কবিতায় শ্লীল, অশ্লীল বলে কিছু নেই । কবিতার শেষ কথা আনন্দ

Share this:

প্রশ্নোত্তর:

শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কিভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?

আম্রপালী দে:  কবিতা লিখতে হবে বা তাড়না বোধ সম্বন্ধে বলার আগে আমি বলব কিভাবে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম । ছোটবেলা থেকে বই পড়তে প্রচুর ভাল লাগত । বই পড়ার পেছনে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমার মায়ের । যেটা সবচেয়ে সত্যি কথা এবং অনেক জায়গায় বলেছি সেটা হল আদতে আমি কোনকালেই কবিতা পড়তে কিংবা কাব্যগ্রন্থ পাঠে বিশেষ আকর্ষণ বোধ করতাম না । আমি যা কিছু পড়তাম পাঠ্যবই বাদে সেগুলো ছিল গদ্যগ্রন্থ । সেটা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি । আসলে গদ্য ভঙ্গিমায় লিখিত মনের ভাবকে খুব কাছের মনে হত । আমি ছোট বয়সে পড়েছি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, উপন্যাস সমগ্র । বঙ্কিম, বিভূতি, শরৎ, মানিক, তারাশঙ্কর এঁদের পড়েছি অল্প বয়সেই । পড়েছিলাম শেক্সপিয়রের বাংলা অনুবাদ । বরং সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সত্যজিৎ রায় কিংবা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা পড়েছি বেশ বড় হয়ে । সে যাই হোক আগরতলায় স্কুলিং শেষ হবার পর পশ্চিমবঙ্গের একটি মেডিক্যাল কলেজে চান্স পাই । সেখানে দীর্ঘ পাঁচ-ছবছরে আমি তীব্র একাকীত্বের সম্মুখীন হই । ধীরে ধীরে সবার মাঝেও নিজেকে ছায়ার মত একা মনে হত । তখন থেকেই মূলত কবিতার প্রতি ঝোঁক আসে । তাড়না বোধের ব্যাপারটাও সেখান থেকেই আসে । আমার প্রথম কেনা কবিতার বই কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “যেতে পারি কিন্তু কেন যাব” । প্রথম প্রথম ফেসবুকে লিখতাম, শখে । তারপর ধীরে ধীরে কিভাবে যে কবিতা আমার কাছে রক্তমাংসের শরীরের মত জলজ্যান্ত হয়ে ধরা দিল তা আমার অজানাই থাকুক চিরকাল ।

 

শুদ্ধস্বর:  আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষা শৈলির বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে শুনতে আগ্রহী।

আম্রপালী দে: নিজের কথা গুছিয়ে কি বলা যায় ? ২০২১ সালে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার একটি প্রকাশনা হাউজ ( সৈকত প্রকাশনী ) থেকে আমার একটি চার ফর্মার কাব্যগ্রন্থ “আমি সুজাতা নই” প্রকাশিত হয়েছে । কাব্যগ্রন্থটি যদি কেউ পাঠ করে থাকেন তাহলে আমাকে প্রথাবিরোধী বলতেই পারেন । আমি সময়কে তুলে ধরতে চেয়েছি । এর ভেতরে সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অবশ্যই আছে কিন্তু সেটা নিরপেক্ষ চোখে দেখা । একজন মানুষ হিসেবে দেখা । আমি আমার কবিতায় নিজের সত্ত্বাকে ধুলিস্যাৎ করে আধুনিক মানুষদের দুঃখ, যন্ত্রণার কাছাকাছি পৌঁছুতে চাই । যিনি লেখেন তিনি যে মূল নন, মূল যে লেখা ( টেক্সট ) সেটাই আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি । প্রথম বই প্রকাশের পরবর্তীতে আমি যা কিছু লিখেছি ইতিমধ্যে চেষ্টা করেছি ভিন্নস্বরে বলার ।

 

শুদ্ধস্বর:  কবিতার শ্লীল অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

আম্রপালী দে: কবিতায় শ্লীল, অশ্লীল বলে কিছু নেই । আমার অভিমত । কবিতার শেষ কথা আনন্দ । এই আনন্দ পাঠকেরও হতে পারে, যিনি লিখেছেন তারও হতে পারে । কবি একাই হয়ে উঠতে পারেন কবিতার পাঠক । কাব্যতত্ত্বের মূল হল রূপের দ্বারা অরূপের প্রকাশ আর অরূপের দ্বারা রূপকে আচ্ছন্ন করে দেখা ।

প্রথম যখন হাংরি জেনারেশনের কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতায় শ্লীল, অশ্লীলের যে থিন লাইনটা ছিল সেটা প্রায় মুছে যায় । আমরা যা শুনে কানে হাত দিই সেটা আসলে বাস্তব পরিস্থিতিকে গ্রহণ করার অক্ষমতা । কবিতা তো অনেক রকমের হতে পারে । পাঠকেরও রয়েছে প্রকারভেদ। যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ” যাকে সুন্দর বলি তার কোঠা সংকীর্ণ, যাকে মনোহর বলি তা বহুদূর প্রসারিত ।” আসলে এই সুন্দর, অসুন্দর অথবা শ্লীল, অশ্লীল আমাদের ব্যবহারিক জীবনের প্যারামিটার । কবিতায় কবিতায় প্রকাশ পায় । কিন্তু সাহিত্যের আসরে সবকিছু সত্য আর মনোহর ।

 

শুদ্ধস্বর:  বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আাপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/ বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যে কোনো সময় ধরে হতে পারে, আপনার যেমন ইচ্ছে।

আম্রপালী দে: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কবিতা নিয়ে যদি বলতে হয় তাহলে আমি বলব পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষ বসবাস করেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলায় । পরবর্তীতে রয়েছে আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য । তাই মাতৃভাষায় কবিতা পাঠের সময় ( যে কোন কবির ) আমি ভাবি না যে সেই লেখাটি কোন ভূখণ্ড থেকে প্রকাশিত হয়েছে । তবে কবিতা নিয়ে আলোচনার অভাব তো নেই । আলোচনা হয় বলেই আমরা অনেক কিছু জানতে পারি । কিন্তু আলোচনা বা মূল্যায়ন তো কবির কাজ নয়, আলোচকের কাজ । তবে একথা ঠিক বর্তমানে কবিতা নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে । তাই খুব ভাল ভাল কবিতা পড়ার সুযোগ পাচ্ছি আমরা । বাঙালি বিশ্ব সাহিত্যে পিছিয়ে নেই, বরং এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ ।

 

শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।

আম্রপালী দে:  খুব সাম্প্রতিক সময়ে আমি পড়েছি কবি কিশোর রঞ্জন দে’র কবিতা, কবি সেলিম মুস্তাফার কবিতা, কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর কবিতা । এঁরা প্রত্যেকেই উত্তর-পূর্ব ভারতের কবি । আরো অনেকেই আছেন । কবি প্রদীপ চৌধুরী ও কবি শৈলেশ্বর ঘোষ, বারবার পাঠ করি তাঁদের । ভাল লাগে ।

 

 

কবিতা: 

রক্ত লেগে গেল

ওইখানে আমাদের ঘর ছিল

ছবির মত জল আর সূর্যমুখীর নির্ভীক গন্ধ

ফিরে ফিরে আসত বাতাসের ভেতর ।

এই যে আমি একা

পুরোনো কোনও ছাগলছানার মত

ঝুপঝাপ শব্দে জল নড়ে ওঠে

কেউ যেন বলে যায়

          ফিসফিসিয়ে রঙিন কথা

চারিদিকে সানাইয়ের সাদা ফুল,

ভুতুড়ে কান্না আর পায়রা রঙের দিনে

যেন হঠাৎ একটু রক্ত লেগে গেল

এই যাহ,

নদীর মুখে রক্ত উঠে এল ।

 

দেবী

একেকদিন জানালা গলে উপচে ওঠে ক্লান্তি

দুপুর গোলাপী

দু’দণ্ড শোবার জন্য

ইতস্ততঃ করে যে পৃথিবী

স্মৃতিরা তাতে মানুষের মত হাঁটে

নিজেকে অপরাধী মনে হয়

শৃগালের মত দ্বৈত মনে যাকে ভালবেসেছ

সে তো গৃহ-দেবতা নয়!

ফুল তুলসী ফুরিয়ে গেলেও

তোমার ভক্তি ফুরোতে দেখি না

তুমি একটি অদৃশ্য উপমা, হে দেবী

স্বপ্ন ফুরিয়ে গেলে অপরাধ নিও না

 

সাদা ঘোড়া

অন্ধকার কাকে বলে

জানার প্রয়োজন নেই

সে দুমদাম দিক পাল্টায়

রঙ বদলে হয়ে যায় আলো

সেই আলো আমাকে চেনে

হাতছানি দিয়ে আহ্বান করলে

একটু একটু করে এগিয়ে যাই

যেতে থাকি…

পেছনে পড়ে থাকে

একটি দিকশূন্যহীন

সাদা ঘোড়া

 

স্বপ্ন

বাংলাকবিতার মাঝপথে

শুয়ে আছেন ব্রজকিশোর

তাঁর টলমল চোখে

রোহিণী জ্বলে ওঠে

আজ সে প্রেমিকা

টাটকা ফুলের মত হাসি

ছারখার করে পালায়

আমাদের স্বপ্ন

ঘুম ছেড়ে পালায়

 

নরক এখন ঈশ্বরের আবাস স্থল

হে আমার ভোঁতা সকাল

অঙ্কুরিত হও–

প্রাগৈতিহাসিক মাছেরা জলকেলি করছে

তুমি কোন চুলোর দালাল ভেবে নিয়ে

চুল বেঁধে দাঁড়াও পৃথিবীর ভাঁড়ারে

কাগজের উপর লেগেছে রক্ত

আমি নারী,

একটু বেকায়দায় ঘুমোলেই

লেগে যায় কলঙ্ক

পথে পথে আজ রক্ত ঘুরে বেড়ায় পাখির মত

মৃত্যু এক অপবিত্র জিহাদ–

পৃথিবীর প্রতিটি প্রতিভার পোশাক সাদা, চোখ লাল ও যৌনাঙ্গ রক্তাপ্লুত

এসো মৃত্যু,

এসো সহমরণ,

তোমার পিণ্ড দানের পর জায়গা করে নেবো জঠরে

চিত্রগুপ্তেরা বলে উঠছে

আম্রপালী, এসব লিখলে তুমি নরকেও স্থান পাবে না

নরক এখন ঈশ্বরের আবাস স্থল

 

মা

এই সমস্ত পাহাড় প্রমাণ চিন্তা

আমার পেশা–

তোমরা তো সবকিছুই জানো

মা বেছে বেছে ঐটি নিয়েছেন

আমার জন্য

যেভাবে ভগবান বাছেন কপাল

এটা অমুককে দেব

ওটা তমুককে

ঝেড়ে ঝুরে খানিক সিকি আধুলি বেরোয়

ভগবান কৃপা করে আমায়

ওই আধুলিটুকু দিয়েছেন

আর ভালবেসে দিয়েছেন

সোনায় মোড়ানো তোমাকে…মা

তুমি ছুঁলেই যে আমার সবকিছু

সোনা হয়ে যায়

 

লিমেরিক

তীব্র অসুখের নীচে  লিখেছি কিছু

প্রলাপের মতন কোনো গহীনে এক

কথামৃত অমৃত যেন  আলোক-শাখা

শিশুদের লিমেরিকে ভেসেছে যে ভেলা

তীব্র যাতনায় আকাশে পথে চাঁদ

পৃথুলা রমণীর মত উর্ধ্বে হাঁটে–

নৃত্য করে ঘোরে, কাপালিকের নিশি

সমারোহে তবুও কেন মৃত্যু  আজ

অপরাজিতা বিষটানে বেঁধেছে হায়

আলোরবাঁকে শিশু পাখিটি মনে পড়ে

About The Author

  • More From This Author:

      None Found

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

1 thought on “কবিতায় শ্লীল, অশ্লীল বলে কিছু নেই । কবিতার শেষ কথা আনন্দ”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!