতাংশ জনগণ পক্ষেভোট দিয়েছে। আগামী বছরের নভেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেরকম হলেগুরুতর অসুস্থ এবং ছয় মাসের কম সময় মারা যেতে পারেন এমন ব্যক্তিরা চাইলে দুইজন ডাক্তারের অনুমতি সাপেক্ষে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিতে পারবেন।
স্বেচ্ছামৃত্যু দু’রকমের : প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে লাইফ সাপোর্ট উইড্র করে স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা হয়। আর, প্রত্যক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে রোগীকে মাত্রাতিরিক্ত ব্যথানাশক ঔষধ দেয়া হয়।এতে শ্বাসকষ্টের রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, পেইনকিলার একদিকে যেমন ব্যথা প্রশমনে কাজ করে অন্যদিকে হৃদযন্ত্র ক্রমশ দুর্বল করে দেয়। এতে সময়ের আগেই রোগীর মৃত্যু হয়।
এমনকি সুইজারল্যান্ডে ‘ডিগনিটাস’ নামের একটি সংস্থা স্বেচ্ছামৃত্যুতে সহায়তা করে। এদের স্লোগান ‘টু লিভউইথ ডিগনিটি, টু ডাই উইথ ডিগনিটি।’ তাদের ভাষ্য : মরতে চেয়ে কেউ ডিগনিটাসে আসে না। আসে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে, যেটা প্রচলিত চিকিৎসা শাস্ত্রে পাওয়া যাচ্ছে না।
অ্যাসিসটেড সুইসাইড পদ্ধতিতে আত্মহননকারীর হাতে দু’দফায় পেনটোবারবিটাল মেশানো পানিয় তুলে দেওয়া হয়। এটি যকৃতে প্রবেশের তিন চার মিনিটের মধ্যেই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায়। তীব্র ঘুম চলে আসে। মৃত্যু আসে ‘রেসপিরেটোরি অ্যারেস্ট’-এর মাধ্যমে। পুরো সময়টা স্বজন, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সঙ্গে থাকতে পারে, থাকেও।
অতি সম্প্রতি ১০৪ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী ড. ডেভিড গুডল ডিগনিটাসের মাধ্যমে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। তিনি যে অসুস্থ বা মরণাপন্ন ছিলেন এমন নয়। তিনি স্রেফ বাঁচতে চাচ্ছিলেন না। তাঁর নিজের ভাষায় : যথেষ্ট হয়েছে, গুডবাই।
প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে ডাক্তারদের ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ বড় বাধা কি? সম্ভবত না। স্বাস্থ্য পরিষেবার মধ্যে ‘এন্ড অফ লাইফ’-এর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আইনি সুবিধা থাকলেই হল। কেননা, যিনি রোগ যন্ত্রনায় ভুগছেন তিনিই বুঝবেন চিকিৎসা প্রত্যাখ্যানের স্বাধীনতা কিংবা ‘সম্মানের মৃত্যু’ কখন কাঙ্খিত হয়ে ওঠে।
দোহাই
১
সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদ
আইনের আশ্রয়-লাভের অধিকার
৩১। আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণ
৩২। আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
২
দন্ডবিধি ১৮৬০, ধারা ৩০৯
আত্মহত্যা করিবার উদ্যোগ
কোন ব্যক্তি যদি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে এবং অনুরূপ অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে কোন কার্য করে, তবে উক্ত ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।