সমসাময়িকতা কবিতার অনিবার্য পাটাতন আর সমসাময়িককালের সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবন বাস্তবতা হলো মননের ভ্রূণ

প্রশ্নোত্তর: শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কিভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন? আলী সিদ্দিকী: কৈশোরে দেখা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান (ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো, বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো; পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা; রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়, ইত্যাদি) আমাকে উদ্বেলিত করতো। আবার কিছুদিন পর রক্ষীবাহিনীর হাতে বড়ভাইয়ের অনেক বন্ধুকে নির্যাতিত নিগৃহীত হতে দেখেছি। তখন তাদের লেখা পোস্টার, দেয়াল লিখন দেখেছি। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ নিয়ে পোস্টার দেখেছি। প্রতিবাদের ভাষা ছন্দোবদ্ধ, কাব্যময়। এলাকার কিছু বড়ভাইদের পুঁথি শুনিয়ে কিছু পয়সা পেতাম। পুঁথিগুলো সুর করে দুলে দুলে পড়তে হতো। সুরেলা, ছন্দোময় শব্দগুলো আমাকে মুগ্ধ করতো, তীব্র আকর্ষণ বোধ করতাম। জামাল চৌধুরী ছিলেন বড় ভাইয়ের বন্ধু। তিনি একটা লিটল ম্যাগাজিন করতেন। তিনি আমাকে কবিতার বই পড়তে দিতেন। তখন আমি সুকান্ত পড়ি, সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়ি, নজরুলের বিদ্রোহী পড়ি (বুঝিনি কিছুই)। এভাবে শব্দ, ছন্দ, কবিতা আমার ভেতর একটি নতুন অনুভূতির জন্ম দেয়। আমি একদিন লিখে ফেলি প্রথম ছড়া ‘টিকটিকি।‘ জামাল ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় সেটি দৈনিক আজাদী পত্রিকার শিশু সাহিত্যপাতা “আগামীদের আসর”-এ পাঠিয়ে দিই এবং কিছুদিন পর সেটি ছাপা হলো। প্রথম লেখা ছাপা হওয়ার সুতীব্র আনন্দবোধ আমাকে আরো আরো লেখার জন্য তাগিদ দিতে লাগলো। আমি বই ও খাতামুখী হয়ে গেলাম। কৈশরোত্তীর্ণ মননে কাব্যিক অনুভূতি এভাবেই জীবনের অংশ হয়ে যায়।   শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষা শৈলীর বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে জানতে আগ্রহী। আলী সিদ্দিকী: প্রথম প্রশ্নের উত্তরের ভেতর আমার রাজনৈতিক বোধের উন্মীলনের একটি রেখাচিত্র পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড, জিয়ার ক্ষমতা দখল, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন, জিয়ার হত্যাকান্ড এবং এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রেক্ষাপট বুকে নিয়ে আমার পথপরিক্রমা। মুক্তচেতনা, মুক্তিযুদ্ধ ও মানবিক মুক্তির আকাঙ্খার বোধন আমার মননের বীজতলায় পরিণত হয়। আমরা প্রত্যেকেই সমকালের বাসিন্দা। সমসাময়িকতা কবিতার অনিবার্য পাটাতন আর সমসাময়িককালের সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবন বাস্তবতা হলো মননের ভ্রূণ। আমরা যে বিশ্বব্যবস্থার বাসিন্দা-কবিতার সময়চেতনা থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন রাখার কোন উপায় নেই। বিদ্যমান সমাজের অসংগতি, অব্যবস্থা, ক্ষরণ ও নৃশংসতা থেকে কবিতা মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারে না।