শব্দের অর্থকে উত্তরণ করে ব্যাঞ্জনা ও ছন্দের মাধ্যমে এক সুরিয়াল জগতের সন্ধান পাই

Share this:

প্রশ্নোত্তর:

শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কিভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবে শের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?

অনুপ রেজ: কবিতা লেখা ও চর্চা করার আবহাওয়া ছোটবেলা থেকে পরিবারে দেখেছি। বাবা ক্লাসিকা বিশ্ব-সাহিত্যে ডুবে থাকতেন। বড়দা ফরাসী কবিদের ভক্ত ছিলেন। কবিতা না লিখে ইন্টেলেকচুয়াল হওয়া যায় না সেই ধারনা পোষণ করতাম। তাই আমিও কবিতা লিখতে ধরি।

লিখতে গিয়ে বুঝতে পারি মনের এক অচেনা দিক আছে যা দৈনন্দিন জীবনে প্রকাশ পায়না। ভিতরের যে অনিভুতিগুলো সূক্ষ্ম এবং সাদা-মাটি জীবনের ঊর্ধ্বে মনকে তুলে নিয়ে যেতে পারবে সেগুলো প্রকাশের জন্য কবিতার প্রয়োজন আছে অনুভব করি। শব্দের অর্থকে উত্তরণ করে ব্যাঞ্জনা ও ছন্দের মাধ্যমে এক সুরিয়াল জগতের সন্ধান পাই। এইভাবে নিজের মধ্যে এক অচেনা জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এই “অচেনা আমিকে” আবিষ্কারের ইচ্ছাই কবিতা লেখার সর্বপ্রথম কারণ হয়ে ওঠে।

 

শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষা শৈলির বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে শুনতে আগ্রহী।

অনুপ রেজ: আমার নিজের ভিতর যে সৃষ্টি ক্ষমতা আছে তাকে চেনার  এবং “অচেনা আমিকে” আবিষ্কারের ইচ্ছাই আমার কবিতা লেখার মূল উদ্দ্যেশ্য। রাজনৈতিক জীবনের ঘটনা কিংবা কবিতার বাজারে কি চলছে তার প্রভাব আমার লেখায় বলতে গেলে নেই।

অবশ্য সমসাময়িতার রূপ বিভিন্ন স্তরের। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে কি পরিবর্তন ঘটছে এবং তার ছাপ কাব্য সৃষ্টিতে কি ভাবে পড়েছে সেটা এক স্তরের সমসাময়িকতার দ্যোতক। আবার মানুষের জ্ঞানের পরিধি কত বাড়ছে এবং মানুষের মূল্যবোধ কতখানি আত্মকেন্দ্রিয়তা ছাড়িয়ে বিশ্ব মানবিকতায় পরিণত হচ্ছে সেটা অন্য স্তরের সমসাময়িকতা। আমার কবিতায় এই দ্বিতীয় স্তরের সমসাময়িকতার প্রাধান্য। দেশ, কাল, স্থান, প্রতিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা উত্তরণ করে যে চেতনা আত্মবোধ ও উচ্চতর অভিব্যক্তির সন্ধ্যানী সেই বিশ্বমানবিক চেতনাই আমার কবিতায় সমসাময়িকতার স্বরূপ।

তবে, প্রতিটি পদক্ষেপেই মানুষের জীবন সংগ্রামে লিপ্ত। প্রতিটি অভিব্যক্তির স্তরেই রয়েছে নানা প্রকারের বাঁধা বিপত্তি। সর্বত্র একই অন্য ধরনের  স্বাধীনতা হরণের শক্তি সর্বদাই ক্রিয়মাণ। মানুষের অন্তর শক্তির কাজই হচ্ছে সব প্রতিরোধকে অতিক্রম করে উচ্চতর অভিব্যক্তির পথে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রকৃতি ও পরিবেশের বন্ধন থেকে জীবনকে মুক্ত করে চৈতন্যের নতুন স্তরে পৌঁছিয়ে দেওয়াই স্বাধীনতার সর্বপ্রথম প্রয়োজন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে জীবনের দ্বন্দ্বের চিত্রও সর্বদাই পরিবর্তনশীল। মানুষের জীবন স্বাধীনতার কি সুযোগ পাবে তা  এই সংগ্রামের তীব্রতার উপর নির্ভরশীল। তাই বিভিন্ন অভিব্যক্তির স্তরে সংগ্রামে লিপ্ত বিশ্বমানবের জীবন আমার কাব্যের মুখ্য বিষয়। সেই দিক থেকে বিচার করলে আমার কবিতায় রাজনৈতিক বিষয়বস্তু অনেক।

 

শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল-অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

অনুপ রেজ: সাহিত্যে অশ্লীলতার প্রশ্ন সমাজ ও সংস্কৃতি নির্ভর। সমাজের রাজনীতি, সমাজনীতি , আর ধর্ম রক্ষকরাই শ্লীলতার রক্ষক।যে সমাজে সাধারন মানুষ ক্ষমতাবানদের নজর থেকে মুক্ত সেখানে স্বাধীনতা প্রকাশের সুযোগ ও শ্লীলতার গণ্ডি টপকানোর উপায় অনেক বেশি।

শ্লীলতা সাধারণত যৌনতা সম্পর্কিত আলোচনার বিষয়। যে সমাজে যৌনতার প্রকাশের স্বাধীনতা মরালীটির বাঁধনছাড়া সেখানে অশ্লীলতার ধারনাও বাঁধনহীন। যৌনতা যেখানে বাজারের পণ্যে পরিণত সেখানে সাহিত্যে অশ্লীলতার পরিমাণ বেশি।এখানে প্রশ্ন করা যায় যৌনতা সম্পর্কিত বিষয়কে সাহিত্যের মধ্যদিয়ে প্রচার ও উপভোগ করার আনন্দ কি মানুষকে তার উচ্চতর অভিব্যক্তির পথে এগিয়ে দিতে  পারবে? মানুষের সঙ্গে অন্য পশুদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে মানুষ উচ্চতর মননের জীব।তার চৈতন্যের অভিব্যক্তির সম্ভাবনা বহু উচ্চতরের।মানুষকে উচ্চতর পথের সন্ধান না দিয়ে যৌনতার পথ খোঁজার স্বাধীনতা দেখালে কি সেই সমাজে মানসিক বৈক্লব্য বাড়বে না?

আমি যৌনতার পথকে প্রবৃতির পথ বলি। আমার কাছে এটা অভিব্যক্তির নিম্নতর পথ। অন্ধকারে নামবার ইচ্ছা। অন্তরের যে আলো এই অশ্লীলতাকে অতিক্রম করে মানুষকে দৈহিক অনুভবের জগত থেকে তুলে  মানসিক সৌন্দর্যের জগতে জীবজগতকে ভালবাসতে শেখাবে, আমার মতে, মানুষের জীবনে তারই প্রয়োজন বেশি। দেহজাত প্রকৃতির অন্ধকারে ডুব দিলে এই সুন্দর জগতের সন্ধান পাওয়া যাবে না।

এইভাবেই আমি শ্লীলতা ও অশ্লীলতাকে বিচার করি।

 

শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আাপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/ বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যেকোনো সময় ধরে হতে পারে, আপনার যেমন ইচ্ছে।

অনুপ রেজ: বাংলা কবিতা পড়ার বেশি অভ্যেস ছিলোনা। অল্প মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জিবানন্দ ছাড়া আধুনিক কবিতা একটু আধটু ছুঁয়েছি। বিদেশে আসার  পর থেকে গত পঞ্চাশ বছর বাংলা কবিতার সঙ্গে প্রায় কোন যোগ নেই (নিজে যেটুকু লিখেছি তা ছাড়া)। বাংলা কবিতার মূল্যায়ন করার জন্য যে জ্ঞ্যান ও পরিচিতির দরকার তা আমার সত্যি নেই।

আমি ইংরেজিতেই বেশী লিখেছি। কলকাতায় থাকাকালীন যা বাংলায় লিখেছি তাতে আমার অস্তিত্ববাদী মনের ছায়া গভীর। অর্থহীনতা, শূন্যতা, আর স্বাধীনতা হরণকারী সমাজ ব্যবস্থা মনকে অন্ধকারের দিকেই টেনেছে বেশী। অন্যদের লেখা আধুনিক কবিতা যা পড়েছি তাতে হতাশার ছবিই আছে  মনে হয়েছে। এদের মধ্যে  যারা বাজারে নাম করেছেন তাদের কবিতায় আটপৌড়ে জীবনের “ক্লিসে” , অথবা দৈহিক প্রেম,দুর্যোগময় প্রকৃতি ও পরিবেশ, কিংবা  রাজনৈতিক দলের মানিফেস্টো চোখে পড়েছে। এগুলো আমার কাব্যানুভুতিকে কোনভাবে নাড়া দিতে পারেনি।

রবীন্দ্রনাথের লেখাই বাংলা কবিতার সবচেয়ে সুন্দর প্রকাশ। বাংলা ভাষার সাবলীলতা ও সৌন্দর্যের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বাংলার মাঠ, ঘাট, আকাশ বাতাস, জল নদী, পশুপাখি ও ঘাস পাতা মনকে আনন্দ জগতে পৌঁছিয়ে দেয়। লাঙ্গল ঠেলা চাষির জীবনের কথা যেমন কবিতায় ধরা আছে তেমনি অন্তর জগতের অন্তর্যামীর আরাধনাও শুনতে পাওয়া যায়। বৃহত্তর অস্তিত্বের সঙ্গে সাধারন মানুষের অস্তিত্বের যে যোগ তা অনুভূতির সূক্ষ্ম তুলি দিয়ে বাঙালীর মনে সুন্দর ভাবে এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথ বাহ্যজগত ও অন্তরজগতকে বিশ্বজগতের ও বিশ্বমানবের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে সাহায্য করেছেন।

অবশ্য অন্তর শক্তিকে উনি যে ধার্মিক চিন্তার বিন্যাসে রূপ দিয়েছেন, সেভাবে আমি অন্তর আলোকে দেখিনা। হিন্দু সমাজের ছাপ রবীন্দ্রনাথে আছে। একে উত্তরণ করে বাংলা কবিতাকে আর উচ্চতর পথে বিশ্বকাব্যের আসরে তুলে নিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা নিশ্চয়ই আছে। আমার মতে, বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর কবিতার ভাষা।

 

শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন

অনুপ রেজ: গ্যেটের ফাউস্ট দেবব্রত রেজ (আমার বাবা) মূল জার্মান থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। বইটা ২০১৪ সালে ঢাকায় প্রকাশিত হয় (ঊ পি এল)। আগে ইংরেজিতে পড়েছিলাম। বাংলায় পড়ে ফাউস্টের মর্ম অনেক বেশী বুঝতে পারলাম। পরিচিত চিন্তা ও জীবনের শাশ্বত দ্বন্দ্বকে ঘনিষ্ঠভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ হোল।  বইটা আমার সাম্প্রদায়িক পাঠের লিস্টে।

এই বইটার মধ্যে বাংল ভাষার এক নতুন  রূপ দেখলাম। এতে  ভাষার শিল্পকলা ও রসময়তার মধ্যে দিয়ে  বাংলা ভাষার সৌন্দর্য নতুনভাবে প্রকাশ পেয়েছে। পড়লে মনে হয় এ যেন বাঙালীরই জীবনের কাব্য নাট্য। বাংলা ভাষা যে পৃথিবীর অন্য দেশের প্রকৃতি, পরিবেশ ও সংস্কৃতিকেও  সুন্দর ভাবে রূপ দিতে পারে তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলা ভাষা যে স্থান কাল উত্তরণ করে শাশ্বত মনের ভাষা বইটা তারই প্রমাণ। যে ভাষা ধান চাষ করা শস্য শ্যামল সোনার বাংলার দৃশ্যকে , গ্রামের সুন্দরী বধূর প্রেমাক্ত দৃষ্টিকে রূপ দেয় ,কিংবা ফুল ফলে সাজানো আরাধনার বেদিতে সত্য ও সুন্দরের উপাসনা করতে আহ্বান জানায়, সেই ভাষাই আবার আল্পস পর্বতের কোলে ধর্মভীরু জার্মান মেয়ের ভালবাসার খোঁজে পতিত জীবনের কাহিনীতে  মহাকাব্যের ভাষায়  পরিণত হতে পারে। লাইপৎসীজ শহরে মদের দোকানে মাতলামি, কিংবা ডাকিনীদের রন্ধনশালায় ভোজবাজীর কবিতা চেনাশোনা মানুষের জীবনের কাব্য মনে হয়! পড়তে ভালো  লাগে।

বইটা পড়লে বোঝা যায় বাংলা ভাষা বিশ্ব সংস্কৃতির ভাষা হিসেবও সাফল্য লাভ করার যোগ্য।

 

 

কবিতা:

কবির সাথে মানুষের সাক্ষাৎ

সমুদ্রসৈকতে মাঝিদের সাথে মানুষের জীবন ও ভ্রমণ দৃশ্য

জন্ম -মৃত্যু, জয়-পরাজয়, স্বাধীনতা- পরাধীনতা,

স্বপ্ন ও বাস্তব

প্রকৃতি ও পরিবেশ

জ্ঞান, বুদ্ধি, ইচ্ছা

ধর্ম ও অধর্ম

বিশ্বাস ও অবিশ্বাস

এই সব নিয়ে আলোকিত জীবনের খোঁজে কবির কাছে মানুষের প্রশ্ন

 

মানুষ

সূর্য্যকে প্রদক্ষিনরত গ্রহ মাঝে,

জীব জীবানু, কীট পতঙ্গঁ আর পশুপাখীদের সাথে

শত শত কোটি মানুষের জন্ম আর মৃত্যুর নাটকে

জন্ম মোর

পৃথিবীর ইতিহাসে;

প্রতিদিন ক্ষুধা, শ্বাস-প্রশ্বাস, জিবীকা সন্ধান,

তাঁরই মাঝে হিংস্র জীব আর চতুর প্রানীর আক্রমন

বাঁচার প্রচেষ্টা তুলিয়া হাতিয়ার,

শিখেছি বিবিধ কৌশল,

করেছি জ্ঞানার্জন,

পৃথিবীর পশুদের সাথে খুঁজিয়াছি শান্তি, বাসস্থান;

জানলার পাশে এসেছে আলো,

ফুল পাখী বিবিধ রঙের সাজে

বেড়ে গেছে ইন্দ্রিয়ে

স্বপ্ন ও বাস্তব;

দেখেছি সুন্দর;

স্পর্শ করেছি আনন্দ;

চিন্তায়, ঘ্রানে এসেছে স্পৃহা,

বিচিত্র পৃথিবীর স্বাদ;

ইন্দ্রিয়ের দ্বারে দ্বারে স্মৃতি,

যে মানুষ একদিন পৃথিবীতে ছিলো,

আজ নাই, এঁকেছে মুখ;

একইভাবে মহাকাল আসে যায়

বারবার একই কথা বলে যায়

যে আসে,তাকে যেতে হবে,

এখানে নাই কারো বাসস্থান চিরকাল;

জন্ম মানে মৃত্যু হবে,

আনন্দের পর শেষ করিবে আঘাত,

যে শক্তি ভাঙে বিশাল পাথর।

সেই শক্তির ভান্ডার শেষ হলে

পাথরের তলে নিষ্পেষিত হবে জীবকোষ

জন্মের নতুন বীজ জাগিবে সেথায়,

সৃষ্টির এই নিয়ম হতে ছাড় নাই

ব্রহ্মাণ্ডের কোনস্থানে নাই

এর অন্যকোন রূপ

বিধাতার লিখন অমোঘ নির্ভুল।

শৈশবের ক্রীড়া, শিক্ষা, কৌতুহল

সবই নিয়মেতে বাঁধা

মাতৃকোড় হতে নেমে মাটির আশ্রয়ে পেতে

শরীর ও মনের চাই বহু বাস্তব সমাধান;

জল, বায়ু, মাধ্যাকর্ষনে

পতন,ঘর্ষন, অপ্রত্যাশিত ঘূর্ণন,

অশান্ত প্রকৃতির সাথে জীবনের আন্দোলন,

এরই মাঝে ভাব, ভালবাসা,

বিবাহ, বন্ধন, সন্তান, প্রজনন,

ঘৃণা,লোভ, জুগুপ্সা, প্রেম,

দ্বন্দ, ক্ষত, প্রলোভন, হিংসা,

ক্রোধ, আশা, নিরাশা,

বিশ্বাস, অবিশ্বাস, বিদ্রোহ

কিংবা আত্নসমর্পণ;

ক্রম আবর্তমান নাটকের মত

বারবার ঘুরে ফেরে

একইভাবে জন্ম-জন্মান্তরে;

এই ব্রহ্মাণ্ডের লীলায়

জন্ম,মৃত্যু, শোক, দুঃখ, অনুতাপ

সুখ আর আনন্দের সাথে একাকার;

এর থেকে সময়েরও মুক্তি নাই,

অনু, পরমানু, কোষ, কোষান্তর,

কোটি কোটি নক্ষত্রপুঞ্জ,

তারও উর্ধ্বে অনন্ত অনাদি ব্রহ্মাণ্ড

চঞ্ছল ঢেউয়ের তালে তালে,

একই ছন্দে যায়, আসে, আছে… নেই, আছে …… নেই

যা পরিবর্তিত তাই ফিরে আসে অপরিবর্তিত

রুপ নিয়ে বারংবার।

যে জীব পারেনা বুঝিতে নিয়ম,

পারেনা বুঝিতে জীবনের আক্রমন,

হেরে যায় অন্যসব প্রানীদের কাছে

সে লুপ্ত হয় ইতিহাস থেকে;

বুদ্ধিমান মানুষের মাঝে

এই সংগ্রাম আরও তীব্র ও কঠোর,

যে পারেনা চলিতে বুদ্ধিদীপ্ত পথে,

মহাকাল গ্রাস করে তারে;

এইভাবে চলিতেছে জীবনের ইতিহাস,

এককোষী জীবানুর স্তর হতে অভিব্যাক্তি  গড়েছে মানুষ,

চেতনাও এর সাথে জেগেছে ধীরে ধীরে,

অন্ধকার থেকে আলোর মূর্তির মত

 উঠেছে অশরীরি আত্নারদল জীবনের তীরে;

দেহ বয়ে ইচ্ছায় শক্তিতে

জাগায়েছে জীবন উৎসব

চেতনায় স্ফুলিঙ্গঁদল মুহুর্মুহু

জ্বলেছে, নিভেছে

কোষের নিগুড় আদেশে,

তাঁরই সাথে চিন্তা, ভাষা, ভাব

উড়িছে অদৃশ্য মনের আকাশে।

দেহের মৃত্যু হলে চিন্তাও নিভোয়,

যে আত্না নিয়ে মানুষের জীবন

জড়ায় নিজেরে,

তৈরী করে ঘটনা, সংবাদ

লুপ্ত হয় সব একদিন সৃষ্টির আদেশে;

সেই সব আত্নার দল

যারা দলবদ্ধ হয়ে ঘুরেছে

করেছে হানাহানি, খুঁজেছে পৃথিবীর মাটিতে

ঘর বাড়ী দেশ,

শৃঙ্খলে বেঁধেছে নিজেরে;

যে ঘটনার বিন্যাস ইন্দ্রিয়ের দায়ভাগী,

যা আছে মনে হয়,

তা ইন্দ্রিয়ের ছায়াও হতে পারে,

এইভাবে মিশে যায় স্বপ্নের ভিতর বাস্তব।

এরই মাঝে জন্ম মোর,

জানি যে আত্নারদল চারিদিকে ঘোরে

তারা মায়া হতে পারে,

ইন্দ্রিয়ের স্ফুলিঙ্গঁ মাত্র

জমায়িত হয়ে তৈরী করে বোধ, বুদ্ধি, জ্ঞান,

এক দৃশ্যগ্রাহ্য ছবি;

আমি সেই আয়নার জগতে

আলো আর অন্ধকারের ছায়া ছবি হতে পারি;

আছে অথবা নেই এই দুই বিপরীত পরিধীতে

আমার অস্তিত্বের স্থান;

“ইন্দ্রিয়ের বাইরে কে আছে?”

এই প্রশ্ন বারংবার ফিরে আসে মনে,

“মৃত্যুই কি, যারে আত্না বলি তার শেষ?

পদার্থের আকর্ষনে যা তৈরী হয়,

এবং যার আঘাতে সব ভেঙ্গে যায়,

সেই কি আমার একমাত্র পরিচয়?

না আমি কোন পদার্থহীন, অবয়বহীন মানুষ

যার চেতনার শক্তি অন্য কিছু হতে পারে?”

এসব প্রশ্নের উত্তর যে দেবে

সেই কবির অপেক্ষায় আছি।

দেখেছি তারে স্বপ্নের ভিতর,

বলেছে সেঃ এক আলোকিত কায়া নিয়ে দেখা দেবে

 এই সমুদ্র সৈকতে।

সে আমারই আরেক রুপঃ

দেহহীন শক্তির প্রকাশ;

(কবির আবির্ভাব)

ঐ দেখি আলোর সংকেত

পদধ্বনী শুনি,

একি স্বপ্ন না বাস্তব?

বুঝিনা এখনও

আলোর অংকনে স্নিগ্ধ অপরূপ,

দেহহীন অথচ দেহের ভিতর

কম্পিত শিখায় ভর করে নামে,

একি সত্যই বাস্তব?

স্বপ্ন হলে এত কি স্পষ্ট কায়া হত?

এত গভীরে ছড়াতে আনন্দের রেশ?

জাগ্রত আমি সুনিশ্চিত;

ইন্দ্রিয়ের দ্বার খোলা

আসে হাওয়া, বালু, তরঙ্গিত সমুদ্রের রেশ,

পৃথিবীর পটভূমি

ঢেউয়ের আঘাতে দেখি হয়েছে উজ্জ্বল মসৃণ;

পশুপাখীর স্থানে কালে

সেই পরিচিত পদক্ষেপ,

দূরে মহীরুহ দেখি

ভারহীন আকাশের দিকে

খুলে রেখে পাতা

আলোরে করেছে আশ্রয়;

ভারে নতজানু

এক বিশাল পাথর

অদৃশ্য ভারে যেন ভর করে

ঢেউ ছুঁতে ঝোঁকে;

এরই মাঝে কত আনাগোনা,

আসে মাঝিদের দল,

সংসারি মানুষেরা যেতে চায়

অন্য কোন দ্বীপে,

দীপ্ত এক আলোকিত বেশে,

কবি তুমি

স্বপ্নেতে দিয়েছো নির্দেশ,

সত্য তুমি, না সব মিথ্যা?

মায়াময় জগতের ভ্রম

এখনও কি কাটেনি মনে?

এখনও কি দূর্বল স্নায়ু্তে

কুন্ডলিত হয়ে আছে

ইন্দ্রিয়ের ভ্রান্তি আর সংস্কার?

কে তুমি?

কেমনে বুঝিবে মানুষ তোমায়?

 

কবি

ইন্দ্রিয়ের গঠনে যে দেহ,

তার মাঝে আছে এক অতিন্দ্রিয়

অস্ফুট  জগত;

দৃশ্যগ্রাহ্য সংসার

পারেনা গড়িতে সেথা অনাচার,

সংসার যারে বলো,

তা ইন্দ্রিয়ের সংস্কার, বিচার,

আর বুদ্ধিবৃত্তির অলঙ্কৃত সাজ;

জ্ঞান যারে বলো তা আপেক্ষিক

উত্তরিত হতে থাকে বারবার;

আজ যা নতুন,

কাল তা প্রাচীন,

আজ যা সত্য মনে হয়,

কাল তা অসত্যের নির্বোধ প্রাচীর;

ইন্দ্রিয় যা জ্বালায়

চিন্তার দীপ,

নিয়মের আন্দোলনে জ্বলে দীপ দীপ

শরীরের ভিতর ধোঁয়ার মত

টানে বস্তু হতে নির্গত

ছাই, পাঁশ, শ্বাস;

কুন্ডলিত হয়ে পাকায়

মনের ভিতর সংস্কার

যারে লোকে মায়া বলে

সেই মায়াবী মনের আশ্রয়ে

জেগে ওঠে “আমি”;

এই আমি যারে দেখো আলোকিত বেশে,

সংসারের উর্দ্ধে আকাশ চত্বরে,

সে আমি অন্য এক আমি,

সকল মানব মনে বিচারিত,

কল্পনার মুকুলে প্রস্ফুটিত জীবনের মাঝে;

সকল “আমির” ভিতর

অদৃশ্য শক্তি এক

যার স্পর্শে জ্বলে উঠে অলীক, মহাকাশ, বাতাস;

সেই আকাশ বাতাস

পরমানু গঠিত জগতের ওপাড়ে,

কল্পনা নিয়ে ওড়ে,

কম্পিত হৃদয়ে নেড়ে শব্দ, অনুভব

কথা হয়ে নেমে আসে বুকে।

 বোধ নই, জ্ঞান নই ,

নিয়মের দাস নই,

শুধু আলো আর মুক্তির আমি অমর প্রকাশ;

করোনা বুদ্ধি দিয়ে এর বিচার,

শৃংখলিত মনে পড়াতে চেয়োনা নতুন শৃংখল,

দেখো মোর আলোর আকার,

শোন যে নিরাকার

তার উপদেশ   কাব্যের কথায় ।

 

মানুষ

জানি, এই দৃশ্যও ভ্রান্তি হতে পারে ,

তবু বলো শুনি;

মানুষ সে এক নয়,

তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ,

কোথাও সে অন্ধকারে বিভ্রান্ত পশুর মত

ছোটাছুটি করে,

হানাহানি, চিৎকার , রক্তপাত করে

পথের দুধারে টানে মৃতদের লাশ;

সারা জীবন ধরে শুনি কত

মানুষের দুঃখ, কষ্ট, আর্তনাদ;

ক্ষুধায় আক্রান্ত প্রাণী,

শান্তি নাই যার,

প্রতি পদক্ষেপে ভয় যারে

ক্লান্ত করে ,

কোথাও নিশ্চিন্তে যার ঠাই  নেই

পৃথিবীর বুকে ,

তারে আশা দেবে কে?

 অশান্তি যার জীবনের একমাত্র আশ্রয়

তারে বোঝাবে কি ভাবে

পৃথিবীর জীবনের মাঝে

আছে ঈশ্বর, কবি আর মহামানব?

ঐ দেখো!

অন্ধকারে যেথা অস্পষ্ট আলোর রেখা ,

তরঙ্গেরে ঠেলে ঠেলে উঠে আসে

এই সৈকতের দিকে,

মাঝিদের কাঁধে ভর করে নামে

সেই আত্নার দল

যাদের দেখেছি শৈশবে;

ঘুমন্ত এখনও তারা,

অন্ধকার জগতের ছায়া যাদের এখনও পশ্চাতে,

স্নায়ুতে জড়ায়ে দড়ি ,

বহিতেছে অপোগণ্ড জীবনের ভার;

এদের তুমি কি দেবে উপদেশ?

ঐ দেখো!

অন্ধকারে  পাথরে ঘর্ষণরত বালুকণা

সমুদ্রের জল বয়ে ওঠে আর নামে ,

চিৎকার করে  নিজেকে ছাড়াতে

বস্তুক্লিষ্ট জগতের থেকে,

তাই কলরব হয়ে ফিরে  আসে

জাগায় অন্ধকারে জগতের ধ্বনি ;

শোন সেই কলরব;

শোন অন্ধকার মানুষের উত্থান পতন,

ঐ আত্নার দল

যারা ভিড় করে চলিতেছে অনির্দিষ্ট পথে ,

শোন তাদের কথোকপথন ,

চলো নিয়ে চলো ঐ দিকে

যেখানে মানুষেরা অন্ধকারে ভারাক্রান্ত,

আঘাতে পরিশ্রান্ত,

ভ্রান্তিতে মাটি থেকে তুলিয়া পাথর

বাড়াতেছে নিজেদের চলিবার ভার।

 

কবি

মানুষের অভিব্যক্তি বস্তুকণা থেকে

যে বালি, মাটি, কাঁকর

প্রতি পদক্ষেপে সহিতেছে অস্তিত্বের ভার,

তারই মাঝে জন্মেছে প্রাণ জীবনের অংকুর;

যারে চেতনা বল

তা শক্তির প্রকাশ,

মাটিরও চেতনা আছে,

গাছ, পতঙ্গ,  পশুপাখী, প্রাণী

সবই চেতনা উদ্ভুত শক্তি,

মহা আকাশ যা দৃষ্টির অগোচর,

যেখানে লক্ষকোটি আলোকবর্ষ ব্যাপী

ব্রম্মান্ডের সৃষ্টির জন্ম থেকে মৃত্যু ,

মৃত্যু থেকে জন্মের পুনরাবর্তন ,

সেখানেও একই শক্তি,

এইভাবে চলিতেছে মহাকাল;

যা নিশ্চল মনে হয়,

তা নিশ্চল নয়,

যে পাথর মনে হয় শক্ত ও কঠিন,

তাও নিয়মের দাস,

যা আজ তরল তা কাল কঠোর,

যা আজ কঠোর , কাল তা তরল ,

শক্তির আন্দোলনে,

এক থেকে অন্য ক্রমাগত পরিবর্তন;

সমুদ্রের তরঙ্গ যেমন

হাওয়ার আঘাতে নেয় বিবিধ আকার,

তারই সাথে প্রতি ঢেউয়ে ঢেউয়ে

মানে মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম,

সূর্য্য প্রদক্ষিণরত গ্রহের ঘূর্ণন

এরই মাঝে টেনে যায় স্রোত ;

সারা ব্রম্মান্ডকে এক ক্ষুদ্র তরঙ্গের বুকে

বেঁধে রাখে

চিরচঞ্চল সৃষ্টির অনিবার্য্য পরিনাম;

তেমনি এই মানুষের জীবন;

শক্তির স্রোতবাহী অমোঘ প্রকৃতি

সৃষ্ট যে জীবন,

সেখানে বহুবিধ টান,

একদিকে মাটি,গাছ পালা,

জলবায়ু , হাওয়া আর আকাশের টান,

অন্যদিকে বাঁচার প্রয়োজন,

কোষের ইন্ধন;

শক্তির প্রয়োজনেএকে অন্যকে করে আক্রমণ,

কেউ ভেঙে যায়

কেউ হয় শক্ত ও কঠোর,

যে এই টানাপোড়নে ,

ব্রম্মান্ডের গতিময় পথে

তরঙ্গের মত একে ওপরের বুকে

করে শক্তি বিনিময়,

এইভাবে চলার বিশ্বাসে টেনে যায়

একইসাথে অন্যসব তরঙ্গের স্রোত ;

তারই জীবন প্রতিষ্ঠা করে

যারে বলি কঠোর বাস্তবে;

যে ভেঙে যায়

তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রোত,

মিশে যায় অন্যসব

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রোতেদের  সাথে

মিলিত হয় অন্য  ঢেউয়ের মাঝে;

এইভাবে চলে জীবন,

সুখ, দুঃখ , ক্ষোভ

অনুভূতির প্রতিধ্বনি নিয়ে

ভেসে আসে বুকে

আবার হারায়ে যায় অনন্তের বুকে;

এর মাঝে চেতনা অমর,

যে শক্তিতে ধূলোকনা বায়ু

হাওয়া হয়ে জন্ম নেয় তরঙ্গের সাথে,

যার ইচ্ছায় মাধ্যাকর্ষণ টানে

প্রতি জলকণা, মেঘ ও পাথর,

যে শক্তির  আলোড়নে

পৃথিবী ঘোরে গ্রহপথ ধরে ,

সে শক্তি চিরন্তন,

এরই বিভিন্ন রূপে ,

মানুষের মনের গঠন;

প্রতি দেহে আছে মন,

দেহ মনের প্রকৃতিগত আশ্রয় ;

দেহের চঞ্চলতা করে মনকে চঞ্চল ,

সেভাবে চঞ্চল মন আবার

করে দেহকে অস্থীর;

দেহের চঞ্চলতা আবার জলবায়ু

প্রকৃতির উপর নির্ভর ;

যেখানে বড় বড় ঢেউ করে আঘাত ,

সেখানে খোঁজে মানুষ  বাঁচবার বিভিন্ন প্রলোভন;

কেউ ঝাপ দেয়, ডোবে, আত্নহত্যা করে,

কেউ অন্যকে ডুবায়ে ভাবে

বেঁচে যাবে অন্যদের মৃতদেহ ভিড়ে;

অশান্ত প্রকৃতি থেকে বাঁচবার নাইকো সহজ উপায় ;

যে মানুষ বুদ্ধিমান

সে ঝাঁপায় না অস্থির স্রোতে ,

অন্যকে ফেলে মৃত্যুর কবলে চায়না স্রোত পার হতে;

নিজের ভিতর যে শক্তি বিদ্যমান ,

যার আক্রমণে ঢেউয়ের উত্থান পতন,

তার কাছে আত্নসমর্পন করে

দাঁড় ধরে, নিজের ভিতর নিজেকেই অতিক্রম করে ,

অভিব্যক্তির নতুন পথ খোঁজে অন্য এক দিকে।

 

 মানুষ

ঐ দেখি যেথা আকাশ ধীরে ধীরে হতেছে পরিষ্কার ,

নামিতেছে  অন্য একদল

যেথা পশুপাখি করিয়াছে ভীড়,

ফুল-পাতা হাওয়ায় নড়িছে অস্থির ;

দেখেছি এদের আমি বহুদিন আগে

শৈশব সবে  শেষ হলে ,

যখন ঘনঘটা করে নেমেছে মেঘের ভিতর বিদ্যুৎ

আলোর সংকেত এসেছে হৃদয়ে,

অন্ধকারে চিড়ে আলো একেঁছে মুখ,

দেখেছি এদের অন্য জগতের তীরে;

ঘুমন্ত না জাগ্রত?

বুঝিবার  ছিলোনা উপায়;

ঘুমের ভিতর হেঁটেছি নিজেই বহুবার,

জেগে জেগে স্বপ্ন দেখেছি বহুকাল;

ঘুম ভেঙে যখন ভেবেছি এবার হয়েছে সকাল,

আরেক জগৎ মোরে করিয়াছে গ্রাস;

অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভার,

ইন্দ্রিয়ের সংস্কার ,

ইচ্ছার শৃঙ্খল আর প্রবৃতির পাশ,

নিয়মমত জাগিয়েছে অনুভব আর সংসার;

কল্পনায় জাগিয়া বারবার

ঠেলিয়াছি অবরুদ্ধ দ্ধার;

এক স্বপ্ন হতে আরেক স্বপ্নে

জেগে দেখেছি যে জাগ্রত মনে হয়

সে হয়ত ঘুমন্ত ,

মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে

যা ক্রিয়াময় ও অস্থির

তাই যেন বারংবার মনে হয় অক্রীয় এবং স্থির;

ঐ দ্যাখো!

আমারই মতো এক মানুষের  দল,

নামিতেছে এই ভ্রাম্যমান জগতের তীরে,

স্বপ্ন না বাস্তব?

কল্পনা না সত্য?

আছে কি নেই?

কোন কিছুর জানেনা উত্তর;

মাঝিদের হাতধরে চলিতেছে কদর্পক পদ,

তারপর হারায়ে যেতেছে

যেথা মেঘদল করিয়াছে ভীড়;

দেখিতে পাওকি ওদের মেঘের ওপারে ?

কবি তুমি ,

অদৃশ্য জগত  তোমার গোচর ;

দেখিতে কি পাও

মানুষের চোখের আড়ালে আছে

আরেক অন্তর?

মনের ভিতর জাগ্রত যে মানুষ ,

সেও কি স্বপ্নাতুর ?

কোথায় কাব্যের শেষ?

কোথায় বাস্তব?

ঐ যে মানুষের দল চলে সত্য জীবনের খোঁজে,

অদৃশ্য আলোতে ,

বিদ্যুতের আস্ফালনে কেঁপে উঠে ,

আকাশের গর্জনে আত্নসমর্পন করে

খোঁজে পরিষ্কার চলিবার পথ

সবইকি ভ্রান্ত, মনের কল্পনা আর বিশ্বাস?

কোথায় পাবে স্বপ্নাতুর মানুষ এই সব প্রশ্নের উত্তর?

এখনও কি স্বপ্নের ঘোরে

চলিতেছে এই মানুষের দল প্রতি পদক্ষেপ?

স্বপ্ন কি? কোথা তার বাসস্থান?

কেনই বা স্বপ্নের ভিতর

বারবার ভুল হয় জীবনের বাস্তব ?

সবই কি কোষে কোষে ঘর্ষনে জাগ্রত

বিদ্যুতের দোলা

এক অলীক সাজানো আকাশ?

মন -সে কি?

জাগ্রত হতে চায় কেন  ?

আর জাগিবেইবা কোথায়?

আছে কি কোন আসল বাস্তব

যা মনের ভ্রান্তি বিনা

“আছে” এই অস্তিত্বের তীরে?

মন কি কম্পন?

যার নাই কোন ভাষা,

সমুদ্র সৈকতে ঢেউয়ের মত

শুধু তোলে আন্দোলন,

যেখানেই আলোর স্পর্শ

সেখাইনেই তার কম্পিত আবেগ ,

মূর্চ্ছা যায় বালুতটে

বালুতে, পাথরে লুটায়ে আবেগ

সমুদ্রেতে ফিরে যায়

দিক চক্র যেথা শেষ

যেথা অনন্ত শূন্যতায় ভাসে মহাদেশ

সেথা নিয়ে যায়

পৃথিবীর জীবনের ক্লান্তি আর ক্লেশ ;

ঐ দ্যাখো!

কত কল্পনার তরী করিছে প্রবেশ ,

কত মাঝি বাড়ায়ে  হাত

টানিছে পথিক,

কতজন ভ্রমণের তরে

আগ্রহে অপেক্ষা করিছে

কল্পনার রঙের আঁকা বুকে/মুখে

কাঁপিতেছে কত শত আলোর প্রদীপ;

সব কি ভ্রান্তি?

নিছক আলোর খেলা

তরঙ্গিত যা,

তা’কি শুধু বায়ুর কম্পনে

শূন্যতায় দোদুল্যমান কণিকার ভেলা?

তবু তীব্র হয়ে জাগে কেন মন?

কেন ভেঙে দিতে চায় সব

যেথা আকাশের অবিশ্রান্ত গর্জন

কেন সেথা করেন সে আত্নসমর্পন?

কেন বারবার পড়লেও উঠিতে চায়।

স্বপ্নের ভিতর স্বপ্নে

বিদ্যুতে বিদ্যুতে আলোকিত পথে

কেন সে উড়িতে চায় মহাশূন্য মাঝে?

 

কবি

স্বপ্ন যারে বলো

তা বহু বর্ষব্যাপী

অভিজ্ঞতার স্তুপ

অভিব্যক্তির আদিম ইঙ্গিত;

দেহ আর মন এই দুই স্রোত

টানিছে সময়ে,

তরঙ্গেতে চলমান ভেলার মত দেহ

আকাশে বাতাসে বয় ,

ব্যবহার করে অভিজ্ঞতার নির্দিষ্ট নির্দেশ,

জীবনের প্রথম রূপ থেকে

তার আজ যা রূপ সবকিছু মিলে

নির্দিষ্ট পথের দিকে চলে তার গতি;

এইভাবে দেহের নির্দেশে

মন তার তরী বয় ,

যেতে চায় অন্ধকার পার হয়ে আলোকিত পথে ;

জন্ম, মৃত্যু , প্রজনন

কত শত ইচ্ছার প্রদীপ

জ্বালায়ে মনের আলো

খোঁজে তার বাসস্থান

অশান্ত সমুদ্র পাশে

খোঁজে কোন আলোকিত দ্বীপ;

যেমন তরঙ্গের স্রোতে

বহুবিধ শক্তি নিমজ্জিত,

হাওয়া থেকে আকাশে আনে

গতিময় ব্রম্মান্ডের সংকেত

তেমনি মনের স্রোতে নিমজ্জিত

বহু অচেনা, অদৃশ্য শক্তি

যা স্বপ্নের রূপ নিয়ে আসে;

কোন দিকে , কোন স্রোতে দেহ যায়

তা নিশ্চিত করে মনের আবেগ;

মন বিবিধ শক্তির প্রকাশ,

দেহ কোষে নিমজ্জিত যে জীবন,

সে যেতে চায় সেই স্থানে

যেথা আছে জীবন যাপনের

সহজতম উপায়,

পথে আসে বাঁধা,

আসে ঢেউ, ঝড়, বিদ্যুৎ গর্জন,

প্রদীপেরা নিভে যায়,

 নামে অন্ধকার ;

মনের আরেক শক্তি

নেয় এই ঝড় ঝঞ্চা

পার হবার ভার;

স্বপ্ন জাগায় এই অন্ধকারে চলার শক্তি ,

অশান্ত জীবনের সাথে

কিভাবে বুঝিবে এই দেহ

কিভাবে মন প্রস্তুত করিবে

তার অভিজ্ঞতার ভান্ডার ।

স্বপ্ন তার নিজস্ব ভাষায়

তৈরী করে তার ঘটনা বিন্যাস;

যা সত্য নয় ,

 তাইই সত্য বোধ হয়,

যা বাস্তবে ঘটেনি কোনদিন ,

তিনি বাস্তবের রূপ নিয়ে

নাটকের মতো বুনে যায়

হৃদয়ের ইচ্ছা, আন্দোলন।

স্বপ্নের এই শক্তি ,

বাস্তবের ঘটনার সাথে

মোকাবিলা করার অনন্য উপায়;

শুধু তাই নয়,

আরও উচ্চতম স্বপ্ন আছে,

যা মানুষের ভবিষ্যৎ অভিব্যক্তির

পথ দেখায়;

কল্পনা স্বপ্নের এক জাগ্রত রূপ,

ঘুমন্ত যে মানুষ

তার মস্তিস্ক পারেনা বুঝিতে

কোনটা ইন্দ্রিয়বাহিত সংকেত

আর কোনটা স্বপ্নাতুর মনের ছায়া,

জাগ্রত মস্তিষ্ক জানে ভেদাভেদ,

মনের যে শক্তি স্বপ্নের আকার,

সেই শক্তিই

জাগ্রত মস্তিষ্কে ইন্দ্রিয় বাহিত স্রোতে

কল্পনার রূপ নিয়ে আসে;

স্বপ্ন যেমন ঘুমন্ত মস্তিষ্কে

অন্ধকার পথ চলার শিক্ষা ও প্রচেষ্টা ,

কল্পনা জাগ্রত মনে দিক নির্ণয় করার কম্পাশ;

কল্পনার ও আছে ভেদাভেদ

একদিকে দেহ মনের সংকেত,

অন্যদিকে জ্ঞান, বুদ্ধি, আর বৃত্তির সমাবেশ;

যে মানুষ জ্ঞান ও বুদ্ধিদীপ্ত

সেই ই পারে

যা আজ অবাস্তব তাকে কাল করিতে বাস্তব;

নিয়মকে করিয়া  উত্তরণ

সেইই পারে গঠিতে

কল্পনার আশ্চর্য তোরণ ;

মনই  আবার জ্ঞানের উৎস,

শক্তির আরেক বিকাশ;

যে মন জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত ,

সেই মনে কল্পনার  আসেই

আছে ভবিষ্যতের বাস্তব;

আরও উচ্চতর স্বপ্ন ও কল্পনা যাদের

তারা অভিব্যক্তির আরেক নতুন স্তর ;

যা দৃশ্য গ্রাহ্য জগৎ.

তার উপরে আছে আরও ঊর্ধ জগৎ,

উচ্চতর  স্বপ্ন সেই জগতের স্বপ্ন

উচ্চতর কল্পনা সেই অদৃশ্য জগতকে

ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য জগতের দ্বারে করে প্রতিষ্ঠিত ;

মানুষের অভিব্যক্তির স্তর জ্ঞান নির্ভর,

অজ্ঞান মানুষ অভিব্যক্তির বিপরীত স্রোত,

জ্ঞানও দৃশ্যগ্রাহ্য জগতের দ্বারা পরিচালিত।

যা অদৃশ্য , যা অনুভবের গণ্ডীর বাইরে

তার “জ্ঞান ” অন্য প্রকার

উচ্চতর মানুষ সেইই যে

অপূর্ব অদৃশ্য জগতের সংবাদ বাহক;

এইও এক ধরনের স্বপ্ন ও কল্পনা ;

যা  মনে হয় আছে তার উর্দ্ধে আছে আরো ঊর্ধ জগত,

তার উপর আছ অভূতপূর্ব সৃষ্টির সংকেত ,

যা দেখো তাই-ই স্বপ্ন আবার বাস্তব,

সবই  মনের বিভিন্ন  স্তর।

 

মানুষ 

ঐ দ্যাখো !

যেখানে ঢেউয়েরা হতেছে স্থীর ,

জমিছে পাথর,

স্বপ্ন ও কল্পনা  মুছিয়া চোখে নামিতেছে একদল ,

ওখানে জাগ্রত মানুষের ভীড়;

পাথর সরায়ে হাতে

পরিষ্কার করিছে পথ ,

সমুদ্র সৈকত থেকে দূরে

জ্বলিতেছে আশার মশাল ;

দূরত্ব অনেক,

আবার পথও নয় পরিষ্কার

পাথর সরালে নামে পাহাড়,

পাহাড়ের পাদদেশে এলে

আরও বেড়ে যায় পাহাড়ের ভার,

সংকীর্ণ হয়ে যায়,চলবার  স্থান ;

এদের অনেককে দেখেছি বহু বছর আগে

পথে পথে ঘুরেছে এরা আমারই আশে পাশে ,

স্বাধীনতা প্রিয় এই মানুষের দল

বলেছে আমায় :

স্বাধীন জীবন পেতে হলে

একপথ থেকে আরেক পথে নিজেরে

খুঁজতে হবে বারবার;

দাঁড়াবার নাইকো উপায় ,

যে পথেই চলো ,

সেই পথেই রয়েছে মন্ত্রী,

আইন কানুন ছাড়া চলবার  নাইকো সুযোগ

সব পথই অবরুদ্ধ করে বসে আছে

কোন সন্ত্রাসীর দল,

কিংবা কোন রাজা, কি মন্ত্রী

তাদের প্রহরীদের নিয়ে;

কোথাও আবার কোন অপদার্থের দল

খেলিছে জুয়া, পাশা আর তাস ,

হয় খেলো, হারো, জেতো

নয় রেখে যাও মূল্যবান যা আছে তোমার ;

স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের দল

 পারেনা বিকাতে তার মর্যাদা, সম্মান;

রাজা, মন্ত্রী, সান্ত্রী ও সন্ত্রাস

রাখে তারে যাযাবর করে,

তাই যেখানেই আবার সুযোগ দেখে

সেখানেই বসে যায় জুয়ার আসরে

তাসের পিঠেই রাজা মন্ত্রী বসে

ছিনিয়ে নেয় মানুষের সম্মান;

এদেরই মতন আমি খুঁজেছি নিজেরে,

নিজের আশা, বিশ্বাস, সম্মান নিয়ে,

অন্যের নিয়মের সাথে পারিনি মেলাতে

আমার আত্নজ্ঞান ;

এদেরই মধ্যেই দেখেছি দীন দরিদ্র,

আর শ্রমিকের দল,

বাচাঁর প্রয়োজনে

বিকাতে হয়েছে যাদের জীবনের

মূল্যবান সম্পদ;

আশা, ভালোবাসা, স্বপ্ন

সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে

কাটতে হয়েছে নিজের কবর;

তাদের চিৎকার ক্রন্দন

আজোও মনে আছে, ,

আমারই হাত ধরে  পার্থনা করেছে তারা

 চেয়েছে মুক্তি,

নিজেই স্বাধীন নই;

কেমনে করিবো তাদের স্বাধীন?

আমি নিজেই যাযাবর,

কেমনে দিবো তাদের হৃদয়েতে আশ্রয়?

যাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নাই সংসার পালনের কোন ক্লেশ,

যাদের নাই আর্থিক সংকট,

তবু তারাও কেন স্বাধীনতা খোঁজে?

কি এই স্বাধীনতা?

কেন এরা স্বাধীনতা চায়?

সম্পদ ও কি বন্ধন?

মুক্তি কার থেকে?

কিসের জন্যে মুক্তি?

দেখি কত পুরাতন মুখ,

কেউ একদিন শ্রমিকের নেতা ছিলো,

ঝান্ডা হাতে দিয়েছিলে স্লোগান,

” পৃথিবীর মাটি যা শ্রমিকের রক্তে উর্বর,

হোক স্বাধীনতার জন্ম”,

হোক মানুষের জয়!

কেউ ছিলো ভবঘুরে,

কল্পনার দোরে দোরে ঘুরে

নিজেকে করে পরিশ্রান্ত,

ভেবেছে খুঁজে পাবে

অশান্ত জীবনপাড়ে শান্তির জীবন;

যা বাস্তব তাকে ছেড়ে

খুঁজেছে কল্পনায় বাস্তব,

এ কোন স্বাধীনতা?

কি খোঁজে এরা ?

পালাতে চায় কেন

নিজের জীবন থেকে?

দেখি এরই মধ্যে রয়েছে,

আমার প্রিয়তম বন্ধুজন,

মুক্তি চায় অজ্ঞানতা  থেকে,

কিন্তু আসল জ্ঞান কি?

কে জ্ঞানী, কে মূর্খ

বুঝিবো কেমনে?

সম্পদ যদি বন্ধন,

সম্পদ ছাড়াও মানুষ অন্যের দাস নয় কি?

জ্ঞান যদি মুক্তি,

সে জ্ঞান কিসের জ্ঞান?

আছে কি সেরকম কোন জ্ঞান

যা মুক্তির পথ বলে দিতে পারে?

যাযাবর জীবন তো মুক্ত নয়,

সে এক পথ থেকে আরেক পথে ঘুরে

নিজেকে হারাবার পথ আর কি!

দেখো, এরই মধ্যে চলেছে

এক অস্তিত্ববাদীর দল ,

এরা এত স্বাধীনতা প্রয়াসী

যে পারেনা বাছতে কোনদিকে যাবে,

প্রতি পদক্ষেপে এদের স্বাধীনতা হারাবার সংশয়;

ভাবে কোনদিকে সরাবে পাথর,

চারদিকেই তো জমে আছে আছে ঘন অন্ধকার!

ইচ্ছা থাক, কি না থাকে,

তবুও সরাতেই হবে অস্তিত্ত্বের ভার,

বাছতেই হবে চলবার দিক ও গতি,

মানতেই হবে ভবিতব্য,

পথের অন্ধকারে ডুবতেই হবে;

এইভাবে আরম্ভ করতে হবে জীবন,

এবং শেষ ও হবে তার;

স্বাধীনতা কি এই ভয়াবহ

অন্ধকারে নিজেকে ধ্বংসের পথ?

বলো: কি তোমার উত্তর?

 

কবি

স্বাধীনতা বহুবিধ,

বাঁচার তাগিদ তারই একদিক;

যে ক্ষুধায় কাতর,

যার উপর ঝড় ঝঞ্চা

সর্বদা করে উপদ্রব,

পশুদের সঙ্গে সংগ্রাম

যার প্রাথমিক জীবিকার উপায়,

তার কাছে স্বাধীনতা

এই সংসার থেকে মুক্তি,

অন্য এক জগতের সন্ধান,

যেখানে জীবনের অর্থ হয়ত

শান্তি ও বিশ্রাম।

সব পশু পাখি প্রাণী

অহরহ এই সংগ্রামে লিপ্ত,

যে হারায় আশ্রয়,

যার নাই কোন দাঁড়াবার ঠাঁই,

তার স্বাধীনতা ঝড়ে  ভাসা

গাছের পাতার মত,

ঝড়ের আঘাত এলে তারা

উড়ন্ত তখনি;

কোন জীবনেরই নাই সম্পূর্ণ বিশ্রাম,

জীবন মানেই দ্বন্দ, আঘাত,

একে অন্যকে বাঁধার অভিপ্রায়,

একে অপরকে বেঁধে গড়তে চায়,

তার নিজস্ব আশ্রয়;

শান্তি সেইখানেই যেখানে

দুর্বল করে আত্নসমর্পন,

সমানে সমানে যেখানে যুদ্ধ ,

সেখানে কখনোই গড়েনা

কোন শান্তির দেশ;

শান্তি ছাড়া মানুষের নাই কোন বিশ্রাম,

বিশ্রামহীন জীবন মানে অনুতাপ;

ঐ যারা সরায় পাথরের চাঙ ,

বিশ্রাম ওদের কোথায়?

অহঃরহ সংগ্রাম করছে ওরা নিজেদেরই সাথে,

ভাবছে পথ আছে হয়ত

যেখানে পাবে খুঁজে শান্তিতে আশ্রয়;

স্বাধীনতা মায়া ,

এই মায়া যদি না থাকে ,

কোথায় পাবে মানুষ তার চলবার স্বপ্ন?

কে দেবে তাকে আশ্রয়ে বিশ্বাস ?

যে অন্যকে করেছে আশ্রয়,

দূর্বলের ঘর ভেঙে

যে গড়েছে নিজের প্রাসাদ,

যে ছড়ায়ে সন্ত্রাস,

জানায়েছে একজনের স্বাধীনতা

কিভাবে জাগায়, অন্যদের ত্রাস;

সেও তো স্বাধীন নয়,

তার ভয়, ভীতি, সবই আছে,

নিজের গন্ডীর ভিতর সেও ক্রীতদাস;

কেউ একা নয়,

ক্ষমতা নেয় অন্যের ক্ষমতায় আশ্রয়,

সব ক্ষমতাই দ্বন্দমুখী,

থাকে জিতবার সুযোগের অপেক্ষায়;

আজ যে রাজা

কাল সে হয়ত কারাবন্দী ক্রীতদাস;

জীবনের ইতিহাস,

সবই প্রায় পরাধীনতার ইতিহাস;

যে আজ স্বাধীন,

সে অন্যকে করেছে পরাধীন,

যে আজ পরাধীন কাল

সেও তুলবে হাতিয়ার!

একের স্বাধীনতা অন্যের বন্ধন,

বন্ধনই আবার শক্তির উৎস

এর থেকে জন্ম নেয় নতুন প্রজন্ম,

ইতিহাস সেখানে খোলে এক নতুন অধ্যায়

এইভাবে  স্বাধীন ও পরাধীন জীবনের চক্র ঘোরে বারবার;

এই জয় পরাজয়,

এই দ্বন্দ্ব  এবং সমাধান,

টানে ইতিহাসের গতি,

এইভাবেই জীবনের অভিব্যক্তি হয়েছে সম্ভব;

কিছু গড়ার আগে

অন্যকিছু ভাঙা দরকার

কিছু ভাঙার আগে

যা দিয়ে ভাঙতে হবে তাও গড়া দরকার;

প্রতি প্রদক্ষেপে আছে নিয়মন বন্ধন,

আবার প্রতি বন্ধনের মাঝে আছে বন্ধনকে উত্তরণের

শক্তি ও ইচ্ছা;

এই হচ্ছে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার

অঙ্গাঙ্গী রূপ ;

সর্বস্থানে, সর্বকালে,

সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে

এ এক ঈশ্বরীক লীলা বিরাজমান।

এই দ্বন্দ্বই  কল্পনার উৎস;

স্বাধীনতা মুখী মানুষের কল্পনা

খোঁজে দ্বন্দের সমাধান ;

দ্বন্দ্ব ও কল্পনার বিপরীত স্রোতে

জন্মনেয় বাস্তব ;

বাস্তব আপেক্ষিক

দ্বন্দ্বে বিচ্ছিন্ন,

কল্পনায় আঁকা,

মায়াময় দর্পনে বিভক্ত শক্তি,

দুই দিক তার আকার;

যা একদিক বাস্তব, তাইই অন্যদিকে তার প্রতিফলন!

জ্ঞানদীপ্ত মন যার

সেই জানে স্বাধীনতা মায়া!

যেই অস্তিত্ববাদী,

যে ভীত, সন্ত্রস্ত্র

নিজেরই ছায়ার ভয়ে

বাছতে পারেনা কোন পথ;

 আলোয় দাঁড়িয়ে

নিজের ছায়ায় দেখে ভুত,

কল্পনার বৈকল্বে সর্বস্থানে দেখে

অন্ধকারের নরক।

ঐ যারা জ্ঞানের প্রদীপ নিয়ে চলে

যাও ঐদিকে,

জ্ঞান বাড়ায় না শৃঙ্খল,

দ্বীপ্ত করে এই মায়ামুগ্দ্ধ জীবন!

 

মানুষ

ঐ শোন!

দূরে যেথা ঘণ্টা বাজে,

কিংবা আকাশ বিদীর্ন করে

নামে  নামাজের স্বর;

কেউ বলে ঈশ্বর,

কেউ বলে God ;

কেউ ডাকে অন্য কোন নামে;

এরা  মুক্তি খোঁজে

দৃশ্যগ্রাহ্য জগতের মাঝে,

অন্য কোন স্থানে;

আছে কি কোন জগৎ

যেথা এরা পাবে মুক্তির সন্ধান?

জন্মকাল হতে দেখেছি এদের ,

মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায়,

সাজায়ে ফুলের ডালা,

সাজিয়া নতুন পোশাকে,

মুছিয়া দেহ থেকে জগতের ভার,

মনের ভিতর বিছায়ে চাদর পরিষ্কার

নিজেকে পরিশুদ্ধ করিবার তরে

ধর্মের নিয়মকানুন করে পালন

অদৃশ্য শক্তির সম্মানে

দরজায় দাঁড়ায়ে জানিয়েছে হৃদয়ের গভীর বিশ্বাস;

কোথাও কি আছে সেই শক্তি

যার কাছে মাথানত করে

এই মানুষের দল পাবে পরিত্রান?

স্বাধীনতা যদি মায়া হয়,

পাবে কি এরা মুক্তি জীবনের এই কাল চক্র থেকে,

পাবে কি কোথাও মানুষ

সেই শক্তির সন্ধান যা দিতে পারে শান্তিতে বিশ্রাম?

ধর্মান্ধ এরা,

জাগাতে চায়না মনে কোন অবিশ্বাস,

ধর্মভ্রষ্ট হলে ভাবে নামিবে ঈশ্বরের রাগ,

শাস্তি হবে পরিণাম;

এই জীবনের পর যদি অন্য কোন জীবন থাকে

সেখানে হয়ত জ্বলতে হবে আরও নিষ্ঠুর আগুনে;

এই ধর্মভীরু মানুষের সাথে চলে

পুরোহিত পাদ্রী আর ইমামের দল;

এরা রক্ষা করে ঈশ্বর, God, কিংবা আল্লাহ প্রেরিত আদেশ;

দেখে কে কোথাও ভেঙ্গেছে কিনা

এদেরই তৈরি করা নিয়ম ও নির্দেশ;

সহস্র বছর ধরে এইভাবে চলেছে

ধর্মের ইতিহাস,

ঈশ্বরের থাকুক, বা না থাকুক,

এদের হাত থেকে

ধর্মভীরু মানুষের নাই পরিত্রাণ;

ঈশ্বর যদি থাকে,

সেকি শুধু লেখে শাস্তির বিধান?

ঈশ্বর কি সত্যি আছে,

না ধর্মের আনুন-কানুন বিধান

ক্ষমতালোভী মানুষের অপপ্রচার

করার মিথ্যা অনুষ্ঠান?

ইতিহাসের পাতায় পাতায়

ধর্মের নামে হয়েছে যুদ্ধ আর মারামারি

ঈশ্বর, God, আল্লাহ পরস্পরকে

হারাতে মানুষের জীবন নিয়ে করেছে কাড়াকাড়ি,

ধর্মভীরু মানুষের জীবন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে,

প্রমাণ করতে চেয়েছে জীবনের উপর

ঈশ্বরীয় শক্তির আছে একচ্ছত্র অধিকার;

ঈশ্বর, God , আল্লাহ যদি একই শক্তি হয়

কেন তার এই ফার্স?

কেন ইতিহাস এত কদর্য বর্বর?

কেন ধর্মের নামে মিথ্যা প্রচার

আজও পৃথিবীর কোনে কোনে

জালায় আগুন?

ঈশ্বর যদি সত্যই থাকে ,

কেন পারেনা সে থামাতে এই অত্যাচার,

কেন করেনা সে ধর্মভীরু মানুষদের

মাঝে নিজের আত্নপ্রকাশ?

কেন ধর্মের নামে মিথ্যা নিয়ে

জারা খেলে জুয়া, পাশা, তাস

তাদের সত্যরূপ করে না ফাঁস?

দ্যাখো ঐদিকে!

পুরোহিত, ইমাম আর পাদ্রিদের

পিছনে পিছনে ঘুরছে আরেক দল,

এরা ছড়ায় অর্থ ও সম্পদ,

লোভাতুর মানুষের দল কুড়ায় এইসব,

ঈশ্বরের নামে বানায় অট্টালিকা, প্রাসাদ ও প্রাচীর,

আর তারই মাঝে তোলে গির্জা মন্দির

ও মসজিদ;

ধর্মের গুরু যারা

তাদের বানায় পুরোহিত;

এইভাবে রাজা মন্ত্রী করে ভিড়;

প্রাসাদে, প্রাচীরে ধর্মের বিশ্বাস,

নিয়ম কানুন করে আরও জটিল ও কঠিন,

যত মানুষকে ধর্মভীরু করে

তত তারা এদের আজ্ঞাবাহি হয়,

ততই বাড়ে এদের ধন ও সম্পদ;

ধর্মকে ভিত্তি করে বাড়ে এদের

মিথ্যার প্রাচীর!

ঈশ্বরের নামে কেন এত মিথ্যাচার?

ঈশ্বর যদি সত্যই থাকে,

কেন পারেনা সে মিথ্যাকে করিতে পরাজয়?

ক্ষমতা চতুর  মানুষের কাছে

কেন হেরে যায়

বুদ্ধিমান মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক?

ধর্ম কি?

আছে কি ধর্মের সত্যই কোন প্রয়োজন?

 

কবি

ধর্ম আদিম কাল থেকে

মানুষের মনে জাগায়েছে শ্রদ্ধা ও ভীতি,

যে অমোঘ শক্তি

বালুকণা হয়ে ওড়ে,

সূর্যের আলোয় বোনে আকাশ গভীর,

জীব, জীবাণু বক্ষে আনে জীবনের স্পন্দন,

অনিবার্য নিয়তির মত

ভাঙে  গড়ে,

আবার ভেঙে আবার গড়ে,

বারংবার একই ভাবে

আলোকে সরিয়ে আনে অন্ধকার,

তারই পর আবার অন্ধকার ভেদ করে

জাগায়, আলোকে;

মানুষ জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারেনা,

সে কি শক্তি?

সে কে?

সে কোথায়?

তারই মূর্তি গড়ে

নিজের মনের খড়কুটি দিয়ে,

সামান্য জ্ঞানের পরিধিতে যতটুকু ধরে

সেই দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে,

রূপহীন জগতের সত্য,

রূপকথার কাহিনীর মতো বানায়

স্বপ্নের দেশ,

দৃশ্য গ্রাহ্য জগতের ছবিতে

দেখতে চায় অদৃশ্য জগতকে;

যে শক্তির প্রকাশে আকাশ জ্বলে,

মেঘ, বিদ্যুৎ, ঘর্ষনে নামে জল,

যার আঘাতে ঢেউ  ভেঙে উঠে আসে

উন্মুক্ত হওয়ার পাখা;

যার স্পর্শে কেঁপে উঠে মাটি,

যার হৃদয়জুড়ে

ভেসে বেড়ায় স্ফুলিঙ্গের স্রোত,

যার কাছে মাথানত করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়, পর্বত ,

সেই শক্তিই ঈশ্বর।

অস্তিত্ব মানেই এই ঈশ্বরের প্রকাশ,

যা কিছু আছে তার মধ্যে একই শক্তি বিদ্যমান,

জল, বায়ু, মহাকাশ,

চাঁদ, সূর্য

নক্ষত্রখচিত অন্ধকার,

সবেরই মধ্যে সে গতিময়,

জীবকোষে, অংকুরে, ফুলে , ফলে

তারই সংগীতের  আসর;

মানুষের জীবন এই সংগীতের

এক অভূতপূর্ব অনুষ্ঠান,

ঘন্টাধ্বনি, সংগীত, গান

মানুষের নিজের ভিতর যে কম্পন

তারই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য় রূপ ;

প্রতি জীবনই বিভিন্ন স্রোতের টানে নিমজ্জিত,

একদিকে কাদা, মাটি,

ফুল, হাওয়া আর জীবন সংসারের  টান,

অন্যদিক অদৃশ্য জগতের

ভয়, ভীতি, ঈশ্বরের প্রতি আকর্ষণ;

প্রতি জীবন বহু অন্যজীবনের উপর নির্ভরশীল,

অন্যের গতিতে তাদের নিজের গতি নির্দিষ্ট,

বহু জীবনের গতির সমন্বয়ে তৈরী

এই ইচ্ছার সংসার;

যেদিকেই যায়

দেখে অন্যদিকে আছে

অন্য এক জগতের ভার আর টান,

কি আসলে মুক্তি,

বুঝবার নাইকো উপায়,

তাই অদৃশ্য জগতের হাতে

আত্মসমর্পণ করে খোঁজে,

বিভিন্ন আশ্রয়;

যেখানে নদ নদী, জলাতে

ঝড় ঝঞ্চা আর

প্রকৃতির অহরহ উৎপাত,

যেখানে উর্বর মাটিতে

হয় শাক সবজির চাষ ,

সেখানে ঈশ্বরের রূপ

মাটি দিয়ে গড়া

মানুষের স্বপ্নের প্রতীক;

সেখানে মানুষ করে

প্রকৃতির আরাধনা ;

প্রতিষ্ঠা করে দেবতারে

মাঠে ঘাটে অথবা নিজের ঘরের চত্বরে ;

যেখানে মানুষের সাথে নেই

প্রকৃতির সেইরকম ঘনিষ্ঠ সংযোগ;

যেখানে মানুষ অশ্বারোহী হয়ে

অন্যের ভূমি থেকে তুলে আনে সম্পদ

আর বাঁচার জন্য যা প্রয়োজন ,

যেখানে মানুষের পেশির শক্তিতে

লেখা থাকে তার ভবিষ্যত ,

সেখানে মানুষ খোঁজে মহামানব;

নিজের ভিতরই দেখে অন্য এক জগতে রয়েছে মানুষের সাথে ঈশ্বর;

যেখানে আছে শান্তি,

নাই কোন শত্রুর  উৎপাত,

প্রকৃতির সঙ্গে মোকাবেলা করার পথও

যেখানে সহজ,

সেখানে ঈশ্বরের রূপ

প্রকৃতি ও মানুষের ঊর্ধ্বে, এক শান্তিময় জগত;

 সবই মানুষের মনগড়া সৃষ্টি,

নিজের বাঁচার তাগিদে এই ভাবে

মানুষ তৈরী করে ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন রূপ;

অন্যের হাত থেকে বাঁচবার অভিপ্রায়ে

তোলে এক শক্তি

অন্য শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ও হাতিয়ার;

তাই ধর্মের ইতিহাস

অজ্ঞান মানুষের প্রকৃতি ও মানুষের

ক্রোধ থেকে বাঁচার ইতিহাস;

যেখানে মানুষ জীবন নির্বাহের

যুদ্ধ থেকে মুক্ত,

যেখানে মানুষ জ্ঞানী ও বুদ্ধিদীপ্ত, বুদ্ধিমান

জানে প্রকৃতি ও মানুষ ও

তাদের উর্ধে যে শূন্যতার জগৎ

সর্বস্থানে রয়েছে ঈশ্বর, God

তার কাছে ঈশ্বরের রূপ এক,

সে দেখেনা ঈশ্বর, God

কিংবা আল্লার মধ্যে কোন প্রভেদ/তফাত;

ঈশ্বর আছে তাই প্রকৃতি আছে,

তাই পৃথিবীর জীবন এত স্রোতময় ও চঞ্চল;

তাই মানুষ অনুভব করে

মানুষের ভিতরে রয়েছে অতিমানব,

তাইই আবার মানুষকে নির্দেশ দেয়

প্রকৃতি জগৎ ও মন জগতের

উর্ধে শূন্যতায় শান্তির আরেক জগৎ;

ঈশ্বর দেহী এবং বিদেহী,

ঈশ্বর আছে আবার নেই,

ঈশ্বর প্রকৃতি, মন আবার

কোন কিছুই নয় ;

যে জগতে সূর্যের আলোয় জাগে প্রভাত,

যে জগতে স্বপ্নের ভিতর জাগে

অতিপ্রাকৃতিক আলো আর অন্ধকার

যে জগতে ব্রম্মান্ড

অনন্ত শূন্যতার বুকে গতিময়

সেখানে ঈশ্বর এক মহাজাগতিক মন

স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন  তার ভিতর স্বপ্ন

তার ভিতর স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন যেন !

এক আশ্চর্য আলোতে বস্তুহীন, মনহীন

জগতে ভাসমান চৈতন্যের তরী;

যে যেভাবে ঈশ্বরের খোঁজ করে

তার কাছে ঈশ্বর প্রতিভাত হয় সেইভাবেই ;

ধর্ম ঈশ্বরের খোঁজ;

মানুষের অসম্পূর্ন চৈতন্যের

এক কাল্পনিক সৃষ্টি;

যে মন যে স্তরে বিরাজমান

সেইভাবেই সে দেখে ঈশ্বর ;

ইন্দ্রিয়, অতীন্দ্রিয় সবজুড়ে

যে শক্তি বিরাজমান,

তার সান্নিদ্ধ ও জ্ঞান

যদি দিতে পারে কোন উপায়

তবেই আছে ধর্মের প্রয়োজন।

 

মানুষ

দেখতে পাও

ওই ধর্মভীরু মানুষের পাশে পাশে

চলেছে অধার্মিকের দল?

ওরা বিশ্বাস করেনা  ঈশ্বর,

বলে ঈশ্বর চিন্তা শুধু ভ্রান্ত মনের সংসারে ;

যা আছে সব কিছু বাস্তব

তা সব বস্তু কণিকার আকর্ষণ বিকর্ষণ

আর ব্রম্মান্ডের  চালিত নিয়ম;

তাই এরা অনু পরমাণু,

তারও থেকে ক্ষুদ্র মৌলকণা

চর্চা করে, ধরতে চায় বাস্তবের রূপ;

মন যারে বলি ;

এরা   বলে সে মন বস্তুর টানে গড়া

অস্তিত্বের এক ভিন্নতম রূপ

জ্ঞান, বুদ্ধি, ইচ্ছা,

সবই বস্তুরই বিভিন্ন বিকল্প  আকার

সবকিছু বস্তু দিয়ে গড়া যায় ,

ভাঙা যায়, আবার তৈরী করা যায়;

নতুন জ্ঞান, বুদ্ধি, ইচ্ছা ও

তারই উপর ভিত্তি করে গড়া জীবন নাটক;

দেখ !ওরা তাই বানিয়েছে যান্ত্রিক মানুষ,

যাদের নাম দিয়েছে রোবট;

দেখতে পাও ঐ রোবটের দল

যাদের পিছু পিছু চলেছে নাস্তিক মানুষ?

হাতে নিয়ে ছোট একটা স্ক্রিন

দেখো কেমন অসাধারণ কৌশলে

এরা চালাতেছে  রোবটের প্রতি পদক্ষেপ ,

অদৃশ্যে দিতেছে দৃষ্টি, জাগাতেছে বিচার বিবেচনা আর

কর্মের আদেশ;

নিজেদেরই মনের ধাঁচে

এরা  গড়েছে যান্ত্রিক মানুষের মনের গঠন;

দর্পনে যেমন মানুষে দেখে আলোতে

নিজের প্রতিফলন,

এই অধার্মিকের  দল

তেমনি দেখে যন্ত্রমানুষের দেহে

নিজের বুদ্ধি, জ্ঞান ও ইচ্ছার প্রতিফলন;

যে মানুষ জীব কোষে গড়া,

সে গড়েছে নতুন মানুষ  যা শুদু বালুকণা ভরা,

এদের বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে বলে

চৈতন্যের রূপ এই কণারই  ভিতর

ঈশ্বর যদি থাকে

তা শুধু মৌল কণা

আকর্ষণ আর বিকর্ষণ;

এ কি সত্য?

সব কণিকাই তো শক্তির ভান্ডার,

সেই শক্তিই কি ঈশ্বর?

না, বস্তুর গঠনের বাইরে

আছে অন্য কোন শক্তি

যা থেকে আসে মনের নির্দেশ?

নাস্তিক মানুষ বলে

নেই অন্য কোন কিছু;

যান্ত্রিক মানুষই একদিন চালাবে সব ,

জীবকোষে তৈরী মানুষ হবে একদিন

এই রোবটের দাস।

 

কবি

নাস্তিক বলো যারে

সে খুঁজিছে নিজের মনের ভান্ডারে;

জ্ঞান, বুদ্ধি দিয়ে যুজিছে সংস্কার ,

সত্যকে বুঝিবার  তরে

করিছে আক্রমণ

যা কিছু তার কাছে মনে হয় অলীক বিশ্বাস ;

নাস্তিক দুই প্রকার:

একদল  সত্যান্বেষী,

অন্যদল শুধু করে সত্যের নামে

নিজের সীমিত জ্ঞানের অপপ্রচার ;

যারা স্বল্প জ্ঞানী,

স্বার্থান্বেষী ও ভাবে জীবনের অর্থ

শুধু সম্পদ ও বিলাস

যান্ত্রিক জগতে তারা খোঁজে

কি করে বানানো যায়

কৌশলে অন্য মানুষের কিকরে চালু হয়ে যায় নিজেদের দাস;

যে শক্তির প্রকাশে পৃথিবীর মাটি

হয়েছে উর্বর,

যে শক্তি ক্ষেতে, মাঠে, জলে, জঙ্গলে

জীবকোষে গঠিত প্রাণে করিছে জীবন উৎসব,

সে শুধু মাটি নয়, জল নয়,

নয় শুধু অনু পরমাণুর জটিল বিন্যাস,

সবই ঈশ্বর উদ্ভুত পরম বিস্ময় ;

যে কণিকার শক্তি বাঁধে দেহের বাঁধন,

যে শক্তি কোষে, অণুকোষে

জাগায় স্পৃহা, ইচ্ছা, দ্বন্দ্ব, জয়, পরাজয়

ঘৃণা, আক্রমণ,

যে শক্তি ভাঙে,  গড়ে

দৃশ্য গ্রাহ্য জগতের রূপ,

সবই সত্য: ব্রম্মান্ডের অমোঘ নিয়ম ;

এরই মাঝে রয়েছে ঈশ্বর ,

তবে ঈশ্বর শুধু পদার্থ নয়;

ঈশ্বরের মাঝে আছে আরো অনেক জগৎ;

গাছ-পালা , প্রাণী

পদার্থের উপর আরেক স্তর,

বস্তুর গঠনে নির্মিত জগতে

সে এক আরেক রূপে ঈশ্বরিক প্রকাশ;

দেহে যারে  দেখা যায়,

তার বাইরে রয়েছে ঈশ্বরের

অন্য এক অদৃশ্য “আকার “

ঐ নাস্তিকের দল যারে শক্তি বলে

যে শক্তি পদার্থে নিহিত রূপ,

যা তৈরী করে দেহের গঠন,

পরিবর্তিত  হতে থাকে

অন্যসব পদার্থের সাথে;

যা কঠিন তা হয় তরল,

যা তরল তা

বায়ু হয়ে উঠে যায় আকাশের মাঝে;

যা বাস্তবে মনে হয় রঙিন,

তাই হয়ে যায় অদৃশ্য রঙহীন;

যা মাটি তাইই হয় গাছ,

যা গাছ তাইই হয় ফুল ,

যা ফুল  তাই হয়ে যায় ফল,

তারপর আবার গাছ থেকে পাতা হয়ে যায় মাটি;

এইভাবে আবর্তিত হয় শক্তির

বিভিন্ন প্রকাশ;

এরই মাঝে রয়েছে ঈশ্বর;

কেন এই পরিবর্তন?

কেন এই জন্ম-মৃত্যু

তারপর আবার নতুন করে

জন্ম-মৃত্যুর কালচক্র ঘোরে?

যা আছে এখন

তা বাঁধা আছে

প্রতি স্থানে প্রতিকালে

কালচক্রে বিধানের সাথে ,

প্রতি অনু পরমাণুতে রয়েছে

ব্রম্মান্ডের গতি আর নির্দেশ;

প্রতি মুহূর্তে এই ব্রম্মান্ড চঞ্চল অস্থির;

তাই সর্বস্থানে জন্মায় বস্তু আর গতি,

সবাই   চলেছে একসাথে

নিয়মের টানে

পরস্পর পরস্পরকে নিয়ে;

যা একদিকে বয়ে যায় স্রোতে,

তাইই আবার ফিরে আসে অন্যদিক হতে,

এই পরিবর্তিত জীবনের মাঝে

আছে তাই এক অপরিবর্তিত অনাদি ঈশ্বর;

এই পদার্থের রূপ ছাড়া

ঈশ্বর আছে ভিন্ন আরও রূপে,

ব্রম্মান্ডের যা দৃশ্য গ্রাহ্য ,

আলোয় বাহিত কিংবা অন্ধকারে

নিমজ্জিত  শক্তির ভান্ডার ,

তার অদৃশ্যে আছে ঈশ্বরের অন্য প্রকাশ;

সে কি?

কিভাবে তাকে বুঝবে?

যে জ্ঞান আর বুদ্ধি বস্তু সংশ্লিষ্ঠ,

বস্তুর সাথে বস্তুর পরস্পর সম্পর্ক্যে পুস্ট,

তা দিয়ে মানুষ কিভাবে বুঝবে ঈশ্বর ?

যে ভাষা দিয়ে মানুষ ব্যক্ত  করে

তার চিন্তা, ভাবনা , উপলব্ধি, অনুভব,

সে ভাষাতেই মানুষ বুঝতে পারে

বাস্তবের বাইরে আছে এক অবাস্তব ;

মনের গভীরে দৃশ্য গ্রাহ্য জগতের বাইরে আছে শক্তি

স্বপ্নে কল্পনায়,

প্রশান্ত নদীর বুকে আলোকিত আকাশের

ছায়ার মতো তাকে দেখা সম্ভব;

জ্ঞান, বুদ্ধি যখন এই শক্তির কাছে আত্নসমর্পণ করে ,

তখন সে দেখা দেয়  তার অদৃশ্য রূপে;

শব্দ, চিন্তা, চারদিকে  ঘটনার স্রোত

প্লাবনের মতো সর্বদাই মনকে করিছে  আঘাত ;

যখন এই মন ডুবদেয় গভীর অতলে,

বস্তুর স্পর্শে আসেনা ইন্দ্রিয়ের আঘাত,

ভাষার বদলে সেথা শোনা যায়

নিস্তব্ধ জগতের কম্পন;

এই গভীরতম মনকে কি করে বোঝা যায়

তা’ বোঝে না

ঐ নাস্তিকের দল যারা করে

সবকিছুর  পদার্থিক বিশ্লেষণ ।

যাও ঐ মানুষের দলে

শোনো কি স্বপ্ন দেখে ওরা

কোথায় খোঁজে ওরা স্বাধীনতা?

কি ভাবে জানতে চায় ঈশ্বর কি ও কোথায়?

 

More Posts From this Author:

    None Found

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!