স্লাভো জিজেকের দ্যা সাবলাইম অবজেক্ট অব আইডিওলজির ভূমিকা অংশ

Share this:

অনুবাদকের ভূমিকা: বৈরিতা বিষয়টিকে স্লাভো জিজেক (Slavoj Žižek) তার বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করেন। কেননা বৈরিতাকে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমেই সবার্ত্মকবাদী তৎপরতাকে নির্মূল করা সম্ভব। একসময় ফুকো-হাবারমাসের চিন্তাকে ঘিরে সামাজিক বিশ্লেষণমূলক তৎপরতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছিলো। কিন্তু তাদের উভয়ের সাবজেক্টের মধ্যে এ বিষয়টিকে আমলে নেওয়া হয়নি। যার ফলে তাদের সাবজেক্টের ধারণা বৈরিতাকে স্বীকৃতি না দিয়েই এর সাথে সামঞ্জস্য বা অসামঞ্জস্যের সম্পর্ক গড়ে তুলে। এখানে জিজেক আলথুসার ও লাকাঁর চিন্তাকে অগ্রবর্তী হিসেবে বিবেচনা করেন কেননা তারা উভয়েই বৈরিতাকে গুরুত্বের সাথে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। বৈরিতাকে স্বীকার করার ফলাফল হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মৌলিক বৈরিতাকে উন্মোচন করা। প্রত্যেকটি মৌলিক বৈরিতাই এককভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মোকাবিলাও এককভাবে করতে হয়। সাম্যবাদ, পরিবেশবাদ, শ্রমিক আন্দোলন প্রত্যেকেরই তাদের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বৈরিতার সাথে মোকাবিলা করতে হয়। কোন সার্বজনীন তৎপতার মধ্য দিয়ে এগুলো সমাধান করার প্রেষণাই হচ্ছে সর্বাত্মকবাদী প্রেষণা। তাই জিজেকের মতে যখন পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র দাবী করে যে এটি একক ও সার্বিকভাবে সবধরনের সমস্যাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম তখন গণতন্ত্র একটি সর্বাত্মকবাদী রূপ ধারণ করে। এমনকি প্রথাগত মার্কসবাদের মধ্যেও এই বিষয়টি লক্ষ্যণীয় যেখানে বৈশ্বিক বিপ্লব হচ্ছে সব সমস্যার সমাধান। এজন্য জিজেক হেগেলের চিন্তাকে কথা বলেন, কেননা হেগেলের দ্বান্দ্বিকতা সঠিকভাবে বৈরিতাকে ধারণ করতে সক্ষম।  জিজেকের একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে “হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতাকে লাকাঁনিয়ান মনোবিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটি নতুন পাঠ প্রদান করে একধরনের ‘হেগেলের কাছে প্রত্যাবর্তনকে’ বাস্তবায়িত করা।” লেখাটি জিজেকের প্রথম প্রকাশিত বইয়ের  The Sublime Object of Ideology  ভূমিকা অংশের বাংলা অনুবাদ। জিজেকের এ বইটি কন্টিনেন্টাল ফিলোসোফিতে ইতিমধ্যেই গুরুত্বের সাথে স্বীকৃত। একইসাথে এই বইটি তাৎপর্যপূর্ণভাবে তার পরবর্তী চিন্তাভাবনা সম্প্রসারণে মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

অনুবাদক: জাহিদুল ইসলাম

 

 

হাবারমাস তার ‘দ্য ফিলোসোফিক্যাল ডিসকোর্স অব মর্ডানিটি’ বইতে তথাকথিত ‘উত্তর-কাঠমোবাদ’ ইস্যুকে বিশেষভাবে মোকাবিলার করতে চেয়েছেন। এতে লাকাঁর নাম সম্পর্কে একটি কৌতূহলী বিশদ রয়েছে। তাকে শুধুমাত্র পাঁচবার উল্লেখ করা হয়েছে এবং প্রত্যেকবারই অন্য কারো নামের সাথে সংযুক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে। লাকাঁনিয়ান তত্ত্বকে তখন এবং এখনো একটি নির্দিষ্ট সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়না। Laclau এবং Mouffe এর বরাত দিয়ে বলা যায় লাকাঁর তত্ত্ব – সবসময়ই সমজাতীয়তার একটি ধারাবাহিকতাকে গ্রন্থিবদ্ধ করে। এমন একটি বই যাতে বাতাই, দেরিদা এবং সর্বোপরি ফুকো, যিনি হাবারমাসের সত্যিকারের অংশীদার তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে, তাতে কেন সরাসরি লাকাঁর মুখোমুখি হতে এই অস্বীকৃতি?

এই জটিলতার উত্তর পাওয়া যায় হাবারমাসে বইয়ের আরেকটি কৌতূহল থেকে। এটি হচ্ছে আলথুসার সম্পর্কিত একটি ‘কৌতূহলী ঘটনা।’ অবশ্যই, আমরা শার্লক হোমসবাদী অর্থে ‘কৌতূহলী ঘটনা’ শব্দটি ব্যবহার করছি। হাবারমাসের বইতে একইভাবে আলথুসারের নামও উল্লেখ নেই, আর এটিই হচ্ছে সেই কৌতূহলী ঘটনা। তাই আমাদের প্রথম থিসিস হবে যে মহান বিতর্কটি আজকের বুদ্ধিবৃত্তিক দৃশ্যের অগ্রভাগে দখল করে আছে, তা হচ্ছে হাবারমাস-ফুকোর বিতর্ক, এটি আরেকটি বিরোধকে আড়াল করে দিচ্ছে, আরেকটি বিতর্ক যা তাত্ত্বিকভাবে আরও সুদূরপ্রসারী আর তা হচ্ছে আলথুসার-লাকাঁর বিতর্ক। আলথুসারিয়ান স্কুলকে আকস্মিক গ্রাস করার  মধ্যে জটিল কিছু ব্যাপার রয়েছে। শুধুমাত্র তাত্ত্বিক পরাজয় বিবেচনায় এনে একে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটি যেন তারচেয়েও আরো বেশি কিছু। আলথুসারের তত্ত্বের মধ্যে এমন আঘাতদায়ক মর্মস্থল ছিলো যাকে দ্রুত ভুলে যেতে হয়। ‘অবদমন’ হচ্ছে এই তাত্ত্বিক স্মৃতিভ্রংশের একটি কার্যকর ঘটনা। তাহলে কেন আলথুসার-লাকার বিরোধিতার জায়গায় একধরনের রূপক বিকল্প হিসেবে হাবারমাস-ফুকোর বিরোধিতাকে প্রতিস্থাপন করা হলো? এর উত্তর হিসেবে এখানে সাবজেক্টের চারটি ভিন্ন ধারণাও চারটি ভিন্ন নৈতিক অবস্থানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।

হাবারমাসের সাথে, আমাদের অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগের নীতি-নৈতিকতা  রয়েছে। তার সার্বজনীনতার আদর্শ আন্তঃবিষয়ক সম্প্রদায়ের স্বচ্ছতা প্রদান করে। তার সাবজেক্টের পিছনের ধারণাটি অবশ্যই ভাষার দর্শন, যা পুরানো সাবজেক্টের অতীন্দ্রিয় প্রতিফলনের সংস্করণ। ফুকোকে নিয়ে আমরা সেই সার্বজনীন নীতিশাস্ত্রের বিরুদ্ধে মোড় নিলাম যার ফলে নীতিশাস্ত্রের এক ধরনের নান্দনিকীকরণ ঘটে। ফুকোর প্রত্যেকটি সাবজেক্ট সার্বজনীন নিয়মের কোন সমর্থন ছাড়াই, স্ব-প্রভুত্বের নিজস্ব পদ্ধতি তৈরি করে। একে অবশ্যই নিজের মধ্যে থাকা ক্ষমতার বৈরিতাকে সামঞ্জস্য করতে হয় যার মাধ্যমে সে নিজেকে উদ্ভাবন করে। কাজেই বলা যায় এটি নিজেই নিজেকে সাবজেক্ট হিসেবে তৈরি করে তার নিজস্ব জীবন যাপনের শিল্প খুঁজে বের করে। তাই ফুকো সুনির্দিষ্ট সাবজেক্টিভিটির ধরন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রান্তিক জীবনযাপনের দ্বারা বিশেষভাবে মুগ্ধ ছিলেন।

ফুকোডিয়ান সাবজেক্টের ধারণা কিভাবে অভিজাত-মানবতাবাদী ঐতিহ্যে প্রবেশ করেছে তা সনাক্ত করা কোন কঠিন কাজ নয়। এর নিকটতম উপলব্ধি হবে রেনেসাঁরের ‘সার্বিক ব্যক্তিত্বের’ আদর্শ যা নিজের মধ্যে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার নিজের জীবনকে শিল্পকর্ম হিসেবে গড়ে তোলে। ফুকোর সাবজেক্ট ধারণাগভাবে বরং এই ধ্রুপদী ধারণা। এখানে সাবজেক্ট হচ্ছে আত্ম-মধ্যস্থতার ক্ষমতা যা বৈরিতামূলক শক্তির সাথে সামঞ্জস্য তৈরি করে। সাবজেক্ট নিজের ইমেজ পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে ‘আনন্দের ব্যবহার’ আয়ত্ত করার একটি উপায় হিসাবে কাজ করে। এখানে হাবারমাস এবং ফুকো একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। এর সত্যিকারের ভাঙ্গন আলথুসার দ্বারাই উপস্থাপন করা যায়, কেননা তার থিসিসে তিনি বৈরিতার ব্যাপারে স্থির ছিলেন যে এটি একটি নির্দিষ্ট ভাঙ্গন, একটি নির্দিষ্ট ফাটল যা ভ্রান্ত স্বীকৃতির মাধ্যমে মানবীয় শর্তসমূহকে বৈশিষ্ট্যসূচক করে তুলে। হামাবারমাস ও ফুকোর  ভাবাদর্শের সম্ভাব্য সমাপ্তির ধারণা যে নিজেই একটি ভাবাদর্শিক ধারণার সমান শ্রেষ্ঠ তা আলথুসারের থিসিসের মাধ্যমে স্পষ্ট।

যদিও আলথুসার নৈতিক সমস্যা নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখেননি, তবে এটা স্পষ্ট যে তার পুরো কাজটি একটি নির্দিষ্ট র‌্যাডিক্যাল নৈতিক মনোভাবকে মূর্ত করে তুলে যাকে আমরা বলতে পারি বিচ্ছিন্নতার বীরত্ব বা বিষয়গত দৈনদশার বীরত্ব। ( যদিও সুনির্দিষ্ট কারণ হচ্ছে ‘বিচ্ছিন্নতা’ ধারণাটিকে আলথুসার ভাবাদর্শিক হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।) বিষয়টি এমন নয় যে শুধুমাত্র আমাদেরকে কাঠামোগত প্রযুক্তির মুখোশ খুলে ফেলতে হবে, যা ভাবাদর্শের ভ্রান্ত স্বীকৃতি হিসেবে সাবজেক্টের কার্যকারিতা উৎপাদন করে। বরং আমাদেরকে আবশ্যিকভাবে একই সময়ে এই ভ্রান্ত স্বীকৃতিকে অনিবার্য হিসেবে মেনে নিতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, আমাদের ঐতিহাসিক কার্যকলাপের শর্ত হিসাবে একটি নির্দিষ্ট বিভ্রমকে মেনে নিতে হবে, একে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার প্রতিনিধির ভূমিকা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

এই দৃষ্টিকোন থেকে, সাবজেক্ট একটি নির্দিষ্ট ভ্রান্ত স্বীকৃতির মাধ্যমে গঠিত হয়। ভাবাদর্শিক ইন্টারপেলেশন প্রক্রিয়া বলতে ভাবাদর্শগত কারণের আহ্বান সম্বোধনকারী একটি নির্দিষ্ট শর্ট সার্কিটকে বোঝায় যার মাধ্যমে সাবজেক্ট নিজেই নিজেকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এটি হচ্ছে ‘আমি আগে থেকেই সেখানে ছিলাম’ এই ধরনের একটি বিভ্রম ধারণা যা, মিশেল পেচেউক্স – তার ইন্টারপেলেশন তত্ত্বে সবচেয়ে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। আর এটির হাস্যকর প্রভাব ছাড়া উল্লেখ্যযোগ্য কিছু নয়। ভ্রান্ত স্বীকৃতির শর্ট সার্কিটটি হচ্ছে এতে  ‘আশ্চর্যের কিছু নেই যে আপনাকে সর্বহারা হিসাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, যখন আপনি সর্বহারা হিসেবে স্বীকৃত।’ এখানে, পেচেউক্স মার্কস ব্রাদার্সের সাথে মার্কসবাদের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছেন, যার এইধরনের সুপরিচিত রসিকতা রয়েছে যে : ‘আপনি আমাকে ইমানুয়েল রাভেলির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।’ ‘কিন্তু আমিই ইমানুয়েল রাভেলি।’ ‘তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে আপনি তার মতো দেখতে।’

আলথুসারিয়ান বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বের নৈতিকতার মধ্যে ‘সাবজেক্ট ছাড়া যে’ প্রতীকি ‘প্রক্রিয়া’ রয়েছে তার বিপরীতে লাকাঁনিয়ান মনোবিশ্লেষণের পরোক্ষ নৈতিকতাকে আমরা বিচ্ছেদ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। বিখ্যাত লাকাঁনিয়ান সূত্র হচ্ছে নিজের বাসনার উপর নিজেকে সঁপে দিওনা।  এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তবকে তার প্রতীকীকরণ থেকে ফারাক করার জন্য  যে দূরত্ব রয়েছে তাকে আমরা যেন মুছে ফেলতে না পারি। এটি হচ্ছে প্রত্যেক প্রতীকীকরণের উপর বাস্তবের উদ্বৃত্ত  যা বাসনার বস্তু-কারণ হিসেবে কাজ করে। এই উদ্বৃত্ত (অথবা, আরও সঠিকভাবে, অবশিষ্ট) এর সাথে সমঝোতার শর্তে আসা মানে একটি মৌলিক অচলাবস্থাকে (‘বৈরিতাকে’) স্বীকার করা যা প্রতীকী একীভবন-বিচ্ছেদ প্রতিহত করার কেন্দ্রস্থল। এই ধরনের একটি নৈতিক অবস্থান সনাক্ত করার সর্বোত্তম উপায় হল সামাজিক বৈরিতার যে প্রথাগত মার্কসবাদী ধারণা রয়েছে তার বিরোধিতার করা। এই প্রথাগত ধারণায় দুটি আন্তঃসংযুক্ত বৈশিষ্ট্য অন্তর্নিহিত। প্রথমত, একটি নির্দিষ্ট মৌলিক বৈরিতা অন্য সমস্ত বৈরিতাকে ‘মধ্যস্থতা’ করার জন্য সত্তাতাত্ত্বিক অগ্রাধিকার ধারণ করে। একটি মৌলিক বৈরিতাই অন্যান্য সমস্ত বৈরিতার ক্ষেত্র এবং গুরুত্ব নির্ধারণ করে। (যেমন শ্রেণী বৈরিতা, অর্থনৈতিক শোষণ। ) দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ যা একটি প্রয়োজন হিসেবে না হলেও মৌলিক বৈরিতার সমাধান এবং একইভাবে অন্যান্য বৈরিতার মধ্যস্থতা করার জন্য অনন্ত একটি ‘উদ্দেশ্যমূলক সম্ভাবনা’ নিয়ে আসে। এটি  সুপরিচিত মার্কসবাদী সূত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে সমজাতীয় যুক্তির ভিত্তিতে  ব্যাখ্যা করা হয় যে ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ সমগ্র মানবজাতিকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যায় একইসাথে এটি শ্রেণী বিভাজনের বিলুপ্তিরও শর্ত তৈরি করে।  মার্কসের সমসাময়িক ওয়াগনার পার্সিফালের মুখ দিয়ে যা বলেছিলেন এক্ষেত্রে এই কথাই প্রাসঙ্গিক, আর তা হচ্ছে – [ক্ষতটি শুধুমাত্র নিজ বর্শা দ্বারা নিরাময় করা যায় যা এটি নিজে তৈরি করেছে]

এই দুটি বৈশিষ্ট্যের ঐক্যের উপর ভিত্তি করেই বিপ্লবের মার্কসবাদী ধারণা ও বিপ্লবী পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পরিস্থিতি এমন একটি রূপক অচলাবস্থা তৈরি করে যেখানে সবগুলো সমস্যার সমাধান না করে চূড়ান্তভাবে কোনো নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয় বলে আমাদের প্রাত্যহিক চেতনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, সামাজিক সামগ্রিক বৈরিতার চরিত্রকে মূর্ত করেনা বলে এটি একক মৌলিক প্রশ্নের সমাধান করেনা, যদিও একটি ‘স্বাভাবিক’, প্রাক-বিপ্লবী অবস্থায় প্রত্যেকে তার নিজের নির্দিষ্ট সংগ্রামে লিপ্ত। (শ্রমিকরা ভাল মজুরির জন্য ধর্মঘট করছে, নারীবাদীরা নারীর অধিকারের জন্য লড়াই করছে, গণতন্ত্রবাদীরা রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার জন্য, পরিবেশবাদীরা প্রকৃতির শোষণের বিরুদ্ধে,  শান্তিকামীরা যুদ্ধের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে শান্তি আন্দোলনের পক্ষে সংগ্রাম করছে।) মার্কসবাদীরা তাদের সমস্ত দক্ষতা এবং যুক্তির চতুরতা ব্যবহার করে এই বিশেষ সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের বোঝানোর জন্য যে, তাদের সমস্যার একমাত্র বাস্তব সমাধান বৈশ্বিক বিপ্লবের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক সম্পর্ক পুঁজির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত লিঙ্গ সম্পর্কের মধ্যে সর্বদা পুরুষ-প্রাধান্য থাকবে, সর্বদা বৈশ্বিক যুদ্ধের হুমকি থাকবে, সর্বদা রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্বাধীনতা স্থগিত রাখার একটি হুমকি থাকবে, প্রকৃতি নিজেই সর্বদা নির্মম শোষণের বস্তু থেকে যাবে…বৈশ্বিক বিপ্লবই তখন একমাত্র মৌলিক সামাজিক বৈরিতা দূর করে, একটি স্বচ্ছ, যৌক্তিকভাবে শাসিত সমাজ গঠনে সক্ষম হবে।

তথাকথিত ‘উত্তর-মার্কসবাদ’-এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অবশ্যই এই যুক্তির সাথে বিচ্ছেদ ঘটানো। একে ঘটনাক্রমে, শুধুমাত্র মার্কসবাদী অর্থে ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কেননা প্রায় যে কোনও বৈরিতা যা মার্কসবাদের আলোকে গৌণ বলে মনে হয় তা নিজে অন্য সকল কিছুর জন্য মধ্যস্থতার অপরিহার্য ভূমিকা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। কিছু উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাদের রয়েছে নারীবাদী মৌলবাদ (যেখানে নারীর মুক্তি ও পুরুষ-প্রাধান্যের বিলুপ্তি  ছাড়া বিশ্বব্যাপী মুক্তি নেই); গণতান্ত্রিক মৌলবাদ ( যেখানে গণতন্ত্র পশ্চিমা সভ্যতার মৌলিক মূল্যবোধ হিসাবে কাজ করে এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক, নারীবাদী, সংখ্যালঘুদের সমস্ত সংগ্রাম ইত্যাদি মৌলিক গণতান্ত্রিক সমতাবাদী নীতির সম্প্রসারিত প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব); পরিবেশবাদী মৌলবাদ (মানবজাতির মৌলিক সমস্যা হিসাবে পরিবেশগত অচলাবস্থাকে বিবেচনা করে); এবং কেন নয়? এমনকি মনোবিশ্লেষণমূলক মৌলবাদও রয়েছে  যা মারকুজের ইরোস অ্যান্ড সিভিলাইজেশনে গ্রন্থিবদ্ধ করা হয়েছে (যেখানে নিপীড়নমূলক লিবিডিনাল কাঠামো পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে মুক্তির চাবিকাঠি)

মনোবিশ্লেষণমূলক ‘অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যবাদ’ (essentialism)   আপাত স্ব-বিরোধী যতক্ষণ পর্যন্ত এটি সুনির্দিষ্টভাবে মনোবিশ্লেষণ। অন্তত লাকাঁনিয়ানে পাঠে এটি লক্ষ্যণীয় যে তার মনোবিশ্লেষণ অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যবাদের যুক্তির সাথে সত্যিকারের বিচ্ছেদ উপস্থাপন করে। তাই বলা যায় যে, লাকাঁনিয়ান মনোবিশ্লেষণ তথাকথিত ‘উত্তর-মার্কসবাদের’ অপরিহার্য-বৈশিষ্ট্যবাদ বিরোধীতার চেয়ে একটি নির্ধারক ধাপ এগিয়ে রয়েছে যা অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যবাদের বিরোধিতা করলেও নির্দিষ্ট সংগ্রামের ধারাবাহিক বহুত্বকে নিশ্চিত করে। অন্য কথায় বলা যায়, নির্দষ্ট সংগ্রামের সমজাতীয়তার ধারাবাহিকতাকে কিভাবে গ্রন্থিবদ্ধ করে প্রদর্শন করা যায় তা সবসময় সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার আমূল অনিশ্চিত ঘটনার  উপর নির্ভর করে। আর লাকাঁনিয়ান মনোবিশ্লেষণ আমাদেরকে স্বয়ং সমজাতীয় বহুত্বের যে অসম্ভব-বাস্তব মর্মস্থলের বহুবিধ প্রতিক্রিয়া রয়েছে তাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম করে তুলে।

আমরা এখানে ফ্রয়েডীয় ‘ডেথ ড্রাইভের’ ধারণা উল্লেখ করতে পারি। আমাদেরকে অবশ্যই ফ্রয়েডীয় জীববিজ্ঞানবাদকে সারাংশ করতে হবে যে; ‘ডেথ ড্রাইভ’ একটি জৈবিক বাস্তবতা নয় বরং এটি এমন একটি মানুষিক যন্ত্রের ধারণাকে ইঙ্গিত করে যা আনন্দ-অন্বেষণের উর্ধ্বে উঠে অন্ধ স্বয়ংক্রিয়  পুনরাবৃত্তির অধীনস্থ। এই অন্ধ স্বয়ংক্রিয়তা হচ্ছে মানুষ এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্যকার অবস্থান  অনুযায়ী ব্যক্তির আত্ম-সংরক্ষণ। হেগেলীয় সংজ্ঞা অনুযায়ী মানুষ হচ্ছে ‘মৃত্যুর দিকে পীড়িত একটি প্রাণী’, এমন এক প্রাণী যা পরাশ্রয়ী অতৃপ্তি (বুদ্ধি, যুক্তি, ভাষা) দ্বারা বলপূর্বক চালিত।  এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ‘ডেথ ড্রাইভের’ আমূল নেতিবাচকতার এই মাত্রাকে বিচ্ছিন্ন সামাজিক অবস্থার প্রকাশক হিসেবে সংকুচিত করা যায় না। এটি  মানবীয় অবস্থাকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করে যেখানে ডেথ ড্রাইভের কোন সমাধান নেই, এর থেকে কোন মুক্তি নেই। যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে একে ‘পরাজিত করা’ বা ‘বিলুপ্ত’ করা নয়, বরং এর সাথে সমঝোতায় আসা। এর যে ভয়ঙ্কর মাত্রা রয়েছে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া শিখতে হবে এবং তারপরে, এই মৌলিক স্বীকৃতির ভিত্তিতে, এটির সাথে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করতে হবে।

এই ভারসাম্যহীনতা, আঘাতমূলক মর্মস্থল, এবং এই আমূল বৈরিতাকে সীমিত করে গড়ে তোলার জন্য সমস্ত ‘সংস্কৃতি’ ডেথ ড্রাইভকে ভিন্নভাবে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে সমজাতীয় প্রতিক্রিয়া-গঠন করে। যার মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির এবং প্রাণীর হোমিওস্টেসিসের সাথে তার কেন্দ্রস্থলকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই বৈরিতার প্রেষণাকে রদ করার যে লক্ষ্য রয়েছে শুধুমাত্র তাই সর্বাত্মকবাদী নয়, বরং একে বিলুপ্ত করার আকাঙ্ক্ষাও হচ্ছে সর্বাত্মকবাদী প্রলোভনের উৎস। সর্বাধিক গণহত্যা ও হলোকাস্ট সর্বদাই সমজাতীয় সত্তা হিসেবে মানুষের নামে সংঘটিত হয়েছে, যেটি বৈরিতাকে বিবেচনা ছাড়াই নতুন মানুষের কথা বলে।

আমরা একই যুক্তিকে পরিবেশকে দেখে থাকি যে, মানুষ হচ্ছে ‘পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’ কিন্তু প্রাকৃতিক ভারসাম্যে ফিরে যাওয়ার এখন আর কোন সুযোগ নেই। মানুষ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে একমাত্র যে কাজটি করতে পারে তা হচ্ছে এই ভঙ্গুর, এই ফাটল, এই কাঠামোগত বিনাশকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করে পরবর্তীকালীন যতদূর সম্ভব জিনিসগুলিকে জোড়া লাগানোর জন্য চেষ্টা করা। অন্যান্য সমস্ত সমাধান, যেমন, প্রকৃতিতে সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনের বিভ্রম, প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ সামাজিকীকরণের ধারণা এগুলো হচ্ছে সর্বাত্মকবাদের একটি প্রত্যক্ষ পথ। আমাদের একই যুক্তি নারীবাদের মধ্যে রয়েছে যে ‘লিঙ্গগত সম্পর্ক বলতে কিছু নেই’, অর্থাৎ সংজ্ঞা অনুসারে লিঙ্গগত সম্পর্ক স্থাপন ‘অসম্ভব।’ কিন্তু বৈরিতা ছাড়া এখানে চূড়ান্ত কোন সমাধান নেই। লিঙ্গভিত্তিক সহনীয় সম্পর্কের একমাত্র ভিত্তি হল এই মৌলিক বৈরিতার ও মৌলিক অসম্ভবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া।

গণতন্ত্রের সাথে আমাদের একই ধরনের যুক্তি রয়েছে। যে জরাজীর্ণ যুক্তি চার্চিল গণতন্ত্রের উপর আরোপ করেছিলেন সে বাক্যাংশ যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, আর তা হচ্ছেঃ  সমস্ত সম্ভাব্য ব্যবস্থার মধ্যে গণতন্ত্র সবচেয়ে খারাপ কিন্তু একমাত্র সমস্যা হল এর ভালো কোন বিকল্প নেই। অর্থাৎ, গণতন্ত্র সর্বদা নিস্তেজ মধ্যপন্থার শাসনকে অন্তর্ভুক্ত করে দুর্নীতির সম্ভাবনা তৈরি করে। একমাত্র সমস্যা হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত ঝুঁকি এড়াতে এবং ‘আসল’ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার প্রতিটি প্রচেষ্টা অগত্যা তার বিপরীত অবস্থায় নিয়ে আসে কেননা স্বয়ং গণতন্ত্রের বিলুপ্তির মাধ্যমেই এগুলোর অবসান ঘটে। এখানে একটি থিসিস প্রতিরক্ষা করা সম্ভব হবে যে প্রথম উত্তর-মার্কসবাদী আর কেউ নয় বরং হেগেল নিজেই। হেগেলের মতে সর্বাত্মক সন্ত্রাসবাদকে পতন ছাড়া সুশীল সমাজের বৈরিতাকে দমন করা যাবেনা। এই পতনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র তার বিপর্যয়কর প্রভাবকে সীমিত করতে সক্ষম।

এটি Ernest Ladau ও Chantal Mouff এর দক্ষতা যে তারা হেজেমনি এন্ড সোস্যাল  স্ট্র্যাটেজি গ্রন্থে সামাজিক পরিসরে এমন একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন যাতে বৈরিতার একটি ধারণা রয়েছে। যে ধারণা অনুযায়ী বৈরিতা হচ্ছে বাস্তব ‘আঘাতদায়ক মর্মস্থলের’ স্বীকৃতি, একটি অসম্ভব মর্মস্থল যা প্রতীকীকরণ, সর্বাত্মকরণ ও প্রতীকী একীভূতকরণকে প্রতিরোধ করে। প্রতীকীকরণ, সর্বাত্মকরণের প্রতিটি প্রচেষ্টা সবার শেষে আসে। এটি আসল ফাটলকে জোড়া লাগানোর একটি প্রচেষ্টা। এমন একটি প্রচেষ্টা যা তার শেষ অবলম্বন হিসেবে নিজস্ব সীমানির্দেশের ব্যর্থতার জন্য নিজেই ধ্বংস হয়ে যায়। তারা যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন তা হচ্ছে একটি মৌলিক সমাধানের লক্ষ্যে আমাদের ‘মৌলবাদী’ হওয়া উচিত নয়। আমরা সবসময় একটি আন্তঃস্থান এবং অনুকরণকৃত সময়ের মধ্যে বাস করি যেখানে এক ধরনের মৌলিক অসম্ভবকে স্থগিত করা জন্য প্রতিটি সমাধানই স্থানিক এবং কালিক। তাই তাদের ‘র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্রেসি’ শব্দটিকে একরকম আপাত স্ববিরোধি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এটি ঠিক বিশুদ্ধ,  সত্যিকারের গণতন্ত্রের অর্থে ‘র‍্যাডিকাল’ নয় বরং এর র‍্যাডিক্যাল চরিত্র ঠিক বিপরীত ইঙ্গিত বহন করে, যেখানে আমরা গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারি শুধুমাত্র তার নিজস্ব র‍্যাডিকাল অসম্ভবতা বিবেচনায় নিয়ে। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি কিভাবে প্রথাগত মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত শীর্ষে আমরা পৌঁছেছি। প্রথাগত মার্কসবাদে একমাত্র বৈশ্বিক বৈপ্লবিক-সমাধান হল সমস্ত বিশেষ সমস্যার কার্যকর সমাধানের শর্ত। যদিও এখানে একটি নির্দিষ্ট সমস্যার স্থানিক ও কালিক সফল সমাধানের সাথে বৈশ্বিক আমূল অচলাবস্থা, অসম্ভবতা ও মৌলিক বৈরিতার স্বীকৃতি রয়েছে।

আমার থিসিসটি হচ্ছে (যা The Most Sublime of Hysterics: Hegel Passes এর মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে) এই ধরনের বৈরিতার স্বীকৃতির সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ মডেলটি হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতা দ্বারা প্রদান করা হয়েছে। প্রগতিশীল সফলতার গল্প থেকে দূরত্ব বজায় রেখে হেগেলের জন্য দ্বান্দ্বিকতা হচ্ছে সমস্ত প্রচেষ্টার ব্যর্থতার একটি নিয়মতান্ত্রিক  প্রতীক। হেগেলের ‘পরম জ্ঞান’ একটি বিষয়গত অবস্থানকে বোঝায় যা শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পরিচয়ের অভ্যন্তরীণ শর্ত হিসাবে ‘দ্বন্দ্ব’কে গ্রহণ করে। হেগেলীয় ‘সমন্বয়ের’  ধারণা বলতে সমস্ত বাস্তবতাকে ‘যৌক্তিক’ ধারণায় মহিমান্বিত করাকে বুঝায় না, তবে এই বাস্তবতা সম্পর্কে চূড়ান্ত সম্মতি প্রদান করে যে ধারণা নিজেই (লাকাঁনিয়ান ভাষায় বলা যায়) ‘সার্বিক’ নয়। এই অর্থে আমরা থিসিটিকে পুনরাবৃত্তি করতে পারি যে হেগেলেই প্রথম ‘উত্তর-মার্কসবাদী’ যিনি নির্দিষ্ট ফাটলের পরিসরকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন যা পরবর্তীতে মার্কসবাদীদের দ্বারা ‘জোড়া লাগানো’ হয়েছিল।

হেগেলের ‘পরম জ্ঞানের’ মধ্যে রয়েছে ধারণাগত সর্বাত্মকবাদ যা প্রতিটি আকস্মিক পরিস্থিতিকে গ্রাস করে, এই ধরনের বোঝাপড়া অনিবার্যভাবে হেগেলের চিন্তার বিরোধী। হেগেলের প্রতি এই ধরনের বোঝাপড়া হচ্ছে তাকে খুব দ্রুত মেরে ফেলা । এটি ঠিক সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই জারুজেলস্কির পোল্যান্ডে টহলরত সৈনিককে নিয়ে সুপরিচিত কৌতুকের  মতো। সেই সময়ে সামরিক টহলকারীদের কারফিউ (রাত দশটার) পরে রাস্তায় হাঁটা লোকেদের উপর কোন ধরনের সতর্কতা ছাড়াই গুলি করার অধিকার ছিল। টহলরত দুই সৈন্যের একজন দশটা বাজার দশ মিনিট পূর্বে কাউকে তাড়াহুড়ো করে যেতে দেখে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে। যখন তার সহকর্মী তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে কেন  লোকটিকে গুলি করে, যেহেতু দশটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকি। তখন সে উত্তর দেয়: ‘আমি সেই লোকটিকে চিনতাম, সে এখান থেকে অনেক দূরে থাকত এবং কোনো অবস্থাতেই দশ মিনিটের মধ্যে সে তার বাড়িতে পৌঁছাতে সক্ষম হবে না, তাই এটি খুব সাধারণ বিষয় যে আমি তাকে এখনি গুলি করেছি।’  হেগেলের ‘যুক্তিবাদের’ সম্ভাব্য সমালোচকরা ঠিক এভাবেই এগিয়ে যান, তারা পরম জ্ঞানের নিন্দা করেন ‘দশটা বেজে যাওয়ার আগে’, অর্থাৎ হেগেলের দর্শনের নিকট না পৌঁছেই। এজন্য তাদের পর্যালোচনার মধ্যে নিজেদের পূর্বধারণা ছাড়া অন্যকিছুকে খন্ডন করতে দেখা যায়না।

এই বইয়ের লক্ষ্য তাই ত্রিমাত্রিকঃ

  • লাকাঁনিয়ান মনোবিশ্লেষণের কিছু মৌলিক ধারণাকে একটি ভূমিকা হিসাবে পরিবেশন করা। ‘উত্তর-কাঠামোবাদী’ পরিসরের অন্তর্ভুক্ত হিসাবে লাকাঁর যে বিকৃত চিত্র রয়েছে তার বিপরীতে বইটিতে ‘উত্তর-কাঠামো’-এর সাথে তার আমূল বিচ্ছিন্নতাকে প্রকাশ করা হয়েছে। লাকাঁনিয়ান অস্পষ্টতাবাদের বিকৃত চিত্রের বিপরীতে, এটি তাকে যুক্তিবাদের সমগোত্রীয় হিসেবে খুঁজে পায়। লাকাঁনিয়ান তত্ত্ব সম্ভবত আলোকায়নের সবচেয়ে সমসাময়িক র‍্যাডিকাল সংস্করণ।
  • হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতাকে লাকাঁনিয়ান মনোবিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটি নতুন পাঠ প্রদান করে একধরনের ‘হেগেলের কাছে প্রত্যাবর্তনকে’ বাস্তবায়িত করা। একজন ‘আদর্শবাদী-মনিস্ট’ হিসেবে হেগেলের বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণরূপে বিভ্রান্তিকর। হেগেলের মধ্যে আমরা এখনো যা পাই তা হচ্ছে ভিন্নতা ও আকস্মিকতার জোরালো সমর্থন। ‘পরম জ্ঞান’ নিজেই একটি নির্দিষ্ট মৌলিক ক্ষতি স্বীকৃতির নাম ছাড়া অন্য কিছু নয়।
  • কিছু সুপরিচিত, ধ্রুপদী প্রসঙ্গের (কমোডিটি ফেটিশিজম ইত্যাদি) একটি নতুন পাঠের মাধ্যমে ভাবাদর্শ তত্ত্বে অবদান রাখা। একইসাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লাকাঁনিয়ান ধারণাকে ব্যবহার করা যা আপাতদৃষ্টিতে ভাবাদর্শ তত্ত্বের জন্য কিছু দেওয়ার নেই। এগুলো হচ্ছে ‘কুইল্টিং পয়েন্ট’ (‘গৃহসজ্জার বোতাম’), সাবলাইম অবজেক্ট, উদ্বৃত্ত-উপভোগ ইত্যাদি।

আমি মনে করি যে এই তিনটি লক্ষ্য পরস্পরের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। একমাত্র লাকাঁর মাধ্যমেই ‘হেগেলকে বাঁচানোর’ উপায় রয়েছে। হেগেলের লাকাঁনিয়ান পাঠ এবং হেগেলীয় ঐতিহ্য ভাবাদর্শের জন্য নতুন পদ্ধতি উন্মুক্ত করে। এটি কোনো ধরনের ‘উত্তর-আধুনিকতাবাদী’ ফাঁদের (যেমন এইধরনের বিভ্রম রয়েছে যে আমরা এখন ‘ভাবাদর্শোত্তর’ অবস্থায় বাস করি) শিকার না হয়ে আমাদের সমসাময়িক মতাদর্শগত প্রপঞ্চ (যেমন নৈরাশ্যবাদ, ‘সর্বাত্মকবাদ’, গণতন্ত্রের ভঙ্গুর অবস্থা) উপলব্ধি করার অনুমতি দেয়।

 

 

অনুবাদকের টিকা

১) মনোবিশ্লেষণের ভাষায় লিবিডো বা লিবিডিনাল কাঠামো  বলতে জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বিষয় কতৃক প্রভাবিত সার্বিক জৈবিক প্রেষণাকে বোঝায়।

২) হোমিওস্টেসিস বলতে বাস্তুসংস্থানের বিভিন্ন উপাদানের পরিবর্তনের ফলে গ্রহীয় প্রাণ পদ্ধতি তাদের কর্ম ও জীবনযাপনের পদ্ধতিকে পরিবর্তন ঘটিয়ে বাস্তুসংস্থানের সাথে সমতা বজায় রাখার প্রক্রিয়াকে বুঝায়।

 

 

More Posts From this Author:

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!