“হায় ভালোবাসি”, আমাদের করোনাকাল এবং সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম

Share this:

লকডাউনে এখন সময়টাই এরকম – এ এটা শেয়ার করে, ও সেটা শেয়ার করে ইনবক্সে – ভার্চুয়াল ভালোবাসাবাসি। যেমন কয়েকদিন আগে ঢাকাবাসী এক বন্ধু পাঠালো মহীনের ঘোড়াগুলি’র ১৯৭৭ সালের সংবিগ্ন পাখিকুল ও কোলকাতা বিষয়ক অ্যালবামের “হায় ভালোবাসি” গানের নতুন গায়ন। গানটার তিনজন গীতিকারের একজন তাপস দাস বাপী (বাকী দুইজন: রঞ্জন দাশ, তপেশ বন্দোপাধ্যায়) এ সময়ের মহীনের বন্ধুদের (মহীন এখন ও বন্ধুরা) সাথে গাইলেন গানটা মাস দুয়েক আগে।

“সুদিন কাছে এসো/ ভালোবাসি এক সাথে সবকিছুই” . . .।

এই সময়ে, মানে এই যে করোনাভাইরাসের এই ভয়-লাগা, অজানা ভবিষ্যতের আতঙ্কে ভরা বর্তমানে গানটার “কোথাও রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ” এবং তার সাথে “তবুও” মনের ভিতর সম্পর্ক বুনতে থাকে কম্ফোর্ট জোনের ডিসকম্ফোর্ট বা বলা যায়, আরামের মধ্যে অস্বস্থি। আমি আবার শুনি, বার বার শুনি, প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে অনেকবার শোনা গান এই সময়ের কনটেক্সটে কী জানি এক খটকায় আটকায়। আমি ধরতে পারি এবং ধরতে পারি না। কিন্তু এক মায়ার খেলা চলতে থাকে, আগে যেমন চলতো যখন গলা মিলায়ে উঁচু গলায় গাইতাম শব্দগুলা “ডিঙ্গি নৌকা”, “বুনো হাঁস”, “জোছনায় কাশবন”, “ধানক্ষেত সবুজ দিগন্ত” অথবা পিকাসো-ডিলান-আলী আকবর মেশানো ঘোরে “ভোরে কুয়াশায় ঘরে ফেরা (ফিরতে)” উচ্চারণে। আর তারপর, “যখন দেখি ওরা কাজ করে গ্রামে বন্দরে/ শুধুই ফসল ফলায়, ঘাম ঝরায় মাঠে প্রান্তরে/ তখন ভালো লাগে না, লাগে না কোন কিছুই/ সুদিন কাছে এসো, ভালোবাসি একসাথে সবকিছুই” শুনতে-শুনতে, গাইতে-গাইতে “সুদিনে” এসে মনের ভেতরে আটকানো খটকা বললো: ইউটোপিয়া!

হ্যা, “সুদিন” তো ইউটোপিয়ান বা কল্পিত ভালো থাকার দিন, যখন বাস্তবতাই তার উল্টা, ডিসটোপিয়ান। ডিসটোপিয়ানও কল্পিত নৈরাজ্যের চিত্রায়ন, কিন্তু সে তো দেশে দেশে কড়া ব্যবস্থাপনার সর্বব্যাপি নিয়ন্ত্রণ এবং ঢিলা ব্যবস্থাপনা ঢাকতে কড়া দমন-বাস্তবতাকে সহজে দেখায়; বলে, এই যে দেখো, এই কড়া নিয়ন্ত্রণ আর কথা বলতে না পারা, এটাতো ডিসটোপিয়ান, যেমন দেখা যায় জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটি ফোর উপন্যাসে।

উপন্যাস, গল্প, নাটক এসব তো মানুষেরই দেখা আর ভাবনার মিশেল। ইউরোপের ছোট এক দেশের ছোট এক শহরে যখন লিটারেচার আর ভিজ্যুয়াল কালচার পড়ছিলাম, তখন ডিস্টোপিয়ান সাহিত্যের বেশ কিছু উপন্যাস পড়া আর বোঝায় এসে হাজির হয় মিশেল ফুকো, হানা আরেনডট এর ক্ষমতা, স্বৈরাচারিপনার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা যেটা সব কল্পিত নৈরাজ্যময়তা বিশ্লেষণ করার উপায় চেনায়। সেসব তত্ত্বের ভিত্তি অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর ষাট, সত্তর, আশির দশকের পশ্চিমা দুনিয়া। তবে ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস হিসাবে বিখ্যাত অরওয়েলের নাইনটিন এইটি ফোর সহ ইয়েভগানি জমিয়েতিনের উই, আলডোস হাক্সলি’র ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড বা মার্গারেট অ্যাটউডের আ্যা হ্যান্ডমেইডস টেইল  সবগুলার মূল ফোকাস সার্ভেইলেন্স বা নজরদারি। নজরদারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতাকে চুড়ান্ত করে নিজেদের দখলে রাখছে আর সেইসব স্বৈরাচারদের কর্মকাণ্ড নিয়ে যে-ই মন্তব্য করছে বা সত্য বলছে বা প্রশ্ন তুলছে তাদের দেয়া হচ্ছে কঠিন, কঠিনতর শাস্তি। অরওয়েলের নাইনটিন এইটি ফোর য়ে যেমন দেখা যায় কড়া নজরদারির মাধ্যমে উইনস্টন আর জুলিয়ার প্রেম ধরে ফেলে “থট পুলিশ” আর তারপর তাদের এমন চরম শাস্তি দেয়া হয় “মিনিস্ট্রি অফ লাভ” য়ে, যে, উইনস্টন স্মিথ নিজের ভেতর থেকে অংক করা শেখে দুই যোগ দুই পাঁচ; চার নয়।

তো, বাস্তব দুনিয়ায় নজরদারীর কী কারবার চলছে এই করোনাকালে, এই বাংলাদেশে? অসংখ্য মেগা প্রকল্প, উন্নয়ন আর উন্মাদনায় এই দেশে গত বেশ কয়েক বছরে সামাজিক যোগাযোগে গণমাধ্যম হওয়া ফেইসবুকে অনেকেই মত দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় জেলে ঢুকেছেন, কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন আবার অনেকেই শারীরিকভাবে চরম নির্যাতনের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। গত বছর, সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্যদের নির্যাতনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদের খুন হওয়া তো নজরদারির নৃশংসতার উদাহরণই। তারপরও, এই মহামারীকালে, দেশের বিভিন্ন এলাকার নাগরিকরা স্থানীয় পর্যায়ের “নির্বাচিত” ইউনিয়ন পরিষদ নেতাদের ত্রাণের চাল চুরি করা নিয়ে, করোনাভাইরাসের কারণে আরোপ করা লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে পুলিশের লাঠি-পেটা, রাস্তায় লাশ পড়ে থাকা, জরুরী ভিত্তিতে এম্বুলেন্স না পাওয়া এসব নিয়ে ক্ষোভ-রাগ-আভিযোগসহ নানা ধরণের পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন। এসব পোস্টে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান, অন্য রাজনৈতিক দলের এথনোগ্রাফি, রাজনৈতিক অর্থনীতি, করোনা মহামারীর পরের অর্থনীতি ইত্যাদি নানান বিষয়ে মতামত, প্রশ্ন, তর্ক, ফটোগ্রাফ, ভিডিও, লাইভ ভিডিও হচ্ছে।

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে, দৈনিক প্রতিদিনের একজন সাংবাদিক ফেইসবুক লাইভে এসে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান হারুনের ১০ কেজি চালের জায়গায় ৫ কেজি চাল দেয়ার অনিয়ম তুলে ধরায় লাইভের পরপরই নির্যাতনের শিকার হন (বাংলা ট্রিবিউন, ১ এপ্রিল ২০২০)। আবার চিকিৎসকরাও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগিদের চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন এন-৯৫ মাস্ক, পিপিই বা পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট পাচ্ছেন না বলে ফেইসবুকে অভিযোগ করে কর্তৃপক্ষের নজর কেড়েছেন এবং কেউ কেউ সেজন্য কারণ দর্শানো নোটিশ পাওয়াসহ প্রশাসনিক ব্যবস্থারও শিকার হয়েছেন; নজরদারির মাধ্যমে।

দুনিয়াজোড়া সার্ভেইল্যান্সের সুফল দেখানো হয় শত্রুকে চিহ্ণিত করে রাষ্ট্রীয় বা গোষ্ঠীগত অথবা ব্যক্তিগত সুরক্ষা তৈরি করা। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর জর্জ ডব্লিউ বুশ জুনিয়রের নেতৃত্বাধীন সরকার দুনিয়া জুড়ে, গরীব দেশে “ওয়ার অন টেরর” প্রকল্পের মাধ্যমে শত্রু খুঁজতে থাকলো আর দেশে দেশে বেচা-বিক্রি বাড়তে থাকলো স্ক্যানিং মেশিন, মেটাল ডিটেক্টর আর সিসিটিভি ক্যামেরার। এইসব সার্ভেইলেন্স অ্যাসেটের মাধ্যমে, বাণিজ্যের মাধ্যমে, ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের শরীর সাবধান হতে থাকলো। কে সন্ত্রাসী বা কোথায় সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসী কি একটা ভূত না মানুষ, তা জানা বা না-জানার অস্পষ্টতা যাই-ই হোক, আমাদের অফ-লাইন, বাস্তব দুনিয়ায় আমরা ভয় পেতে থাকি, আমরা মেনে চলতে থাকি, আমরা যথা এবং অযথাই ধরা পড়তে থাকি, শাস্তি নির্ধারণ হতে থাকে সিসিটিভি ক্যামেরায় রেকর্ড হওয়া ফুটেজ থেকে।

পূর্ব বা পশ্চিম, গরীব বা বড়লোক দেশের সরকারগুলো বলতে থাকে, এই তো সার্ভেইলেন্স যন্ত্রপাতিতে সিস্টেম চলছে ঠিক-ঠাক; যদিও, কোন দেশই তার টার্গেট সন্ত্রাসীদের ধরতে শতভাগ সফল হতে পারে নাই, এখনো। কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যায্য ক্ষোভ, ন্যায্য আন্দোলন, ন্যায্য দাবি সন্ত্রাস হিসাবে সরকারি খাতায় তালিকাভূক্ত হয়েছে। সম্ভাব্য ভয়ঙ্কর নির্যাতনের ভয়ে ন্যায্য আন্দোলনের শরীরগুলা গুটায়ে গেছে, বাধ্য শরীরে পরিনত হয়েছে। সার্ভেইলেন্স বা নজরদারির যন্ত্রপাতি ক্যামেরার মাধ্যমে এভাবে সিস্টেম চালানোর  “মাস সার্ভেইল্যান্স” কৌশলে যে ক্ষমতা পরিচালিত এবং কার্যকর হয়,তাকে মিশেল ফুকো ব্যাখ্যা করেছেন “ডিসিপ্লিনারী পাওয়ার” হিসাবে; যে ক্ষমতা অবাধ্য, দ্রোহী মানুষদের সিস্টেমের বাধ্যগত, অথর্ব শরীর বা “ডোসাইল বডি”তে পরিনত করতে কাজ করে।

কিন্তু মিশেল ফুকোর নজরদারির মাধ্যমে ক্ষমতা চর্চা’র যে সিস্টেম, যে প্রবল স্বৈরাচারিতার কাঠামো চেনায়, তাতে দেখা যায় না নজরদারির বাণিজ্য, ওই বাণিজ্যের পুঁজি আর পুঁজিঅলাদের বাজার। গত এক দশক ধরে এই নতুন পুঁজি আর পুঁজিঅলারা গোপনে, আড়ালে-আবডালে, নজরদারির মাধ্যমে যে বাণিজ্য করে যাচ্ছে, করোনা কালে তা ভীষণ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, এপারে-ওপারে।

নিউজ স্টেটসমেন্ট’র ২৫ মার্চের লং-রিড প্রতিবেদন “দ্যা রাইজ অফ বায়ো-সার্ভেইলেন্স স্টেট/ অ্যা গ্রিম চয়েস ফেইসেস টুয়েন্টিফার্স্ট-সেঞ্চুরি সোসাইটিস: প্যানোপটিকনস অর প্যানডেমিকস?” জানাচ্ছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় সফল। এসব দেশের সরকার সিসিটিভি ফুটেইজ, মোবাইল ফোন ডেটা, শরীরের তাপমাত্রা মাপার চেক পয়েন্টস, বিমান-রেলের বুকিং, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের তথ্য ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষ যেসব তথ্য দিচ্ছে, সেগুলা থেকে একেবারে ব্যক্তি পর্যায়ে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে বা আক্রান্ত হয়েছে কি-না, জানতে পারছে। ড্রোনও ব্যবহার হচ্ছে করোনাভাইরাস আক্রান্তকে সনাক্ত করার ক্ষেত্রে। ইউরোপে করোনাভাইরাসের কেন্দ্র ইতালির লোম্বার্ডিতে এই প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত করা হচ্ছে কতজন মানুষ দিনে ৫০০ মিটারের বেশি দূর ঘোরাঘুরি করেছে। একই প্রতিবেদন জানাচ্ছে, করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিহ্নিত করার জন্য ব্রিটিশ সরকার টেলিকমিউনিকেশন সার্ভিস অপারেটর ও-টু ইউকে এবং ইই লিমিটেডকে মোবাইল ফোনে মানুষ যেসব ব্যক্তিগত-অব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদান করে তা শেয়ার করার বিষয়ে আলাপ চালাচ্ছে। আমেরিকায় ট্রাম্প সরকারও একই বিষয়ে আলাপ চালাচ্ছে গুগল, ফেইসবুক এবং অ্যাপল’র সাথে। বটে, লক্ষ্য করোনাভাইরাস আক্রান্তকে সনাক্ত করা। কিন্তু সেই সনাক্তকরণের নজরদারি প্রক্রিয়া “ওয়ার অন টেরর” থেকে “ওয়ার অন করোনাভাইরাস”য়ে ঠেকে নিয়ে যাচ্ছে আপনার আমার স্বাধীনভাবে চলাচল, কথাবার্তা, মেশামেশির ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।

ভাবা যেতে পারে এসব তো বিদেশি, বড়লোক দেশের ব্যাপার-স্যাপার। বাংলাদেশের মতো গরীর দেশের দুর্নীতিবাজ গরীব সরকার এসব তো বুঝবে না, করবেও না, তাতে তো কিছুটা বেঁচে যাচ্ছি। কিন্তু কি তাই? এই করোনাকালেই ২৭ মার্চ দ্য ডিইলি স্টার  মতামত বিভাগে প্রকাশ করে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যাপকভাবে নজরদারি করা উচিৎ। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ডেমোগ্রাফি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক আয়শা মাহমুদ এবং হার্ভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথ’র সহযোগি অধ্যাপক ড. ক্যারোলাইন বাকি যৌথভাবে জোর দেন:

অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আত্মবিশ্বাসের সাথে আমরা বলতে পারি যে, স্পষ্ট সিদ্ধান্ত এবং দ্রুত গতিতে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর থাকা চাপ কমানোর সবচে ভালো উপায়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষের উচিৎ হবে শিগ্গিরই নজরদারির ক্ষমতা বাড়ানো যাতে তারা ভাইরাসের বিস্তার কোন মাত্রা পর্যন্ত গেছে জানতে পারে . . .।

এরপর ৭ এপ্রিল অপর ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন  জানায়, বাংলাদেশের একটা স্টার্ট আপ মাস্কপরাদের সনাক্ত করতে একটি সার্ভেইলেন্স অ্যাপ তৈরি করেছে।

করোনাভাইরাস গত বছরের শেষ দিকে চীন দেশে আবির্ভুত হয়ে পুরা দুনিয়ার অর্থনীতি, সামাজিক যোগাযোগ, আচরণ-ব্যবহারে তুমুল পরিবর্তন নিয়ে আসছে। পুরা দুনিয়ায় যেমন, বাংলাদেশেও তাই। বেশিরভাগ মানুষই, যাদের টাকা খরচ করে ইন্টারনেট এর সংযোগ এবং গতি কেনার সামর্থ আছে, সবাই কমবেশি ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ভাব প্রকাশ করছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করছেন এবং ব্যাপক ব্যাপকভাবে ভিডিও এবং ফটোগ্রাফ প্রকাশ করছেন, নিজের, পরিবারের, বন্ধুদের, সহকর্মীদের যার বেশিরভাগই ফেইসবুকে; ইনস্ট্রাগ্রাম, টুইটার এবং আরো আরো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর গুগল সার্চ ইঞ্জিনে এটা খুঁজে, সেটা খুঁজে পড়ছে, খাবার বা বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস অর্ডার করে; নিচ্ছে, ব্যস্ত থাকছে। আমাদের আগোচরে, আমাদের সচেতনতার আবডালে, আমরাই অনলাইনে রেখে দিচ্ছি নানা তথ্য।

জেসন পল হুইটেকার তার গত বছর প্রকাশিত বই টেক জায়ান্টস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, অ্যান্ড দ্য ফিউচার অফ জার্নালিজম  বইয়ে খোলাসা করেন কীভাবে “বিগ টেক” কোম্পানি গুগল, ফেইসবুক, অ্যাপল, আমাজন, মাইক্রোসফট গত এক দশকে শীর্ষে থাকা “বিগ অয়েল” কোম্পানিগুলোকে সরিয়ে শীর্ষ ধনীতে পরিনত হয়েছে। একবিংশ শতকের শুরুর দশকে মার্কিন তেল-গ্যাস করপোরেশন এক্সন-মবিল, ব্রিটিশ বিপি-পিএলসি, রাশিয়ান গ্যাজপ্রম, চীনের পেট্রো চায়না এবং ডাচ-ব্রিটিশ কোম্পানি রয়্যাল-ডাচ শেল – এই পাঁচ কোম্পানি ২০১৫ সাল থেকে রাজত্ব হারাতে থাকে “বিগ টেক” কোম্পানিদের কাছে। ওই পাঁচ প্রযুক্তি কোম্পানির প্রত্যেকের সর্বাধিক বাজার মূলধন বা ক্যাপিটাল ৫০০ বিলিয়ন থেকে প্রায় ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাথা ঘুরায়ে দেয়া অর্থকড়ির এই পরিমান মনে তো প্রশ্ন জাগায়, উস্কায় “কীভাবে?”,  যখন আমাদের নিত্যদিনে ফেইসবুক আর গুগল ব্যবহার করছি বিনাপয়সায়। ওরা এত টাকার মালিক, তাহলে?

স্যোশাল সাইকোলজির শিক্ষক, গবেষক, শোশানা জুবফ আমাদের মগজে ছটফট করা প্রশ্নগুলার উত্তর হাজির করেন তার “সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম” তত্ত্বের মধ্য দিয়ে। ২০১৪ সালে তার অ্যাকাডেমিক আর্টিকেল “অ্যা ডিজিটাল ডিক্লারেশন: বিগ ডেটা অ্যাজ সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম”য়ে প্রথম সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম টার্ম ব্যবহার করেন। ২০১৫ সালের আর্টিকেল “বিগ আদার: সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম অ্যান্ড দ্য প্রসপেক্টস অফ অ্যান ইনফরমেশন সিভিলাইজেশন” য়ে বড় প্রযুক্তি কোম্পানি গুগল, ফেইসবুক, এসব কীভাবে গোপন নজরদারীর মাধ্যমে ইউজার বা প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করছে যা তথ্য সভ্যতার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত দ্য এইজ অফ সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম: দ্য ফাইট ফর অ্যা হিউম্যান ফিউচার এট দ্যা নিউ ফ্রন্টিয়ার পাওয়ার  বইয়ে জুবফ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন নজরদারির মাধ্যমে গড়ে ওঠা নতুন পুঁজি আর এর মাধ্যমে নতুন পুঁজিঅলাদের বাণিজ্য কীভাবে গড়ে তুলছে সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম, যেটা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত অর্থনীতিকে নতুন এক আদল দিচ্ছে। বদল ঘটছে পুঁজির কাঁচামালের।

জুবফের ব্যাখ্যায় জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটিফোরর নজরদারি কর্তপক্ষের প্রধান বিগ ব্রাদার (বহুল প্রচলিত শব্দমালা “বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং য়্যু”) ধরা দেন “বিগ আদার” হিসাবে। সেইসব বিগ ব্রাদার, বিগ আদার, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলা যেসব ব্যক্তিগত অনুভূতি, যা আমরা সহজে অন্য কাউকে বলতে চাইনা এবং ফেইসবুক আর গুগলকে বিশ্বাস করে প্রকাশ করি যেহেতু তারা প্রাইভেসি সেটিংয়ের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যক্তিগততাকে ব্যক্তিগত রাখার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে, সেইসব ব্যক্তিগত অনুভূতির তথ্য আমাদের না জানিয়েই নিয়ে নিচ্ছে রোজ রোজ। জুবফ বলছেন, আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে তারা “হাইজ্যাক” করে তাদের বাণিজ্যের পুঁজি করছে।

এসব হাইজ্যাক করা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার তথ্যকে জুবফ চিহ্ণিত করেন “বিহেভিয়োরাল ডাটা” হিসাবে। তার মতে, এসব ডাটায়-মানে একটা লাইক, ডিজলাইক বা বিস্ময়বোধক, হাসি বা কান্নার ইমোজি প্রকাশ, অথবা রাজনৈতিক মত প্রকাশ করা, অথবা যৌন পরিচয় বা সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ করা অথবা সেলফি বা পারিবারিক, বন্ধু-বান্ধবের ছবি প্রকাশ করা, আমাদের এসব তথ্য আমাদের আচরণ সম্পর্কিত ধরণ-ধারণকে প্রকাশ করে। তার মতে, গুগল-ফেইসবুক প্রতিনিয়ত তাদের সার্ভিস ভালো করার নামে আমাদের কাছ থেকে যেসব তথ্য নিচ্ছে, সেইসব তথ্যের বাইরে আরো অনেক তথ্য থেকে যাচ্ছে, যেগুলোর সাথে প্রাইভেসি সেটিংস বা সার্ভিস ডেভেলপমেন্টের আদতে কোন সম্পর্ক নাই। যেহেতু একটা ভার্চুয়াল আইডেন্টিটি তৈরি করার মাধ্যমে আমরা এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে ঢুকি, তাই সব তথ্যই তাদের কাছে যাচ্ছে, আমরা চাই বা না চাই। সচেতন থাকি বা না থাকি। এইসময়ের বিগ ব্রাদার প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ওইসব বাড়তি তথ্য গোপনে গোপনে বিক্রি করার জন্য সংগ্রহ করছে, প্রতিনিয়ত; জুবফ যাকে বলছেন “বিহেভিরিয়ল সারপ্লাস”।

একটা উদাহরণ দিয়ে জুবফ বুঝাচ্ছেন আচরণের উদ্বৃত্ত তথ্য এভাবে; যেমন: কেউ একজন ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলো, আমি তোমার সাথে সাতটা বা পৌনে সাতটায় দেখা করবো রাতের খাবার খাওয়ার জন্য এবং এরপর একটা অনুভূতি প্রকাশক ইমোজি ব্যবহার করলো। এই ইমোজি ব্যবহার অথবা এই যে রাতের খাবার সময় উল্লেখ করে শেয়ার করা এর সাথে এই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলার সার্ভিস উন্নয়ন বা প্রাইভেসি পলিসি বা আর যা কিছু ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা এবং উন্নয়নের কথা বলে এবং বলছে, তার সাথে সম্পর্ক নাই। জুবফের মতে, অনলাইনে আমাদের এইসব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রকাশকে বলা যায় আচরণগত তথ্য, যেগুলো ফাইভ-ফ্যাক্টর পার্সোনালিটি মডেল ব্যবহারের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয় ব্যক্তি কোন সময়ে কী খাবে, পরবে, বিনোদন করবে বা সময়, স্থান, ভৌগলিক সীমা রেখায় কি বিষয়ে সোচ্চার হন, কি বিষয়ে সমর্থন জানান, সমকামী কি-না বা ক্যুয়ার কি-না, এরকম নানা নানা ক্যাটাগরিতে আলাদা হয়। সেইসব ক্যাটাগরীর কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত হয় মার্কেটে বিক্রিযোগ্য ক্যাটাগরির পণ্যের পূর্বাভাস, চিহ্নিত করা হয় ক্রেতা আর ক্রেতার চাওয়া, চাহিদা, তৈরি করা হয় চাহিদা আর তারপর যোগান যায় অবস্তুগত তথ্যের রূপান্তরে হওয়া বস্তুগত পণ্য, আবার ভার্চুয়াল পণ্য।  অনলাইনে আমাদের আচরণগত উদ্বৃত্ত তথ্য থেকে মেশিনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া প্রেডিকশন পণ্য বিক্রি হয় বিভিন্ন কোম্পানির কাছে; হতে পারে সেটা রেস্টুরেন্ট, প্রসাধন কোম্পানি, ভোট নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যেমন: ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা, হতে পারে বিক্রিযোগ্য যে কোন কিছু, যার নিখুঁত পূর্বাভাষ নিশ্চিয়তা দিবে বাণিজ্যে নিশ্চিত লাভের।

ডাচ কমিনিউকেশন মিডিয়া ভিপ্রো’র সাথে এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে জুবফ ব্যাখ্যা করেছেন এইসব প্রেডিকশন বা পূর্বাভাষ শুধু ফ্যাশন, খাবার-দাবার বা এইরকম ইন্ডাস্ট্রির সাথেই যুক্ত না, এইসব পূর্বাভাষ স্বৈরাচার সরকার পরিচালিত দেশগুলোর সরকারের কাছে বিক্রি করে তাদের স্বৈরাচারিপনাকে আরো কঠোর হতে সহায়তা করছে পূর্বাভাস তৈরি করা সফটওয়্যার কোম্পানিগুলা যারা কাঁচা মাল কিনে নিচ্ছে ফেইসবুক, গুগল, অ্যাপলের কাছ থেকে। গুগল আর্থ নামক কম্পিউটার প্রোগ্রাম যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআএ’র নজরদারির জন্যই তৈরি করা হয়েছিল, তা উল্লেখ করে জুবফ তথ্য জানান, ফেইসবুকে আপলোড করা ফটোগ্রাফের বিশ্লেষণ করা কোম্পানি থেকে তথ্য কিনে চীন উইঘুর মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন জারি রেখেছে এবং গত বছরের হংকংয়ে গণতন্ত্রের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনও দমন করেছে ফটোগ্রাফে থাকা মুখের মাসল, চেহারার আকৃতি-ধরণ বিশ্লেশষনের মাধ্যমে।

অর্থাৎ, আমরা বিনামূল্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে আমাদের ব্যক্তিগত যেসব তথ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা হলো সার্ভিল্যান্স ক্যাপিটালিজমের কাঁচা মাল, সেইসব কাঁচামাল বিভিন্ন ধরণের উদ্দেশ্যঅলা বানিজ্যিক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে বিগ আদার প্রযুক্তি কোম্পানীগুলো বাণিজ্য করে যাচ্ছে, যার অনেক উদ্দেশ্যের একটা হলো, তা দিয়ে আমাদের প্রতিরোধকে দমন করার জন্য স্বৈরাচারি সরকারকে শক্তিশালী করা। অর্থাৎ, গোপনে গোপনে নজরদারি করে হাইজ্যাক করে নেয়া আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য পুর্বাভাষ ম্যাকানিজমের ভিতরে ঢুকে পণ্য হচ্ছে, আর তাতে কোম্পানিঅলারা বেচা-বিক্রি করে ধনী হচ্ছে, আবার স্বৈরাচারী সরকারগুলা আরো কড়া স্বৈরাচার হচ্ছে।

 

এই করোনাকালে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়া আমাদের রাগ-ক্ষোভ, আহাজারি, চিৎকার, রাজনৈতিক নেতাদের ত্রাণচুরি অথবা স্বাস্থ্য সেবার ব্যর্থতা নিয়ে মতামত – এইসবই ফেরত আসতে পারে আমাদের দমন করার উপাদান হিসাবে, নিকট ভবিষ্যতে, দূর ভবিষ্যতে। অফ-লাইনের “বিগ ব্রাদার” অন-লাইনের “বিগ আদার”দের কাছ থেকে গোপনে গোপনে সংগ্রহ করা আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলাকে কিনে নিবে।  আমাদেরই জমা দেয়া ট্যাক্সের টাকায়। সেগুলো আবার প্রয়োগ হবে আমাদেরই দমন করার জন্য।

“হায় ভালোবাসি”!

 

 

ইচ্ছা হলে পড়তে বা দেখতে পারেন:

Kulwin , Noah. “Shoshana Zuboff on Surveillance Capitalism’s Threat to Democracy”. New York Magazine. February 24, 2019.

nymag.com/intelligencer/2019/02/shoshana-zuboff-q-and-a-the-age-of-surveillance-capital.html

Shoshana Zuboff on Surveillance Capitalism. VPRO documentary. December 20, 2019.

www.youtube.com/watch?v=hIXhnWUmMvw

Age of Surveillance Capitalism: “We Thought We Were Searching Google, But Google Was Searching Us”. Democracy Now. March 1, 2019. www.youtube.com/watch?v=Vo6K-bPh39M&list=FLI41d5kYnAxemutnglhq_-g&index=2&t=7s

Zuboff, Shoshana. “A Digital Declaration”. Faz.net. 2014. www.faz.net/aktuell/feuilleton/debatten/the-digital-debate/shoshan-zuboff-on-big-data-as-surveillance-capitalism-13152525.html

Zuboff, Shoshana. “Big Other: Surveillance Capitalism and the Prospects of an Information Civilization”. Journal of Information Technology. March 1, 2015. journals.sagepub.com/doi/10.1057/jit.2015.5

 

সংগ্রহ করে বা খরিদ করে পড়তে পারেন:

Zuboff, Shoshana. The Age of Surveillance Capitalism: The Fight for a Human Future at the New Frontier of Power. Public Affairs. 2019.

 

 

 

Shameema Binte Rahman is an experienced journalist, editor of Rottenviews.com; also does independent research and critics visual arts. Currently, she has been working on a visual art project about the postcolonial identity of the Santals, a marginalized ethnic group from Bangladesh. Published book: Toxic Lala, a short stories collection (2010; Publisher: Shuddashar) and Bangladeshe Juddhaparadh: Koekti Onusandhani Protibedon/ A collection of some investigative reports on War Crimes in Bangladesh (2008; Publisher: Shrabon Prokashani).

 

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!