প্রশ্নোত্তর:
শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কিভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?
উপল বড়ুয়া: বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মানুষ বিভিন্ন কিছু আঁকড়ে ধরে বেড়ে উঠতে চেষ্টা করে। আর কৈশোর হলো স্বপ্ন তৈরির কারখানা। আমি আসলে একেক সময় একেক রকম হতে চেয়েছি। এখনো চাই। এই চাওয়ার শেষ নেই। ওই সময় বিভিন্ন বই-পত্রিকা পড়তে পড়তে লেখার দিকে হাত বাড়ানো। পাঠ্যপুস্তকের বাংলা বইটাও থাকবে এই তালিকায়। সময়টাতে মানুষের মন খুব সংবেদনশীল থাকে। কৈশোরে যেসব বাধা, অভিমান, রাগ, প্রেম, বেদনা নিয়ে শরীর ও মন বেড়ে উঠছিল তা যাতে ভারী বাতাসে ভেঙে না পড়ে তার জন্য কিছু একটা আঁকড়ে ধরার দরকার ছিল। আমার জন্য লেখালেখি হচ্ছে সেই খুঁটি। অচেতন মনে শব্দ নিয়ে খেলাটা তখনই শুরু। কবিতা বা লেখালেখিটা কেমন হচ্ছে, আদৌ হচ্ছে কিনা এসব নিয়ে ভাবার চেয়ে আমি যেকোনো কিছু নিয়ে লিখতে পারলেই আনন্দ পাই।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষা শৈলীর বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে শুনতে আগ্রহী।
উপল বড়ুয়া: নিজের সৃষ্টির ব্যাপারে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিটা নিরপেক্ষ থাকে না। একজন কবির ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সমসাময়িক, কতটুকু রাজনৈতিক বোধ লালন করছেন এবং তার নিজস্ব ভাষাভঙ্গিমা রপ্তের বিষয়টির বিচারক মূলত সমালোচক ও পাঠক। বলতে লজ্জা নেই, গদ্যে আমি ভাষার ক্ষেত্রে কিছুটা সিগনেচার তৈরির চেষ্টা করলেও কবিতায় কখনো এই ব্যাপারে ভাবি নাই। ভাষা তো বানানোই আছে, তাকে কতটুকুই বা নিজের করে গড়ে তুলতে পারি! সম্ভবত বাঙালি কবিরা শুরুতেই যে চিন্তায় হাবুডুবু খায়, তার একটি কবিতায় নিজস্ব ভাষা খুঁজে বেড়ানো বা সিগন্যাচার তৈরি। এর ফলে অনেকে ভাষাতেই আটকে থাকে। কবিতাটা আর হয়ে উঠে না। তবে নতুন ভাষাভঙ্গিমা চেষ্টা করে যাওয়াটা সুন্দর ও দরকারি। আর যখন আপনি লিখতে বসেন, তখন সামসাময়িকতা, নন্দন ভাবনা ও রাজনৈতিক বোধ বিভিন্নভাবে এসে জড়ো হয়। কিন্তু কবিতার যে বিমূর্ততা আমাদের দাঁড়িয়েছে, খুব গভীরে ডুব না দিলে তা উপলব্ধি করা মুশকিল।
শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল-অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
উপল বড়ুয়া: আমি যেভাবে চিন্তা করি, কবিতায় শ্লীল-অশ্লীল ব্যাপার বলতে আসলে তেমন কিছুই নেই। আর্টের শ্লীল-অশ্লীল ব্যাপার থাকে কিনা আমার জানা নেই। কবিতা হোক বা অন্যকিছু— তা কতটুকু শিল্পকে ধারন করছে এই বিষয়টায় আমার কাছে মুখ্য। যৌনতা বলেন বা অন্যকিছু, যেসব বিষয় আমাদের চোখে অশ্লীল ঠেকে, তা শিল্পিত নয় বিধায় অশ্লীল। এক্ষেত্রে, খাজুরাহো মন্দিরের মৈথুনরত মূর্তির উদাহরণ আসতে পারে। আমি অবশ্য স্বচক্ষে দেখিনি এই পুরাণকীর্তি। কবিতার কথা বললে, গালি বা শারীরিক যেসব অঙ্গকে আমরা সাধারণরা অশ্লীল বলে গণ্য করি, সেসব শব্দকে যদি যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারেন, তাতে যদি শিল্পের ছোঁয়া থাকে তবে তাকে অশ্লীল বলতে আমি রাজি নই। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে শ্লীল-অশ্লীল দুই ব্যাপারই থাকে। তা শিল্পে উঠে আসতেও পারে। কোনো নগ্ন নারী মূর্তি অনেকের কাছে অশ্লীল ঠেকতে পারে। কিন্তু শিল্পির কাছে এটা একটা শিল্প। ব্যাপারটা পুরোপুরি আমাদের দৃষ্টিকোণের বিষয়।
শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/ বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যে কোনো সময় ধরে হতে পারে, আপনার যেমন ইচ্ছে।
উপল বড়ুয়া: আমার আসলে জানতে ইচ্ছে করে, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরের অন্য যেসব স্থানে বাংলা ভাষার চর্চা হয় তারা কীভাবে কবিতা লিখছে তা জানতে। আন্দামানের বাঙালিদের সাহিত্যচর্চার হদিশ পেলে ভালো হতো। বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ তো আসলে দুই ভাই। ভাষাও একই। কেবল যা পার্থক্য তা একটু সুরে। বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু বা রণজিত দাশের কবিতা বাংলাদেশের পাঠক এখনও পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গের কবিরাও নিশ্চয় শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবুল হাসানদের পড়ছেন। কিন্তু এই পড়াটা এমন যে, এই নামীদের ভেতরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। যেমন আমাদের মাসুদ খানকে উনারা পড়েছেন কিনা জানি না। ফেসবুক সাহিত্য যেহেতু হচ্ছে, আদান-প্রদানটাও জোরালো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই বাংলাতেই কবিতার ক্ষেত্রে, ফর্ম বলেন বা চিন্তায় বেশ ভাঙচুর হয়েছে। এই ভাঙচুরটা অবশ্য বেশি লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে। ওদেরও হয়তো হয়েছে, কিন্তু জানা নেই। এই না জানার দূরত্বটুকুই দুই বাংলার বাস্তবতা। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের কবিতার যে বৈচিত্র্যসম্ভার তা খুব একটা দেখিনা পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যে। তাদের কবিতায় রয়েছে সুললিত লিরিক্যাল, রোমান্টিসিজম, টুইস্টের প্রবণতা। আমাদের এখানেও তা আছে। তবে কিঞ্চিৎ যা পার্থক্য, বাংলাদেশের কবিরা আরও বেশি করে টোটালিটি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্রাইসিসকে দেখতে চায়।
শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।
উপল বড়ুয়া: এবারের বইমেলা থেকে বেশকিছু কবিতার বই কিনেছি। তা পড়ছি। কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনও আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দীর্ঘ চেষ্টার পর তলস্তয়ের আনা কারেনিনা শেষ করলাম। বিভিন্ন কারণে এই উপন্যাস শেষ করতে পারেনি। যারা মার্কসবাদের চর্চা করে, সমাজতান্ত্রিক চিন্তার, আমি মনে করি, তাদের এই বই পড়া উচিত। উপন্যাসের সামন্ত চরিত্র লেভিনের ভেতর দিয়ে তলস্তয় কৃষক-শ্রমিকের মজুরি-শ্রমের যে পার্থক্য তা এতো যৌক্তিকভাবে দেখিয়েছেন, তার প্রাসঙ্গিকতা চিরন্তনের। ফেমিনিজমের কথা আর নাই বা বললাম। ভাবতে অবাক লাগে, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, মার্ক্স প্রায় একই সময়ের। ঊনিশ শতকের ইউরোপ ভাগ্যবান বটে।
কবিতা:
অবসরে
এমনই সে চায়—
আরাম কেদারায়
বসে চুপচাপ
নাড়াতে দু’পা।
হাতে বই, ফ্লাক্সে চা
পিরিচে বিসকুট
সকালের রোদ
চুমু খাবে ঘাসে।
বসে থাকবে সে
দুপুর অবধি
কোনো একদিন
নিষ্কাম অবসরে।
কেউ ডাকবে না
ডাকার নেই কেউ
থাকবে না যেহেতু
দুয়েকটা পাখি
থাকতে পারে।
এমনই সে চায়—
আরাম কেদারায়
না শোনা গানে
নাড়াতে মাথা।
বাসার নীচে কামারশালা
বাসার নীচে কামারশালা
আরেকটু দূরে গ্যারেজ
সকাল থেকে রাত অবধি
বাজে হেভিমেটালের বেস।
ধুম-ধাড়াক্কা হাতুড়ি আর
বাইকের রাগী গরগর
লোহা কাটার মেশিন ঘুরে
লাল ফুলকির কড়মড়।
পেটানো শরীর যেন লোহা
হাতুড়ি পেলে থাকে না হুঁশ
সকাল থেকে বাজাতে থাকে
পিংক ফ্লয়েডের ইকোস।
বিচ্ছিন্ন দ্বীপে
একবার জেগে উঠি, একবার ডুবে যাই
আমি কি চর— সমুদ্রের কোনো দ্বীপ?
তৃষ্ণার খনি হয়ে ভাসছি চতুর্দিক।
নিজেকে নিজে ছুঁড়ে দিয়ে মহানীলে
ডুবসাঁতারে নোনা বিষাদ নিচ্ছি গিলে।
এমন অনেক দুঃখ আছে মূর্খের মতো
দেখতে ওরা। পায়ের সঙ্গে থাকে মাথা
এমন অনেক বৃষ্টি আছে, ভিজতে হয়
উদ্দেশ্যহীন, একা এবং ছাতা ছাড়া।
বিগত শহরে
এইখানে পড়ে আছে ঝাপসা এক অন্ধকার
আপেলের মতো শরীর তার তুলতুলে নরম
এইখানে স্মৃতির বালিশে হেলান দিয়ে আমি
শুয়ে আছি; ভেতরে বাজছে মাতাল ড্রামস।
এক বুড়ো কেশে যাচ্ছে অবিরাম রাত্রি ভেঙে
ভেঙে; অবিকল বিড়াল হয়ে ডেকে যাচ্ছে
আরেকটা বিড়াল। এমন রাত নিয়ে আসে
কাম আর পুরোনো প্রেমিকাদের স্মৃতি বা
নেক্রোপলিস নগরের দিন; মিথ-মদের ঘটনা
আর আমাদের নাক ধরে রাখে প্রত্যেক
প্রেমিকার আলাদা আলাদা ঘ্রাণ।
সান্ধ্যভাষা
একটা ব্যথা নদীর পাশে এসে
ভাসিয়ে দিল ভাঙা তালের কোষা
শাপলা বিলে বৃষ্টি এলোমেলো
মেঘ— এক সরল সান্ধ্যভাষা।
ঝাপসা হলো পাতার আওয়াজ
অদূর গ্রামে ঘরে ফেরার তাড়া
মেঘের ডাকে মেয়েটি জবুথবু
পাখির ডাকে ছেলেটি দিল সাড়া।
পাখি ও ব্যাধ
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পাখি সে। নরম মাংসের ভেতর ধরে রাখে নির্মেদ এক কোমল হৃদয়। আমি তার চোখের ভাষা জানি। যেহেতু ব্যাধ জীবন আমার। ধনুক হাতে ঘুরি বন-জঙ্গল। আমি সেই সাহসী পাখিটিকে দেখি। দূষিত মানুষের ইঙ্গিত সত্ত্বেও যে তাকায় আকুল চোখে। আমি কীভাবে তার দিকে ছুঁড়ি তীর? তারচেয়ে বরং নিজের বুকে বসিয়ে দেওয়া যাক এক গোপন ছোরা।
বোকা নৌকা
তোমার যাবতীয় বসন্তদিন পেরিয়ে—
এক হাঁটু জলের নদী; মৃদু কুয়াশার সুবাস
কেমন নীচুস্বরে গরুগুলো ভাঙছে পথ
তাড়াহীন সময়ে কোথাও বাজছে করুণ বাঁশি
ফেলে যাচ্ছো তোমার ব্যক্তিগত ইচ্ছের ফড়িঙ।
এক ভ্রমরকে দেখেছি গতদিনে—
ফুলের স্তনে মুখ বুজে পড়ে আছে মাতাল
তার শিশুদের ছেঁড়া প্যান্ট, ধুলোমাখা পা
কেমন মায়াবী শৈশবের ফুরিয়ে যাওয়া সন্ধ্যা
সবই আজ ভোঁতা অনুভূতির বসন্তদিন!
এসব আত্মকথার গোঙানি ঝরাপাতাদের কথা
পাখি শিকারীদের নিশানায় দেয় প্রবঞ্চনা।
দূরে, ঐ মাঠের ধারে, কাছে হাঁটু জলের নদী
কুয়াশায় জমে যাওয়া এক বোকা নৌকা
তাতে বসে কয়েকটি শালিক নিভৃতে ডাকছে।
আমি কি মারা যাব তবে—
এমন অত্যাশ্চর্য সুন্দরের আঘাতে?