বাংলা ও বাঙালি মুসলমান

Share this:

১.
ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির আগমন শুনেই লক্ষণ সেন ভয়ে কাপুরুষের মতো পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলে বাংলা মুসলিম শাসনের অধীনে চলে আসে-এরকম ডাহা মিথ্যা ইতিহাস দিয়েই আমাদের চিন্তার ঊষালগ্নের সূচনা ঘটে। এরকম ইতিহাস মুসলমান ঘরের ছেলেমেয়েরা মুখস্থ করে দুটি জিনিস রপ্ত করে তাদের জীবনের একদম শুরুতে-এক, নিজেকে একমাত্র মুসলিম পরিচয়ে আবিষ্কার করে মুসলিম বীরত্বে গর্বিত হওয়া। দুই, হিন্দুদের পরাজিত প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতে শেখা। কথিত লক্ষণ সেনের পলায়নের কাহিনি তার প্রতিবেশী হিন্দুর প্রতি তাকে করে তুলে হীন-অবজ্ঞার মানসিকতা। কেননা এই ইতিহাসের পটভূমিকায় বলা হয়, হিন্দু সেন রাজাদের অত্যাচার আর নিপীড়নে অতিষ্ঠ বাংলার প্রজারা একটা পরিবর্তনের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করেছিল তাই বখতিয়ার খিলজির আগমন ছিল তাদের কাছে সাক্ষাৎ ‘কল্পি অবতারের’ ধরাধামে আগমন! তারপর স্থানীয় হিন্দুরা ইসলামের সুমহান শান্তি আর ভ্রাতৃত্বের নির্দেশনা দেখে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যায়। এবং এরাই হচ্ছে বাঙালি মুসলমানদের পূর্ব পুরুষ…। কয়েক শতাব্দী ধরে এই অসত্য, অর্ধসত্য, বিভ্রান্তিকর, কাল্পনিক, অনুমাননির্ভর ইতিহাস পাঠ করিয়ে বাঙালি মুসলমানকে পরিকল্পিতভাবে স্রেফ মুসলমান ও ভারতবর্ষে একদা শাসন করা মুসলিম শাসকদের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেদের ভাবতে শেখানো হয়েছে। এই ভ্রান্ত কুয়াশার জাল ছিন্ন করে বাঙালি মুসলমানের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় উন্মোচন করার আগে আসুন বখতিয়ার খিলজির কথিত ‘বঙ্গ বিজয়’ বিষয়ে কিছু জেনে নেওয়া যাক।

বখতিয়ার খিলজি আদতেই ‘বঙ্গ বিজয়’ করেনি শুরুতেই এটা সাফ জানিয়ে রাখি। তিনি ১২০৩ ও ১২০৪ সালে নদীয়া ও নবদ্বীপের কিছু অংশ জয় করেছিলেন মাত্র। এদিকে লক্ষণ সেন ১১৭০ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন ও রাজত্ব করছিলেন। ইতিহাসবিদ ভিনসেন্ট স্মিথ মত দেন, এ সময়কালে লক্ষণ সেন মারা গিয়েছিলেন। তাহলে কি করে বখতিয়ার খিলজির ভয়ে লক্ষণ সেন খিড়কি দিয়ে পলায়ন করেছিলেন? মুসলিম ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ- তার ইতিহাস বইতে লক্ষণ সেনের কাপুরুষের মতো পলায়নের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেন বখতিয়ারের নদীয়া জয়ের ৪৩ বছর পর নিজামউদ্দীন ও সামসুদ্দীন নামক দুই ভ্রাতৃদ্বয়ের মুখে শুনে। এই একই বইতে তিনি নিজেই লিখেছেন তখন পর্যন্ত লক্ষণ সেনের বংশধররা পূর্ববঙ্গ রাজত্ব করছিল। ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী গ্রন্থ মিনহাজ শেষ করেন ১২৬০ সালে। ১১৭০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে লক্ষণ সেনের তিন পুত্র মাধব সেন,বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেনের পূর্ববঙ্গ শাসনের তাম্রলিপি নিদর্শন পাওয়া গেছে। তাছাড়া মিনহাজ নিজেই ১২৬০ পর্যন্ত বঙ্গে সেন রাজাদের শাসন চলার কথা স্বীকার করছেন। বুঝাই যাচ্ছে বখতিয়ার খিলজি সুবিশাল বঙ্গের নদীয়া ও নবদ্বীপের খানিকটা দখল করেছিলেন স্থানীয় সেন রাজাদের অনুগত কোনো সামন্তকে পরাজিত করে। এই নদীয়া জয়ের কাহিনিও যে অতিরঞ্জিত ও কাল্পনিক সেটা বখতিয়ারের ১৮জন সৈন্য নিয়ে বঙ্গ বিজয়ের কথা শুনলেই বুঝা যায়। এই কাহিনি বিশ্বাস করতে হলে প্রচুর কল্পনা শক্তির অধিকারী হতে হয়। লক্ষণ সেনের বিরাট সৈন্যবাহিনীর কথা জেনেও বখতিয়ার কি করে মাত্র ১৮জন সৈন্য নিয়ে নদীয়া-নবদ্বীপ দখল করতে সাহস করবেন? এ কারণেই পরবর্তীকালের সমস্ত ঐতিহাসিকরাই লক্ষণ সেনকে ‘বঙ্গ বিজয়ী’ বলেননি। আসল সত্য হচ্ছে ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্বে বাংলায় মুসলিম শাসনের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ১২৮৯ সালেও মধু সেন নামের একজন শাসকের নাম পাওয়া যায় যিনি পূর্ববঙ্গ শাসন করছিলেন। কাজেই বেশির ভাগ ঐতিহাসিকের মতে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গের রাজধানী নদীয়া বিজয়ের কাহিনি অলীক, কল্পনাশ্রয়ী।

বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয় ও লক্ষণ সেনের খিড়কি দিয়ে কাপুরুষের মতো পলায়ন এই গল্প বঙ্গের মুসলিমদের কাছে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও প্রতিবেশী হিন্দুদের থেকে দুরত্ব তৈরি করতেই যুগ যুগ ধরে পঠিত হয়ে আসছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আজো বাংলাদেশের পাঠ্যবইতে বখতিয়ারের এই কল্পিত বঙ্গ বিজয় ও লক্ষণ সেনের খিড়কি দিয়ে ‘কাপুরুষের মতো’ পলায়ন কাহিনি অপরিবর্তিত থেকে যাওয়া সেই সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবার মিশনকে বাস্তবায়নের অবিরাম চেষ্টা মাত্র। এই ইতিহাস পাঠের শিক্ষা কবি আল মাহমুদ তার ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতায় স্পষ্ট করেছেন এভাবে-
…আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি। খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।
দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে
দ্যাখো, দ্যাখো।
মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক
তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার
নিশেন ওড়ায়।…।

বখতিয়ারের ইতিহাস থেকেই বাঙালি মুসলমান নিজেদের ইতিহাসের সূচনা বলে মনে করে। এই ইতিহাসকে পুঁজি করে বাঙালি মুসলমান যখন নিজেদের অসাম্প্রদায়িক, বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারকবাহক বলে দাবি করে তাতে ভিত্তিটা দুর্বল ও ভঙ্গুর থেকে যায়। যে কারণে বাঙালি মুসলমানের অসাম্প্রদায়িকতার প্রচেষ্টা বার বার তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের সেই প্রচেষ্টাকে তাই আমরা দেখি এক দশকের মধ্যেই ধসে যায়। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিও বখতিয়ারের আলখেল্লার নিচ থেকে আসে বলে তার নিজের ভেতর স্ববিরোধিতা থাকে প্রকট আকারে। আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা বখতিয়ারের আলখেল্লার নিচ থেকে উদয় হয়েছিলেন। আসছি সে কথায় ধীরে ধীরে…।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক হামলা ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে ধর্মীয় বিদ্বেষ একটি সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিক নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নির্দেশনার সংমিশ্রণ। তাই বাঙালি হিন্দু মুসলমানের ‘অসাম্প্রদায়িক সহাবস্থান’ একটি রাজনৈতিক ভাষ্য বলেই মনে হয়। মূলত রাজনৈতিকভাবে এই দুই ধর্মীয় সাম্প্রদায়কে একটি অভিন্ন জাতীয়তাবাদী পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে সেক্যুলার হিন্দু কংগ্রেস নেতারা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনকে বেগবান করতে মুসমানদেরও এতে অংশগ্রহণ করানো । এই প্রচেষ্টা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। অত্যন্ত চড়া দরে ভারতবর্ষ তার মূল্য শোধ করেছিল। বাঙালি মুসলমান ধর্মীয় পরিচয়ে পৃথক হয়ে নিজেদের মুসলমান ও তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি করে। এটি ছিল বাঙালি হিন্দু থেকে নিজেদের আলাদা ‘জাতিসত্তার’ স্বাতন্ত্র্যতা প্রতিষ্ঠার একটি চেষ্টা।

২.
বাংলা তথা ভারতবর্ষে ‘মুসলিম’ এই পরিচয়ের জনগোষ্ঠির সূচনা অষ্টম শতাব্দী থেকে বললে ভুল হবে না। এই শতকে আরব বণিকরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাণিজ্য করতে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর সমুদ্র উপকূলে নোঙর ফেলে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণেই এই আরব বণিকরা পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত হয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলার সমুদ্র তীরাঞ্চলে এসে তাদের জাহাজ ভিড়ায়। বাণিজ্যের কারণে বণিকদের দীর্ঘদিন সমুদ্র উপকূলে অবস্থান করতে হতো। এর ফলে স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে সন্তানসন্ততি দিয়ে একটা সীমিত আকারের ‘মুসলিম সমাজ’ তাদের হাতে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আদি এই মুসলিম সমাজ খুব একটা বিস্তার লাভ করতে পারেনি। আরব বণিকদের স্থানীয় রমনীদের গর্ভে জন্মানো সন্তানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। বিধায় সীমিত আকারের এই জনগোষ্ঠী স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে মিলে মিশে গিয়েছিল। তাদের নাম, পদবিগুলোও স্থানীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী রাখা হতো। বাঙালি মুসলমানের ক্রমধারা বিষয়ে সবিস্তারে বলার আগে ভারতবর্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের সামরিক অভিযানের বিষয়ে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনের প্রেক্ষাপট লিখতে গিয়ে অনেকেই দাবি করেন পাল রাজাদের হটিয়ে দক্ষিণ ভারতের সেনদের বাংলা রাজত্বের সময় যে দমনমূলক শাসন চালানো হয়েছিল তাতে অতিষ্ঠ জনগণ মুসলমানদের আগমনকে দুহাত তুলে স্বাগত জানিয়েছিল। জাতিভেদ প্রথার নিস্পেষণে অতিষ্ঠ স্থানীয়রা মুসলিম শাসকদের সঙ্গে আসা সুফিদের উদার ধর্মমতে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল…। এই দাবি সঠিক নয় নানা কারণেই মনে হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের সমস্ত ক্রোধ ছিল বৌদ্ধদের উপর। কেননা এই সময়কালে তুরস্কের বৌদ্ধরা মুসলিম সাম্রাজ্যে হানা দিতে শুরু করে। এসব কারণে মুসলিমদের কাছে বৌদ্ধরা হয়ে উঠেছিল ইসলামের শত্রু। তাই বখতিয়ার খিলজি মগধ দখল করার পর বৌদ্ধদের কচু কাটা করেছিলেন। বৌদ্ধরা জীবন বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় লাভ করেছিল। বখতিয়ারের মগধ জয়ের অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধ শাসক হালাকু খার হাতে বাগদাদ নগরীর পতন ঘটেছিল। কাজেই স্থানীয় বৌদ্ধ জনসাধারণ সেনদের দমনমূলক শাসন থেকে রক্ষা পেতে মুসলমানদের স্বাগত জানিয়েছিল এরকম দাবি যৌক্তিক নয়। মুসলিম ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ বখতিয়ারের বৌদ্ধ বিহারগুলোর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া, শিক্ষার্থী ও জ্ঞান তাপসদের নির্বিচারে হত্যার গর্বিত বর্ণনা করেছেন। অপরদিকে বাংলায় হিন্দু সেন বংশের শাসনকালে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা নিপীড়িত হচ্ছিল। বর্ণবাদী ব্রাহ্মণদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছিল। কিন্তু এতেই মুসলিম শাসকদের দেখে তাদের উৎফুল্লিত হবার কি আসলেই কোনো কারণ ছিল? দেখা যায় অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানরা যখন সিন্ধু জয় করে নিলো তখন বড় প্রশ্ন দেখা দিলো মুসলমানদের দেশে হিন্দুদের বাঁচিয়ে রাখা হবে কিনা? নাকি জিজিয়া কর নিয়ে তাদের নতমস্তকে বাস করতে দেওয়া হবে। মুসলিম শাসকদের প্রয়োজন ছিল বিজিতদের সম্পদ ও অধিকৃত জমি থেকে নির্ধারিত হারে খাজনা (জিজিয়া) আদায় করা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ইসলামী বিধি। ইসলাম মতে কেবল আহলে কিতাবীদের (ইহুদী-খ্রিস্টান) জিজিয়া কর দিয়ে মুসলিমদের বশ্যতা স্বীকার করে বাঁচার অধিকার আছে। কিন্তু যারা হিন্দু পৌত্তলিক তাদের বেলায় জিজিয়া কর দিয়ে বাঁচার কোনো সুযোগ নেই। কারণ তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ ইসলামে স্বীকৃত নয়। তাদের একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলাম গ্রহণ করা নয়ত তলোয়ারের নিচে আপোষে মস্তক এগিয়ে দেওয়া। কিন্তু শেষতক সিদ্ধান্ত হলো এদের জিজিয়া করের বিনিময়ে মুসলিম শাসনে বশ্যতা স্বীকারপূর্বক বসবাসের অধিকার দেওয়া যেতে পারে। এই সিদ্ধান্ত হবার পরে জিজিয়া কর প্রদানের সময় একটি অভিনব দৃশ্যও ঘটতে দেখা গেল। জিজিয়া দেওয়ার সময় একজন হিন্দুকে মুখ হা করতে বলা হতো, আর সেখানে একজন মুসলিম সৈনিক থুতু ফেলে তাকে খেতে বাধ্য করা হতো। থুতু খাওয়ার বিষয়টি সম্ভবত হিন্দুদের আহলে কিতাবী না হওয়াতে বোনাস হিসেবে দেওয়া হয়েছিল-কে জানে! তাহলে দেখা যাচ্ছে সেন বংশের শাসনামলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সামাজিকভাবে নিপীড়িত থাকলেও মুসলিম শাসনের তাদের ভাগ্যের কোনো হেরফের ঘটেনি। তাহলে দলে দলে বাংলার বৌদ্ধ আর হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণের কাহিনির কি হবে? কীসের টানে তারা ইসলামে আকর্ষিত হয়েছিল? বলছি সেকথা…।

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে প্রচলিত ইতিহাস মতে ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গ ছাড়া আর কোথাও ধর্মান্তরিত মুসলিম পাওয়া বেশ দুষ্কর। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের মুসলিমরাই একমাত্র স্থানীয় যারা ধর্মান্তরিত হয়েছিল ধারণা করা হয়। যে কারণে ভারতে দিল্লির মতো বড় বড় শহরগুলোতে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেখা যায় মুসলিমদের সাড়ে পাঁচশ বছরের শাসনামলে। তাহলে বাংলায় কী এমন ঘটেছিল যে মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণের জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল? বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে বাংলায় ধর্মান্তকরণের কোনো প্রমাণ নেই! হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণের কোনো ঐতিহাসিক দলিল আজতক পাওয়া যায়নি। এটি ছিল একটি অনুমান ভিত্তিক ধারণা মাত্র। দুঃখজনক হচ্ছে যতটুকু দলিল পাওয়া যায় তা কেবল উচ্চ রাজ বংশীয়দের সম্বন্ধে, সাধারণ আম-জনতার কোনো ইতিহাস নেই। তাদের ধর্ম বিশ্বাসের পরিবর্তনেরও কোনো ইতিহাস নেই। তবু নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে ঐতিহাসিকদের মতে বাংলার মুসলমানরা পশ্চিম এশীয় মুসলিমদের বংশধর। কিন্তু নৃতাত্ত্বিকদের মত হচ্ছে বাংলার মুসলমানরা বাংলার হিন্দুদের সমগোত্রীয় এবং সম্ভবত স্থানীয়দের ধর্মান্তরণের ফসল। ১৮৭২ সালের আদম শুমারির তত্ত্বাবধায়ক রেভারলির মতে বাংলার মুসলমানরা স্থানীয় হিন্দুদের ধর্মান্তকরণের ফল। কিন্তু তার এই ধারণার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। রেভারলির এই অপ্রমাণিত ধারণাকে আমলে নিয়ে পরবর্তীতে হাবার্ট রিজলি নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় বলেছেন, বাঙালি মুসলমান মঙ্গোলীয়-দ্রাবিড় সংমিশ্রণের ফল যাদের রক্তে ইন্দো-আর্য রক্তও প্রবাহিত। মনে রাখতে হবে বাঙালি মুসলমানরা এরকম ধারণাটা বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছিল। নিজেদের পূর্বপুরুষ হিসেবে কোনো নিন্মবর্ণের হিন্দুকে তারা মেনে নিতে চায়নি। এটিকে তারা তাদের পূর্বপুরুষের মুখে কালি লেপনের ষড়যন্ত্র বলেছে। এ কারণে দেখা যায় খন্দকার ফজলে রাব্বি রেভারলি-রিজলিকে ভুল বলে অভিমত দেন এবং তিনি দাবি করেন, বাংলায় ধর্মান্তরণের কোনো প্রমাণ নেই, এমন কোনো অকাট্য দলিল নেই যেখান থেকে হিন্দুদের দলে দলে ইসলাম গ্রহণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে আফগান, তুরস্কর, আরব, ইরান ও দক্ষিণ ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ মুসলিম অভিবাসী হয়ে বাংলায় আসার প্রামাণ্য দলিল রয়েছে। এছাড়া পূ্র্ববঙ্গে বহু জায়গার মুসলিম নামকরণ থেকেও বুঝা যায় মুসলিম শাসনে এখানে অভিবাসী মুসলিমদের শাসকরা জমি দান করেছিলেন। রাব্বি রিজলির নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার উত্তরে জানিয়েছেন, অভিবাসী মুসলিমদের স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে যে সংমিশ্রণ ঘটেছিল তাতেও স্থানীয় জীবনযাপন ইত্যাদিতে তাদের দৈহিক গঠন স্থানীয়দের কাছাকাছি এসেছিল ধাপে ধাপে। দেখা যাচ্ছে রিজলি ও রাব্বিদের কথাতে যথেষ্ট যুক্তি আছে। তবু তাদের দাবি একপেশে বলেই মনে হয়। কোনোটিই পুরোপুরি মেনে নেওয়ার মতো প্রামাণ্য দলিল আমাদের হাতে নেই। কিন্তু ১৯০১ সালে এ এ গজনভী সবচাইতে যৌক্তিক অনুমানটি করেছিলেন। তিনি মত দেন, বাঙালি মুসলমানের ২০ ভাগ সরাসরি বাইরে থেকে আসা মুসলমানদের বংশধর, ৫০ ভাগ স্থানীয় হিন্দু ও বিদেশী মুসলমানদের যৌন মিলনের ফসল (হানাদার তুর্কি, আফগান, আরব যোদ্ধাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়ে এবং বৈবাহিক সম্পর্ক ধরে) এবং বাকি ৩০ ভাগ হিন্দু ও অন্যান্য ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত। গজনভীর মতে এই সমষ্টির নামই হচ্ছে “বাঙালি মুসলমান”। সবদিক বিবেচনায় গজনভীর গবেষণাই যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তা ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয়। সুফিদের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা ও কঠিন জিজিয়া থেকে রেহাই পেতে ইসলাম গ্রহণের প্রমাণ ইতিহাসে আছে। একই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক বাইরে থেকে আসা মুসলিমদের বাংলায় থেকে যাওয়ার অকাট্য দলিল রয়েছে। গজনভীর নৃতাত্ত্বিক দাবিটিকে আজকের যুগে এসেও সবচেয়ে যৌক্তিক বলে মনে হয় বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় সংকটকে প্রত্যক্ষ করে। বাঙালি মুসলমানের জিনে ৭০ ভাগ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে আরবি-তুর্কি-আফগান রক্ত প্রবাহিত। রাব্বি’র দাবি ও গজনভীর তত্ত্বকে আমলে নিলে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকট বুঝতে অসুবিধা হয় না।
৩.
বাংলা শব্দটি তিব্বতী ‘বঙস’ শব্দ থেকে আসার দাবি করেছেন পণ্ডিতরা। বঙস শব্দের অর্থ ভেজা বা আর্দ্র। পণ্ডিতদের এইমত যে সঠিক তা বাংলার ভূ-প্রকৃতি দেখলে বেশি করে মনে হয়। ‘বাংলাদেশ’ বলতে এখন যে ভূ-রাষ্ট্রটির কথা আমরা জানি সেটি একটি রাজনৈতিক পরিচয়, ‘বাংলা দেশ’ বলতে যে মাটি ও জনগোষ্ঠির কথা আমরা জানি তার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। যে বিশাল অঞ্চলকে বঙ্গদেশ বলা হয় তা সাত-আটশো বছর আগে নানা খণ্ডে বিভক্ত ছিল। মূলত ১৪ শতকে সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এই বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলো একত্র করে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে ভাষাতাত্ত্বিক পাণিণির অষ্টাধ্যায়ীতে ‘গৌড়’ শব্দটি উল্লেখ আছে, তবে বঙ্গ বলতে কিছুর উল্লেখ নেই। কিন্তু তার তিনশ বছর পর ‘পতাঞ্চলী’ অষ্টাধ্যায়ীর টিকাতে ‘বঙ্গ’ শব্দটি যুক্ত করেন। ‘ঐতেরেয় ব্রাহ্মণ’ রচনাকাল খ্রিস্টপূর্বকালে, সেখানেও বঙ্গের উল্লেখ নেই কিন্তু বঙ্গের সমসাময়িক অন্য অঞ্চলগুলোর উল্লেখ আছে। একই সময় বেদে বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় মহাভারতেও। মোঘল দরবারের ঐতিহাসিক আবুল ফজল ‘বাংলাকে’ দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘর বলে উল্লেখ করেছিলেন। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে পাল ও সেন রাজাদের গৌড়ের শাসক বলা হতো, বঙ্গের নয়, ত্রয়োদশ শতকে মুসলিমরা এই অঞ্চল দখল করলে তাদেরও গৌড় বিজেতা বলা হয়েছিল, বঙ্গ বিজেতা নয়। আমরা বর্তমানে এপার বাংলা ও ওপার বাংলার যে ‘সুমহান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’ নিয়ে গর্ব করি তার বয়স বড়জোর দেড়শো বছরের। পূর্ববঙ্গের ‘মুসলমান বাঙালির’ সংস্কৃতিক আন্দোলন ও ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি পাকিস্তান ভেঙে ‘বাংলাদেশ’ সৃষ্টির ইতিহাসও ২৩ বছরের। এই ২৩ বছরকে (১৯৪৭-১৯৭১) মূল্যায়ন করতে হবে সুদীর্ঘ বঙ্গের ইতিহাসের আলোকেই। নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ইতিহাস ছাড়া আজকের ‘বাংলাদেশে’ যে ধর্মীয় ও জাতিগত নিপীড়ন চালানো হচ্ছে তাকে বুঝা যাবে না-।

৪.
আর্যরা আসার পূর্বে যেমন অনার্য বলতে কোনো শব্দের প্রয়োজন পড়েনি, তেমনি ‘মুসলমানি’ শব্দের পূর্বে হিন্দুয়ানি বলতে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। মধ্যযুগের বাংলার হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা জরুরি। মুসলিম শাসনকালে রাজদরবারে বেশ সম্মানিত পদে হিন্দুদের নিয়োগ পেতে আমরা দেখি। মুসলিম সম্রাটের সেনাপতি একজন হিন্দু-এরকমটা ভারতবর্ষের মুসলিম শাসন সময়ে বিরল কোনো ঘটনা নয়। বিষয়টি আবহমান কালজুড়ে হিন্দু-মুসলমানের সৌহার্যময় সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই থলের বিড়াল লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মুসলিম শাসনে হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগের ইতিহাস বর্ণনা করার আগে শুরুতেই বলা উচিত, সুলতানী আমলের প্রথম দুইশত বছরে কোনো হিন্দুকে রাজকাজে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়ার কারণটিও রাজনৈতিক। বিবাদমান মুসলিম শক্তিগুলোকে দুর্বল করতে, তাদের দমন করতে স্থানীয় বিশ্বস্ত হিন্দুদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১০ খ্রি:) সর্বপ্রথম তার শাসনকার্যে স্থানীয় হিন্দুদের নিয়োগ দান করেছিলেন। কিন্তু শুরুতেই প্রবল বিরোধের শিকার হতে হলো সুলতানকে। সুফি দরবেশ মাওলানা মুজফর শামস বলখি সুলতানকে চিঠি লিখে জানালেন, সুলতান এই নিয়োগ দ্বারা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ ও বিভিন্ন শাস্ত্রীয় আইনকে অমান্য করেছেন। কাফেরদের ছোটখাটো কাজে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু শাসনকার্যে তাদের নিয়োগ ঘোরতোর ইসলাম বিরোধী কাজ। ইসলাম কোনো কাফেরকে রাষ্ট্রীয় কাজে যোগ্য বা সমান মনে করে না।… সুলতান বা সম্রাটদের উপর সুফি দরবেশদের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। যদি কোনো সুলতান সুফিদের মতামতকে উপেক্ষার সাহস করতেন, তবে সুফিরা পাশ্ববর্তী কোনো মুসলিম শাসককে চিঠি লিখে আক্রমণের অনুরোধ জানাতেন সুলতানের বিরুদ্ধে। এছাড়া শাসকদের কেউ সে অর্থে ধর্মকর্ম পালন না করলেও প্রবল ধর্মানুরাগী ছিলেন। নিজে ধর্মকর্ম পালন না করার অপরাধবোধেই সম্ভবত মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা, সুফি দরবেশদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বলখির চিঠিতে সুলতান বিচলিত হয়েছিল বুঝা যায়। কেননা সেসময় চীনা দূতেরা বাংলায় এসে যে বিবরণ লিখেছিলেন তাতে উল্লেখ করেছিলেন, সুলতানের ছোটবড় সব অমাত্যেরা সকলেই মুসলমান। প্রসঙ্গত বলা অসঙ্গত হবে না, পাকিস্তান আমল পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় একজন হিন্দু ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলেন। এতে কি সে সময়ের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্রীয় অবস্থাকে ভালো বলে প্রমাণ করে? বাস্তবতা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা হিন্দুদের পাকিস্তানের নাগরিকই মনে করত না। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর তাদের অত্যাচার আর নির্মমতা দেখে বুঝা যায় সেসময় পাকিস্তানে ধর্মীয় পরিচয়ে কতখানি বিদ্বেষ জারি ছিল।

৫.
“যাহার মাথায় দেখে তুলসী পাত।
হাত গলে বান্ধি নেয় কাজির সাক্ষাৎ।
বৃক্ষ তলে থুইয়া মারে ব্রজ কিল।
পাথরের প্রমাণ যেন ঝড়ে পড়ে শিল”…
ব্রাহ্মণ পাইলে লাগ পরম কৌতুক
কার পৈতা ছিঁড়ি ফেলে থুতু দেয় মুখে”।

পঞ্চাদশ শতকে বিজয় গুপ্ত লিখিত ‘মনসামঙ্গলে’ হিন্দু কর্মচারীকে নিয়ে তামাশার চিত্র এভাবেই ফুটে উঠেছে। সাধারণ আম-জনতার জীবনযাত্রা মধ্যযুগের সাহিত্যে কতকটা ফুটে উঠেছে। এসব থেকে আন্দাজ করার যায় সে সময়কার সামাজিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি কেমন ছিল। বিজয় গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’ ছিল জনমানুষের সাহিত্য। বাংলার নিম্নবর্ণের দেবী মনসার উচ্চাসন আদায় করে নেওয়া ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সঙ্গে এক শ্রেণি লড়াই। শিব ভক্ত চাঁদ সওদাগর নিম্নবর্গের দেবী মনসাকে মান্য করতে অস্বীকার করেন। কিন্তু চাঁদ সওদাগরের দর্পচূর্ণ হয় অবশেষে। মনসাকে দেবী মেনে নিতে হয়…। সেই মনসামঙ্গলে রাখাল বালকরা যখন ঘট দিয়ে নদীর ধারে মনসা পুজার সূচনা করে তখন দেখা যায় কাজির লোকজন এসে রাখালদের অকথ্য নির্যাতন করে পুজার আয়োজন ভেঙে দেয়। যে কুমার ঘট তৈরি করে দিয়েছিল তাকে গ্রেফতার করা হলো। মনসামঙ্গলে কাজির উক্তি এভাবে উঠে এসেছে-‘হারামজাত হিন্দুর এত বড় প্রাণ/আমার গ্রামেতে বেটা করে হিন্দুয়ান/গোটে গোটে ধরিব গিয়া যতেক ছেমরা/ এড়া রুটি খাওয়াইয়া করিব জাত মারা”।

চৈতন্যভাগবতের কয়েকটা লাইন, ‘যাহারে পাইল কাজি মারিল তাহারে/ভাঙ্গিল মৃদঙ্গ অনাচার কৈল দ্বারে।/ কাজি কহিল হিন্দুয়ানী হইল নদীয়া।/ করিব ইহার শাস্তি নাগালি পাইয়া/।… কাজির অত্যাচারে ভীত হয়ে চৈতন্যদেবের চ্যালারা নবদ্বীপ থেকে অন্যত্র চলে যেতে চাইল। হিন্দুদের মধ্যে যারা অবৈষ্ণবী ছিল তারা মনে মনে খুশি হলো এই ভেবে যে এইবার নিমাই পণ্ডিতের দর্পচূর্ণ হবে। নিমাই বেদকে অস্বীকার করে যে জাতপাতহীন ধর্ম প্রচার করছে এই হচ্ছে সেই অনাচারের সাজা। কখনো কখনো কোনো মুসলিম শাসককে স্থানীয় হিন্দুদের প্রশংসা বা স্তূতি’র কারণ ছিল এইরকম কায়েমী স্বার্থের কারণে। চৈতন্যদেব জাতপাতহীন হিন্দু ধর্মের সংস্কার করতে চাইলে ব্রাহ্মণরা ক্ষেপে গিয়েছিল। কাজি চৈতন্য ভক্তদের কীর্তন বন্ধ করে দিলে স্বভাবতই ব্রাহ্মণরা খুশি হয়েছিল। ঠিক এইরকম কায়েমী স্বার্থ থেকে শরিকদের বঞ্চিত করতে কখনো কখনো শাসন কার্যে হিন্দুদের স্থান দেওয়া হতো শাসনকার্যে। ইলিয়াস শাহের পদাতিক বাহিনীর অধিকাংশই ছিল হিন্দু যারা বীরত্ব দেখিয়ে যুদ্ধ করেছিল স্থানীয় হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে। একে তাই অনেকেই ধর্ম সংস্পর্শহীন রাজনীতি হিসেবে দেখার দাবি করেন। কিন্তু ঘটনা মোটেই সেরকম ছিল না। ইলিয়াস শাহ বংশের অন্যতম অমাত্য ছিলেন রাজা গণেশ। সুলতানী আমলের ছয়শ বছরের ইতিহাসে গণেশই ছিলেন একমাত্র অমুসলিম শাসক। কিন্তু তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন সুফিরা। গণেশের পুত্র জাদু পিতার বিরুদ্ধে সিংহাসন দখল করতে শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মেলায়। নিজেকে সিংহাসনের যোগ্য করতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ‘জালালউদ্দিন শাহ’ নাম নিয়ে মুসলমানদের সহায়তায় হিন্দু রাজা গণেশকে পরাজিত করে সিংহাসনে বসেন। ত্রয়োদশ শতকের জাফর খা গাজি থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের মুর্শিদকুলী খাঁ পর্যন্ত সকলেই মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। এদের কারুর কারুর যেমন আলীবর্দি খা, মুর্শিদকুলী খানদের শাসনকার্যে হিন্দুদের উচ্চপদে থাকার নজির রয়েছে। একই সময়ে রচিত চৈতন্যভাগবতের আছে, ‘বক্ষে রাখিল ঠাকুর তবু না ছাড়িল।/ চন্দ্রশেখরের মুণ্ডু মুঘলে কাটিল/। চন্দ্রশেখর ছিলেন চৈতন্যদেবের একজন ভক্ত। তার গৃহদেবতা স্বর্ণের তৈরি ভেবে মুসলমান সৈন্যরা তা কেড়ে নিতে হামলা চালায়। সুলতানী আমলে মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল যখন মসজিদগুলোর সংস্কার কাজ চলে। মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দিয়েই যে মসজিদগুলো নির্মাণ তা ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত হয়েছিলেন। মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ গ্রন্থের দুটো লাইনে তখনকার মুসলিম শাসকদের মনোভাব কি ছিল তার কবিতায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন এভাবে- “আমার বাসনা হয় যত হিন্দু পাই/সুন্নত দেওয়াই আর কলমা পড়াই”। কবিতাটা রচিত সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়কালে যখন সেনাপতি মানসিংহ প্রাতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন জাহাঙ্গীরের হয়ে। সে যুগে মুসলিম শাসনে কি পরিমাণ মুসলিম বিদ্বেষ বেড়েছিল তার কিছু দলিল পাওয়া যায় অষ্টদশ শতকে ভারতচন্দ্রের লেখা ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে। নবাব সিরাজদ্দৌলার নানা আলীবর্দি খানকে ‘দুরাত্মা’ উল্লেখ করা হয়েছে অন্নদামঙ্গলে। উড়িষ্যায় হিন্দু ধর্মের প্রতি দমন পীড়ন করার কারণে নন্দি ক্রুদ্ধ হয়ে উক্তি করেছিল, ‘মারিতে লইলা হাতে প্রলয়ে শূল/করিব যবন সব সমূল নির্মূল’। এই কাব্যের আরেক জায়গায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের জবানে বলা হয়েছে, ‘দেহ জ্বলিয়া যায় মোর বামন দেখিয়া/বামনেরে রাজ্য দিতে বল কি বুঝিয়া…/ আমার বাসনা হয় যত হিন্দু পাই/সুন্নত দেওয়াই আর কলমা পড়াই’। বাঙালি হিন্দু মুসলমানের ‘পাশাপাশি বসবাসের’ যে চিত্র মধ্যযুগের সাহিত্যে আমরা পাই তাতে কি করে একে সৌহার্দ্যময় সম্পর্ক বলা যাবে? দীনেশচন্দ্র সেন যিনি হিন্দু-মুসলমানের প্রীতিময় সম্পর্কে বর্ণনা করতে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন তিনিও ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘মুসলমান রাজা এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ সিন্ধুকী (গুপ্তচর) লাগাইয়া ক্রমাগত সুন্দরী হিন্দু রমনীগণকে অপহরণ করিয়াছে। ষোড়ষ শতাব্দীতে ময়মনসিংহের জঙ্গলবাড়ির দেওয়ানগণ এবং শ্রীহট্টের বানিয়াচঙ্গের দেওয়ানেরা এইরূপ কত যে হিন্দু রমণীকে বলপূর্বক বিবাহ করিয়াছেন তাহার অবধি নাই! পল্লী গীতিকাগুলিতে এই সকল করুণ কাহিনি বিবৃত আছে’।

৬.
বাংলার ছয়শ বছরের মুসলিম শাসনের পুরোটাই হিন্দু-মুসলমানের পরস্পর ঘৃণা আর বিদ্বেষ একটা ঐতিহাসিক চেহারা নিয়েছে। জাতিভেদ হিন্দু সমাজকে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ করে দিয়েছিল। কুসংস্কার আর অনাচারে নিমজ্জিত হিন্দু ধর্মে জাতিচ্যুতি কী মহামারির আকার নিয়েছিল খুলনার খান জাহান আলীর শাসন আমল খানিকটা দেখা যায়। খান জাহান আলী ছল-চাতুরী করে তার ব্রাহ্মণ কর্মচারীর জাত মেরে তাকে হিন্দু সমাজ থেকে পতিত করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ভিন্ন কোনো পথ রাখেননি। এই ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণকে ইতিহাসে ‘পিরালী’ বলে অভিহিত করে থাকে। খান জাহান আলী তার নব দীক্ষিত শিষ্য তাহের আলীকে আদর করে ‘পীর আলী’ বলে ডাকত যা পরে লোকমুখে ‘পিরালী’ হয়ে পড়ে। বর্বর ব্রাহ্মণ সমাজ এইসব ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণদের আত্মীয়স্বজনকেও একঘরে করার ঘোষণা দিয়ে তাদেরকে ‘পিরালী বামুন’ নাম দিয়ে সমাজচ্যুত করে। কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, সিঙ্গিয়ার মুস্তফী পরিবার, দক্ষিণ ডিহির রায়চৌধুরী পরিবার, খুলনার পিঠাভোগের ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্মণদের দেওয়া অভিশপ্ত পিরালী বামুন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এসব পরিবারের পুত্রকন্যাদের বিয়ে দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছিল। হিন্দুরা এইসবের জন্য মোটেই অনুতপ্ত ছিল না কারণ তাদের কাছে শাস্ত্রের বিধি অলঙ্ঘনীয়। একইভাবে মুসলিমরা হিন্দুদের দেবালয় ভাঙা, জিজিয়া কর বসানো ইত্যাদির জন্য কোনো মনোবেদনা অনুভব করত না কারণ এসবই ইসলামী শাস্ত্রে আদেশ করা হয়েছে বলে তারা উৎফুল্ল থাকত। এইরকম ভিত্তির উপর কেমন করে আবহমান বাংলায় হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই হয়ে বসবাস করেছিল জানা মুশকিল। মধ্যযুগের সাহিত্যগুলোতে ফুটে উঠেছে হিন্দু-মুসলমান পরস্পর বিদ্বেষ আর ঘৃণা। মধ্যযুগের কবি আলাওল তার কাব্যে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন হিন্দুর দেবতারা অর্থহীন, ইসলামই একমাত্র মোক্ষলাভের উপায় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। অন্যদিকে বৈষ্ণব গ্রন্থ ‘প্রেমবিলাসে’ মুসলিম শাসনকেই সকল দুঃখের একমাত্র কারণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। যদিও আমাদের প্রচলিত কিছু ইতিহাস দাবি করে আবহমানকালের বাংলায় হিন্দু-মুসলমান বাঙালির একই সত্তার দুটো দিক ছিল তার প্রমাণ মুসলমানের পীরের দরগায় হিন্দুদের উপস্থিতি কিংবা হিন্দু সাধুদের প্রতি মুসলিমদের সম্মান জানানো। কিংবা রাত জেগে হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের রাম-সীতার পাঠ দেখা, পক্ষান্তরে বিষাদ-সিন্ধুর পাঠ শুনতে হিন্দুর মুসলমান বাড়িতে যাওয়া। মূলত বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সৌহার্য একটি রাজনৈতিক প্রচারণা। এটি ভারতবর্ষের সেক্যুলার হিন্দু রাজনৈতিক নেতাদের একটি প্রচেষ্টা। কিন্তু ভারতীয় মুসলিম নেতারা নিজেদের ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পৃথক সত্তা বলে স্বীকার করতেন বলেই ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিমরা (জাতিতে তুর্কি, আফগান, আরব) ভারতে এসে যে নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হলেন তার সঙ্গে নিজেদের সংস্কৃতি ও ধর্মের স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষার জন্য একে ‘হিন্দু সংস্কৃতি’ নাম দিলেন। অনেকটা আর্যরা আসার পর যেমন অনার্য পরিচয়টি তৈরি হয়েছিল। ‘হিন্দু ধর্ম’ ‘হিন্দু সংস্কৃতি’ বলতে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না মুসলিম আগমনের পূর্বে। ভারতে বৌদ্ধসহ আরো বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠিত ছিল, এসব ধর্মের বিপুল জনগোষ্ঠি নিজেদের ধর্ম ও জীবনে যে সংস্কৃতি বহমান ছিল তাকে রক্ষা করার জন্য কখনোই ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি’ পরিহার বা স্বাতন্ত্র্র্যতা রক্ষার চেষ্টা করেননি। সেমিটিক ধর্মগুলোর সব ক’টির উৎপত্তি স্থল একই ভূমি ও সংস্কৃতি থেকে বলে তাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে বিবাদ থাকলেও কোনোদিনই ‘ইহুদী সংস্কৃতি’ বা ‘খ্রিস্টান’ সংস্কৃতি’ এইরকম মোটা দাগে সংস্কৃতি বিরুদ্ধাচারণের উদারহণ নেই। এ কারণেই ইসলাম ধর্মের ইহুদী ও খ্রিস্টান অনুষঙ্গ বেশি হওয়ার কারণে তাদের ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির’ প্রতি যতখানি রাগ-ক্ষোভ বা ছুঁতমার্গ তার এক শতাংশও আরবের ইহুদী-খ্রিস্টান কালচার বিষয়ে অনুপস্থিত। বাস্তবতা হচ্ছে ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন জাতির সংস্কৃতির একটি সংকলনের নাম হচ্ছে ‘হিন্দু সংস্কৃতি’। ঠিক ভারতবর্ষের স্থানীয় উৎস থেকে জন্ম নেওয়া সকল ধর্মের সংকলনের নামও ‘হিন্দু ধর্ম’।

৭.
বাঙালি মুসলমান প্রগতিশীলদের উত্থান ইংরেজ আমলে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাংলার গ্রামগুলিতে হিন্দু অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরা স্কুল খুলে ছেলেদের পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই সুযোগে মুসলমান ঘরের দু-চারজন ছেলেও স্কুলে গিয়েছিল মাদ্রাসামক্তবে না গিয়ে। এদের মধ্যে থেকেই আমরা পরবর্তীকালে পাই কাজী মোতাহার হোসেনদের মতো প্রগতিশীলদের। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে ‘বাঙালি আর মুসলমান ছেলেদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ’ এইরকম একটি লাইন দেখে মনোক্ষুণ্ন হয়ে কাজী সাহেব নালিশ জানিয়ে ছিলেন খোদ শরৎচন্দ্রকেই। যদিও লেখক দাবি করেছিলেন মুসলমান বলতে তিনি হিন্দুস্তানী মুসলমানদের কথা বুঝিয়েছেন, বাঙালি মুসলমানদের বুঝাননি। বাংলার মুসলমানও বাঙালি-এই বোধটি প্রতিষ্ঠিত করা ছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের প্রগতিশীলতার হাতেখড়ি। মাওলানা আকরম খাঁ ছিলেন বাঙালি ব্রাহ্মণ থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান। তাদেরকে বলা হয় ‘পীরালী মুসলমান’। ইনারা কোনো মুসলিম সুফি বা শাসকের হাতে হিন্দুত্ব খুইয়েছিলেন জাতমারার মতো কোনো ঘটনায়। স্বয়ং আকরম খাঁ নিজেদের ধর্মান্তরিত মুসলিম স্বীকার করতে চাননি। অন্যত্র এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি বলে এখানে সেই ইতিহাস থেকে বিরত হলাম। দুঃখজনক হচ্ছে আকরম খাঁ’রা নিজেদের বাঙালি বলে অস্বীকার করতেন। তাদের পারিবারিক ভাষা ছিল উর্দু। দাবি করতেন তাদের পূর্বপুরুষ আরব থেকে এসেছিল। কাজেই একই সঙ্গে বাঙালি থাকা ও না থাকাটা প্রায়শই বাঙালি মুসলমানের একক চর্চা বলেই মনে হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বরাবরই দেখা গেছে বাঙালি হিন্দুরাও এক পর্যায়ে মুসলমানদের বাঙালি নয় এমন একটা ধারণা করে বসে আছে। ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে মুসলমানরা ‘খেলাফত আন্দোলন’ শুরু করলে মুসলমানের জাতিসত্তা নিয়ে অন্যরা প্রশ্ন তোলে। তুরস্কের খিলাফতের খলিফাকে নিজেদের খলিফা, তুরস্কের শেষ ইসলামী খিলাফতকে রক্ষা করার দাবি করলে এতকাল ভারতের যেসব হিন্দু রাজনৈতিক ও চিন্তক ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের’ স্বপ্ন দেখতেন, এবং যারা কল্পিত আবহমানকালের হিন্দু-মুসলমান সৌহার্দ্যের ইতিহাস প্রচার করতেন তারা পর্যন্ত ভাবিকালের একটা বিভেদের দৃশ্য কল্পনা করে আতংকিত হয়ে পড়েছিলেন। তাদের সকলের আশংকাই সত্য হয়েছিল। ভারতকে ভাগ করেছিল মুসলমানরা। আর এই কাজটি এককভাবে সফল করেছিল বাঙালি মুসলমানরা, যারা তখন নিঃসন্দিহান তাদের আত্মপরিচয় নিয়ে, তারা কেবলই মুসলমান, আগে বা পিছে বাঙালি বসানোর কোনো প্রয়োজন নেই…।

৮.

উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ভারতীয় হিন্দুদের একটা অংশ ভাগ্যান্বেষে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে অভিবাসী হয়ে নিজেদের ভারতীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। নিজেদের অবস্থাকে ভিএস নাইপল উল্লেখ করেছেন এভাবে,
‘শহরে ভারতীয় লোক খুব কম ছিল। রাস্তাঘাটে আমাদের মতো তেমন কাউকে চোখে পড়ত না; নিজেকে সেখানে কেমন যেন অনাহূত আগন্তুকের মতো লাগত…। আমাদের মানসিকতা আমাদেরকে চারপাশের নানা জাতির সংমিশ্রণে তৈরি ভিন্ন ঔপনিবেশিক পরিবেশ থেকে পৃথক করে রেখেছিল…’।

এই সংস্কৃতি ভিন্নতা,উপনিবেশিক শাসক এইসব কিছু অভিবাসী ভারতীয় যারা দেড় শতাব্দী আগে এখানে এসেছে তারা কি স্থানীয়দের উপর বিচ্ছিন্নতাবাদ চাপাতে চেয়েছিল কিংবা তাদেরকে নিজেদের শাসনে অধীনস্ত করতে রাজনৈতিক প্রচেষ্টা করেছিল? কিংবা ফেলে আসা ভারতের কোনো হিন্দু শাসককে নিজেদের শাসক ভেবে অভিন্ন ভ্রাতৃত্ববোধ অনুভব করেছে? ছয়শত বছরের মুসলিম শাসনের ফলে স্থানীয় ও অভিবাসী মুসলিমদের সংমিশ্রণে ভারতীয় মুসলিম ঠিক কিসের তরে ইসলামী বিশ্বের শেষ খিলাফত রক্ষার্থে আন্দোলনে নামে পরাধীন ভারতবর্ষে? গান্ধিজী তার অসহযোগ আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এই তথাকথিত খিলাফত আন্দোলনে নিজের সমর্থন দিয়েছিলেন। মুসলিম নেতারাও খিলাফতের দাবিকে কংগ্রেস মেনে নেওয়ায় অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে। বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস উপরে দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা করেছি। বিংশ শতকের ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল কাল্পনিক ইতিহাস তৈরি করে তার ভিত্তির উপর মহৎ অসাম্প্রদায়িক একটি অভিন্ন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী পরিচয় তৈরি করতে যাওয়া। কিন্তু যারা নিজেদের তুরস্কের খলিফার প্রজা মনে করে,সেই মানসিক বৈকল্যেকে আরোগ্য না করে যে কৃত্রিম মিলনের প্রচেষ্টা হয়েছিল,তারই ফলে বিয়োগান্তক রক্তপাতময় দেশভাগ সংগঠিত হয়।

উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেল ১৮৫৮ থেকে ১৮৫৯ টাইমস পত্রিকায় ভারতীয় সাধারণ মানুষের দুর্দশা দেখে লিখেছিলেন,সাধারণ মানুষগুলো পেট ভরে খেতে পারে না। হাড় জিরজিরে দুর্বল শরীর নিয়ে তারা ব্রিটিশদের আগে আসা অন্য শাসকদের জন্য যেভাবে খেটেছিল সেভাবেই ব্রিটিশ শাসকদের জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছে…। ভারতের এই সাধারণ মানুষ আসলে কারা? ভারতীয় মুসলমান নিজেদের শাসক জাতি বলে মনে করত। ইংরেজরা তাদের কাছ থেকে শাসন কেড়ে নিয়েছে। সেই শাসক আদায় করে তারা ফের ভারতকে সপ্তম শতাব্দীর অনুকরণে শাসন করবে-এইরকম চিন্তা ও ভাবনা যে সম্প্রদায় তার যাবতীয় জাগতিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে লালন করে তারা কি করে ভারতের অবশিষ্ট বৃহৎ জনগোষ্ঠির সঙ্গে অভিন্ন জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে? ভিএস নাইপল অত্যন্ত কঠোরভাবে মুসলিম শাসনামলকে বলেছেন, স্প্যানিয়ার্ডদের সামনে মেক্সিকান এবং পেরুভিয়ানরা যেমন অসহায় ছিল। আক্রমণকারীদের ওইসব সভ্যতার প্রায় অর্ধেক যেভাবে খান খান হয়ে গিয়েছিল ভারতের সভ্যতাও মুসলমানদের হাতে সেভাবে ধ্বংস হয়ে যায়…। নিঃসন্দেহে নাইপলের কথায় যুক্তি আছে। এক নলন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত সমস্ত বই পুড়িয়ে প্রাচীন ভারতের একটা চিত্রকে বখতিয়ার খিলজী ধ্বংস করে ফেলেছি। হানাদারদের কাছে স্থানীয় ইতিহাস,জ্ঞান,সভ্যতার কোনো মূল্য থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। নাইপল যাকে বলেছেন ‘ভারতের অতীতের বর্ণনা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে…’।

১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলমান ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলেও একই সঙ্গে তারা পাকিস্তানে বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন করে। এটিকে বাঙালি মুসলমান তাদের প্রগতিশীলতার একটি নমুনা হিসেবে দাখিল করে থাকে। এই ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে নতুন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের দাবিকৃত প্রগতিশীলতা শুরুতেই মারাত্মক হোঁচট খায় যখন বাংলাদেশকে একটি ইসলামী চেতনার মুসলিম রাষ্ট্রের অনুরূপ হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন নতুন কিছু না। সাম্প্রতিক সময়ের রামু, মালোপাড়া, নাসিরনগর হামলা নির্যাতন ইতিহাস বর্হিভূত হঠাৎ কোনো পদস্খলন নয়। এর রয়েছে সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক প্রমাণাদি যা উপরে আলোচনা করেছি। এই আলোচনা আত্মসমালোচনার। বাঙালি মুসলমানের আত্মসমালোচনা ব্যতীত মুক্তি নাই…।

তথ্যসূত্র: (১) বাঙ্গালার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (২) বাংলা দেশের ইতিহাস, রমেশচনন্দ্র মজুমদার (৩) বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা, আকবর আলী খান (৪) বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, বিনয় ঘোষ (৫) চিন্ময় বঙ্গ, ক্ষিতিমোহন সেন (৬) দেওবন্দ আন্দোলন, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহা: ইয়াহিয়া (৭) দুশো বছরের বাংলার নথি, ত্রিপুরা বসু (৮) হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস, গোলাম মুরশিদ (৯)আমার পড়া লেখা, ভিএস নাইপল (১০)সুন্দর বনের ইতিহাস, এ এফ এম আবদুল জলিল (১১)সেরা মুসলিম মনীষীদের জীবন কথা, নাসির হেলাল (১২) ইন্টারনেট।

  • More From This Author:

      None Found

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

1 thought on “বাংলা ও বাঙালি মুসলমান”

  1. অসম্ভব তথ্য বহুল একটি লিখা। এই বিষয়ে আমার পড়া এটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ লিখা। অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় এখানে । অনেক দিন পরে কোন লিখা এত আগ্রহ নিয়ে প্রতিটা লাইন পড়লাম এক নিঃশ্বাসে।

    বিশ্লেষণগুলো ও সর্বোপরি চমৎকার ছিল। ২-১ জায়গায় সামান্য দুর্বল মনে হয়েছে। যেমন, উইকিপি[ইডিয়ার তথ্য অনুসারে হালাকু খান মৃত্যর আগে দিয়ে বৌদ্ধ হন। যদি সেটা হয়ে থাকে, তাহলে উনার বাগদাদ আক্রমন আর বৌদ্ধ -মুসলিম বিরোধ এর ব্যাপারটা মিলানো মুশকিল।

    যাই হোক, লেখককে অভিনন্দন এত চমৎকার তথ্যবহুল এবং বিশ্লেষণী লিখার জন্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!