শুদ্ধস্বরের সঙ্গে আমার যখন পরিচয় হয়, তখন তা মেলা শেষের শূণ্য প্রাঙ্গন। উড়তে থাকা লাল বালি কণা বলে দিচ্ছিল, গতকাল এখানে হাজার মানুষের পদচারণা ছিলো। বা বলা চলে, উৎসব শেষে ভাঙা মৃৎপাত্রের মতো শুদ্ধস্বরের কিছু বিলুপ্ত প্রায় সংখ্যা শুদ্ধস্বরের সদস্য নিজেদের কাছে যক্কের ধনের মতোন গচ্ছিত রেখে তারা তখন তারুণ্যের নবীনতাকে পাশ কাটিয়ে যুবক। আর যুবক মানে দায়িত্ব আর কর্তব্যের পাহাড় ঘাড়ে নিয়ে জীবন ধারণের উদ্দেশ্যে অন্য কিছু করার চেষ্টার ব্যস্ততা। স্বপ্ন আর দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে বিশাল পার্থক্য সম্ভবত তা আমাদের যৌবনই জানিয়ে দেয়। আসল কথা, পাঁচটি সংখ্যা বের করার পর লিটল ম্যাগাজিন শুদ্ধস্বর তখন নিজের যাত্রা থামিয়ে দিয়েছে। পরিচয়ের প্রথমে জানালাম, আর প্রকাশ পাবে না শুদ্ধস্বরের কোনো সংখ্যা।
এই সময়ে এসে শুদ্ধস্বরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়, মাত্র এর পাঁচটি পুরনো কাভারের সাথে। যতটুকু মনে পড়ে, ধুসর নীলচে রঙের ছিলো কাভারগুলো, সম্ভবত একটি সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডেরও ছিলো। প্রতিটি কভার খুব ছিপছিপে সাদামাটা, আড়ম্বরহীন ছিলো। একটি শীতল পাটির জমিনে পাঁচটি ম্যাগাজিন কভার খুব যত্ন করে শুইয়ে দিয়ে ফ্রেম করে বাঁধাই করা হয়েছে। বইয়ে বোঝাই দুইটি সেল্ফের পাশাপাশি এই বিশেষ ফ্রেমটিও সম্পাদকের পড়ার রুমের দেয়ালে ঝুলানো ছিলো। আমাকে যখন এই বিশেষ ফ্রেমটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, সে পরিচয়ে ছিলো অন্য রকম বিচ্ছেদের ঘ্রাণ। প্রথম প্রেমিকা খোয়ানোর মতো সুক্ষ বেদনা বোধ ছিলো কি তাতে? হয়ত।
তারপর মাঝে কয়েক বছর শুদ্ধস্বর পুরোপুরি প্রকাশ এবং সম্ভবত শুদ্ধস্বর নিয়ে বাহ্যিক ভাবনা চিন্তাও বন্ধ ছিলো। আমার ধারণা, বাহ্যিক ভাবনা চিন্তা বন্ধ থাকলেও, ভেতরে ভেতরে এটি আরও ব্যপক এবং বিশাল এক বিস্ফোরণের জন্য তৈরী হচ্ছিল। যার স্বপ্নের জঠর থেকে শুদ্ধস্বরের জন্ম, সে শুদ্ধস্বরকে ভুলতে পারেনি কোনো দিনও। প্রতি বছরই নিয়মিত বইমেলায় যাওয়া হতো, যতটা সময় নিয়ে পুরো বইমেলার স্টলগুলো ঘুরে দেখা হতো তারচেয়ে বেশি সময় বয়রা তলায় কাটাতাম আমরা। কী অদ্ভূত আগ্রহ নিয়ে নতুন পুরনো ছোট কাগজের সংখ্যাগুলো নাড়া চাড়া করে দেখা হতো! সে সময় পর্যন্ত শুদ্ধস্বরের জন্য আমার সেটুকুই দরদ।
এরপর ২০০০ বা ২০০১ এ নতুন করে আবার শুদ্ধস্বর প্রকাশনা শুরু হয়। তারপর ২০০৪ এর কথা। আমার খুব মনে আছে, শুদ্ধস্বর আবার নতুন করে স্বপ্ন বোনা ও চাষাবাদ শুরু করলো। এবার আরও একটু ব্যাপক আর বিস্তৃত পরিধি নিয়ে, বই প্রকাশনায় আসলো শুদ্ধস্বর। প্রকাশনী শুদ্ধস্বর বই বের করলো ছোট কাগজ শুদ্ধস্বরের পুরনো কবি লেখকদের। প্রথম বছর শুদ্ধস্বরের জন্য যেমন মেলায় কোনো স্টল ছিলো না, ছিলো না কোনো প্রচার প্রসার বা লোকবল। তখন বইমেলা বাংলা একাডেমির চত্বর জুড়ে, নিজেদের বই প্রকাশক আর লেখকরা মিলে অলমোস্ট ঘাড়ে করেই টিএসসির সামনে থেকে মেলা প্রাঙ্গনের বয়রা তলা পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছিলো রক্তদান কর্মসূচির মতোন একটি ব্যতিক্রমি উদ্যোগের মাধ্যমে। তবে পরবর্তীতে, এই রক্তদান কর্মসূচিটিকে আমার কাছে ইঙ্গিতবহ মনে হয়েছিলো। মানব ইতিহাসের প্রতিটি অর্জনের সঙ্গে রক্ত আদান প্রদানের মতো গৌরব বা বিভীষণ একটি প্রক্রিয়া জড়িত। এমন কী মাতৃগর্ভ থেকে শিশু রক্তের ধারার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আসে। শুদ্ধস্বর অবশ্য এইসব ভাবনা থেকে তাদের রক্তদান কর্মসূচিতে যায় নাই, এটা সত্য। এইসব আমার শুদ্ধস্বরকে নিয়ে ফ্যান্টাসি ভাবনা। কেননা, পরবর্তীতে আমি শুদ্ধস্বরকে দেখেছি, ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দারের মতো শুধু ফ্যান্টাসি আর আত্মবিশ্বাসকে অবলম্বন করে কতটা বন্ধুর পথ পাড়ি দেবার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছে।
শুদ্ধস্বর বই প্রকাশের পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিনও অনিয়মিত ভাবে প্রকাশ করতে থাকে। শুদ্ধস্বর কখনও ভুলেনি, ছোট কাগজই তার প্রাণ ভ্রমর।
২০০৯তে শুদ্ধস্বর প্রকাশনী প্রথমবার বাংলা একাডেমি বইমেলায় স্টল বরাদ্দ পায়। সিঙ্গেল স্টল। বাংলা একডেমি প্রাঙ্গনে তখন কন্সট্রাকশন চলছিলো, শুদ্ধস্বরের স্টল পড়েছিলো এক কন্সট্রাকশন ভবনের ঠিক মুখোমুখি, এবং কানা গলিতে। স্থান হিসাবে খুবই অনাকর্ষনীয়, কিন্তু আধা কন্সট্রাকশন বারান্দাটিতে একটি ইতিহাসের সূচনা হয়ে গিয়েছিল নীরবে। সচলায়তন ব্লগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠনের ছেলে মেয়েরা শুদ্ধস্বরের স্টলে আসতো দল বেঁধে, তারা আবার সবাই সামনের আধা কন্সট্রাকশন বারান্দায় বসে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতো, তারুণ্যের আড্ডা মানেই তো অনেক কিছু বদলে দেবার সম্ভাবনা আর এভাবে এই বারান্দা থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করা হয়। আজ শুদ্ধস্বর নিয়ে লিখতে গিয়ে এই স্মৃতিটাই জ্বলজ্বলে মনে পড়ছে।
শুদ্ধস্বরের আজিজ মার্কেটের অফিস শুধু একটি অফিসই ছিলো না, এটি মূলত অনেক তরুন-প্রবীন নানান শ্রেণির মানুষের একত্রিত হবার স্থান ছিল। সপ্তাহের একদিন, সম্ভবত শনিবার, মার্কেট আওয়ার শেষ হলে, অফিস বন্ধ হয়ে গেলে, মার্কেটের লম্বা করিডোরে পাটি পেতে বসত বিশাল আড্ডা। এই আড্ডাকে আমি ঠিক সাহিত্য আড্ডা বলবো না, শুধু সাহিত্যে আলোচনা বা কবিতা বিশ্লেষনের মধ্যে আড্ডা থেমে থাকেনি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা, তর্ক বিতর্ক করাই ছিলো এই আড্ডার বিষয়। যেখানে বয়স বা নারী পুরুষের মধ্যে কোনো বিভাজন অন্তত আমি কোনো দিন দেখিনি। পরে ১/১১ এর পট পরিবর্তনের পর সামরিক বিধি নিষেধের কারণে ধীরে ধীরে এই আড্ডা বন্ধ হয়ে যায়।
শুদ্ধস্বর শুধু বই প্রকাশ আর ছোট কাগজ প্রকাশের মধ্যে তার কার্যক্রম আটকে রাখেনি। শুদ্ধস্বরকে ঘিরে অন্য রকম যে প্লাটফর্ম তৈরী হয়েছিলো তা কিন্তু প্ল্যান করে নয়, চলতে চলতে যখন যা সামনে এসেছে তা নিয়ে একদল তরুণ যুবক কথা বলেছে, ভেবেছে প্রতিবাদ করেছে।
বছরে একবার একুশের বইমেলা পাঠকের বই প্রাপ্তির জন্য যথেষ্ট নয় বলে শুদ্ধস্বর ঢাকা ও অন্যান্য শহরে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে একক বইমেলার সূচনা করে। এছাড়াও ছিলো শাহবাগ কেন্দ্রীক প্রকাশকদের হেমন্তের বইমেলা। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এটি অনুষ্টিত হতো। হেমন্তের বইমেলা মানে আমার কাছে,হেমন্তেরবাতাসের নবীন হিমেল পরশের অনুভূতি! সেসব আজ কত দূর অতীতের গল্প মনে হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, কখনও, কোনো দিন কি আমরা অমন হেমন্তের বাতাস ছুঁয়ে ঢাকার রাস্তায় হেঁটেছিলাম!
২০০৯ এর পর থেকে বইমেলায় শুদ্ধস্বরের প্রকাশনার পরিধি বড়ো হতে থাকে। শুদ্ধস্বর লেখকদের নিজেদের বইয়ের মোড়ক নিজেদের উন্মোচন করতে উৎসাহিত করতো বরাবর। বই মেলায় মোড়ক উন্মোচনের দিনে বা মেলার শেষ দিনে আমরা লেখক, পাঠক শুভাকাঙ্ক্ষিদের জন্য মুড়ি মুড়কি, নাড়ু, মোয়ার আয়োজন করতাম। চৈত্র সংক্রান্তিতে অনেক লেখক, কবি শুধু এই অনুষ্ঠানটুকুর জন্য বহুদূর থেকে আমাদের সাথে একত্রিত হতে আসতেন। শুদ্ধস্বরের স্টলের সামনে কী দারুণ এক মিলন মেলা হতো লেখক আর পাঠকদের মধ্যে!
এছাড়াও বই মেলা শেষে, এপ্রিল মাসে (বৈশাখে) শুদ্ধস্বর তার লেখক এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান আয়োজন করতো। সেই অনুষ্ঠানগুলোতে দেশের সব প্রতিষ্ঠিত ও তরুণ কবি, সাহিত্যিক জড়ো হতেন। এক ছাদের নিচে এতো অসংখ্য গুনিজনকে এক সাথে পাওয়া, সে এক অন্য রকম অনুভূতি!
শুদ্ধস্বর নিয়ে লিখতে গিয়ে এরকম অসংখ্য স্মৃতি মনে পড়ছে। তাই যেমন ভেবেছিলাম তেমনটি না লিখে খালি স্মৃতি নিয়ে লিখে যাচ্ছি।
শুদ্ধস্বর তরুণ কবি লেখকদের বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশনায় আসলেও পরবর্তীতে দেশের অসংখ্য প্রবীন কিন্তু ভাবনার আলোকে তরুণ লেখকরাও শুদ্ধস্বরের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন। সৈয়দ শামসুল হক থেকে শুরু করে পিয়াস মজিদ সকলের বই একে একে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। শুদ্ধস্বরের কল্যানে নতুন কবি লেখকদের সঙ্গে যেমন সখ্যতা, বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তেমনি অনেক প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ নবীন গুণিজনের ভালোবাসা, স্নেহও ব্যক্তিগত ভাবে আমরা পেয়েছি। শুদ্ধস্বরের কল্যাণে প্রাপ্ত ভালোবাসা স্নেহ যেমন কম নয়, তেমনি শুদ্ধস্বরের দুর্দিনে নিজ নিজ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, স্নেহ তুলে নেওয়া কবি সাহিত্যিকের সংখ্যা বেশি বই কম পাইনি।
শুদ্ধস্বরের মেইন থিমটাই ছিলো, যা বিশ্বাস করে তা করে দেখানো। সত্য যত কঠিনই হোক, তা গ্রহন করার, বলার এবং নিজ কৃতকর্মের জন্য দায় স্বীকার করাই শুদ্ধস্বরের মেরুদন্ড। তাই তো, শুদ্ধস্বর বাংলাদেশের প্রকাশনার যে স্তরে চলে গিয়েছিলো, সেখানে বসে অনেক প্রকাশকের মতো প্রচলিত ধারার কিছু জনপ্রিয় বই প্রকাশ করে চলতে পারতো। কিন্তু অনেক বইয়ের পরও, গতানুগতিক ভাবনার বাইরে, বিতর্কিত ভাবনার অনেকবই শুদ্ধস্বর প্রকাশ করে। যা আমাদের সমাজের অন্ধ বিশ্বাসী মানুষদের ভাবনা চিন্তাকে নাড়াচাড়া দেয়ার জন্য জরুরী ছিলো। এটা শুদ্ধস্বর করেছে দায়বদ্ধতা থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে।
শুদ্ধস্বরের কাজ যাদের পছন্দ হয়নি তারা বার বার শুদ্ধস্বরের পেছনে থাকা মানুষটিকে নানা রকম হুমকি দিয়েছে। আমাদের কখনও মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে যায়নি, তাই কখনও কোনো মৃত্যু হুমকিকে সত্য বলে মানতে চাইনি। তারপরও, চোখের সামনে অনেককে যখন খুন হতে দেখি তখন নিজেদের বিশ্বাসটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সেই নির্মম হুমকি আমাদের জন্য নিষ্ঠুর সত্য হয়ে আসে, ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবরে। সে নির্মম দিনের কথা যদি বলি, বন্ধুদের সাহায্যে শুদ্ধস্বর সম্পাদক বেঁচে যায়। আমি বলি, যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকের মতো গুলিটা তার কানের ডগা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। সে চিহ্ন তার মুখে, ঘাড়ে, মাথায় নিজ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে আছে।
আমাদের নির্বাসনে আসা মানে শুদ্ধস্বরের মুখ থুবড়ে পড়া। এবার নতুন এক দেশ, পুরোপুরি ভিন্ন এক ভাষা,ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন জনপদ। নিজেদের দেশ, ভাষা, বন্ধু স্বজন থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, ঠান্ডা এক বরফের দেশে। মনে মনে জেনে গিয়েছি, শুদ্ধস্বর আর দাঁড়াতে পারবে না। শুদ্ধস্বর নিয়ে সব স্বপ্ন শেষ! এই ঠান্ডার দেশে নিজের ফুলে ওঠা কাটা গালে হাত বুলাতে বুলাতে লোকটি ল্যাপটপে কাজ করতে করতে জানায়, শুদ্ধস্বর অনলাইনে বের করবো…। তাকে তখন আমার ঠিক শহিদুল্লাহ কায়সারের সারেঙ বউর নবীতুন মনে হয়েছিল। ভয়াবহ গোর্কির পরও যে উঠে দাঁড়িয়েছিল। পা টলে উঠলেও নিশ্চিত পদক্ষেপ ছিলো।
তিন বছর ধরে শুদ্ধস্বর অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে, তিন তিনটি ভাষাতে। এখন শুদ্ধস্বরের লেখক ও পাঠক আন্তর্জাতিক অঙ্গন জুড়ে। সামনে শুদ্ধস্বরের আরও অনেক কিছু করার পরিকল্পনা। আমি বিশ্বাস করি, শুদ্ধস্বর আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। ফ্যান্টাসি এবং বিশ্বাস শুদ্ধস্বরকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
শুদ্ধস্বরের জন্য ভালোবাসা এবং শুভ কামনা।
Shamim Runa is a novelist, playwright, film critic, and women’s rights activist.