নয়:
জায়েদের সঙ্গে সে রাতের তর্ক বিতর্কের পর অঞ্জলির বুঝতে সমস্যা হয়না,অনেক কিছু বদলে গেছে; বদলেছে জায়েদ; জায়েদের ভাবনা-চিন্তা এবং সে নিজেও পরিবর্তীত হয়ে গেছে!নিজের পরিবর্তন ওকে তেমন বিস্মৃত করে না,বরং মনে হয়:এই পরিবর্তনটি আরও আগে হওয়া প্রয়োজন ছিল,যেমন জায়েদ বদলে গেছে অনেক আগেই,জায়েদ বদলে যাচ্ছিল দ্রুতই; ও নিজেই শুধু চোখ বন্ধ করেছিল। কিংবা এমনও হতে পারে, জায়েদ নিজের মতোই ছিল অঞ্জলিই হয়ত জায়েদকে চিনতে পারেনি, এখন ধুম করে বন্ধ চোখ খুলে যাওয়াতে হঠাৎ অশনি আলোর ঝলকানিতে ও সংকিত, ভীতশ্রদ্ধ। এও উপলব্ধি করতে পারছে,চোখ খুলে সত্যটা দেখতে হবে,ভয় থেকে বাঁচার জন্য চোখ বন্ধ করে রাখা কোনো কাজের কথা নয়।
জায়েদের হঠাৎ করে সন্তান উৎপাদনের(উৎপাদনই তো!)ঘিনঘিনে ইচ্ছেটা অঞ্জলির গায়ে সারা রাত বিছুটির মতো লেপটে থাকে। টিনটিনের জন্ম হয়েছিল ওদের দু’জনের যৌথ সিদ্ধান্তে, অন্তত এতদিন অঞ্জলি তাই ভেবে এসেছে। কিন্তু গতরাতে জায়েদের হঠাৎ উথলে ওঠা খায়েস ও’কে যতটা বিস্মিত করে তারচেয়ে বেশি ওর মানসিকতার পরিবর্তীত রূপ দেখে আতংকিত হয়ে ওঠে ভেতরে ভেতরে। স্ত্রীকে ঘরের চার দেয়ালের আটক করে রাখার সব চেয়ে মোক্ষম আর আদিম প্রন্থাটি জায়েদ বেছে নিয়েছে,স্ত্রীকে গর্ভবতী করে দেয়া!সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে মা হিসাবে ওর স্বতস্ফূর্ত ইচ্ছা-নিচ্ছাকে জায়েদ ধাতব্যের মধ্যে রাখেনি, যেন নারী স্বামীর ইচ্ছাতে যোনী পেতে দেবে, ডিম্বাশয়ে সযত্নে ধরে রাখবে শক্রানুকে,গর্ভের উষ্ণতায় ভ্রুণটিকে তিলতিল করে বৃদ্ধি করবে, ব্যস এটুকু দায়িত্ব নারীর;আর সব কিছুতে নারীর ভূমিকা উহ্য! বিস্ময়কর পুরুষ ভাবনা বটে!
সারা রাত নারীটি ভাবনার জলে ডুবতে থাকে, নিমজ্জিত হতে থাকে;হাবুডুবু খায়; নিমজ্জিত হতে হতে জলের অনেক নিচে;যেখানে নদীর গভীরে পলি মাটি শীতল পাটির মতো বিছিয়ে রয়েছে,সে পাটিতে সে আছড়ে পড়ে। নিমজ্জিত নারী নদীর অতলে ডুবে পলি মাটির পেলবতায় নিজের বারবার পরাজিত গাল-ললাট চেপে ধরে যখন একটুখানি স্বস্তি খুঁজতে চাইছিল তখন একটি সিদ্ধান্ত খুব সন্তর্পণে নারীর ভেতরে ঢুকে বসে। তখনও সিদ্ধান্তটি চোখকানমাথাহৃৎপিণ্ড এমন কী অপ্রয়োজনীয় লেজবিহীন এক বিন্দু রক্ত ভ্রুণের মতো, জ্বলজ্বল করছিল উদ্ভিন্ন তেজে। ভ্রুণটি নারীকে মন্ত্র মুগ্ধের মতো আকর্ষণ করে,ওষ্ঠহীন,স্বরহীন কণ্ঠে প্রলুব্ধ করে বলে; আমাকে জন্ম দাও। তোমাকে কে রুখবে? কেনো রুখবে? অনেক হলো অন্যের মতো বাঁচা, এবার না হয় নিজের মতো করে আবার বাঁচার চেষ্টা করো। আর একবার নিজেকে বিন্যাস করো। নিজেকে পূণঃনির্মাণ করো।
জায়েদ নিশ্চুপ হয়ে রকিং চেয়ারে বসে ছিল সারা রাত,ভয়ানক রকম চিন্তিত দেখাচ্ছিল ওকে। একটা ভীতি ওর মুখের ওপর হাজার চিহ্নরেখা এঁকে দিয়ে যাচ্ছিল মুহূর্তে মুহূর্তে। সুমনকে নিয়ে সে আর কোনো প্রশ্ন করে না,সন্তানের বায়নার কথাও বিস্মৃত হয়।জায়েদের আকস্মিক এই পরিবর্তন লক্ষ্য না করে অঞ্জলি তখন অন্য বিষয়ে ভাবছিল, জায়েদ কী ওর ওপর জোর খাটাবে? বারো বছরের চেনা কিন্তু পরিবর্তিত জায়েদের সঙ্গে আবার এক বিছানায় ঘুমানো ওর কাছে বিভীষিকা আর দুঃস্বপ্নের ন্যায়।
সারা রাত জায়েদ রকিং চেয়ারে বসে কাটিয়ে দেয় আর অঞ্জলি বিছানার এক প্রান্তে ঘুমের ভান করে ভাবনার নুনজলে ডুবতে ডুবতে রাত পার করতে চায়। খুব ভোরে, পাড়ার মসজিদ থেকে ফজরের আযান শোনা গেলে নি:শব্দ পায়ে জায়েদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় আর কিছুটা প্রত্যাশা নিয়ে অঞ্জলির মনে হয়,আবার;সামনে একটি নতুন দিন আসছে…
অঞ্জলির ধারণাতীত কাজটি করে জায়েদ।ওকে বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত নির্লজ্জ আর গবেটের মতো আচরণই করে জায়েদ। গত কিছু দিনের জায়েদের ক্রমাগত পরিবর্তিত রূপ দেখে অঞ্জলি প্রচণ্ড রকম ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেছে,সেদিন সকালে আবার নতুন ব্যবস্থা দেখে ও ভয়ানক শংকিত বোধ করার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের স্বাধীন সিদ্ধান্তটিও নিয়েছিল নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাড়নায়। লড়াইয়ের ময়দানে সবাই প্রশিক্ষিত যোদ্ধা হয় না, অনেককে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের কৌশল শিখে নিতে হয়।
প্রতিদিন টিনটিনকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অঞ্জলি নিজের কর্মস্থল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। দুপুরে কখনও ড্রাইভার বা বুয়া গিয়ে টিনটিনকে নিয়ে আসে। অন্যদিনের মতো আজও ছেলেকে নিয়ে বেরুবে বলে অঞ্জলি তৈরী হয়ে নিচ্ছিল তখন টিনটিন দৌঁড়ে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে চুমো দিয়ে বলে,মা,আজ বাবা আমাকে স্কুলে দিয়ে আসবে।
তাই!অঞ্জলি কিছুটা অবাক হয়,জায়েদ এসব দায়িত্ব মেয়েলী বলে সব সময় পাশ কাটিয়ে যায়।
তাই মা। বাবা বলেছে তার সাথে গেলে আমাকে ইয়া বড় একটা চকোলেট কিনে দেবে।
বাহ্! খুব ভালো তো!
তাই তোমাকে বাই বাই করতে এসেছি মা।
বাই আমার বাবাটা। আমার টিনটিন ঝিঁঝিঁ পোকাটা। তাড়াতাড়ি যাও, বাবা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
টিনটিন অঞ্জলির গালে ছোট্ট চুমো দিয়ে যেমন এসেছিল তেমনি আবার দৌঁড়ে চলে যায়। অঞ্জলি অফিসের জন্য তৈরী হতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,তখন ও একবারও ভাবতে পারেনি ওর জন্য জায়েদ বাসায় একটি চৌদ্দশ’ বছর পূর্বের আইন জারি করে গেছে। নিজের ঘর থেকে অফিস ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলে ড্রইংরমে শাশুড়ীর মুখোমুখি হতে হয়ওকে,কিছুটা রাশভারি শাশুড়ীর ভুরুতে আগে এমন গিঁট মাঝে মধ্যে দেখা গেলেও কিছু দিন ধরে তা স্থায়ী আবাস গেড়ে বসেছে বলে অঞ্জলির ধারণা। অঞ্জলির সঙ্গে চোখাচোখি হতে তিনি স্বরে বিরক্তি ফুটিয়ে বলেন,তুমি আবার কই যাও? তোমারে জায়েদ কিছু বইলা যায় নাই রেহানা?
সেতো কিছু বলেনি মা,কিসের কথা বলছেন মা?
আজ তোমার অফিসে যাওয়ার দরকার নাই।
কেনো?
জায়েদের সঙ্গে কারা জানি বাসায় আসবে, তোমারেও লাগবে তাই তোমার বাসায় থাকা দরকার। জায়েদ তোমারে অফিসে যাইতে মানা করছে।
মা,ও আমাকে কিছু বলে যায়নি আর চাকরীটা তো আমার। আপনার বা জায়েদের ডিসিশানে তো আমার অফিস চলবে না।
আমার ডিসিশানে তুমি চলবা না তা আমি জানি, তুমি হইলা শিক্ষিত মাইয়া মানুষ। শিক্ষিত হইলে স্বামীর কথার অবাধ্য হইতে হইবো এমনটা কে কইছে? আমার মাইয়াদের শিক্ষা দেই নাই? ওরা কি বেহায়ার মতো চাকরী কইরা বেড়াইতেছে রেহানা? এগুলা হইলো মুরব্বীদের শিক্ষার সুফল আর কুফল, দেখতে হইবো তো কে কেমন শিক্ষা সন্তানদের দিছে,কে কেমন শিক্ষা পাইছে। তোমারে কই, সময় আছে; নেক পথে আসো। এত পাখনায় না উইড়া স্বামীরে মান্য করা শিখো। স্বামী নিষেধ করছে যখন তখন অফিসে যাবা না,ব্যস।
মা,আপনার কথা শেষ হয়ছে? আমাকে বেরুতে হবে,আমার ভার্সিটিতে পরীক্ষার ডিউটি আছে…
রেহানা চুপ করো,আমার সাথে চোপা করবা না। জায়েদ আসুক ওর সঙ্গে তোমার যা বলার বলবা। এখন নিজের ঘরে যাও।
অঞ্জলি শাশুড়ীর কথায় হতভম্ব হয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, ও ভাবতে পারেনি বাসা থেকে বেরুনোর পথে ওকে শাশুড়ীর পাহারা ডিঙ্গাতে হবে কোনো দিন। ও ভাবতে পারেনি স্বামী-শাশুড়ীর হুকুম নিয়ে ওকে বাড়ি থেকে বের হতে হবে একদিন। সংসার ধর্ম মানে কি নারীর বন্দী জীবন!
নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে শাশুড়ী অঞ্জলির উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সোফায় নিজেকে গুঁজে দিয়ে বিরক্তিতে মুখভার করে তসবিহ্’র দানায় আঙুল চালাতে চালাতে বিড়বিড় করে ছেলেকে তিরস্কার করে,ও হইছে একটা বাদাইম্মা পোলা। বউরেও ঠিক মতো শাসন রাখতে পারেনা। প্রথমেই কইছিলাম ঘরের বউরে বাইরে চাকরীতে পাঠানো ঠিক না, কে শোনে কার কথা! শিক্ষিত মাইয়া বিয়া করছে, চাকরী করতে দেওয়া উচিত। এমন চাকরী করে যে খোদা-দ্বীন-দুনিয়া-সংসার সবটাই ভুইলা যাইতে হয়! আমার মেয়েরা যেন পড়া লিখ্যা করে নাই, ওরা সংসার করতেছে না? এমন পাখনা লাগায়া উড়তেছে? প্রথমে বলছিলাম, বাপ দাদা চাচা কী করে ভালো করে জানা দরকার…
শাশুড়ীর কথার এই পর্যন্ত শোনার পর অঞ্জলির দাঁড়িয়ে থাকা বা কথা বলার রুচি হয়না। আগেও বাপ চাচার কাজ নিয়ে শ্বশুড় বাড়িতে অনুযোগের সুর থাকলেও সে কখনো এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কিন্তু গত কয়েকদিনে শাশুড়ীর এই অনুযোগ আগের সব রেকর্ড ক্রশ করে গেছে, আর এই কয় দিনে এইসব শুনতে শুনতে অঞ্জলি হয়ে ওঠেছে অসহিষ্ণু ।
নিজের রুমে ঢুকে অঞ্জলি কিছু সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। গতরাতে জায়েদের ওর কাছে বায়না ধরা (একে অঞ্জলি অযৌক্তিক বায়না ছাড়া আর কী বা বলতে পারে!),সকালে কৌশলে ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার ছলে অঞ্জলিকে বাসা থেকে বেরুতে না দেওয়া বা এখন শাশুড়ীর পাহারাদারের ভূমিকা-সব কিছু ওর কাছে পরিষ্কার হতে থাকেতে,ও’কে বন্দী করা হয়েছে। ওকে বাড়ির বাইরে না যেতে দিবে না ওর। চমৎকার! নিজের তৈরী সংসারে ও বন্দী!
কেন? অঞ্জলি ওর নাস্তিক ছোটচাচাকে দেখতে যায়,তাই? অঞ্জলি ছোটচাচার লেখা বই পড়ে,তাই? অঞ্জলি জায়েদের রাগ ভাঙিয়ে বাসায় ফিরে আসার অনুরোধ করেনি,তাই? অঞ্জলি স্বামীর কথা মেনে চাকরী ছাড়েনি,তাই? অঞ্জলি স্বামীর অকস্মাৎ জেগে ওঠা যৌন কামনায় সাড়া দেয়নি,তাই? সন্তান জন্মদানে চিৎ হয়ে যোনি পেতে না দিয়ে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা জানিয়েছে, তাই? নাকি অঞ্জলি একা পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে কফিশপে বসে কফি খায় বলে? এক সঙ্গে অনেক গুলো “কেন” কিছু সময়ের জন্য ওকে হতচকিত করে তোলে।
সামাজিকতা, লৌকিকতার দায়ে পরে জায়েদ নিজের বর্বর মানসিকতাকে দমন করে অঞ্জলিকে অন্য ভাবে গৃহবন্দীর ফন্দি করেছে, নতুন আর একটি বাচ্চা, সংসারের আরো খুঁটিনাটির চাপে, দৃষ্টিবন্দী করে গৃহবন্দী করবে!স্বৈরাচারী পুরুষত্ব!
আর যদি সে জায়েদের ছকে না হাঁটে? জায়েদ তবে আরও কঠিন হবে,মারধোর করবে? জায়েদ আগেও অনেক বার ওর গায়ে হাত তুলেছে, আবারও তুলবে-তা আর নতুন কী? নাকি আরও ভয়ঙ্কর কিছু…। আরও কিছু কী হতে পারে অঞ্জলির ভেতর চিন্তার স্রোত বাঁধ ভাঙা জলের ধারার মতো তীব্র বেগে ছুটে। জায়েদ আবার ওকে মারধোর করবে তারপর তাবলিগ বা চিল্লার নাম করে বাসা থেকে কয়েক দিনের জন্য গা ঢাকা দিয়ে অঞ্জলিকে বোঝাতে চাইবে ও অনুতপ্ত! যথেষ্ট প্রায়শ্চিত্য হয়েছে মনে হলে বাসায় ফিরে এসে কয়েক দিন সুবোধ বালকটি সেজে থাকবে-হাহ্! জায়েদের অভিনয়ের পাটটি পুরোই অঞ্জলির জানা হয়ে গেছে। জায়েদ ওর গায়ে আবার হাত তুলবে ভাবনাটি ওর নিজের প্রতি এক দলা ঘৃনা ছুঁড়ে দেয়,নিজের প্রতি ঘিনঘিনে অনুভূতির যোগান দেয়, নিজেকেই সে রক্ষা করতে পারে না, কেমন মানুষ সে? জায়েদকে আর কোনো সুযোগ দেয়া যাবে না ওকে অপমান করার,অঞ্জলি নিজের ভাবনাকে দৃঢ় করে।
গতরাতে নারীর ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে বসা জ্বলজ্বলে ভ্রুণটি বেমক্কা ধুম করে লাথি কষায় অঞ্জলিকে, এখনও এত কিসের ভাবনা তোমার!আমি তোমার ভেতর এসেছি,জাগো;আমাকে জন্ম দাও,সে আহ্বানে সাড়া দিতে হতচকিত অঞ্জলি দেরী করেনা,নিজের কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র-ব্যাংককার্ড হ্যাণ্ডব্যাগে ভরে বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলে অঞ্জলি দেখে তখনও শাশুড়ী কপালের মাঝে বিরক্তির ঢিপি নিয়ে তসবিহ্’র দানায় আঙুল বুলিয়ে চলেছেন। অঞ্জলিকে দেখে ঢিপিকে পাহাড় বানিয়ে চোখ তুলে তাকালে অঞ্জলি তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়, তুমি কই যাইতেছো রেহানা? বাস্তবিক অর্থে শাশুড়ীর কণ্ঠে বিরক্তির চেয়ে বিস্ময়ের তীব্রতা এখন।
মা,স্টুডেন্টদের পরীক্ষা চলছে,আমার যাওয়া জরুরী।
তুমি কিন্তু বেশি করতেছো…
শাশুড়ীর গর্জনকে পাত্তা না দিয়ে অঞ্জলি ঝড়ের প্রলয় তাণ্ডব থেকে পালাতে চাওয়া জাহাজের মতো নোঙর ছেঁড়া,সে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। পাঁচতলা থেকে নামার জন্য সে লিফটের অপেক্ষা করে না, ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলে গাড়ির ড্রাইভারের মুখোমুখি হয়ে যায়,ওকে গ্যারাজে দেখে ড্রাইভার বিস্মিত,দ্রুত হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে; স্যার বলছিল আপনি বাইর হবেন না! ম্যাডাম এক্ষুনি গাড়ি বের করছি।
অঞ্জলির মনে পরে, জায়েদের লোক! ও কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেলামেশা সব তথ্য জায়েদকে ড্রাইভারই জানায়, গতকাল সুমনের সঙ্গে মা’র কাছে যাওয়ার কথাও নিশ্চয় এই লোক জানিয়েছে। আর গাড়িটি তো জায়েদের,ওর নয়।
গাড়ি লাগবে না।আমি সিএনজিতে যাচ্ছি। গাড়ি একটু পর বাসায় লাগবে।
কথাটুকু বলে আবারও অঞ্জলি পালায়, খুব দ্রুত ও এই বাসা থেকে দূরে যেতে চায়। ওর মনে হয়,যে কোনো মুহূর্তে জায়েদ এসে ওর সামনে দাঁড়াবে আর নিজের অপছন্দের কোনো কাজকে সে সহ্য করবে না। লোক লজ্জার দ্বিধা কেটে গেলে অঞ্জলিকে আটকানোর প্রয়োজনে যতটা নির্লজ্জ হওয়া যায়,ততটুকু বেহায়া হয়ে উঠতে জায়েদ বিন্দু পরিমান কুণ্ঠিত হবে না।
রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো সিএনজি’তে ওঠে বসে অঞ্জলি বিভ্রান্ত-কোথায় যাবে ও? সিএনজিওয়ালা গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে জানতে চায়,আপা কই যাবেন?
পরীক্ষার ডিউটি শেষ করে করিডোরে বেরিয়ে অঞ্জলি মোবাইল বের করে,এখন টিনটিনের বাসায় ফিরে আসার সময়;বাসার ল্যাণ্ডফোনে ফোন করে ও; টিনটিনই ধরে।
বাবাটা গোসল করেছো?
করেছি মা।
কিছু খেয়েছো?
ময়না খালা লাঞ্চ করিয়ে দিয়েছে তো।
শোনো বাবা সোনাটা,মা কয়েক দিন বাসায় ফিরবো না…
কেনো মা?
কাজের জন্য বাইরে যেতে হবে।
যেমন বাবা যায়?
হুম।অনেকটা তাই।
ওকে। আসার সময় আমার জন্য একটা কার্টুন বুক এনো।
আনবো। আর শোনো, খুব বেশি দুষ্টামী করো না বাবাটা। দাদীকে বিরক্ত করো না।
দাদী তো সব সময় বিরক্ত হয় মা। আজ অনেক বিরক্ত হয়ে আছে।
তাই। থাকুক। তুমি বিরক্ত করো না দাদীকে।
আচ্ছা করবো না।
এখন মা ফোন রাখছি,বাই।
বাই বাই মা।
টিনটিনের সঙ্গে কথা বলার পর অঞ্জলির নিজেকে কিছুটা ভারমুক্ত লাগে। সকাল থেকে ওর ওপর দিয়ে ভয়ানক এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে,ঝড়ের এই হঠাৎ আক্রমণের জন্য ও প্রস্তুত ছিল না,আবার কখনও ভাবেনি এভাবে ওকে সংসার নামক বাসা থেকে মুহূর্তের সিদ্ধান্তে বেরিয়ে আসতে হবে। হ্যাঁ,বেরিয়েই এসেছে ও,একবার যখন জায়েদের প্রাচীন হুকুমের অবাধ্য হয়ে,শাশুড়ীর পাহারাকে উপেক্ষা করে বাসা থেকে বেরিয়েছে তখন ও বাসায় আর ফিরে যাওয়া নয়। আর ফিরে যাওয়া কার কাছে? শুধু একটি বাসায় ফেরা! নিজের নিরাপত্তার নাম করে চার দেয়ালের গণ্ডির মাঝে স্বেচ্চায় বন্দী হওয়া! টিনটিনের জন্য খারাপ লাগবে, টিনটিনও বেশি দিন মা’কে ছাড়া থাকতে চাইবে না,তারপরও অঞ্জলিকে কঠিন একটি ডিসিশন নিতে হচ্ছে, নিজেকে জায়েদের কাছ থেকে মুক্ত করার জন্য,নিজের স্বাধীনতার জন্য। নিজের অধিকার,নিজের স্বাধীনতা নিজের আত্ম সম্মান ও যদি অর্জন করতে পারে তখন নিশ্চয় টিনটিনকে ও নিজের কাছে পাবে। টিনটিনকে একজন বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন মানবিক আর সচেতন শুদ্ধ মানুষ করতে পারবে আর ওর যদি নিজেরই কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতা বা আত্ম সম্মান না থাকে তবে ও আর সন্তানের জন্য কতটা কী করতে পারবে!সন্তানের টানে জায়েদের সংসারে ফিরে গিয়ে শুধু সন্তানকে দুধ-ভাতই খাওয়ানো হবে জীবন ভর, একজন মানবিক শুদ্ধ মানুষ হতে সন্তানকে সাহায্য করা হবে না।
এইসব এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে নিজের অফিস রুমের দিকে যাচ্ছিল অঞ্জলি করিডোরে ওকে ম্যানেজম্যান্টের আফসানা ম্যাডাম থামালো, জানো খবর কিছু?
কিসের খবর?
ইফফাত ম্যাডামের?
না। কেন,কী করেছেন তিনি?
সুইসাইড করেছেন…
এমন উত্তর ধারণাতীত ছিল অঞ্জলির, সে হতভম্ব হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য; মানে! কবে? দু’তিন দিন আগে দেখা হলো…
আমার সঙ্গেও দু’দিন আগে দেখা হয়েছিল। সম্ভবত সেদিনই শেষবার ভার্সিটিতে এসেছিলেন,বেশ হাসি-খুশী ছিলেন; কথায় কথায় হাসছিলেন। আসলে বাইরে থেকে কারো কিছু বোঝা যায় না। হাসব্যাণ্ডের সঙ্গে সেপারেশনে ছিলেন বেশ কিছু দিন ধরে,মাত্র কিছু দিন আগে ডিভোর্সও ফাইনাল হয়ে গেলে হাসব্যাণ্ড আর একটি বিয়েও করে নিয়েছে। ইফফাত ম্যাডাম তা সহ্য করতে পারেনি তাই পরশু রাতেই ঘুমের ঔষুধ খেয়ে…একা থাকতো তো; কেউ জানেনা। আজ সকালে কে যেন ওর বাসায় গিয়ে দেখে কেউ দরজা খুলছে না, পরে পুলিশ এসে দরজা ভেঙলে পরে জানা গেল।
হাসব্যাণ্ডের সঙ্গে উনার তো ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল,তারপর সে হাসব্যাণ্ড আর একটা বিয়ে করলে উনি সুইসাইড করবেন কেনো!
আরে বুঝনা, সেপারেশনের পর থেকে পারিবারিক আর সামাজিক চাপ চলছিল ইফফাতের ওপর। সবাই বলছিলো মেয়েদের মানিয়ে নিতে হয়,সবাই চাইছিল ও আপোষ করে নিক। কিন্তু নিজের ইগোর কারণে ইফফাত স্বামীর সঙ্গে অ্যাণ্ডারস্যাটান্ডিং-এ যেতে পারছিল না। এতদিন ইফফাত হয়ত মনে মনে ভেবেছিল হাসব্যাণ্ডের সঙ্গে কোনো এক সময় মিল হয়ে যাবে কিন্তু হাসব্যাণ্ড বিয়ে করে ফেলায় সে আশা আর থাকলো না। সবাই ইফফাতের অতিরিক্ত স্বাধীন মনোভাবকে ইঙ্গিত করছিল, সংসার ভাঙার পুরা ক্রেডিট ওর ওপর পরায় বিষয়টা মেনে নিতে পারে নাই। নিজের বিয়ে ভাঙার জন্য ইফফাত আত্মহত্যা করে নাই বুঝলে? স্বামীর বাধ্য স্ত্রী হয়ে থাকেনি বলে সবাই মিলে ওকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করছে।
একজন মানুষের স্বাধীন মনোভাব থাকতে পারে।নিজের স্বাধীনতা চাওয়া তো কোনো অন্যায় আব্দার নয়!সংসার তো একজনের এডজাস্ট করার জায়গা না, দু’জনকে এডজাস্ট করতে হয়,তাই না? দুইজনের এডজাস্টমেন্টের অভাবে সংসার ভাঙলে শুধু মেয়েটাকে দোষ দিতে হবে!তার সঙ্গী পুরুষটিকে কেন নয়?
এগুলো প্রশ্ন তুলে লাভ আছে? এটাই তো সমাজের নিয়ম। এডজাস্ট নারীদের করতে হয়। আজ যদি আমার বা তোমার সংসার ভাঙে দোষ কিন্তু আমাদেরই ধরবে,বলবে;এতো ভালো স্বামীর সংসার করতে পারলো না। কেউ কিন্তু খোঁজ নিবে না, আমার স্বামী আমারে কী ভাবে এ্যাবিউজ করে। আর স্বামী যদি এ্যাবিউজ করেও সবাই বলবে, স্বামী হিসাবে এটা করা তার রাইট আছে,বুঝলা অঞ্জলি বিবি? পুরুষের নিয়মে গড়া সমাজ পুরুষের কথা বলবে না তা কেমনে হয়? যাই হোক, ইফফাতের খবরটা শুনে খারাপ লাগছে। আমাদের সমাজ এমন একটা জায়গা, এখানে কোনো মহিলা নিজের সংসারের অশান্তির কথা কারো সাথে শেয়ার করতে পারেনা। কারো সাথে শেয়ার করলো তো সবাই ধারণা করে নিবে, মহিলার দোষ; এডজাস্ট করতে পারেনা। বুঝলে, পড়াশোনা,ধর্ম-কর্ম শালীনতার সঙ্গে সঙ্গে এডজাস্ট করতে শেখাটাও মহিলাদের গুনের মধ্যে পরে। অন্যের চাহিদা মতো চলতে গিয়ে নারী জীবনের ক্ষয় হয়…আফসানা ম্যাডামের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। সে হাসির একটি বিষণ্ন শব্দ অঞ্জলির কানে ধাক্কা দেয়,এক সময় ওর মনে হয়;হাসির শব্দের বদলে আফসানা ম্যাডামের গলা দিয়ে কান্নার হেঁচকি ওঠে আসছে।
নারীকে নারীর সীমাবদ্ধ বোঝানো হয়েছে,নারীর স্বাধীনতার পরিধিও জানানো হয়েছে। মানুষের নিজের স্বাধীনতা,মুক্ত জীবন ভোগ করার অধিকার রয়েছে, নারীরও রয়েছে;নারী কোনো বস্তু নয়; সে একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তারপরও নারী কেন নিজের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে পারে না! নারীর রক্ত থেকে অধিকার আদায়ের রক্ত কণিকাগুলো ভ্রুন থাকার সময় বিভিন্ন সামাজিকতা,লৌকিকতা আর ধর্মের কাঠগড়ায় আটক করা হয়। বিভিন্ন বাঁধা নিষেধের শৃঙ্খল পরিয়ে নারীর বিচরণের গণ্ডির সীমাবদ্ধতা জানিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও দু’একজন নারী মাঝে মাঝে জেগে উঠে নিজেদের অধিকার নিয়ে বলতে চায়,সমাজ তখন তাকে কোণঠাসা করে পুণরায় গর্তে ফেরত পাঠাতে ব্যস্ত হয় যায়,সাইরেন বাজিয়ে জানিয়ে দেয়, বেশি উড়ো না।
দশ:
অঞ্জলি বেপরোয়া,ক্ষিপ্র পায়ে লিফট থেকে নেমে সুমনের মুখোমুখি হয়। সুমন দরজায় ওর জন্য অপেক্ষা করছিল,ইন্টারকমে এ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ড অঞ্জলির আসার খবর আগে জানিয়েছিল,অঞ্জলি ম্যাডাম এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে। হঠাৎ করে এতো রাতে অঞ্জলির আসায় সুমন অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে দ্বিধাহিন কণ্ঠে বলেছিল, পাঠিয়ে দিন।যেন ও অঞ্জলির আসার অপেক্ষায় আছে এমনি ভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,এসো…
অঞ্জলির চোখের দৃষ্টিতে অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগ। নিজের উপস্থিতি নিয়ে অস্বাচ্ছন্দ্য,প্রবল মানসিক চাপে ঘনঘন নি:শ্বাস ফেলছে; দরজায় দাঁড়িয়ে তড়বড় করে সে সুমনকে বলে,আজ রাতটা তোমার বাসায় থাকতে দেবে?
সুমন অঞ্জলির কথায় বিস্মিত হলেও তা প্রকাশ না করে বলে,আগে তো ঘরে আসো…
ঘরে ঢুকে অঞ্জলি লিভিং রুমের সোফায় নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ঝপ্ করে বসে পরে। একবার সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে বলে,আমি সংসার ছেড়ে চলে এসেছি সুমন।একেবারে…আর ফিরতে চাই না ওখানে।
আমি সব শুনবো অঞ্জলি।আগে তোমাকে এক গ্লাস জল দেই?
সুমন ফ্রিজ থেকে এক বোতল ঠাণ্ডা পানি আর একটি গ্লাস নিয়ে এসে নিজেই গ্লাসে জল ঢেলে অঞ্জলির দিকে এগিয়ে দেয়।পর পর দু’গ্লাস জল খাওয়ার পর খানিক ধাতস্ত হওয়ার পর অঞ্জলির মনে হয়,সকালের নাস্তার পর আর কিছুই খাওয়া হয়নি সারাদিনে। সাধারণত,বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য দিন অনেক কিছু খাওয়া হলেও আজ নিজের ভেতরের অস্থিরতা আর ইফফাত ম্যাডামের আত্মহত্যা-সব কিছু মিলিয়ে ক্ষুদাবোধটা হারিয়ে গিয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে ছোটচাচাকে দেখার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিল অঞ্জলি।ছোটচাচা ঘুমাচ্ছিল,চাচীর সঙ্গে অল্প সময় কথা বলে বেরিয়ে এসেছিল ও। চাচীকে নিজের ব্যাপারে কিছুই বলেনি,এমনিতে তিনি সব কিছু নিয়ে এমন নাজেহাল; নিজের বাসায় পর্যন্ত থাকতে পারছেন না; তাকে আর কী বলবে! হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অঞ্জলি সব চেয়ে কঠিন প্রশ্নটি নিজেকে করেছিল,এখন কই যাওয়া যায়? ঢাকা শহর মেয়েদের জন্য এতোই অনিরাপদ চাইলে কোনো মেয়ে কারো আশ্রয় ছাড়া কোথাও রাত্রি যাপন করতে পারে না। আজ সে নিজে নিরাশ্রয় হওয়ার পর খেয়াল করলো, রাত্রি যাপন করার মতো ওরও কোনো আশ্রয় বা স্বজন এই শহরে নেই! প্রথমে মা’র কাছে যাওয়া যাওয়ার ভাবনা মাথায় এলেও তা পর মূহুর্তে নাকচ করে দেয়,জানা কথা; জায়েদ প্রথমে গাজীপুরে ওর খোঁজ করবে। নিজের জন্য মা’কে বিব্রত করতে ইচ্ছে করে না। মা কী চমৎকার নিজের একটি জগৎ তৈরী করে নিয়েছে, থাকুক না নিজের মতো করে। ও’কে না পেলেও জায়েদ মা’কে কটু কথা শোনাতে ছাড়বে না, কিন্তু মা নিজের সামনে অঞ্জলিকে অপমানিত হতে দেখলে বেশি কষ্ট পাবে।মা’কে কষ্ট পেতে দিতে মন সায় দেয় না,তাই ও শেষ পর্যন্ত মা’র কাছে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গন্তব্যহীন ভাবে অঞ্জলি দীর্ঘদিন পর একাকী অনেকটা সময় পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে থাকে। সামনের চত্বরে হেমন্তের বইমেলা চলছে,বেশ আলো জ্বলমলে আর মানুষজনর আলাপচারিতায় পরিবেশটা গমগম করছিল প্রথম দিকে। ধীরে ধীরে স্টলগুলো বন্ধ হতে থাকে,মানুষজন কমে আসে;অনিরাপত্তার ভীতি হামাগুড়ি দিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসে। হেমন্তের রাতের হাওয়া শীতল হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অঞ্জলিকে আতঙ্কের শীতল অনুভূতি আকড়ে ধরে,আজ রাতের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় দরকার-ভাবতে ভাবতে অঞ্জলি বেরিয়ে আসে লাইব্রেরির চত্বর থেকে।
সামনে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। মঞ্চটি এখন আকারে ছোট,যেন; রাস্তার ধারে কিছু মানুষের মিলনমেলা মাত্র। অথচ এটি এক সময় কী বিশাল জনস্রোত হয়ে উঠেছিল! যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ আর একবার এক হয়েছিল শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে। অঞ্জলির তখন আসা হয়নি,টিভিতে দেখেছে,পত্রিকায় পড়েছে সব চেয়ে বড় কথা মানুষের মুখে মুখে গণজাগরণ মঞ্ঝের বিস্ফোরণের কথা উচ্চারিত হয়েছিল। একটি দেশের তরুণ প্রজন্ম,দেশের খুব সাধারণ মানুষের মিলিত ইচ্ছা শক্তি কতটা শক্তিধর হয়ে উঠতে পারে তারই জ্বলন্ত প্রমাণ এই গণজাগরণ মঞ্চ! ১৯৭১-এ এই দেশের মানুষের আন্তরিকতা-ভালবাসার মিলিত শক্তির স্বরূপ আজকের বাংলাদেশ!
অঞ্জলির সে সময় জায়েদের অস্থিরতা আর রাগে তামাটে হয়ে ওঠা মুখের প্রকাশও মনে পরে। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী আর সহযাত্রীদের জন্য কতটা ক্ষিস্তি উগরেছিল সে!আর সে নিজে কী করে এই জায়েদকে এতোটা বছর সহ্য করে এসেছে বিন্দু পরিমাণ ঘৃণা ছাড়া?
আচমকা আসা এইসব ভাবনায় অঞ্জলি আবেগে তিরতির করে কেঁপে ওঠে। ওর ভীষণ করে বাবার কথা মনে হয়,ছোটচাচার কথা মনে হয়। রাতের ঢাকার পথে একাকী হাঁটতে হাঁটতে নীরবে ওর চোখের কোল ভিজে ওঠে।
সুমন অঞ্জলির মুখের দিকে তাকিয়ে মুখোমুখি বসে আছে। ও বুঝতে পারছে অঞ্জলির ভেতরে ঝড় চলছে, সে কোনো প্রশ্ন না করে ঝড় থামার অপেক্ষা করে।
জায়েদের সঙ্গে অনেকটা সময় এক সঙ্গে কাটানো হলো। কিন্তু কিছু দিন ধরে, চাচ্চুর একসিডেন্টের পর থেকে, ও আমার সামনে উন্মোচিত হতে লাগলো। আমার মনে হলো, এই জায়েদকে আমি চিনি না। আগেও,মাঝে মধ্যে ও আমাকে শারিরীক নির্যাতন করতো, পরে আবার সরি টরি বলে…আমি ভাবতাম এটাই হয়ত সংসারের ধর্ম। কিন্তু চাচ্চুর এক্সিডেন্টের পর,আমার আর আমার পরিবারের প্রতি ওর যে ভয়াবহ ঘৃণা দেখেছি, সে ঘৃণা সহ্য করার শক্তি আমার নেই। সহ্য শক্তি নেই বলে আমি আর ওকে সহ্য করতে পারছিলাম না। ওর ভাবনা, মানুষিকতা…
অঞ্জলি,তুমি বরং ফ্রেস হও। তারপর তুমি চাইলে তোমার কথা বলতে পারো আমাকে,না চাইলে বলো না;সেটা তোমার ইচ্ছে। তুমি আমার বন্ধু, আমার কাছে তোমার কোনো এক্সকিউজ করতে হবে না।
তারপরও সুমন তোমার জানা দরকার।
অবশ্যই জানবো। আগে ফ্রেস হও, তোমাকে অনেক টায়ার্ড দেখাচ্ছে।
সুমনের কথায় সারা দিনের এতটা মানসিক উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তার শেষে এখন হঠাৎ করে অঞ্জলির এক রাশ ক্লান্তি অনুভব করে।ও হেসে বলে,খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
সেলফোনটি বেজে চলছিল,ঘুমের গভীর থেকে সে আওয়াজ ক্রমাগত অঞ্জলির কানে পৌঁছালেও ও কিছুতে নিজেকে জাগিয়ে তুলতে পারছিল না। ঘুমের অবশ করা আমেজে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে পেরেছে অনেক দিন পর, অনেক দিন পর এমন অকাতরে ও ঘুমাচ্ছে, নিশ্চিন্তে। অথচ, কাল রাতে এখানে হুট করে চলে আসার আগ পর্যন্ত অঞ্জলি জানত না ও কোথায় যাবে। সিএনজিতে ওঠে বসার আগ মুহূর্তেও অঞ্জলি নিকেতন আসার কথা ভাবেনি, গতকাল সারা দিনে একবারও সুমনের কথা মনে হয়নি। সুমনের ফ্ল্যাটে আসার পর মনে হলো,ও বুঝি সত্যি কোনো বন্ধুর সন্নিকটে এসেছে, যে ওর জন্য দুয়ার খুলে অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু সুমনকে কতটা সন্দেহের চোখে ও দেখেছিল চব্বিশ ঘন্টা আগে! কী এক কারণে জায়েদ সুমন সম্পর্কে ওকে বাজে এক ধারণা দিয়েছিল! গতকাল রাতে সে সুমনের একা ফ্ল্যাটে এসে ওঠার পরও নিজেকে এতটুকু অরক্ষিত বা নিরাপত্তাহীন মনে হয়নি। সুমনের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার উপায়হীন অঞ্জলিকে নিজের ভেতরের শক্তিটুকু ফিরে পেতে সাহায্য করেছিল।
রাতের খাবার ছিল খুব সাধারণ, সুমন রেঁধেছিল; রাইস কুকারের সব্জী খিচুড়ী আর ডিম ভাজি। গোগ্রাসে খেয়ে নিয়েছিল অঞ্জলি। একটি টলায়মান দিনে শেষে চোখে আদৌ ঘুম আসবে কি না ও যখন ভাবছিল তখন এক রাজ্য ঘুম ওকে চেপে ধরেছিল। সুমনের ফ্ল্যাটের গেস্টরুমের পরিপাটি বিছানায় বিস্ময়কর এক নিশ্চয়তায় ঘুমিয়ে পরেছিল ও।
সেলফোন এক নাগাড়ে বেজে চলছে, কেনো ও কাল ঘুমতে যাওয়ার আগে সু্ইচ অফ করে রাখা ফোনের সু্ইচ অন করলো? হ্যাঁ, মা’কে ফোন করবে ভেবেছিল, পরে মনে হয়েছিল; মা অনেক গুলো ঔষুধ খেয়ে রাতে ঘুমাতে যান; ঘুমিয়ে পরলে অনেক রাতে তার ঘুম না ভাঙানো ভালো; এসব ভেবে আর ফোন করা হয়নি। ঘুমের ভেতর মা’র কথা মনে হওয়ায় তড়িৎ গতিতে জেগে ওঠে ও, হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিল থেকে ফোনটি তুলে দেখে মা’ই ফোন করেছে। ভোর ছয়টা, এত ভোরে মা’র ফোন মানে গড়বড় হয়েছে, ভাবতে ভাবতে অঞ্জলি ফোন অন করে; হ্যালো মা…
তুই কেমন আছিস অঞ্জু? মা’র গলায় এক রাশ উদ্বেগ।
ভালো মা।
নিরাপদে আছিস তো মা?
হ্যাঁ মা। অনেক দিন পর ভালো ঘুমিয়েছি। তুমি কেমন আছো?
একক্ষণ অস্থিরতায় কেটেছে। এখন তোর কথা শুনে ভালো লাগছে। মা ফোনের ওপারে হাঁফ ছাড়েন।
আমাকে নিয়ে খুব ভেবো না। আমাকে কিছু দিন আমার মতো থাকতে দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে মা।
অঞ্জু, আমি তোর পাশে আছি সব সময়। তোর যা ভালো মনে হয় তাই কর। নিজের মতো বাঁচ। শুধু আমাকে এটুকু জানাস, তুই ভালো আছিস।
মা’র কথা শুনে অঞ্জলির মন আনন্দে ভরে যায়। মা কী চমৎকার দৃঢ় কণ্ঠে গুছিয়ে কথা বলছেন। অথচ জায়েদের ঘর ছেড়ে এসে অঞ্জলি এখনও ভীত সন্ত্রস্ত। জায়েদ ফোন করে বকাঝকা করবে এই ভয়ে ও ফোনের সুইচ অফ করে রেখেছে,পালিয়ে আছে কাকের মতো নিজের মুখ লুকিয়ে!নিজের দুর্বলতা আর একবার ওকে কটাক্ষ করে।
মা বলে, টিনটিনের জন্য কী করবি?
মা,আমি নিজেকে আগে গুছিয়ে নিই,আমার নিজের অস্তিত্বই যদি রক্ষা না করতে পারি তবে আর টিনটিনের জন্য কী করবো! ওর জন্য পরে ভাববো। আর ওটা টিনটিনের বাবার বাড়ি, ওখানে ওর অযত্ন হবে না। ওখানে টিনটিন ওর বাবা’র আদর্শে গড়ে উঠবে, এটাতেই আমার যতো ভয়। আমি নিজেকে আগে গুছিয়ে নেই মা তারপর…আমার জন্য ওর মন খারাপ করবে খুব।
জানি রে। তোরও তো মন খারাপ করবে টিনটিনের জন্য।
হুম তা করবে। যেমন তোমার করে আমার আর আপুর জন্য।
অঞ্জলির কথায় ফোনের অপর প্রান্তে মা হেসে ওঠেন, আনন্দিত কণ্ঠের রিনিঝিনি হাসি। হাসির ভেতর দিয়ে অঞ্জলি আবার মা’কে নতুন করে আবিষ্কার করে, কই আগে তো মা’র এমন ঝংকার তোলা হাসি কখনও শুনেছে বলে ওর মনে পরে না! মা কী দারুণ বদলে গেছে নিজের একটা জগৎ পেয়ে। মা’র জন্য ওর গর্ব হয়।